তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-১২

0
100

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_১২

” আইজ নতুন কইরা আবার কোন নাটক হইছিল? ”

তমসাবৃত রজনী। বিছানায় বসে মুয়ীয। স্বল্প দূরত্ব বজায় রেখে ডান পাশে বসে উক্তি। মুয়ীযের প্রশ্নমাখা দৃষ্টি স্থির স্ত্রীর অবয়বে। উক্তি হাত নাড়ালো আস্তে করে। কিছু বোঝালো। কিন্তু অপারগতার স্বীকার মানুষটি সে শব্দহীন ভাষা বুঝলো না। তপ্ত শ্বাস ফেলে জিন্সের বাঁ পকেট হতে নিজের স্বল্প দামী স্মার্টফোন বের করলো মুয়ীয। বাড়িয়ে দিলো স্ত্রীর পানে। উক্তি অবুঝ চোখে তাকিয়ে।

” ল। এইডাতে টাইপ কইরা কথা ক। তোর ওই আওয়াজ ছাড়া ভাষা মুই বুঝি না। ”

উক্তির বুকে কি একটু আঘাত লাগলো! হ্যাঁ, লাগলো তো। এমনই অভাগী সে, যার নিঃশব্দ ভাষা স্বামীর নিকটে জটিল। দুর্বোধ্য। উক্তি কষ্ট মেশানো ছোট্ট করে হাসলো। হাত বাড়িয়ে নিলো মোবাইল। মোবাইলের স্ক্রিনটাচ কিবোর্ডে চলছে পেলব আঙ্গুলের নড়চড়। লিখছে সে। মুয়ীয তাকিয়ে অপলক। কে জানে ওই সাধারণ রমণীর আদলে কি অসাধারণের খোঁজে সে! মানুষটির ধ্যান ভঙ্গ হলো ক্ষণিক বাদে। উক্তি মুঠোফোনটি বাড়িয়ে। এরমধ্যে লেখা শেষ! মুয়ীয একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। হাতে নিলো মোবাইল। যান্ত্রিক পর্দায় স্পষ্ট ভাষায় বাংলা বর্ণে লেখা। সে পড়তে লাগলো,

‘ আপনি ভুল ভাবছেন। আজ কোনো নাটক হয়নি। ভাবী আর আমার বান্ধবী শিমু এসেছিল। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল ওরা। হঠাৎ করে না বলেই এসেছে। ওদেরকে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। ওরাও খুশি হয়েছে। আমাদের ভালো একটা সময় কেটেছে। সুন্দর বিকেল ছিল আজ! ‘

এতটুকুই লেখা। মুয়ীয পড়লো। পড়া শেষে তাকালো স্ত্রীর মুখপানে। গমগমে স্বরে বললো,

” এইডা আশা করি নাই তোর থে। ”

উক্তি বোধহীন তাকিয়ে। কি বলছেন উনি, বোধগম্য হচ্ছে না যে। অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললো মুয়ীয,

” মোরা দুইজন স্বামী-স্ত্রী। কালেমা পইড়া মহান আল্লাহ্’র ইচ্ছায় এক বন্ধনে বাঁধা পড়ছি। আমগো সম্পর্কডা বহুত পবিত্র। অন্তরে বিরাজ করে এই সম্পর্কের মায়া, ভালোবাসা। স্বামী স্ত্রী হইলো গা একে অপরের পরিপূরক। পোশাকের লাহান। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোনোরহম লুকাচুপি থাহা উচিত না। ”

উক্তি চুপটি করে শুনছে। মানছে। হ্যাঁ, তার স্বামী ঠিকই বলছে। এই পৃথিবী এবং মৃ ত্যু পরবর্তী পরকালে.. উভয় স্থানেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অন্যতম সেরা এক সম্পর্ক। এ সম্পর্কের কোনো তুলনা হয়না। হয়না কোনো বিকল্প। এ এক জান্নাতি সুখের সমাহার।

” মুই আশা করছিলাম তুই মোর থে সত্যি লুকাবি না। যা যা হইছে, হাছা কবি। কিন্তু না। মুই ভুল ছিলাম। ”

উক্তির বদন জুড়ে তিমিরাচ্ছন্ন মেঘমালার অস্তিত্ব। মুয়ীয তখনো বলে চলেছে,

” তুই কাগো বাঁচানোর লেইগা মিছা কইলি? মোর মা, বুইন, ভাবীরে বাঁচানোর লেইগা? ভুইলা যাইছ না বউ, অরা মোর ঘরের লোক লাগে। কার শিরায় শিরায় কি চলে মুই খুব ভালো কইরাই জানি। মোর চোহে মিছা পট্টি পড়ানো লাগবে না। সব জানা আছে মোর। ”

উক্তি হালকা হাত নাড়িয়ে কিছু বললো। বুঝলো না মুয়ীয। উঠে দাঁড়ালো। সম্মুখ দেয়ালে দৃষ্টি রেখে অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললো,

” দরদীয়া শাবানা হইতে চাছ তো? ঠিক আছে। হ শাবানা। মোর কথা হোনোনের কোনো দরকার নাই। নিজের কপালে নিজেই জুতা মা•রলে, পর-এ করবে’ডা কি? ”

অবস্থা বেগতিক হয়ে যাচ্ছে। উক্তি ত্বরিত উঠে দাঁড়ালো। হাতের ইশারায়, অর্থহীন ‘ আঃ ‘ সূচক শব্দে কিছু বলতে চাইলো। তবে শুনলো না অসন্তোষে তপ্ত পুরুষটি। বড় বড় কদম ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। উপায়ান্তর পিছু ছুটলো উক্তি। লাভ হলো না। ততক্ষণে নাগালের বাইরে মুয়ীয হাসান। অশ্রুসজল চোখে অজানায় তাকিয়ে মিসেস হাসান।

নিস্তব্ধ চারিধার। মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে অলিগলি দাপিয়ে বেড়ানো কুকুরের ঘেউ ঘেউ কলরব। শশাঙ্কের (চাঁদের) মোহিত দ্যুতি ছড়িয়ে দীর্ঘকায় পুরুষটির মাথা, পিঠে।

” কি বন্ধু? রাইত দুপুরে বউ ছাইড়া কু ত্তা য় মন মজলো ক্যা? ”

নিশ্চুপ মুয়ীয। বন্ধুর কাছ থেকে কোনোরূপ ভালোমন্দ জবাব না পেয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও ফেললো না চয়ন। কার কাছে পেটের খবর জানতে চাইছে সে? এ মানুষটি কি পেটের খবর উগলে দেয়ার মতো মন মানসিকতা নিয়ে চলে? কখনোই না। এর সমস্ত আনন্দ, সুখের ভাগিদার হয় দুনিয়াবাসী। আর দুঃখ কষ্টের একচ্ছত্র অংশীদার শুধুই সে। চয়ন আর কিছু বললো না। বন্ধুর নিকটে গেল। নিসংকোচে বসলো ফুটপাতে বন্ধুর একদম পাশ ঘেঁষেই। রাতের আঁধারে ফুটপাতে পাশাপাশি বসে দুই প্রাপ্তবয়স্ক মানব। বড় অদ্ভুত দৃশ্যপট না?

চয়ন বাম হাতের কবজিতে পড়ে থাকা পুরনো ঘড়িতে চোখ বুলালো। সময় তখন রাত এগারোটা বেজে বিশ মিনিট। বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। একমাত্র বউ তার অপেক্ষায় জেগে। এই সপ্তাহে ফ্যাক্টরিতে কাজের খুব চাপ। সংসারের ঘানি ঠিকমতো টানার জন্য ওভারটাইম করছে সে। পাচ্ছে বেতনের অতিরিক্ত কিছু অর্থ। এই অর্থ অল্প হলেও কাজে দিচ্ছে। বিনিময়ে করতে হচ্ছে র ক্ত পানি করা পরিশ্রম। সে-ই যে দুপুরে অল্প ভাত, আলু ভর্তা আর পাতলা মসুরের ডাল খেলো.. এরপর সন্ধ্যায় এক কাপ চা ব্যতীত পেটে আর কিছুই পড়েনি। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি সে। চাইলেই তো দু পয়সা অতিরিক্ত খরচ করে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারে না। তার ভাবনায় সর্বদা ঘুরে বেড়ায় পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মুখ। অসহায় শয্যাশায়ী বাবা, স্ত্রী, তিন মাসের শিশু সন্তান, কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই, বিবাহযোগ্য ছোট বোন। এতগুলো মানুষের ভরণপোষণের দায়িত্ব তো মহান আল্লাহ্ তার ওপরেই ন্যাস্ত করেছে। এখন পরিশ্রম করতে হবে না? নিজ ভাগ্য নিয়ে কখনোই অসুখী নয় চয়ন। কারণ সে জানে আল্লাহ্’র সে-ই নির্দেশ, ‘তিনি (আল্লাহ্) যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না, বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২৩)

আল্লাহ্ তা’য়ালা পূর্ব থেকেই সকল সৃষ্টির তাকদীর নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহ্ বলেন, ‘জলে ও স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত, তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে (ভূগর্ভের অন্ধকার স্তরে) এমন কোনো শস্যকণাও অংকুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোনো বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নাই।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৫৯)

ভাগ্য মানুষের জীবনকে সংযত করে। আল্লাহ্ বলেন, ‘এটা (ভাগ্য নির্ধারণ) এ জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার জন্য হর্ষোত্ফুল্ল না হও। আল্লাহ্ পছন্দ করেন না উদ্ধত ও অহংকারীদের।’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ২৩)

আল্লাহ্ মানুষের জন্য যা নির্ধারিত করে রেখেছেন তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। পবিত্র কোরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ্ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেনই; আল্লাহ্ সব কিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৩)

কুরআনের এ সকল বাণী পড়েছে চয়ন। জেনেছে কিছু চিরন্তন সত্য বাক্য। তাই তো নিজ ভাগ্যের ওপর কখনোই অসন্তুষ্ট নয় সে। বরং বন্ধু মুয়ীয হাসানের মতো সদা সর্বদা বলে থাকে,

‘ আলহামদুলিল্লাহি আ’লা কুল্লি হাল। ‘

বন্ধুর নীরবতায় কিছুটা চিন্তিত চয়ন। হঠাৎ হলো কি এর? কোনো ঘরোয়া বড় সমস্যা নাকি বাহ্যিক সমস্যা? রাশভারী পরিবেশে প্রাণ ফেরাতে চয়ন রসিকতার সুরে শুধালো,

” বন্ধু! বউয়ের লগে আজ আড়ি কাল ভাব হইছে নি? এমন আন্ধার মুখ কইরা আছো ক্যা? ”

মুয়ীয এমন দৃষ্টি ফেলে তাকালো..! চয়ন শার্টের অতলে বুকে এক দলা থুথু ছেটালো। সরস কণ্ঠে বললো,

” ওয়াক থু! বন্ধু এমন লুক দিতাছো ক্যা? রাইত দুপুরে ভয় পাই না? আমার কিছু হইয়া গেলে আমার পাঁচটা না দশটা না একমাত্র বউয়ের কি হইবো? অন্য বেডা ইন্টুবিন্টু করবো না? ”

মুয়ীয দৃষ্টি হটিয়ে নিলো। তাকিয়ে রাস্তায় বেওয়ারিশ ঘুরতে থাকা এক কুকুরে। চয়ন বুঝলো বন্ধুর মন সত্যিই খারাপ। তার কিছু এক করা দরকার। নইলে কেমন বন্ধু সে! চয়ন-ও পাশে বসে থাকা মানুষটির দৃষ্টি অনুসরণ করে খাবারের খোঁজে ঘুরতে থাকা কুকুরে দৃষ্টিপাত করলো। খানিকের নীরবতা। বড় নিস্তব্ধ, ভূতুড়ে অনুভূতি জাগায় লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায়। চয়ন আপনমনে বলতে লাগলো,

” বউয়ের ওপর রাগ করতে নাই বন্ধু। বউ রাগ করার পাত্রী না। বরং আদর সোহাগে যত্ন করার পাত্রী। মা বাপ, ভাই বোন সব ছাইড়া ওরা তো আমগো বিশ্বাস কইরাই চইলা আহে। হেই আমরাই যদি মুখ কালা করি, দূর ছাই করি… কই যাইবো ওরা? ক। ”

মুয়ীয কিচ্ছু বললো না। শুধু তাকালো একবার। চয়ন বললো,

” ফেসবুকে পড়ছিলাম একবার। খুব ভালো লাগছিলো। তোরেও হুনাই। [ নারী হইলো কাঁদা যুক্ত মাটির মতন। কাঁদা মাটি দিয়া যেমন নানারকম জিনিস তৈরি করা যায়। নারীরে ভালোবাইসা ঠিক যেমনভাবে গইড়া তুলবা, নারী ঠিক তেমন ভাবেই গইড়া উঠবো। ] হাছাই কইছে বন্ধু। নারীরে মনের মতন গইড়া নিতে হয়। আবার কখনো কখনো নিজেও তার মনের মতন গইড়া উঠতে হয়। ত্যাগ স্বীকার, পরিবর্তন খালি এক পক্ষে হইবো ক্যা? সমানে সমানে হওয়া উচিত। তয় না সংসার সুখের হইবো। আল্লাহ্’র রহমত বর্ষণ হইবো।”

কিছুটা সময় নীরবে অতিবাহিত হলো। মুয়ীযের মনটা আজ বিমর্ষ। তার এক ও অদ্বিতীয় কারণ সম্পর্কে শুধুমাত্র সে এবং মহান রবই অবগত। আকস্মিক কেন এই বিমর্ষতা? বোঝা দুঃসাধ্য। লম্বা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো মুয়ীয। চয়নও উঠে দাঁড়ালো। বছর এক জুনিয়র বন্ধুটির কাঁধ চাপড়ে বললো,

” বাড়ি যা। ভাবী অপেক্ষায়। ”

মুয়ীয কিছু বললো না। চুপচাপ হাঁটা ধরলো। বাড়ির পথে। চয়ন মুচকি হাসলো সে পথে তাকিয়ে।

ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই। একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে। সময় তখন প্রায় বারোর কাছাকাছি। ঘরের ভেজানো দরজা উন্মুক্ত করে ভেতরে প্রবেশ করলো মুয়ীয। আঁধারে ডুবে গোটা ঘরটি। ঈষৎ চমকালো সে! বউ কি তবে তার অনুপস্থিতিতে ঘুমিয়ে পড়েছে! মনটা অজান্তেই ভারাক্রান্ত হলো। সে কি তবে স্ত্রীর জাগ্রত, অপেক্ষমাণ রূপের আশা করছিল? হয়তো হ্যাঁ। মাথা ঝেড়ে অহেতুক আশা, চিন্তা দূর করার প্রচেষ্টা করলো মানুষটি। আঁধার মাঝেই সয়ে যাওয়া চোখের দৃষ্টিতে, আন্দাজ মতো ভেতর হতে আঁটকে দিলো দরজা। শার্টের টপ বাটনে হাত দিয়ে এক কদম অগ্রসর হলো। লহমায় ছলকে উঠলো হৃদয়ে বহমান তরঙ্গ। মাটিতে সেঁটে গেল পদদ্বয়। চোখের তারায় অবিশ্বাস্য ভাব! মুগ্ধতার ঝলমলে উজ্জ্বলতা! সে কি রাতদুপুরে সুমধুর স্বপ্ন দেখছে! নাকি এ অভাবনীয়, অকল্পনীয় সত্য? বুকের ধারে স্থির হয়ে থাকা হাতটা কখন যেন নেমে গেল। একটিবার চোখের পলক ফেললো মুয়ীয। নিশ্চিত হলো এ স্বপ্ন নয়। অমোঘ সত্যি। ঠোঁটের কোলে তৃপ্তির আভা প্রসারিত হলো। একটু একটু করে অগ্রসর হতে লাগলো বিমুগ্ধ পুরুষটি। আরো কাছ হতে, আরো স্পষ্ট রূপে অবলোকন করতে লাগলো নিজের নারীকে। লাল টুকটুকে সুতির শাড়ি পড়নে অর্ধাঙ্গিনীর। শাড়ির পাড়ে এবং আঁচলে কৃষ্ণসবুজ রঙের আধিপত্য। সেথায় উপস্থিত হালকা কারুকার্য। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরিহিত কৃষ্ণসবুজ রঙা ব্লাউজ। কেশরাশি উন্মুক্ত রূপে ছড়িয়ে পিঠের আবরণে। ডান পাশে সুনিপুণ ভঙ্গিতে সিঁথি কাটা। বাম পাশে ঠাঁই মিলেছে কেশগুচ্ছের। চোখের কার্নিশে কাজলের হৃদয় বিদীর্ণ করা মোটা রেখা। ঠোঁটে রক্তজবার রঙে রঙিন ওষ্ঠরঞ্জনী। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘রেড কালার লিপস্টিক’। স্বামী প্রদত্ত শাড়ি, প্রসাধনীতে আজ নিজেকে সাজিয়েছে উক্তি। স্বল্পমূল্যের এই সাধারণ সাজেই আজ স্বামীর চোখে সে অপরূপা! মনমোহিনী! হৃদহরণী! মুয়ীয অতি সন্নিকটে এসে থামলো। দুজনার মধ্যকার দূরত্ব অতীব ক্ষীণ। উক্তির চোখ দু’টো নত। মেঝেতে অহেতুক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। লাজ, অনুশোচনা, আড়ষ্টতা, ভয়ে কাঁপছে অভ্যন্তর। অস্ফুট স্বরে এ প্রথমবারের মতো কোনো নারীর তরে প্রশংসা সূচক বলে উঠলো মুয়ীয হাসান,

” মাশাআল্লাহ্! ”

ক্ষুদ্র এই বিমোহিত শব্দ… রমণীর হৃদয়ের বদ্ধ কুঠুরিতে বন্দী হয়ে থাকা আহ্লাদে পাখিটাকে চিরতরে মুক্ত করে দিলো। চোখের কার্নিশে নোনাজল থৈ থৈ। ঠোঁটে ছোট্ট লজ্জালু ঝলক। মুয়ীয তাকিয়েই রয়েছে। তাকিয়েই রয়েছে। অস্থির হৃদস্পন্দন। অশান্ত অভ্যন্তর। দিশেহারা সুপ্ত অনুভূতির দল। কি বলবে না বলবে জানা নেই মানুষটির। কোন ক্ষুদ্র বা বৃহৎ শব্দভাণ্ডারের মাধ্যমে এই নৈস্বর্গিক, অতুলনীয়, মনমাতানো সৌন্দর্যের প্রশংসা করার ধৃষ্টতা দেখাবে সে! জানা নেই। তাই তো বেছে নিলো নীরবতার ভাষা। চোখের নৈঃশব্দ্য ভাষা। দু’টো প্রাণের মধ্যবর্তী দূরত্বের অবসান ঘটিয়ে মুয়ীয এলো সন্নিকটে। বাঁধাহীন, নিসংকোচে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলো। ছুঁলো স্ত্রীর বাঁ গালের কোমলতা। অনুচ্চার্য অনুভূতির ব:শীকরণে উক্তি’র দু অক্ষিপাতা বন্ধ হয়ে গেল। গাল বেয়ে নামলো বর্ষণের ফোঁটা ফোঁটা জল। কপালের ঠিক মধ্য স্থলে মুয়ীয তার ঠোঁটের ছাপ বসালো। অত্যন্ত গাঢ় সে ছাপ। হৃদয়ের অন্তঃস্থল অবধি নাড়িয়ে দিয়ে গেল। সম্পূর্ণ ঘোরাচ্ছন্ন দুই মানব, মানবী। উক্তি’র মনে চলছে স্বামীর অভিমান, ক্ষুদ্র রাগ দূরীকরণ করার সর্বোচ্চ মনোবাসনা। এদিকে প্রিয়তম স্বামীর অন্তরে একান্ত নারীর সমগ্র সত্তায়, স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ভিন্নধর্মী, বিপরীতধর্মী দুই বাসনা, আকাঙ্ক্ষা মিলেমিশে রচিত হলো এক নৈঃশব্দ্য প্রহর!

‘ হৃদয়েশ্বরী আমার,
শুধু তোমাতেই নৈঃশব্দ্য এ প্রহরে
হারিয়ে গেলাম প্রণয়াকাঙ্ক্ষী দু’টো প্রাণ
অন্তরে অন্তরে ‘

চক্ষু বন্ধ রমণীর। চোখেমুখে লজ্জালু আভার প্রলেপ। বদ্ধ চোখের পাতায় অঙ্কিত হচ্ছে পুরুষালি ঈষৎ কালচে ঠোঁটের পরশ। মাঝারি আকৃতির নখ ডেবে গেল মানুষটির মাংসল বাহুদ্বয়ে। তবুও দমলো না সে। চালিয়ে গেল নিজ প্রণয় উপাখ্যান! একে একে মিটছিল দূরত্ব। বৃদ্ধি পাচ্ছে নৈকট্য। অন্তরঙ্গতা। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠলো নরম কোমল হৃদয়টা। অপ্রত্যাশিত এই ঘন মূহুর্তে তবুও পিছপা হলো না উক্তি। নিজেকে স্বামীর সনে সমর্পণ করলো। কেননা রাসূলুল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَلَمْ تَأْتِهِ ، فَبَاتَ غَضْبَانَ عَلَيْهَا ، لَعَنَتْهَا المَلاَئِكَةُ حَتَّى تُصْبحَ » . (متفق عليه).

“যখন কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তার বিছানায় ডাকে, তারপর সে তার কাছে না আসে এবং স্বামী তার প্রতি অসন্তুষ্ট অবস্থায় রাত কাটায়, তাহলে ফেরেশ্তাগণ সকাল হওয়া পর্যন্ত তাকে অ*ভিশাপ দিতে থাকে।” [ বুখারী, হাদিস নং- ৩০৬৫; মুসলিম, হাদিস নং- ৩৬১৪ ]

বিছানায় শায়িত উক্তি। বালিশে ঠেকে মাথা। বন্ধ চক্ষু। শিহরণে রোমাঞ্চিত তনু মন। শূন্য দূরত্বে, বিপরীত দিকে স্বামী মুয়ীয। ঝুঁকে তার পানে। রূক্ষ-খসখসে আঙ্গুল খেলে বেড়াচ্ছে স্ত্রীর গালের নরম ত্বকে। চোখে চোখে নিশ্চুপ আলাপ। নাকের ডগায় লজ্জায় আরক্ত আভায়, ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো মানুষটি। বেশ কিছু মূহূর্ত সেভাবেই কেটে গেল। নাকে আদর ছুঁয়ে। প্রথম কোনো পুরুষের গাঢ় স্পর্শে আন্দোলিত হৃদয়াঙ্গন। সে আবার হালাল, পবিত্র স্পর্শ। নারী মনে তখন তরঙ্গায়িত অনুভূতির তোলপাড়। আরো কাছে পাওয়ার অভিলাষ। ধীরে ধীরে বাড়ছে রাত। দূরীভূত হচ্ছে কপোত কপোতীর ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতম দূরত্ব। একই সুতোয়, শক্ত গিঁটে বাঁধা পড়ছে দু’টো প্রাণ। রাতের আঁধারে, চক্ষু সয়ে যাওয়া শশাঙ্কের আলোয় দাম্পত্যের পবিত্র, অবশ্যম্ভাবী সূচনায় পদার্পণ হলো মুয়ীয, উক্তি যুগলের। রমণীর চক্ষু কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো সুখানুভূতির দু ফোঁটা অশ্রুজল।

চলবে।