তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
১১।
আচ্ছা, বিয়ের পর পরই বাচ্চা নিয়ে ফেললে কেমন হয়? পাশের বাসায় একটা দম্পতি এসেছে গত বছর। সদ্য বিবাহিত। তবে বয়সটা একটু বেশি। ভাইয়ের বোধহয় দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম স্ত্রী মারা গেছে। কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। আর ভাবির এবারই প্রথম বিয়ে। ভাবির গায়ের রঙটা চাপা আর চেহারাও দেখতে আহামরি কিছু না। গালে মেছতার দাগ। গলায় ভাঁজ পড়ে গেছে। দেখতে মোটা। শারীরিক কোনো সমস্যা আছে বোধহয়। এজন্য এই বাসায় আসার পর পরই তারা ডাক্তারের কাছে যাওয়া-আসা শুরু করল। মাস দুয়েক পর মিষ্টি নিয়ে এসেছিল ওদের বাসায়। সন্তান হবে, এই আনন্দের খবর জানিয়েছিল। ভাবির সন্তান এখনো হয়নি। তবে সময় ঘনিয়ে এসেছে। ডাক্তার বলেছেন, এই মাসের শেষের দিকেই লেবার পেইন হবার সম্ভাবনা আছে। পেইন উঠলেই যেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তড়িঘড়ি করে। ভাই খুবই ঘাবড়ে গেছেন ভাবির এই দুঃসময়ে। তিনি নিজে সবসময় বাসায় থাকেন না। তার অফিস আছে। কাজ ফেলে তো সারাদিন বউকে নিয়ে বসে থাকলে চলে না। ছুটিও নেয়া সম্ভব না। এখন নিলে পরে বাচ্চা হবার সময়ে ছুটি মিলবে না। ভাই সব ছুটি ওই সময়ের জন্য জমিয়ে রেখেছেন। ভাবি বাসায় একা থাকেন। শ্বশুরবাড়ির মানুষজন সবাই গ্রামে। শাশুড়ি দুই-একবার ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু কী কারণে যেন ঢাকায় থাকতে তার মন চায় না বেশিদিন। কদিন বেড়িয়েই আবার চলে যান। একারণে ভাই ওদের বাসায় এসে অনুরোধ করে গেছেন, তিনি না থাকলে যেন ওরা তার স্ত্রীর দিকে খেয়াল রাখে। ভাবিকেও বলেছেন, কোনো দরকার পড়লে আমিনাদের বাসায় নক করতে। ভাবি প্রায়ই দুপুরের পর পর চলে আসে বাসায়। গল্পগুজব করে। মা বিকেলের নাশতা বানায়। ভাইয়ের ফিরতে রাত নয়টার মতো বাজে। ততক্ষণ ভাবি এখানেই থাকে। দুদিন ধরে অবশ্য আসছেন না। ভাবির মা ফাইনালি এসেছেন গ্রাম থেকে। বাচ্চা হওয়ার পর তাকে পেলেপুষে খানিক বড় করা পর্যন্ত মনে হয় এখানেই থাকবেন।
আমিরার খুব ভালো লাগে ভাবির একার সাজানো সংসার দেখতে। প্রায়ই পড়াশুনার ফাঁকে একটু অবসর মিললেই ভাবির কাছে চলে যায় সে। ভাবির সংসারে বসে কল্পনা করে, একদিন এরকম একটা সংসার তার নিজেরও হবে। তখন কী কী জিনিসপত্র কিনবে, কীভাবে সাজাবে তাও মনে মনে সাজানো এখনই শেষ। আসলে এগুলো মনের অলসতা। ভালো লাগে ভাবতে। তাই কল্পনার জগতে স্বাধীন ঘুরে বেড়ায়। কখনো এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবার দরকার অনুভব করেনি। সবসময় মনে হয়েছে, বর্তমানের এই দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হবে। আর সেজন্য মন দিয়ে পড়াশুনা করাটা জরুরি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
আজ শফিককে দেখার পর মনে হচ্ছে, দুইজনের সংসারে কাজ খুব একটা থাকবে না। পাশাপাশি পড়াশুনাও করা যায় কিন্তু। তবে শফিক পড়তে দেবে কি না, এটাও ভাববার বিষয়। শুধু মুখে বললেই তো পড়াশুনা হয়ে যায় না। এর পেছনে খরচের ব্যাপার আছে। খালা নিশ্চয়ই বিয়ের পরও ওর পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যাবেন না। ওটা শফিককেই সামলাতে হবে। সে কি পারবে? আচ্ছা শফিকের বেতন কত? একবার কি জিজ্ঞেস করবে? অবশ্য এখন জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। সংসার চালাতে কী পরিমাণ খরচ হয়, তার জানা নেই। তবে আগামীকাল অবশ্যই ভাবির কাছ থেকে জানতে হবে। যদি শফিকের বেতনটা আহামরি না হয়, তবে আমিরা নিজেই নিজের পড়ার খরচ চালাবে। শফিক সারাদিন অফিসে থাকলে তো বাসা একরকম খালিই থাকবে। ওই সময়ের মধ্যে ব্যাচ পড়ানো শুরু করলে মন্দ হয় না। তবে শুরুর দিকেই ব্যাচে কেউ পড়তে আসবে কি না, কে জানে। আমিরার তো আহামরি কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা এখনো তৈরি হয়নি। এখন তাকে সবাই চিনবে ম্যাট্রিক পাশ বলে। হুম, টিউশনি করতে হবে। আগে বাসায়-বাসায় গিয়ে পড়াতে হবে। এরপর…
শফিকের ডাকে আমিরার চিন্তাভাবনায় ছেদ পড়ল। কয়েকবার ডেকেছে মনে হয়। আমিরার কানে যায়নি। সে মগ্ন ছিল ভবিষ্যত পরিকল্পনায়। তার এরকম স্বভাব আছে। প্রায়ই হুটহাট চিন্তাভাবনার জগতে ঢুকে পড়ে। বেশ অনেকটা সময় পর কাঠখড় পুড়িয়ে তাকে ফেরত আনে চারপাশের মানুষরা। শফিক অবশ্য কাঠখড় পোড়ায়নি। ডাকাডাকিও খুব একটা করেছে বলে মনে হয় না। দুই-একবার ডেকে এরপর সামনে এগিয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে সে দাঁড়ানো ঠিক আমিরার সামনে। এক হাতে আমিরার কাঁধ স্পর্শ করেছে। সংবিৎ ফেরার পর আমিরা মুখ তুলে তাকাতেই সে বলল,
– আপনি কি ঠিক আছেন?
– হু। কেন?
– কেমন স্ট্যাচু হয়ে গেলেন, তাই।
– স্ট্যাচু?
– ওই তো নড়াচড়া করছিলেন না। মনে হচ্ছিল স্ট্যাচু। কী হয়েছিল আপনার?
আমিরা স্বাভাবিক সুরে বলল,
– কিছু না। আমি মাঝেমধ্যে এরকম ডুবে যাই।
– কোথায়?
– আপনাকে তো বলা যাবে না। খুউব সিক্রেট।
কথাটা এমনভাবে বলল আমিরা যেন মজার কিছু বলে ফেলেছে। শফিক হাসল। ঠিক ওই মুহূর্তে আচানক বিপত্তি ঘটল। আমিরা একটা রবার ব্যান্ড দিয়ে খুব টাইট করে উঁচু পনিটেইল বেঁধেছিল মাথায়। বাধার সময় বুঝতে পারেনি। কিন্তু এখন মাথা ঝিমঝিম করছে। চুলগুলো মাথার তালু থেকে উঠে আসার জোগাড়। ব্যাথাও লাগছিল একটু বোধহয়, তাই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চুলে হাত দিয়ে ব্যান্ড ঢিলা করতে গেছে, অমনি ওটা গেল ছিঁড়ে। নিমেষেই কাকের বাসা স্বরূপে ফিরল। আমিরা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে চুল দুই হাতে চেপে ধরল সে। ঘরের ভেতরই একপাশের দেয়ালে আয়না লাগানো। তার সামনে একটা পড়ার টেবিল। ওটার পর যাবতীয় প্রসাধনী সামগ্রী। আমিরা হন্যে হয়ে নতুন রবার ব্যান্ড খুঁজছে। পেছন থেকে শফিক বলল,
– কী খুঁজছেন?
আমিরা উত্তর দিল না। তার মানইজ্জত শেষ। এই কাকের বাসা দেখার পর শফিক ছুটে পালাবে! আর কোনোদিন এই মুখো হবে না। ওর খুব রাগ হচ্ছে রবার ব্যান্ডের উপর। বড় আপার উপর সেই রাগ চলে যাচ্ছে। কারণ দুই টাকার সস্তা রবার ব্যান্ড বড় আপাই কিনে এনেছে। কান্নাও পাচ্ছে। শফিকের সাথে বিয়ে না হলে কী হবে, ভাবতেই পারছে না।
শফিক আবার বলল,
– চুলটা বাঁধার দরকার নেই। থাকুক না!
আমিরা মনে মনে বলল,
– হু, তোমাকে দেখাই কাউয়ার বাসা। এরপর তুমি বলবা জীবনেও এই মেয়ে বিয়ে করব না। মরে গেলেও না।
– এক্সকিউজ মি! শুনতে পাচ্ছেন?
আমিরাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতে হলো। কারণ শফিক একদম পেছনে চলে এসেছে। আমিরার চোখভর্তি টলমল করছে নোনাপানি। যে কোনো মুহূর্তে ঝরে পড়বে। কোনোরকমে কান্নাটা চেপে রেখে বলল,
– আপনি প্লিজ ওখানে বসুন। আমি জাস্ট চুলটা…
– চুল বাধার দরকার নেই। আপনার চুল তো বেশ বড়ই মনে হচ্ছে। বড় চুল সবসময় খোলা রাখতে হয়।
আমিরা এখন কেঁদেই ফেলবে। তার চুল বড়। কিন্তু খুলে রাখার মতো সৌন্দর্য তার চুলে নেই। আমিরা এক হাতে ধরে রেখেছে পনিটেইল। এটা ছাড়লেই যাচ্ছেতাই সাইজে দাঁড়িয়ে যাবে। এই চুলের জন্য কম হ্যাপা সইতে হয়নি। সবাই ক্ষেপিয়েছে। কেউ কেউ আফ্রিকানও বলেছে। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ক্লাসের কতগুলো মেয়ে গুজব ছড়াল, আমিরা আসলে ওর বাবা-মায়ের আপন মেয়ে না। ওকে এডাপ্ট করে আনা হয়েছে আফ্রিকা থেকে। অথবা কোনোভাবে ওর আফ্রিকান বাবা-মা এই দেশে এসেছিলেন। ওর জন্ম হবার পর ওকে ফেলে রেখেই ওরা চলে গেছেন। ও বড় হচ্ছিল এতিমখানায়। আমিরার বর্তমান বাবা নিশ্চয়ই খুব ভালো মানুষ। তাই দয়া করে নিয়ে এসেছেন। নিজের পরিচয়ে বড় করছেন। প্রথমে এই গুজব গুটিকয়েক মেয়েদের মধ্যে ছড়াছড়ি হচ্ছিল। আস্তে-আস্তে পুরো স্কুল ছড়িয়ে গেল। টিচাররা পর্যন্ত জেনে গেলেন। একদিন সমাজ আপা আমিরাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
– অ্যাই আমিরা, তোর সম্পর্কে কী কী শুনতেছি। এগুলো সত্যি নাকি রে? তুই কি আফ্রিকান? তোর বাবা নাকি তোকে পালক এনেছে!
আজগর আলী তখনো শক্ত সামর্থ। চাকুরি করছেন। আমিরা বাসায় গিয়ে কেঁদেকেটে তাকে সবকিছু জানাতেই পরদিন তিনি স্কুলে গেলেন। হেড টিচারের সাথে দেখা করে গুজবের প্রসঙ্গ তুললেন। হেড টিচার খুবই লজ্জিত। তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমিরার বাবাকে আশ্বস্ত করলেন, বিষয়টা নিয়ে স্কুলের টিচারদের সাথে কথা বলবেন। কিন্তু কথাচ্ছলে তিনিও বলতে বাকি রাখেননি, আমিরার গায়ের রঙ আর চুলের কারণেই এই গুজবটা ছড়িয়ে গেছে। এখানে অন্যদের খুব একটা দোষ দেয়া যায় না।
এখন এইসব কথাবার্তা আর চুল নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা মোটামুটি গায়ে সওয়া হয়ে গেছে। খুব একটা খারাপ লাগে না। আসলে বাবা পঙ্গু হবার পর থেকেই জাগতিক অনুভূতিগুলো সব শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সেখানে চুল নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করাটা বেমানান। আমিরা এখন উলটাপালটা কথা শুনলেও রিঅ্যাক্ট করে না। কিন্তু আজ তার জীবনমরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই চুল। সে মনে মনে বলল,
– শফিক যদি আমাকে বিয়ে না করে, এই চুল আমি রাখব না। একদম ন্যাড়া করে ফেলব মাথা।
মুখে কিছু একটা বলতে হয়। তাই বলল,
– না মানে আমার চুলগুলো এত বেশি কোঁকড়ানো, না বাধলে খুব খারাপ দেখায়।
– খারাপ দেখাবে কেন? আমার মায়েরও কোঁকড়ানো চুল ছিল। বুবুরও চুল কোঁকড়ানো। আপনি বরং চুলটা ছেঁড়ে রাখুন। ভালো লাগবে। প্লিজ।
আমিরা চোখ বুজে ফেলল। চুল থেকে হাত সরিয়েই মাথা নিচু করল। কোঁকড়ানো চুলগুলো কাঁধের উপর ছড়িয়ে যাচ্ছে। কোমর সমান তাই পিঠের উপরও ছড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে যেটা অনর্থ ঘটাচ্ছে, তা হলো, মাথার চাঁদিতে ফুলেফেঁপে আছে। শফিকের রিএকশন কি? নিশ্চয়ই বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তো মনে মনে ভাবছে, এতক্ষণ যার সাথে হেসে-হেসে কথা বললাম সেই মেয়ের চুলের এই অবস্থা কেন?
চারদিকে সাড়াশব্দ নেই। হচ্ছেটা কি? শফিক কি তবে অজ্ঞান হয়ে গেল? নাকি চুলের বাহার দেখেই ঘর থেকে ছুটে পালিয়েছে? আমিরা ধীরে-ধীরে চোখ খুলল। ঠিক সামনেই এক জোড়া পা। প্যান্ট পরা। তার মানে শফিক এখনো সামনে দাঁড়ানো। কিন্তু সে চুপচাপ কেন? ঝট করে আবার চোখ বুজল আমিরা। তারপর মাথা তুলে তাকাল। শফিক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তবে হতাশা স্পষ্ট। তার হাতে চিরুনি। কখন আমিরাকে পাশ কাটিয়ে চিরুনিটা তুলে নিয়েছে, টের পাওয়া যায়নি। আমিরাকে মাথা তুলে তাকাতে দেখে বলল,
– আপনাকে নোবেল প্রাইজ দেয়া দরকার।
– অ্যা?
– এই চুল আপনি ম্যানেজ করেন কীভাবে? মানে কারও মাথাভর্তি এত এত চুল থাকতে পারে, তাও কোঁকড়ানো। আমি এই প্রথম দেখলাম। আমার বুবু আর মায়ের চুলও কোঁকড়ানো। কিন্তু এত বেশি না। আপনার মাথা ভার লাগে না?
আমিরার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তীরে এসে তরী ডুবে গেছে তার। সে কোনো কথা বলল না। শফিকই আচানক বলল,
– আপনি একটু আগে জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আপনার ঠিক কোন দিকটা আমার পছন্দ হয়েছে। আমি তখন উত্তর দিতে পারিনি। কিন্তু এখন বলছি, আপনার চুল। বিশ্বাস করেন, এত এত ঘন চুল আমি কারো মাথায় দেখিনি।
কথাগুলো আমিরার কানে ঢুকলেও বিশ্বাস হচ্ছে না। সে ঘুরে তাকাল আয়নার দিকে। সেই কাকের বাসা। এটা দেখেই শফিক বিয়ে করতে চাইল?
ঠিক তখন শফিক ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
– তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমিরা। চলো, বিয়ে করে ফেলি।
=====================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
১২।
শফিকের খুব তাড়া ছিল। বিকেলেই ফেরার কথা। ঘন্টাদুয়েকের সময় নিয়ে এসেছিল আমিরাদের বাসায়। কিন্তু সন্ধ্যে পার হবার পরও তার বের হবার নাম নেই। সেই যে শোবার ঘরে ঢুকেছে। গুটুর-গুটুর করে কথা বলেই যাচ্ছে দুজন। যেন বহুদিন ধরে জমিয়ে রেখেছিল কথাগুলো। নাসিমা বানুর বিরক্ত লাগছে কেন জানি। বিরক্তিটা শফিকের প্রতি না। রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে, এই দুশ্চিন্তায়। শফিক না থাকলে অত কিছু ভাবতে হতো না। রাতে তারা তেমন কিছু খান না। সংসারের খরচ বাঁচানোর চিন্তায় নাকি স্বাস্থ্য সচেতনতা, তা হলফ করে বলা যায় না। রাতে শুধু আজগর আলীর জন্য দুটো রুটি বানানো হয়। তিনি দুপুরের বাসি তরকারি বা সকালের নাশতার জন্য রান্না করা সবজি দিয়েই খেয়ে নেন। তিনি আর মেয়েরা কখনো বাসি ভাত থাকলে একটু ভর্তা-ভাজি অথবা শুধু ডাল দিয়ে খেয়ে ফেলেন। মেয়েরা প্রায় রাতেই খায় না। সন্ধ্যায় নাশতা খাওয়া হলে রাতের খাবারের চিন্তা অত থাকেও না। সেই হিসেবে বলা চলে, ওদের বাসায় রাতের জন্য আলাদা করে বন্দোবস্ত করা হয় না।
আজ রান্না করতে হবে। কী রান্না করবেন, তা নিয়ে মুলত মাথাব্যাথা। বাসায় বাজার বলতে কিছু নেই। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমিনা বাজার করে আনে। এলাকার মোড়ে কয়েকজন একটা ঝুড়িতে কিছু শাকসবজি নিয়ে বসে। ওগুলো মুলত সারাদিনের বিক্রি না হওয়া অবশিষ্টাংশ। নামমাত্র দামে দিয়ে দেয়। অল্প টাকার মধ্যে বেশ অনেকগুলো সবজি মিলে, এজন্য আমিনা ওখান থেকেই বাজার করে। কিন্তু আজ সে বের হয়নি। শফিক এসেছে বলে সেও আটকা পড়েছে। আজ এতই মরার কপাল, বাসায় ডিমও নেই। কদিন ধরেই ডিমের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। তাই মাসখানেক হলো, ডিম খাওয়া হচ্ছে না সেভাবে। আমিনা এক ডজন কিনে আনে, ওটা শুধু আজগর আলীকে প্রতিদিন একটা করে খাওয়ানো হয়। কখনো আনিসা আবদার করে ডিম খাওয়ার। তখন ওকে একটা ভেজে দেন।
নাসিমা বানু চাপা সুরে স্বামীকে তিরস্কার করলেন,
– খুব তো বড় মুখ করে বললা, চারটা ডালভাত খেয়ে যাইতে। এখন কি খালি ডালভাত খাওয়াইয়া বিদায় করব?
আজগর আলীর মুখ শুঁকিয়ে আছে। তিনি আমতা-আমতা করে বললেন,
– কেন? বাসায় কি বাজারসদাই কিছু নাই?
– কেমনে থাকবে? তুমি জানো না, অন্যের টাকায় এই সংসার চলে? আমিনা কয় টাকা পায়? তাও তো কিছু না কিছু কিনে আনে। তা দিয়ে কি মেহমান খাওয়ানো যাবে?
আজগর আলী নিজেও বেকায়দায় পড়ে গেছেন। ঘরের বাজারের খবর তার কাছে থাকে না। তাই অতশত মাথায় আসেনি। আবেগের বশে শফিককে বলে ফেলেছেন, রাতে খাওয়ার কথা। শফিকও যে কথাটা লুফে নিবে, কে জানত। তাকে দেখে তো মনে হচ্ছিল অনেক তাড়া। আমিরার সাথে দেখা না করেই চলে যায় পারলে। আর এখন এই যে কথা বলছে, তো বলছেই! এদের কথা আর শেষ হবার নাম নেই। এত কী কথা বলে? আজকেই পরিচয়, আর আজই কথার বাজার খুলে বসেছে। একদিনেই সব কথা শেষ করে ফেললে বাকিজীবন কাটবে কী করে?
যেন তার মনের কথাটা অবিকল পড়ে নিলেন নাসিমা বানু। বললেন,
– কী এত কথা চালাচালি করতেছে, আল্লাহ মালুম! পাত্রী দেখতে আইসা কত কথা বলে মানুষ?
বসার ঘরের পাশেই আজগর আলী আর নাসিমা বানুর শোবার ঘর। আমিনা ও ঘরেই। বাবা-মায়ের ফিসফাস এতক্ষণ তার কানেও যাচ্ছিল। এবার সে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। চাপা সুরে বলল,
– ওদের যতক্ষণ কথা বলতে মন চায়, বলুক না! তোমাদের এত সমস্যা লাগছে কেন?
আনিসা এতক্ষণ মেয়েদের শোবার ঘরের পাশে দাঁড়ানো ছিল। ঘরের দরজা খোলা। ভেতরের কথাবার্তা মোটামুটি শোনা যাচ্ছে। তবু সে ওখানে দাঁড়ায়নি। ভেতর দিকে ঘরের একটা জানালা আছে। ওটার একটা পাল্লা লাগানো যায় না। সবসময় খোলাই থাকে। ওখানে কান পেতে মেজপা আর শফিক ভাইয়ের গল্প শুনছিল সে। এবার দৌড়ে এসে বাবা-মা আর বড় বোনকে বলল,
– ও আল্লাহ! মেজপার সাথে তো দুনিয়ার গল্প শুরু করছে ভাইয়া। মেজপাও একদম কথার বাজার মেইলা বসছে। কত কী যে বলতেছে দুইজন। শুনলে তোমরা অজ্ঞান হয়ে যাবা। এত কথা বলতে পারে রে! এই দুইজনকে কিন্তু ভালো মানাবে। দুইজনই পকপক করতে পারে সেইরকম।
নাসিমা বানু বললেন,
– তুই আবার ওই কথা শুনতে গেছিস? এতক্ষণ কি ওই ঘরে ছিলি নাকি?
– না, মা। আমি তো জানালার সামনে দাঁড়াইয়া শুনতেছিলাম। এই কথাবার্তা কিন্তু সহজে শেষ হবে বলে মনে হইতেছে না। খালি কথা বললেও চলত। এরা হাসাহাসিও করতেছে। মেজপা কী কী জানি বলে, আর শফিক ভাই হাসে। আবার শফিক ভাইয়ের কথা শুনে মেজপা হাসি চেপে রাখতে পারে না।
আমিনার মুখে হাসি ফুটল। সে বলল,
– যত কথা বলা লাগে, বলুক। সময় ধরে দেয়া লাগবে নাকি ওদের? আমিরার সারাজীবন এখানে ইনভলভড। ভালোমতো জেনেশুনেই বিয়ে করা উচিত। অন্তত আমার মতো ভুল জানি না করে। আমি তো একটু-একটু কথা বলে দুই বছরেও চিনতে পারি নাই। এখন মনে হইতেছে, আরও সময় নেয়ার দরকার ছিল। ওদের যতক্ষণ কথা বলতে মন চায়, বলুক। লাগলে সারারাত বসেই কথা বলুক। অন্যায় তো করতেছে না। আর রাত শুধু হইলো মাত্র। ঘড়িতে বাজে মাত্র সাতটা। আরও অনেকক্ষণ পড়ে আছে।
বলেই খানিক অন্যমনস্ক হলো সে। হয়তো নিজের জীবনের গল্পটা মনে পড়ল। রাজুর সাথে তারও অনেক কথা বলার ছিল। ওই সময়ে তার নিজের মোবাইল ফোন ছিল না। এর-ওর মোবাইল থেকে কল করতে হতো। অল্প একটু কথা বলেই রেখে দিত। দেখা করতে গেলেও ভয় থাকত, কখন কে দেখে ফেলে। নিজেরা কথা বলার চেয়ে, পরস্পরকে চোখ ভরে দেখার চেয়ে এদিক-ওদিক তাকানোতেই ব্যস্ত থাকত। মন খুলে কথা তো বলাই হয়নি কোনোদিন। বিয়ের পর সেই ফুসরত মিললেও জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে গেল। সেখানে অত কথা বলার সময়ই নেই। রাজু তখন বেকার। তার মাথার উপর চাকুরি খোঁজার চাপ প্রবল। সারাদিন বাইরে-বাইরে ঘুরত। এখানে-সেখানে ইন্টারভিউ দিত। পরিচিত যারা চাকুরির ব্যাপারে হেল্প করতে পারে, তাদের কাছে ধর্না দিত। আর রাতে বাসায় আসার পর প্রবল ক্লান্তি তাকে ছুঁয়ে থাকত। আমিনাও তখন কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে থাকত না। দিনভর বাসার ভেতর থাকলেও রাজ্যের কাজকর্ম তাকেই করতে হতো। সবটাই শ্বশুরবাড়ির মন রক্ষার তাগিদে। তাই দেখে বড় জা হাত গুটিয়ে থাকতে শুরু করল। সে নিজেও পারলে কাজের অর্ডার দেয় ওকে। আমিনার কষ্ট হতো। তবু চুপ থাকত। মুখ বুজে কাজ করে যেত অনবরত। তাছাড়া, নতুন বিয়ে। রাতের বেলায় নিজেদের জন্য সময় মিললেও কথা বলার চেয়ে শারীরিক সান্নিধ্যটাই তখন প্রকট হয়ে ধরা দিত। এভাবেই গড়াল সময়। মন খুলে কথাই বলা হলো না আর।
নাসিমা বানুর কথায় সংবিৎ ফিরল আচানক,
– হু, নিজের কপাল নিজেই পুড়াইছিস। রাজুর সাথে না গেলে তোর খালা ঠিক এরকম ছেলে খুঁজে নিয়ে আসত তোর জন্য। সেই ঘরে ভালোই থাকতি।
আজগর আলী বললেন,
– এইটা ভুল বললা, আমিনার না। কপালে দুঃখ লেখা থাকলে যেইখানে যাইব, সেইখানেই দুঃখ ওর পিছু নিত। দুঃখ এমন একটা জিনিস, কেউ কোনোদিন এড়াইতে পারে না। তাছাড়া রাজুর ঘরে তো আমিনা ভালোই ছিল…
কথা শেষ করলেন না তিনি। তবে বাকি কথাটুকু উপস্থিত সবাই বুঝে নিতে পারল। আমিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আসলেই তাই। রাজুর সংসারে তার হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করতে হলেও এক কথায় ভালোই ছিল সে। রাজু তার দিকে অত মনোযোগ না দিলেও কখনো সেভাবে চোখে পড়ার মতো অবহেলাও করেনি। শ্বশুরবাড়ির অন্যরাও মোটামুটি খুশি ছিল। শাশুড়ি শুরুর দিকে খুব কথা শোনাতেন। রাজুর মতো রাজপুত্রের জন্য কতশত বড়লোকের মেয়ে লাইন ধরে আছে। মেয়েরা বাবারা এত এত জিনিসপত্র নিয়ে মুখিয়ে আছে। রাজু সেসবে পানি না ঢাললে আজ তাদের অবস্থাও ঘুরে যেত। বড় জাও দুই-এক কথার ফাঁকে বলত, তার বাপের বাড়ি থেকে কী কী এসেছিল বিয়ের সময়। এই যা, এর বাইরে আর কোনো ঝামেলা ছিল না। বছর গড়াতেই শাশুড়ির মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তিনি হয়তো ভাগ্যকে মেনেই নিলেন। যাক, যৌতুক না মিললেও গায়ে-গতরে ভালো খাটতে পারে, এমন মেয়েকে রাজু বউ করে এনেছে। এও বা কম কীসে? বড় বউ তো ভালো ঘর দেখেই এনেছিলেন। সে হচ্ছে বারোমেসে রোগী। প্রতিদিনই তার একটা না একটা রোগ লেগেই থাকে। সব হচ্ছে কাজ না করার বাহানা। ওসব তিনি ভালোই বুঝেন। এসব কারণে আমিনাকে সরাসরি আদর-স্নেহ না দিলেও সংসারের কাজ থেকে মোটামুটি রেহাই দেবার চেষ্টা করতেন। বিপত্তি বাধল বাচ্চা না হওয়ায়।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমিনার মুখে কালো ছায়া নেমে এসেছে। নাসিমা বানু তড়িঘড়ি প্রসঙ্গ বদলালেন,
– ওরা যতক্ষণ মনে চায়, কথা বলুক। ওদের কথা বলায় আমার সমস্যা নাই। সমস্যা হইতেছে, শফিককে তো খাওয়ানো লাগবে। তোর বাপে রাতে খাওয়ার দাওয়াত দিয়া বসল। এদিকে যে ঘরে কিছু নাই, সেই তাল আছে?
এই কথায় আমিনার কপালে ভাঁজ পড়ল। সে খানিক চিন্তা করে বলল,
– তুমি কি বড় খালার সাথে এর মধ্যে একবার কথা বলছ? তার না আজকে আসার কথা।
– বড়াপা তো বলছে, আসতে রাত হবে। নয়টা-দশটা বাজতে পারে।
– একটু আগে আসতে পারবে না? বড় খালা তো আসার সময় কত খাবার-দাবার নিয়ে আসে। আটটা-সাড়ে আটটার দিকে আসলে কিন্তু হয়। খালা যেই খাবার আনল, তা দিয়েই শফিককে খাওয়ানো যাইত।
– তা যাইত। কিন্তু বড়াপার তো টাইমের ঠিক নাই। সে আটটায় আসার কথা বললে আসে দশটায়।
– তাও ঠিক। তুমি এক কাজ করো। খালাকে কল দিয়ে কথা বলো। জিজ্ঞাস করো, কখন আসবে। আর আমি দেখি কিছু কিনে-টিনে আনি।
– সেটাই ভালো হবে। এক কেজি পোলাওর চাল আনবি। একটা মুরগি আর বড় মাছ পাইলে আনিস। আর এক ডজন ডিম। সালাদের জন্য যা যা লাগে, শসা টমেটো…
– হইছে, আমাকে বলা লাগবে না। আমি বুঝেশুনেই আনব।
=============