তোমাতে আসক্ত আমি পর্ব-৪২+৪৩

0
330

#তোমাতে_আসক্ত_আমি
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_৪২

দেখতে দেখতে আবরার আরশির বিয়ের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আবরারের সাথে বেশ ভালো আছে আরশি। আবরার তার অনেক যত্ন নেয়। তবে লোক টা এখন পুরো দ*মে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিন বাড়ি থাকে না, রাতে ফিরেও টু*ক*টা*ক কাজ করে। এ নিয়ে আরশির অবশ্য কোনো অ*ভি*যো*গ নেই। লোক টা সুযোগ পেলেই তাকে ফোন করে, খোঁজ খবর নেয়। রাতেও ঘন্টা খানেক সময় দেয়। এই বা কম কি! আরশির মতে, কেউ যদি হাজারো ব্যস্ততার মাঝে আপনার জন্য দুই তিন মিনিট সময় বের করে তাহলে সে অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসে, আপনার কথা চি*ন্তা করে। আপনার কথা সারাক্ষন তার মাথায় থাকে। তাই তো সুযোগ পেলেই আপনার খোঁজ খবর নেয়। আর এমনিতেও আবরারের কাছে তার মূল্য কতটুকু এটা আরশি বেশ জানে।

ছাদে বসে আছে আরশি। আজ তার মন টা ভীষণ খা*রা*প। বাবার কথা বড্ড মনে পড়ছে। আবরার রুমে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে আর তার ও ঘুম আসছে না তাই ছাদে চলে এসেছে সে। দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকালো আরশি। তবে আজ আকাশ অ*ন্ধ*কার। চন্দ্র, তারা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টির পূর্বের শীতল হাওয়া এসে শরীরে বা*রি খাচ্ছে। হালকা শীত শীত লাগছে আরশির। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে হয়তো। কিন্তু মোটেও ন*ড়*তে ইচ্ছা হলো না তার। এই পরিবেশটাই ভালো লাগছে।

চোখ বন্ধ করে বাবার সাথে কা*টা*নো শৈশবের সুন্দর স্মৃতি গুলো মনে করতে লাগলো আরশি। কতো সুন্দরই না ছিলো দিনগুলো! তারপর কতো কিছু হয়ে গেলো তার জীবনে। কেউ গায়ে চাদর মু*ড়ে দেয়ায় চোখ খুললো আরশি। তাকিয়ে দেখলো আবরার তার পাশে কিছু টা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। সেই দূরত্ব ভালো লাগলো না আরশির। মুহূর্তেই আবরারের কাছে চে*পে আসলো সে। দূরত্ব ঘু*চি*য়ে নির্দ্বিধায় আবরারের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বু*জ*লো। হাসলো আবরার। শান্ত কণ্ঠে শুধালো,

— মন খা*রা*প?

আরশি চোখ বু*জে*ই জবাব দিলো,

— হু। আব্বুর কথা ভীষণ মনে পড়ছে।

এতটুকু বলে থেমে গেলো আরশি। আবরার টু শব্দটাও করলো না। কিছু সময় নীরবতা পালনের পর আরশি পুনরায় বলে উঠলো,

— জানেন অনেক সুখের পরিবার ছিলো আমাদের। সুখ আর সুখ। অর্থ, ভালোবাসা কোনো কিছুর অভাব ছিলো না আমাদের। আব্বু, আম্মু আর আমি। আমাদের তিনজনের সুখী পরিবার। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি, আব্বুর প্রিন্সেস ছিলাম। আমার নামটাও নাকি আব্বু রেখেছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নাকি তার মনে হয়েছিল সে কোনো স্বচ্ছ আরশি তে চোখ রেখেছে। তাই একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছে আরশি। আব্বু আমাকে কতোটা ভালোবাসতো তা বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মা*র তো দূরের কথা, কোনোদিন উচু আওয়াজে কথা বলতো না আমার সাথে। যদি ক*ষ্ট পাই! আম্মু মাঝে মাঝে ব*ক*তো, তখন আব্বুই আমাকে বাঁচাতো। আব্বু আসলে কেঁ*দে কেঁ*দে আম্মুর নামে বি*চা*র দিতাম। তখন আমাকে খুশি করার জন্য মি*ছে মি*ছে আম্মু কে ব*ক*তো আব্বু। কোনো কিছু চাওয়ার আগেই হাজির করতো। কোনো কিছুর কমতি রাখতো না। আমার সকল আবদার পূর্ণ করতো। বাবা মায়ের এতো টা আদরের হওয়ায় অনেকটাই বাঁ*দ*র তৈরি হচ্ছিলাম। সারাদিন খেলাধুলা, দু*স্টু*মি করতাম। পড়াশোনা তেমন একটা করতাম না। তবে রেজাল্ট যে খা*রা*প ছিলো এমন না, মোটামোটি ভালোই ছিলো। এভাবেই স্বপ্নের মতো সুন্দর দিন কা*ট*ছিলো আমাদের।

কথাগুলো বলে ছ*ল*ছ*ল চোখে হাসলো আরশি। আবরার আরশির মুখের পানে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আজ যেনো আরশি নিজের ভিতরে জমিয়ে রাখা প্রতিটা কথা আবরার কে জানিয়ে দিতে চাচ্ছে। আরশি ফের বলে উঠলো,

— বাবা পেশায় মোটামোটি নামকরা সাংবাদিক ছিলেন। দাদাবাড়ি থেকেও ভালোই সম্পত্তি পেয়েছিলেন। সেই সম্পত্তি বেঁচে আমাদের বাড়ি টা তৈরি করেছিলেন আর বাকি টা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। সেই বাড়িতেই সুখের দিন কা*ট*ছি*লো আমাদের। তবে বেশি সুখ বুঝি কপালে স*য় না! হঠাৎ এক ঝ*ড় এসে আমাদের সুখের জীবন ল*ন্ড*ভ*ন্ড করে দিয়ে যায়। আমার গর্ভধারিণী মা আমাকে ঘৃ*ণা করতে শুরু করে। অবশ্য আমার দো*ষ ছিলো। আমার কারণেই হয়তো আমার আব্বু আর নেই…

শেষের কথা টা বলতে গলা কাঁ*পে আরশির। আবরার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরশির পানে। কোনো শান্তনা দেয় না। সে চায় আরশির থেকে সব টা শুনতে। কিছুক্ষন বিরতি নেয় আরশি। শান্ত হয়ে বলা শুরু করে,

— সেবার আমি এসএসসি দিয়েছি। রেজাল্ট ও দিলো। গোল্ডেন না পেলেও এ প্লাস পেয়েছিলাম। তাতেই আব্বু সে কি খুশি! আমাকে দাদির দেয়া লকেট উপহার দেয়। আব্বুর ইচ্ছা ছিলো বেস্ট কলেজে পড়াবে আমাকে। কিন্তু কলেজ টা আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে ছিলো। তখন ও আমি বাবা মায়ের হাত ধরে সব জায়গায় যেতাম। তারা আমাকে একা ছাড়তো না। তাই বহু ভাবনা চি*ন্তা*র পর আমার যাতায়াতের সুবিধার কথা ভেবে নিজের জমানো টাকা ব্যয় করে অল্প দামের মধ্যে সেকেন্ড হ্যান্ড একটা গাড়ি কেনে আব্বু। এ নিয়ে আম্মুর সে কি রা*গ! শুধু শুধু কেনো এতো টাকা ব্যয় করলো? সাধারণ একটা কলেজে পড়ালেই তো হয় আরও কতো কি… আব্বু শুধু হাসছিলো। শেষে আম্মু কে বলেছিলো,

“তুমি শুধু শুধু রা*গ করছো মিহি। আমি বেঁচে আছি তো। আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের কোনো ক*ষ্ট করতে দেবো না। তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে বলো! আর আমার মামুনি বেস্ট কলেজেই পড়বে। ও যখন ভালো কোনো পসিশন এ যাবে তখন এমন কতো টাকা আসবে!”

সেদিন আব্বুর কথাগুলো শুনে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম এবার থেকে অনেক ভালো করে পড়াশোনা করবো। আমাকে অনেক বড় পসিশন এ যেতে হবে। আব্বু আম্মুর খেয়াল রাখতে হবে। তাদের যে আমি ছাড়া কেউ নেই।

পরেরদিন ছুটির দিন ছিলো। আব্বু বাসায় ছিলো। কিন্তু সকাল থেকেই খেয়াল করেছিলাম আম্মু কিছু একটা নিয়ে চি*ন্তি*ত। কেমন যেনো অ*ন্য*ম*ন*স্ক হয়ে আছে। আম্মু কে জিজ্ঞাসা করার পরও আম্মু কিছু বললো না। নাস্তা করার পর আব্বু গাড়ি দেখানোর জন্য বাড়ির বাইরে নিয়ে আসলো। আর কথায় কথায় জানতে পারলাম আব্বু ড্রাইভিং জানে। গাড়ি দেখে আর আব্বু ড্রাইভিং জানে এটা জানার পর আব্বুর কাছে বায়না ধরলাম যেনো আমাকে গাড়িতে করে আশেপাশের এলাকা ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। আব্বুর প্রিন্সেস আবদার করেছে আর আব্বু তা পূরণ করবে না তা কি হয়? আব্বু এক কথাতেই রাজী হয়ে যায়। কিন্তু আম্মু কে আমার ইচ্ছার কথা জানানোর পর সে কেমন যেনো অ*স্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। ভ*য়া*র্ত কণ্ঠে বলে আজ যেনো আমরা কেউ বাইরে না যাই। তার মনে হচ্ছে কোনো ভ*য়া*নক বি*প*দ আসতে চলেছে। কেমন যেনো অ*স্থি*র অ*স্থি*র লাগছে। আর সে নাকি রাতে কোনো একটা বা*জে স্বপ্ন ও দেখেছে। আসলে এই পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক মানুষ রয়েছে যারা বি*প*দ আসার পূর্বে কোনো না কোনো ভাবে বি*প*দ আসার ইঙ্গিত পেয়ে যায়। কেউ বুঝতে পারে আবার কেউ দুঃ*স্ব*প্ন, এমনিতেই ভ*য় হচ্ছে এসব ভেবে উ*ড়ি*য়ে দেয়। আমরাও সেদিন আম্মুর কথা গায়ে মা*খি নি। আম্মু দুঃ*স্ব*প্ন দেখার কারণে ভ*য় পাচ্ছে ভেবেছিলাম। আর আম্মুর এই কথা না শোনাটাই আমাদের জন্য কা*ল হয়ে দাঁড়ালো।

আব্বু আর আমি বেরিয়ে পড়ি গাড়ি নিয়ে ঘুরতে। আম্মু অনেকবার নিষেধ করেছিলো। কিন্তু আমি মন খা*রা*প করবো তাই আব্বু আম্মু কে এটা ওটা বুঝিয়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আস্তে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছিলো আব্বু। আমিও জানালা খুলে পরিবেশ টা উপভোগ করছিলাম। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর আব্বু খেয়াল করে একটা বিশাল বড় ট্রাক সর্বোচ্চ স্পিডে পিছন থেকে আমাদের গাড়ি বরাবর এগিয়ে আসছে। আব্বু বুঝে যায় ভ*য়া*নক কিছু হতে চলেছে। সেও গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আব্বু গাড়ি যেদিক যেদিক সরিয়ে নিচ্ছিলো, ট্রাকটাও সেদিক সেদিক ই আসছিলো। মনে হচ্ছিলো যেনো ইচ্ছা করেই আমাদের গাড়িতে ধা*ক্কা দিতে চাচ্ছে। আব্বু যে গাড়ি থামাবে তারও উপায় নেই। কারণ গাড়ি থামানো মাত্র হয়তো ট্রাক টা গাড়ি কে ধা*ক্কা মা*র*বে। আব্বু বুঝে যায় বাঁচার কোনো উপায় নেই। ট্রাক যেকোনো মুহূর্তে আমাদের গাড়ি কে ধা*ক্কা দিবে। আমি আ*ত*ঙ্কি*ত দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে তাকাই। দেখি আব্বুর চোখে জল ট*ল*ম*ল করছে। আব্বু হুট করে আমাকে বলে,

“মামুনি নিজের আর তোমার আম্মুর খেয়াল রাখবে। তোমাকে অনেক স্ট্রং হতে হবে কিন্তু। আমার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।”

এতটুকু বলে থামে আব্বু। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। আমিও তখন কাঁ*দ*ছি আর আব্বুর কথার মানে বো*ঝা*র চেষ্টা করছি। ট্রাক আমাদের গাড়ির একেবারে কাছে চলে এসেছে তখন। আব্বু এগিয়ে এসে আমার সাইডের ডোর খুলে দেয়। আমি চ*ম*কে তাকাই সেদিকে। কি হতে যাচ্ছে তার কিছু টা আন্দাজ করে ফেলি। হা*উ*মা*উ করে কেঁ*দে বলে উঠি,

“এমন টা করো না আব্বু। আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না। প্লিজ এমন টা করো না।”

অ*শ্রু*শি*ক্ত চোখে হাসে আব্বু। এক হাতে ড্রাইভ করতে করতে শেষ বারের মতো বলে,

“আব্বু তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসে মামুনি…”

বাস্ এটাই ছিলো আব্বুর শেষ কথা। মুহূর্তের মাঝে আমাকে ধা*ক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বাইরে ফে*লে দেয় আব্বু। গাড়ি রাস্তার সাইডে নিয়ে আমাকে ধা*ক্কা দিয়েছিলো আব্বু। যার ফলে অন্য কোনো গাড়ির নিচে পড়ার সুযোগ ছিলো না। কিন্তু চলন্ত গাড়ি থেকে ফে*লার কারণে ভীষণ আ*ঘা*ত পেয়েছিলাম। রাস্তার সাইডের ইটে বা*রি খেয়ে কপাল ফে*টে গ*ল*গ*ল করে র*ক্ত বের হচ্ছিলো। জীবনে প্রথম বার এতো আ*ঘা*ত পেয়ে স*হ্য করতে পারি নি। চোখ ঝাঁ*প*সা হয়ে আসছিলো। ঝাঁ*প*সা চোখেই তাকিয়ে ছিলাম আব্বুর গাড়ির দিকে। আশায় ছিলাম আব্বুও গাড়ি থেকে লাফ দিবে। কিন্তু সেই সুযোগ টা হয়তো আব্বু আর পায় নি। চোখের সামনেই ট্রাক টা আব্বুর গাড়ি ধা*ক্কা দিয়ে উ*ল্টি*য়ে দেয়। তারপর… তারপর সব অ*ন্ধ*কার।

চলবে,

#তোমাতে_আসক্ত_আমি
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_৪৩

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। তার মাঝেই আবরারের বুকে মুখ গু*জে বসে আছে আরশি। দীর্ঘ সময় কাঁ*দার কারণে ক্ষনে ক্ষনে কেঁ*পে উঠছে সে। আবরারের গভীর দৃষ্টি সেই ক*ম্প*নরত আরশির পানেই নিবদ্ধ। ইতোমধ্যেই তার টি-শার্ট এর এক পাশ আরশির চোখের পানিতে ভিজে গেছে। তবুও ন*ড়*চ*ড় নেই তার। সে চাচ্ছে আরশি নিজের বুকের মাঝে জমানো ক*ষ্ট গুলো আজ তার সাথে ভাগ করুক, মন ভরে কাঁ*দু*ক। এতে যদি মেয়েটার ক*ষ্ট একটু কমে। নিজের চোখের সামনে নিজের প্রাণের প্রিয় বাবার মৃ*ত্যু দেখার মতো বড় য*ন্ত্র*না আর কিছু আছে কি? আবরার আরশির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে গিয়েও করতে পারলো না। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও অন্তর কেঁ*পে উঠলো তার। অথচ সেই ছোট্ট আরশি সেটা স*হ্য করেছে।

দীর্ঘ সময় চোখের জল ফেলার পর ধীরে ধীরে শান্ত হলো আরশি। এতো বছরের জমানো অব্যক্ত ব্য*থাগুলো ভরসা যোগ্য কারোর কাছে ব্যক্ত করতে পেরে ভীষণ শান্তি অনুভব করলো সে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে টের পেতেই আবরারের কাছ থেকে সরে আসতে চাইলো সে। কিন্তু ছাড়লো না আবরার। সেভাবেই বুকের মাঝে পুরে রাখলো আরশি কে। আরশি কা*ন্না ভেজা কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললো,

— ছাড়ুন এমপি সাহেব। বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের ভেতরে যাওয়া উচিত।

আবরার শান্ত কণ্ঠে বললো,

— এরপর কি হয়েছিল মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি? আমি সব টা জানতে চাই। যখন বিশ্বাস করে এতটুকু বলেছো, তখন বাকিটাও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। বলবে না আমায়?

সময় নিলো আরশি। তারপর ধীর আওয়াজে পুনরায় বলতে লাগলো,

— এরপর আর কি? আমার জীবনের সুখের অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছিলো সেদিন। এরপর পদে পদে বুঝতে পেরেছিলাম বাবা ছাড়া সন্তান কতটা অ*স*হায়। যখন আমার সেন্স ফেরে তখন নিজেকে হসপিটালে পাই। পাশে চাচিম্মু অর্থাৎ আমার বড় চাচার স্ত্রী বসেছিলেন। হা*উ*মা*উ করে কেঁ*দে আব্বুর কাছে যেতে চেয়েছিলাম। আব্বু কে দেখার জন্য পা*গ*লা*মি করছিলাম। তখন চাচিম্মু আমাকে শ*ক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। জানান অতিরিক্ত র*ক্ত*ক্ষ*র*ণের কারণে আমি প্রায় পনেরো ঘন্টা অ*জ্ঞান ছিলাম। ততক্ষনে আমার বাবার জানাজা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, তাকে ক*ব*র ও দেয়া হয়েছে। ক*ষ্টে বুক টা ফে*টে যাচ্ছিলো তখন। শেষবারের মতো আব্বু কে না দেখতে পারার ক*ষ্ট, তার বুকে মাথা রেখে “ভালোবাসি আব্বু” বলতে না পারার ক*ষ্ট। হুট করে আম্মুর কথা মনে হলো। অ*স্থি*র কণ্ঠে চাচিম্মু কে আম্মুর কথা জিজ্ঞাসা করতেই চাচিম্মু জানালো আম্মু পাশের রুমে আছে। তার অবস্থা ও ভালো না। আব্বুর ম*র*দে*হ দেখার পর থেকে কেমন যেনো পা*গ*লের মতো আচরণ করছে। অসংখ্যবার জ্ঞান হা*রি*য়েছে। তাই তাকেও হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। ক*ড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আম্মুর অবস্থার কথা শুনে ছ*ট*ফ*ট করে উঠলাম আম্মু কে দেখার জন্য। চাচিম্মু ডাক্তারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসলেন। আমাকে নিয়ে গেলেন পাশের রুমে। আমার সবসময় গোছালো, পরিপাটি থাকা আম্মুর বে*হা*ল দশা দেখে বুক কেঁ*পে উঠলো আমার। এ*লো*মে*লো চুল, চোখের নিচে গাঢ় কালি, মলিন চেহারা। দুই হাতে মুখ চে*পে ডু*ক*রে কেঁ*দে উঠলাম আমি। পরম মমতাময়ী মায়ের মতো বুকে জড়িয়ে নিলেন চাচিম্মু। মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝালেন আমাকে শ*ক্ত হতে হবে, আমার মায়ের জন্য হলেও শ*ক্ত হতে হবে। আমার মায়ের যে এখন আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আম্মুর কথা ভেবে নিজেকে কিছুটা শান্ত করি। আম্মুর জ্ঞান ফেরা অব্দি ওখানেই আম্মুর হাত ধরে বসেছিলাম। ঘন্টা দুয়েক পর আম্মুর জ্ঞান ফেরে। কিন্তু আমার হাতের মাঝে নিজের হাত দেখে এক ঝ*ট*কা*য় হাত সরিয়ে নেয় আম্মু। ক্রো*ধ আর ঘৃ*ণা মিশ্রিত চোখে আমার দিকে তাকায়। চি*ৎ*কা*র করে বলে আমাকে তার সামনে থেকে চলে যেতে। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি আম্মুর দিকে। ন*ড়*তে ও যেনো ভুলে গিয়েছিলাম তখন। আমি যাচ্ছি না দেখে আম্মু চি*ৎ*কার চেঁ*চা*মে*চি করতে থাকে। রুমে থাকা নার্স এমন অবস্থা দেখে আমাকে বলে রুম থেকে চলে যেতে। আম্মুর ব্রেনে চা*প পরে এমন কোনো কিছু করা যাবে না এখন। এতে ক্ষ*তি*ক*র কিছু হতে পারে। আম্মু তখন অ*স্বাভাবিক আচরণ করছিলো। বারবার চি*ৎ*কা*র করে বলছিলো আমাকে সামনে থেকে চলে যেতে। ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি। খুব করে কাঁ*দ*তে চাইছিলাম কিন্তু কেনো যেনো চোখে আর পানি আসলো না। এরপর দুইদিন হসপিটালে থাকতে হলো। দুইদিন পর নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসলাম। সাথে আসলো বড় চাচা আর তার পরিবার। আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন? আব্বুর মৃ*ত্যু*র খবর শোনার পর আমাদের কোনো আত্মীয় আমাদের বাড়িতে আসে নি। হয়তো আমাদের দায়িত্ব না নেয়া লাগে এই ভ*য়ে। হাসি পাচ্ছিলো তখন। আব্বু থাকতে তারা কি মিষ্টি ব্যবহার ই না করতো! আর আব্বু যাওয়ার পর কেউ শান্তনা টুকু দিতে আসে নি। তবে এটা ভেবে শান্তি লাগছিলো যে সবাই ছেড়ে গেলেও আমার বড় আব্বু মানে আমার বড় চাচা আমাদের ছেড়ে যান নি। কিন্তু উনি যে ভ*য়ং*কর পরিকল্পনা করে আমাদের সাথে ছিলেন তা তখনও বুঝা তো দূর, মাথাতেও আসে নি। দেখতে দেখতে আব্বু যাওয়ার দুই সপ্তাহ পার হলো। চাচিম্মু ছায়ার মতো আমার সাথে সাথে ছিলেন। এর মাঝে যতবার ই আম্মুর সামনে গিয়েছি আম্মু দূর দূর করে তা*ড়ি*য়ে দিয়েছে। আম্মুর চোখে আমি তার স্বামীর মৃ*ত্যু*র জন্য দো*ষী হয়ে গিয়েছিলাম। চাচা চাচিম্মু সাথে ছিলো দেখে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম। আব্বু চলে গেলেও দ্বিতীয় বাবা অর্থাৎ আমার বড় চাচার হাত আমার মাথার উপর আছে ভেবে ভরসা পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই বিশ্বাস, ভরসা যে এক নিমিষেই ভে*ঙে চু*র*মা*র হয়ে যাবে তা কে জানতো!

থামলো আরশি। লম্বা একটা শ্বাস টে*নে আবার বলা শুরু করলো,

— আব্বুর যাওয়ার তৃতীয় সপ্তাহ চলছে তখন। হুট করে একদিন সন্ধ্যায় চাচা এসে রু*ক্ষ কণ্ঠে বললেন আম্মু কে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। অবাক হলাম আমি। বিস্ময়ে চোখের পাতা ফেলতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো যা দেখছি ভুল দেখছি, যা শুনছি ভুল শুনছি। বিশ্বাস হচ্ছিলো না এটা সেই চাচা যে এতদিন আমাদের সাথে এতো সুন্দর ব্যবহার করেছে। কিন্তু চাচা পুনরায় একই কথা বলায় অবাক কণ্ঠে চাচা কে জিজ্ঞাসা করলাম এসব উনি কি বলছেন। চাচা বা*জে একটা গা*লি দিয়ে বললেন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। সেদিন কি হলো কি জানি নিজের মাঝে একটা জে*দ অনুভব করলাম। তে*জে*র সাথে বললাম আমার আব্বুর বাসা ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। আর এই বাসা তো আমাদের। উনি যেনো এই বাড়ি থেকে চলে যায়। আমার কথায় খি*ক*খি*ক করে হেসে উঠলেন চাচা। কিছু পেপার্স আমার সামনে ফেলে বললেন এখন থেকে এই বাড়ি আর আব্বুর ব্যাংক এ যা ব্যালেন্স আছে সবকিছুর মালিক উনি। চমকে উঠলাম আমি। দ্রুত পেপার্স হাতে নিয়ে দেখলাম। তেমন কিছু না বুঝলেও এটা বুঝলাম আমাদের সব কিছু আমার চাচা নিজের নামে করে নিয়েছেন। পায়ের তলা থেকে যেনো মাটি সরে গিয়েছিলো এসব দেখার পর। চাচা মানুষটাকে অচেনা লাগছিলো। আমি জে*দ ধরে বসে রইলাম আমার বাসা থেকে আমি কিছুতেই যাবো না। চাচিম্মু আর নাতাশা আপু ও অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো চাচা কে। কিন্তু চাচা মানবার মানুষ নন। উনাদের ও অ*কথ্য ভাষায় গা*লি*গা*লা*জ করলেন, চাচিম্মুর গায়ে হাত পর্যন্ত তু*লে*ছিলেন। তারপর… তারপর আর কি আম্মু আর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। চাচা এতো বড় বে*ই*মা*নি করবেন ধারণার বাহিরে ছিলো। এইসব কিছুর মাঝে আম্মু একদম নীরব ছিলো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমাদের বাড়িটার দিকে। আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে খুব ক*ষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু কাঁ*দ*তে পারছিলাম না। বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে এবার অনেক বেশি শ*ক্ত হতে হবে। কারণ এই সুন্দর পৃথিবী আমার জন্য আর সুন্দর নেই বরং ক*ঠি*ন থেকে ক*ঠি*ন হতে চলেছে। অ*ন্ধ*কা*র হয়ে গেছে তখন। আম্মু কে বাসার সামনে রেখে আমি পাশের দোকানে গিয়ে মুনের বাবা কে ফোন করলাম। মুন আমার বেস্টু ছোটবেলা থেকে। একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি আমরা। মুনের বাবা কে সব টা জানানোর পর উনি কিছু সময়ের মধ্যেই আমাদের বাড়ির সামনে আসেন। আমাদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যান। মুন আর মুনের বাবার এতে কোনো স*ম*স্যা না থাকলেও মুনের আম্মুর মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম উনার আমাদের আসা টা মোটেও পছন্দ হয় নি। আর পছন্দ না হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেখানে আত্মীয়রা পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিলো সেখানে উনি তো বাইরের মানুষ। কিন্তু ওই রাত টা ওখানে কা*টা*নো ছাড়া আর কোনো উপায় ও ছিলো। মুনের বাবা সব টা জানার পর আমাকে পুলিশের হেল্প নিতে বললেন। কিন্তু আইনের উপর থেকে আমার ভরসা একেবারেই উঠে গিয়েছিলো। কারণ আব্বুর মৃত্যু নিয়ে তারা কোনো তদন্ত ই করে নি। যেখানে আমার কাছে স্পষ্ট মনে হয়েছিল আমাদের ইচ্ছা করে হ*ত্যা*র চেষ্টা করা হয়েছিল সেখানে তারা কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই সেটাকে এ*ক্সি*ডে*ন্ট বলে চালিয়ে দিয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, তারা সেই ট্রাক ড্রাইভার কেও খোঁজার চেষ্টা করে নি। তাই পুলিশের কাছে সাহায্য চাওয়া মানে সময় ন*ষ্ট বলে মনে হলো আমার। ওইদিন রাত টা মুনদের বাড়িতেই কা*টা*লাম। সকালে আম্মু কে ওদের বাড়িতে রেখে মুনের বাবার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। খুঁজে একটা দুই রুমের ঘর ভাড়া নিলাম। নিম্নমানের এলাকা হওয়ায় ভাড়া খুব বেশি ছিলো না। তবে আমার কাছে বেশিই ছিলো। বাড়িওয়ালি যখন অ্যাডভান্স চাইলো মুখ টা শু*কি*য়ে গেলো আমার। আমার কাছে তখন এক টাকাও নেই। কিন্তু বেশিক্ষন চি*ন্তা করতে হলো না। মুনের বাবা অ্যাডভান্স সহ দুই মাসের ভাড়া দিয়ে দিলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন যতক্ষণ না আমার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে উনি সাহায্য করবেন। এর জন্য আমি সারাজীবন উনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। এরপর আম্মু কে নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠলাম। কাজের খোঁজ করতে লাগলাম। আমাকে দেখে মায়া হলো প্রতিবেশী আন্টির। উনি খোঁজ করে কিছু টিউশন পাইয়ে দিলেন। খুব বেশি বেতন ছিলো না তবে চলার মতো। নাতাশা আপুর সাথে যোগাযোগ করে আমার সার্টিফিকেট গুলো নিয়ে একটা সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। দেখলেন ভাগ্য কাকে, কখন, কোথায় নিয়ে যায়? কোথায় আমার পড়ার কথা ছিলো বেস্ট কলেজে, সেই আমি ভর্তি হলাম একটা সরকারি কলেজে। অবশ্য এতে আমার রেজাল্ট এর কোনো ক্ষ*তি হয়নি। কারণ পড়াশোনা নিজের কাছে। আমি যেখানেই পড়ি না কেনো, ভালোমতো পড়াশোনা করলে আমাকে ভালো ফলাফল করা থেকে ঠে*কা*বে কে?

চলবে,