#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ১৭)
নুসরাত জাহান লিজা
দীপ্ত দ্বিতীয়বার শ্বশুর বাড়ি এলো। আসার সময় বাস থেকে নামার পরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। শ্রেয়সী রিকশার হুড তুলতে দেয়নি।
“কতদিন পরে এমন দারুণ বৃষ্টি। তুমি আনরোমান্টিকের মতো হুড তুলে দেবার জন্য পাগল হয়ে গেছ কেন?”
“হুড তোলার সাথে আনরোমান্টিক হবার কী সম্পর্ক?” দীপ্ত বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করল।
“বৃষ্টির সাথে আমার প্রেম আছে। এত চমৎকার বৃষ্টি। না ভিজলে বৃষ্টির অপমান হবে। তাই ভিজছি।”
দীপ্ত বলল, “আমার ঠান্ডার ধাত আছে।”
“তুমি ভিজেছ কবে বৃষ্টিতে?”
“ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজলেই ঠান্ডা লেগে জ্বর আসত। তাই বাবা ভিজতে দিত না। আমিও জ্বরের ভয়ে সাবধানে থাকতাম।”
শ্রেয়সী হাত মেলে বৃষ্টির পানি জমিয়ে দীপ্তর মুখে ছিটিয়ে দিয়ে বলল, “আজ বড়বেলায় আমার সাথে ভিজে দেখো। ভালো লাগবে।” বলে আরেকবার আঁজলা ভর্তি করে পানি নিয়ে দীপ্তকে ছিটিয়ে দিয়ে দীপ্তকে চোখ বন্ধ করে ফেলতে দেখে সে সশব্দে হেসে ফেলল।
হাসির শব্দে দীপ্ত শ্রেয়সীর দিকে তাকাল, আর স্থির হয়ে গেল। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দের সাথে বাতাসের শো শো শব্দের সাথে শ্রেয়সীর হাসি সন্ধি স্থাপন করেছে যেন৷ কী অপার্থিব লাগছিল মুহূর্তটা দীপ্তর, সাথে শ্রেয়সীকে মনে হচ্ছিল, কোন সুদূর থেকে আসা কোন সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি যেন। অপ্রিয় বৃষ্টিটা সে-ই ক্ষণেই সে ভালোবেসে ফেলল।
“ঝুম বৃষ্টিতে রিকশার হুড ফেলে ভেজার আনন্দ থেকে কেন বঞ্চিত হবে দীপ্ত? ফ্রেন্ডদের সাথে আগে ভিজতাম এভাবে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল বিয়ের পরে প্রিয়জনের সাথে এভাবে ভিজব। আজ পূরণ হলো।” দীপ্তর হাত ধরে বলল শ্রেয়সী।
দীপ্ত তখনো মোহাবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে শ্রেয়সীর দিকে। শিমুলের একটা কথা মনে পড়ল,
“প্রেমে পড়লে তার আলোয় পুরো পৃথিবীকে সুন্দর মনে হয়। আর যার প্রেমে পড়েছিস তাকে সুন্দর মনে হবে না?”
শ্রেয়সী নিঃসন্দেহে সুন্দরী, তবে আজকের মতো এমন আলোকিত, উদ্ভাসিত, মোহময়ী কখনো মনে হয়নি দীপ্তর কাছে। আজ অন্যরকম এক স্নিগ্ধ আলো যেন শ্রেয়সীতে ভর করেছে। তবে কি সে তার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছে! প্রেমে পড়ার ক্রাইটেরিয়া কী কী!
“কেমন লাগছে?” শ্রেয়সীর কথায় দীপ্ত অবচেতনে অস্ফুটস্বরে বলল, “অপূর্ব।”
“আমি বৃষ্টির কথা জিজ্ঞেস করেছি, প্রেমে পড়ল?” হাসিমুখে বলল শ্রেয়সী।
দীপ্ত আধা সম্বিতে ফিরল, এরপর নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে বলল, “আমি বৃষ্টি আর বৃষ্টিকন্যা, সাথে পুরো মুহূর্তটার কথা বললাম। বৃষ্টি সাথে আরও যে উপস্থিত আছে তারও?”
শ্রেয়সীর মুখের হাসি বদলে চোখে দুষ্টুমি খেলা করল, “রিকশাওয়ালা মামারও?”
বলেই আবারও প্রাণখোলা হাসিতে মুহূর্তটাকে অন্য মাত্রা দিল শ্রেয়সী। দীপ্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মনে মনে বলল, “মুড কি লা র।”
সেদিন রাত থেকেই শ্রেয়সী জ্বর বাঁধিয়েছে। হাঁচি দিতে দিতে অবস্থা খারাপ। তবে বৃষ্টিতে দীপ্ত দিব্যি সুস্থ আছে। সে একবার রেগে শ্রেয়সীকে বলল,
“আরও করো বৃষ্টির সাথে প্রেম। এখন ভোগো। নিষেধ করেছিলাম আমি।”
শ্রেয়সী বিরস মুখে বলল, “তুমি মা’র মতো করে কথা বলছ কেন?”
“তাই বলা উচিত নয়? উনি তোমার ভালো চান, আমিও তাই।”
“ধূর। তোমার সাথে কথাই বলব না।” সত্যি সত্যি সে কথা বলা বন্ধ করে দিল দীপ্তর সাথে। আয়েশার বকা খেয়ে তার সাথেও কথা বলছে না।
শাফকাত সাহেব বললেন, “অসুস্থ হলে ও অভিমানী হয়ে যায়।”
রাতে আয়েশা মেয়েকে জোর করে ধরে মুখে খাবার তুলে দিলেন। মাথায় পানি ঢেলে মুছিয়ে দিয়ে গেলেন।
সকালেও তিনি শ্রেয়সীকে কী সুন্দর করে খাইয়ে দিচ্ছিলেন। মাঝেমধ্যে অবশ্য দুই একবার কড়া কথাও শুনাচ্ছিলেন।
দীপ্ত সেই আদুরে মুহূর্তটুকু মায়ের স্নেহটুকু চোখ ভরে উপভোগ করছিল। সে বহুবার অসুস্থ হয়েছে। বাবা নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছেন সবসময়। মুখে তুলে খাইয়েও দিয়েছেন৷ তবুও ওর বুভুক্ষু মন অগোচরে কখনো সখনো মা’কে খুঁজে বেড়িয়েছে। কিন্তু পায়নি।
তার মা থাকলে তিনিও ওকে এভাবে আদর মাখা শাসন করতেন। কিন্তু তিনি তো থেকেও নেই। ওর সেই মাতৃস্নেহ বুভুক্ষু মন কখন যে মা’কে ঘৃণা করতে শুরু করেছে!
তবুও আজ শ্রেয়সীর মাকে দেখে তাকে ভীষণ মা বলে ডেকে নিজের শূন্যস্থান কিছুটা পূরণ করতে ইচ্ছে করল।
শ্রেয়সীকে খাইয়ে তিনি চলে গেলে দীপ্ত ওকে ওষুধ খাইয়ে দিল। এরপর নিজে খেতে গেল। টেবিলে আয়েশার দিকে তাকিয়ে দীপ্ত কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আন্টি, আমি কি আপনাকে মা ডাকতে পারি?”
তিনি ওর দিকে একরাশ মায়া নিয়ে তাকালেন। ওর কষ্টটা তিনি বুঝতে পারলেন। বললেন, “সে কী বাবা, আমি তো তোমার মা’ই। মা’কে মা বলতে আবার জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি?”
দীপ্ত অস্ফুটস্বরে বলল, “মা… আমি..”
বাকিটা বলতে পারল না, কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তবে আজ ভালো লাগল। নিজের মা’কে তো আপন করে পাওয়া সম্ভব নয়, সে চায়ও না। তবে শ্রেয়সীর মা’কে যে ভীষণ আপন কেউ বলে মনে হলো।
আত্মীক বন্ধন কখনো কখনো যেন রক্তকে ছাপিয়ে যায়। আজ যেমন হলো।
………..
ক্রমশ