#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৬
কয়েকদিন হাসপাতালে কাটানোর পর বাড়ি ফিরেছে আদনান, মোটামুটি সুস্থই এখন তবে হাতের চোট ঠিক হতে সময় লাগবে। এদিকে রোজা ওকে ছোটো বাচ্চার মতো ট্রিট করছে, হাত দিয়ে তুলে একটা কাজও করতে দিচ্ছেনা। আদনান কিছু বললেই ছ্যাৎ করে উঠছে, মেয়েটা রেগে আছে না অভিমান করে আছে সেটা এ কয়দিনেও বুঝে উঠতে পারেনি ও। নিজের হসপিটাল সামলে আবার আদনানের সঙ্গে রাতে থেকে রোজা নিজেও কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দুদিনের জন্যে ছুটি নিয়েছে রোজা, এই পুরোটা সময় আদনানের সঙ্গে থাকবে। লাঞ্চের পর রোজা ঘুমিয়ে পড়েছিলো, সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙতেই হুড়মুড় করে উঠে দেখলো আদনান ঘরে নেই। বসার ঘরে গিয়ে দেখে সে টিভি দেখছে, রোজা হেলেদুলে গিয়ে আদনানের পাশে বসে হালকা ঘুম জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করলো…
‘ সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আমাকে ডাকোনি কেনো?’
‘ নিজের সঙ্গে একটু একান্তে সময় কাটাচ্ছিলাম, তাই ডাকিনি। তোমার জন্যে তো কয়দিন ধরে নিজেকে একটু সময়ও দিতে পারছি না’
‘ এতো বড় একটা কাহিনী করে ফেলার পরও মুখ দিয়ে কথা কিভাবে বের হয় তোমার হুমম? তোমার এরকম অবস্থায় আমি তোমার সঙ্গে থাকবো না পাশের বাড়ির মেয়ে এসে থাকবে?’
‘ আফসোস, আমাদের পাশের ঘরে মেয়ে নেই। থাকলে বিবেচনা করে দেখতাম ‘
রোজা মুখ বাঁকিয়ে চোখ বুঝে আদনানের কাধে মাথা রাখলো, মেয়েটার যে ঘুম পরিপূর্ন হয়নি তা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
‘ অনেক খাটাখাটনি করেছো এ কয়দিন, তোমারও যে একটু বিশ্রাম প্রয়োজন সেটা কি মাথায় আছে? নিজে যদি অসুস্থ হয়ে যাও তাহলে আমার টেক কেয়ার কিভাবে করবে?’
‘ দুদিন ছুটি নিয়েছি তো বিশ্রামের জন্যে ‘
‘এগুলোকে বিশ্রাম বলে? যাও, গিয়ে আরেকটু ঘুমিয়ে এসো’
কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো রোজা, এলোমেলো চুলগুলো খুলে আরেকবার খোঁপা করে নিলো…
‘ আলসেমি করার সময় নয় এখন, কি খাবে বলো’
‘ আমার খিদে পায়নি, তোমাকে কিছু…’
‘ ঠিক আছে, আমি যেটা বানাবো সেটাই খেতে হবে। অভিযোগ করতে পারবে না’
রোজা যেনো ওর কথায় কোনো পাত্তাই দিলো না, আদনান লক্ষ্য করছে মেয়েটা ইদানিং ওকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করছে। হয়তো হারানোর ভয় মনে জন্মেছে বলে এমন করছে? তবে বউয়ের এই কেয়ার ভালোই লাগছে আদনানের কারণ রোজাই প্রথম যে ওর এতো দেখভাল করছে। রোজা নাস্তা হিসেবে মোগলাই বানিয়ে আনলো, আদনান কোনো অভিযোগ না করেই খেতে শুরু করলো। খাওয়ার এক পর্যায়ে বললো…
‘ রোজা, অনেকদিন ধরে বাড়িতে বসে আছি। ভাবছিলাম বাইরে গিয়ে একটু…’
‘একদম না, এখন তোমার বাইরে যাওয়া চলবে না। কিছু প্রয়োজন হলে বলো আমি এনে দেবো ‘
‘ আমি ড্রাইভ করবো না, ড্রাইভ তুমিই করো ‘
‘ আদনান! এসব আমাকে বলে লাভ নেই। তুমি এখন বাড়ির বাইরে যাবেনা এটাই শেষ কথা ‘
আদনান রোজাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু রোজা শুনলে তো, এরই মাঝে হসপিটাল থেকে একটা ফোন এলো। রোজা কল রিসিভ করার আগে উঠে দাঁড়িয়ে বললো…
‘ আমি কথা বলে আসতে আসতে পুরোটা খেয়ে শেষ করবে’
রোজা কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে ঘরে চলে গেলো, এদিকে আদনান মুখ গোমড়া করে খাবার খাচ্ছে। রোজার জন্মদিনের দিন দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় ওকে কোনো উপহার দিতে পারেনি বিধায় ভেবেছিলো কিছু কিনে আনবে কিন্তু তার উপায় নেই। চাইলে অনলাইন অর্ডার করেই কিছু আনিয়ে নিতে পারতো কিন্তু আদনান নিজের হাতে উপহার আনতে চায়। এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। রাতে…রোজা ল্যাপটপে কিছু একটা দেখতে ব্যস্ত ছিলো কোত্থেকে আদনান এসে রোজার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো!
‘ কি হলো?’
‘ আমি বোর ফিল করছি, চলো কোথাও ঘুরে আসি ‘
‘শুধু বাইরে বেরোনোর বাহানা তাইনা?’
‘আমার জায়গায় তুমি থাকলে বুঝতে, এভাবে সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে কাটাতে কার ভালো লাগে। নিজেকে এতো অসহায় লাগছে ‘
‘ সারাদিন আমি তোমার সঙ্গে আছি, তারপরও অসহায় লাগছে?’
‘ চলো না একটু বাইরে হেঁটে আসি ‘
আদনান এতো অনুরোধ করলো যে রোজা এর না করতে পারলো না, তাছাড়া বেচারা এতদিন ধরে বাড়িতে বসে আছে। বাইরে বেরোলে ফ্রেশ লাগবে ভেবে রোজা রাজি হয়ে গেলো। ডিনার শেষে ওরা বেরোলো, ওদের বাসার সামনে বড় রাস্তা আছে। রাত নয়টার পরেই রাস্তায় লোকের আনাগোনা কমে যায়। প্রথমবারের মতো আদনানের হাত ধরে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটছে রোজা, পূর্বে কয়েকবার অবশ্য আদনান বলেছিলো কিন্তু দুজনের কারোরই সময় হয়ে উঠতো না। আদনান ছোটো একটা বিজনেস শুরু করেছে। রোজা আদনান উভয়ই সারাদিন কাজে ব্যস্ত থেকে বাড়িতে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়তো, এরপর আর বাইরে হাটতে আসার মতো শক্তি বা ইচ্ছা কোনো থাকতো না তবে আজ সুযোগ এসেছে। ধীরে ধীরে হাঁটছে দুজনেই, এরই মাঝে আদনান জানতে চাইলো…
‘তোমার হাসপাতালে কাজকর্ম কেমন চলছে?’
‘ ভালোই, কিন্তু আমাদের বিভাগে ডাক্তার কম থাকায় কাজের চাপ মাঝে মাঝে একটু বেশি হয়ে যায়’
‘ আই নো! তা লাস্ট কবে ডেলিভার করেছো?’
‘ তোমার যেদিন অ্যাকসিডেন্ট হলো সেদিন একটা মেয়ে বেবী ডেলিভার করেছি। বেবীর মা ইমার্জেন্সীতে এসেছিলো। তার অবস্থা ক্রিটিকাল ছিলো, তবে আলহামদুলিল্লাহ এখন সে সুস্থ’
‘ বেবী গার্ল? আই অলসো লাইক বেবী গার্ল। আমাদের একটা হলে মন্দ হয় না কি বলো?’
‘ হ্যাঁ, তারপর তাকে কে সামলাবে?’
‘উম্ম! তুমি চাইলে আমি কাজকর্ম ছেড়ে বাড়িতে থাকতে পারি। আমি বেবী পালবো এবং বাড়ির কাজ করবো আর তুমি ইনকাম করবে। আইডিয়াটা কেমন?’
‘ ভীষন বাজে আইডিয়া ‘
‘কেনো! মা বা বাবা কোনো একজনকে বেবীর সবসময় কাছে পাওয়া উচিত। আমি না হয় থাকলাম’
‘ আচ্ছা, যখন সময় আসবে তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে যে কে বাড়িতে থাকবে। দরকার পড়লে আমি…’
‘ তুমি এতোটা স্ট্রাগল করে, নিজের বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছো রোজা। এতো সহজে ছেড়ে দেবে? আমি থাকতে সেটা হবেনা। তুমি তোমার কাজ ছাড়বে না, বেবী হলে আমি কোনোভাবে ম্যানেজ করে নেবো ‘
‘ কিন্তু…’
‘ আচ্ছা, এখন এসব আলোচনা করার সময় না। আমি বোধহয় একটু বেশীই তাড়াতাড়ি এসব ভাবছি, এক – দু বছর যাক তারপর দেখা যাবে’
‘ হুমম!’
‘ চলো চা খাই?’
‘ রাতের বেলা চা খাওয়ার দরকার নেই, এমনিতেই তোমার ঘুম পাতলা। তার ওপর চা খেলে রাতে ঘুম আসবেনা। এখন তুমি যতো বেশি ঘুমাবে ততো দ্রুত সেরে উঠবে ‘
‘ আমি একদম সুস্থ!’
‘ আমাকে ওসব বুঝিয়ে লাভ নেই, চা খাওয়া চলবে না। আর এখন কিসের খাওয়া? মাএ না ডিনার করে বেরোলে?’
রোজাকে এক প্রকার শাসন করতে দেখে আদনান হেসে বললো…
‘তুমি যেভাবে শাসন করো তাতে মনে হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ সন্তানের কপালে দুঃখ আছে’
‘ শাসন না করলে বাঁদর হয়ে যাবে, শাসন করা জরুরি তবে অতি শাসন নয়। আমার বাবা আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছে, আমার সন্তানের সঙ্গে আমি তেমন করতে চাইনা’
মুহূর্তের মধ্যেই রোজার মন খারাপ হয়ে গেলো, আদনান কিছু বলবে তার আগেই রোজা বলে উঠলো…
‘ যে ডেলিভারির কথা বললাম একটু আগে, জানো ওই মেয়েটার সঙ্গে শুধু ওর হাসবেন্ড এসেছিলো। নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছিল বলে ওদের পরিবার মেনে নেয়নি। মেয়েটার এমন অবস্থায় সাহায্যের জন্যে অন্তত মায়ের প্রয়োজন ছিলো কিন্তু ছেলেটার কথায় যা বুঝলাম হয়তো কেউই আসবেনা। মেয়েটার জায়গায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে নিজেকে ভাবছিলাম, আমাদেরও পাশে কেউই নেই ‘
কথাগুলো বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোজা, আদনান পাশ থেকে রোজাকে জড়িয়ে ধরে বললো…
‘ জানো এমন কত ঘটনা আছে যেখানে একটা মেয়ে সবার সাপোর্ট পাওয়ার পরও শুধু হাসবেন্ডের সাপোর্ট না পাওয়ায় স্যাড ফিল করে? আমার এসব বিষয়ে যদিও তেমন অভিজ্ঞতা নেই তবে আমি যতটুকু বুঝি তাতে মেয়ের বিয়ের পর তার হাসবেন্ডের পাশে থাকার সবচেয়ে জরুরি। ওর সঙ্গে পরিবারের কেউ নেই ঠিকই, কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় সাপোর্ট সিস্টেম ওর হাসবেন্ড আছে। এটাই অনেক! দেখবে তারা নিজেরাই সব সামলে নেবে, আর যে আপন মানুষগুলো ওদের বিপদের দিনেও এগিয়ে আসেনি তারা নিজেদের ভুল একদিন অবশ্যই বুঝবে’
আদনানের কথা শুনে ভীষন ভালো লাগলো রোজার, ও লক্ষ্য করেছে যে যখনই লো ফিল করে তখনই আদনান ওকে মোটিভেট করার চেষ্টা করে। আদনানের এই দিকটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ রোজার, গত মাসে এক ডেলিভারির সময় বাচ্চা বা উভয়েরই কিছু কম্পলিকেশন হওয়ায় পেশেন্টের বাড়ির লোক ওকে দোষারোপ করেছিলো যদিও ওর কোনো দোষ ছিলো না তবুও কেনো যেনো ওনাদের কথা শুনে গিল্টি ফিল করছিলো তখনও আদনান ওকে বুঝিয়েছে। বরাবরই আদনান চেষ্টা করে ওকে হ্যাপী রাখার। মাঝে মাঝে নিজেকে ভীষন ভাগ্যবতী মনে হয় রোজার, হয়তো পালিয়ে আসার সিদ্ধান্তটাই সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো আর এর জন্যে রোজার কোনোদিন আফসোস হবেনা!
__________________________
রোজা কাজে ব্যস্ত ছিলো এরই মাঝে মায়ের ফোন এলো। আজ অনেকদিন পর মায়ের ফোন এলো, সেদিন ও বাড়ি থেকে চলে আসার পর রোজার আর ওর মায়ের সঙ্গে কথা হয়নি। ঝামেলা হতে পারে ভেবে রোজাও আর ওর মাকে কল করেনি, আজ মা নিজেই ফোন করেছে দেখে রোজার মনে শান্তি লাগলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রোজার মা বললো…
‘ কেমন আছিস রে মা?’
‘ ভালো, তোমরা কেমন আছো?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রোজার মা…
‘এতকিছু হয়ে গেলো তারপরও কিভাবে ভালো থাকি বল? তোর বাবা তোর ওপর ভীষণ রেগে আছে, তার ওপর তোর বোনের..’
‘ কি হয়েছে?’
‘ তুই পালিয়ে যাওয়ার পর তোর বাবা সেদিন নিজের সম্মান রক্ষার জন্যে নিষাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ‘
মায়ের কথা শুনে চমকে গেলো রোজা, ও ভেবেছিলো পালিয়ে এলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। হয়তো ওর বাবা কিছুটা হলেও বুঝবে যে তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো কিন্তু ওর বাবা যে উল্টে এমনকিছু করবে তা কল্পনাও করেনি রোজা!
‘ কি বলছো মা! এতকিছুর পরেও বাবা এটা কিভাবে করলো? আর ও রাজি কেনো হলো?’
‘ আমিও জানিনা তোর বাবা কি বলেছে ওকে। আমি কতো করে জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু কিছুই বলেনি আর এখনও বলতে চায়না। সেদিন পার্লারে তোর ওপর ঠিকঠাক নজর রাখতে পারেনি বলে বাড়ি আসার পর তোর বাবা ওকে মে’রে’ছিলো। পরে নিষাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তোর বোনকে বিয়ের জন্যে রাজি করিয়েছে।বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়েই রাজি হয়ে গেছে। এখনও কোনো ঝামেলা তো হয়নি, তবে তোর কাছে ছেলেটার যে বর্ণনা শুনেছি তাতে ভবিষ্যতে কি যে হবে ভেবেই আমার মাথা কাজ করেনা ‘
‘ এখন কি অবস্থা ওর? নিষাদ ওর সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেনা তো?’
‘ আপাতত তো তেমন কিছু শুনলাম না, নতুন নতুন তো আর কিছু করবেনা। জানিনা মেয়েটা আমার ও বাড়িতে কিভাবে থাকবে ‘
বাবার এই কর্মের কথা শুনে বাবার ওপর অসন্তুষ্ট হলো রোজার, এমনকি ছোটো বোনকে ওর জন্যে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হলো জেনে নিজের ওপরও রাগ হলো ওর!
‘ ভেবেছিলাম আমি চলে এলে হয়তো বাবা একটু ভাববে, বোঝার চেষ্টা করবে যে তার সিদ্ধান্ত কোথায় আর কেনো ভুল ছিলো কিন্তু উনি এমন একটা কাজ করে একদম ঠিক কাজ করলেন না ‘
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]