তোমার জন্য এক পৃথিবী পর্ব-১৯+২০

0
216

তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
১৯।
আমিরার ঘুম ভাঙ্গল খুব সকালে। অবশ্য ঘুম না বলে তন্দ্রাও বলা যেতে পারে। কারণ রাতভর সজাগ ছিল সে। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দোনোমনা করেছে। এক তো বড়াপার ঘুম ভেঙ্গে যাবার ভয়, আরেকদিকে কয়েক ঘন্টার পরিচয়ে একটা ছেলেকে গভীর রাতে কল করা যায় কি না তা নিয়ে দ্বিধা। তাও যদি শফিক হতো! ছেলেটা তো শফিকও না। এসব ভাবতে ভাবতেই সুবহে সাদিক চলে এলো। আমিরার তখন চোখ বুজে আসতে চাইছে। কিন্তু বিছানায় গিয়ে শোবে, সেই ইচ্ছেটা নেই। মন এতই অস্থির হয়েছে যে, কোনো কুলকিনারা করতে না পেরে রীতিমতো কান্না পাচ্ছে, অজানা এক ছেলের জন্য। এই ছেলের সাথে ওর বিয়ে হবে না, ভাবতে গেলেই চোখ ভর্তি করে নোনাজল ভীড় করছে। আমিরার মনে হচ্ছে, সমস্ত দুনিয়া একদিকে রেখে এই ছেলের হাত ধরতে, তার সাথে আজীবন পথ চলতে তার এতটুকু ভয় করবে না।
হয়তো ঘন্টাখানেকের জন্য চোখ বুজে এসেছিল। ফজরের আযান কানে যেতেই ধড়মড়িয়ে উঠল সে। আশপাশে মসজিদ নেই। তবে মেইন রোডের উপর যে মসজিদটা আছে, সেখান থেকে খুব স্পষ্টভাবে আযান শোনা যায়। দিনের বেলায় হাজার শব্দের ভীড়ে আযান কানে অতটা না বাজলেও ফজরের এই সময়ে শব্দটা এত প্রবল হয়, যেন কানের কাছেই বাজছে। আমিরা সবদিন নামাজ পড়ে না ফজরের। ভোরবেলার ঘুম তার ভীষণ প্রিয়। একারণে ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হয়। কখনো মাথার কাছে অ্যালার্ম দিয়ে রাখলেও ঘুম ভাঙ্গে না। প্রায় প্রতিদিনই বলতে গেলে ফজরের নামাজ পড়া হয় না ওর। আলসেমিটাও বড় একটা কারণ। যদিও দিনের বেলায় বাকি চার ওয়াক্তের নামাজ সময়মতো পড়ে। দুপুরবেলা যোহরের নামাজের সাথে ফজরের কাজা নামাজটাও পড়ে ফেলে।
নাসিমা বানু এই নিয়ে প্রায়ই রাগারাগি করেন। ফজরের নামাজটা দুপুরবেলা কাজা পড়া যেন আমিরার রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছে। একদিন-দুইদিন কাজা পড়া যায়। তাই বলে প্রতিদিন কাজা পড়লে চলবে? এই নামাজ তো কবুলও হয় না আল্লাহর দরবারে। কিন্তু আমিরা ওসবে কান দেয় না। ধর্মকর্ম নিয়ে তার অত মাথাব্যাথা নেই। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে, মা-বোনরা দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ে। বাবা পঙ্গু। সেও বিছানায় বসে নামাজ আদায় করে। তাই তার রুটিনে নামাজ চলে এসেছে। এখন নামাজ কাজা পড়ল নাকি তাজা, ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু আজ ঘুম ভাঙ্গার পর পরই তার মন বলল, আল্লাহ ওকে পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। যে পাপ এতদিন সে অবলীলায় করে এসেছে, ফজরের নামাজ সবসময় কাজা পড়েছে। নামাজ ঠিক সময়ে না পড়ার শাস্তিটাই এখন ওর ঘাড়ের উপর ভর করতে যাচ্ছে। সারাজীবনের পথ চলার সঙ্গী হিসেবে যাকে সে চায়, তাকে না পাওয়ার চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? সজ্ঞানে এছাড়া আর কোনো পাপ সে করেছে বলে তো মনে পড়ে না। নিজের অজান্তে অনেক সময় অন্যায় কিছু করে ফেলতে পারে। কিন্তু সেজন্য আল্লাহ ওকে এতবড় শাস্তি দিবেন না। মানুষ না জেনে অন্যায় করলে আল্লাহ তাকে সুযোগ দেন ভুল বুঝার। নিজেকে শুধরে নেয়ার। কিন্তু এই পাপটা সে সজ্ঞানেই করেছে। মা বারবার নিষেধ করলেও শুনেনি। মায়ের বকা, বোনের ধমক কোনোটাই কানে তোলেনি। জেনেবুঝেও ফজরের নামাজ পড়তে ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেনি।
বিষয়টা ঝট করে আমিরার মাথায় গেড়ে বসল। সে ঝেড়ে দৌড় দিল ওয়াশরুমের দিকে। হাতমুখ ধুয়ে, ওজু করেই জায়নামাজে দাঁড়াল। শুধু ফরজ আর সুন্নতই না, দুই রাকআত নফল নামাজও পড়বে। তারপর হাত তুলবে মোনাজাতের জন্য। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে এবং প্রতিজ্ঞা করবে, এই পাপ আর কোনোদিনই করবে না সে।
আমিনা প্রতিদিন ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠে। নামাজ পড়েই নাশতার আয়োজন করতে লেগে পড়ে। আজগর আলীর জন্যই এত সকালে নাশতা তৈরি করতে হয়। সকাল ছয়টায় তাকে একটা মেডিসিন খেতে হয় নিয়ম করে। এই মেডিসিন খাওয়ার পরই নাশতা খেয়ে নিতে হয়। এরপর আবার আরও কিছু মেডিসিন খাওয়ার পালা। আসলে মেডিসিনগুলো ঘড়ির কাঁটা ধরে খাওয়ার নিয়ম। কোনোটা ছয় ঘন্টা পর পর, আবার কোনোটা আট-দশ ঘন্টা পর। দিনে দুই-তিনবার খেতে হবে। একারণে খুব সকালেই নাশতার পর্ব সারতে হয়। নাসিমা বানু মাঝেমধ্যে রাত জাগেন। আজগর আলীর প্রাকৃতিক ডাকের চাপ আসে। আবার কখনো পেটে গ্যাস হলে বুকে চাপ লাগে। একারণে তিনি একটু দেরিতে উঠেন। তারপর আজগর আলীকে হাতমুখ ধুইয়ে ফ্রেশ করাতে হয়। সুর্য উঠার আধঘন্টা-চল্লিশ মিনিট আগে চট করে নামাজটা পড়ে ফেলেন। তাই সকালবেলার নাশতা বানানোর দায়িত্ব বড় মেয়ের উপর ছেঁড়ে দিয়েছেন।
আজ আমিনা ঘুম থেকে উঠেই ভুত দেখার মতো চমকে গেল। ঘরে আলো জ্বালানো হয়নি। জানালা গলে দিনের আলো প্রবেশ করেছে ভেতরে। সেই আবছা আলোয় দেখল, কে যেন ঘরের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে ভুতের মতো। মশারির ভেতর থেকে অত ভালোমতো দেখা যাচ্ছে না। সে মশারি একটুখানি তুলে মাথা বের করল। পরক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আমিরা নামাজে দাঁড়িয়েছে। আরেকটু হলে তার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত ভয়ে! বিস্ময় তখনো সরেনি দুচোখ থেকে। আমিরা এই ভোরবেলায় নামাজ পড়ছে! কোনোদিন টেনেহিচড়ে এই মেয়েকে বিছানা থেকে নামানো যায় না এই সময়ে। দুই-একবার সে টানাটানি করেছে নামাজ পড়ার জন্য। এরপর হাল ছেঁড়ে দিয়েছে। আমিরাকে বিছানা থেকে তুলে দিলেও সে ঘুমুতে থাকে। ওয়াশরুমে গিয়ে ঘুমায়। নামাজে দাঁড়িয়ে ঘুমায়। জায়নামাজে বসে ঘুমায়। কখনো দেখা যায়, একবার সিজদা দিয়ে আর মাথাই তুলে না। ওভাবেই ঘুমিয়ে যায়। ওর পেছনে লেগে থাকতে গেলে নিজের নামাজ পড়াটা উচ্ছন্নে যায়। এজন্য আমিনা হাল ছেঁড়ে দিয়েছে। সেই মেয়ে কি না আজ একাই ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ছে!
বিস্ময়ের ধকল সামলে আমিনা ওয়াশরুমে গেল। হাতমুখ ধুয়ে, ওজু করে নামাজ পড়ল। আমিরার ততক্ষণে নামাজ পড়া শেষ। তবু জায়নামাজে ঠায় বসে আছে সে। চুপচাপ, নিথর ভঙ্গিতে। ঘুমুচ্ছে নাকি, কে জানে। আমিনা ওকে ডাকল না। মেহমান কেউ বাসায় এসে নামাজ পড়তে চাইলে তার জন্য আলাদা করে একটা জায়নামাজ তুলে রাখা আছে। বসার ঘর থেকে ওটা এনে বোনের পাশে দাঁড়াল সে। তার নামাজ শেষ হবার পরও আমিরার নড়চড় নেই। আমিনা ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল, চোখজোড়া খোলা। তাতে রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে আছে। চোখের নিচটা একটু বসে গেছে। আমিরার এই সমস্যাটা হয়। একরাত না ঘুমুলেই চোখের নিচের অংশটা কেমন বসে যায়। একবার খেয়াল করেই আমিনা বুঝে গেল, তার বোন সারারাত ঘুমায়নি। এটা অবশ্য আরও আগেই টের পেয়েছে। মোবাইল ফোনটা প্রতি রাতে শোবার সময় চার্জে দিয়ে ঘুমায়। ফোনটা বিছানার পাশের বেডসাইড টেবিলের উপর থাকে। আজ ঘুম ভাঙ্গার পর তা যথাস্থানে ছিল না। খানিকবাদে পড়ার টেবিলের উপর ফোন দেখেছে। অর্থাৎ আমিরা ফোন ধরেছিল। কেন? এত রাতে ফোন দিয়ে কী কাজ ওর? কাকে কল করেছিল সে?
উত্তরটা মাথার মধ্যেই ঘুরঘুর করছিল, বলা যায়। যদিও পুরোপুরি নিশ্চিত না। শফিকের নাম করে আসা ওই ছেলেটা কি নিজের মোবাইল নাম্বার দিয়ে গেছে আমিরাকে? তাকেই কি কল করেছিল আমিরা? কী কথা বলেছে? তখনই ফোনটা হাতে নিয়ে চেক করেছে আমিনা। ডায়াল লিস্টে কোনো নাম্বার নেই। মেসেজ বক্সেও কোনো মেসেজ নেই। আরেকটু নিশ্চিত হতে মোবাইলের ব্যালেন্স চেক করল। তাও একদম পয়সার অঙ্ক সহ ঠিকঠাক আছে। অর্থাৎ আমিরা কাউকে কল করেনি। তাহলে ফোন নিয়েছিল কেন? ফেসবুক, হোয়্যাটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো সবকিছু ঘাটাঘাটি করার পরও সেরকম কিছু পাওয়া গেল না। আমিরা মোবাইল ফোন ব্যবহারে অত এক্সপার্ট না। সোশ্যাল মিডিয়া তার কাছে মোটামুটি অপরিচিত। শুধু ফেসবুকের নাম শুনেছে সে। তাতে আইডি খুলতে হয়। ছবি তুলে আপলোড করতে হয়। নিজের মনমতো কত কিছু লেখা যায়। আবার পরিচিতর মধ্যে যাদের ফেসবুক আইডি আছে, তাদেরকে ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাড করলে ছবি-টবি দেখা যায়। মেসেঞ্জারে চ্যাট করা যায়। ভিডিও কল দেয়া যায়। এগুলোই সে জানে। কখনো নিজে ব্যবহার করেনি। একবার ফেসবুক আইডি খোলার আবদার করেছিল। আমিনা দেয়নি। বলেছে, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দে ভালোমতো। এরপর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলে নতুন একটা মোবাইল ফোন কিনে দেব। তখন ফেসবুক আইডি খুলতে পারবি। আমি দেখিয়ে দিব কীভাবে খুলতে হয়। আর এখন খুব বেশি জরুরি হলে আমার আইডিটা ব্যবহার করতে পারিস।
আমিরার ফেসবুকে জরুরি কিছু নেই। তার বান্ধবীরা তার মতোই নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত ঘরানার। তাদের ঘরে স্মার্টফোন আছে হয়তো। কিন্তু ফেসবুক জগতের খবর কানে যায়নি সেভাবে। তাদের নিজের মোবাইল ফোনও নেই। তবু আমিনা ভালোমতো চেক করে দেখেছে। কোথাও কিছু পায়নি।
নামাজ শেষ করে সেও খানিকক্ষণ বসে রইল। আজ নাশতা বানানোর তাড়া নেই। রাতে অনেক খাবার-দাবার এনেছিল বড় খালা। ওগুলো দিয়েই নাশতার পর্ব সেরে ফেলা যাবে। আমিরার সাথে কথা বলা দরকার। সারারাত ঘুমায়নি, মোবাইল হাতে নিয়ে বসেছিল। আবার এই ভোরবেলায় ফজরের নামাজ পড়েছে, এর মানেই বুঝতে হবে কোথাও কিছু একটা ঠিক নেই। হয়তো ওর ভেতর প্রবল ভাঙ্গচুর হচ্ছে। হয়তো ছেলেটাকে খুব পছন্দ হয়েছে। পছন্দ হবার মতোই একজন সে। আমিনারও তার প্রতি ভালো লাগা কাজ করেছে, এটা অস্বীকার করতে পারবে না। মন বলছিল, এই ছেলেটা তাদের পরিবারের একজন হয়ে যাক দ্রুত। ছেলেটার সাবলীল আচরণ, সহজ ধরনের কথাবার্তা খুব আকৃষ্ট করেছে। পাত্রপক্ষ তো কতই এসেছে। এই ছেলেটার মতো কাউকে মনে ধরেনি সেভাবে। বড় বোন হয়ে তার নিজেরই মুগ্ধতা কাজ করছিল প্রবল। আর আমিরা মনে কীরকম জায়গা করে নিয়েছে, তা আর বলতে!
সমস্যা এই ছেলেটাকে নিয়ে না, বড় খালাকে নিয়ে। খালা শফিকের সাথে আমিরার বিয়ে এক প্রকার পাকাপাকি করেই ফেলেছেন। গতকাল কেবল দেখাদেখিটাই বাকি ছিল। ইতোমধ্যে শফিকের সম্মতি নেয়া হয়ে গেছে। আমিরাকে সামনাসামনি না দেখেই সে পছন্দ করে ফেলেছে। বড় খালুকে অকপটে বলেছে, তার মাথার উপর কোনো অভিভাবক নেই। খালুকে সে নিজের অভিভাবক মনে করে। তাই খালু যা ভালো মনে করবেন, তাই হবে। এই কথার পর বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হওয়াটা বাকি থাকে শুধু। তবু খালা আর খালু জোর দিচ্ছিলেন পাত্র-পাত্রী নিজেদের সামনাসামনি দেখুক। হাজার কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেলেও সারাজীবনের ব্যাপার। তা করতে গিয়ে এই অনর্থ হবে, কে জানত।
আর ওই ছেলেটাইবা কী ভেবে এসেছিল ওদের বাসায়? তারও কি পাত্রী দেখার কথা ছিল? ভুল ঠিকানা চলে আসলেও কি কোনো অসঙ্গতি ধরা পড়েনি? নাকি ছেলেটা ইচ্ছে করেই ভান করেছে শফিক সেজে। বিষয়টা কেমন ঘোলাটে মনে হচ্ছে। আমিনার মাথায় কেবলই জট পাকিয়ে যাচ্ছে। চকিতে বড় খালার কথা মনে পড়ল। খালা এক প্রকার নিশ্চিত সুরেই বলেছিলেন, এই ছেলের আমিরার পুর্ব-পরিচিত। আমিরাই তাকে পাত্র সাজিয়ে বাসার ভেতর ঢুকিয়েছে।
আমিনা জানে, এই কথাটা ভুল। আমিরার সাথে ওরকম কারও পরিচয় নেই। কখনো কলেজের পর এক সেকেন্ডও দেরি হয় না তার, বাসায় ফিরতে। ব্যাচে পড়তে গেলেও ঘড়ি ধরে ঠিক সময়ে যায়, ঠিক সময়ে ফিরে। কখনো বান্ধবীদের বাসায় গেলে আনিসাকে সাথে নেয়। বেশিরভাগ সময় বান্ধবীরাই আসে। কারণ নাসিমা বানু সবসময় ওকে বাইরে যাবার অনুমতি দেন না। তাছাড়া বাসার কাজকর্মও করতে হয়। বান্ধবীদের সাথে ক্লাসের বাইরে গল্পসল্প করার ফুসরত তার থাকে না। সবথেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমিরা কখনোই বোনদের কাছে কিছু লুকায় না। বিশেষ করে আমিনার কাছে। যে কথা মাকে বলতে পারে না, যেটা বাবা-মাকে বললে কঠিন ধমক খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেই কথাও সে অবলীলায় বড় বোনকে বলতে পারে। আমিনা মাঝেমধ্যে শাসন করে। ধমক দেয়। কিন্তু তাতে আদর মেশানো থাকে। আমিরা তা বুঝতে পারে।
আমিরার যদি সত্যিই পরিচিত হতো গতকালকের ছেলেটা, সে অবশ্যই বোনকে বলত। পুরোটুকু না বললেও কিছুটা বলত। তাছাড়া এই ছেলের সাথে তার পরিচয় হবারও কোনো সম্ভাবনা নেই। এই ছেলের বাসা, চাকরি সবটাই ঢাকার অন্য প্রান্তে। গতকালই বলছিল, এই এলাকায় সে প্রথমবার এসেছে। এখানে আসতে তার পাক্কা তিন ঘন্টা লেগেছে।
সবটা জেনেবুঝেও আমিনা খালার যুক্তির বিরোধিতা করতে পারেনি। বরং তারও মনে হয়েছে, এই ছেলের সাথে আমিরার কোনো যোগসাজশ আছে। এজন্যই ওর সাথে কথা বলতে হবে।
আমিনা আলতো করে ধাক্কা দিল বোনকে,
– কী রে? ভুতের মতো বসে আছিস কেন? ঘুমাইতেছিস নাকি?
আমিরা আবছাভাবে মাথা নাড়ল। একই সঙ্গে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খানিক নড়ে উঠল। হয়তো এখনই জায়নামাজ গুটিয়ে ফেলবে। আমিনার খারাপ লাগছে খুব। বোনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
– মন খারাপ?
– নাহ।
– তাহলে? কী হইছে?
– কিছু হয় নাই!
– আমাকে বলবি না?
– এমনিই, বড়াপা। কিছু হয় নাই। মনও খারাপ না।
– তুই মিথ্যা কথা বললে আমি কিন্তু বুঝতে পারি। তোর মন আসলেই খারাপ। নাইলে সারারাত জেগে থাকতি না।
– ঘুম আসতেছিল না। এইজন্য সজাগ ছিলাম।
আমিনা একটু চুপ থেকে আবার বলল,
– তুই কি ওই ছেলেকে কল দিছিলি রাতে?
ঝট করে বোনের দিকে ঘুরে তাকাল আমিরা। দুই বোনের চোখাচোখি হলো। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে ফেলল আমিরা। বলল,
– না। আমি কেন কল দিব?
– তোকে কি নাম্বার দিয়ে গেছে উনি? কল করতে বলছিল বা এরকম কিছু?
– উহু, উনি তো জানে উনার নাম্বার অলরেডি আমার কাছে আছে। বায়োডাটার মধ্যে দিছিল। আমিও তাই জানতাম। এইজন্য নাম্বার চাই নাই। পরে তো বুঝলাম…
আমিরা কথা শেষ করল না। এই মিথ্যে কথা সে কেন বলল, তাও জানে না। মুখ ফস্কে বের হয়ে গেছে কথাটা। আমিনা বলল,
– বিয়েশাদি হইতেছে কপালের খেলা। আল্লাহ যেইখানে জোড়া লিখে রাখছে, ওইখানেই বিয়ে হবে তোর। তাই কে আসল, কে কী বলল, ওইসব নিয়ে ভাবিস না। গতকালকের ঘটনাটা মনে কর একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। হয় না কত এরকম? ভুল ঠিকানায় চলে আসে।
– হু। উনিও এই কথাটা বলছে। আল্লাহ যেখানে জোড়া লিখছেন, ওইখানেই বিয়ে হবে।
– তাইলে বেহুদা মন খারাপ করতেছিস কেন? উনার সাথে তো আল্লাহ জোড়া লিখে নাই। লিখছে শফিকের সাথে।
– আমার মন খারাপ না, আপা।
– তুই বললেই হইল? আমি ক্লিয়ার বুঝতেছি তোর মন ভাঙ্গছে।
আমিরা কিছু বলল না। আমিনা আবার বলল,
– দেখ, মন খুব ভঙ্গুর জিনিস। একবার ভাঙ্গলে সহজে জোড়া লাগে না। তাই চট করে কাউকে মন দিয়ে ফেলা উচিত না। আমরা এই বিষয়টা আগে বুঝি না। যারে-তারে মন দিয়ে দেই। এরপর ভাইঙ্গা গেলে কান্নাকাটি করি। মন খারাপ করি। মনে হয়, জীবনটাই বুঝি শেষ হয়ে গেল! আমাকেই দেখ! কোনোদিন কি ভাবছিলাম, আজকে এই পর্যায়ে আসতে হবে? তোর বয়সে আমার দুই চোখ ভরা কত স্বপ্ন ছিল। রঙিন-রঙিন স্বপ্ন দেখতাম। তার বদলে কী পাইলাম জীবনে? ভাঙ্গা মন ছাড়া আর কী আছে আমার?
– হু।
– তুই মন শক্ত কর, ময়না। ভালোলাগা অল্প কিছুক্ষণের। একসময় কেটে যাবে।
– আর ভালোবাসা?
– আরে পাগল, ভালোবাসা সস্তা জিনিস না। দুই মিনিটের পরিচয়ে ভালোবাসা হয় না কারও। ভালো লাগা হয়। সেই ভালো লাগা ডালপালা মেলে। আস্তে আস্তে ভালোবাসায় রূপ নেয়। আমরা ভুল করি। ভালো লাগারেই ভালোবাসা মনে করে ফেলি!
– ওহ।
– কয়টা দিন মন পুড়বে। এরপর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
– হু।
– ওই ছেলেও দেখ গে বাসায় গিয়ে বুঝতে পারছে, ভুল জায়গায় গেছিল। ভালো সেও তোরে বাসে না। তার ভালো লাগছে অন্য কাউকে। অন্য কোনো মেয়ে। গতকালের পর সেও তোরে মনে রাখবে না কোনোদিন।
আমিরা চুপ করে রইল। কথা বলতে ভালো লাগছে না তার। মাথায় চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে। চোখে প্রবল ঘুম আর রাতজাগা ক্লান্তি। তার প্রভাবে শরীরও অবশ হয়ে আছে প্রায়। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই কথা। নাম জানতে হবে। বিয়েটা হোক বা না হোক, ওই ছেলের নাম না জানা পর্যন্ত মনে শান্তি আসবে না। ক্ষণিকের ভালোলাগা বা ভালোবাসা যাই হোক, তার নাম জানাটা জরুরি। খুব বেশি জরুরি।

তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
২০।
নাশতা খেয়েই আমিরা বের হলো বাসা থেকে। গন্তব্য, কলেজ। অন্তত বাসায় ওটাই বলে এসেছে। আসলে সে কোথায় যাবে, নিজেও জানে না। কলেজে যেতে পারে। আবার নাও পারে। অস্থির মন নিয়ে কলেজে গেলে লাভ হবে না। ক্লাসে মন বসবে না। ম্যাডামের বকা খেতে হবে। তাতে মেজাজ খারাপ হবে বেশি। মন খারাপ হয়ে কান্নাও চলে আসতে পারে। বান্ধবীদের সাথে আড্ডায় মন দিতে পারবে না। অন্যমনস্ক থাকবে। বান্ধবীরা এই নিয়ে খোঁচাখুচি করবে। তার চেয়ে আজ কলেজে না যাওয়াই ভালো। আমিনা অবশ্য কয়েকবার মানা করেছিল। আজ কলেজে না গিয়ে বাসায়ই পড়াশুনা করতে বলল। রাতজাগা ক্লান্তি নিয়ে কলেজে গেলে খারাপ লাগবে অনেক। শরীর ম্যাজম্যাজ করবে। ঘুমেরও দরকার আছে। কিন্তু আমিরা ওই কথা কানে তোলেনি। বাসায় থাকলে খারাপ লাগা আরও বাড়বে। অস্থির মন আরও বেশি অস্থির হবে। মা বারবার রান্নাঘরে ডাকাডাকি করবে। এই কাজ, সেই কাজের ছুতো ধরিয়ে দেবে। কাজ না করলে বকাবকি করবে। গতকালকের প্রসঙ্গও চলে আসতে পারে। তার রাগ এখনো কমেনি। আজ সকালেও বাবার সাথে চিল্লাচিল্লি করেছে। নাশতার টেবিলে এই নিয়ে কী যেন বলতে গেছিল। শফিককে আজ আসতে বলবে। শনিবারও তার অফিস ছুটি থাকে। বড় খালাকে ইতোমধ্যে কল করে এই কথা বলাও শেষ। খালা বলেছেন, তিনি খালুর সাথে কথাবার্তা বলে এরপর কনফার্ম করবেন। তারও ইচ্ছে, শফিক আজ আসুক। তিনিও আসবেন। নিজেই শফিকের সাথে সমস্ত কথাবার্তা ক্লিয়ার করবেন। বোন-বোন জামাইয়ের উপর আর ভরসা করতে পারছেন না। আমিনা কী বুঝে এই বিষয়ে কথা বাড়াল না। ব্যস্ততার অজুহাতে মুখ বন্ধ করে রাখল।
আমিরার আজ বাসা থেকে বের হবার মূল কারণ, ওই ছেলের নাম্বারে কল করা। নামটা জিজ্ঞেস করতে হবে। সে মনস্থির করেছে, দোকান থেকে কল করবে। বড়াপার মোবাইল থেকে কল করার সাহস হয়নি। কল করলে বড়াপা ঠিক টের পেয়ে যেত। আর ছেলেটার নাম্বারও জেনে ফেলত। অবুঝ মন কী কারণে যেন নাম্বারটা লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। মন বলছে, আপার হাতে এই নাম্বার পৌঁছুনো মানেই মা বা বড় খালার হাতে চলে যাওয়া। এরপর তারা দুই বোন ওই নাম্বারে কল করে আজেবাজে কথা বলবে না, তার নিশ্চয়তা কী? বাসা থেকে বের হবার আগে আমিনার গোপন সঞ্চয় থেকে কিছু টাকা সরিয়েছে। খুব বেশি না, পাঁচশত টাকার একটা নোট মাত্র। খুচরা কিছু ছিল অল্প। ওগুলোয় হাত দেয়নি। বড়াপা প্রায়ই ওখান থেকে খরচ করে। ওগুলো হিসেবের টাকা। বড় অঙ্কের নোটগুলোও হিসেব করে রাখা আছে। কিন্তু ওখান থেকে একটা নোট সরালে চটজলদি ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। আপা ওই বান্ডিলে হাত দেয় না খুব একটা।
আমিরার বুক ধুকপুক করছে। আজ সত্যিকার অর্থে নিষিদ্ধ অভিযানে নেমেছে সে। আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে। সে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছে। অর্থাৎ আর কখনো ফিরবে না। আজ সারাদিনের ভেতর কোথাও থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। না পারলে বাসায় ফিরে যাওয়ার পথ যেন খোলা থাকে, সেটা ভেবে কোনো চিরকুট লিখেনি। তাছাড়া কাগজে লেখা মেসেজের চল এখন নেই। দিনের শেষে কোনো দোকান থেকে বড়াপার নাম্বারে কল করে পালিয়ে আসার কথা বললেই কেল্লাফতে। কেন এই পালিয়ে যাওয়া, সে জানে না। শুধু জানে, তার মন এই মুহূর্তে খুব করে পালাতে চাইছে। এই ইচ্ছে কতক্ষণ বহাল থাকবে, তাও কথা। আসলে গলার মধ্যে দলা পাঁকিয়ে আছে কান্নারা। এদেরকে অতিসত্ত্বর মুক্তি দেয়া জরুরি। এজন্য নির্জন কোনো জায়গা দরকার। যেখানে চিৎকার করে কাঁদতে পারবে কিছুক্ষণ। বড়াপা বলে, মন খুব বেশি ভার হয়ে গেলে চিৎকার করে নাকি কাঁদতে হয়। কান্নার সাথে বুকের মধ্যে গুমরে মরা কষ্টগুলো সহজেই মুক্তি পায় তাহলে। মনও হালকা হয়ে যায়। আমিরা মন হালকা করতে চায় কি না, কে জানে। শুধু জানে, কাঁদতে হবে চিৎকার করে। তারপর যদি মন ভালো হয়, দিন শেষে বাসায়ই ফিরে গেল!
এলাকার দোকানে মোবাইল ফোন আছে। প্রতি মিনিট দুই টাকা নিবে। অনেকক্ষণ কথা বলা যাবে। পাঁচশ টাকায় আড়াইশ মিনিট! আমিরা অবশ্য জানে না, ওই ছেলে কতক্ষণ তার সাথে ফোনালাপ চালাবে। হতে পারে, পরিচয় পেয়েই তার কন্ঠ বদলে যাবে। গম্ভীর সুরে বলবে,
– স্যরি আমিরা, গতকাল আসলে ভুল হয়েছিল আমার। আমি না জেনেই তোমাদের বাসায় ঢুকে পড়েছিলাম। আসলে আমার অন্য কারও সাথে দেখা করতে যাবার কথা ছিল। তোমাদের এলাকাতেই! এজন্যই ভুল হয়ে গেছে। ওরাও তিন বোন। একারণে আমি বুঝতেই পারিনি… প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না। ধরে নাও, ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল! আমার দিক থেকে তোমার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। আমি জাস্ট ভুল মানুষকে আমার ফিলিংস এক্সপ্রেস করেছিলাম।
আচ্ছা, তুমি করেই কি বলবে? নাকি আপনিতে চলে যাবে শুরুতেই? আমিরার চট করে মনে হলো, এলাকার দোকান থেকে কল করলে অসুবিধা আছে। পরিচিত কেউ দেখে ফেলতে পারে। আবার দোকানদার লোকটা কোনো একদিন বড়াপাকেও বলে দিতে পারে। বড়াপা তো এই দোকান থেকেই ফ্লেক্সিলোড করে। আমিরা একটা রিকশায় উঠে পড়ল। আপাতত কলেজের দিকে যাবে। ওদিকে বেশ অনেকগুলো দোকান আছে। তার মধ্যে মোবাইল ফোনের দোকানও আছে। তাছাড়া পরনে কলেজের ইউনিফর্ম। এটা পরেই দোকানে বসে কথা বলতে থাকলে লোকজন বিষয়টা ভালোভাবে নাও নিতে পারে। কলেজের ওখানে এই সমস্যাটা হবে না। অনেক ছাত্রীরাই ইউনিফর্ম পরে ওদিকটায় ঘুরঘুর করে। ক্লাস বাংক করে। কেউ কিছু বলে না।
কলেজে যেতে অনেকটা সময় লাগল। রিকশা নড়েই না বলতে গেলে। রাস্তায় এত মানুষ আর যানবাহন। ডানে-বায়ে কোনোদিকেই যাবার উপায় নেই। আমিরার জন্য অবশ্য ভালোই হলো। ক্লাস শুরুর সময় পার হয়ে গেল রাস্তায়। এখন আর চাইলেও কলেজে ঢুকা যাবে না। প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কড়া নির্দেশ, নয়টা বাজতেই দরজা বন্ধ করে দিতে হবে। এরপর ঘন্টাখানেকের মধ্যে যে বা যারা আসবে, তাদের সরাসরি গেট থেকে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুমে যেতে হবে। দেরি কেন হলো, তার যৌক্তিক কারণ দর্শিয়ে তবেই ক্লাসে যাবার অনুমতি পাওয়া যাবে। দশটার পর কাউকে কলেজে ঢুকতে দেয়া নিষেধ। আমিরার অত দেরি হবে না। দশটার আগেই পৌঁছে যেতে পারবে মনে হচ্ছে। মনের মধ্যে এক ধরনের তাড়া কাজ করছে। একই সঙ্গে খানিক দোনোমনা। কলেজ কি সত্যিই বাংক করবে আজ? নাকি টিফিন ব্রেকে কলেজ থেকে বের হয়ে পাশের দোকান থেকে কল করবে ছেলেটাকে? কল করেই বা কী বলবে?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কলেজ গেটে পৌঁছে গেল রিকশা। আমিরা ঘড়ি দেখল, নয়টা চল্লিশ বাজে। গেটের নিচ দিয়ে দারোয়ান চাচার পা দেখা যাচ্ছে। টুলের উপর বসে আছেন তিনি। দশটা পর্যন্ত থাকবেন। তারপর ভেতর থেকে তালা মেরে অন্য কাজে যাবেন। ভাড়া মিটিয়ে দেবার পরও অনেকটা সময় আমিরা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই। দশটা পার হতে খুব বেশি সময় নিল না। আজ যেন ঘড়ির কাঁটারা দৌড়াচ্ছে। আমিরা খুব ঘামছে। প্রথমত, ক্লাস বাংক করা হলো জীবনে প্রথমবার। দ্বিতীয়ত, ওই ছেলেটাকে কল করার কথা ভাবতেই পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছে। ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে। অবশ্য এর মধ্যে তো একবার পালিয়েছেই! বাসায় আজ ফিরবে কি না, তা নিয়ে মনের মধ্যে এখনো তুফান চলছে। আরও একবার ছুটে পালিয়ে কোথায় যাবে, তাও একটা কথা। আজকের এই ঘর পালানো তো যার জন্য, তার কাছ থেকে ছুটে পালিয়ে লাভটাই বা কী?
আমিরা মন শক্ত করল। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গেল ফোনের দোকানের দিকে। লোকজন নেই তেমন। একটা লোক পান কিনতে এসেছে। দোকানদার তাকে পান বানিয়ে দিচ্ছে। মশলা দিয়ে শাহি পান। আমিরা বলল,
– একটা কল করব।
লোকটা কিছু না বলে মোবাইল ফোনটা এগিয়ে দিল ওর দিকে। এই ফোনের সাথে দড়ি বাঁধা একটু বড় করে। আমিরা ওটা নিয়ে দোকানের বাম দিকে চলে গেল। দুরু দুরু বুকে নাম্বার ডায়াল করল। নাম্বারটা সে মুখস্ত করে ফেলেছে। তবু হিসাববিজ্ঞান বইয়ে লেখা আছে। সহজ করে না, বিশেষ সাংকেতিক কায়দায়। কেউ ধরতেই পারবে না, নাম্বারগুলো একসাথে করলে কারও মোবাইল নাম্বার হয়। কল বাটনে চাপ দেয়ার দুই সেকেন্ডের মাথায় রিঙটোন বাজতে লাগল,
তোমার জন্য এক পৃথিবী, জেনেছি প্রথম দেখায়
তোমার জন্য এক পৃথিবী, এঁকেছি স্বপ্ন-রেখায়
থাকলে তুমি রাজি, ধরতে পারি বাজি
হোক না এ পথ বহুদূর…
পরক্ষণে সেই কন্ঠ বাজল,
– হ্যালো!
আমিরার বুক ধড়ফড় করে উঠল। গানটা শুনতে গিয়ে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল সে। অবাক হচ্ছিল ভেবে, এই কথাগুলো আসলে তার নিজেরই। ফোন নাম্বারের মালিকের উদ্দেশ্যে বলা। সে জানল কী করে?
– হ্যালো! কে বলছেন?
আমিরার মিনমিন করে উত্তর দিল,
– আমি। আমি বলছি।
– আমি কে?
– আমার নাম আমিরা।
পরক্ষণে ফোনের ওপাশে উচ্ছ্বসিত কন্ঠ,
– তুমি!!!! আমিরা, তুমি কল করছ! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কীভাবে পসিবল? মানে…
– আমার বোধহয় কল করার কথা ছিল না। আমি…
– না না কী বলছ! কল করবে বলেই তো নাম্বার দিয়েছি।
– হ্যাঁ কিন্তু…
ওপাশের উচ্ছ্বাস আমিরা খুব সহজেই অনুভব করতে পারছে। ছেলেটা ওর ক্ষীণ কন্ঠ শুনলই না। বলল,
– কিন্তু আমি ভাবিনি তুমি কল করবা। তুমি তো বলছিলা তোমার ফোন নাই! এই নাম্বারটা কার?
– আমার কলেজের পাশে একটা দোকান।
– ওহ গ্রেট। তুমি কাল যেভাবে বলতেছিলা ফোন নাই, দোকান থেকে কল করার কথাটা আমার মাথায়ও আসেনি। বাই দ্য ওয়ে, তোমার না এখন ক্লাস! তুমি বলছিলা তোমার কলেজ খুব কড়া। নয়টার মধ্যে গেটের ভেতর ঢুকতে হয়। যখন-তখন বের হওয়া যায় না। তাহলে তুমি বাইরে আসলে কীভাবে?
– আমি আজ কলেজে ঢুকিনি। বাংক করেছি।
– তাই? কেন?
– আপনার সাথে কথা বলব তাই।
– আর এটা তোমার লাইফে ফার্স্ট টাইম!
– আপনি কী করে জানলেন?
– কাল তোমার সাথে কথা বলেই বুঝতে পারছি তুমি হচ্ছ লক্ষী টাইপ মেয়ে! ডানে-বায়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে একদম সোজা হেঁটে যাও।
– ওহ।
– আমিরা, তুমি রাখো। আমি কল দিচ্ছি। এই দোকানে ইনকামিং কল রিসিভ করতে দেয় তো?
– আমি ঠিক জানি না।
– জিজ্ঞেস করে দেখো।
– ইয়ে, না থাক। কলটা চলতে থাকুক।
– কী হয়েছে তোমার?
– কই? কী হবে?
– তোমার ভয়েসটা কেমন যেন লাগছে। কথাও বলছ খুব আস্তে। মনে হচ্ছে মন খারাপ খুব।
– না আসলে আমি আগে কখনো দোকান থেকে কাউকে কল করিনি তো!
– আশপাশে লোকজন আছে?
কেউ নেই, তবু আমিরা মিথ্যে করে বলল,
– হু।
– বুঝতে পারছি। আচ্ছা, আমি কাল-পরশু কোনো একসময় স্পেয়ার ফোনটা তোমাকে দিয়ে আসব। উমম, কাল কি সকালের দিকে তুমি থাকবে বাসায়? আমি তাহলে অফিসে যাবার আগে…
আমিরা আতঙ্কিত সুরে বলল,
– না প্লিজ, বাসায় আসবেন না। একদম না!
– কেন? বাসায় গেলে কী সমস্যা?
আমিরা চুপ করে রইল। ওপাশ থেকে ছেলেটা ডাকছে,
– আমিরা! শুনতে পাচ্ছ?
– হু।
– কী হয়েছে, বলো তো? তুমি কি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছ? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে…
– আমি চাই না, আপনি আর কখনো বাসায় আসেন।
– কিন্তু কেন? গতকালই তো তোমাদের বাসায় গেলাম। এরপর কি কিছু হয়েছে?
আমিরা আবার চুপ করে আছে। ছেলেটাও ওকে ঘাটাল না। বলল,
– তুমি তো আজ ক্লাস বাংক করেছ, তাই না?
– হু।
– বাসায় ফিরবে কখন?
– জানি না।
– মানে স্পেসিফিক কোনো টাইম নেই? যে কোনো সময় ফিরলেই হবে?
আমিরা উত্তর দিল না। সে মনেপ্রাণে নাম জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছে না। শব্দগুলো গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে।
– আমিরা! হ্যালো, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না?
– হ্যাঁ পাচ্ছি।
– তাহলে কথা বলছ না কেন?
– আপনার নাম কী?
– হোয়্যাট?
– আপনার নাম জানতে চাচ্ছি! প্লিজ নামটা বলেন। এরপর আমি ফোন রেখে দিব।
– তুমি আমার নাম জানো না?
আমিরা একটু ভেবে বলল,
– জানি। তবু শুনতে চাচ্ছি। নাম কী আপনার?
– তুমি প্লিজ আমাকে খুলে বলো, কী হয়েছে।
– আগে নাম বলেন। তারপর অন্য কথা।
– রিফায়াত।
– হু। ঠিক আছে।
– কী হয়েছে? এনি প্রবলেম?
– উহু। কিছু না।
– কিছু তো অবশ্যই হয়েছে। আমার কাছে লুকাবা না একদম। তোমার ভয়েস শুনেই বুঝা যাচ্ছে, সামথিং ইজ রঙ।
আমিরা মনে মনে বলল,
– সামথিং না, এভরিথিং ইজ রঙ। আমার পুরো লাইফ উল্টেপাল্টে গেছে এক রাতের ব্যবধানে। সবকিছু ভুল। সব।
– তুমি এক কাজ করো। কলেজের ওখানে আছ, তাই না? আশপাশে কোনো জায়গা আছে বসার? কোনো শপ বা এমন কিছু?
– হ্যাঁ, একটা বার্গার শপ আছে। উইকিংস নাম। ভেতরে বসার জায়গাও আছে।
– তুমি ওখানে থাক। আমি আসতেছি। আমার জাস্ট এক ঘন্টা লাগবে। ঠিক আছে?
– আপনি আসবেন? কেন?
– দরকার আছে। তোমার সাথে সামনাসামনি বসে কথা বলতে হবে। আর্জেন্ট।
আমিরা মনে মনে বলল,
– আমারও আপনার সাথে কথা আছে। খুব জরুরি! আমার জীবন মরণ সমস্যা হয়ে গেছে!
– আমি আসছি।
– আপনার অফিস নেই আজ?
– আমি ম্যানেজ করব। তুমি ওই বার্গার শপে থাক। কোথাও যাবা না। আমি এখনই আসতেছি।
======================================