#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ১৮)
নুসরাত জাহান লিজা
দু’দিনে দীপ্তর সাথে শ্রেয়সীর বাবা-মার সহজ সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শ্রেয়সীর জ্বরও কমে গেছে। মোহসীন সাহেব প্রতিদিন ফোন করে ওর খবর নিয়েছেন।
আয়েশার জোরের জন্য রবিবার ছুটি ম্যানেজ করতে হয়েছে ওদের। দীপ্ত ঘরে বসেছিল। শাফকাত এসে বললেন, “মেয়েটা এখনো দূর্বল। তুমি একটু বাইরে হাঁটাহাঁটি করে এসো। ভালো লাগবে।”
সে তবুও শ্রেয়সীকে জিজ্ঞেস করল, “বাইরে হাঁটতে যাবে একটু?”
শ্রেয়সী বলল, “থাক। কাল জার্নি করব। তুমি ঘুরে এসো।”
মেয়েটার চোখেমুখে জ্বরের আবহ বিদ্যমান। দীপ্ত এরপর একা একাই হাঁটাহাঁটি করে এলো। বাসার গেটে এসে একজন মহিলাকে দেখল। মহিলার মুখ ভর্তি পান। দীপ্ত গেটের ভেতরে ঢুকছিল, তখন মহিলা পানের পিক রাস্তায় ফেলে ওকে বলল,
‘’আপনে এই বাড়ির পোলা? আয়েশা ভাবিরে একটু খবর দিয়েন তো, বলবেন জামিলা ঘটক আসছে।”
দীপ্ত প্রথমে সুবোধ বালকের মতোই কথা শুনছিল, কিন্তু ঘটক শুনে টনক নড়ল।
“আপনি ঘটক?”
“হ্যাঁ। এই তল্লাটের এক্কেবারে এক নম্বর ঘটক। এইবার ফাস্ট ক্যালাস পাত্র আনছি হ্যার মাইয়্যার লাইগ্যা। অবশ্য পোলার একটু নাক উঁচু। তয় আমি আছি যহন, জুরি তহন ফিক্স করমুই।
দীপ্তর গা জ্বলে গেল। শ্রেয়সীর জন্য পাত্র এনেছে এই মহিলা।
“তয় আমার ডিমান্ড এটটু হাই। কাম ভালা হইলে ডিমান্ড তো চরবই। পাত্রও আনছি টপের। তয় সামান্য লেনদেন আরকি…”
মেজাজের যেটুকু চড়া বাকি ছিল ততটা চড়ে একেবারে যেন সর্বোচ্চ বিন্দুতে পোঁছে গেল দীপ্তর। এই মহিলাকে ওর শুরু থেকেই বিরক্ত লাগছিল। এখন আবার নিজের আর পাত্রের গুণগানের সাথে যৌতুকও চাইছে আকারে ইঙ্গিতে।
“আপনার টপ ক্লাস পাত্র নিয়ে অন্য কোথাও যান। এইখানে আপনাকে প্রয়োজন নেই।”
“দ্যাহেন, আগেরবারও আমারে উনি অপমান করছিল। তাও আমি আবার সব ভুইলা ভালোর জন্য আইছি। আপনে ক্যাডা এমনে কইতাছেন?”
“যার জন্য পাত্র এনেছেন, আমি ওর হাজব্যান্ড।”
“ও। আপনে কী করেন? এইখান থেইকা কী কী দিছে?”
“তাদের সবচাইতে ভালোবাসার মানুষকে দিয়েছেন। আরও কিছু দিতে হবে? আর যারা যৌতুক নিয়ে নিজেকে বিক্রি করে, আমি তাদের দলে নই। আপনি যান। আপনার আর আসার দরকার নেই।”
জামিলার চেহারা হলো দেখার মতো। সে আরও দু’বার পিচিক করে পিক ফেলে ক্ষোভ নিয়ে বলল, “আয়েশা ভাবি আমারে জানাইতে পারত। কামডা ঠিক করে নাই।”
দীপ্ত এই মানসিকতার মহিলার সাথে আর কথা বাড়াল না। রুচি হলো না। সে ভেতরে চলে গেল। একেতো তার বিয়ে করা বউয়ের বিয়ে নিয়ে কথা বলতে এসেছে, তারউপর আবার কী উদ্ভট কথা! এই মহিলার স্পর্ধা দেখে সে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। শ্রেয়সীর বর হিসেবে অন্য কারো সাথে ওর তুলনাও করতে চাইছে আবার। ইচ্ছে তো করছিল আরও কঠিন কথা বলতে। নেহায়েতই সে ভদ্রলোক। তাই ফিরে এলো। তবে সে এখনো ধাতস্থ হতে পারছে না।
বাসায় ঢুকতেই আয়েশা দরজা খুললেন।
“মা, বাইরে একজন মহিলা এসেছিলেন। আপনাকে খুঁজতে। বলল ঘটক।”
“ও, শ্রেয়সী গো ধরেছিল নিজের পায়ে না দাঁড়ানো অব্দি বিয়ে করবে না। কিন্তু আমি তো মা। চিন্তা হতো। তাই তখন কিছু ঘটকের সাথে কথা বলেছিলাম। তাদেরই কেউ হবে হয়তো।”
“একজন মহিলা। অতিরিক্ত কথা বলে।”
খানিকটা ভেবে আয়েশা বললেন, “ও, বুঝতে পেরেছি। সে আবার কোন সাহসে এসেছিল?”
“আমিও তাই বলি। শ্রেয়সীর বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে আমার কাছে। তাও আবার কোন টপ ক্লাস যৌতুকখোর ব্যাটার সাথে। এমন রাগ হচ্ছে।”
আয়েশার ভালো লাগল, এমন কিছু অধিকারবোধ সম্পর্কে জন্মাতে হয়৷ তাহলে সম্পর্ক গভীর হয়। মেয়েকে নিয়ে চিন্তা নেমে গেল তার। দীপ্ত ভালো ছেলে, তার মেয়েকে সে ভালো রাখবে এমন একটা ভরসা এবার এই দু’দিনে তার তৈরি হয়েছে। শ্রেয়সীর অসুস্থতায় যেভাবে খেয়াল রেখেছে দীপ্ত তা মা হিসেবে তার জন্য প্রশান্তির।
দীপ্তর রাগের কারণ হলো, জামিলা শ্রেয়সীর পাশে আরেকজনকে বসিয়ে ওকে দাড়ি পাল্লায় মাপতে চেয়েছে বলে। শ্রেয়সীর সাথে তো ওর নাম জুড়ে গেছে। ওর পাশে নিজের নাম ভিন্ন অন্য কারো নাম শুনলেই এই অনুভূতি হচ্ছে ওর। এর আগেও সৌম্যর কথায় যেমন গা জ্বলে গিয়েছিল। শিমুলের কাছে সেটা শোনার পরে সৌম্যকে সে ফেসবুকে ব্লক করেছে।
এখন শ্রেয়সীর ঘরে বসে সে নিজের ফেসবুকে ঢুকল। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেঞ্জ করা হয়নি দীপ্তর। এখনো সিঙ্গেল দেখাচ্ছে। সে দ্রুত রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস বদলে ম্যারিড করে শ্রেয়সীকেও ট্যাগ করল।
শ্রেয়সী শুয়ে ছিল চোখ বন্ধ করে। দীপ্তর পায়ের শব্দে সে চোখ খুলে তাকিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। সে দেখল ছেলেটা ঢুকেই বিছানার একপাশে বসে ফোন নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন করছে। কপাল কুঁচকে ছিল, কিছুক্ষণ পরে সেখানে মৃদু হাসির ঝিলিক দেখা গেল। সে কৌতূহল চেপে না রেখে প্রশ্ন করল,
“কী করছো? ঘোরাঘুরি শেষ?”
দীপ্ত যেন সহসা খানিকটা চমকে উঠল। এতক্ষণ ঝোঁকের মাথায় কাজটা করেছে। এখন মনে হচ্ছে কেন করল! সে শ্রেয়সীকে বিয়ে করেছে, এটা দুনিয়াকে জানানোর জন্য সে এতটা উদগ্রীব কেন হলো! আবারও সে-ই একই উত্তর পেল, প্রেমে পড়ছে দীপ্ত, নিজের বিয়ে করা বউয়ের। যার এখনো বিয়ের প্রস্তাব আসছে, তো কেউ দাবি করছে তার সাথে বিয়ের সম্ভাবনা ছিল। কী এক যন্ত্রণা!
তাও ভালো সে শ্রেয়সীকে বিয়ে করে আগেই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে বাকিদের থেকে। নইলে কতগুলো প্রতিদ্বন্দ্বী জুটত কপালে কে জানে!
……….
ক্রমশ