#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_৩১
” মুন্নি ছোট তুমি। এসব প্রেম ভালোবাসার বয়স নয় এটা। ধোঁ’কা খেয়ে জীবন শেষ করার বয়স। হারাম সম্পর্কের ফাঁদে পা দিয়ো না প্লিজ। জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। ”
সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভাষায় ছোট ননদকে বোঝাতে চাইছে উক্তি। তবে মুন্নি কি বললো বিপরীতে,
” মোর জীবনে কি হইবো না হইবো হ্যাতে তোমার কি? হা? নিজের চরকায় তেল দাও গিয়া। যাও না যাও। ”
মাছি তাড়ানোর মতো বিদায় করতে চাইছে উক্তিকে। উক্তি এবার সরলতা ত্যাগ করে অভিভাবকের ন্যায় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে বললো,
” তোমার ভাইয়া, মা জানলে কিন্তু চরম অশান্তি হবে। ভুলে গেলে গতবার… ”
কথাটা সম্পূর্ণ করা হলো না। মুন্নি অভব্য, উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
” না না। ভুলি নাই। তোমার লেইগা মা টের পাইয়া গেছিল। মোর এই… এই ডাইন গালে থা°প্পড় মা’রছিল। আস্ত একখান ডা’কিনী তুমি। মাইনষের খালি ক্ষতিই করতে পারো। অপয়া, অলক্ষ্মী! ”
এমন নির্মম-নিষ্ঠুর শব্দ বাণে উক্তির ভেতরটা খণ্ডিত হলো কয়েক শতাধিক টুকরোয়। বাষ্প জমায়িত হলো দু চোখের কোলে। হাঁসফাঁস অবস্থা তার। শ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে। একদলা কষ্ট গিলে নেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গেল উক্তি। আস্তে ধীরে কম্পিত হাত দু’খানা নাড়িয়ে বলতে লাগলো,
” অপয়া, অলক্ষ্মী আমি? যদি তাই হতাম না কখনো তোমায় সৎ পরামর্শ দিতে আসতাম না। যেভাবে জন্মের সময় জন্মদাত্রী মা’কে খেয়ে নিয়েছি ঠিক সেভাবেই তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ খেয়ে নিতাম। ওই ছেলের সঙ্গে আরো লেলিয়ে দিতাম। তোমাদের এই নোংরামিতে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিতাম। কিন্তু আফশোস! এই অপয়া, অলক্ষ্মী মেয়েটা চিরকাল না চাইতেও অন্যের ক্ষতিই করে গেছে শুধু। আজ তোমায় সাবধান করলাম। শুনলে না। ভ্রুক্ষেপ করলে না। সবশেষ এটাই বলবো শুধু, মহান আল্লাহ্ পাক তোমাকে নেক হেদায়েত দান করুন। এই ভুল পথ, গুনাহের পথ থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করুন। মস্তবড় বিপদ থেকে বেঁচে যাবে তুমি। ”
শব্দহীন ভাষায় উক্তি যা বলার বললো। বিপরীতে দণ্ডায়মান মুন্নি তার কতটুকু বুঝলো কিংবা বোঝার অপেক্ষায় তার ধার ধারলো না। ডান হাতের উল্টো পিঠে ভেজা গালটা মুছতে মুছতে উক্তি ঘুরে দাঁড়ালো। আত্মপ্রত্যয়ী চিত্তে, এক লড়াকু মনোভাবের সহিত পথ চলতে লাগলো। ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল সেই দমবন্ধ করা পরিবেশ হতে। এদিকে মুন্নি বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে! অপয়া, অলক্ষ্মী, মূক উক্তি কবে থেকে এমন নির্বিশঙ্ক জবাবে অন্যের মুখ বন্ধ করতে শিখলো? কবে থেকে…..?
•
প্রায় মধ্য রজনী তখন। চন্দ্র উপস্থিত অন্তরীক্ষের বিস্তৃত বক্ষে। খোলা জানলা দিয়ে প্রবেশ করছে শিরশিরে হাওয়া। শুধু চন্দ্র দ্যুতি ছড়িয়ে ঘরের অন্দরে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে মুয়ীয। পিঠে ঠেকে লম্বালম্বিভাবে রাখা বালিশ। হাতে স্মার্টফোন। ব্যস্ত দিনের শেষে দেশ-বিদেশের খবর দেখতে ব্যস্ত সে। পাশে শুয়ে উক্তি। একাকী ঘুচুর ঘুচুর করে চলেছে। ঘুম নামছে না দু চোখেতে। উক্তি গাল ফুলিয়ে তাকালো স্বামীর দিকে। মানুষটা খবর দেখছে। দেশে চলমান সাম্প্রতিক খবরাখবরে মগ্ন সে। এদিকে রাত যে এতগুলো বেজে গেছে সে খবর আছে কি? নেই তো। থাকলে এতক্ষণে আরামের শয্যা গ্রহণ করতো। নিঃশব্দ বউটিকে বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়াতো। কিন্তু না। সেসবের কিছুই হচ্ছে না আপাতত। তিনি যে দেশের খবরে ডুবে। এদিকে ঘরের একান্ত খবর সম্পর্কে অজ্ঞ। উক্তি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছুটা সময় অপেক্ষা করলো। লাভ হলো না। তাই তো ক্ষুদ্র পদক্ষেপ গ্রহণ করলো। আলতো করে তর্জনীর গুঁতো দিলো স্বামীর বাহুতে। মুয়ীয ‘ উহ্ ‘ সূচক শব্দ করে হাতটা সরিয়ে দিলো। উক্তি এতে অবাক! রাতদুপুরে একমাত্র বউকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। উক্তি আবারো হাত বাড়িয়ে দিলো। স্বামীর কোমরে ঠিক নরম চামড়ায় বসিয়ে দিলো এক নির্দয় চিমটি। মৃদু আর্তনাদ করে মুয়ীয তাকাতে বাধ্য হলো স্ত্রীর দিকে। শুধালো,
” কি হইছে? রাইতদুপুরে এমন বান্দরনির লাহান চিমডি মা-রতাছোছ ক্যা? ”
উক্তি চক্ষু বড় করে তাকালো। প্রতিবাদী ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বলে উঠলো,
” আমি বাদরনি হলে আপনি কি? আপনি তো একটা পেঁচা। শুধু পেঁচা না। বাদুড়-ও। ”
মুয়ীয চক্ষু পিটপিট করে বললো,
” মুই পেঁচা? বাদুড়? দিমু না এমন এক? বেফাঁস কথা বন্ধ হইয়া যাইবো। ”
উক্তি করুণ চোখে তাকিয়ে। মনে হচ্ছে অভিমানী অশ্রু এই গড়িয়ে পড়লো বুঝি। এতটা কষ্ট পেয়েছে মন? শব্দহীন ভাষায় শুধালো সে,
” আপনি মা°রবেন আমাকে? ঠিক আছে। মারুন না। মারুন। ”
উক্তি স্বেচ্ছায় গাল বাড়িয়ে দিলো মা র খাওয়ার উদ্দেশ্যে। ওর এমন কিউটিপাই মুখখানি দেখে মুয়ীয নীরবে হেসে উঠলো। আস্ত এক কিউটি তার বউটা। একখান চুমু তো প্রাপ্য ই এই কিউটনেসের জন্য। যেই ভাবা সেই কাজ। চট করে উক্তি’র বাড়িয়ে দেয়া গালে চুমু বসিয়ে দিলো মানুষটা। হকচকিয়ে গেল উক্তি! মা রে র বদলে আদর! এই মধ্যরাতে কেমনতর ফাজলামি হচ্ছে এসব? হা?
” বউরে! অমন কইরা তাকাইছ না। এই মনোরম রাইতে চুমুর বর্ষণ আইলো বলে। ”
কানের কাছে গাঢ় নিশ্বাসের স্পর্শন। কণ্ঠে মা`দকতা। উক্তির বক্ষ মাঝে সেতার সুরায়িত হতে লাগলো যেন। আত্মিক সুখে বুজে এলো চক্ষু। মুয়ীয গভীর চোখে তাকিয়ে। হাতের মোবাইলটি কখন যে পড়ে গিয়েছে কোলে টের পায়নি সে। মুয়ীয আলতো চুম্বন ছুঁয়ে দিলো স্ত্রীর কানের পশ্চাৎ অংশে। ভেতরকার নে`শালো মনটাকে কাবু করতে সে সরেই যাচ্ছিল তৎক্ষণাৎ। তবে বিপত্তি ঘটলো তখুনি। শার্টের কলার দু’টো কোমল হাতে বন্দী হলো। এক টানে নিজের অতি নিকটে টেনে নিলো সঙ্গিনী। মুয়ীয কোনোরূপ শব্দ উচ্চারণ করার পূর্বেই লজ্জালু মুখটা লুকিয়ে গেল তার কাঁধের অগভীরতায়। মুয়ীয হাসলো। শব্দহীন, প্রাণোচ্ছ্বল সে হাসি! স্ত্রীর মনোবাসনা বুঝতে বাকি নেই তার। সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় হৃদ রাজ্যের রাজার তরে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছে রাণী সাহেবা। এবার সেই সমর্পিত হৃদয়ে সর্বোচ্চ ভালোবাসা উজাড় করে দেবে সে। দেবে অপ্রতিম সোহাগী পরশ। তৃপ্ত মনে সহধর্মিণীকে কাছে টেনে নিলো মুয়ীয। মোবাইলের ঠাঁই হলো বালিশের পার্শ্বে। অকৃত্রিম আঁধারির খেলায় মেতে উঠলো দু’জনে আদিম সে ক্রীড়ায়।
———- >
মুয়ীয হাসান। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এক সংগ্রামী পুরুষ। বাবাকে হারিয়েছে তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে সে। ফাইনাল পরীক্ষা এক মাস বাদে। দারিদ্রতা ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। তবুও একমুঠো সুখ ছিল সংসারে। অকস্মাৎ এক রাতের দুর্ঘটনায় সবটা ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হলো। ছিনতাইকারীদের ছু°রিকাঘাতে নিহত হলেন বাবা। এক লহমায় ওদের সাজানো গোছানো দরিদ্র পরিবারে কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। এলোমেলো হলো জীবনধারা। ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে তৃতীয় বর্ষে উঠতে সক্ষম হয়েছিল মুয়ীয। তবে হার মানতে হলো তাকে। বাবাহীন এই নি’ষ্ঠুর দুনিয়ায় বেঁচে থাকা কঠিন। টাকা চাই টাকা। বাবা তেমন কিছু রেখে যেতে পারেননি। দিনকে দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এই প্রতিকূলতায় বেঁচে থাকা রীতিমতো দুঃসাধ্যের বিষয়। বাধ্য হয়ে তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন সময়েই পড়ালেখা ত্যাগ করলো মুয়ীয। মাস্টার্স শেষ করে ভালো কোনো চাকরি করার স্বপ্ন নিজ হাতে নির্দয়ভাবে মুছে ফেললো। এভাবে ওভাবে সৎ পথে লড়াই চালিয়ে গেল। অবশেষে রবের অশেষ রহমতে বছর দুয়েক বাদে নিজ কর্ম যোগ্যতায় পেল ভালো একটি চাকরি। এভাবেই দিনকাল এগিয়ে যাচ্ছিল। আস্তে ধীরে মোটামুটি সচ্ছলতা এলো পরিবারে। পরিবারের একচ্ছত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মুয়ীয। বড় ভাই মারুফ যা উপার্জন করে তা জু-য়া খেলে, ম-দ খেয়েই খুয়ে ফেলে। তার উপার্জনে সংসারে দু আনা উপকার হয় না। এতে অবশ্য মুয়ীযের কিছু এসে যায় না। নিজ আয়ে সংসারে বিরাট ভূমিকা রেখে যাচ্ছিল সে। বয়স এখন ঊনত্রিশ। বিয়ের বয়স হয়েছে। মা পাত্রী খুঁজছেন বেশ কিছুদিন ধরে। তবে ওনার মনের মতো পাত্রী মিলছেই না। ওনার তো আবার যে সে নয় বরং বিশাল ডিমান্ড। সবচেয়ে বড় ডিমান্ড পাত্রী অতিরিক্ত সরল হতে হবে। বড় বউ জান্নাতের মতো বেয়াদব, তর্ক করা স্বভাবের হবে না। দু কথা শোনালে বিপরীতে পাঁচ কথা বলবে না। চুপ থাকবে। সর্বদা মাথা নিচু করে বাঁচবে। ওনায় আপনি আজ্ঞে করে চলবে সবসময়। আজকের এই যামানায় ওনার এমন অবাস্তব চাহিদা অনুযায়ী পাত্রী মিলছিলো ই না। ঘটক সাহেব পড়েছে আচ্ছা জ্বালাতনে। মোমেনা বেগম খেঁকিয়ে ওঠে যে অহেতুক,
” কেমনতর ঘটক আমনে? হা? একখান সরল মাইয়া খুইজ্জা পাইতাছেন না। দুনিয়া থে ব্যাবাক সরল মাইয়া ম°রছে নি? ”
একদিন বাড়ি বসে ঘটকের সঙ্গে এমন হাউকাউ করছিলেন মোমেনা বেগম। আর পাত্রীদের ফটো নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। সহসা ওনার হাত থেমে গেল। জ্বলজ্বল করে উঠলো অক্ষিযুগল। হাতের মুঠোয় তখন এক ললনার ফটো। নীলাভ রঙা সালোয়ার কামিজ পড়নে তার। মাথায় বাঁধা রঙিন হিজাব। মুখে লেপ্টে অকৃত্রিম মুচকি হাসি। চেহারায় এক আলাদাই মায়া। সে মায়ায় ব’শীভূত হয়ে মোমেনা বেগম শুধিয়ে উঠলেন,
” মাইয়াডা কেডা? কোন বাড়ি? নাম কি এর? ”
ঘটক যারপরনাই উৎফুল্ল হলেন এ প্রশ্নে। যাক বাবা। অবশেষে এই দ`জ্জাল মহিলার পছন্দ হলো কাউকে। না জানি কার কপাল পু’ড়বে এর পুত্রবধূ হয়ে।
” কই? দেখি দেখি। ছবিটা… ”
মোমেনা বেগম ছবিটা দেখালেন। ওনার ঠোঁটে বিদ্যমান বক্র রেখা। ছবির মেয়েটিকে দেখে ঘটকের মাথায় হাত। ওরে সর্বনাশ! এ কার ফটো এসে পড়েছে এ মহিলার হাতে! না না। এ হতে দেয়া যাবে না। ঘটক আমতা আমতা করতে লাগলেন। মোমেনা বেগম শুধোলেন আবার,
” কি হইলো? কন। নাম কি মাইয়ার? ”
” বলছি যে ভাবী আরেকটা ফটো দেখাই? এটা ছাড়েন না। ”
মাঝবয়সী ঘটকের চোখেমুখে কেমন অন্ধকার নেমে এসেছে। শুভ্র শার্ট, কালো প্যান্ট পড়নে ভুঁড়িওয়ালা লোকটির। মাথায় অর্ধ টাক। মুখে চিবোচ্ছে পান। যাতে রঙিন হয়ে এসেছে ঠোঁট। মোমেনা বেগম অসন্তুষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,
” না। অন্য না। এইয়ার খবরই চাই মোর। ব্যাবাক খুইল্লা কন দি। ”
আর নিস্তার নেই। ঘটক থেমে থেমে বলে উঠলেন,
” উক্তি। মেয়েটার নাম উক্তি কায়সার। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। বড় ভাই আছে একটা। বিবাহিত। বোনের জন্য পাত্র খুঁজছেন। ছবিটা আমার এক ঘটক বন্ধু পাঠাইছে। পাত্রের খোঁজে। ”
পাত্রীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা শুনেই চকচক করে উঠলো মোমেনা বেগমের চক্ষুদ্বয়। সে কি অর্থ লো’ভে না ভিন্ন কোনো কারণে, বোঝা মুশকিল।
” বাহ্! বাহ্! তা মাইয়ার স্বভাব চরিত্র ক্যামন? বড়লোকের মাইয়া? স্বভাবে উচ্ছৃঙ্খল, আলতু ফালতু নি? ”
ঘটক তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানালেন,
” এই না না। মেয়ে মাশাআল্লাহ্ অনেক ভদ্র। স্বভাব চরিত্র নজরকাড়া। আস্ত এক হীরের টুকরো মেয়েটা। ”
” মোর পোলাও কম কিসে? খাঁটি হীরা একখান। তয় এই হীরার লগে মোর হীরার একখান হিল্লে কইরা দেন দেখি। মাগার মাইয়ার বাপ তো ধনী। মানবো নি এই সম্বন্ধ? ”
শেষের কথায় প্রকাশ পেল দুশ্চিন্তা। ঘটক সাহেব এবার করুণ হেসে বললেন,
” মেয়ের বাবার কথা ছাড়েন। মেয়েটার বাস্তব সত্য জানলে আপনি নিজেই পিছিয়ে যাবেন। এই সম্বন্ধ করবেন না। ”
” ক্যান? মাইয়া কোথাও ফস্টিনস্টি করছে নি অতীতে? ”
” না। মেয়েটা যথেষ্ট পুত পবিত্র। ধার্মিক চরিত্রের। ”
” অ্যা তো ভালা কথা। তয়? ” প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোমেনা বেগম।
” মেয়েটা কথা বলতে পারে না। জন্মগতভাবে বোবা। ”
বিকট শব্দে এক বজ্রাঘাত হলো যেন ঘরে। অবিশ্বাস্য নয়নে হাতে থাকা উক্তি’র ছবিতে তাকালেন মোমেনা বেগম। মাতৃ হৃদয় ক্ষণিকের জন্য হলেও যেন কেঁপে উঠেছিল। ফুলের মতো একটা মেয়ে। বোবা কিনা!
” হ্যাঁ। বোবা। এজন্য তেমন কেউই ওকে ঘরের বউ করতে আগ্রহ দেখায় না। যারাও দেখায় মেয়ের বাবার অর্থ লো ভে দেখায়। ”
দুর্বোধ্য হেসে উঠলেন মোমেনা বেগম। যে হাসির অর্থ সকলের ছিল অজানা। বলে উঠলেন,
” সম্বন্ধ পাডান ওই বাড়ি। এই মাইয়াই হইবো মোর মুয়ীযের বউ। ”
.
জন্মগতভাবে বোবা উক্তি। বাবা, ভাইয়ের চক্ষুশূল। বিয়ের বয়স হয়েছে কিছুটা। ভাই জাওয়াদ তাকে যথাসম্ভব দ্রুত বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে ইচ্ছুক। পাত্রের খোঁজে ঘটককে খবর দেয়া হয়েছে। পাত্র কোনোমতে একটা মিললেই হলো। ভালোমন্দ অত খোঁজ নেয়ার সময় নেই। এতে যদি বোনের জীবনটা নরক হয়ে যায়, যাবে। তাতে তার কিচ্ছু এসে যায় না। শুধু এই মেয়েটা বাড়ি থেকে বিদায় হোক। চোখের অগোচর হোক। এ-ই তার মনোবাসনা। এভাবে তড়িঘড়ি করে উক্তির জন্য পাত্রের খোঁজ চলছিল। খুঁজতে খুঁজতে একজনকে পছন্দ হলো জাওয়াদের। মনে ধরলো। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান সেই পাত্র। উচ্চ শিক্ষিত। শুধু কিছুটা বখে গিয়েছে। বাবার কোম্পানি সামলানোর পাশাপাশি জু য়া খেলে টাকা ওড়ায়। ম-দও খায় মাঝেমধ্যে। জাওয়াদ প্রায় তাকেই সিলেক্ট করে ফেলেছিল বোন জামাই হিসেবে। তখুনি ঘটক সূত্রে মুয়ীয হাসানের বায়োডাটা ও প্রস্তাব পৌঁছালো কায়সার সাহেবের হাতে। কায়সার সাহেব মেয়ের বিবাহ বিষয়ে এতকাল চুপ ছিলেন। এবার এই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রস্তাব পেয়ে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলেন। ঘনিষ্ঠ সূত্র মোতাবেক যথেষ্ট খোঁজ নিলেন। চমকে উঠলেন এই গরীব ছেলেটার জীবনবৃত্তান্ত শুনে! এতটা সৎ, সাহসী, সংগ্রামী এই ছেলেটা! মাশাআল্লাহ্! আজকের দুনিয়ায় এমন সৎ লোক পাওয়াই মুশকিল। সেখানে গরীব ঘরে জন্মে সততার নজির! অসম্ভব প্রায়। পুত্র জাওয়াদ যে কোন ধান্দায় উক্তিকে তড়িঘড়ি করে বিদায় করতে চাইছে তা জানতে বাকি নেই ওনার। তাই এই প্রথমবারের মতো বিচক্ষণ এক সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন উনি। মুয়ীযকে নির্বাচন করলেন উক্তির জীবনসঙ্গী হিসেবে।
জাওয়াদ কথাটা শুনে অত্যন্ত আশ্চর্য হলো! বাবা এ কাকে চুজ করেছে? ফ’কিন্নি ঘরের একটা ছেলে হবে কিনা তার বোন জামাই? নো ওয়ে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদ জানালো জাওয়াদ। তবে তা ধোপে টিকলো না। কায়সার সাহেবের একক সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ বিয়ের সম্বন্ধ ফাইনাল হলো। উক্তির মতামত অবধি নিলো না কেউ। শুধু জানলো মেয়েটা ক’দিন পর তার বিয়ে। এভাবেও বিয়ে হয় বুঝি?
জাওয়াদ প্রথম প্রথম নারাজ ছিল। তবে কিছুদিন বাদে বোধোদয় হলো তার। ফ”কিন্নি এক ছেলে। সবসময় তো তাদের পায়ের তলেই পিষে থাকবে। কখনো মাথা উঁচু করে কিছু বলতে পারবে না। চোখে চোখ মেলাতে পারবে না। আর উক্তি কি এমন তার বোন হয়? খু*নি একটা। ওর জীবন ওই বস্তিতেই নষ্ট হয়ে যাক। গোল্লায় যাক। হি ডাসে’ন্ট কেয়ার। এভাবেই দিন গড়ালো। কায়সার সাহেব মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কোনোরূপ ত্রুটি রাখলেন না। রাখলেন না একমাত্র মেয়ের মনের খোঁজও। এমনই এক পা’ষাণ হৃদয়ের বাপ তিনি। নজিরবিহীন এই সমাজে।
.
মুয়ীয জন্ম থেকেই নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করে চলেছে। আশপাশের নারী ও নারীঘটিত বিষয়ে যথেষ্ট নিরাশা তার। বিয়েশাদী মানুষ করে কেন রে ভাই? খালি অশান্তি আর অশান্তি। মেয়েমানুষ মানেই ঝুটঝামেলা। দিনরাত ভাবী করে হাউকাউ। বুইন করে। এককালে মা-ও করছে। এইসব বিয়েশাদীর কপালে জুতো। তবে পুরুষ মানুষ তো। দিনশেষে রাতের অন্ধকারে একান্ত একজনের অনুপস্থিতি হৃদয়ে দাগ কাটতো যে। পাশে চাইতো কাউকে। যে হবে তার শারীরিক সুখ ও মানসিক প্রশান্তির কারণ। চির সঙ্গিনী। সুখ ও দুঃখের অকৃত্রিম ভাগীদার। একদিন মা এলেন ওর ঘরে। কেমন ভীত, দ্বিধাগ্রস্ত চেহারা। মুয়ীয জানতে চাইলো,
” কি হইছে? মুখ অ্যামন কালা ক্যা? কিছু কইবা? ”
মোমেনা বেগম কোনোরকম ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের কথা বলেই ফেললেন। ছোট ছেলের হাতে তুলে দিলেন পাত্রীর অপরূপ ফটো। তৎক্ষণাৎ প্রাণ নিয়ে পালালেন সে ঘর থেকে। পাছে মুয়ীযের দ্বিরুক্তি না শুনতে হয়। মুয়ীয মায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালো হাতে থাকা এনভেলপে। খুলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবুও উৎসুক মনে এনভেলপ খুলে বের করলো সে-ই ছবি। সালোয়ার কামিজ পরিহিতা এক মায়াবিনীর ছবি। ছবিটি দেখা মাত্রই পৌরুষ হৃদয়ে এক অদম্য আলোড়ন সৃষ্টি হলো যেন। তরঙ্গ বয়ে গেল শিরায় উপশিরায়। বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো মুয়ীয! বোধহয় সে ক্ষণে, সেই লগ্নে উক্তিতে ফেঁ’সে গেল অনন্তকালের জন্যে। বিয়েশাদী করতে অনিচ্ছুক মনটাও বেয়াড়া হয়ে উঠলো। পাত্রী সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর নিলো না। প্রয়োজন বোধ করলো না। মায়াবী মুখের সরলতাই তার মন ছুঁয়েছে যে। এই মেয়ে অন্তত বিনাশিনী, ঝগড়ুটে হতে পারে না। সংসারে সুখ ও শান্তি বয়ে আনবে এ। ইনশাআল্লাহ্ ইনশাআল্লাহ্।
বিয়েতে মতামত দিয়ে দিলো মুয়ীয। বড়লোক শ্বশুরবাড়ি তাতে কি হয়েছে? সে তাদেরটা খেতে যাবে না পড়তে যাবে? বউ হলেই হলো। শ্বশুরবাড়ির ধার ধারে না সে। বেপরোয়া মনটা ভালোমতোই ফেঁ’সে গিয়েছে উক্তির তরে। তবে উক্তি’র চরম সত্যি অজানা রয়ে গেল তার। মোমেনা বেগম যথেষ্ট চতুরতার সহিত সত্যিটা গোপন করলেন। কেন করলেন? কারণ ওই সোনার ডিম পাড়া বোবা হাঁসটাই চাই তার। বড় বউ তো আস্ত বেয়াদব জুটেছে। মুখে মুখে তর্ক করে খালি। আর এটা? বোবা। শব্দ বাণে কোটি বার জর্জরিত করলেও মুখ ফুটে এক বর্ণ বেরোবে না। মূক রইবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অতিরিক্ত শান্ত মেয়েটা। এমন মেয়েই তো হয়ে থাকে পারফেক্ট ডটার ইন ল ম্যাটারিয়াল। এদের ওপর নিজের স্বৈ*রাচারীতা খুব ভালো মতোই ফলানো সম্ভব। যা খুশি তাই বলা যায়। শক্ত হাতে সংসারের রাজত্ব চালানো যায়। এর ওপর বোনাস স্বরূপ মেয়েটা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই বাপের বাড়ি থেকে ঘনঘন জুটবে এটা ওটা। ওনাদের ভবিষ্যৎ বদলে যাবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। আহ্! শান্তিই শান্তি। মোমেনা বেগমের কলুষিত মনটা যেন ইন্ডিয়ান টিভি সিরিয়ালের ‘ কোকিলা মোদী ‘ রূপে রুপান্তরিত হলো। তাই তো সর্বোচ্চ রাখঢাক করে মুয়ীয, উক্তি’র বিয়েটা হয়েই গেল। যেহেতু মুয়ীয বিয়ের পূর্বে উক্তির সঙ্গে দেখা করেনি। কিংবা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। তাই জানতেও পারেনি উক্তি’র চরম সত্য। সত্য কি আর চাপা থাকে বেশি কাল? শেষমেষ সত্যি বেরিয়েই এলো মুয়ীযের সামনে। বাসর রাতেই মুয়ীয পেল জোর কা ঝটকা! বোবা তার বউ। রূপসী এ কন্যা জানে না কথা বলতে। জন্মগতভাবে বোবা সে।
উক্তি নামক মেয়েটি বোবা। তবে চরিত্রহীন কিংবা ঝগড়ুটে স্বভাবের নয়। তার সরলতা, উত্তম আখলাকের দরুণ যে কারো মন জয় করতে জানে। স্বামীর মনে চিরস্থায়ী বসত গড়লো সে বড় যতনে, আদরে। বিনিময়ে পেল এক সমুদ্র প্রণয়ের ঠিকানা। দু’জনে হয়ে উঠলো একে অপরের পরিপূরক। শারীরিক সুখ ও মানসিক শান্তির উৎস। একে অপরের চির সঙ্গী তারা। দু’জনের অবদানে তৈরি হয়েছে আজকের এই ‘ ভালোবাসার সংসার। ‘
<-------------- চলবে।