তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-০৮

0
103

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_৮

” দ্যাখ ছেমড়ি! মেজাজ এমনিতেই গরম তাওয়ার লাহান উত্তপ্ত হইয়া আছে। আর গরম করিস না। হাছা কইরা ক। পোলাডা কেডা? ”

অত্যন্ত কর্কশ সে শব্দমালা। বুকের ভেতরটা ভয়ে, আতঙ্কে শত টুকরোয় ছিন্নভিন্ন হলো। গলার ভেতরটা শুকিয়ে খাঁ খাঁ মরু প্রান্তর। চোখে ভীতিকর ছায়া। কি বলবে উক্তি? মানুষটা কি রেগে দা`নবীয় আকার নেবে না? ভীতু নজর স্বামীর অবয়বে বুলিয়ে নিলো উক্তি। মুয়ীযের শ্যামরূপ মুখখানা তখন লালাভ উত্তাপে ফুটছে। কপালের দু ধারের রগ অস্থির হয়ে ওঠানামায় ব্যস্ত। অধরোষ্ঠের ফাঁক গলিয়ে বেড়োচ্ছে গরম নিশ্বাস। পরিহিত রঙিন পোশাকটিও যেন আজ টগবগিয়ে ফুটছে। মাংসল হাত দুটো কাঁপছে থরথরিয়ে। মুয়ীয মানতে নারাজ। তার একমাত্র নারীর আশেপাশে সে কোনো অযাচিত কীট অবধি সহ্য করবে না। সেখানে কোথাকার কোন ব•দমাশ!! সাহস কি করে হয়! উক্তি অসহনীয় কুণ্ঠায় দুর্বল হয়ে পড়ছিল। কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার দু ঠোঁটের কোমলতা। হাতের নড়াচড়ায় কিছু বললো মেয়েটি। মুয়ীয বুঝলো না। ক্ষি’প্র স্বরে শুধালো পুনরায়,

” পোলাডা কেডা? ”

উক্তি’র দু’চোখ ছাপিয়ে নামলো অশ্রু। মানুষটি এমন রেগে কেন? ওকে ভুল বুঝছে শুধু শুধু। ওর সরল মনটা যে একান্ত পুরুষের চোখে ভাসমান সন্দেহ সইতে পারছে না। অন্তর্দাহ হচ্ছে। জ্বলছে আগুন, পুড়ছে বুক! চোখ দুটোয় অশ্রু নিয়ে, উক্তি খাটের পাশ হতে সরে গেল। হাঁটি হাঁটি কদম ফেলে কাঠের টেবিলটার নিকটবর্তী হলো। পৌঁছালো টেবিলের ধারে। হাত বাড়িয়ে নিলো সাম্প্রতিক এক পত্রিকা। আর নিলো একটি কলম। কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি লিখে গেল মেয়েটা। মুয়ীযের ঈর্ষান্বিত চোখ গেঁথে স্ত্রীর অবয়বে। উক্তি লিখলো। ফিরে এলো পত্রিকা হাতে। অবনত মস্তকে পত্রিকা বাড়িয়ে দিলো স্বামীর পানে।

” এইডা কি? ”

হিমশীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো মুয়ীয। উক্তি ঈষৎ পত্রিকা নাড়িয়ে, হাতে নিতে ইশারা করলো। অনিচ্ছাকৃত ভাবে পত্রিকা হাতে নিলো মানুষটি। চোখ বুলালো পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজে। ওপর দিকে এক কোনায় ক্ষুদ্রাকৃতির গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, তার অজানা প্রশ্নের উত্তর। স্তব্ধতার সহিত তাকিয়ে মুয়ীয। এসব কি লেখা!!
___

দিবাবসুর মধুর রশ্মি ছড়িয়ে পৃথিবীর বুকে। রাস্তার একপাশ দিয়ে ধীরে সুস্থে হেঁটে চলেছে একটি মেয়ে। কৃষ্ণবর্ণ বোরকা পড়নে তার। হিজাবে আবৃত মস্তক, পিঠ ও বক্ষস্থল। বেশ শালীনতার সহিত পড়া সেই কালো রঙা হিজাবটি। নোজ নিকাবের আড়ালে ঢাকা পড়েছে ফর্সা, মায়াবী মুখখানি। এই এলাকা, এখানকার রাস্তা তার জন্য অচেনা। এখন অবধি বেড়োনোর প্রয়োজন পড়েনি। আজ শাশুড়ি মায়ের আদেশে বের হতে হলো। এই অচেনা পরিবেশে কেমন ভীত-পীড়িত অন্তর। সতর্ক ভঙ্গিতেই হাঁটছে মেয়েটা। মাঝেমধ্যে নজরকাড়া চোখ দু’টো বুলিয়ে যাচ্ছে রাস্তার উভয় পার্শ্বে। এভাবে কিছুটা পথ হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটি পৌঁছে গেল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এক মুদির দোকান। বেশ বড় আকারের দোকানটি। ক্রেতা তেমন একটা নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল উক্তি। এগিয়ে গেল সম্মুখে। প্রবেশ করলো দোকানে। দোকানদার বসে ছিল চেয়ারে। নারী ক্রেতা দেখে মুচকি হেসে উঠলো। দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে। এগিয়ে এসে অতিরিক্ত চিনি মেশানো কণ্ঠে বললো,

” কি লাগবে আফা? ”

অধরে ঝুলিয়ে ভুবন ভুলানো হাসি। উক্তি’র তা পছন্দ হলো না। দৃষ্টি হটিয়ে চুপচাপ হাতের মুঠোয় থাকা কাগজটি বাড়িয়ে দিলো। তাতেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের পরিমাণ ও নাম লেখা রয়েছে। দোকানদার কাগজে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। হাসিমুখে কৌতূহল প্রকাশ করে বললো,

” আফা এলাকায় নতুন নি? কয় নাম্বার বাড়িতে উঠছেন? আগে দেহিনি তো। ”

এখানকার মানুষগুলোর মতো নয় উক্তি’র বেশভূষা। ওর চালচলনে, পোশাকে আলাদাই সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত ঘরের কোনো কর্মঠ, স্থানীয় গৃহিণীর মতো লাগছিলো না। তাই তো কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে দোকানদার। উক্তি এমনতর অহেতুক প্রশ্ন এবং কৌতূহল দুটোই এড়িয়ে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকে। এসব ওর পছন্দ নয়। তাই তো হাতের ইশারায় কাগজটি দেখিয়ে দিলো, যেটা অবস্থান করছে দোকানদারের হাতে। দোকানদার বুঝলো, ক্রেতা সরঞ্জাম দিতে তাড়া দিচ্ছে। তাই কৃত্রিম হেসে জিনিসপত্র বের করতে মনোযোগী হলো। উক্তি চুপটি করে দাঁড়িয়ে। নিকাবে আবৃত মুখশ্রী। হুট করে দেখে চেনার কোনো উপায় নেই। তবে কিছুটা দূরে আগত মানুষটি ঠিক ওকে চিনতে পারলো। তার চক্ষুদ্বয় চিকচিক করে উঠলো খুশিতে। ঠোঁটের কোলে মনোমুগ্ধকর হাসি ফুটিয়ে সে দ্রুত বাইক হতে নেমে এলো। পথের এক পাশেই স্ট্যান্ড করলো বাইক। পকেটে পুরে নিলো বাইকের চাবি। চুলে আলতো হাত বুলিয়ে রাস্তার দুই পাশ লক্ষ্য করে, পাড় হলো রাস্তা। এসে দাঁড়ালো উক্তি’র ঠিক পেছনেই। প্রখর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো পেছনে রয়েছে কেউ একজন। উক্তি কৌতূহলের চোখে এমনিই পিছু ঘুরে তাকালো। লহমায় বদলে গেল তার মুখভঙ্গি। আশ্চর্যান্বিত চাহনিতে তাকিয়ে উক্তি! ফাঁক দু ঠোঁটের মাঝে। নিঃশব্দে আওড়ালো কিছু এক। তা উপলব্ধি করে বিপরীতে দণ্ডায়মান ছেলেটি মৃদু হেসে উঠলো। উজ্জ্বল বদনে শুধালো,

” হাউ আর ইয়্যু? ”

উক্তি হাস্যোজ্জ্বল বদনে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে জবাব দিলো। ওদিকে যে বেজে গিয়েছে শনি, সে কি তা জানে? জনাব মুয়ীয হাসান সদ্যই এ পথ দিয়ে বাইকে করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ চলতি পথে থমকে গেল বাইক। মনে হলো, পরিচিত নারীটির দেখা মিললো! ভ্রু’যুগলে ভাঁজ ফেলে মুয়ীয তাকালো ডানে। চক্ষু জোড়া অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ভাবে তাকিয়ে! উক্তি! হ্যাঁ ওটা উক্তিই। হয়তো সে এখন অবধি স্ত্রীকে এমন বোরকা আবৃত অবতারে দেখেনি। তাই বলে নিজের নারীটিকে চিনতে পারবে না, এতটাও মূর্খ নয় সে। সে ঠিকই চিনেছে। ওটা ওর মূক স্ত্রী ই। হাত নাড়িয়ে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে কথা বলছে। বিপরীতে থাকা ছেলেটি বেশ হেসেই কথা বলছে। কিসের এত আদিখ্যেতা হা? তার সঙ্গে কথা বলার সময় তো চোখমুখে আঁধার ঘনিয়ে আসে। মাথা একদম ঘাস খাওয়ারত ঘোড়ার মতো নত হয়ে যায়। হাত-পা হয়ে যায় জড়বস্তু। আর রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে অপরিচিত কিংবা অত্যন্ত পরিচিত কারোর সঙ্গে এত প্রেমালাপ? সহ্য হলো না আর। জাগ্রত হলো বেপরোয়া সত্তা। রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি দিকেই বাইকটা দাঁড় করালো মুয়ীয। নেমে এলো হনহনিয়ে। অগ্রসর হলো স্ত্রীর পানে। দ্রুততম পায়ে হেঁটে চলেছে পেশিবহুল, দীর্ঘকায় মানুষটি। কোমরের দু পাশে ঝুলছিল তার দু’হাত। ডান হাতের মুঠোয় অ”ত্যাচারিত হচ্ছে বাইকের চাবি। আহত হচ্ছে হাতের তালু। জুতো অবিরাম মাড়িয়ে যাচ্ছে পিচঢালা পথ। স্ত্রীর একদম কাছ ঘেঁষেই থামলো এই দুরন্ত চলন। আকস্মিক পাশে কারোর অস্তিত্ব টের পেয়ে চমকালো উক্তি! আগন্তুক হতে দৃষ্টি সরিয়ে ডানে তাকালো। আঁতকে উঠলো স্বামীর উপস্থিতি স্বচক্ষে দেখে! ওর এই আতঙ্কিত মুখখানি, ধরে পড়ে যাওয়ার মতো ভঙ্গিমা… মুয়ীয হাসান নামক অ°গ্নিকাণ্ডে ঘি ঢেলে দিলো যেন। চট করে ওর ডান হাতটা মুঠোয় ভরে নিলো মুয়ীয। শক্ত হাতের থাবায় ছটফটিয়ে উঠলো পেলব হাতটি। মুয়ীয শক্ত, দৃঢ় স্বরে বললো শুধু একটিমাত্র বাক্য,

” চল। ”

স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বড় বড় কদম ফেলে চলতে লাগলো সে। চেনা নেই জানা নেই যার তার সামনে স্ত্রীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, হেয় করার মতো মন মানসিকতা অন্তত মুয়ীয নামধারী মানুষটির নেই। যা হবে চার দেয়ালের মধ্যে, নিজেদের মধ্যে হবে। কোনো বহিরাগতের সামনে তো নয়ই। চোখের পলকে ধূলো উড়িয়ে দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেল বাইকটি। বাইকে অবস্থানকারী দম্পতি। আর সেই অজ্ঞাত ছেলেটি? বিস্ময়কর নেত্রে তাকিয়ে! এটা কি হলো?
___

সে-ই যে ঘরে ফিরলো তারা।‌ ফিরেই কঠোর জেরার মুখোমুখি উক্তি।

” দ্যাখ ছেমড়ি! মেজাজ এমনিতেই গরম তাওয়ার লাহান উত্তপ্ত হইয়া আছে। আর গরম করিস না। হাছা কইরা ক। পোলাডা কেডা? ”

অবশেষে পত্রিকার কাগজের মাধ্যমে সত্যিটা প্রকাশ করলো উক্তি। মুয়ীয নির্বাক! থেমে থেমে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,

” পোলাডা তোর ফুফাতো ভাই?! ”

উক্তি ভয়ে আস্তে ধীরে ইতিবাচক মাথা নাড়লো। হ্যাঁ। ওটা তার আপন ফুফাতো ভাই ছিল। মুয়ীয দাঁতে দাঁত পিষে শুধালো,

” হা°লার পো হা°লায় এ্যাদ্দিন কোন চিপায় হান্দাই ছিল? বিয়াতে তো দেখলাম না। ”

উক্তি একটুখানি মাথা উঁচু করে তাকালো। সাহস জমায়েত করে হাতে নিলো পত্রিকা। সাদা, ফাঁকা এক অংশে লিখে দিলো উত্তর। লেখা শেষ হওয়া মাত্রই মুয়ীয চট করে পত্রিকা কেড়ে নিলো। দেখলো লেখা,

‘ ভাইয়া খুলনায় ছিল। ‘

” ক্যা? ” প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকিয়ে মুয়ীয।

উক্তি হাতের ইশারায় কিছু বোঝালো। মুয়ীয ভ্রু কুঁচকে, নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করলো,

” পড়াল্যাহা করে ওম্বে? ”

উক্তি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। তবুও শান্ত হচ্ছে না মটকা। অতিরিক্ত গরম হয়ে রয়েছে। এখন এক কাপ গরম চা খেয়েই মন, মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা করতে হবে। নইলে টগবগিয়ে সিদ্ধ হবে তনুমন। মুয়ীয অসন্তোষের সহিত পত্রিকা ছিটকে ফেললো বিছানায়। অতঃপর বড় বড় কদম ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর হতে। উক্তি বেশ বড় করে নিশ্বাস ফেললো। ধপাস করে বসে পড়লো বিছানায়। মানুষটি ওকে অহেতুক ভুল বুঝছিল! কি করে পারলো! সে কি উক্তি’কে একটুও চিনতে পারেনি? উক্তি বুঝি স্বামী বিনা এভাবেই পরপুরুষে মজে যেতে পারে! কন্যার বুকে পর্বতসম অভিমান জমলো।

‘ শুধুই কি অভিমান এ, নাকি হৃদয়স্পর্শী অনুরাগের প্রারম্ভিক সূচনা! ‘

মোমেনা বেগম নিজ ঘরে বিছানায় বসে। রোদে শুকিয়ে যাওয়া শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট এবং কনিষ্ঠ কন্যা মুন্নির সালোয়ার কামিজ গুছিয়ে রাখছেন। তেমনই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলো মুন্নি। এসে বসলো বিছানায়। হাঁপিয়ে চলেছে বেশ। মা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মেয়ে কি পা’গলা কুকুরের ধাওয়া খেয়ে এলো!

” কি রে! এমন করতাছোছ ক্যা? পা’গলা কু•ত্তায় কামড়াইছে নি?”

মুন্নি চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। বললো,

” কি যে কও না মা! কু°ত্তায় কামড়াইবো ক্যা? ”

” তাইলে? এমন ছুটছোছ ক্যালা? ”

মুন্নি এবার প্রসন্ন হলো। দুই পা খাটের ওপর তুলে, আসন করে বসলো। রমরমা খবর শোনানোর মতো কণ্ঠস্বরে বলতে লাগলো,

” জানো মা, কি হইছে? ”

মোমেনা বেগম কামিজ ভাঁজ করতে করতে বাঁকা স্বরে বললেন,

” না কইলে জানুম ক্যামনে? মুই কি অন্তর্যামী? ”

” ধুর মা। তুমি খালি কথা প্যাঁচাও। আরে হোনো না। ”

” কইতে থাক। হুনতাছি। ”

মুন্নি টিভি সিরিয়ালের সেই ভেজাল নারী চরিত্রের মতো অঙ্গভঙ্গি করে বললো,

” তোমার ছোডো বউ আছে না? হুদা বোবাই না। ক্যারেক্টার ঢিলাও আছে। ”

মোমেনা বেগম স্তব্ধ! ওনার শ্রবণ পথে কি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে? দিনদুপুরে এ কি অযাচিত ভুলভাল শুনছেন উনি? পঞ্চাশোর্ধ সে মহিলা কাঠের আলনায় ভাঁজকৃত পোশাক গুছিয়ে রাখছিলেন। পিছে ফিরে দাঁড়ালেন উনি। এগিয়ে গেলেন মেয়ের কাছে। বেশ উদগ্র স্বরে প্রশ্ন করলেন,

” কি?! তুই এইয়া কি কইতাছোছ? হাছা কইতাছোছ? ”

” আরে মা হ। হাছা কইতাছি। তোমার ছোডো পোলা হাতেনাতে ধরছে। বউরে হুনলাম ঘরের মধ্যে আচ্ছা মতো ধাতানি দিতাছে। এক্কারে ক্ষ্যা’পছে মোর ভাইডা। ”

মোমেনা বেগমের মুখশ্রী বেরঙিন রূপ ধারণ করলো। মেয়ের বাম পাশে বসলেন উনি। কিছু এক ভাবনায় ডুবে, মেয়েকে শুধোলেন,

” খুইল্লা ক সব। ”

মুন্নি বললো সবটা। রঙচঙ মিশিয়ে একদম মাখো মাখো খাবারের ন্যায় পরিবেশন করলো সত্য মিথ্যার দুর্দান্ত এক রেসিপি। প্রতিটি শব্দ, বাক্যের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছিল মোমেনা বেগমের অভিব্যক্তি। উনি শুনলেন সবটা। ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লেন। ওই মেয়ে তবে সতি সেজে তলে তলে কালিমুখো!

মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়েছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। নিজ ঘরে জায়নামাজে বসে নিশাত। হিজাবে আবৃত সতর। হাতে পবিত্র কুরআন শরীফ। পাঠ করছে সূরা ওয়াক্বিয়াহ। প্রতিদিন মাগরিবের নামাজ শেষে সূরা ওয়াক্বিয়াহ পাঠ করে থাকে সে। আগে করা হতো না। জানা ছিল না এর ফজিলত। তবে একদিন, ননদিনী উক্তি তাকে সওয়াবের পথ দেখালো। জানালো সূরা ওয়াক্বিয়াহ এর ফজিলত।

দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। মাগরিবের নামাজ সমাপ্ত করে নিশাত একাকী সময় পার করছিলো। তাই ভাবলো ঘুরে আসা যাক ননদের ঘর হতে। যেই ভাবা সেই কাজ। নিশাত হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল উক্তি’র ঘরে। ঘরে প্রবেশ করেই জুড়ালো নয়ন। শুভ্রময়ী এক মূক কন্যা বসে জায়নামাজে। হাতে বড় যতন করে ধরে রাখা পবিত্র কুরআন মাজিদ। নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে নাড়িয়ে পড়ছে সে। শুভ্র ও ঈষৎ গোলাপি রঙের মিশেলে তৈরি হিজাবটি। গৌর বর্ণের ত্বকে বেশ মানিয়েছে। সদ্য প্রস্ফুটিত পুষ্পের ন্যায় নির্মল, সতেজ লাগছিল উক্তি নামক রমনীকে। নিশাত মুগ্ধ চোখে ঘরে প্রবেশ করলো। বসলো বিছানায়। অপেক্ষায় কুরআন তেলাওয়াত সমাপ্ত হবার। কিছুটা সময় অতিবাহিত হলো। কুরআন তেলাওয়াত সমাপ্ত হলো। আদবের সহিত কুরআন শরীফ বুকে আলিঙ্গন করে উঠে দাঁড়ালো উক্তি। নির্দিষ্ট স্থানে এক সেল্ফের তাকে রাখলো স্রষ্টার দেয়া সর্বোত্তম ও পবিত্র কুরআন শরীফ। অতঃপর জায়নামাজ গুছিয়ে রাখলো। হিজাব খুলে জড়িয়ে নিলো ওড়না। আবৃত হলো দেহের উর্ধাংশ। শুধুমাত্র মুখখানি দৃশ্যমান। সালোয়ার কামিজ পরিহিতা উক্তি ভাবীকে লক্ষ্য করে মুচকি হাসলো। এসে বসলো তার পাশে।

” কি পড়ছিলে গো ননদিনী? ”

নিশাত মৃদু হেসে শুধালো। উক্তি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে জবাব দিলো,

” সূরা আল-ওয়াকিয়াহ। ”

” ওয়াকিয়াহ সূরা? হঠাৎ? ”

” মাগরিবের পর এই সূরা পড়তে হয় ভাবী। অনেক ফজিলত আছে। ”

উক্তি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে বললো। নিশাত মনোযোগ সহকারে তা লক্ষ্য করলো। বুঝতে পারলো ননদ কি বলছে। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের সাথে সে বেশ অভ্যস্ত কিনা! নিশাত কৌতুহলী হয়ে বললো,

” কি ফজিলত গো। একটু বলবে। ”

ভাবীর আগ্রহ দেখে উক্তি প্রসন্ন হলো। হাতের কাছেই বিছানায় ছিল মোবাইল। মোবাইল হাতে নিলো মেয়েটি। প্রবেশ করলো গুগল ক্রোমে। সার্চ দিলো সেথায়। দৃশ্যমান হলো কাঙ্খিত ফলাফল। বোবা মেয়েটি হয়তো এতগুলো কথা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে ঠিকঠাক বুঝিয়ে উঠতে ব্যর্থ হতো। তাই তো গুগলে বের করলো ‘ সূরা ওয়াক্বিয়াহ এর ফজিলত ‘. নিশাত ননদের হাত থেকে মোবাইল নিলো। গুগলে পড়তে লাগলো,

‘ সূরা আল-ওয়াকিয়াহ। পবিত্র কোরআনুল কারিমের ৫৬তম সুরা। এই সুরার আয়াত সংখ্যা ৯৬। আর রুকু আছে ৩টি। সুরা ওয়াকিয়াহ মক্কায় অবতীর্ণ হয়। সুরা আল ওয়াক্বিয়ার অর্থ নিশ্চিত ঘটনা। ‍মুফাসসিরে কিরাম বলেন, ওয়াকিয়া অর্থ কিয়ামতও বটে।

সূরা ওয়াকিয়ার ফজিলত অনেক বেশি। এই সূরা প্রতিদিন মাগরিবের পরে পাঠ করা হয়। এই সুরা পাঠ করলে কখনো অভাব আসে না। দরিদ্রতা কখনো গ্রাস করতে পারে না।

বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আল্লাহ্’র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন রাতে সুরা ওয়াকিয়াহ তেলাওয়াত করবে, তাকে কখনো দরিদ্রতা স্পর্শ করবে না।’ (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান; হাদিস, ২৪৯৮) ‘

সূরা ওয়াক্বিয়াহ সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য উল্লেখিত ছিল। নিশাত পড়লো সবটা। জন্মালো আগ্রহ। সে-ই থেকে সূরা ওয়াক্বিয়াহ প্রাকটিস করতে লাগলো সে। প্রথম প্রথম মাঝেমধ্যে পড়তো। আর এখন? আলহামদুলিল্লাহ্ প্রতি মাগরিবের শেষে সূরা ওয়াক্বিয়াহ পাঠ করে থাকে সে। শুকরিয়া ননদের। তাকে এমন ফজিলতপূর্ণ সূরার খোঁজ দেয়ার জন্য।

নিশাত সূরা ওয়াক্বিয়াহ এর শেষ আয়াত পড়ছিল। ঠিক সে মুহূর্তে মোবাইলটি সশব্দে জানান দিলো, কেউ যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক। কল করছে তাকে। সূরা তেলাওয়াত শেষে উঠে দাঁড়ালো নিশাত। নির্দিষ্ট স্থানে কুরআন শরীফ রাখলো। এসে দাঁড়ালো ড্রেসিং টেবিলের কাছে। সেথা হতে হাতে নিলো মোবাইল। কিঞ্চিৎ চমকালো কলার আইডি দেখে। এতদিন পর এ ফোন করেছে!

চলবে।