তোমাকে নিয়েই গল্প পর্ব-১৯

0
1045

#তোমাকে_নিয়েই_গল্প
#পর্ব:১৯
#জুনাইনাহ_তাসনিম_অরহা

আপুর হাতে মেহেদি লাগানো শেষ।এবার আমরা নিজেদের হাতে মেহেদি লাগাচ্ছি।হাত ভর্তি করে আমিও মেহেদি লাগিয়ে নিলাম।আমার বরাবর হাত ভরে মেহেদি লাগাতে ভালো লাগে।আপুর বিয়েতে তাই সুযোগটা মিস করলাম না।সবাই প্রায় মেহেদি লাগায়ছে হাতে।রাতও হয়ে এসেছে।সবাই খেতে গেছে তাই।আমি আর মারিয়া একা একা প্যান্ডেলে হাতে মেহেদি নিয়ে বসে আছি।হাত না শুকালে তো খেতেও পারবো না।সবার শেষে মেহেদি পরার এই এক জ্বালা,এবার বসে থাকা লাগবে।আমি আর মারিয়া দুজন একে অপরের ডিজাইন দেখছিলাম তখন অভ্র ভাই এসে আমাদের থেকে কিছুটা দুরে একটা চেয়ার নিয়ে বসে।হাতে গরম গরম মোরগ পোলাও।এত্তো সুন্দর স্মেল যে আমার ক্ষুদা ডাবল হয়ে গেলো।উনি তো সেই মজা করে খাচ্ছেন।
–উউম,রান্নাটা যা হয়েছে না!আমি তো আজ ৩-৪ প্লেট খেয়ে নেবো।মাংস,ভাত সব কিছুই একদম পারফেক্ট রান্না হয়েছে।উউউম…
উনি খেতে খেতে ওরকম মজা মজা করছিলেন।ওনার কথা শুনে আমার আর মারিয়ার মুখে পানি চলে এসেছে।ধোয়া ওঠা গরম মোরগ পোলাও আর ওত্তো সুন্দর স্মেল।টেস্টটাও যে অনেক মজা তা বুঝতে বাকি নেই আর আমাদের।মারিয়া তো লোভ সামলাতে না পেরে উঠে চলে যায়।আর আমি ওনার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলাম।উনি খেতে খেতে সেটা লক্ষ্য করেন।তারপর চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলেন,

–কি ব্যাপার?? আমার খাবারে চোখ দিচ্ছো কেন??আমার তো পেট খারাপ করবে।

–চোখ দিলাম কখন আবার?আর আপনার খাবারে চোখ দিতে যাবো কেন আমরা?(আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বলি)

–মিথ্যা বলবা না।আমি স্পষ্ট দেখেছি।

–ভুল দেখেছেন আমি চোখ দেইনি।

–মিথ্যা বলছো তুমি।মিথ্যাবাদি,মিথ্যাবাদি।সূচী একটা মিথ্যাবাদি।(উনি প্লেট রেখে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে বলেন)

–বললাম না আমি চোখ দিইনি।কতোবার বলা লাগে এক কথা?(আমিও উঠে দাড়ালাম)

–তোমার যে ক্ষুদা পায়ছে তা ভালোমতোই বোঝা যাচ্ছে।হাহাহাহ…

–আমার ক্ষুদা…ধুর আপনার সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই।সরেন তো…

আমি ওখান থেকে চলে আসতে যাই।কিন্তু আমার কপাল এতোটাই খারাপ যে ইটে বেধে ব্যালেন্স হারিয়ে মাটিতে পড়তে যাচ্ছিলাম।পড়ে গেলেও ভালো হতো অন্তত উনি আমাকে বাঁচাতে তো আর আসতো না।আর ওনার সাদা পাঞ্জাবিতে আমার হাতের ছাপ ও বসতো না।

ফ্লাসব্যাক:-
–আমার ক্ষুদা…ধুর আপনার সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই।সরেন তো…
কথাটা বলেই যেই এক পা বাড়াইছি আর পায়ের নিচে পড়েছে এক ইট।জুতাটা একটু উচু থাকাই খুন সহজেই তাই ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলি।আমি তো ভাবলাম নিচেই পড়বো হয়তো আর আমার পা টাও যাবে ভেঙে।কিন্তু উনি সাইডে থাকাই কি মনে করে যে ওনাকে ধরতে গেলাম।উনিও আমাকে বাঁচাতে এসে ওনার হাত দুটো গেলো আমার কোমরে আর আমার হাত দুটো ওনার বুকে।মেহেদি ভরা হাতটা ওনার বুকে স্ট্যাম্পের মতো বসে গেলো।সাদা পাঞ্জাবিতে মেহেদি পরা দুই হাতের ছাপ।

বর্তমান:-
উনি তো আমার দিকে তাকিয়ে রাগে গজ গজ করছেন।আর আমি তো এদিকে ভয়ে বারবার ঢোক গিলছি।ওনার যে রাগ তা তো ভালো মতোই জানা আছে আমার।কি যে করবেনে এখন আল্লাহই ভালো জানেন।আমি খুব নরম সূরে বলি,
–আমি ইচ্ছা করে করিনি।আপনিই তো আমাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে আসলেন।আপনি যদি আমাকে না ধরতেন তাহলে আর এরকম কিছু হতো না।
–…………….(উনি রাগে ফুসছে কিন্তু কোন কথা নেই)
–আমি সত্যিই ইচ্ছা করে করিনি।সত্যি(এবার একটু কাঁদো কাঁদো গলাই বলি)
–রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে ছাদে আসবে।
–কেন??(আমি খুব কৌতুহল নিয়ে বলি)
–পাঞ্জাবিটা কি তোমার বর কেচে দেবে??
–মানে??(নাক শিটকিয়ে)
–আমার নতুন পাঞ্জাবিটা যে মেহেদি লাগিয়ে দিলে এটা কাচবে কে শুনি?
–কিন্তু তার জন্যে রাতে কেন??আর ছাদেই বা কেন?
–আমি বলছি তাই।আর শোন যদি না আসো আমি কিন্তু সবাইকে বলে দেবো যে তুমি ইচ্ছা করে আমার গায়ের ওপরে ঢুলে পড়েছো বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে।আর কোন মেয়ে কেন কোন ইয়াং ছেলের উপরে পড়ে সেটা বুঝার মতো বুদ্ধি আশা করি তোমার আছে।হ্যা তুমি হয়তো সবাইকে এটা বলবে যে তুমি ইচ্ছা করে করোনি কিন্তু এই ব্যাপারগুলো কিন্তু এতো সহজে মানুষ মানে না।আর যদি একবার তোমাকে অবিশ্বাস করে তারপর কি হবে সেটা নিজেই ভাবো…
–কি?
–জিইইই।এবার তুমিই ভাবো কি করবে।আমি যাই।টাটা….
(সবাইকে এই কথা বললে তো সবাই খারাপ ভাববে আমাকে।যদি সত্যিই কেউ বিশ্বাস না করে তখন?যদি সত্যিই ভাবে আমি এগুলো ইচ্ছা করেছি,ওনার কাছে যাওয়া জন্যে।ছি,ছি তা কি করে হয়?না না কিছুতেই এগুলো বাড়ির কাউকে জানতে দেয়া যাবে না।সাদা বাদরটার কথায় মেনে নিতে হবে–মনে মনে ভাবলাম)
–ঠিক আছে আমি যাবো।মেনে নিলাম আপনার সব কথা।কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।কাউকে কিছু জানাতে পারবেন না এ ব্যাপারে।
–ওকে।কিন্তু একা আসবে।
–কেন?একা যাবো কেন?এরকম তো কোন কথা তো ছিলো না?
–আমি বলেছি তাই।বেশি কথা বললে কিন্তু আমি এক্ষুনি যাচ্ছি সবাইকে এসব দেখাতে।
–এই না না।প্লিজ যাবেন না।আমি একাই।যাবো।
–এই তো গুড গার্ল।

উনি চলে যায় আর আমি ধপ করে স্টেজে বসে পড়ি।

*রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যার যার রুমে চলে গেছে।আজ খাটাখাটনি গেছে এমনিতেই আবার সকাল হলেই তো আপু আর আকাশ ভাইয়ের হলুদ ছোয়ানো হবে।যদিও আলাদা আলাদা ভাবে।মারিয়া বসে বসে কালকে সকালে পড়ার শাড়ি ইস্ত্রি করছে।এদিকে আমি তো ভয়ে আছি,অভ্র ভাই দেখা করতে বলেছে।কি যে বলবে আল্লাহই ভালো জানেন।মারিয়াকে তো ব্যাপারটা বলতেও পারছি না।আবার ও না ঘুমালে তো যেতেও পারছি না।
–মারু তুই ঘুমাবি না?
–ঘুম আসছে না তো।
–ঘুম ঘুম আসছে না মানে কি??যা ঘুমা।(ধমক দিয়ে)
–তুই আমাকে ধমক দিচ্ছিস কেন সূচী?
–আরে ধমক দিচ্ছি কই?আমি তো ঘুমাতে বলছি।তুই যদি এখন না ঘুমাস সকাল সকাল তো উঠতে পারবি না।এখানে তো ভোর বেলা হলুদ হয়(জোর করে হেসে বলি)
–কিন্তু কেউ তো কিছু বললো না যে ভোরে অনুষ্ঠান হবে।
–আমাকে বলেছে তো।যা যা ঘুমা।

মারিয়া কিন্তু কিন্তু করলেও আমি ওকে তাড়াহুড়া করে বিছানায় শুইয়ে দিলাম।ওর আবার বিছানায় শোওয়ার সাথে সাথে ঘুম চলে আসে।কিন্তু সমস্যা আছে,খুব অল্পতে ঘুম ভেঙে যায় আগের দিন যেমন অভ্র ভাইয়ের দরজা ধাক্কাতে ওর ঘুম ভেঙেছিলো আবার পরে কাথার মধ্য থেকে উকি দিছিলো।মারিয়া ঘুমায় গেলো,কিন্তু ভোরে হলুদ হবে এই মিথ্যা কথাটা বলাই নিজের একটু রাগ হলো আর ওর জন্যে খারাপ লাগলো।কিন্তু কিই বা করতাম!অভ্র ভাই তো আবার…….

*রাত ২টা ৪৩,বাড়ির সবাই ঘুম।আমি পা টিপে টিপে দরজা পর্যন্ত গেলাম খুব আস্তে আস্তে ঘরের দরজা খুললাম।বাইরে বের হয়ে এদিক ওদিক উকি দিলাম,না কেউ নেয়।আস্তে করে আবার দরজাটা দিয়ে ছাদের সিড়ির দিকে এগোতে লাগলাম।চারিদিক বেশ ফাকাই আছে তাই খুব বেশি ভয় লাগলো না।কিন্তু যতো ছাদের দিকে একটা একটা করে সিড়ি এগোচ্ছি তত ভয় লাগছে।তবে ভয়টা আজকে ভূতের না,অভ্র ভাইয়ের।ওনার রুড বিহেভিয়ার+আজকালকার অদ্ভুত বিহেভিয়ার দুটোর ভয় আমাকে চেপে ধরেছে।চিলেকোঠার কাছে চলে এসেছি।কিন্তু দরজাটা পার করে ছাদে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না।মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো,প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে,শরীর যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে,মাথা ঘুরে এক্ষুনি পড়বো মাটিতে।খুব কষ্টে নিজেকে সামলালাম।
–সূচী এতো বেশি ভাবিস না।যতো ভাববি ততো কেমন কেমন লাগবে।আর তাছাড়া উনি তো পাঞ্জাবি ধোয়াতে ডেকেছেন।কিন্তু ছাদে কেন??ছাদে পাঞ্জাবি ধোয় কে আবার??ধুর আবার ভাবছিস?কুল সূচী কুল।এতো না ভেবে চলে যা,যাআআআআ(মনে মনে বিড়বিড় করলাম)

ওসব ভাবতে ভাবতেই ছাদে চলে আসলাম দরজা খুলে,সারা বাড়ির আশেপাশে লাইটিং করা তাই ছাদের ওপরেও আলো আছে।কিন্তু সামনে তো কেউ নেই মানে অভ্র ভাই।তাহলে কি উনি আসেননি?আমি বাম সাইডে তাকাতেই দেখি জনাব সিগারেট খাচ্ছে।আমি একটু গলা ঝাড়া দিলাম।আমার গলা ঝাড়ার আওয়াজ পেয়ে উনি সাথে সাথে সিগারেট ফেলে দিলেন।
–আসার আর সময় পেলো না।এখনি আসার দরকার ছিলো?!(অভ্র মনে মনে ভাবে)

অভ্র উঠে দাড়ায় তারপর গলার সূর গম্ভির হয়ে বলে,
–ওহ এসেছো।এতো দেরি হয় কেন?আমি তো ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম।
–হ্যা সে তো দেখতেই পাচ্ছি সিগারেট হাতে নিয়ে কিরকম ঘুম ঘুমাচ্ছিলেন।
–আ আরে আমি সিগারেট খাইনা।ও তো মাঝে মাঝে একটু।এসব কথা বাদ দাও,তুমি রেডি তো??(দুষ্টু হেসে)
–রেডি মানে?(ভয় পেয়ে)
–কাপড় ধুতে।
–ওহহহহহ,হুম আমি রেডি।দেন আপনার পাঞ্জাবি দেন।

উনি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ছাদের রেলিং এ হাত দিয়ে দাড়ায়।আমি ওনার পিছনে গিয়ে দাড়াই।
–কি হলো পাঞ্জাবি দিলেন না তো।কাচা লাগবে না??আচ্ছা এখানে তো পাঞ্জাবি বা কাচার জন্যে কিছুই তো দেখছি না।
–……………(উনি অপরদিকে মুখ করে চুপ করে আছেন)
–অভ্র ভাই
–আচ্ছা আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি??প্লিইইইজ।

ওনার ভয়েজটা কেমন নার্ভাস নার্ভাস লাগলো।প্রথমে কেমন কেমন লাগলো তাও কি মনে করে অনুমতি দিলাম।উনি উল্টোদিক ঘুরেই সিগারেট ধরালেন।এদিকে আমি দাড়িয়েই আছি,এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও কাপড় কাচার মতো কিছু দেখছি না।আর তা ছাড়া ছাদের ওপর কেই বা কাপড় কাচবে।উনি যে ঠিক কি কারনে ডাকলেন সেটাও তো বুঝতে পারছি না।ধুর বিরক্ত লাগছে।
–আচ্ছা আমি কি চলে যাবো?
–এই না না প্লিজ যেও না(আমার দিকে ঘুরে বলে হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে)আসলে সূচী তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো।কাপড় কাচা তো বাহানা মাত্র।আসলে,ওহ ম্যান!আই এম সো নার্ভাস।একচুয়্যালি তোমাকে একটা জিনিস দেয়ার ছিলো।এক মিনিট.

উনি কথাটা বলে ছাদের চিলেকোঠার ওইদিকে চলে গেলো।তারপর হাতে একটা বেশ মাঝারি সাইজের বক্স এনে আমার সামনে ধরলো।
–কি আছে এতে??(আমি বেশ সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম)
–ধরো তো আগে তারপর বলছি।
আমি হাত বাড়িয়ে নিলাম বক্সটা।তারপর আমার আর কোন কথা বলার আগেই উনি এক দৌড়ে ওখান থেকে চলে আসলো।যেন আর কিচ্ছুক্ষন দাড়ালে বা আমি কোন কথা বললে উনি বিপদে পড়ে যাবেন।ওনাকে এভাবে চলে আসতে দেখে আমারও বেশ অবাক লাগলো কিন্তু আমিও ওনার পিছন পিছন নিচে চলে এলাম কিছুক্ষন পর।রুমে ঢুকে দেখি মারিয়া টের পাইনি।সাদা র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো বক্সের মধ্যে কি আছে দেখতে ইচ্ছা হলো কিন্তু মারিয়া যদি জেগে যায় সেই ভয়ে দেখলাম না রেখে দিলাম লুকিয়ে।তারপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

২৮.
ঘুমের মধ্যে মনে হলো কেউ যেন আমাকে পুকুরে ফেলে দিলো।আমি লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম ঘুম থেকে।কিন্তু ঘুম ভাঙার পর বুঝলাম আমি পুকুরে পড়িনি আমার গায়ে এক বালতি পানি ছুড়ে মারা হয়েছে।এক বালতি পানিতে আমি পুরো ভিজে চপ।পাশে তাকিয়ে দেখি মারিয়াও ভেজা অবস্থায়,ওর চশমা দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে।দেখে মনে হচ্ছে আমার থেকে বেশি পানি ও খেয়েছে।

চলবে……
(গল্পটা কেমন হচ্ছে জানাবেন.কোন ভূলত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন
ধন্যবাদ)