#তোমায়_দিলাম_কফির_নিমন্ত্রণ
By #Arifa_Afroze
#পর্ব_৫
.
.
.
সকালের রাউন্ড শেষে ডক্টরস রুমে ঢুকে দেখি পরিবেশ থমথমে।সামনে যে জুনিয়র কাজ করছিল ওকে ডেকে বললাম,
–কিরে দ্বীপ, কিছু হইছে নাকি?রুম টা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত লাগছে কেন?
কোথা থেকে প্রীতি এসে আমার মুখ চেপে ধরে বলল,
–আস্তে বল,নইলে তোর কথা শেষ হবার আগেই অগ্নুৎপাতে ধ্বংস হয়ে যাবি।
ধ্বংস হইনি কিন্তু বিধ্বংসী ডিউটি একটা ছিল সেদিন।চারটা পর্যন্ত আমরা কেউ লাঞ্চ করার সময় পাইনি।তাই সবাই মিলে ঠিক করলাম আজ আর হাসপাতালে না,বাইরে কোথাও খেতে যাবো।
জুনিয়র এক ইন্টার্ন খেতে খেতে প্রশ্ন করল,
–প্রীতি আপি, আজকে আসাদ ভাই এর কি হয়েছিল যে আমাদের দিয়ে এই গাধার খাটুনি টা খাটালো?আমার এত খিদে পেয়েছে,কিছু বলতেও পারছিলাম না ভয়ে।
বেচারির কাঁচুমাচু মুখ দেখে আমরা সবাই হেসে উঠলাম।পাশ থেকে অমিত ভাই বলে উঠল,
–এই অগ্নুৎপাত এর কারণ ভাবীর সাথে ঝগড়া।যেদিন ই ভাইয়ের ঝগড়া হয় সেটা এসে উনি আমাদের উপর ছাড়েন।তুমি নতুন তো বুঝতে পারোনি।আমরা ওনার চেহারা দেখলেই বুঝি আজ আকাশে মেঘ কেমন আর আমাদের ডিউটি কেমন যাবে।
–শুধু উনি কেন,আমাদের শফিক স্যার,তিনিও তো যেইদিন ঝগড়া করে আসেন সেদিন ওটি তে তান্ডব হয়।
প্রীতির কথা শুনে আমরা সবাই আরেক পরস্ত হাসলাম।
–ভাগ্গিস ,রেশাদ ভাই এর বউ নাই,নাইলে তো আমাদের কপালে খারাবি ছিল।
চিকেন ফ্রাই টা মুখে পুরতে পুরতে অমিত ভাই বলে উঠল আবার।
–বউ নেই তো কি হইছে গার্লফ্রেন্ড আছে নিশ্চই?
প্রশ্নটা করেছে এক ইন্টার্ন।কিন্তু টেবিল এ বসা সব কটা মেয়ের মনোযোগ এক নিমেষে উত্তরের অপেক্ষায় অমিত ভাই এর দিকে ঘুরে গেল সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম কেননা আমিও তাদের মধ্যে একজন।
–ভাই এর গার্লফ্রেন্ড এর অভাব আছে নাকি!!!একটা ছাড়ে আরেকটা ধরে।আপাতত কেও আছে কিনা শিউর না,পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত তো,তাই ঠিক বুঝতেছিনা।
আসলেই তো,ওনার মত এলিজিবল ব্যাচেলর মানুষ সিংগেল আছে সেটা ভাবাই তো বোকামি।চুপসে যাওয়া বেলুনের মত আমিও চুপসে গেলাম যে বেলুনের প্রেম হাওয়া আমার ই দেয়া।
●●●
২ এপ্রিল…
কোনো অকেশন নাই তবুও কাঁচা হাতে টুকটাক সাজ করলাম,রাতের বেলা ইস্ত্রি করে রাখা প্রিয় জামাটাও গায়ে জড়ালাম।আমার মায়ের সন্ধিগ্ন দৃষ্টি কে ভেংচি কেটে বেরিয়ে পড়লাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।ছোটবেলা থেকে সার্জন হব সেই স্বপ্নে বাকি সব কিছু বিসর্জন দিয়েছিলাম।আঁতেল আরুশি পড়াশোনা,লেখালেখি আর ড্রামা দেখা ছাড়া জীবনের বাকি অংশের সাথে খানিকটা অপরিচিতই বটে।সেই ছোট্ট দুনিয়ায় একটা মাতাল হাসি নিয়ে কারো ছায়া পড়বে ভাবিনি।
মায়ের মত প্রীতির চোখেও সন্ধিগ্ন দৃষ্টি।ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখছে।চোখমুখ আঁকাবাঁকা করে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করছে,কিন্তু আমি সব দেখেও না দেখার ভান করলাম।আমার সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আজকে রেশাদ ভাই,দু দিন পর ফিরছেন তিনি।আদেশমত তার সকল রোগী এই কয়েকদিন আমি ই দেখেছি,যদিও কোনো রোগী খারাপ নেই তবুও তাঁকে রিপোর্ট করার জন্য আমি নিজেই বেশি আগ্রহী আজ।
সকাল থেকে একের পর এক রোগী আসছে,কিন্তু যার জন্য এই অপেক্ষা তার দেখা নেই।দুপুর হয়ে এলো,ক্যান্টিন এ তাই পেটপুজো করতে গেলাম।খাবার মুখে দেবার আগেই মোবাইল টা বেজে উঠল।স্ক্রিন এ বহু আকাঙ্খিত একজনের নাম দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম আমি।ফোন ধরতেই,
–আরুশি,ওটি তে আসো।
–জী রেশাদ ভাই আসছি।
এরপর খাবার রেখে এক দৌড়ে ওটিতে পৌঁছেছিলাম।
তার পরের অংশ ??
প্রিন্স চার্মিং সিন্ডারেলা কে দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল।এখানেই থামুন।এই ঘটনা রূপকথাতেই সম্ভব।বাস্তবের আরুশি সেই পুরনো ওটি ড্রেসেই সাজ সজ্জাহীন,অতি সাধারণ বেশে মাস্ক মুখে আবার মুখোমুখি হল সার্জন রেশাদ ভাই এর।পর পর বেশ কয়েকটা খারাপ কেস থাকায় ওটি শেষ হতে বাজল রাত সাড়ে এগারোটা।মোটামুটি সবাই তখন চলে গেছে।আমার তখন হাত পা ভেঙে ঘুম আসছে।আড়মোড়া ভাঙছিলাম ডক্টরস রুমে আর সেই সময় প্রথমবারের মত সেইদিন ভালো করে দেখতে পেলাম আমার আগন্তুক কে।
–কি অবস্থা মিস আরুশি?
বলতে বলতেই মাথার ক্যাপ টা খুলে ঠাস করে বসে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন রেশাদ ভাই,দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচন্ড ক্লান্ত।
–ভাইয়া পাঁচ নম্বর বেডের রোগীকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি,ছয় নম্বর রোগীটাকে কার্ডিওলজিস্ট দেখে গেছেন,বলেছেন অপারেশন করা যাবে সমস্যা নাই,আর এই সি ইউ এই..
–আর আপনার????
এবার সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল সে।আমার কথা আটকে গেল,হা করে তাকিয়ে রইলাম।চশমার আড়ালের ঐ চোখে কিছু একটা ছিল,ঠোঁটের কোণে সেই হাসিতে কিছু একটা ছিল,আমি বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম।আমার সামনে এসে তুড়ি বাজিয়ে বাস্তবে ফিরিয়ে এনে আবার প্রশ্ন করলেন,
–কি হল?
–না,কিছুনা ভাইয়া।
ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়ার্ড বয় এল,
–স্যার রোগীর লোক আপনার সাথে একটু কথা বলবে।
–‘চলো।’ বলেই রেশাদ ভাই বের হয়ে গেলেন।আমার উত্তর আর দেয়া হল না।মনে মনে যেন হাফ ছাড়লাম।যদি উনি আমার এই অস্থিরতা বুঝে ফেলতেন তাহলে?
ড্রেস চেঞ্জ শেষে পোস্ট অপারেটিভ রোগিগুলোকে একবার দেখে ফেললাম।কাজ শেষে রুমের বাইরে আসতেই দেখি দেয়ালে হেলান দিয়ে রেশাদ ভাই দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছেন।আমায় দেখে চোখ না তুলেই প্রশ্ন করলেন,
–বাসায় যাবে এখন?
–না ভাইয়া,অনেক রাত হয়ে গেছে।আজ প্রীতির সাথে হোস্টেল এ থাকবো।
–হুম।খিদে পেয়েছে?
পেটের মধ্যে বেশ মোচড় দিচ্ছিল,দুপুরেও না খেয়ে দৌড় দিয়েছিলাম ওটি তে,বিকেলে এক ফাঁকে শুধু একটা স্যান্ডউইচ আর এখন এত রাত যে ওটি তেও খাবার শেষ।
এবার মোবাইল রেখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করে রেশাদ ভাই বললেন,
–চলো।
আমিও আর কিছু না বলে মন্ত্রমুগ্ধের মত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পিছনে ছুটলাম।
●●●
–পহেলা বৈশাখে তুই আবার ডিউটি রাখছিস আরুশি?
হাতে রোস্টারের কাগজ টা নিয়ে জেরায় ব্যাস্ত প্রীতি বলে উঠল।
–হুম,কেন?
–কেন মানে?তুই শাড়ি পড়বিনা?আমরা একসাথে ঘুরতে যাবোনা?
–হুম,তারপর ঘুরতে গিয়ে আমাকে একা রেখে ‘সরি দোস্ত,আমার সে আসছে’ বলে তো উধাও হয়ে যাবি।এর থেকে আমি ডিউটি করি সেটাই ভালো।
কথাটা শুনে মন খারাপ করে মাথা নিচু করে প্রীতি আবার বলে উঠল,
–আর কিছুদিন পরেই তো আমাদের বি সি এস পোস্টিং হয়ে যাবে,আবার কবে এভাবে হ্যাংআউট করতে পারবো জানিনা,আর তুই কিনা সেদিনের ঘটনায়..
–আহ হা,ধুর বোকা মেয়ে! আমি তো মজা করছিলাম।তুই তো জানিস আমি কোলাহল পছন্দ করিনা।
–প্লিজ আরু,প্লিজ আমার সাথে এবার বাইরে চল, আচ্ছা ঠিক আছে বাইরে না ক্যাম্পাসেই ঘুরব আমরা,এখানেই তো প্রোগ্রাম হবে।
●●●
১৪ এপ্রিল…
অপটু হাতে পড়া মায়ের একখানা শাড়ি,অনেকদিনের অবহেলায় ফেলে রাখা শখের গয়না,ইউ টিউব এর কল্যানে শেখা মুখশ্রী বর্ধন আর আমি আরুশি।এই সব কিছুর কম্বিনেশনেই এবার আমার পহেলা বৈশাখ।প্রীতির জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হল,ভাবছিলাম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
-খারাপ লাগছেনা আরুশি।মাঝে মাঝে একটু সাজলেও তো পারিস।কে জানে আগন্তুকের হাসি যদি ফুটে ওঠে তোকে দেখে।
মাথায় নিজের হাত দিয়েই একটা থাপ্পড় মেরে বললাম,
–আরুশি অনেক হয়েছে রূপকথা,এবার চল বাস্তবতায় যাই।
বাস্তবতার কোলাহলে পরিপূর্ন চারদিক,সাদা লালে রাঙিয়ে যাওয়া ক্যাম্পাস,চারপাশের উচ্ছল আনন্দ যেন আর একটু বেশি রং মাখিয়ে দিচ্ছে পরিবেশ টায়।পান্তা আর শুটকির কম্বিনেশন এর ঘ্রাণ এই চেয়ে সবার মনের আনন্দের সুবাসেই ম ম করছে চারদিক।কিছু আনন্দ বেশ ছোঁয়াচে হয়,এই যেমন আমাকেও ছুঁয়ে গেল।সব আনন্দের মাঝে অপটু হাতে সাজানো আজকের চশমা ছাড়া চোখটা এদিক ওদিক ঠিক ই কাওকে খুঁজে ফিরছে ক্ষণে ক্ষণে।আমার এদিক ওদিক তাকানো দেখে কুলফি টা হাতে রেখেই প্রীতির প্রশ্ন,
–কিরে কাকে খুঁজছিস?
–আরে কাকে খুঁজবো!!চোখে চশমা নেই তো তাই বারবার এদিক ওদিক চোখ যাচ্ছে,আসলে তো কিছু দেখছিনা।
আমিও কথা ঘুরিয়ে কুলফি খাওয়ায় মন দিলাম।কিন্তু আমার মায়োপিক দৃষ্টি ঠিক ই কারো খোঁজ নিচ্ছে প্রতিনিয়ত শুধু একটা আশায় হয়ত একবার দেখা হবে।
সব আশা ভরসায় অন্ধকার চাদর দিয়ে ঢেকে দিল অস্তমিত সূর্য।এবার বেশ জোরাজুরি করলাম চলে যাওয়ার জন্য,কারণ সত্যি মন খারাপ হলো আমার,সারাদিনে একবারও রেশাদ ভাই এর দেখা নেই।আর বিকেলের সেই ‘অপ্রস্তুত’ ঘটনায় আমি এখনো স্বাভাবিক হতে পারছিনা।
–দোস্ত এই প্রোগ্রাম টা শেষ হলেই চলে যাবো প্লিজ প্লিজ।
–প্রীতি আমার মাথা ধরছে দোস্ত।
–আমি জানি তিয়াস এর আজকের ঘটনায় তুই আপসেট।
–প্লিজ ওর কথা আর বলিস না।আমি চলে যাচ্ছি।
‘ওকে,তো এখন আমাদের সামনে একটা ডুয়েট পরিবেশন করতে আসছেন এই হাসপাতালের কৃতি ছাত্র,স্বনামধন্য সার্জন ডাঃ রেশাদ হাসান চৌধুরী।’
উপস্থাপকের কথায় সব ভুলে গিয়ে মুহূর্তে মন বদলে প্রীতি কে সাথে নিয়ে বসে পড়লাম কোনার একটা সীটে।অবশেষে,অবশেষে সারাদিনের সব অনাকাঙ্খিত ঘটনা ছাপিয়ে সেই কাঙ্খিত হাসিমুখ আগন্তুক আমার সামনে।
সেই হাতাগুটানো সাদা শার্ট,হাতে গীটার আর সবচেয়ে বড় কথা মুখে সেই মাতাল করা হাসি।মনে মনে বললাম,
‘আমিও হাসছি তোমার হাসিতে’।
–আল্লাহ,ভাইয়ার সাথের মেয়েটা কি সুন্দর তাইনা,আরু? পুরাই শরৎচন্দ্রের নায়িকা লাগছে।
–হুম হা হুম…
–মেয়েটা কে,আগে কখনো দেখিনি।আহ কি সুন্দর মিষ্টি কন্ঠ ।কে মেয়েটা তুই জানিস?
–হুম হা হুম…
–আরে কি হুম হা করতেছিস??
কিসের মেয়ে আর কিসের কন্ঠ,আমার সকল মনযোগ তখন ঐ একজনের উপর আমার হাসিমুখ আগন্তুক আর তার কন্ঠে গান,
‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন।
ঐ চোখে সাগড়ের নীল,
আমি তাই কি,গান গাই কি,
বুঝি মনে মনে হয় গেল মিল।’
●●●
২০ এপ্রিল…
–আরুশি এ আমাদের নতুন ট্রেইনি ড.রায়া।
গত দুইদিন জরুরি কাজে ঢাকার বাইরে ছিলাম,নতুন ট্রেইনি জয়েন করেছে তাই দেখা হয়নি আমার সাথে, আজ আসতেই অমিত ভাইয়া আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
–মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে কেনরে প্রীতি?
–লাগবেই তো পহেলা বৈশাখে দেখলি যে রেশাদ ভাই এর সাথে গান গাইল।ওনার গার্লফ্রেন্ড।
(( চলবে… ))
●●●
(পরিশিষ্ট::
–রেশাদ ভাই আজ গান গাইলা নাকি হাসপাতাল এ?গীটার বের করা?
রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল রেশাদ এর ছোট ভাই রেহান।
–হুম,বৃত্তের অনুষ্ঠানে আমাকে তো যেতেই হয় জানিস ই,এক্স সভাপতি বলে কথা।
–হুম,কি করো ক্যামেরা হাতে? দেখি আজকের ছবিগুলো।
রেহানের হাতে ক্যামেরা দিয়ে গীটার নিয়ে বসল রেশাদ।
–ওয়াও,রেশাদ ভাই তুমি কি পারোনা বলোতো?পড়াশুনা,সার্জারী, গান লেখা,গাওয়া গীটার বাজানো ,ছবি তোলা।আনবিলিভেবল!!! কি সুন্দর ছবি!!আরেহ!!! এইটা কে??ভাই কে এই মেয়ে??এত সুন্দর এঙ্গেল এ তোলা ছবিগুলা,অসাম!!উফ এই ছবিতে ঘাসের মাঝে বই হাতে মেয়েটাকে সত্যি শরৎচন্দ্রের নায়িকা লাগছে।বাট এইটা কে?তোমার নিউ গার্লফ্রেন্ড নাকি?
উত্তরে,
.
.
.
.
গীটারের টুং টাং।)