তোমার নামে হৃদয় পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯+৫০

0
358

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৪৭)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
অনেকদিন পর শিকদার বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছেন তালিব আবসার। সঙ্গে তার স্ত্রী এবং ছেলে তকি এসেছে। তাদের সামনে মুখোমুখি হয়ে বসে আছেন আশফাক শিকদার। অনেকদিন পর এভাবে হুট করে বন্ধুর দেখা পেয়ে যাবেন ভাবতে পারেন নি। যদিও অর্ধেকটা বুঝে গিয়েছেন তাদের আসার উদ্দেশ্য। আসার পর থেকে তালিব আবসারের চোখ জোড়া আশেপাশের পরিবেশের দিকে যাচ্ছে। আশফাক শিকদার নিজে থেকে বকবক করে যাচ্ছেন। অথচ তার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একপর্যায়ে আশফাক শিকদার জিজ্ঞেস করলেন, ” কিরে মেয়েকে খুঁজছিস নাকি? ”

” হ্যাঁ! অনেকদিন মেয়েটাকে দেখি না। তাই ভাবলাম একবার এসে তোদের সাথেও দেখা করে যাই। তা ভাবী কোথায়? উনাকে কোথাও দেখছি না যে! ”

” এতোক্ষণ এখানেই ছিল। সবে উঠে গিয়েছে। দাঁড়া আমি ডেকে আনছি! ” আশফাক শিকদার সামিরাকে ডাকতে ভেতরের রুমে চলে গেলেন।

আশফাক শিকদার চক্ষু আড়াল হতে নীলিমা মুখ ভার করে স্বামীকে বললেন, ” আমার মনে হয় না তামান্না আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে। ”

” আসবে না কেন? নিশ্চয়ই আসবে। তুমি দেখ যখন শুনবে ঠিক ছুটে চলে আসবে। ”

” মিথ্যে আশ্বাস নিয়ে এভাবে কতক্ষণ থাকা যায় বল তো? শেষে আমাদের জন্য তোমার বন্ধু আর বন্ধুর বউ না মেয়েটাকে ভুল বুঝে! ”

তকি চুপচাপ বাবা মায়ের প্রলাপ শুনছিল। এ বছর নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। এতোটাও অবুঝ নয় যে তাদের কথাবার্তার মানে বুঝবে না। সেদিন যখন তামান্নার মা এসেছিল সে সবটা শুনে নিয়েছে। শুধু শোনাতে নয় বরং নিজের দু-চোখের সাহায্যে মিলিয়ে নিয়েছে সবটা। কেবল মানতে পারছে না তামান্না তার সৎ বোন। কখনো মানবেও না। বোনের রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা আছে তকির। নিজের মায়ের কথা শুনে সেও মায়ের সাথে কিছুটা একমত। সে যাই হোক! তাকে অন্তত বোনের সাথে দেখা করতে হবে। কতদিন বোনটাকে দেখে না!

তকি বাবা মাকে বলল, ” আমি যাই আপুর সাথে দেখা করে আসি। দেখি আপু কি বলে! ”

নীলিমা ভেতরে যেতে বারণ করতে চাইলে তালিব আবসার বারণ করতে চাইলেন না। ছেলেকে ভেতরে যেতে সম্মতি প্রদান করলেন।
.

.
তালিব আবসারের আগমনে সামিরা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। স্বামীর সামনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন, ” এখন আবার কি চাই তোমার বন্ধুর? আমার ছেলেটাকে তো তারা সবাই মিলে হাত করে ফেলেছে। ”

সামিরার কথা খানি আশফাক শিকদারের কানে গিয়ে ঠেকতে স্ত্রী-য়ের দিকে কড়া চোখে তাকালেন, ” কি সব যা তা বলছো? ”

” যা সত্যি তাই বলছি। ওদের আমার একদম পছন্দ না। এতো কিছুর পরেও কেন যে মেয়েটা এখানে বেহায়ার মতো পড়ে আছে কে জানে? ”

” বেহায়ার মতো পড়ে আছে মানে কি? এ বাসায় তোমার যে টুকু অধিকার, ওরও ঠিক ততটুকুই। ভুলে যেও না ও সাদিবের বউ, তোমার একমাত্র পুত্রবধু। ”

” হুহ পুত্রবধু! ওকে আমি মানলে তো! ”

” শোন সামিরা, বাসার গেস্ট আছে। তাদের সামনে এ মুহুর্তে কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট আমি চাইছি না। মেহমানকে কিভাবে আপ্যায়ন করতে হয় জানো তো! নাকি সেটাও শিখিয়ে দিতে হবে? ”

আশফাক শিকদারের এহেন ব্যবহার সামিরা প্রত্যাশা করেননি। ভেবেছিলেন সাদিবের পরিবর্তন তিনিও তার মতো ভালো চোখে দেখবেন না। কিন্তু হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। সে ছাড়া বাকি সবাই তামান্নার পক্ষ নিচ্ছে।

” কিভাবে কথা বলছো তুমি আমার সাথে? ছেলের পরিবর্তন তোমার কি একটুও খারাপ লাগছে না? আমার ছেলে আমার থেকে ঐ মেয়েটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সারাদিন ওকে নিয়ে পড়ে থাকছে, এসব দেখতে কার ভালো লাগবে বল? ”

” তো এতে ক্ষতিটা কোথায়? তোমার পেটে যখন সাদিব এসেছিল তখন এর চেয়ে বেশি করেছি আমি। ভুলে গেছ সব? ”

” না ভুলি নি। কিছু ভুলি নি আমি। তাই বলে তোমার মাকে তো কখনো তোমার দ্বারা অবহেলা করতে দেইনি। দিয়েছি কি? ”

” এ কথা তুমি বলছো সামিরা? আমার মা তোমার সাথে কিরূপ আচরণ করতেন আর তুমি তার সাথে কিরূপ আচরণ করছো, আগে সেটা মিলিয়ে দেখ। ”

সামিরা চুপসে গেলেন। তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলেন না। আশফাক শিকদার বললেন, ” আমি জানি না তার সাথে তোমার এতো কিসের দ্বন্দ্ব। এখন যাও তাদের দেখভাল কর। ”

সামিরা তেতে উঠলেন, ” হ্যাঁ যাবোই তো। সব ঠেকা আমার। এ সংসারে আমার কথার কোনো দাম আছে? ” হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন সামিরা।
.

.
তামান্না কানে এয়ারফোন গুঁজে দিব্যি ফোনে স্ক্রোল করে চলছে। সারাদিনে তার তেমন কোনো কাজ থাকে না। রান্নার কাজে শ্বাশুড়ি মাও তাকে খুব একটা হাত লাগাতে দেয় না। বলতে গেলে সারাদিনই এক প্রকার অলস সময় কাটে।

” আপু! ” ছোট্ট সম্বোধনটি তামান্নার কানে পৌঁছাতে তামান্না এক কান থেকে এয়ারফোন আলগা করে সারা ঘরে চোখ বোলালো। মনে হলো তকি তাকে ডেকেছে। অথচ ঘরে সে ছাড়া কেউ নেই। মনের ভুল ভেবে পুনরায় নিজের কাজে মনযোগ দিল। পরক্ষণে একই শব্দ তার কানে এসে ঠেকল। তকি চোখের সামনে দৃষ্টিগোচর হতে তামান্নার চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। সাথে সাথে কান থেকে এয়ারফোন ছাড়িয়ে বিছানার এককোণে ছুঁড়ে মারল।

” ভাই! তুই কখন এলি? ”

” এই তো আপু, একটু আগে। ”

” এদিকে আয়। বোস এখানে। ”

তামান্নার কথা মতো তকি পাশে গিয়ে বসল। ভাইয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
” একাই এসেছিস? সাথে কেউ আসেনি? ”

” এসেছে। বাবা মা তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। উনারা সামনের রুমে। ”

” ওহ্। ”

” আপু তুই কি আমাদের ওপর রেগে আছিস? ”

” না তো। আমি কি আমার একমাত্র ভাইটার ওপর কখনো রাগ করে থাকতে পারি বল? এমনটা কোনোদিনও হবে না? ”

তকি স্নিগ্ধ হাসল। এতোদিন তার মনের ভেতর এক প্রকার খচখচানি কাজ করছিল। বয়স কম, সদ্য টিনএজার! তা সত্ত্বেও পুরুষ মানুষকে কখনো নিজেদের দায়িত্ব শেখাতে হয় না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা সবটা শিখে ফেলে। তকি বোনকে বলল, ” বাবা মা তোর জন্য ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করছে। যাবি না? ”

তামান্না মৌন রইল। তাকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে না দেখে তকি বলল, ” কি হয়েছে কিছু বলছিস না যে! ”

” না! ”

” কেন? উনারা তো তোকে দেখবে বলেই এসেছে। ”

” যেখানে আমি উনাদের কিছু হই না, সেখানে আমাকে উনারা কেন দেখতে আসবে? ”

” তাহলে আমি আর তনিমা আপুও তো তোর কিছু হই না! ”

” আমাদের তিনজনের বাবা একজনই তকি। তাই অবশ্যই তোরা আমার ভাইবোন। ”

” তাহলে কেন বললি উনারা তোর কিছু হয় না? ”

ধরা গলায় তাচ্ছিল্যের সাথে তামান্না ভাইকে বলল, ” উনারা আমাকে কিছু মনেই করেন না ভাই। ”

” আপু তুই কাঁদিস না রে, তোর কান্না আমার একদম সহ্য হয় না। হোক তুই আমার নিজের বোন না, তবুও তনিমা আপুর আগে আমার কাছে তুই আমার বড় বোন। যখন যে কোনো কিছুর প্রয়োজন হবে কাউকে না পারিস, শুধু আমাকে একবার বলিস। দেখবি তোকে তোর ছোট্ট ভাইটা কখনো ফিরিয়ে দেবো না। ”

তকির কথায় তামান্না বিস্মিত হয়। ভাইয়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে আজ যেন হঠাৎ করে কত বড় হয়ে গেছে তার সেই ছোট্ট ভাইটা। যাকে সে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। বুঝদার মানুষের মতো তাকে আশ্বাস দিচ্ছে।

দরজায় সামান্য শব্দ হতে দু’ভাই বোনের কথার ব্যঘাত মাঝে ঘটল। দরজায় টোকা দেয়ার মালিক সাদিয়া ছিল। সাদিয়ার দিকে দু’জনের দৃষ্টি যেতে সাদিয়া জানাল, ” ভাবী তোমাকে বাবা ডাকছে। ”

শ্বশুরের কথা ফেলার পাত্রী নয় তামান্না। একথা এ বাসার সবাই কম বেশি জানে। অগত্যা না চাইতেও বাধ্য হয়ে যেতে রাজি হতে হলো তাকে। সাদিয়াকে বলল, ” তুমি যাও। আমরা আসছি! ”
.

.
তালিব আবসার মেয়েকে দেখে হাসি মুখে জড়িয়ে ধরতে চাইলে তামান্না দুই কদম পিছিয়ে গেল। নিজের অভিমান বজায় রেখে শ্বশুরকে বলল,
” বাবা আমি কিচেনে মায়ের কাছে যাচ্ছি। ”

তামান্নার চলে যাওয়ার দিকে ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে রইলেন তালিব আবসার। নীলিমা কাঁধে হাত রাখলেন। শান্তনা দেওয়ার ভাষা তারও জানা নেই। নীলিমা মেয়েকে অনুসরণ করতে তার পেছন পেছন গেলেন।

আশফাক শিকদার বাবা মেয়ের অভিমান কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলে তালিব আবসার চুপসে গেলেন। ভাবনায় পড়ে গেলেন সত্যিটা জানাবেন কিনা ভেবে। আশফাক শিকদারের চোখের দিকে তাকাতে তিনি ইশারায় বোঝালেন। তালিব আবসার বন্ধুকে সবটা খুলে বললেন।
.
.
সামিরা রাগে গজগজ করতে করতে কাজ করছেন। তামান্নাকে দেখতে পেয়ে কিছুটা থেমে বললেন, ” কি ব্যাপার তুমি এখানে? ওখানে তোমার বাবা মা বসে আছে তোমার জন্য? তোমাকে এখানে আসতে বলেছে কে? ”

” আপনারা কম কিসে? উনারা আপনারা তো সমানই! ”

তামান্নার কথায় সামিরা কিছুটা চমকে গিয়ে বললেন, ” সমান কিভাবে হই? উনারা তোমার আপন না হলেও আমরা কিন্তু সাদিবের আপন বাবা মা-ই। ”

সত্য কথা তিতা হলেও সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই তামান্নার কাছে। বিনা ভানবা চিন্তা ছাড়াই জবাব দিল, ” হুম, জানি আমি। ”

#চলবে?

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৪৮)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
” সমান কিভাবে হই? উনারা তোমার আপন না হলেও আমরা কিন্তু সাদিবের আপন বাবা মা-ই। ”

সত্য কথা শুনতে তিতা হলেও সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই তামান্নার কাছে। বিনা ভাবনা চিন্তা ছাড়াই জবাব দিল, ” হুম, জানি আমি। ”

” নেও বাপু, ফলগুলো কেটে ফেলো। তোমাকে কিছু করতে বললেও দোষ না বললেও দোষ। ”

” জ্বি দিচ্ছি! ”

শ্বাশুড়ি বউয়ের আলাপনের মধ্যিখানে নীলিমাকে দেখা গেল। তামান্নার পেছন পেছন আসায় দু’জনের কথোপকথন কিছুটা শুনে ফেলেছেন। সামিরাকে সালামের পাশাপাশি কুশলাদি বিনিময় করে বলেন, ” ভাবী আপনি কি কোনো কারণে মেয়ের ওপর রাগ? ”

সামিরা তামান্নার দিকে চাইল। ভাবলেন বাপের বাড়ি তাহলে সব কথাই পাচার করে। তবুও ঘাবড়ালেন না। নিজেকে সামলে নিলেন। ভদ্রতা বজায় রাখতে বেশ পটু সামিরা৷ বললেন,
” কেন আপনার মেয়ে কোনো দোষ করেছে কি? ”

” ভাবী মানুষ তো মাত্রই ভুল। ছোট মানুষ সেভাবে বুঝদার হতে পারে নি। তাই বলছিলাম একটু বুঝিয়ে নিলে দেখবেন আস্তে আস্তে সবটা শিখে ফেলবে। ”

” আপনি কখন শিখেছিলেন? ”

নীলিমা আমতা আমতা করলেন। ” আমাদের সময়টা ছিল একরকম ওদেরটা অন্য রকম। যুগের সাথে তো তাল মিলিয়ে চলতে হয় ভাবী। ওরা আজকালকার ছেলেমেয়ে বুঝেনই তো। ”

” আমি যতদূর জানি ওর মা-ও ঘরে বাইরে দুই ধরনের কাজেই বেশ পারদর্শী। আপনার বোন শুনতে খারাপ শোনা গেলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাহিরেও তো উনি ভালোই কাজ করে বেরিয়েছে। শ্বাশুড়ি উচিত কথা বলায় উল্টো সংসার গুটিয়ে পালিয়েছেন। তাই তো ওকে কিছু বলতে পারছি না। কি জানি ও আবার এমন করে কি না। শত হলেও মেয়েরা তো মায়ের গুণটাই পায় তাই না ভাবী? ”

সামিরা কথাগুলো যে তামান্নাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেছে সেটা বুঝতে এতটুকু কমতি রইল না নীলিমার কাছে। তামান্না হাতে কাজ চালালেও কান সম্পূর্ণ সামিরা আর নীলিমার কথোপকথনের দিকে। নিজের মা যতই ভালো হোক কিংবা খারাপ হোক না কেন! পৃথিবীর কোনো সন্তানই মাকে নিয়ে কটু কথা সহ্য করবে না। তামান্নাও পারেনি। চট করে তাই জবাব দিয়ে বসে।

” আপনি তো সেটাই চাইছেন, আমি যেন উনার মতোই আপনার ছেলেকে ছেড়ে দেই! ”

” কোনো মাকে দেখেছ কখনো নিজের ছেলের খারাপ চাইতে? তোমার মামনি তো সামনেই আছে তাকে জিজ্ঞেস করে দেখ তো! উনি পারবেন? ”
.

.
যাওয়ার আগে নীলিমা তামান্নার সাথে আড়ালে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলেন। তামান্না বাসা থেকে তাদের ওপর অভিমান করে এসেছিল। ভেবেছিল তার মান ভাঙাতে একবার দেখা করে যাক। অথচ এসে দেখছেন এখানকার পরিবেশ অন্যরকম। সামিরা তাকে এখনো মেনে নিতে পারেননি।

নীলিমা তামান্নাকে বলেন, ” কি করছিলে তখন? ”

তামান্না না জানার ভাণ করে বলল,
” কি করছিলাম? ”

” কি দরকার ছিল মুখের ওপর কথা বলার? উনি যে তোমার শ্বাশুড়ি ভুলে গেছ? ”

” তো এতে আমি এমন কি বলেছি যে শ্বাশুড়ির অমর্যাদা করা হয়ে গেছে? ”

” দেখ মাথা ঠান্ডা করতে শিখ। সব জায়গায় জবাব দিতে হয় না৷ এটা পরের বাড়ি। এখানে অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। দাঁতে দাঁত চেপে এড়িয়ে যেতে হয়। তাছাড়া আমি তো তোমার হয়ে কথা বলছিলাম নাকি? ”

তামান্না কিঞ্চিৎ রেগে গেল। ” তুমি শুনতে পাওনি উনি কতগুলো কথা বলেছেন আমাকে? কতদিন এভাবে সহ্য করা যায়? ”

” যতদিন না পরিস্থিতি ঠিক হয় ততদিন। ”

তামান্না চুপসে গেল। নিরবে রাগে ফুঁসছে সে। চাইলেও কোনোভাবেই নিজের রাগ দমিয়ে রাখতে পারছে না। নীলিমা তামান্নার চেহারায় স্পষ্ট রাগের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছেন। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখে এসেছেন। অত্যন্ত প্রতিবাদী স্বভাবের মেয়ে তামান্না। ভাবনা চিন্তা ছাড়াই সরাসরি মুখের ওপর জবাব দিয়ে ফেলে। নিজেকে যে মেয়ে কারোর সামনে ছোট হতে দেখতে পারে না সে যে এতটা সহজে দমে যাবে, সেটা ভাবাটাও নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক।

নীলিমা সামান্য দম নিলেন। তামান্নাকে বোঝানোর স্বার্থে বললেন, ” দেখ তুমি এখন আর একা নেই। তোমার সাথে আরো একজন জড়িত। তোমার অনাগত সন্তান। সাদিব কেমন সেটাও তো তুমি জানো। ও যদি দেখে তুমি তার মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছ, তাহলে বিষয়টি কেমন হবে ভেবে দেখেছ? ”

” সে কোনো কিছুই চোখে দেখে না। নিজের মায়েরটা তো আরো আগে না। ”

” সাদিব তোমাকে মেনে নিয়েছে বলে ভেবোনা তার মায়ের অসম্মান হলে তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে! ”

তামান্না নিচু গলায় বিড়বিড় করে বলল, ” একথা খুব ভালো করেই জানি আমি। ”

” তো জানো যখন মানছো না কেন? মা ভক্ত ছেলেরা ভীষণ ভয়ঙ্কর হয় তামান্না। এদের পুরো দুনিয়া একদিকে আর মা অন্যদিকে। মায়ের কথা মতো তোমাকে ছেড়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাববে না সাদিব! তাই বলছি নিজের ভালোটা বুঝতে শেখো। নিজের খেয়াল রেখো, আসছি আমরা। যাওয়ার আগে আরেকটা কথা, কাল পরশুর দিকে গিয়ে চেকাপটা করিয়ে নিও। ”

” করবো না কোনো চেকাপ, যাও তো। ”

নীলিমা কণ্ঠে আক্ষেপ মিশিয়ে বললেন,
” এতোক্ষণ যাবত কাকে কি বোঝালাম? ”

” কাউকে বোঝাতে হবে না। আমার অনেক ভালো করেছ তোমরা সবাই মিলে। যখন যা করতে মন চেয়েছ করেছ। প্লিজ আর কোনো ভালো করতে এসো না। এবার মাফ চাই। ” বলে হনহন করে ভেতরের দিকে চলে গেল তামান্না। তালিব আবসার যাওয়ার আগে অন্তত একবার তামান্নার সাথে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও হয়ে উঠল না। নীলিমার কাছে জানতে চাইলে নীলিমা চোখের ইশারায় আশ্বাস দিলেন। ফলে কিছুটা শান্ত হলেন তালিব আবসারের অশান্ত মন।
.

.
রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে তামান্না। রাগে নিজের মাথার সব চুলে একসাথে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এ বাসার পরিবেশটা তার জন্য দম বন্ধকর মনে হচ্ছে। আসার পর থেকে চাতক পাখির মত অনবরত একটুখানি মানসিক শান্তির সন্ধ্যান করে চলছে সে। মানুষ সব সহ্য করতে পারে। কিন্তু নিঃসঙ্গতা? সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তির মধ্যে অন্যতম শাস্তি বোধহয় এটাই। না পারে কারোর সাথে মন খুলে দু’টো কথা বলতে না, পারে নিজের মতো করে একা কাটাতে। একজন সুস্থ্য হাসিখুশি মানুষকে কুড়ে কুড়ে শেষ করার জন্য এটাই যথেষ্ট। টেবিল ল্যাম্প ঘেঁটে নোটবুকটা খোঁজার ব্যর্থ প্রয়াস চালাল। সেটারও নাগাল খুঁজে পাচ্ছে না গত দু’দিন ধরে।

মেয়েদের জীবন চক্র বুঝি এমনই। বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি ব্যতিত তাদের অন্য কোনো বাড়ি থাকতে নেই। স্বামী ছাড়া কোনো আপন মানুষ থাকতে নেই। যাদের কাছে মেয়েরা জীবনের দেড় কিংবা দুই যুগ পার করেছে, যাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে। সেই তারাও তাকেই বলবে মেনে নিতে, স্বামী শ্বশুর বাড়ির সবার মন জুগিয়ে চলতে। তাদের স্থান যে কোথাও থাকতে নেই!
.
#চলবে..?

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৪৯)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
মেয়েদের জীবন চক্র বুঝি এমনই। বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি ব্যতিত অন্য কোনো বাড়ি থাকতে নেই। স্বামী ছাড়া কোনো আপন মানুষ থাকতে নেই। যাদের কাছে মেয়েরা জীবনের দেড় কিংবা দুই যুগ পার করেছে, যাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে। সেই তারাও এসে একসময় তাকে বলবে সবটা মেনে নিতে, স্বামী শ্বশুর বাড়ির সবার মন জুগিয়ে চলতে। তাদের স্থান যে কোথাও থাকতে নেই!

দরজার ঠকঠক শব্দে তামান্নার ঘুম ভেঙে গেল। এ সময়টায় প্রতিদিন সাদিব বাসায় ফেরে। আজও নিশ্চয়ই সে-ই হবে। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিল না তামান্না। তাড়াহুড়ো করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতে সাদিব ডুকে পড়ল। তামান্নার দিকে নজর যেতে প্রশ্ন বিদ্ধ দৃষ্টি রাখল। ঘুমালে এবং কাঁদলে যে কোনো মানুষের চোখ মুখ ফুলে উঠা-টা স্বাভাবিক। সাদিব ভ্রু তুলে চোখ মুখ ফুলে থাকার কারণ জানতে চাইল। ভেবেছিল তামান্না কেঁদেছিল বেধহয়। কিন্তু তামান্না জানালো ঘুমের কারণে এমনটা হয়েছে। শুনে সাদিব আর কোনো প্রশ্ন করল না।
.

.
নীলিমার বলে যাওয়া চেকআপের কথা তামান্না উড়িয়ে দিলেও সাদিব উড়িয়ে দেয়নি। সাদিবের ঠিক মনে ছিল চেকআপের কথা। তাই পরদিন সকাল সকাল তামান্নাকে নিয়ে হসপিটালের দিকে রওয়ানা দিল।

গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মনিরা সুলতানা। সাদিবের কলিগ হিসেবে ভালো জানাশোনা। একই হসপিটালের ডাক্তার তারা। সাদিব মনিরার কেবিনে তামান্নাকে নিয়ে এলো। মনিরার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সে জরুরি ফোনকলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। মনিরা সুলতানা বেশ হেসে হেসে কথা বলছেন তামান্নার সাথে। তামান্নারও উনার সাথে কথা বলতে ভালোই লাগছে। মনিরা তামান্নার প্রেশার চেক করলেন। টুকটাক কথার মাঝে বললেন, ” বয়সে তুমি আমার চেয়ে কম হলেও পাঁচ বছরের ছোট হবে তাই না? ”

” জ্বি আপনার বয়স তো আমার সেভাবে জানা নেই তাই ঠিক বলতে পারছি না। ”

” ডাক্তার ইরফান সাদিব মানে তোমার হাসবেন্ড আর আমি সময়বয়সী। একই সাথে এই পেশায় যুক্ত হয়েছি। ”

” তাহলে ঠিকই আছে। পাঁচ বছরেরই হবেন। ”

” তোমাকে এতোক্ষণ তুমি করে বলছি কিছু মনে করো নি তো? ”

তামান্না সৌজন্যতামূলক হাসল। ” না না কি বলছেন! কি মনে করবো! ”

” এখন এটা বল আমায়, তুমি এতো চিন্তা করো কিসের?”

ডাক্তারের প্রশ্ন শুনে তামান্না চুপসে গেল। ” কই না তো? ”

” আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি বুঝলে? ” দুষ্টুমির ছলে ডাক্তার মনিরা সুলতানা বললেন, ” ইরফান সাদিবের মতো হাসবেন্ড পেয়েছো! উনাকে এতোদিন ধরে দেখে আসছি উনি কিন্তু মানুষ হিসেবে একদম খারাপ না! এবার স্বামী হিসেবে কেমন সেটা তুমি জানো? ”

তামান্না মৃদু হাসল। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলল, ” হ্যাঁ হ্যাঁ কেমন তা জানব না? স্বামী ছাড়া বাকি সব দিক থেকেই সে পারফেক্ট! ”

” একদম স্ট্রেস নেওয়া যাবে না কেমন? এসময় যত পারো চিন্তা মুক্ত থাকো। বেবির সাথে সাথে আমাদের বেবির মায়েরও কিন্তু সুস্থ্য থাকা চাই কেমন? ”

ডাক্তার মনিরা কথাগুলোর মাঝে এক অধিকারবোধ প্রকাশ পেল। তিনি না জানলেও এই অধিকার বোধ থেকে তামান্নার মনে তিনি অনেকটা জায়গা দখল করতে সক্ষম হয়েছেন।

সাদিব কথা শেষে কেবিনে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে মনিরার কেবিনে প্রবেশ করল। জিজ্ঞেস করল,
” কেমন দেখলেন? অল গুড? ”

” হুম। শুধু স্ট্রেস নিতে বারণ করবেন। অন্যথায় সব ঠিক আছে। ”
.

.
সাদিব খেয়াল করছে তামান্না তার সাথে আজকাল আগের মতো খুব একটা কথা বলছে না। ব্যাপারটা সাদিবের কাছে মোটেও ভালো লাগছে না। ডাক্তারের বলা কথায় বুঝতে পারছে তামান্না আর সে একই ছাঁদের নিচে, একই বিছানায় পাশাপাশি ঘুমলেও দু’জন অনেকটা দূরে সরে গেছে। খুঁজে বের করতে চাইল, এমন কি ঘটল যার জন্য তামান্নার আর তার মাঝে এতোটা দূরত্ব তৈরি হলো? অনেকদিন তো রয়েসয়ে দেখেছে। আর কতদিন! এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। সরাসরি তামান্নার সাথে আজই এ বিষয়ে কথা বলা উঠিত বলে মনে করল সাদিব।

সাদিব ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে তামান্নার হাতে সেদিনের সেই নোটবুকটি যা সে খুঁজে চলছিল। সাদিবকে দেখে তামান্না কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল, ” আমার নোটবুক তোমার কাছে কি করে ডাক্তার সাহেব? ”

সাদিব না জানার ভাণ করল। ” এটা তোমার নোটবুক? ”

” যার-ই হোক। তুমি কেন নেবে? ”

” মালিকানা ভুক্তহীন হলে নেওয়া কি দোষের? ”

” এইই, এটা মালিকানা ভুক্তহীন হয় কিভাবে? এটা আমার নোটবুক। তুমি চুরি করেছ! চুরি তো চুরি আবার সিনা জুরী! ”

” আমি চুরি করেছি কোনো প্রমাণ আছে? ”

” তোমার ড্রয়ারেই তো পেয়েছি। তাহলে বলো আমি রেখেছি ওখানে? ”

” রাখতেও তো পারো। মাঝে মাঝে আমার অগোচরে কত কিছু করে বেড়াও তার সবটা কিন্তু আমি জানি! ” সাদিব মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল।

তামান্না সাদিবকে ধরতে গিয়ে উল্টো নিজে ধরা পড়ে গেছে। এটা ঠিক সাদিবের অগোচরে তামান্না সাদিবের ড্রয়ার চেক করে। কখনো জামা কাপড় নেড়ে ছেড়ে দেখে। সেগুলো থেকে সাদিবের গায়ের সুগন্ধ নেয়। আবার কিয়ৎক্ষণ নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে। অনুভব করতে চায় সাদিবের শূন্যতা। কিন্তু সেসব কখনো মুখে প্রকাশ করতে পারে না। মনের দিক থেকে সাদিবকে অনেকটা জায়গা দিয়ে দিলেও বাস্তবিক অর্থে সাদিব এখনো সেভাবে তাকে বুঝতে পারেনি। সে চায় তার ডাক্তার সাহেব তাকে একটু বুঝুক। অন্য সব স্বামী স্ত্রীদের মতো তারা একে অপরের সুখ দুঃখ কিংবা একাকীত্বের সঙ্গী হোক। তাকে সব প্রকার মানসিক কষ্ট থেকে বের করুক!

সাদিবকে নিজের দূর্বলতা বুঝতে দিতে চাইল না তামান্না। ” কচু জানো। যদি জানতেই তাহলে কত সমস্যার সমাধান এক নিমিষে হয়ে যেত। ”

” কি সমস্যার সমাধান চাও? ”

” কিছু না! ”

তামান্না নোটবুকটা আগের জায়গায় তুলে রাখল। সাদিব হঠাৎ পেছন থেকে তামান্নার কোমর জড়িয়ে ধরল। সাদিবের আচমকা স্পর্শে তামান্না খানিকটা চমকে গেল। কিন্তু কিছু বলল না।

” তোমাকে রাগলে অনেক সুন্দর লাগে। তার মানে এই নয় যে, সবসময় এতো রাগতে হবে। জানো তো অতিরিক্ত রাগ কতটা ভয়ঙ্কর! ”

” তাহলে কি করতে হবে? ”

” রাগ কমিয়ে দেও! নাহলে আমার বেবি যদি রাগী হয় না! দেখ তোমার কি করি? ”

সাদিবের বাচ্চামো কথাতে তামান্না ফিক করে হেসে দিল। এই প্রথম সাদিবের এতোটা খোলামেলা স্বভাব তামান্নার নিকট ধরা পড়ল। হুট করে তামান্নার কি হলো কে জানে? পেছন ফিরে সাদিবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সাদিবও একইভাবে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল।

আবেগাপ্লুত হয়ে তামান্না আনমনে বলল, ” ডাক্তার সাহেব আমার নিজেকে বড্ড একা লাগে। আমি একাকীত্ব আর নিতে পারছি না। প্লিজ আমাকে তুমি বের হতে সাহায্য করবে? ”

তামান্না স্পষ্ট সাদিবের হৃৎস্পন্দনের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। সাদিব তামান্নার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ” তোমার পাশে আমি আছি তো? তাহলে এতো কিসের একাকীত্ব? ”

” আমি জানি না সেসব! ”

” বেশ! তাহলে তোমাকে আমার একটা কথা রাখতে হবে। আগে বল রাখবে? ”

সাদিবের বুক থেকে তামান্না মাথা তুলে তাকাল। আবেগে তামান্নার কণ্ঠস্বর ভেঙে ভেঙে আসছিল এতোক্ষণ। রাগী হওয়ার পাশাপাশি মেয়েটা ভীষণ আবেগী যে বটে! চোখের কোণে পানি চিকচিক করা শুরু করেছিল। নিজেকে ধাতস্থ করে ধরা গলায় জানতে চাইল, ” কিইই কথা? ”

#চলবে…

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৫০)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সাদিব তামান্নার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ” তোমার পাশে আমি আছি তো? তাহলে এতো কিসের একাকীত্ব? ”

” আমি জানি না সেসব! ”

” বেশ! তাহলে তোমাকে আমার একটা কথা রাখতে হবে। আগে বল রাখবে? ”

সাদিবের বুক থেকে তামান্না মাথা তুলে তাকাল। আবেগে তামান্নার কণ্ঠস্বর ভেঙে ভেঙে আসছিল এতোক্ষণ। রাগী হওয়ার পাশাপাশি মেয়েটা ভীষণ আবেগী যে বটে! চোখের কোণে পানি চিকচিক করা শুরু করেছিল। নিজেকে ধাতস্থ করে ধরা গলায় জানতে চাইল, ” কিইই কথা? ”

” তুমি এতে যা যা লিখেছো আমাকে পড়ে শোনাতে হবে। ”

” সবটা কিভাবে শোনাবো? ”

” কেন? যেভাবে আমাকে ভেবে লিখেছো সেভাবে পড়েও শোনাবে! ”

” তুমি তো পড়লে আমি কি লিখেছি, তাহলে নতুন করে কি শুনতে চাইছো? ”

” উঁহু কিছুই পড়িনি। তোমার মুখে থেকে শুনবো বলে রেখে দিয়েছিলাম। ”

তামান্না লম্বা শ্বাস ছাড়ল। ভাবনায় পড়েছে সবটা সাদিবকে কিভাবে পড়ে শোনাবে। তার সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটা দিন প্রতিটা ঘটনাকে তামান্না যতটা আবেগ মাখিয়ে লিখেছে তা কখনো মুখে পড়ে শোনানো শোভা পায় না। তাছাড়া নোটবুকে এমন সব কথা লেখা আছে যা শুনলে সাদিব ভালোভাবে নেবে না৷ উল্টো নিজেদের মধ্যে ভুলবোঝাবুঝি বাড়বে। সাদিবের দিকে একবার চোখ তুলে দেখল তামান্না। সাদিবের মাঝে কোনোপ্রকার হেলদোল প্রকাশ পেল না। যেন পণ করেছে তামান্নার মুখ থেকে শুনেই ছাড়বে।
.

.
বাহিরে দমকা হাওয়া বইছে। গরমের হাহাকার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এইটুকু বাতাসই যেন যথেষ্ট। তামান্না জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এ মুহুর্তে ধ্যান জ্ঞান সব বাহিরে। সাদিব এগিয়ে গেল। বিছানার কিনারায় বসে উপর থেকে নিচ অব্ধি তামান্নাকে খুঁটে খুঁটে দেখছে। কোনো কারণে তাকে বিষন্ন লাগছে। আগের মতো আর চঞ্চলতা তার মাঝে নেই। এর কারণটা কোনো কারণে সে নয় তো? হাত বাড়িয়ে দিলো সাদিব অর্ধাঙ্গীনির দিকে। হাত ধরে টেনে এনে তামান্নাকে নিজের কোলে বসালো। দু’জনের দৃষ্টি দুজনে নিবদ্ধ। চোখ মানুষের মনের কথা পড়তে পারে। তামান্না চাইছে তার ডাক্তার সাহেব তাকে বুঝুক, সাদিবেরও একই চাওয়া।

নিরবতা ছাড়িয়ে সাদিব বলে উঠল, ” তোমার চোখ বলছে তুমি আমার সাথে ভালো নেই। আর আমার মন জানতে চাইছে তোমার ভালো না থাকার কারণ! ”

” সত্যি কি মন জানতে চাইছে? ”

সাদিব করুণ চাহনিতে অর্ধাঙ্গীনির পানে তাকাল।
” আমি কি তোমার এতোটা পর যে আমাকে একবার বলা যায় না? ”

” সব কথা যে মুখে বলতে নেই ডাক্তার সাহেব। কিছু জিনিস বুঝে নিতে হয়। ”

” তুমি আমার অর্ধাঙ্গীনি। তাই বলে তোমার ভালো খারাপ জানার অধিকার কি নেই আমার? ”

তামান্না মৃদু হাসল। ” অবশ্যই আছে। ”

” তাহলে? ”
” ডাক্তার সাহেব তুমি আমাকে তোমার মনে কতটুকু স্থান দিতে পেরেছো তা আমার জানা নেই। তবে আমার মনের সম্পূর্ণ দাবিদার তুমি একাই। যার কোনো অংশীদারত্ব নেই। যে আমার এতোটা স্থান জুড়ে আছে তাকে কিভাবে কষ্ট দেই বল? ”

” এখন কি কোনো অংশে কম পাচ্ছি? ”

” বাদ দেও। ” তামান্না সরে এসে বিছানার অন্য প্রান্তে বসল। নোটবুকটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। পুরাতন লেখাগুলোতে স্পর্শ করল। ছোঁয়া না গেলেও সেগুলো সে নিজের আবেগ মিশিয়ে লিখেছে। সাদিব পড়লে নিজের সকল প্রশ্নের জবাব এখানেই পেয়ে যেত। ধরে ফেলতে পারতো তামান্নার না বলা সব কথার কারণসমূহ। পৃথিবীতে এ যাবত বড় ছোট যত উপন্যাসের সূত্রপাত ঘটেছে। সবগুলোর উপসংহারও মিলেছে। কখনো মিলনে তো কখনো বিচ্ছেদে। কিন্তু নিজের জীবন সম্পর্কে লেখা উপন্যাসের শেষ কোথায়? আদৌও কি লিখতে পারবে সে? শেষ অব্ধি নিজের একাকিত্ব কি বুঝতে পারবে কখনো ডাক্তার সাহেব? হয়তো হ্যাঁ, হয়তোবা না!

সাদিব চলে যেতে তামান্না আনমনে আওড়ালো,
” আপন মানুষরাই অনেকসময় আমাদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ডাক্তার সাহেব। আমি কষ্ট পাচ্ছি তোমার আর আমার আপন মানুষ দ্বারা, তদ্রূপ তুমি পাচ্ছো আমার দ্বারা। তুমি বুঝতে ভীষণ সময় নিচ্ছ ডাক্তার সাহেব। এমন যেন না হয় আমাকে বুঝতে গিয়ে অনেকটা সময় পুরিয়ে গেছে। যখন বুঝবে তখন হয়তো বলার জন্য আমাকে আর তুমি খুঁজে পাবে না! ”
.

.
আজ বহুদিন পর সামিরা নিজে থেকে তামান্নাকে ডাকতে এসেছেন। শ্বাশুড়ির ব্যবহার তাকে আশ্চর্য হতে বাধ্য করেছে। বাড়ির প্রতিটি সদস্য বহুদিন পর একসাথে খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়েছে। সাদিবও আজ সবার মাঝে আছে। মূলত সাদিবকে দেখেই সামিরা এতোটা খুশি। এতোক্ষণ বুঝতে না পারলেও তামান্না এখন বেশ বুঝতে পারছে। সামিরা যেমনই হোক সাদিবের সামনে তামান্নার সাথে কখনো তাকে খারাপ ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

তামান্না তাকে হাতে হাতে সাহায্য করতে গেলে তিনি বললেন, ” আরে কি করছো? তোমাকে এ অবস্থায় কোনো কাজ করতে হবে না। তুমি বরং খেতে বসো বুঝলে। এসময় ঠিকঠাক মতো খাওয়া দাওয়া করতে হয়। ”

তামান্না জোরপূর্বক হাসল। আশফাক শিকদার স্ত্রীয়ের ব্যবহারে খুশি হলেন কিনা জানা না গেলেও তাকে হাসতে দেখা গেল। সামিরা স্বামীর অবস্থা খেয়াল করে কপাল কুঁচকালেন। বললেন, ” কি হয়েছে? এতো হাসির কি হয়েছে? ”

আশফাক শিকদার বললেন, ” তোমাকে দেখে হাসলাম আরকি!”

” আমাকে দেখে কোনো দিক দিয়ে কি সং-য়ের মতো মনে হয়? ”

” তা নয়। হঠাৎ করে তোমার এতো পরিবর্তন ভাবাচ্ছে আমাকে বুঝলে? ”

” এতো ভাবানোর কি আছে। ওর গর্ভে আমার সাদিবের সন্তান, আমার বংশের বাতি উজ্জ্বল করে বংশধর আসতে চলেছে। ওর যত্ন নেবো না বলছো? ”

” যাক সুবুদ্ধি হলো তবে তোমার? ”

মাথা নিচু করে নিজের খাবারের দিকে তাকিয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ির কথা শুনছে। শ্বশুরের কথা শুনে মনে হচ্ছে উনিও তার সাথে একমত। শ্বাশুড়ির হঠাৎ পরিবর্তন তামান্নার মতো উনাকেও ভাবাচ্ছে। শ্বাশুড়িকে কি সরাসরি এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে? যদি উল্টো রেগে গিয়ে সাদিবের কাছে নালিশ দেয়? তখন তো আবার ভুল বোঝাবুঝি শুরু হবে। সাদিব তার মাকে ভীষণ ভালোবাসে। সে কোনোভাবে নিজের মাকে অবিশ্বাস করবে না। যতটা মাকে বিশ্বাস করে ততটা পৃথিবীর কোনো মানুষকে সে করে বলে তামান্নার জানা নেই। এমনকি নিজের বাবাকেও না। তারচে বরং মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আরজি, উনি যেন সব ঠিকঠাক করে দেন। শ্বাশুড়ি যেন সত্যিকার অর্থে সবটা মেনে নেন।

তামান্নাকে চুপচাপ বসে খাবার নড়াচড়া করতে দেখে সামিরা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
” কি হলো? খাচ্ছো না যে? আমার রান্না ভালো হয়নি বুঝি? ”

তামান্না হাসার চেষ্টা করল। বলল, ” না, তেমন কিছু না। এইতো খাচ্ছি আমি। ”
.

.
পরদিন সাদিব, আশফাক শিকদার সবাই যে যার কাজে চলে গেলেন। বাসায় নতুন কাজের মেয়ে একজন রাখা হয়েছে। সাথে ছুটা বুয়া তো আছেনই। তামান্নাকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয় না। এটা বাপ বেটা দু’জনের কড়া নির্দেশ। এতোদিন একা একা কাজ করলেও এখন থেকে প্রতিদিন কাজের মেয়েটাকে রান্নাবান্নার বেশিরভাগ কাজ বুঝিয়ে দেন সামিরা। সবাই কাজে চলে যাওয়ার পর তার আর তেমন কোনো তাড়া থাকে না। তখন আস্তেধীরে সব করেন। কাজের মেয়েটার নাম মিনা। মিনাকে সব শাকসবজি কেটে রান্নার বন্দবস্ত করতে বলে তিনি তামান্নার কক্ষের দিকে চললেন।

তামান্না বারান্দার দোলনায় বসে বই পড়ছিল। দক্ষিণ দিক থেকে মৃদু বাতাস এদিকটায় এসময়ে বেশি পাওয়া যায়, বিধায় তামান্না বেশিরভাগ সময় এখানে বসেই কাটায়। বারান্দায় নিজের পছন্দের কয়েকটা ফুল গাছও লাগিয়েছে ইতিমধ্যে। অল্প কয়েকটা হলেও এদের সাথে সময় কাটানোর মাঝে আলাদা একটা তৃপ্তি খুঁজে পায় যেন সে।

সামিরা তামান্নাকে ঘরে খুঁজে না পেয়ে থাই গ্লাসের দিকে নজর দিল। থাই গ্লাসের আবছা রঙে বুঝতে পারল তামান্না সেখানেই আছে। এগিয়ে গিয়ে বলল, ” সকালে তোমার ঔষধ খেয়েছো? ”

হঠাৎ এহেন প্রশ্নে তামান্না অবাক হতে ভুলে গেল যেন। বিস্ময় এসে ভর করল তাকে। মানুষের আচরণের পরিবর্তন হয় তাই বলে এতোখানি? নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে বলল, ” জ্বি মা। খেয়েছি। ”

সামিরা এক পাতা ঔষধ এগিয়ে দিয়ে বলল,” এটা কি তোমার? দেখ তো? ”

তামান্না হাত থেকে ঔষধের পাতাটা নিল। নেড়েচেড়ে ভালোভাবে দেখে বলল, ” না তো। আমার তো এমন কোনো ঔষধ নেই। ”

” ভালো করে দেখে বলছো তো? ”

” হ্যাঁ মা, এটা আমার না। ”

” মিনা ঘর ঝাড়ু দেওয়ার পর তোমার ঘর থেকে পেয়েছে তাই দিতে এসেছি। হয়তো কোনো ভাবে হারিয়ে ফেলেছ। ডাক্তারের কাছে গেছো আজ থেকে তিনদিন আগে। অথচ পুরোটা পাতা ভর্তি। একটাও খাওনি। নেও এখন খেয়ে নেও! দরকারি ঔষধই হবে। ”

” জ্বি মা। ঠিক আছে! আপনি যান আমি এক্ষুনি রুমে গিয়ে খেয়ে নিচ্ছি। ”

” রুমে যেতে হবে না। আমার সামনেই খাবে। দাঁড়াও পানি এনে দিচ্ছি। ”

সামিরা রুমে ঢুকে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে তামান্নার হাতে ধরিয়ে দিলেন। অগত্যা বাধ্য হয়ে তামান্না ঔষধটা সেবন করলেও মনের মাঝে খচখচানিটা রয়েই গেল…

#চলবে..?