তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
২১।
অনেকটা সময় আমিরা বসে আছে চুপচাপ। মাথা নিচু করে রেখেছে। দুই হাত টেবিলের উপর ভাঁজ করে রাখা। আমিরার মনে হচ্ছে, যে কোনো মুহূর্তে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। হাত-পা কাঁপছে প্রচন্ড। বুক ধড়ফড় করছে। এর কারণ, রিফায়াত। একদম পাশেই বসে আছে। একঘন্টার কথা বললেও কীভাবে যেন চল্লিশ মিনিটেই সে এসে পড়েছে। সাদা একটা গাড়ি, কনভারটিবল ঘরানার। খুব ঝকঝকে। দেখলেই মনে হয় নতুন কিনে আনা হয়েছে শো-রুম থেকে। বেশ দামিও। রিফায়াত এই গাড়িটা নিজে ড্রাইভ করে এসেছে। আমিরা দরজার পাশেই কাচের দেয়াল ঘেঁষে একটা টেবিলে বসা ছিল। খানিক আগে একটা বিফ বার্গার খেয়েছে সে। সকালে নাশতা করে এলেও খেতে হয়েছে। কারণ কিছু না কিনলে এই বারগার শপে বসা যাবে না। আবার বারগারটা কিনে ফেলে রাখাও সম্ভব না। রিফায়াত এসে দেখবে, একটাই বার্গার অর্ডার করা হয়েছে। ব্যাপারটা কেমন দেখায় না? দুটো অর্ডার করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আমিরার কাছে টাকা নেই। এই দোকানে একটা বার্গারের দামই সাড়ে তিনশ টাকা। রিফায়াতের সাথে কথা বলতে মোট খরচ হয়েছে সাত মিনিট চব্বিশ সেকেন্ড। দোকানদার আট মিনিট ধরে বিল করেছে ষোল টাকা। তার কাছে আবার ভাঙ্গতি নেই। এজন্য বিশ টাকাই দিতে হলো। দোকানদার অবশ্য বলেছে, বাকি দুই মিনিট পরে এসেও কল করা যাবে। আমিরা তো এদিকে প্রতিদিন আসে। কলেজের ইউনিফর্ম পরা মানেই এখানকার ছাত্রী।
আমিরা কথা বাড়ায়নি। তার নিজেরও মনে হয়েছে। দুই মিনিটের কলটা বাকি থাকলে ভালো। যদি কখনো ইমারজেন্সি কল করার দরকার হয়, আর সেদিন পকেটে টাকা না থাকলে এই বাকি থাকাটা কাজে দেবে খুব। অবশ্য তার কাউকে কল করার মতো নেই। রিফায়াতের সাথে আজকের পর যোগাযোগ থাকবে কি না সন্দেহ।
বারগারটা ব্যাগে রাখবে নাকি খেয়ে ফেলবে, ভাবছিল আমিরা। বারগারটা বেশ জুসি ধরনের। আর বড়সড়। দুটো পেটির সাথে চিজ, সালাদ, সস নিয়ে রেডি করে দিয়েছে। ‘ইট ইন’ বলেছিল তাই। নয়তো প্যাকেট করে দিত। আসলে ভুল হয়ে গেল। টেক অ্যাওয়ে বললেই হতো। প্যাকেট করে দিত বারগারটা। সরাসরি ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলা যেত। এখন কি প্যাকেট করে দিতে বললে শুনবে? আমিরার অস্বস্তি হচ্ছিল একা বসে থাকতে। দোকানে আর কেউ নেই। দোকানদার ছেলেটা ছোকরা ধরনের। কাজের ফাঁকে একাই গান গাচ্ছে, কানে ব্লু টুথ লাগিয়ে হাহা-হিহি করছে কারও সাথে। মাঝেমধ্যে আমিরার দিকেও তাকাচ্ছিল। তাই যেচে পড়ে আর কথা বাড়ায়নি। ঝটপট খেয়ে ফেলেছে বারগার। এখন ভরপেট অবস্থায় বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। পেট ফুলে ঢোল প্রায়। চোখে প্রবল ঘুমও লেগে আছে। রিফায়াতের জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রায় ঘুমিয়েই পড়ছিল। কাচের দেয়ালের বাইরে তাকিয়ে থাকলেও আসলে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না সে। হঠাৎ সাদা গাড়িটা বারগার শপের সামনে থামল। তখনও অত খেয়াল হয়নি। গাড়ি থেকে রিফায়াত বের হতেই টনক নড়ল।
– আমিরা!
মাথা নিচু করে ঝিমিয়ে যাচ্ছিল আমিরা। ডাক শুনে ঝট করে মুখ তুলল। তবে সরাসরি রিফায়াতের দিকে তাকাল না। চোখ তুলে দেখতে খুব লজ্জ্বা লাগছে ওর। রিফায়াতও আর বসার জায়গা পেল না। একদম পাশের চেয়ারে এসেই বসতে হলো। এই টেবিল-চেয়ারের সেটআপ খুব সুবিধের না। একদম অল্প জায়গার মধ্যে সাজিয়েছে। একটা টেবিলের একেক পাশে দুটো করে চেয়ার। পাশাপাশি দুই চেয়ারের মধ্যে ফাঁক খুবই কম। নেই বললেই চলে। রিফায়াতের তাতে সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয় না। তবে আমিরার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। রিফায়াত অবশ্য প্রথমেই এই চেয়ারে বসেনি। ওপাশে একটা চেয়ারে বসেছিল। তারপর কুশল বিনিময় করতে গিয়ে আচানক আঁতকে উঠল। বলল,
– কী হয়েছে তোমার? চেহারার এই হাল কেন? তুমি কি কান্নাকাটি করেছ? কী ঘটছে গতকাল তোমাদের বাসায়, বলো তো! আমি যতক্ষণ ছিলাম, এভরিথিং ওয়াজ ওকে। তারপর কী এমন হলো…
বলতে না বলতেই সে ঝট করে পাশের চেয়ারে চলে এসেছে। খুব কাছে। আমিরা চমকে উঠে একপাশে সরে গেছিল। তখনই মাথা নিচু করে ফেলেছে।
– আমিরা, প্লিজ কথা বলো।
– হ্যাঁ মানে আমি আসলে ঘুম থেকে উঠেছি দেরি করে। বেশি ঘুমুলে আমার চোখ ফুলে যায়।
– কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না তুমি বেশি ঘুমিয়েছ। চোখ ফুলে আছে ঠিকই। কিন্তু চোখের নিচে গর্ত হয়ে আছে।
– এটা আমার সবসময়ই হয়।
– কাল তো দেখলাম না।
– ইয়ে, কালকে তো আমি মেকআপ করেছিলাম। বড়াপা সাজিয়ে দিয়েছিল আমাকে। ওই ফাউন্ডেশন না কী যেন বলে, ওটা দিলেই চোখের নিচে গর্ত ঢেকে যায়।
– উহু, তুমি গতকাল সাজলেও ফাউন্ডেশন ইউজ করোনি। একদম ক্লিন স্মুথ ফেস ছিল! এই যে তোমার গালের এই পিম্পল, এটাও ছিল। ফাউন্ডেশন দিলে তো এটা দেখা যেত না।
কথা অতি অবশ্যই সত্য। আমিরা কথা বাড়াল না। রিফায়াত আবার বলল,
– আমাকে সবকিছু খুলে বলো। কী হয়েছে?
আমিরা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
– আমার বড় খালা এসেছিলেন বাসায়। আপনি চলে যাবার একটু পরই। খালা এসেই বললেন যে…
– কী বললেন?
আমিরা ঠোঁট টিপে ভাবল, রিফায়াতকে ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দেবে কি না। গতকাল সে ভুল ঠিকানায় গিয়েছিল পাত্রী দেখতে, এই কথাটা বোধহয় তাকে এখন অবধি কেউ বলেনি। এখন শুনলে কীরকম রিঅ্যাক্ট করবে, আল্লাহ মালুম! সে একটু ঘুরিয়ে বলল,
– বড় খালা আমার বিয়ে ঠিক করেছে তার পরিচিত একজনের সাথে। নাম শফিক। খালুর অফিসে জব করে। গতকাল তার আসার কথা ছিল, মানে আমাকে দেখতে আসত। কিন্তু কী একটা কারণে আটকা পড়ে গেছে। সে আর আসেনি। বড় খালা বাসায় এসে যখন শুনল আপনার কথা, খুব রেগে গেছে।
– ওয়েট। বিয়ে ঠিক করেছে মানে কী? তোমার বিয়ে তো আমার সাথে ঠিক করা হয়ে গেছে অলরেডি।
– কী জানি। হতে পারে।
– হতে পারে না। হয়েই গেছে। সেখানে উনি হুট করে আরেকজনের সাথে বিয়ে করেছে, মানে কী? উনাকে তুমি বলোনি আমাদের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে আছে।
– আ-আমি কিছু বলিনি। আসলে খালা আমাকেও জিজ্ঞেস করেনি। বাবা আর মায়ের সাথে কথা বলছিল।
– উনারা কী বললেন?
আমিরা ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
– বাবা তো আপনার কথা বলল। কিন্তু মা হুট করে ঘুরে গেছে। মানে খালার সাপোর্ট নিয়েছে। বড়াপাও। সবাই মিলে উলটো বাবাকেই কথা শুনিয়েছে। এখন বাবা চুপ করে আছে। মা আর বড়াপা মাইন্ড চেঞ্জ করেছে। তারা ওই শফিক নামের ছেলেটার সাথেই আমার বিয়ে দিতে চায়।
– তারা চাইলে কি হবে? বিয়ে তোমার। তুমি কাকে বিয়ে করবে, সেটা তারা কেন ঠিক করে দিবে?
– কারণ তারা মনে করে আমি অনেক ছোট। আমার এখনো ভালোমন্দ বুঝার বয়স হয়নি।
– তাহলে তো তোমাকে বিয়েই দেয়া উচিত না এখন। বিয়ে দিচ্ছে। অথচ ভালোমন্দ বুঝো না তুমি।
আমিরা চুপ করে রইল। রিফায়াত প্রথমে নরম সুরে কথা বললেও এখন তার কন্ঠ বদলে যাচ্ছে। সম্ভবত রেগে যাচ্ছে সে। বলল,
– তুমি কী চাও? বলো। তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও?
আমিরা উত্তর দিল না। চুপচাপ বসে রইল। রিফায়াতও প্রশ্ন করল না আর। খানিকবাদে গলা নামিয়ে বলল,
– তুমি আমাকে বিয়ে না করতে চাইলে আমি জোর করব না, আমিরা। যদিও আমার বাবা তোমাকে পছন্দ করেছিল। তার অনেক ইচ্ছে ছিল তোমাকে আমার বউ করে আনার। আর এই মুহূর্তে আমি বাবার ইচ্ছেটাকেই প্রায়োরিটি দিচ্ছি। তবু যার সাথে সংসার করব, সারাজীবন থাকব, সে নিজেই যদি না চায়…
– আমি…আমি আসলে বুঝতে পারছি না কী করব। সত্যি বলতে আমার এই মুহূর্তে বিয়ে করার ইচ্ছা নাই। আমি পড়াশুনা করতে চাই। কিন্তু বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে অনেক। জানেন তো, আমার বাবা পঙ্গু। আমাদের সংসারে মুল ইনকাম সোর্স ছিল বাবা। এখন খালা আমাদেরকে আর্থিক সাপোর্ট দেয়। আর বড়াপাও জব করে। সো, সবাই চাচ্ছে আমার বিয়ে তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। মা একটু নিশ্চিন্ত হয় তাহলে। বড়াপার ডিভোর্সের পর থেকেই মা উঠেপড়ে লেগেছে আমার বিয়ে দেবার জন্য। তার ধারণা, আমিও বড়াপার মতো পালিয়ে যাব।
– বুঝলাম।
– আসলে ফ্যামিলি চাচ্ছে। তাই ইচ্ছা না থাকলেও বিয়ে করতে হবে। কার সাথে বিয়ে হবে, এই ব্যাপারটা কখনোই আমার হাতে ছিল না। আমার বাবা-মা, বড়াপা, বা বড় খালা কেউ কোনোদিন জিজ্ঞেস করেইনি আমার পছন্দ হয়েছে কি না। তাদের পছন্দ হলেই বিয়ে ফাইনাল।
– এখন আমি জিজ্ঞেস করছি। তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও? তোমার খালার ঠিক করা পাত্রকে নাকি আমাকে?
আমিরা মুখ নামিয়ে ফেলল। তার খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুনতে অসম্ভব লাগলেও এটাই সত্যি তোমাকে এক ঝলক দেখেই আমি ভালোবেসে ফেলছি। ওই যে বলে, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। আমার ঠিক ওটাই হয়েছে। তার পর তুমি অনেকক্ষণ আমার সাথে কথা বললা। আমরা একজন-আরেকজনকে জানলাম। গল্প করলাম। আমার ভালোবাসা তখন বেড়েছে একটু একটু করে। এখন রাত পার করে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তোমাকে না পেলে আমি মরেই যাব। ইভেন, আমি বাসা থেকে পালিয়েও আসছি। আমার ফিরে যাইতে ইচ্ছা করতেছে না। একদম না!
মন বেহায়া হতে পারে, মুখ তো না। তাই মনের আকুতি চাইলেও মুখে বলা সম্ভব না। পাশে বসে থাকা এই মানুষটাকে আমিরা প্রচন্ড ভালোবাসে। পাগল করা সেই ভালোবাসা। কিন্তু তার বহিপ্রকাশ হচ্ছে না।
– আমিরা প্লিজ। কথা বলো। চুপ করে থাকলে তো প্রবলেম সলভ হবে না। তোমাকে স্পেসিফিক করে বলতে হবে কাকে বিয়ে করতে চাও।
আমিরা এবারও কিছু বলল না। মনে মনে বলল,
– আমি পারব না বলতে। মরে গেলেও পারব না।
রিফায়াত আর কথা বাড়াল না। তার চেহারায় প্রবল হতাশা কাজ করছে। অনেকটা তীরে এসে তরী ডোবার মতো। একটু বিরতি নিয়ে বলল,
– তুমি কিছু খাবা? বারগার অর্ডার করি?
আমিরা ডানে-বায়ে মাথা নাড়ল। বলল,
– আমি সকালে নাশতা খেয়ে এসেছি।
– কফি কিনি তাহলে? তুমি খাও কফি?
– আমি আগে কখনো কফি খাইনি।
– আজকে ট্রাই করবা? খেয়ে দেখ কেমন লাগে।
আমিরা কিছু বলল না। রিফায়াতও উত্তরের অপেক্ষা না করে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। দুই কাপ কফি অর্ডার করে আবার ফিরল টেবিলে। এবার সে আমিরার উল্টোদিকের চেয়ারে বসল। কারণ আমিরা পাশের চেয়ারে তার কলেজের ব্যাগ রেখেছে। রিফায়াতকে এতটা কাছে বসে থাকতে দেখে সে এত নার্ভাস বোধ করছিল যে, ঠিকমতো কথাই বলতে পারছিল না। সরাসরি মুখ তুলে তাকাতেও পারছিল না। খুব অস্বস্তি লাগছিল। সামনের চেয়ারটাও যে খুব দূরে, তা না। এই টেবিলটাই আসলে ছোট। রিফায়াত সামনের চেয়ারে বসলেও পায়ের সাথে পা লেগে যাচ্ছে প্রায়।
রিফায়াত হঠাৎ সামনে ঝুঁকে এলো। ঝট করে আমিরার দুই হাত চেপে ধরল সে। আমিরা চমকে উঠতেই চোখাচোখি হলো। দৃষ্টি বিনিময়ের আলাদা ভাষা আছে। সেই ভাষা মানুষের বোধগম্য হয় না। তবে দৃষ্টিরা নিজেদের মধ্যে কথামালা বিনিময় করে ফেলে নির্দ্বিধায়। রিফায়াতের দৃষ্টি কী বলতে চাচ্ছে, আমিরা চট করে বুঝে উঠতে না পারলেও তার দৃষ্টি সহজেই সংযোগ স্থাপন করল। আমিরা আটকে গেল দৃষ্টি বিনিময়ের ফাঁদে।
রিফায়াত বলল,
– ফুপু যখন আমাকে প্রথমবার তোমার কথা বলল, আমি খুব একটা আগ্রহ দেখাইনি। আমার মনে হয়েছিল কোথাকার কোন মেয়ে, তাকে কোনো একসময় আমার বাবা ছেলের বউ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। মানুষ তো কত কথাই বলে। কত ইচ্ছাই মনের মধ্যে পুষে। তাই বলে কি সবটা পূরণ হয়? নাকি পূরণ করাটা কম্পোলজারি? আর যেখানে আমার বাবা এই দুনিয়াতে জীবিত নাই। সেখানে তার ইচ্ছাগুলোও জীবিত থাকতে পারে না। মানুষটাই নাই আমার লাইফে। তার ইচ্ছা পূরণ করে কী এমন অসাধ্য সাধন হবে? তাছাড়া যখন এই ইচ্ছের কথা বলেছিল ফুপুকে অথবা আশপাশের মানুষদের, তখন আমি অনেক ছোট। যাকে বউ করে আনতে চেয়েছে, সেই তুমি আরও ছোট। হাঁটি হাঁটি পা করতে শুরু করেছ মাত্র। ওই সময়ের কথাবার্তা আর ইচ্ছা দিয়ে তো আমাদের লাইফ স্টাক হয়ে থাকতে পারে না। তাই না?
আমিরা সম্মোহিতের মতো শুনছে রিফায়াতের কথা। নিজের অজান্তেই হ্যা-সূচক মাথা নাড়ল। রিফায়াত বলল,
– আমি ফুপুকে এই কথাটা বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ফুপু মানতে নারাজ। তার মরহুম বড় ভাইয়ের ইচ্ছা পূরণ করাটাই তার সবথেকে বড় প্রায়োরিটি। আর ভাইয়ের ছেলে হিসেবে এই প্রায়োরিটিকে বাস্তবায়িত করার দায়ভার আমার। কেমন বেখাপ্পা শোনাল না?
– হু।
– তবু ফুপুর কথা ফেলতে পারিনি। তার একটাই কথা, তুই মেয়েটাকে একবার দেখ। তার ধারণা, একবার দেখলেই আমি রাজি হয়ে যাব বিয়েতে। মূলত ফুপুর জোরাজুরিতেই বড় স্যারের ভাইয়ের মেয়েকে আমি দেখতে গিয়েছিলাম গতকাল। তোমাকে দেখার আগপর্যন্ত আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম যে, যাব, দেখব, দুই-চারটা কথা বলব, এরপর চলে আসব। ফুপুকে বলব, মেয়ে আমার পছন্দ হয় নাই। ব্যস, ঘটনা এখানেই শেষ। কিন্তু না। তোমাকে দেখলাম জানালায় দাঁড়ানো। দেখামাত্রই মনে হলো, আমি যদি রাজি না হই, এই মেয়েটা সারাজীবন আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। আশায় বুক বেঁধে রাখবে, কোনো একদিন আমি মন বদলাব। তাকে বিয়ে করতে রাজি হব। তবেই সে ধন্য হবে। বিলিভ ইট অর নট, আমার ঠিক এটাই মনে হচ্ছিল।
– তারপর?
– তারপর তোমার বাবার সাথে কথা বললাম। আমার কী মনে হইছে জানো? আমার বাবাই বুঝি আবার ফিরে আসছে দুনিয়াতে। আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না, আমার মনের মধ্যে কী চলতেছিল তখন। আমি লিটারেলি জেলাস ফিল করতেছিলাম যে, তোমার বাবা অ্যাটলিস্ট বেঁচে আছেন। হোক পঙ্গু। তবু তো আছেন! উনার মতো আমার বাবারও রোড অ্যাক্সিডেন্ট হইছিল। সে সারভাইভ করতে পারে নাই। আমার মা, আমার বোন কেউ সারভাইভ করে নাই। কিন্তু তোমার বাবা লাকি। উনি সারভাইভ করে গেছেন। আর তোমাকে যখন দেখলাম, অনেস্টলি স্পিকিং আমার হার্টবিট মিস হয়েছে। তুমি দেখতে আহামরি সুন্দর না, আমিরা। আমি মিথ্যে প্রশংসা করতে চাই না। কিন্তু তোমার চোখ খুব এক্সেপশনাল। তোমার চোখ তোমারই বডির একটা পার্ট কিন্তু তার আলাদা আইডেন্টিটি আছে। আমার মনে হলো, এই চোখের মানুষের সাথে সারাজীবন কাটানোটা অনেক লাকের ব্যাপার। সবার কপালে এই লাক জোটে না।
– তাই?
– শুধু এটুকুই না। তুমি পুরোটাই এক্সেপশনাল। তোমার মাথায় এত এত চুল! আমার মনে নাই কিন্তু মামা আর বুবু প্রায়ই গল্প করে, আমার মায়ের মাথায় নাকি অনেক চুল ছিল। কোঁকড়া-কোঁকড়া। এত চুল যে, মায়ের মাথাব্যাথা হতো। চুল সামলাতে গেলে দুই-তিনজন লাগত। প্রতিদিন বিকেলে উঠানে বসে আমার মায়ের চুল বেনি করে দিত বুবু আর তার ছোট বোন। মা-খালারা মিলেই চুল সামলাতে হিমশিম খেত। আমার মায়ের মাথার চুল নাকি খুব দ্রুত বড়ও হতো। অনেক বড় চুল ছিল। কোমর ছাঁড়ানো। আরেকটু হলে নাকি গোড়ালির সমান হয়ে যায়। বিয়ের পর এই চুল সামলানোর কেউ ছিল না। আমার মা ছিল বড় বউ। তাকে সংসারের অনেক কাজ করতে হতো। নিজের যত্ম নিতে পারত না আর চুলের আলাদা যত্ম কীভাবে নিবে? তখন থেকে চুল ঝরতে শুরু করল। অথচ এই চুলের জন্যই আমার দাদা মাকে আমার বাবার বউ করে নিয়েছিলেন। এরপর যখন আমার জন্ম হলো, মা নিজেই চুল কেটে ফেলল কোমর পর্যন্ত। চুলও ঝরে পড়তে লাগল। আমি নিজে দেখি নাই আমার মায়ের সেই চুল। কিন্তু গল্প শুনেছি অনেক। বিশেষ করে বুবু গল্প করতে বসলেই মায়ের চুলের কথা বলবে। বসার ঘরে যখন ছিলে, আমি অত খেয়াল করিনি। কিন্তু পরে তোমার ঘরে গিয়ে তোমাকে দেখার পর কী মনে হয়েছে, জানো?
– কী?
– আমার মায়ের চুলগুলো মনে হয় এরকমই ছিল! তোমার চুল অত বড় না। কিন্তু মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। আমার মায়ের হয়তো এরকমই চুল ছিল! ঠিক ওই মুহূর্তে আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল তোমাকে। আমার মনে হলো, যে কোনো মুল্যে তোমাকেই পেতে হবে।
– হু।
রিফায়াতের দুই হাতের আগলে আমিরার হাতজোড়া আটকা পড়ে আছে। সেই বন্ধন জোরালো হলো। রিফায়াত বলল,
– তোমার হয়তো যে কাউকে বিয়ে করলেই চলবে। কিন্তু আমার তোমাকেই লাগবে, আমিরা। শুধু তোমাকে। আমি ফুপুর জোরাজুরিতে তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু পছন্দটা একান্তই আমার। প্লিজ, ম্যারি মি!
======================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
২২।
আমিরার মনে হলো, স্বপ্ন দেখছে সে। এটা কোনো অবস্থাতেই বাস্তব হতে পারে না। সে নাহয় রিফায়াতকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু রিফাত কেন এই ভুলটা এড়িয়ে যাচ্ছে? সে কি আদৌ বুঝে উঠতে পারেনি, যাকে তার বাবা পছন্দ করেছিলেন, সেই মেয়েটা অন্য কেউ? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করছে? প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। কিন্তু উত্তর খুঁজে বের করার আতঙ্ক আমিরাকে তাড়া করছে। যে কারণেই হোক, রিফায়াতের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। গতকাল যে মানুষ গিয়েছিল বাসায়, আজ সে-ই এসেছে এই বারগার শপে এবং করুণ সুরে আকুতি জানাচ্ছে যেন আমিরা তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়!
আমিরা আলতো করে নিজের হাতে চিমটি কাটল। ব্যাথা পাচ্ছে। কুট করে পিপড়া কামড়ে দেবার মতো চিন চিন ব্যাথা না। একটু জোরেই চিমটি কেটেছে। নখের দাগ বসে গেছে চামড়ায়। একটু ছিলেও গেছে। জায়গাটা লাল হয়ে গেছে। তার মানে ঘটনা সত্যি! রিফায়াতের কথায় এটা স্পষ্ট, ভুল বুঝাবুঝির ঘোর থেকে এখনো বের হয়ে আসেনি। তবে একসময় বের হতে হবে। রিফায়াতের ফুপু আজ বা কাল নিশ্চয়ই কল করে ভাতিজাকে জানাবেন, কেউ ওই মেয়েটাকে দেখতে যায়নি। তখন কথা প্রসঙ্গে বের হয়ে আসবে সত্যিটা। তখন কী করবে রিফায়াত? আজকের এই মুহূর্তে যে আকুলতা তার মধ্যে কাজ করছে, সেটা রয়ে যাবে? নাকি এক ঝটকায় উবে যাবে?
রিফায়াতের অবস্থা আমিরার থেকেও সঙ্গীন। তার হবু স্ত্রীর বিয়ে অন্য জায়গায় হবার পায়তারা চলছে, এই খবরটা তাকে ভালোমতোই নাড়া দিয়েছে। আমিরার উত্তর জানতে সে উদগ্রীব। এদিকে আমিরার মাথায় প্রবল গতিতে চিন্তাভাবনা চলছে। লজ্জ্বার মাথা খেয়ে ‘হ্যাঁ’ বলবে নাকি মৌণ সম্মতি জানাবে, ভাবছে। ভালোবাসার কথা জানানোর বোধহয় এটাই সুযোগ। আজকের পর এই সুযোগ আবার নাও আসতে পারে।
– আমিরা, কথা বলো! কাকে বিয়ে করতে চাও তুমি? আমাকে নাকি তোমার খালার পছন্দের পাত্রকে?
আমিরার খুব নার্ভাস লাগছে। হাত-পা কাঁপছে তো সেই কখন থেকে। এখন ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা। রিফায়াত ওর হাত চেপে ধরে রেখেছে। যেন ‘হ্যাঁ’ না বলা পর্যন্ত ছাড়বেই না। শক্ত করে ধরে রাখবে। হাতের তালু ঘেমে চিটচিট করছে। তাও সে নির্বিকার। আমিরার গলাও শুঁকিয়ে যাচ্ছে। রিফায়াতকে ভালোবাসে, এটা ঠিক। কিন্তু বিষয়টা দুইদিনের না। বলা চলে সারাজীবনের ঝুঁকি। এই ঝুঁকিটা নিতে সে প্রস্তুত না। তার মানসিক কোনো প্রস্তুতিও নেই। শুকনো একটা ঢোক গিলে আবছাভাবে মাথা নাড়ল সে। এই মাথা নাড়ার অর্থ দুইরকম হতে পারে। হ্যাঁ অথবা না। রিফায়াত এটাকে হ্যাঁ ধরে নিল। নিঃশব্দে হাসল সে। চোখমুখে বিশ্বজয়ের ইঙ্গিত। আমিরা অবাক হচ্ছে ভেবে, তাকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ এই দুনিয়ার কোনো মানুষের কাছে এতটা উচ্ছ্বাসের হতে পারে। অবশ্য রিফায়াতও তার কাছে এমনই একজন।
রিফায়াত বলল,
– তুমি তোমার ফ্যামিলির সাথে কথা বলো। স্ট্রংলি কথা বলতে হবে। তোমার মা আর বড় আপা খুব সহজে রাজি হবেন বলে আমার মনে হয় না। তোমার বাবা কতখানি সাপোর্ট করবেন, সেটাও দেখার বিষয়। উনাকে আপাতত মাইনাস পয়েন্টে রাখতে হবে। ধরে নিতে হবে, তোমার পক্ষে উনি নেই। সো, তুমি একাই ফাইট করবে। ঠিক আছে? যে যাই বলুক না কেন, তুমি নিজের জায়গায় ডিটারমাইন্ড থাকবে। আর আমি আজই ফুপুকে কল দিব। গতকালই কল দিতাম। কিন্তু বাসায় ফিরতে একটু রাত হয়ে গেছিল। অনেক টায়ার্ড লাগছিল। তাই আর কথা হয়নি। আজ হয়তো অফিসের ফাঁকে কল দিতাম বা সন্ধ্যার দিকে। এনিওয়ে, ফুপুকে বলব আগামীকালই ঢাকায় চলে আসতে। তারপর পরশুদিন আমি আবার যাব তোমাদের বাসায়। ফুপুকে সাথে নিয়ে। আমার মনে হয়…
– কোনো লাভ হবে না। আপনার ফুপুর কথা কেউ মানবে না।
– কেন?
– ওই যে বললাম, আমাদের বাসায় বড় খালার কথাই ফাইনাল।
– ফাইনাল বললেই তো হয় না, আমিরা। আমার আর তোমার বিয়ের কথাবার্তা আগে হয়েছে। ফুপু নিজে বড় স্যারের সাথে কথা বলেছে। স্যার তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথাবার্তা পাকা করেই ফুপুকে কনফার্ম করেছে। বাকি ছিল শুধু আমাদের দেখা হওয়াটা।
– হু।
– এর মধ্যে তোমার খালা উড়ে এসে জুড়ে বসলে আমরা মানব কেন?
– কী করবেন তখন? ধরেন, আপনার ফুপু আমাদের বাসায় গেল। কথা বলল। কিন্তু আমার ফ্যামিলি মানে মা আর আপার কথার নড়চড় হলো না। তারা মুখের উপর ঠাস করে বলে দিল, আপনার সাথে আমার বিয়ে দেবে না। তখন কী করতে পারবেন আপনি?
রিফায়াত এভাবে চিন্তা করেনি। প্রশ্ন শুনে তার কপালে ভাঁজ পড়ল। আসলেই তার কিছু করার নেই! আমিরা যতই নিজ অবস্থানে শক্ত থাকুক, তার মতামতকে কেউ খুব একটা গ্রাহ্য করবে না। উলটো আমিরাকে জোর করে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। আমিরা নিজ সিদ্ধান্তে কতক্ষণ স্থির থাকতে পারবে, তাও ভাববার বিষয়। রিফায়াতের সাথে তার বহুদিনের প্রেম নেই। চেনাজানাও অল্প সময়ের। তার উপর ভরসা করে এই মেয়ে বারগার শপে এসেছে দেখা করতে, কথা বলতে, এটাই ঢের। এমনও হতে পারত, গতকাল মা-বোনের সাথে আমিরাও মন বদলে ফেলল। বদলায়নি। উলটো আজ সকালে কলেজ বাদ দিয়ে কল করেছে রিফায়াতকে। এর মানে তার অন্যত্র বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তবু পরিবারের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলার মানসিকতা তার থাকার কথা না। আবার থানা-পুলিশও করার যাবে না। পুলিশ আমিরার বাবা-মায়ের কথার বাইরে কোনো পদক্ষেপ নিবে না। আমিরার মতামতকে হয়তো গুরুত্ব দেবেই না। থানা-পুলিশ করলে তার ফলও ভালো হবে না। সম্পর্ক তৈরির আগেই তা বৈরিতায় পরিণত হলে আজীবন তিক্ততা রয়ে যায়।
রিফায়াত চিন্তিত সুরে বলল,
– তোমার কী মনে হয়, কী করা যাবে?
আমিরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর ধীর সুরে বলল,
– আজ সকালে নাশতা খাওয়ার সময় মা বলল, খালার ঠিক করা সেই পাত্র আজ বিকেলে বাসায় আসবে। খালাও তখন আসবেন। আজই বিয়ের ব্যাপারে সবকিছু ফাইনাল হবে। আমার ধারণা…
– কী?
– আমি ঠিক জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে।
– কী মনে হচ্ছে?
আমিরা চুপ করে রইল। রিফায়াত ওর হাতের উপর চাপ দিল। বলল,
– বলো। কী মনে হচ্ছে তোমার?
– মনে হচ্ছে আজকেই হয়তো…
আমিরা কথা শেষ করল না। রিফায়াতও বাকিটুকু জানতে চাইল না। দুজন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে। দৃষ্টি তার নিজ ভাষায় জানান দিল মনের কথা। রিফায়াত অস্ফুট সুরে বলল,
– তুমি শিউর?
– না। আমার শুধু মনে হচ্ছে এরকম।
– মনে হবার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে কোনো?
– উহু, কোনো কারণ নাই।
– সিক্সথ সেন্স?
– হু।
– সিক্সথ সেন্স কখনো মিথ্যে হয় না, আমিরা।
– জানি। এইজন্য আমি… মানে আমি বাসা থেকে পালিয়ে আসছি।
– হোয়্যাট?
– মানে আমি বাসায় ফিরব না।
– তাহলে কোথায় যাবা?
– জানি না। হয়তো আমার কোনো ফ্রেন্ডের বাসায়।
– তোমার বাসা থেকে খোঁজাখুঁজি করবে না?
– হ্যাঁ, সেটা তো করবেই।
– সবার আগে ফ্রেন্ডের বাসায় খুঁজবে। তখন তোমাকে ধরে ফেলবে। এরপর জোর করে বাসায় নিয়ে যাবে। তাছাড়া কতদিন লুকিয়ে থাকবা? তোমার ফ্রেন্ড কতদিন তোমাকে সাপোর্ট দিবে?
– আমি আসলে অত কিছু ভাবি নাই। আমার জাস্ট মনে হইছে, পালাইতে হবে। আমি আজকে বাসায় ফিরলে যে কোনো কিছু হইতে পারে।
রিফায়াত চুপ করে রইল। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। বুঝাই যাচ্ছে, মাথার ভেতর এলোমেলা ভাবনার তুফান চলছে। কফি দিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কেউ তাতে এক চুমুক দেয়নি। আমিরার এতক্ষণ গলা শুঁকিয়ে আসছিল। রিফায়াতকে কথাগুলো বলতে পেরে অনেকটা স্বস্তি লাগছে। সবথেকে বড় কথা, তার মাথা থেকে দুশ্চিন্তাগুলো এবার রিফায়াতের মাথায় ভর করেছে।
কফির কাপে আলতো চুমুক দিল আমিরা। তারপর বলল,
– আপনি বলছিলেন, আল্লাহ যার সাথে জোড়া লিখে রাখছে, তার সাথেই বিয়ে হবে।
রিফায়াত হতাশ কন্ঠে বলল,
– বলছিলাম। কিন্তু তখন বুঝি নাই চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে এই কথা রিবাউন্স করবে। আমি তো এই সেন্সে বলছি যে, আমার কোনো প্ল্যান ছিল না তোমাকে বিয়ে করার। আমার এখন ক্যারিয়ার বিল্ড আপ করার সময়। তাছাড়া মামা-মামির তোমাকে নিয়ে ভালোই আপত্তি আছে। তারা চেয়েছিল, আমার বিয়েটা অন্য কারও সাথে হোক। সামওয়ান, যে কি না আমার ইকুয়াল। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আমি স্ট্রেইট কথা বলতে পছন্দ করি।
– হু।
– মামি যখন ফুপুর কাছ থেকে তোমার ডিটেইলস শুনল, সবার আগেই ‘না’ বলে দিয়েছে। বুবুও রাজি না। তাদের কথা হচ্ছে, ফিন্যান্সিয়ালি এস্ট্যাবলিশড ফ্যামিলি থেকে একটা মেয়ে আসুক আমার লাইফে, যে কি না নিজেও ওয়েল এডুকেটেড। আমারও সেরকম ইচ্ছে ছিল। তাই ফুপুর কথায় অত পাত্তা দেইনি। কিন্তু ফুপু দিনকে দিন ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করছিল। বাবার পছন্দের মেয়ে, বাবার ইচ্ছে, এই ধরনের কথাবার্তা বলে কান ঝাঝরা করে দিচ্ছিল। আমি এই প্যারা আর নিতে পারছিলাম না। তাই মনে হলো, একবার গিয়ে দেখা করাই যায়। দেখা করলেই তো বিয়ে হয়ে গেল না! কিন্তু তোমাকে দেখার পর মনে হলো, এটা আল্লাহর ইশারা ছিল। আল্লাহ চাচ্ছিলেন আমাদের বিয়ে হোক। এজন্য আমাকে তিনি এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন।
– কোনটা আল্লাহর ইশারা আর কোনটা মানুষের, এতকিছু আমার মাথায় ঢুকে না।
– তবে আল্লাহ জোড়া লিখে রেখেছেন, এই কথার উপর ভরসা করে বসে থাকতে কিন্তু বলা হয়নি, আমিরা। আল্লাহ কার সাথে কার জোড়া লিখেছেন সেটা আমরা কেউ জানি না। সো আমাদের যেটা করতে হবে তা হলো, কিপ ট্রাইং। আমরা আমাদের ডিসিশনে স্ট্রিক্ট থাকব। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করে যাব। এরপরেও যদি বিয়ে না হয়, হয়তো একসেপ্ট করা গেল। কিন্তু কোনোরকম ট্রাই না করেই যদি হার মেনে নিই…
– কী ধরনের ট্রাই করা উচিত, জানি না। আমার জাস্ট মনে হচ্ছে, আজকে বাসায় না গেলেই ভালো। খালার পছন্দ করা ছেলেটা মানে শফিক আসবে বাসায়। খালাও বলেছেন, বিকেলের দিকে চলে আসবেন। খালু নাকি সন্ধ্যার দিকে শফিককে নিয়ে আসবে।
– মানে, আটঘাট বেঁধেই আজকের প্ল্যান হচ্ছে!
– আমি এই সিচুয়েশন ফেস করতে চাচ্ছি না। তাই ফিরব না। আর আগামী কয়েকদিন বাসার বাইরে থাকব। বিয়ে সংক্রান্ত ঝামেলা ঠান্ডা হলে এরপর…
– তোমার কি মনে হয় এই ঝামেলা সহজে ঠান্ডা হবে? তোমাকে খুঁজে না পেলে আরও দাউদাউ করে জ্বলবে আগুন। থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়াবে।
– হু। তা জানি। তবু এই মুহূর্তে পালানো ছাড়া আমার কাছে আর কোনো অপশন নাই।
রিফায়াত খানিক ভাবল। তারপর ঝট করে উঠে দাঁড়াল। আমিরার হাত টেনে ধরে বলল,
– চলো আমার সাথে।
আমিরা হতবাক সুরে বলল,
– কোথায়?
– আমার মাথায় একটা প্ল্যান আসছে। চলো তো!
===============================