#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০২
আদনানদের বাড়িটার নাম “পুরুষ নিবাস” দিলেও মন্দ হবেনা কারণ, এ বাড়িতে কোনো মহিলা নেই। মহিলা বলতে এক কুক ও কাজের মহিলা আছে। তারা কাজ শেষে চলে যায়। এনায়েত সাহেবের তিন ছেলে, তার স্ত্রীর সঙ্গে বহু আগেই বিচ্ছেদ হয়েছে তবে ছেলেরা তার সঙ্গে থাকে। এনায়েত সাহেব নিজে ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকতেন তাই ছেলেরা বলা যায় যে যার মতো বড় হয়েছে। ছেলেদের একসঙ্গে নিয়ে খাওয়ার সুযোগ এনায়েত সাহেবের খুব একটা হয়ে ওঠেনা। একদিন একজন, নয় একদিন দুজন কিন্তু তিনজনকে একসঙ্গে পাওয়া দুষ্কর! আজ দুই ছেলের সঙ্গে লাঞ্চ করতে বসেছেন এনায়েত সাহেব, কুক রান্না শেষে খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। আদনান তো মজা করে খাওয়া শুরু করেছে, ফারহান ও এনায়েত সাহেব ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে ওর দিকে, আদনানের আচরণ এমন যেনো কিছুই হয়নি! এরই মাঝে আদনানের ফোন বেজে উঠলো, ওর সেক্রেটারি সাদিকের কল! আদনান ইদানিং বেশিরভাগ সময় ওর ঐ বাড়িতে থাকে, সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে সাদিকও বেশি সময় আদনানের সঙ্গেই থাকে কিন্তু আজ আদনান ওকে রেখে এসেছে। কল রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে সাদিক বলে উঠলো…
‘ বস, ওই মেয়েটা এসেছে ‘
‘ কোন মেয়ে?’
‘ যে আপনার ট্রিটমেন্ট করছিলো! সে আপনাকে খুঁজছে, কি বলবো?’
‘ আমি তো সব হিসেব সেটেল করেই দিয়েছি, আবার আমাকে খুঁজবে কেনো! আহহ! এক কাজ কর। আমার স্টাডি রুমের ড্রয়ারে ক্যাশ আছে, ওখান থেকে কিছু ক্যাশ দিয়ে দে ‘
‘ ন..না বস, আপনি ভুল বুঝছেন! মেয়েটা…’
‘ কাম অন সাদিক! অনেকদিন পর বাড়িতে এসে সবার সঙ্গে বসে খাবার খাচ্ছি, ডিস্টার্ব করিস না ‘
ফোন কে’টে দিয়ে আবারো খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো আদনান, এনায়েত সাহেব কৌতুহল বশত প্রশ্ন করলেন…
‘ আদনান, কোন মেয়ের কথা হচ্ছিলো?’
‘কেউ না বাবা ‘
‘ সত্যি করে বলতো আদনান, তুই কোনো মেয়ের পাল্লায় পড়েছিস? এতদিন কি তার সঙ্গেই ছিলি?’
‘ ওহ কাম অন বাবা! ওইসব মেয়ে টেয়ে নিয়ে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই আর তোমরা দুজনে এভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছো কেনো! আমার মুখ দেখলে তোমাদের পেট ভরবে না, খাবার খাও’
রেগে গেলেন এনায়েত সাহেব…
‘ সবক্ষেত্রে এরকম ঝেড়ে কথা বললে লাভ হবেনা আদনান, তুই কোথায় কি করছিস সেটা জানার অধিকার আমার আছে ‘
‘ অবশ্যই আছে বাবা, কিন্তু খাওয়ার সময় এসব কথা উঠছে কেনো! কুক এতো ভালো রান্না করেছে, ইনজয় করে খাওয়া উচিত। কি বলিস ফারহান?’
উত্তর দিলো না ফারহান, আদনানের কথাবার্তা মোটেও সুবিধা লাগছে না ওর! হুট করে এতদিন গায়েব থাকার পর ফিরে আদনানের এতো স্বাভাবিক আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে ফারহানের! লাঞ্চ শেষে আদনানকে ফারহান জিজ্ঞাসা করলো..
‘ কোথায় ছিলি এতদিন?’
‘ তা জেনে কি করবি?’
‘ সামনে আমাদের এতো জরুরি একটা মিটিং আছে জানিস তো। এরপরও গায়েব হয়ে যাওয়ার কারণটা ঠিক বুঝলাম না ‘
ফারহানের কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আদনান..
‘ ফারহান, তোর অ্যাকটিং করা উচিত জানিস? হেবি ট্যালেন্ট তোর, শুধু শুধু নিজের ট্যালেন্ট নষ্ট করছিস তুই!’
‘ কি বলতে চাইছিস!’
হাসি থামিয়ে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো আদনান…
‘ আমি কেনো গায়েব ছিলাম সেটা তুই ভালোভাবেই জানিস, তাহলে এতো নাটকের কি আছে?’
‘ হোয়াট ননসেন্স! আমি জানবো কিভাবে?’
তখনই ফারহানের ফোন বেজে উঠলো, জরুরি একটা কল আসায় আদনানের সঙ্গে কথা সম্পূর্ন করতে পারলো না ও। ফারহান চলে যাওয়ার পর হাত পা এলিয়ে সোফার উপর বসলো আদনান, ক্ষতস্থানটা সেরেছে বটে তবে এখনও মাঝে মাঝে টান ধরে! চোখ বুঝে হেলান দিয়ে আদনান আপনমনে বললো…
‘ আদনান নিজের হাত থেকে কিছুই ফস্কাবে না ‘
ওদিকে আদনানের বাড়ি থেকে ফেরার পরই রাগে ফুঁসছে রোজা, আজ লাঞ্চটাও করেনি। মেয়েটার মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে দেখে সুজানা বললো…
‘ আচ্ছা, তুই অন্যের রাগ নিজের ওপর ঝারছিস কেনো? খাবারটা অন্তত খেয়ে নে ‘
‘খাবার আমার দিয়ে এখন নামবে না! ওই লোকটা নিজেকে কি ভাবে হ্যাঁ, আজকে যদি আমার সামনে উপস্থিত থাকতো তাহলে উচিত শিক্ষা দিয়ে আসতাম ‘
‘ লোকটা বাড়িতে ছিলো না?’
‘ না! উল্টে তার সেক্রেটারিকে দিয়ে আমাকে ক্যাশ দিয়ে বিদায় করতে চাইছিলো। মানে, একটা মেয়েকে তিনটা দিন এভাবে আটকে রাখলো তারপরও তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা বোধ নেই!’
রোজার এতো রাগ দেখে ভয় হচ্ছে সুজানার, মেয়েটা না এবার স্ট্রো’ক করে বসে…
‘ আচ্ছা, তুই শান্ত হ এবার! অনেক রাগ করেছিস ‘
‘ শান্ত হতে পারছি না আমি! পুরুষ মানুষ এতো জঘন্য হতে পারে ওই লোকটাকে না দেখলে বুঝতাম না, একে তো আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে তার ওপর টাকা দিয়ে দায় সারতে চায়! ওই লোকটার জন্যে আমি বাড়ি ছাড়া হয়েছি, জীবনেও ক্ষমা করব না তাকে’
‘ ঠিক আছে বাবা, এবার একটু খেয়ে নে। আমাদের তো আবার ডিউটি আছে, না খেয়ে ডিউটি করতে গিয়ে অসুস্থ হলে দায় কে নেবে বলতো?’
সুজানা চামচসহ খাবার প্লেটটা রোজার দিকে এগিয়ে দিলো, নিজেকে কিছুটা শান্ত করে খাওয়ায় মন দিলো রোজা কিন্তু মনে মনে আদনানকে গা’লি দিতে ভুল করেনি! রাতে…দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনায় বসেছেন এনায়েত সাহেব। সফট ড্রিংকস/ কোমল পানীয় পণ্যের কোম্পানির মালিক তিনি, তার এ কাজে সাহায্য করেন তার ছেলেরা। তবে কাজের ক্ষেত্রে বড় ছেলের ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করেন এনায়েত সাহেব, কারণ মেজো ছেলে ফারহান কাজ কমাতে গিয়ে উল্টে বাড়িয়ে দেয় আর ছোটো ছেলে ঈশানের এসব ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই!
‘ গত মাসে আমাদের প্রোডাক্ট সেল খুবই কম হয়েছে, অ্যানালাইজ করে সেল কম হওয়ার কারণ বের করতে হবে আর নতুন দু – একটা প্রোডাক্ট শীঘ্রই আনা উচিত আমাদের ‘
‘ নতুন প্রোডাক্ট আনলেই তো লাভ হবেনা বাবা, পুরোনো প্রোডাক্টে কি সমস্যা হচ্ছে। কেনো সেল কম হচ্ছে সেটা আগে দেখতে হবে, এতে সমস্যা থাকলে এটা সাপ্লাই বন্ধ করে নতুন প্রোডাক্ট আনা যাবে ‘
সঙ্গে সঙ্গে ফারহান বলে বসলো…
‘ বাবা, আমি মেকারদের সঙ্গে মিটিং সামলে নেবো ‘
‘ ফারহান, তোকে আমি ইনভেস্টরদের সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলাম। সেটা আগে কর, নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে মিটিং আদনান করে নেবে। আদনান তোর কোনো সমস্যা আছে?’
‘ নো, আমি ম্যানেজ করে নেবো!’
বরাবরের মতো এবারও বড় ভাইয়ের কাছে বড় দায়িত্ব চলে যাওয়ায় হতাশ ও বিরক্ত হলো ফারহান! একটু আগে হসপিটাল থেকে ফিরেছে রোজা, সুজানা আসেনি কারণ আজ ওর নাইট ডিউটি আছে। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে রোজা ভেবেছিলো মাকে একবার ফোন করবে কিন্তু রাত হয়ে গেছে দেখে আর ফোন করলো না! ডিনার বানানোর শক্তি নেই, তাই ফ্রিজে ব্রেড জ্যাম দিয়েই ডিনার সেরে শুয়ে পড়লো রোজা। কিন্তু শান্তিতে আর শুতে পারলো কই, মেজাজ যে এখনও চড়া হয়ে আছে। বালিশে মাথা চেপে অনেকক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমাতে না পেরে উঠে বসলো নিজের গাইনোকলোজি সম্পর্কিত বইটা নিয়ে! পড়তে পড়তেও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিভাবে বাড়ি ফেরা যাবে? বাবার কাছে কিভাবে নিজের নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ দেবে?
________________________________
পরেরদিন সকালে…বাবার বাসা থেকে নিজের বাসায় ফেরে আদনান। সাদিক আজ আসতে একটু দেরি করেছে, ওকে দেখামাত্রই আদনান বললো…
‘ একটা দিন শান্তিতে থাকতে পারবো না নাকি আমি? তোকে না বলেছি ছোটোখাটো বিষয় নিজে হ্যান্ডেল করবি, আমাকে কল করবি না?’
‘ ছোটো বিষয় ছিলো না এটা ‘
‘ এটা আবার বড় বিষয় হলো কিভাবে? যাই হোক, মেয়েটাকে কতো ক্যাশ দিয়েছিস? পঞ্চাশ?’
‘ এক টাকাও না, উল্টে আপনার দেওয়া সব ফেরত দিয়ে গেছে ‘
‘ হোয়াট!’
সাদিক নিজের পকেট থেকে টুকরো কিছু কাগজ বের করে আদনানের ডেস্কের ওপর রাখলো…
‘ এগুলো কি!’
‘ আপনার ব্ল্যাঙ্ক চেক কুটিকুটি করে দিয়ে গেছে। আর আপনার কথা শুনে টাকা দিতে গেছিলাম আমি, উল্টে আমার মুখে ছুঁড়ে দিয়েছে। আমি তো ভেবেছিলাম থা’প্প’ড় খাবো!’
‘ তাই নাকি? এতো রাগ দেখিয়েছে? কই তিনদিন এখানে ছিলো তখন তো একটা টু শব্দ করতে দেখলাম না ‘
‘ সে তো ভয়ে চুপ ছিলো, কিন্তু এখন মেয়েটা অনেক রেগে আছে বস!’
খানিকটা অবাক হলো আদনান…
‘ আর ইউ সিরিয়াস! ব্ল্যাঙ্ক চেক ফেরত দিয়ে গেছে?’
‘ প্রমাণ নিজের চোখেই তো দেখছেন বস, আর হ্যাঁ যাওয়ার সময় বলে গেছে ভবিষ্যতে আপনাকে যেনো দ্বিতীয়বার না দেখে ‘
টাকা ফেরত দেওয়া এবং সাদিকের কাছে রোজার আচরণের বর্ণনা শুনে আদনানের মনে কৌতুহল জাগলো! চেকের টুকরো টুকরো আঙ্গুল দিয়ে নাড়তে নাড়তে বাঁকা হাসলো আদনান…
‘ ইন্টারেস্টিং তো!’
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]