তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0
287

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#অন্তিম_অধ্যায়

গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ট জনজীবন। রৌদ্রের তেজদীপ্ত উত্তাপে পু’ড়ছে আশপাশ। বাতাসের দেখা নেই বহুকাল। চারপাশে ধূ ধূ নীরবতা আর ভ’য়ঙ্কর হাতছানি। অশরীরী কে যেন ডেকে চলেছে। এই তো মাত্র গা ছুঁয়ে পেরিয়ে গেল। এমনই তনু মন হীম করা পরিবেশ সেটি। গা ছমছমে সে-ই নীরব স্থানে সম্পূর্ণ একাকী বসে এক ব্যক্তি। হাতে ধরে একটি বেরঙিন ছাতা। সে ছাতার ছায়াতলে আবৃত করে রেখেছে নিজের জান’কে। পাছে তার জান উত্তপ্ত রোদে কষ্ট না পায়। মানুষটি আলতো করে হাত বুলিয়ে চলেছে মাটির ওপর। সাড়ে তিন হাত এই মাটির নিচেই শুয়ে যে তার ভালোবাসা। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সঙ্গীকে আরাম দিচ্ছে সে। একাকী বিড়বিড় করে কত কি বলছে। পড়নে থাকা দামী শার্টটা রৌদ্রে চিকচিক করছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে নামছে গলা বেয়ে আরো নিচে। শার্টের অন্তরালে। কবরের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে সে জানাতে লাগলো পরিবারের হালচাল। তাদের সন্তানের খোঁজখবর। মাতৃহারা কেমন আছে ওরা। ওরা.. ওরা ভালো নেই। ভালো নেই সে নিজেও। প্রতিটি মূহুর্ত দ’গ্ধ অনলে পু’ড়ছে সে। অতিশয় কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। গলা ফেটে আসে অসহনীয় যন্ত্রনায়। শতাধিক ছু`রি যেন একত্রে চিঁড়ে ফুঁড়ে যায় হৃৎপিণ্ডে। র`ক্তাক্ত হৃদয়ে বেঁচে আছে সে। শুধুমাত্র সন্তানের জন্যে। মা নেই ওদের। এখন বাবাও যদি হারিয়ে যায়। অনাথ ওরা সমাজে লা`থি উস্টা খেয়ে ম`রবে। এই কঠিন বাস্তবতায় সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বে। ওদের জন্য হলেও তাকে বেঁচে থাকতে হবে। নিজ সত্তার সঙ্গে কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। রবের ইবাদত বন্দেগী করতে হবে। অন্যথায় বৃথা এই জীবন। ব্যর্থ আ’ত্মা। পরকালে কড়া হিসাবনিকাশ, জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। তখন কি জবাব দেবে সে? পরাজিত সৈনিকের মতো আ’ত্মহনন করেছে? নাহ্। লড়তে জানে সে। সে-ই শিশুকাল হতে। লড়েছে চিরটা কাল। ইনশাআল্লাহ্ ভবিষ্যতেও লড়াই চালিয়ে যাবে। হারবে না সে। জয়লাভ করবেই করবে।

মানুষটি আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো কবরে। নিচু হয়ে চুমু খেল চিরনিদ্রায় শায়িত ভালোবাসার মরহুমা সঙ্গিনীকে। দু চোখের কার্নিশ তখন নোনাজলে থৈ থৈ। কণ্ঠনালীতে চাপা পড়েছে একদলা হাহাকার।

‘ কেমন আছো?
আমি প্রতিক্ষণ খুঁজি তোমাকে
কেন এসেছিলে অসমাপ্ত গল্পের বেশে
কেন মিশে গেলি আমার অভ্যাসে
রোজ ছিল দু’জনের কতো কথার হিসেব নিকেশ
তবে কেন অবেলায় আমাদের এই গল্প শেষ? ‘
[ সংগৃহীত ]

••••

মৃদু অন্ধকারাচ্ছন্ন সে ঘরটি। জানালায় ভারী পর্দা ভিড়িয়ে রাখা। বহিরাগত আলো ঘরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ। হাতে ফটো অ্যালবাম নিয়ে বসে একজন। সেথায় দৃশ্যমান এক মানবীর হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী। মানবীর পাশে দাঁড়িয়ে শ্যামবরণ এক সুপুরুষ। প্রবল আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন এক পুরুষ। জীবনসঙ্গী হয় সে মানবীর। নাম তাদের মোঃ মুয়ীয হাসান এবং মিসেস উক্তি কায়সার। ফটো অ্যালবাম হাতে থাকা অজ্ঞাত মূর্তি ছবিতে এলোমেলোভাবে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। চোখ বুজতেই গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা বেদনা। বক্ষ গহ্বরে অসীম পীড়ন হচ্ছে তার। ঠোঁট কামড়ে নীরবে কেঁদে চলেছে। অস্ফুট স্বরে কান্নার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। যা চাপা পড়ে যাচ্ছে এই চার দেয়ালের অভ্যন্তরে।

” মুক্তি! মুক্তি! ”

পুরুষালী কণ্ঠে একজন ডাকতে ডাকতে ঘরের দরজা উন্মুক্ত করে ভেতরে প্রবেশ করলো। আধুনিক হুইলচেয়ারে বসে থাকা মেয়েটি সে ডাক যেন শুনতেও পেল না। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মুয়ীয, উক্তির ফটোতে। নীরব কান্নায় লিপ্ত। চোখের ভাষা অর্থহীন। মেহরাব এসে দাঁড়ালো ছোট বোনের পাশে। মুক্তি মা-বাবার ফটো হাতে নিয়ে কাঁদছে। কান্নায় ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। মেহরাব তা লক্ষ্য করে করুণ হাসলো। আস্তে করে হাঁটু ভেঙে বসলো বোনের হুইলচেয়ারের পাশে। হাতে থাকা ফটো অ্যালবামটি নামিয়ে রাখলো বোনের কোলে। অকস্মাৎ এমন পরিবর্তনে মুক্তি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো এদিকে। ভাইয়ের দিকে। মেহরাব হাসিমুখে ওর গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুবিন্দু মুছে নিলো। মাথা নেড়ে বললো,

” কাঁদে না বনুই। কাঁদলে মা-বাবা কষ্ট পাবে যে। ”

মুক্তি কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। অতঃপর অস্ফুট স্বরে কি ভেবে যেন বলে উঠলো,

” ক-ষ্ট! ”

” হ্যাঁ কষ্ট। আমাদের মুক্তি তো গুড গার্ল। সে কাউকে কষ্ট দিতে পারে না। কি? পারে? ”

” ক-ষ্ট। ”

অস্পষ্ট স্বরে আনমনে কিছু বলে চলেছে মুক্তি। মেহরাব কিছু বললো না এর বিপরীতে। বোনটার মন অন্যদিকে ঘুরেছে এ-ই অনেক। আপাতত মেয়েটা একাকী এভাবে কথা বলবে। কাঁদতে ভুলে যাবে। যাক। বনুইয়ের চোখে অশ্রুজল বড্ড বেমানান। বুকের ভেতরটা ফালাফালা করে দেয় যেন। মেহরাব ফটো অ্যালবাম হাতে উঠে দাঁড়ালো। অ্যালবামের ফটোতে তাকিয়ে রইলো কিছু মুহূর্ত। অন্তরে কান্নারা উঁকি দিতেই শুকনো ঢোক গিললো সে। আলতো করে মা-বাবার ছবিতে হাত বুলিয়ে দিলো। চুমু খেল পরপর দু’বার দুইজনের মুখে। প্রকৃত না হোক কৃত্রিম এ ছোঁয়াতেই তৃপ্ত হলো মন। কান্নারা পুনরায় দল বেঁধে আক্রমণ করতে চাইছে যেন। ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল মেহরাব। নিজেকে দক্ষভাবে সামলিয়ে অ্যালবামটি বন্ধ করে সযত্নে রাখলো কাবার্ডের ভেতরে। কাবার্ড বন্ধ করে ফিরে এলো ছোট বোনের কাছে। মুক্তি তখনো একাকী বলে চলেছে কিছু। সরলতায় ভরা মুখখানি। দেখলেই মায়া হয়। তবে করুণা নয়। মেহরাব বোনের মাথায় স্নেহের চুম্বন এঁকে দিলো। এরপর হুইলচেয়ারে বসে থাকা বোনকে নিয়ে অগ্রসর হলো লিভিংরুমের উদ্দেশ্যে।
.

বিশালাকার জায়গা জুড়ে অবস্থিত লিভিংরুমটি। রুমের আনাচে কানাচে শৌখিন আভিজাত্যের ছোঁয়া। দেশীয় মৃৎশিল্প, হস্তশিল্পের নিদারুণ রূপে সজ্জিত এই লিভিং রুম। বিদেশি আসবাব বা গৃহ সজ্জার সামগ্রীর উপস্থিতি নগণ্য। ময়না সোফায় বসে। পড়নে দামী শাড়ি। তবে অঙ্গভঙ্গিতে স্পষ্ট নিরহংকার। সে টি-পট হতে চা ঢেলে দিচ্ছে শুভ্র রঙা আকর্ষণীয় কাপে। পাশের সোফায় পাশাপাশি বসে জাওয়াদ এবং নিশাত। বয়সের ছাপ পড়েছে দু’জনের গড়নে। বয়স তো কম হলো না। পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে সে-ই কবে। এক কন্যা সন্তানের প্যারেন্টস হয়েছে। বিয়ে দিয়েছে তার। জাওয়াদ এখন ষাট বছরের এক বয়স্ক ব্যক্তি। আর ময়না ষাটোর্ধ্ব নারী।

” এই যে ভাই তোমার চা। ”

ময়না চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলো। জাওয়াদ আন্তরিকতার সহিত চায়ের কাপ হাতে নিলো। এরপর নিলো নিশাত।

” তা কি অবস্থা তোমাদের বলো? তালই মশাই কেমন আছেন? ”

জাওয়াদ বললো,

” এই তো আছেন আলহামদুলিল্লাহ্। বয়স হয়েছে না? শয্যাশায়ী। এই ভালো এই খারাপ। ”

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ময়না দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

” হ্যাঁ। বয়স হয়েছে তো। ভালোমন্দ মিলেই জীবন কাটবে। খেয়াল রেখো ওনার। কোনোরকম অসুবিধা হয় না যেন। ”

” হু। ”

তেমনি মূহুর্তে ছোট বোনকে হুইলচেয়ারে সঙ্গে নিয়ে লিভিংরুমে উপস্থিত হলো বছর আটাশের মেহরাব। এসেই মামাকে দেখে আনন্দিত হলো। সে আনন্দ ঝড়ে পড়লো কণ্ঠে,

” হেই মামু! আসসালামু আ’লাইকুম। কখন এলে? ”

” ওয়া আ’লাইকুমুস সালাম ভাগ্নে। এই তো পাঁচ মিনিট হয় এসেছি। কেমন আছো বলো? ”

স্নেহের ভাগ্নেকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করলো জাওয়াদ। মেহরাব-ও জড়িয়ে ধরে হাসিমাখা কণ্ঠে বললো,

” এই তো আছি আলহামদুলিল্লাহ্। তোমরা কেমন আছো? নানাভাই? ”

” আলহামদুলিল্লাহ্ অল গুড। ”

নিশাতের সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো মেহরাবের। মুচকি হেসে নিশাত হাত বুলিয়ে দিলো অসুস্থ ভাগ্নির মাথায়। মুক্তির এসবে ধ্যান নেই। সে আপাতত বসে ফুপির পাশে হুইলচেয়ারে। একমনে কুকিজ খাচ্ছে উনিশ বছরের মেয়েটা। বেশ সুস্বাদু কুকিজ কিনা। ময়না বেদনাময় হাসিতে তাকিয়ে ভাতিজির দিকে। ইতিহাসের এমন করুণ পুনরাবৃত্তি হওয়ারই ছিল কি?? সব এক হয়েও যেন ভিন্ন। উক্তির মতো পরিণতি হতে গিয়েও হলো না কনিষ্ঠ সন্তান মুক্তির। শেষমেষ এই ছিল তাদের তাকদীরে…?

<--------- প্রথম সন্তান মেহরাব জন্মের পর খুশির ঢল নেমেছিল মুয়ীযের পরিবারে। হাসিখুশি, সুখেদুঃখে কাটছিল দিনগুলো। মাংসের দোকান দিয়েছে মুয়ীয। গরুর মাংস ও খাসির মাংস বিক্রি করা হয় সেথায়। প্রথম প্রথম ধৈর্য্যের প্রচুর পরীক্ষা দিতে হয়েছে। লাভ হচ্ছিল না তেমন। অতঃপর বছর কয়েক বাদে ধরা দিলো কাঙ্ক্ষিত সফলতা। হুরহুর করে বৃদ্ধি পেতে লাগলো মুনাফা। বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে অর্থ সঞ্চয় করতে লাগলো মুয়ীয। স্বল্প মূল্যে কিনে ফেললো একটি জমি। আল্লাহ্'র অশেষ রহমতে আর্থিক সচ্ছলতা আসতে লাগলো সংসারে। এদিকে বাবা ও মেয়ের মধ্যে চলমান অকথ্য অভিমান, অভিযোগ এখন প্রায় সমাপ্তির পথে। উক্তি আজকাল স্বাভাবিক আচরণ করছে বাবা, ভাইয়ের সঙ্গে। আর কতকাল এই নীরব লড়াই, অভিমান চলবে? ক্ষণস্থায়ী মানবজীবন। আজ আছি তো কাল নেই। এরমধ্যে সবটা মিটমাট করে নেয়াই শ্রেয়। বয়স্ক বাবাকে আর কত কষ্ট দেবে সে? এত বছর ধরে অনুশোচনার আগুনে পু'ড়তে পু'ড়তে খাঁটি হয়েছে পিতৃ ভালোবাসা। সে তো অপয়া, অলক্ষ্মী নয়। নম্র, ভদ্র, ধার্মিক চরিত্রের এক মেয়ে। তার দ্বারা এত অসদাচরণ বেমানান যে। মেয়ের থেকে পাওয়া স্বাভাবিক আচরণে তুষ্ট হয়ে বড় আবেগী হয়ে পড়তেন কায়সার সাহেব। জীবনটা এত সুন্দর কেন? কেন এত ক্ষণস্থায়ী? সময়ের পরিক্রমায় উক্তি কায়সার স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একদা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, সেখানেই এখন প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছে মেয়েটা। এছাড়াও একটি এনজিওতে কাজ করছে সে। বোবা হওয়া তার দুর্বলতা হতে পারেনি। নিজ প্রচেষ্টায় এবং স্বামীর দৈনন্দিন অনুপ্রেরণায় আজ এই অবস্থানে সে। আল্লাহ্'র রহমতে সবটাই প্রাপ্ত। উক্তি এখন সেলাইয়ের কাজ পারে সুনিপুণ ভাবে। বিভিন্ন রকমের মৃৎশিল্প, হস্তশিল্পের কাজ শিখে নিয়েছে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সে এখন বিশাল বড় ভূমিকা রাখে। তার হাতে তৈরি পণ্যসামগ্রী বিক্রি হয় শহরের বিভিন্ন স্থানে। বেশ কদর রয়েছে সেসব মাটির তৈরি জিনিসপত্র এবং হাতে তৈরি পণ্যসামগ্রীর। মুয়ীয গর্বিত। স্ত্রীর এমন সফলতায় সে সত্যিই গর্বিত। মূক হতে পারে তার হৃদয়েশ্বরী। তবে কারোর বোঝা নেয়। মেহরাবের বয়স তখন দশ বছর। দ্বিতীয়বারের মতো মা হতে চলেছে উক্তি। তবে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। হৃদয়বিদারক! মা হবার সংবাদ নিশ্চিত হবার ঠিক এক সপ্তাহ পূর্বে উক্তির ডায়বেটিস ধরা পড়লো। অন্তঃসত্ত্বা সে। এছাড়াও শরীরে বাসা বেধেছে ডায়াবেটিস। অকূলপাথার অবস্থা মেয়েটার। গর্ভবতী অবস্থায় ডায়বেটিস মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। এছাড়াও তার উচ্চ র'ক্তচাপ রয়েছে। খুশির সংবাদে এবার মোটেও খুশি হতে পারলো না উক্তি। মুয়ীয চিন্তায় পড়ে গেল। একমাত্র মেয়ের অদূর ভবিষ্যত চিন্তা করে ভয়ার্ত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কায়সার সাহেব। দেখতে দেখতে করুণ দিনগুলো অতিবাহিত হতে লাগলো। উক্তির অবস্থা দিনকে দিন নাজুক। গর্ভের সন্তান কষ্টে দিনযাপন করছে। মা হয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা সত্ত্বেও ব্যর্থ উক্তি। ব্যর্থ মুয়ীয। অবশেষে বহু জটিলতা পার করে আকাঙ্ক্ষিত দিন এলো। কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো উক্তি। তবে ইতিহাসের নি'র্মম পুনরাবৃত্তি হলো যেন। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দিয়েছে সে। এছাড়াও নবজাতকের পায়ে সমস্যা রয়েছে। হাঁটতে পারবে না। যদি না রবের ইশারায় কোনো মিরাকল ঘটে। গর্ভবতী মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং উচ্চ র'ক্তচাপের দরুণ মুয়ীয, উক্তির কনিষ্ঠ সন্তানের এই পরিণতি। নবজাতক মেয়েকে বুকে আগলে উক্তি হুঁ হুঁ করে কাঁদলো অনেকটা সময় ধরে।‌ আবারো। আবারো কেন হলো তাদের সঙ্গে এমনটা? মায়ের গর্ভকালীন জটিলতার ফলস্বরূপ বোবা হয়ে জন্মেছে সে। পেয়েছে বাবা, ভাইয়ের তীব্র তিরস্কার। হয়েছে জন্মগতভাবে মাতৃহারা। আজ তার সন্তান? সে-ও একই ভাগ্য নিয়ে জন্মালো? তবে কি ওর কপালেও এই সমাজের তিরস্কার জুটতে চলেছে? অপয়া, অলক্ষ্মী, প্রতিবন্ধী, বলদ বলে ডাকবে সকলে? না। নাহ্। প্রয়োজনে সে এই খুদে প্রাণটিকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে। ওকে... ওকে সমস্ত প্রতিকূলতার হতে রক্ষা করবে। তবুও ফুলের টোকাও লাগতে দেবে না বাচ্চা মেয়েটার গায়ে। উক্তি যখন কন্যার ভবিষ্যৎ চিন্তায় দিশেহারা। তখন ঢাল হয়ে দাঁড়ালো জীবনসঙ্গী মুয়ীয।‌ বরাবরের মতই মানুষটি তার হতবুদ্ধি জান'কে আগলে নিলো। যথাযথ ভাবে মানসিকভাবে উদ্দীপনা জোগাতে লাগলো। এবার এই মানসিক লড়াইয়ে প্রত্যক্ষভাবে সঙ্গী হলো জাওয়াদ এবং কায়সার সাহেব। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না তারা। উক্তি'র মেয়ে মুক্তি সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচবে আর দশটা শিশুর ন্যায়। অত্যাধুনিক চিকিৎসা করানো হবে ওর। যদি আল্লাহ্ সহায় হন তো তবে একদিন না একদিন সুস্থ হয়েও উঠবে। তবে দ্বিতীয় উক্তি কিছুতেই জন্ম নেবে না। উক্তি'র মতো মুক্তির জীবনটা বি-ধ্বস্ত হবে না। সে পাবে। ছোট-বড় সকলের স্নেহ, ভালোবাসা পাবে।‌ ওর পরিবার সদা সর্বদা ঢাল হয়ে থাকবে ওর। ইনশাআল্লাহ্ ইনশাআল্লাহ্। এভাবেই দিনকাল কাটছিল।‌ আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর ন্যায় পরিবারের সদস্যদের যত্ন, স্নেহ, ভালোবাসা পাচ্ছিল শিশু মুক্তি। মুয়ীযের আর্থিক অবস্থায় তখন কিছুটা ডাউন চলছিল।‌ বড় লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে মুয়ীয। সম্প্রতি একটা ছোটোখাটো রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করেছে সে। প্রথম মাসে বড় লোকসান হয়েছে। সেই নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিল মানুষটা। কোথা থেকে কোথায় পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে ভুল হলো তা নিয়ে হিসাবনিকাশ কষে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই দোরগোড়ায় দেখা দিলো নতুন বিপদ। কথায় বলে না ' বিপদ আসে যখন চারপাশ থেকে একসাথে আসে। ' ঠিক তাই হলো। স্ত্রী উক্তি'র কিডনি সমস্যা ধরা পড়েছে। কিডনিতে ক্রিয়েটিন নামক পদার্থ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও পূর্ব থেকে রয়েছে ডায়বেটিস, উচ্চ র'ক্তচাপ। ফলস্বরূপ বিকল হয়ে যাচ্ছে কিডনি। প্রথম প্রথম এই সমস্যা ধরা পড়েনি। লক্ষণ টের পায়নি উক্তি কিংবা পরিবার। যতদিনে টের পেয়েছে ততদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এবার ওর ডায়ালাইসিস করতে হবে। [ মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর শরীরে শারীরিক বিপাকের ফলে যে বর্জ্য তৈরী হয় তা শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য ছাঁকনি হিসেবে কিডনি কাজ করে। কিডনি শরীরে প্রবাহিত সমস্ত র'ক্ত ছেকে পানির সাথে মিশিয়ে মূত্র হিসেবে শরীরের বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। কোন কারণে কিডনি নষ্ট হলে কিডনির পরিবর্তে কৃত্রিম ছাঁকনি ব্যবহার করে তার মধ্যে দিয়ে শরীরে প্রবাহিত সমস্ত র'ক্ত ছেঁকে শরীর থেকে বর্জ্য বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয় ডায়ালাইসিস্। তথ্যসূত্র- ইন্টারনেট ] ধীরে ধীরে উক্তির শরীরটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। নিজের অন্তিম সময়ের অপেক্ষায় দিন গুনছিল বোধহয়। মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। অতিরিক্ত চুপচাপ। সমস্ত চঞ্চলতা হারিয়ে গিয়েছে কোথাও। সন্তান, এই পরিবার, স্বামী সবেতে উদাসীন। দিনরাত দক্ষিণা জানলায় মাথা ঠেকিয়ে কিংবা কখনো দুর্বল হাতে গ্রিল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওই সুবিশাল আকাশ পানে চেয়ে থাকে। বেদনামথিত সে করুণ দৃষ্টি। পাখিদের কিচিরমিচির শোনে। গান শোনে ওদের। আজ আর ওদের কিচিরমিচির গান বিমোহিত করে না ওকে। আজ আর ওই বিশাল আকাশের বুকে চলতে থাকা মেঘ নিয়ে ভাবনায় ডুবে না সে। আনমনে কি থেকে কি যেন ভাবতে থাকে। অনবরত জিকির করে মনে মনে। বারবার কুরআন তেলাওয়াত করে। তাহাজ্জুদের নামাজে শেষ রাতের অনেকটা সময় অতিবাহিত করে। ওর এই অস্বাভাবিক আচরণ, অদ্ভুদ নীরবতায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল মুয়ীয। কি হয়েছে ওর হৃদয়েশ্বরী'র? কেন এমন মৃ-ত্যু পথযাত্রী ব্যক্তির ন্যায় আচরণ করছে? সে কি স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতে চলেছে মৃ-ত্যুকে? এসবের মানে কি? পাগলপারা অবস্থা মানুষটির। দু হাতের মুঠোয় চুল আঁকড়ে ধরে একাকী চিৎকার করে ওঠে। উক্তিকে সামলাতে ব্যর্থ সে।‌ ব্যর্থ। মেয়েটা কিছুতেই আর স্বাভাবিক হচ্ছে না। দিনকে দিন নিথর দেহে রূপান্তরিত হচ্ছে। জিন্দা এক লা'শ। যে বেঁচে আছে। শ্বাস নিচ্ছে। খাচ্ছে। পড়ছে। তবুও যেন প্রাণহীন আ'ত্মা। " আঃ....! " অন্ধকার বিস্তীর্ণ-শূন্য ওই আকাশ পানে মুখ করে অট্ট চিৎকার করে ওঠে মুয়ীয। বেদনা ঝড়ে ঝড়ে পড়ে তার কৃষ্ণকালো দু'চোখ বেয়ে। উক্তি'র ডায়ালাইসিস চলছে। সপ্তাহে দুইদিন করে। চার ঘন্টা ব্যাপী চলে এই কার্যক্রম। সপ্তাহের এ দু'টো দিন উক্তির ছায়াসঙ্গী হয়ে বাঁচে মুয়ীয। বাচ্চাদের মায়ের তত্বাবধানে রেখে উক্তিকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে বেড়ায়। মেয়েটার বাম হাতে ফিস্টুলা করা হয়েছে। হাতে সে কি ব‌্যথা! বাম হাতটা যেন কেউ আঘাত করে থেঁতলে দিয়েছে। ওই হাতে ছোট-বড় কোনোরকম কাজকর্ম করা দায়। অসাড় লাগে। হাতটাকে। গোটা আমিটাকে। ডায়ালাইসিস চলাকালীন সময়ে মেয়েটা একদম নীরব হয়ে থাকে। কখনোবা চোখ বন্ধ করেই কাটায়। ওকে আজকাল চক্ষু বন্ধ অবস্থায় দেখলে মুয়ীযের ভয় হয়। অন্তর কেঁপে ওঠে। উক্তি তা ঠিক উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই তো একদিন হাত নাড়িয়ে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভাষায় বললো, ' ভয় নেই গো। হারিয়ে যেতে এখনো কিছুদিন বাকি যে। ' মেয়েটা এতবড় নি'ষ্ঠুর কথা কি করে বললো? পারলো কি করে? ও কি ম-রে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে? মুয়ীয এবং ওদের সন্তানদের একাকী ফেলে পালিয়ে যেতে চাইছে? স্বার্থপর, হৃদয়হীনা নারী! মুয়ীয হনহন করে সেথা হতে প্রস্থান করলো। তবে উক্তি ঠিকই লক্ষ্য করলো মানুষটার চোখে ভাসমান বাষ্পের উপস্থিতি। মেয়েটা আস্তে করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। চক্ষু বুঁজে নিতেই গড়িয়ে পড়লো যন্ত্রনার জলীয় রূপ। কতক্ষণ যে গড়িয়ে গেল জানা নেই। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল উক্তি। সহসা ক্ষীণ কোনো শব্দে তন্দ্রা ভাব ভঙ্গ হলো। চোখ তুলে তাকালো উক্তি। ঘাড়টা স্বল্প ঘুরিয়ে তাকালো ডানে। বেডের ঠিক পাশেই উঁচু টুলে বসে মুয়ীয। একমনে সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে চলেছে। ডায়ালাইসিস চলাকালীন দুর্বল শরীরের জন্য সিদ্ধ ডিম খুবই উপকারী। তাই তো ডায়ালাইসিসের এই দিনগুলোতে মুয়ীয চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্ত্রীর জন্য যথাসম্ভব পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করে। নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দেয়। আজও তাই করবে। রাগ হোক কিংবা অভিমান। যত্ন নিতে ভুলবে না। ভালোবাসতে ভুলবে না এই পা'গলটা। ওর একান্ত পা'গলটা। নিম্ন ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো উক্তি। এই পা'গলটিকে ছেড়ে, ওদের সন্তানদের ছেড়ে কি করে ওই অন্ধকার কবরে পাড়ি দেবে সে? হে আল্লাহ্! তুমি কি একটু সহায় হতে পারো না? নীরব রোদনে লিপ্ত উক্তি। সবটা জেনে, বুঝেও নিশ্চুপ মুয়ীয। তার ব্যস্ত হাত দু'টো সেই কখন থেমে গিয়েছে। একফোঁটা নোনাজল টুপ করে গড়িয়ে পড়লো কোলে। . পূর্ণিমার রাত ছিল সেবার। অর্ধ উন্মুক্ত জানালা গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে শিরশিরে হাওয়া। চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল ঘরটা। ঘুমের ঘোরে শীত শীত ভাব অনুভব করে হালকা জেগে উঠলো মুয়ীয। পায়ের কাছে থাকা পাতলা কাথাটি পা দিয়েই টেনে নিলো। গায়ে জড়াতে চাইছিল। তবে হচ্ছিল না কিছুতেই। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো মুয়ীয। বিশ্রী একটা গালি দিয়ে কাঁথা জড়িয়ে নিলো শরীরে। যেই না শুতে যাবে অমনি আঁতকে উঠলো আকস্মিক! এ কি? পাশে থাকা স্ত্রীর শরীরটা এমন হীমশীতল হয়ে রয়েছে কেন? ও কি অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে? পা'গলী মেয়েটা। শীত করছে তবুও গায়ে কাঁথা জড়াবে না। মুয়ীয একাকী বিড়বিড় করে স্ত্রীর গায়ে কাঁথা জড়ানোর উদ্দেশ্যে একটুখানি ঝুঁকে যেতেই সবটা চোখের তারায় স্পষ্ট ধরা দিলো। চাঁদনী রাতের আলোয় সে সাক্ষী হলো এক হৃদয় বিদীর্ণ করা মুহূর্তের। সেকেন্ডের মধ্যেই লক্ষাধিক ওজনের ভারী পাথর যেন বুকটা পিষে পিষে থেঁতলে ফেললো। কণ্ঠনালী কাঁপছে। কিছু বলতে চাইছে সে। ডাকতে চাইছে ওর জান'কে। তবে আজ চূড়ান্ত পর্যায়ে অবরুদ্ধ শব্দনালী। মুয়ীয ফ্যাসফেসে গলায় কি যেন বলে উঠলো। ডাকলো বুঝি। সে-ই জাদুময়ী ডাক! ' বউ! ' তবে। তবে আজ আর কেউ সাড়া দিলো না। সম্মোহনী এই কণ্ঠের সম্মোহনে কেউ ব'শীভূত হলো না। হলো না তাদের বিশেষ মূহুর্ত। শক্ত সামর্থ্য পুরুষটার হাত আজ কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতে সে স্ত্রীর মাথায় হাত রাখলো। আলতো করে একবার বুলিয়ে দিলো। কপালে না সময় নিয়ে চুমুও খেল। তবে স্বার্থপর মেয়েটা একদম সাড়া দিলো না। চির জনমের মতো ওই যে চুপ করেছে, সেটাই জারি রাখলো। কেমন পা'ষণ্ড রে! মুয়ীয জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। অশ্রুসজল চোখে আকুতি জানালো ওকে উঠতে। সাড়া দিতে। এই মেয়ে। শেষ রাত তো এখন। তাহাজ্জুদ পড়বে না? রবের ইবাদত করবে না? ওঠো না। ওঠো। কতক্ষণ ডাকলো মুয়ীয। ধৈর্য্যের পরীক্ষাও দিলো। দ্রুততার সহিত ঝাঁকুনি দিয়ে ঠাণ্ডায় হিমায়িত শরীরটা নাড়াতে লাগলো। জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। সেই ডাক ধীরে ধীরে চেঁচানোতে পরিণত হলো। স্ত্রীকে জোরালো আলিঙ্গন করে বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেললো মানুষটা। নিথর মেয়েটির হাত দু'খানা আজ আর স্বামীকে আগলে নিলো না। বরং অসাড় হয়ে লুটিয়ে পড়লো বিছানায়। মুয়ীয অবচেতন মনে মাথা নেড়ে চলেছে। যাবে না। তার বক্ষ পিঞ্জর ত্যাগ করে জান কোথাও যাবে না। ওকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার সহিত লুকিয়ে রাখবে এই বুকেতে। মুয়ীয ডেকেই চলেছে স্ত্রীকে। কান্নার আক্রমণে গলার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। কোনো শব্দ বেড়োতে চাইছিল না। অস্ফুট স্বরে প্রকাশ পাচ্ছিল তীব্র যন্ত্রণা আর হারানোর পীড়ন। ' তুমি আমার সোনা পাখি আদর সোহাগ রাখি একলা করে চলে গেলে ক্যামনে বলো বাঁচি? একলা করে চলে গেলে ক্যামনে বলো বাঁচি....? [ অ্যালবাম - এই বুকেতে কেউ থাকে না ] ময়না উঠেছিল সে রাতে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। আকস্মিক ভাইয়ের ঘরে এমন চেঁচামেচি। ছুটে এলো দরজায়। অসুস্থ ভাই বউয়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে দরজায় কড়া নাড়লো। মূহুর্তের মধ্যেই খুলে গেল স্বল্প বন্ধ দরজা। ময়না দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এসে যা দেখলো পিলে চমকে উঠলো তার! " উক্তিহ্.....! " --------- >

পুরনো স্মৃতিচারণ করে ময়নার চক্ষু ভিজে উঠলো। সকলের অলক্ষ্যে শাড়ির আঁচলে মুছে নিলো অশ্রু কণা। সে-ই পূর্ণিমা রাতের আলোয় ময়না দেখেছিল অপ্রত্যাশিত এক নিথর দেহ। এই নিয়ে তিনবার। খুব কাছ থেকে দেখলো নশ্বর এই দেহের নিথর রূপ। প্রথমে নিজের জন্মদাতা পিতা। দ্বিতীয়ত স্বামী নামক ন*রপশুটার নিজ বাসভবনে দেয়াল চাপা পড়ে করুণ মৃ ত্যু। যা আজো রহস্যময় হয়ে রয়েছে। থাক না কিছু রহস্য প্রকৃতির বুকেই ধামাচাপা। আর সেই বার দেখলো স্নেহের ছোট ভাই বউয়ের নিথর রূপ। ঘুমের ঘোরে শেষ রাতের দিকে রবের ডাকে সাড়া দিয়ে, মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে চলে গিয়েছিল উক্তি। হার্ট অ্যাটাকে মৃ*ত্যু। মুক্তি তখন বছর তিনের অবুঝ শিশু। স্ত্রীর অপ্রত্যাশিত ইন্তেকালে ভাইটা কেমন যে বদলে গেল! খায়দায়, সন্তানদের যত্ন নেয়। বাঁচে। তবে একপ্রকার জীবিত লা’শ হয়ে। রাতের ঘুম তো সেই কবেই হারিয়েছিল। ময়না একবার কোনো এক বইয়ে পড়েছিল উক্তিটি। আজ আবার খুব করে মনে পড়লো,

‘ কিছু মানুষের জীবনে সুখ হলো হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। এক ছোঁয়াতেই বিলীন। ‘

ভ্রাতা বধূ উক্তির জীবনটাও যেন এমনই। জন্ম থেকেই অবহেলা, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা। অবশেষে বহু বছর বাদে ধরা দিলো সুখের হাতছানি। এক বুক ভালোবাসা দিয়ে দুঃখে ভরা জীবনটা যত্ন করে সাজিয়ে দিলো মুয়ীয। দু’জনে একসাথে গড়ে তুললো সুখময় নীড়। তাদের ভালোবাসার সংসার। তবে এবারো সুখপাখিটা ধরা দিয়েও অল্পতেই পালিয়ে গেল। এই পৃথিবী হতে বিদায় নিলো উক্তি। ষোলো বছর শান্তিতে, অসীম ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে কাটালো। দু’টো আদুরে রত্নের মা হলো। এরপর আকস্মিক বিদায়। ওর একান্ত পা’গলটাকে সম্পূর্ণ একাকী করে পালিয়ে গেল। কতটা নি`ষ্ঠুর, পা`ষণ্ড হৃদয়!

°° পরিশিষ্ট °°

উক্তি ইন্তেকাল করার পর আরো পনেরো বছর সম্পূর্ণ শূন্য হৃদয়ে বেঁচে ছিলো মুয়ীয। শুধুমাত্র সন্তানদের মুখ চেয়ে বেঁচে ছিলো। স্ত্রী বিহীন তাদের সন্তানদের ঘিরে বেঁচে ছিলো। মোঃ মুয়ীয হাসান মৃ’ত্যুবরণ করেছে গতবছর নভেম্বর মাসে। শীতের এক রাতে। প্রিয়তমার মতোই ঘুমের ঘোরে হারিয়ে গেল। নিলো চিরবিদায়। ষাট বছরে ইন্তেকাল করলো মুয়ীয। মোমেনা বেগম চলে গিয়েছেন বহু বছর আগেই। কেয়া, খেয়ার বিয়ে হয়েছে। মুন্নি ত্যাজ্য হয়েছে এই পরিবারে। সকলের অমতে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক বয়সে। বিয়েও করেছিল। এতে অসহনীয় কষ্ট পেয়ে মোমেনা বেগম ত্যাজ্য ঘোষণা করেছিলেন ওকে। বিয়ের বছর কয়েক গড়াতে না গড়াতেই ডিভোর্স হলো মুন্নির। আর যাই হোক কোনো চরিত্রহীন, ল’ম্পটের সঙ্গে সংসার করা যায় না। তার হাতে মার-গুঁতো খাওয়া যায় না। বর্তমানে দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে সংসার করছে মুন্নি। এবারো সংসার জীবনে সুখে নেই। পরপর তিন মেয়ে সন্তানের মা হয়ে শ্বশুরবাড়ির চোখের বি-ষ সে।

মুয়ীযের গড়ে তোলা এই সুবিশাল অট্টালিকা দেখে যেতে পারেনি উক্তি। বর্তমানে এখানে বসবাস করে তাদের সন্তান মেহরাব, মুক্তি, ময়না, শয্যাশায়ী মারুফ, জান্নাত, জীবন এবং তার পরিবার। এই তো চলছে দিনকাল। জীবদ্দশায় অর্থনৈতিক উন্নতির শুরু শুরু দিকে একটি ছোটোখাটো রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করেছিল মুয়ীয। অতঃপর তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পরবর্তীতে একমাত্র ছেলের অদম্য জেদের ফলস্বরূপ তাদের রেস্টুরেন্টের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। সে রেস্টুরেন্টের জনপ্রিয়তা আজ তুঙ্গে। শাখা রয়েছে শহরের আরো তিনটে স্থানে। পরের বছর ইনশাআল্লাহ্ বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকীর দিনে আরো একটি শাখা উদ্বোধন করার পরিকল্পনা রয়েছে বছর আটাশের মেহরাবের। বাবার চোখে দেখা ক্ষুদ্র স্বপ্ন আজ ব্যাপকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে ছেলের মাধ্যমে। মুয়ীয পেরেছে। পেরেছে তার এক জীবনে দেখা ছোট-বড় সকল স্বপ্ন, ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে। এজন্য সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ্’র। আলহামদুলিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্!

.

তমসাচ্ছন্ন তিমির। জানালায় টেনে রাখা ভারী পর্দার আস্তরণ। বিছানায় কোলবালিশ আলিঙ্গনাবদ্ধ করে আরামে ঘুমিয়ে মুক্তি। বিছানার ঠিক ডান পাশেই বেড সাইডে টেবিলে থাকা নান্দনিক ডিজাইনের টেবিল-ল্যাম্পটি জ্বালিয়ে দিলো মেহরাব। অন্ধকারে বোনটার বড় ভয় যে। মেহরাব বিষাদময় দৃষ্টিতে বোনের ঘুমন্ত মায়াবী মুখ পানে তাকিয়ে রইলো। আগামীকাল মায়ের মৃ’ত্যুবার্ষিকী। ওর অবুঝ বোনটার পা’গলামি বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। সামলাতে হবে বহু খেসারত দিয়ে।

‘ ইয়া আল্লাহ্! ধৈর্য্য দাও তুমি। ‘

ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল মেহরাব। বোনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে চুমু খেল। দেহে ভালোমতো জড়িয়ে দিলো পাতলা কাঁথা। সকল বিপর্যয়, প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে ইনশাআল্লাহ্ সফলকাম হবে ওরা দুই ভাই-বোন। কেননা ওরা মুয়ীয, উক্তি দম্পতির সু সন্তান। হার না মানা, অপরাজেয় এক দম্পতির সন্তান। কি করে ওরা হার মানবে? অগণ্য নৈঃশব্দ্য-পরাজিত প্রহরের শেষে আলোর দিশা মিলবেই মিলবে যে। কেননা পবিত্র কুরআন মাজিদে এসেছে…

” নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী। ” [ সূরা আনফাল: আয়াত ৩০ ]

<< সমাপ্ত >>

[ আসসালামু আ’লাইকুম। কেমন আছেন পাঠক বন্ধুগণ? আশা করি আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছেন। আজকের এই বিশাল বড় পর্বটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন? সুদীর্ঘ ছয় মাসের যাত্রা শেষে আজ সমাপ্ত হলো আপনাদের প্রিয় মুয়ীয, উক্তির পথচলা। মানুষ মাত্রই ম’রণশীল। একদিন না একদিন মৃ`ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবেই প্রতিটি জীবন্ত জীবকে। সেই চিরন্তন সত্যিকে বিবেচনায় রেখে প্রথমবারের মতো লিখে ফেললাম এক স্যাড এন্ডিং। এটা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্যাড এন্ডিং নয়। মুয়ীয, উক্তি হয়তো আর নেই। তবে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে রেখে গিয়েছে দুই সন্তান। জীবন তো থেমে নেই। চলছেই তার আপন ধারায়। একজনের অভাব পূরণ হচ্ছে অন্য দ্বারা। তাই বলা যায় ‘ তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে ‘ পুরোপুরি স্যাড এন্ডিং নিয়ে বিদায় নিচ্ছে না। নতুন প্রজন্মকে জায়গা দিতে বিদায় নিচ্ছে পুরনো। জানেন তো দুঃখ, বিষাদে বড় অপটু এই আমিটা। না দুঃখ ঠিকভাবে প্রকাশ করতে জানি। না লিখতে। তন্মধ্যে উক্তির মৃ’ত্যু দৃশ্য লিখতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে। কষ্ট হয়েছে খুব। কাছের মানুষের মৃ`ত্যু এতটা যন্ত্রনার কেন? হয়তো আমি দুঃখের মূহুর্তগুলো নিজের অপারগতার জন্য ঠিকমতো গুছিয়ে লিখতে পারিনি।‌ দুঃখ প্রকাশ করছি এজন্য। তো…

বন্ধুরা। কেমন লাগলো ‘ তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে ‘ গল্পটি? এই প্রথমবার দীর্ঘদিন সময় নিয়ে একটি গল্প লিখলাম মাত্র। যেখানে এরচেয়েও কম সময়ে আগে পূর্ণাঙ্গ একটা উপন্যাস লিখে ফেলতাম। এখন বিভিন্ন কারণে অনিয়মিত হয়ে গিয়েছি। বাস্তব জীবনে ঢের পরিবর্তন এসেছে। সবটা মানিয়ে গুছিয়ে এরপর লিখতে হচ্ছে।

আজ আপনাদের প্রাণখোলা গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো। প্রথমবারের মতো বাস্তবধর্মী গল্প লিখলাম। নিজস্ব ঘরানার বাইরে গিয়ে লিখলাম। জানিনা কতটুকু সফল হয়েছি। এই পুরো জার্নিতে আমার যে সকল পাঠক ধৈর্য ধরে পাশে ছিলেন, সর্বদা উৎসাহ জুগিয়েছেন তাদের জন্য ধন্যবাদ বিহীন আর কিইবা বলবো? কম পড়ে যাবে যে। অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপু এবং ভাইয়ারা 🌼