তোমার নামে হৃদয় পর্ব-৫৯

0
327

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা_৫৯
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
প্রিয় মানুষের কাছে ঠকে যাওয়ার ভয়ে তামান্নার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিল সে। ঠিক করল, অন্যায়ের সাথে এবার থেকে আর কোনো আপস করবে না সে। রুখে দাঁড়াতে হবে তাকে। নিজের জন্য না হোক অন্তত তার সন্তানদের জন্যে হলেও। হাতের উল্টো পিঠের সাহায্যে চোখের পানি মুছে সাদিবকে ফোন করল। সাদিবের ফোনে সংযোগ যাচ্ছে না। তামান্না রাগে হাল ছেড়ে দিল। এদিকে চোখের পানি বাঁধ মানছে না। তার এখনো দৃঢ় বিশ্বাস তার ডাক্তার সাহেব তাকে কোনোভাবেই ঠকাতে পারে না।

ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে তামান্নার ফোনখানি সশব্দে বেজে উঠল। স্ক্রিনে ডাক্তার সাহেব দেখে রাগ খানিকটা দমে গেল। রিসিভ করতে সাদিবকে ব্যস্ত কণ্ঠে বলতে শোনা গেল, ” সেই কখন থেকে কল করে যাচ্ছি। তোমার ফোন এতোক্ষণ সংযোগ হচ্ছিল না কেন? ”

কান্নার কারণে তামান্নার কথা খানিকটা দলা পাকিয়ে যেতে চাইল। বলল, ” তুমি ফ্রী আছো? ”

তামান্নার কণ্ঠে সাদিব ঘাবড়ে গেল। ” তুমি ঠিক আছো? তোমার কথা এমন শোনাচ্ছে কেন? ”

তামান্না রাগত স্বরে জানতে চাইল, ” আগে বল তুমি ফ্রী আছো কিনা? ”

” হ্যাঁ। কিন্তু কি হয়েছে সেটা তো বলবে? ”

” এক্ষুনি বাসায় আসো। ”

” কিন্তু তামা…..

” কোনো কিন্তু পিন্তু শুনতে চাই না আমি। তুমি এক্ষুনি আসবে মানে এক্ষুনি। অন্যথায় আজ প্রলয় বইয়ে দেবো বলে দিলাম। ”

সাদিবের উত্তরের অপেক্ষা না করে তামান্না সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল।
.

.
তামান্নার হুমকিতে সাদিব তাৎক্ষণিক বাসার পথে রওয়ানা দিল। তামান্নার কণ্ঠস্বর শুনে এতটুকু আন্দাজ করা গেল সে কোনো কারণে প্রচন্ড রেগে আছে। কিন্তু ঠিক কী কারণে কিংবা কার ওপর সেটা কোনোভাবে বোধগম্য হচ্ছে না সাদিবের নিকট।

” কি হয়েছে এতো জরুরি তলব? ”

তামান্না সাদিবের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকানোর পরিবর্তে অনেকটা শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। শান্ত স্বরে জানতে চাইল, ” একটা সত্যি কথা বলবে ডাক্তার সাহেব? ”

সাদিব সম্মতি জানালে তামান্না বলল, ” তুমি ঠিক কি চাইছো বলতো? ”

ঘুর্ণিঝড়ের পূর্বে প্রকৃতি বেশ শান্ত হয়ে থাকে। এ বুঝি ঘুর্ণিঝড়েরই পূর্বাভাস! সাদিব কিছু সময় ভাবল। সাদিবের কাছ থেকে প্রতিত্তোর না পেয়ে তামান্না পুনরায় জানতে চাইল, ” কিছু বলছো না যে? ”

” কি চাইবো তুমি জানো না? ” সাদিব কণ্ঠস্বর স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা নরম শোনাল।

তামান্না সামান্য শ্বাস ছাড়ল। সাদিবকে এ মুহুর্তে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করছে শ্বাশুড়ির বলা প্রতিটা কথা যেন মিথ্যে ফলে।

” ডাক্তার সাহেব! ”

” বলো? ”

” তোমাকে না আমি এখনো বুঝতে পারি নি। তোমাকে শুধু একটা অনুরোধ করবো আশা করি ফেলবে না। ”

তামান্নার ভাঙ্গা কণ্ঠে সাদিব বিস্মিত হলো। ” কি অনুরোধ? ”

” আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে প্লিজ আমার সন্তানদের তুমি আগলে রেখো। ”

” এসবের মানে কি? তুমি আমাকে এতো জরুরি তলবে ডেকে এনেছো এসব বলার জন্য? ” সাদিবের কণ্ঠে মৃদু রাগ প্রকাশ পেল।

” না সে জন্য নয়। অন্য কারণও আছে। ”

” কি সেটাই তো জানতে চাইছি! ”

তামান্না সামিরার সাথে কথা বলার সময় ফোনের রেকর্ড অপশন চালু করে রেখেছিল। কথার ধরণ শুনে আগে থেকেই আন্দাজ করে রেখেছিল তিনি নিশ্চয়ই নতুন কোনো অশান্তি শুরু করবেন কিনা! করে রাখা রেকর্ড সম্পূর্ণটা শোনার পর সাদিব কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে গেল। একজন মানুষ কতটা স্বার্থপর হলে এভাবে তারই ছেলের বউকে মানসিক টর্চার করতে পারে? তাও কিনা সে মানুষটা অন্তঃসত্তা জানা সত্ত্বেও। সাদিব নিজের মায়ের নিচু মানসিকতার পরিচয় পেয়ে কিছুক্ষণ নিজেকে ধিক্কার জানাল। সৃষ্টিকর্তা বেছে বেছে তাকে এমন মায়ের কাছেই কেন পাঠালেন? এতোদিন যে মায়ের আঁচলের তলায় থেকে অন্ধের মতো তাকে বিশ্বাস করে এসেছে সে মা-ই আজ তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে উঠে পড়ে লেগেছে।

রাগে সাদিবের সারাশরীর রি রি করে কাঁপতে লাগল। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে এ মুহুর্তে তার। এতোদিন যে মায়ের কথা শুনে যাচাই বাঁচাই ছাড়া সে তার প্রেয়সীকে কষ্ট দিয়ে এসেছে। সেই মানুষটার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা তার বোধগম্য নেই। হুট করে সাদিব তামান্নাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। অনেকটা শক্ত হাতে বুকের সাথে চেপে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগল সাদিব। যেন ছেড়ে দিলে সে তার প্রেয়সীকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। তামান্না কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। সে ভাবতে পারেনি সাদিব এরূপ প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।

এভাবে কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সাদিব নিজেকে সামলে নিল। প্রিয়তমর কান্নায় তামান্নার চোখেও পানি এসে জমেছিলো। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তামান্না সযত্নে সাদিবের চোখের পানি মুছে দিল। সাদিব তামান্নাকে বলল, ” তোমার কিছু হতে দেবো না আমি। তোমাদের থেকে একমাত্র মৃত্যু ছাড়া কেউ আমাকে আলাদা করতে পারবে না। তুমি যেদিন ও বাড়ি ছেড়েছিলে সেদিনই আমি সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমাদের নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো আমি। যেখানে আমাদের চারজনের একটি আলাদা জগৎ তৈরি হবে। এ নিয়ে তুমি একদম চিন্তা করবে না। তোমার ডাক্তার সাহেব সব ঠিক করে দেবে। কারোর একটা আছড়ও আসতে দেবে না। প্রমিস! ”

” তুমি নিজেকে সামলাও ডাক্তার সাহেব। তোমাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখতে আমার একদমই ভালো লাগে না। ”

” তামান্না তুমি থাকো। আমি একটু আসছি। ”

” কিন্তু….

তামান্নার কপালে ঠোঁট ছু্ঁয়ে সাদিব জানাল,
” যাবো আর খুব শীগ্রই ফিরে আসবো। ”

” অপেক্ষায় রইলাম! ”

সাদিব চলে যাওয়ার আগে তামান্নার মনে হলো এই বুঝি ডাক্তার সাহেবের সাথে তার শেষ আলিঙ্গন, দু’জনের সাথে দু’জনের শেষ সাক্ষাৎ! আচমকা হারানোর ভয় এসে তাকে ঘিরে ধরল যেন। যেতে দিতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে যেতে দিতে হলো তাকে।
.

.
সাদিবকে বাসায় আসতে দেখে সামিরা বেজায় খুশি হলেন। সাদিবের মনমরা অবস্থা দেখে ভেবেছিলেন সাদিবের সাথে নিশ্চয়ই তামান্নার নতুন কোনো ঝামেলা হয়েছে। এ সুযোগ লুপে নিয়ে তাদের আলাদা করার এটাই মুখ্যম সুযোগ ভেবে বসলেন। হাসোজ্জল চেহারায় সামিরা সাদিবের দিকে এগিয়ে গেলেন। সাদিবকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ওমনি সাথে সাথে সাদিব তাকে না দেখার ভাণ করে এড়িয়ে গেল। সাদিবকে এড়িয়ে যেতে দেখে সামিরা আশ্চর্য হলেন। সাদিব জোরে জোরে ” বাবা বাবা ” বলে হাঁক ডাকতে শুরু করল।

সন্ধ্যের পূর্ব মুহূর্তে আশফাক শিকদার সেসময় সচরাচর বাসায় বসেই কাটিয়ে দেন। আজও তাই করছিলেন। সাদিবের হাঁক ডাকা শুনে তিনি শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সাদিবকে অভদ্রের মতো চেঁচাতে দেখে তার মেজাজ ইতিমধ্যে বিগড়ে গেছে।

সাদিবকে হুঙ্কার ছেড়ে তিনি বললেন, ” কি সমস্যা সাদিব? এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন? এতো অভদ্রতা কোথা থেকে শিখেছ তুমি? ”

সাদিবের ব্যবহার সামিরা যত দেখছেন ততই যেন অবাক হচ্ছেন। রাগান্বিত কন্ঠে ফোড়ন কেটে বলল, ” শিখবে না? বিয়ে তো করিয়েছ পরিচয়হীন একটা অভদ্র মেয়ের সাথে। তার সাথে থেকে তার মতো অভদ্রই তো হবে। স্বাদে কি আর বলি এই মেয়েকে ঘরে তুলতে না? কেউ শোনে আমার কোনো কথা? ”

সাদিবের রাগের আগুনে ঘি ঢালতে সামিরার উক্ত কথাটিই যথেষ্ট ছিল। কড়া চোখে তাকিয়ে সামিরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” কে বলেছে ও পরিচয়হীন? ওর সবচেয়ে বড় পরিচয় ও আমার স্ত্রী। সম্পূর্ণ শরিয়ত মোতাবেক আমি ওকে বিয়ে করেছি। এর পরেও যদি আপনি আরেকবার ওর পরিচয় নিয়ে আজেবাজে কথা বলেন তাহলে আমি ভুলে যাবো আপনি আমার মা। ”

সামিরা বিস্ময় হতে যেন ভুলে গেছেন। এ কোন ছেলেকে তিনি চোখের সামনে দেখছেন? একি তার সেই ছেলে? যে তাকে ছাড়া কারোর কথা মানতো না। সে তিনি যতই ভুল বলুক না কেন! সামিরা আশফাক শিকদারের কাছে অভিযোগ জানিয়ে বলল, ” দেখেছ তোমার ছেলের কান্ড? এরপরেও তুমি বলবে সব দোষ আমার? ”

সাদিবের আচরণে আশফাক শিকদার এতোক্ষণে কিছুটা হলেও আন্দাজ করেছেন, নিশ্চয়ই সামিরার কোনো দোষ রয়েছে। নয়তো সাদিব নিজের মায়ের ওপর এতোটা রেগে যাওয়ার কথা তো নয়! তাইতো এতোসময় চুপ করে থাকলেও এবার তিনি মুখ খুললেন। সাদিবকে সমর্থন জানিয়ে জানতে চাইলেন মূল কারণ। ” কি হয়েছে সাদিব? দয়া করে তুমি কি আমাকে সবটা খুলে বলবে? ”

সাদিব শুরু থেকে সবটা খুলে বলল নিজের বাবাকে। সব শুনে আশফাক শিকদারের মুখের রঙ বদলে গেল। তাৎক্ষণিকভাবে বিনা ভাবনা চিন্তায় তিনি সিন্ধান্ত নিয়ে নিলেন। বললেন, ” বেশ! এতো যখন তোমার ইচ্ছে সামিরা তবে ঠিক আছে। আলাদা করাই হোক! ”

বাবার রায় শুনে সাদিব এবং তার মা দু’জনেই বিস্মিত হলো। তারা ভাবেনি আশফাক শিকদার এতো সহজে বিষয়টি মেনে নেবেন। মনে মনে খুশি হলেন সামিরা। অন্যদিকে সাদিব ভেবেছিল, তামান্নার দিকটা অন্তত সে না বুঝলেও তার বাবা ঠিক বুঝবেন। অথচ সাদিবকে তার বাবাও নিরাশ করে দিয়েছে। সাদিবের তামান্নাকে করা প্রতিশ্রুতি আরো দৃঢ় হলো। সিন্ধান্ত নিলো যাই ঘটে যাক না কেন? প্রয়োজনে সব সম্পর্ক ত্যাগ দেবে তবুও সে তামান্নাকে ছাড়তে রাজি নয়। নিজের সিন্ধান্ত জানাতে যাবে আর সেসময় আশফাক শিকদার আচমকা বলে উঠলেন, ” তবে সাদিব তামান্না নয়। বরং তুমি আমার থেকে আলাদা হবে। তোমাকে ডিবোর্স দেবো আমি। আর এটাই হবে তোমার করা পাপের সবচেয়ে মুখ্যম শাস্তি…..

#চলবে….