#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৮
ভদ্রলোকের কথা শুনে আদনান মস্তিষ্কে আরো জোর খাটালো, সাধারণত কারো সঙ্গে একবার দেখা হলেও সেই ব্যক্তিকে মনে থাকে ওর কিন্তু এই লোকটির সঙ্গে কথাও আলাপ হয়েছে কিনা সেটা মনেই পড়ছেনা আদনানের। এদিকে ভদ্রলোক এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেনো আদনান তার কতদিনের পূর্ব পরিচিত!
‘ দুঃখিত কিন্তু আমার মনে পড়ছেনা, আমাদের আগে দেখা হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই আমি আপনাকে চিনতাম’
লোকটি যেনো এ কথা কিছুটা কষ্ট পেলেন, পরক্ষনেই স্মিত হেসে বললেন…
‘এতো ভাবনার কিছু নেই, আমাদের আগে দেখা হয়নি তবে আমি তোমার ব্যাপারে শুনেছি। তুমি আমার ছেলের বয়সি, তুমি করে বললে আপত্তি আছে?’
‘ সমস্যা নেই, প্লিজ হ্যাভ অ্যা সিট ‘
লোকটি চেয়ার টেনে বসলো…
‘ বলুন আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি আর আমার এই ছোট্ট অফিসের খোঁজ আপনি কিভাবে পেলেন সেটা কি জানতে পারি?’
‘অফিস ছোটো হলেও তোমার বিজনেস স্কিলের অনেক প্রশংসা শুনেছি, অল্পদিনেই ভালো প্রফিট করেছো সেটাও শুনেছি। তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে বিজনেসের বিষয়েই কিছু আলাপ করা যাক’
লোকটির কথা শুনে আদনানের কিছুটা সন্দেহ হলো, কৌতুহলবশত সে প্রশ্ন করে বসলো…
‘ আপনাকে কি আমার বাবা পাঠিয়েছে?’
‘ বাবা?’
‘ ইয়াহ! আপনার কথা শুনে মনে আমার বাবা…’
‘আমাকে কেউ পাঠায়নি, আমি নিজেই এসেছি। তোমার এক ক্লায়েন্টের কাছে তোমার কথা শুনেছি। এই অফিসে ঠিকানাও সেই দিয়েছে’
‘ওহ আচ্ছা, আপনি হঠাৎ বিজনেসের কথা বললেন বলে ভাবলাম আমার বাবা হয়তো…’
‘ তুমি আর তোমার বাবা আলাদা বিজনেস করো?’
‘জ্বি আমি নিজের আলাদা বিজনেস করছি।এনিওয়ে, বলুন আপনি কি বিষয়ে আলোচনা করতে চান?’
ভদ্রলোকটি আদনানের বিজনেসে বড় অঙ্কের টাকা ইনভেস্ট করার আগ্রহ প্রকাশ করলো, লোকটির সঙ্গে আলাপ শেষে আদনান লোকটির পরিচয় জানতে পারলো। সেও একজন বড় ব্যবসায়ী। আদনান প্রথমে রাজী হয়নি কারণ নতুন বিজনেস হিসেবে বড় অঙ্কের টাকা ইনভেস্ট করে লস হলে পরবর্তীতে ইনভেস্টর নিজের মূলধন ফেরত পাওয়ার জন্যে ঝামেলা করতে পারে।
‘দেখুন আমি এতদিন আমার বাবার বিজনেস সামলেছি, কয়েকমাস যাবৎ নিজের বিজনেস শুরু করেছি। আপনি যে প্রফিটের কথা শুনেছেন সেটা খুবই সামান্য, অ্যাজ অ্যা বিজনেসম্যান আপনি নিশ্চয়ই জানেন নতুন বিজনেসে বড় অঙ্কের টাকা ইনভেস্ট করলে রিস্ক আছে’
‘আমি জানি, তবুও একটা রিস্ক নিতে চাইছি’
‘আপনি রিস্ক নিতে চাইছেন কিন্তু লস হলে তখন তো দায় আমাকেও দিতে পারেন। আর আমার বিজনেস এতটাও স্টেবল নয় যে ভবিষ্যতে আপনি দাবি আমি আপনার ইনভেস্ট করা টাকা ফেরত দিতে পারবো’
‘লস কেনো হবে? নিজের ওপর কনফিডেন্স নেই তোমার? একটা বিজনেস শুরু করার জন্যে যথেষ্ট সাহস ও স্কিল দরকার হয় নিশ্চয় সেসব তোমার আছে বলেই নিজের বিজনেস শুরু করার সাহস পেয়েছো?’
‘আপনার আগ্রহের জন্যে ধন্যবাদ তবে আমি বলবো আপনি আরেকবার ভেবে দেখুন। আপনি টাকা ইনভেস্ট করলে হতে পারে আমাদের দুজনেরই লাভ হলো আবার ডুবলে আমরা একসঙ্গেই ডুববো ‘
‘আমি সব ভেবেই এখানে এসেছি, আর আমি এটাও জানি তোমার বিজনেস এখনও নড়বড়ে। ইনভেস্ট আমি করতে চাইছি, এবার সিদ্ধান্ত তুমি নেবে। তবে আমার মনে হয় আমার সঙ্গে ডিল করলে তোমার লস হবেনা’
লোকটি বেশ আগ্রহ প্রকাশ করছে দেখে আদনান কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেলো, ওর বিজনেস বাড়ানোর জন্যে এই মুহূর্তে বড় অঙ্কের টাকার দরকার কিন্তু এতো টাকা আপাতত ওর কাছে নেই। লোকটি ইনভেস্টর হলে মন্দ হয় না। তবুও কিছু ফিক্স করার আগে লোকটির সম্পর্কে আরও খোজ নিতে চায় আদনান…
‘ ফাইন! আমি ভেবে দেখবো এ ব্যাপারে। আমরা অনেকক্ষণ যাবত কথা বলছি, আপনি চা কফি বা অন্যকিছু কিছু খাবেন?’
‘ না না, ডাক্তার আমাকে চা কফি খেতে সম্পূর্ন নিষেধ করেছে ‘
‘তাহলে অন্যকিছু আনতে বলবো?’
‘দরকার নেই। উম্ম! আচ্ছা তোমার বর্তমান বয়স কতো?’
‘উনত্রিশ’
ভদ্রলোক যেনো খানিকটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন, আদনান বিষয়টা লক্ষ্য করলো ঠিকই তবে কিছু বললো না। মিনিট দুয়েক পর উঠে দাঁড়ালেন সে…
‘আচ্ছা, ঠিক আছে আজ আসছি। আমার কার্ড তো তোমাকে দিলাম, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমাকে একটা কল করে দিও’
বেরিয়ে গেলো লোকটি, আদনান এবার ভদ্রলোকের কার্ডটা দেখতে দেখতে একজনকে ফোন করলো লোকটির বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্যে। ওদিকে…রোজা আজ ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আজ সকালে ওর মা ফোন করেছিলো, ওর বাবা আজ বাড়ি থাকবেনা বিধায় মেয়েকে দেখা করতে আসতে বলেন তিনি। রোজা যদিও প্রথমে রাজি হয়নি কিন্তু মাকে একনজর দেখার জন্যে মনের ভেতর আনচান করছে মেয়েটার। তাই লাঞ্চের পর বাড়ি চলে গেলো, হসপিটাল থেকে নিজের বাড়ি যেতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগলো। মেয়েকে এতদিন পর দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন রোজার মা…
‘ এতদিন পর তোর মায়ের কথা মনে পড়লো রে রোজা? একবার নিজে থেকে দেখা করতেও এলি না। আমি না বললে হয়তো আর আসতিস না’
‘ না গো মা, তোমাকে এতদিন না দেখে ভালো থাকা কি সহজ বলো? কিন্তু আমি এখানে এলে বাবা সেটা ভালো চোখে দেখবেনা, এখন বাবা বাড়িতে থাকলে হয়তো আমাকে বাড়িতেই ঢুকতে দিতো না’
‘এখন এসব কথা থাক মা, তোর বাবার কথা ছাড়। আজ শুধু আমরা মা মেয়ে কথা বলবো। তা তুই একা এলি কেনো? তোর বরকেও সাথে আসতে বলতে পারতি’
‘ও ব্যস্ত আছে মা, তাছাড়া আমি ওকে বলে আসিনি। বললে হয়তো আসতো’
‘পরে সময় সুযোগ বুঝে একদিন নিয়ে আসিস, কাকে বিয়ে করলি ছেলেটা কেমন দেখলামও না। তোর বাবার সঙ্গে তো শুনলাম দেখা করেছিলো। তোর বাবার কাছে যা শুনেছি তাতে তো শুধু বদনামই শুনলাম, ওর কথা তোর বাবার পছন্দ হয়নি। যাই হোক, এসব কথা বাদ দেই। তুই গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি আজ তোর পছন্দের খাবার বানিয়েছি’
রোজার মা আগেই মেয়ের পছন্দের কিছু খাবার বানিয়ে রেখেছিলেন, রোজার বাবা তার বোনের বাসায় গেছেন রাতে আসবেন তাই রোজা সন্ধ্যা অব্দি এখানে থাকবে। রোজা হাতমুখ ধুয়ে আসতেই ওর মা খাবার বেড়ে দিলেন, বহুদিন পর মেয়েকে যত্ন করে খাওয়ালেন। খাওয়ার ফাঁকে মেয়ের কাছে ওর সংসার জীবনের গল্পও শুনলেন। রোজা আদনানের ছবিও দেখিয়েছে ওর মাকে। মেয়ের মুখে আদনানের এতো প্রশংসা শুনে স্বস্তিবোধ করছেন রোজার মা, সব মায়েরাই তো চায় তাদের মেয়ে ভালো থাকুক সুখে থাকুক।
‘আমি একদিন রাইসাকে আসতে বলবো, তুইও আসিস। কতদিন হলো দুই মেয়েকে একসঙ্গে দেখিনা। দুই মেয়েকে একসঙ্গে রেঁধে খাওয়াবো ‘
‘ বিয়ের পর রাইসা আর এ বাড়িতে আসেনি?’
‘ একবার এসেছিলো, ওর শাশুড়ি নাকি ঘনঘন বাপের বাড়ি যাওয়া পছন্দ করেনা। আমিই গেছিলাম দুবার দেখা করতে। মেয়েটা ভীষণ উদাস হয়ে ছিলো রে, যদিও মুখ ফুটে কিছু বলেনি তবে আমি বুঝেছি ও হয়তো ভালো নেই ওখানে ‘
‘মা, তুমি নিয়মিত ওর খোঁজ নিও। ও ছোটো মানুষ, শ্বশুরবাড়িতে কোনো ঝামেলার সম্মুখীন হলে সেটা প্রকাশ করতে দ্বিধা করবে’
‘সে তো আমি নিজের যথাসাধ্য খোঁজ রাখার চেষ্টা করি কিন্তু তোর বাবার জন্যে পারি কই? শান্তিমতো একটু কথাও বলতে পারিনা রাইসার সঙ্গে, তোর বাবা বলে এতো কিসের কথা। তোর বাবার স্বভাব কেমন জানিস তো’
জামাল সাহেব ঘরে বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই বরাবরই রুক্ষ ছিলেন, ছোটো থেকে নিজেদের ইচ্ছায় নিজের স্ত্রী বা সন্তান কাউকেই কিছু করতে দেননি। সবকিছুই নিজের মর্জিমাফিক চালনা করার চেষ্টা করেছেন আর সেটাই করেছেন। বাবার এই স্বভাবের জন্যে দিনদিন বাবার প্রতি রোজার মনে তিক্ততা বেড়ে যাচ্ছে।
‘বাবার এতো কিসের সমস্যা সেটাই আমি বুঝতে পারছি না, নিজের জেদের জন্য রাইসার জীবনটা শেষ করে দিলো। বাবার থেকে অন্তত এটা আশা করিনি আমি’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রোজার মা…
‘মা হিসেবে আমি নিজেই তো ব্যর্থ, আমি কিছুই করতে পারলাম না আমার মেয়েদের জন্যে। চোখের সামনে শুধু দেখেই গেলাম’
‘তুমিই বা কি বলতে মা, তুমি কিছু বললেই বাবার সঙ্গে ঝামেলা হতো। এসব নিয়ে ভেবো না তুমি, শুধু ওর রেগুলার খোঁজ খবর নিও। আর ও বাড়িতে ও কেমন আছে সেই খবর রেখো, কোনো সমস্যা হলে আমাকে অবশ্যই কল করো’
মায়ের সঙ্গে পুরোটা বিকেল কাটিয়ে বাসায় ফিরলো রোজা, আসার সময় মেয়ের কাছে জামাইয়ের জন্যে জন্যে খাবারও দিয়ে দিয়েছে। বাসায় এসে রোজা দেখলো আদনান আজ সন্ধ্যায়ই এসে গেছে।
‘আজ এতো তাড়াতাড়ি বাসায় এসে গেছো?’
‘তেমন কাজ ছিলো না তাই চলে এলাম, কিন্তু তুমি এগুলো কি কিনে এনেছো?’
‘কিনে আনিনি, আমার মা পাঠিয়েছে তোমার জন্যে’
খাবারের ব্যাগটা আদনানের হাতে দিয়ে রোজা গিয়ে সোফায় বসলো, আদনান টেবিলের ওপর বক্সগুলো বের করে রেখে রোজার জন্যে এক গ্লাস পানি এনে বললো…
‘তোমার মা পাঠিয়েছে?’
‘হুমম, আমি আজ দুপুরে বাসায় গেছিলাম। অনেকদিন পর মায়ের সঙ্গে দেখা হলো, তার সাথে গল্প করে মনটা ভীষণ ভালো লাগছে’
‘তোমার বাবা কিছু বললো না?’
‘তোমার কি মনে হয় বাবা বাড়িতে থাকলে আমি ভেতরে ঢোকার চান্স পেতাম? বাবা ফুপুর বাড়িতে গেছে সেই সুযোগই তো মা আমাকে যেতে বলেছিলো’
‘তাও ঠিক, তোমার বাবা যে রাগী মানুষ। আপাতত ওনার সামনে তোমার না যাওয়াই উত্তম। তোমার ওপর এখনও রেগে আছেন উনি?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোজা, পানিটুকু খেয়ে আদনানের কাঁধে মাথা রাখলো। আদনান তাতেই বুঝেছে রোজার বাবার রাগ এখনও পড়েনি!
‘ ভালোই হয়েছে তুমি বাসায় গেছিলে, এই সুযোগে আমি শাশুড়ি মায়ের হাতের রান্না প্রথমবারের মতো টেস্ট করতে পারবো’
‘মা তোমাকে এরপর নিয়ে যেতে বলেছে, তোমাকে দেখতে চায় সে’
‘ অবশ্যই দেখা করবো, কিন্তু তুমি আজ গেলে আমাকে বললেই পারতে। আমিও সঙ্গে যেতাম ‘
‘ হুট করে গেছি, ভাবলাম তোমাকে বিরক্ত না করি। আচ্ছা একদিন মাকে এখানে নিয়ে আসবো কি বলো? এটা ভালো হবেনা?’
‘গুড আইডিয়া’
আদনানের সঙ্গে কথা শেষে ফ্রেশ হতে গেলো রোজা, অন্যান্যদিনের তুলনায় শরীরটা বেশিই দুর্বল লাগছে আজ। ওর শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ এমনিতেই কম, ডিউটি করতে গিয়ে ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া হচ্ছেনা কিছুদিন যাবত। রোজা ভাবলো হয়তো এজন্যেই এমন হচ্ছে, পরেরদিন ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে শরীরে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধির জন্যে কিছু ওষুধ কিনে নিলো। ওদিকে…আজ বহুদিন পর তানভীরের সঙ্গে আদনানের দেখা হলো। আদনান নিজের যোগাযোগ করেছে, বন্ধুর খোঁজ পেয়ে তানভীরও আর দেরি করেনি। সোজা ছুটে আদনানের বাসায় চলে এসেছে দেখা করতে…
‘তুই যেভাবে হুট করে গায়েব হয়ে গেলি আমি ভেবেছিলাম আর তোর খবরই পাবো না। কিন্তু তুই তো দেখছি ভালোই সংসার পেতেছিস’
‘আর বলিস না, রোজা ওভাবে হুট করেই বিয়ের জন্যে রাজি হয়ে যাবে ভাবিনি। তাই তো এক প্রকার অপ্রস্তুত হয়েই সব করতে হয়েছে’
‘এই বিয়ের ব্যাপারে হুটহাট ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোই টিকে যায়। আর রোজা রাজি না হলেও বা কি, তুই তো ওকে তুলে আনার প্ল্যান করেছিলি। তা ভাবী কোথায়?’
‘ হসপিটালে ‘
‘ ওহ আচ্ছা, আমি আরেকদিন এসে বরং ভাবীর সঙ্গে দেখা করবো। বাই দ্যা ওয়ে, তুই সব ছেড়ে আসার পর তোর বাবা কিন্তু বিজনেস সামলাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে ‘
‘ কেনো? ফারহান কি করছে?’
‘ও কি আর তোর মতো সব সামলাতে পারে? জরুরি সব কাজ আঙ্কেলকেই করতে হচ্ছে ‘
এনায়েত সাহেবের বাড়ি থেকে চলে আসার পর আদনান আর ওদিকে কি হয়েছে খোজ নেয়নি, যদিও বাবার কথা মনে পড়েছে কিন্তু সব ছেড়ে আসার পর তো আবেগ দেখানো উচিত নয়। তানভীরের কাছেই নিজের বাবার বিষয়ে অনেককিছু জানতে পারলো আদনান!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]
#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#বোনাস_পর্ব
মাঝরাতে ভীষণ খিদে পেয়েছে রোজার, আস্তে আস্তে উঠে ফ্রিজের কাছে গেলো কিন্তু ফ্রিজে বানানো কোনো খাবারই ছিলো না। কিছু বানিয়ে খাওয়ার মতো শক্তি বা সময় কোনোটাই এখন নয়। অগত্যা বিস্কুট খেয়েই খুদা নিবারণ করতে হবে ভেবে ফ্রিজের ওপর থেকে বিস্কুটের কৌটা নামাতে যাবে তখনই পেছনে কারো ছায়া দেখে চিৎকার করে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখ চেপে ধরলো আদনান…
‘এভাবে চিৎকার করো না বউ! লোকে কি ভাববে?’
‘ চিৎকার করবো না তো কি করবো হ্যাঁ? ভূতের মতো আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলে কেনো! ভয় পেয়ে গেছি আমি ‘
‘আর তুমি চোরের মতো এই মাঝরাতে উঠে এখানে কি করছো?’
‘ খিদে পেয়েছে আমার ‘
‘তোমার আবার মাঝরাতে খুদা লাগতে শুরু করলো কবে থেকে?’
‘ আজ থেকে!’
‘ খুব খিদে পেয়েছে?’
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো রোজা, বয়াম খুলে একটা বিস্কুট মুখে দিলো। এক কা’ম’ড় খেতেই বাকিটুকু আদনান ওর হাত থেকে নিয়ে নিজে খেয়ে নিলো…
‘ আমার বিস্কুট খেলে কেনো?’
‘ এসব খেয়ে পেট ভরবে না তোমার, আমি কিছু ভারী খাবার বানিয়ে দিচ্ছি’
‘ পা’গ’ল নাকি! এতো রাতে তোমাকে কোনো ঝামেলা করতে হবেনা, আমি কয়েকটা বিস্কুট খেয়ে পানি খেয়ে নিলেই হয়ে যাবে’
‘এতে খুদা যাবেনা, আর খুদা না গেলে তোমার ঘুমও আসবেনা। তুমি এক কাজ করো, গিয়ে শুয়ে থাকো। আমি তোমার জন্যে নুডুলস বানিয়ে দিচ্ছি ‘
‘ মানে কি! তুমি এখানে খাটবে আর আমি আরাম করবো? আমিও হেল্প করি ‘
‘কোনো প্রয়োজন নেই! তুমি যদি এখানে থাকতে চাও তাহলে চুপ করে ওখানে বসে থাকো ‘
রোজা সাহায্য করার জন্য চেষ্টা করলো কিন্তু আদনান কিছু করতে দিলে তো, বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হলো ওকে। কিছুক্ষণ পর আদনান এক বাটি নুডুলস সুন্দরভাবে রোজার সামনে পরিবেশন করলো। খিদেয় পেট চো চো করছিলো রোজার, খাবার পেয়েই খাওয়া শুরু করলো। নিজে খাওয়ার ফাঁকে আদনানকেও কিছুটা খাইয়ে দিলো। খেতে খেতে প্রশ্ন করলো…
‘আমি যদি মাঝেমাঝে এভাবে মাঝরাতে তোমাকে ডেকে আমাকে কিছু বানিয়ে দিতে বলি, দেবে?’
‘তোমার কখন কি খেতে ইচ্ছা হয় শুধু সেটা বলবে, সময় দেখার প্রয়োজন নেই। আমি সব বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো’
একগাল হেসে মেয়েটা পুনরায় খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো, আদনান স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে মেয়েটাকে। রোজার হাসিমুখটা দেখলেই যেনো আদনানের সকল চিন্তা দূর হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আদনান ভাবে কখনো কি এই মেয়েটাকে ছাড়া একদিনও কাটানো সম্ভব হবে? হয়তো না! আদনান চায়না তেমন কোনো দিন ওর জীবনে আসুক, রোজাকে যে সে সারাজীবন নিজের পাশে দেখতে চায়
_____________________________________
আদনানের বিজনেসে টাকা ইনভেস্ট করার জন্যে যিনি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ওনার নাম মোস্তফা হাসান। লোকটির সম্পর্কে খোজ খবর নিয়েছে আদনান, মোটামুটি বড় মানের ব্যবসায়ী উনি তাছাড়া তেমন কোনো খারাপ রেকর্ডও নেই। আদনানের এ মুহূর্তে ইনভেস্টর প্রয়োজন, তাই সকল দিক বিবেচনা করে মোস্তফা সাহেবের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ও। সাধারণত ইনভেস্টরের কাজ শুধু টাকা ইনভেস্ট করা ও লাভের ক্ষেত্রে নিজের অংশ বুঝে নেওয়া কিন্তু মোস্তফা সাহেব প্রায়ই আদনানের অফিসে আসেন, মাঝে মাঝে এসে অনেকক্ষণ সময় কাটান। আদনানের সঙ্গে কথা বলেন, যেনো ওকে জানার চেষ্টা করেন। শুরুতে আদনান বিষয়টা তেমন গুরুত্ব দেয়নি কিন্তু ইদানিং ওর কেমন সন্দেহ হচ্ছে। ব্যবসায়ের খাতিরে আগ্রহ দেখাতেই পারে কিন্তু উনি যেনো আদনানের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। উনি আজও এসেছেন, মাসে দু – তিনবার আসেন। আদনান আজ কথার ফাঁকে ওনাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলেছে…
‘ আই ওয়ান্ট টু নো সামথিং ‘
‘ কোন ব্যাপারে?’
‘ আপনি কি কোনোভাবে আমাকে আগে থেকে চেনেন? ছোটবেলায় দেখেছেন বা এমনকিছু? আসলে এতদিন ধরে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আমায় ভালোভাবেই চেনেন ‘
‘ আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন? তোমার কি আমাকে সন্দেহ হচ্ছে?’
নড়েচড়ে বসলো আদনান, ভাবলো আজ সোজাসাপ্টা কথা বলে নেওয়াই উচিত কাজ হবে…
‘ধরে নিন তাই! আসলে আপনি প্রায়ই এখানে আসছেন আর বিজনেস রিলেটেড কথা না বলে আমার ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে জানতে চাইছেন। বিষয়টা সন্দেহজনক বটে। আমরা পূর্ব পরিচিত নই এরপরও আমার বিষয়ে আপনার এতো আগ্রহের কারণ বুঝতে পারছি না’
মোস্তফা সাহেব কিছুটা বিচলিত হলেন বটে!
‘ঠিকই ধরেছো, আমি তোমাকে চিনি। তুমিও আমাকে চেনো তবে…’
‘ তবে?’
মৌন রইলেন মোস্তফা সাহেব, আদনানের প্রশ্ন শুনে মধ্য বয়স্ক পুরুষটি যেনো কোনো এক গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো। আদনান বললো…
‘দেখুন, আপনার যা বলার স্পষ্ট করে বলুন। আর আপনি আমাকে কিভাবে চেনেন বা আমার সম্পর্কে জানতে কেনো আগ্রহী সেটাও আমার জানার অধিকার আছে ‘
আদনানের কথায় লোকটির ধ্যান ভাঙলো…
‘অবশ্যই! তবে আজ থাক। অন্য একদিন আসবো, সেদিন তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবো’
‘ আজ কেনো নয়?’
‘আজ মনে হয় না উপযুক্ত সময়, যাই হোক। আমি আজ আসি’
লোকটি অফিস থেকে বেরিয়ে এলো, লোকটিকে বেশ রহস্যময় লাগে আদনানের। লোকটি বেশ স্নেহমাখা কণ্ঠে ওর সঙ্গে কথা বলে, আদনান শুনেছে তার কোনো সন্তান নেই কিন্তু লোকটির কথাবার্তায় পিতার স্নেহমিশ্রিত আছে। আদনান জানেনা লোকটি আসলে কে, কেনোই বা বারবার ওর সঙ্গে দেখা করতে চলে আসে। নিজের প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় আছে সে। আদনানের অফিস থেকে বাইরে বেরোতেই মোস্তফা সাহেবের সেক্রেটারি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। উনি গাড়িতে বসতেই সেক্রেটারি ড্রাইভিং শুরু করলো। কিছুটা দুর যাওয়ার পর কৌতুহল বশত মোস্তফা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলো…
‘স্যার, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?’
‘ বলো ‘
‘আপনাকে দেখছি ইদানিং প্রায়ই এখানে আসছেন, কিছু সময়ও কাটাচ্ছেন। ওই ছেলেটা মানে মি. আদনান কি আপনার পরিচিত কেউ?’
সেক্রেটারির প্রশ্ন শুনে ভগ্ন নজরে বাইরের দিকে তাকালেন মোস্তফা সাহেব, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন…
‘পরিচিত বটে! আমার থেকেই ওর পরিচয়, কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো নিজের পরিচয় আমি ওর সামনে প্রকাশ করতে পারছিনা’
মোস্তফা সাহেবের কথা কিছুই বুঝলেন না ওনার সেক্রেটারি!
‘কিছু মনে করবেন না স্যার কিন্তু আপনার কথার মানে ঠিক বুঝতে পারলাম না’
‘ সে অনেক লম্বা কাহিনী, বলার মতো ধৈর্য্য বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। চলো এখন ‘
আর কথা বাড়ালো না সেক্রেটারি, চুপচাপ ড্রাইভ করতে থাকলো। সিটে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে দেখতে দেখতে মোস্তফা সাহেব ভাবছেন এবার হয়তো নিজের আসল পরিচয় দেওয়ার সময় এসেই গেছে। ওদিকে….সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে এক রোগীর কেস নিয়ে আলাপ করতে এসেছিলো রোজা, রোগীটির প্রেগন্যান্সিতে কিছু কম্প্লিকেশন আছে। কিভাবে কি করলে ভালো হবে তাই নিয়ে ডা. জোহরার কাছ থেকে কিছু বিষয় জেনে নিয়ে যাওয়ার সময় উনি জিজ্ঞাসা করলেন…
‘আর ইউ ওকে রোজা?’
‘ ইয়াহ! কেনো?’
‘তোমাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে ‘
‘ অসুস্থ? না তো? আমি ঠিক আছি। আসলে কিছুদিন যাবত ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছেনা তাই হয়তো ফেসটা এমন লাগছে’
‘নিজের যত্ন করো রোজা, এমনিতেই তো তোমার শরীর দূর্বল। ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করো, বিশ্রাম নাও। বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?’
স্মিত হাসলো রোজা…
‘ বাসায় তো শুধু আমি আর আমার হাসবেন্ড থাকি, তাই কোনো সমস্যা হয় না ‘
‘তোমার হাসবেন্ডকে যতটুকু দেখেছি তাতে তো কেয়ারিংই মনে হলো, এখন কি তোমার কেয়ার করেনা?’
‘না না, ও ভীষণ কেয়ারিং। আসলে আমার দোষেই আমার এই হাল হয়েছে। আমি নিজের যত্ন করবো। থ্যাংকস ফর ইউর কনসার্ন’
ডা. জোহরার কেবিন থেকে বেরোলো রোজা, উনি মন্দ বলেননি। রোজা নিজেও কিছুদিন যাবত অসুস্থ অনুভব করছে যদিও তেমন গুরুতর কিছু নয় তবে শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগে। আদনানকে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি, সে জানলে ঘরবাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে। আজকে লাঞ্চের সময় হসপিটালে সকল ডাক্তারদের সমন্বয়ে একটা মিটিং আছে, সে খবর পেয়ে রোজা আগেই বাইরে থেকে খাবার কিনে এনেছিলো কারণ লাঞ্চ টাইমে মিটিং হলে পরে খাওয়ার সময় আর পাওয়া যাবেনা। কোনরকম গোগ্রাসে খেয়ে সবে উঠেছে তখনই নার্স ওকে ডাকতে এসেছে….
‘ ম্যাডাম, আপনাকে মিটিংরুমে ডেকেছে ‘
‘ হ্যাঁ, আসছি আমি। সবাই এসে গেছে?’
‘ বেশিরভাগই আসেনি, এতো তাড়াহুড়ো করতে হবেনা। আপনি আস্তে আস্তে আসুন ‘
টেবিলের জিনিসগুলো গুছিয়ে রেখে রোজা যাওয়ার জন্যে যেই পা বাড়ালো অমনি মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো ওর, নিমিষেই চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। শরীরটা যে হেলে মাটিতে পড়েছে সেটা টের পেয়েছে রোজা, চোখ সম্পূর্ন বন্ধ করার আগে নার্সকে ছুটে আসতে দেখেছে। এরপর আর কিছু মনে নেই ওর!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]