#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২৪)
নুসরাত জাহান লিজা
দীপ্ত আর শ্রেয়সী অফিসে চলে গেলে মোহসীন সাহেব গত কিছুদিন থেকে বাইরে যাচ্ছেন। তার এক বন্ধুর কাছ থেকে গাড়ি বিষয়ক পরামর্শ নিলেন এরপর গাড়ি দেখে এলেন। দীপ্ত আর শ্রেয়সীর বিয়ের উপহার হিসেবে এটা দেবার কথা ছিল। দীপ্তকে কয়েকবার বললেও সে কানে তোলেনি কথাটা।
তাই নিজেই উদ্যোগ নিলেন, এবার জন্মদিনে এটাই উপহার দেবেন। সাথে তিনি নিজের হাতে প্রতি বছর ছেলের জন্ম কেক বানান। এবারও বানাবেন।
তবে শ্রেয়সী কেক বানানোর কথা শুনে আবদার করেছে সে-ও সাথে থাকবে। তিনি মানা করেননি। মেয়েটার এই স্বপ্রণোদিত উৎসাহ তার ভালো লেগেছে। দুজনে মিলে এবারের জন্মদিনের আরও কিছু পরিকল্পনা করেছে।
শ্রেয়সী নিজে গিয়ে আরমান ভাই আর তার স্কুলের শিশুদের দাওয়াত দিয়ে এসেছে। শিমুল আসবে শান্তাকে নিয়ে। এই আয়োজনের ঘটা নিয়ে দীপ্তকে আপাতত কিছু জানানো বারণ।
শ্রেয়সী বাবা-মাকে আসতে বলেছিল। কিন্তু মায়ের কোমড় ব্যাথাটা বেড়েছে। লম্বা জার্নি ধকল হয়ে যায় বলে আসতে পারবেন না, মা না এলে বাবা আসার প্রশ্নই আসে না। দু’জনে একসাথে যায় যেকোনো দাওয়াতে বা কোথাও। এখনো একজন আরেকজনকে ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ তারা। তবে না আসতে পারলেও উপহার পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ শ্রেয়সী অফিসের ঠিকানায় পাঠাতে বলেছিল। দীপ্ত যাতে আভাস না পায়।
মোহসীন সাহেব হেসে বললেন, “ধেড়ে খোকার জন্মদিনের এমন আয়োজন দেখলে ওর নিজেরই পিলে চমকাবে।”
শ্রেয়সী হেসে বলল, “কথা ঠিক বলেছ। ধেড়ে খোকার জন্মদিন।”
***
রাত বারোটার পর থেকেই দীপ্তর টাইমলাইনে শুভেচ্ছা পোস্ট আসতে শুরু করে। এসব নিয়ে সে তেমন মাথা ঘামায় না। বাবা ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন বলে তিনি সকালে উইশ করেন। তবে এবার সে ভেবেছিল শ্রেয়সীর কাছ থেকে প্রথম শুভেচ্ছা আসবে। কিন্তু মেয়েটা আজ দেখো, আগে আগে ঘুমিয়ে পড়েছে।
দীপ্ত কিছুক্ষণ উশখুশ করে শুয়ে পড়ল। মনে মনে কিঞ্চিৎ আশাহত হলো। ওর মনে আছে শ্রেয়সীর জন্মদিনে সে আগে উইশ করবে বলে অসুস্থতা নিয়েও বসে ছিল। যখন আর পারছিল না, তখন সময়ের খানিক আগেই এসএমএস করেছিল। অথচ দেখো মহারানী কেমন নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। না, নাক ডাকে না, এমন মিথ্যা অপবাদ দেওয়া যাবে না। তবুও অভিমান যে হয়নি সেটাও নয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে আসতে ভেবেছিল বাবা কেক এগিয়ে দেবেন প্রতিবারের মতো। কিন্তু তা না উল্টো বললেন,
“কী রে? রান্নাঘরের দায়িত্ব থেকে তুই অব্যহতি নিয়েছিস না-কি? সব তো আমি আর শ্রেয়সীই করছি। এসে একটু হাত লাগা আমাদের সাথে।”
দীপ্ত মনে মনে বলল, “ধূর, কেন বিয়ে করেছি আমি? বাপ তো দামই দিচ্ছে না, বউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। কোনো মানে হয়।”
গজগজ করতে করতে এসে রুটি সেঁকে দিল। শ্রেয়সী সবজি করছে। বাবা রুটি বেলে দিচ্ছেন৷ শ্রেয়সীর এখনো রুটি গোল করাটা শেখা হয়নি। তবে মোহসীন সাহেব ওকে গোলা আটা সরাসরি দিয়ে গোল করা শিখিয়েছেন।
মোহসীন সাহেবের রুটি বেলা শেষ হলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন, খাবার আগে তার দুটো ওষুধ খেতে হয়।
দীপ্ত বলল, “আজ কয় তারিখ যেন?” সরাসরি মনে করিয়ে দিতে বাঁধল বলে ইঙ্গিতে মনে করিয়ে দিতে চাইল।
“এগারো তারিখ। এখন দিন তারিখ ভুলে যাচ্ছো নাকি তুমি?”
দীপ্ত মনে মনে গজগজ করতে করতে বলল, “নিজে ভুলে বসে আছে। আবার কীভাবে বলছে দেখো!”
মুখে বলল, “আমি প্রয়োজনীয় জিনিস মনে রাখি। তোমার মতো না।”
শ্রেয়সী মনে করার চেষ্টা করে বলল, “আমি কী ভুলে গেলাম?”
“কিছু না। আমি রেডি হই। অফিসে যাব। শুধু শুধু দেরি করে লাভ নেই।”
“হ্যাঁ দেরি করো না, পরে লেইট হয়ে যাবে।” হেসে বলল শ্রেয়সী।
“ভেরি লেইম জোক।”
দীপ্ত বেরিয়ে গেলে ওর গাল ফোলানো চেহারা মনে করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল শ্রেয়সী।
পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, “আরে, তুমি একাই অফিসে যাবে নাকি! আমিও তো যাব।”
খাবার টেবিলে মোহসীন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “তোর কী হয়েছে রে? ওমন ভল্লুকের মতো মুখ করে খাচ্ছিস কেন?”
“সুখে। আর কী কী বিশেষণ আছে দাও। ভাল্লুক, উল্লুক, গাধা, গরু, ছাগল যা আছে সব বলো।”
“নিজের নাম নিজেই দিচ্ছিস। ভালোই হলো পরিশ্রম কমে গেল আমার।”
শ্রেয়সী আবারও হেসে ফেলল, মোহসীন সাহেবও যোগ দিলেন সাথে। দীপ্ত শুধু রাগ মাখা করুণ চোখে দু’জনকে একবার দেখল।
***
শ্রেয়সী বারোটার পরপরই অফিস থেকে বাসায় ফিরে এলো। সে বলেছিল এসে মোহসীন সাহেবের সাথে রান্না করবে। তবে তিনি আগেই সব গুছিয়ে নিয়েছেন৷ এখন শুধু রান্না চুলায় উঠা বাকি।
“তোমার ছেলে কিন্তু সেই ক্ষ্যাপেছে।”
“বেচারা এটেনশন চাইছিল, তখন পায়নি। সমস্যা নেই আসুক। তখন খুশি হয়ে যাবে। ওকে চিনি তো আমি।”
“বাইরে যেমনই দেখাক, তোমার ছেলে কিন্তু ভেতরে ভেতরে এখনো বড্ড ছেলেমানুষ। বার্থ ডে উইশ না পেয়ে কেমন করছে। অবশ্য ওর উইশ কম পড়েছে নাকি। ফেসবুক ভর্তি ওয়েল উইশার তার।” শেষের কথাটায় খানিকটা যেন ঈর্ষার আভাস।
মোহসীন সাহেব প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন৷ এটুকু অধিকারবোধ সম্পর্কে থাকতে হয়। তাহলে দৃঢ়তা বাড়ে৷ তবে এটা যদি মাত্রা ছাড়ায় তখনই বিষাক্ত হয়ে যায়। ঠিক তার নিজের একদা এক সম্পর্কের মতো।
***
অফিসে অনেকেই দীপ্তকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। জিজ্ঞেস করছে, “বিয়ের পরে প্রথম জন্মদিন। কীভাবে সেলিব্রেট করছেন?”
আর সেলিব্রেট, বাসায় ওকে কেউ পাত্তা দেয় নাকি! ওকে আজ ঘণ্টা দেড়েক আগে ছুটি দেয়া হলো।
যাদের মনে রাখার তাদেরই মনে নেই, বাকি দুনিয়ার উইশ করায় কী আসে যায়। তার মধ্যে একটা শুভেচ্ছাবার্তা শোভার। সেটা সে ওপেন-ই করেনি। একদিনে এত বিরক্তি সে নিতে পারবে না।
বাসায় ফেরার সময় দীপ্ত ভাবল কারো যেহেতু মনে নেই, সে নিজেই মনে করিয়ে দেবে। উল্টো কাজ করবে, সে নিজেই ওদের জন্য উপহার কিনবে। এতে যদি ওদের শিক্ষা হয়। এটাও এক ধরনের প্রতিবাদ ওর পক্ষ থেকে।
সে বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি আর শ্রেয়সীর জন্য একটা শাড়ি কিনল। এরপর মিষ্টি আর রসমালাই কিনে বাড়ি ফিরল। বাবার করা পায়েশটাও এবার মিস হয়ে গেল।
বাসায় ফিরে হতভম্ব হয়ে গেল দীপ্ত। বসার ঘরে এত লোক সমাগম দেখে প্রথমে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, পড়ে চারপাশের আয়োজন দেখে হাসল।
শ্রেয়সী আর মোহসীন সাহেবের দিকে তাকাতে ঘর ভর্তি সকলে একসাথে বলে উঠল, “শুভ জন্মদিন।”
দীপ্ত অবচেতনেই হেসে ফেলল। একরাশ খুশির বাতাস বয়ে গেল মন জুড়ে৷
মোহসীন সাহেব ওকে বসতে ইশারা করে হাতে পায়েশের বাটি তুলে দিলেন, দীপ্ত হাসিমুখে কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “তোমরা আমার সাথে এটা করতে পারলে?”
শিমুল পাশ থেকে বলল, “খাবারের গন্ধে ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে তো। কান্নাকাটি পড়ে কর না।”
“কান্নাকাটি মানে?”
“সব শুনেছি আমরা। এখন ঢং রাখ, আর আয়।”
এবার শ্রেয়সীর দিকে কড়া চোখে তাকায়ে গিয়েও দৃষ্টি নরম হয়ে এলো। মেয়েটা ওর মন জুড়ে একরাশ স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় সবসময়।
সে এগিয়ে যেতে যেতে সুযোগ পেয়ে শ্রেয়সীকে বলল, “আমার উপহার কই?”
“যথাসময়ে পাবে। এখন এসো তো। সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
শাফকাত সাহেব আর আয়েশা ভিডিও কলে কথা বললেন ওদের সাথে।
সবচাইতে আনন্দিত হয়েছে শিশুরা। শ্রেয়সী ওদের সবার জন্য নতুন পোশাক কিনে দিয়েছে৷ এভাবে আনন্দ করার সুযোগ ওরা সবসময় পায় না। আজ এমন আদর পেয়ে সকলেই ভীষণ খুশি।
ওদের খুশি দেখে দীপ্তর মনে হলো, ওর পাশে বাবা সবসময় আছেন, সামর্থ্য ছিল, এখন শ্রেয়সী আছে। এই শিশুদের পাশে এসব নেই। তবুও কী সুন্দর করে হাসতে পারছে, সেই হাসিতে কোনো পঙ্কিলতা নেই৷
দীপ্তকে তো আল্লাহ ওদের চাইতে ভালা রেখেছে। তবে সে কেন এত বিষাদ জমিয়ে রাখবে অপ্রাপ্তির। বরং নিজের প্রাপ্তির আলোয় নিজের কাছের প্রিয়জনদের পাশাপাশি এদেরকেও যদি কিঞ্চিৎ আলোকিত করা যায় মন্দ কী। জীবন তো একটাই, সেটা বৃথা যন্ত্রণায় না ব্যয় করে ভালো কাজে ব্যয় হোক। তাতে সুখের সঞ্চয় জমা হবে হৃদয়ে।
………
ক্রমশ
#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২৫)
নুসরাত জাহান লিজা
বাইরে ভীষণ মেঘ করেছে বলে আরমান ভাই শিশিদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রাত দশটার দিকে। এরপর শিমুল আর শান্তা আরও ঘণ্টাখানেক থেকে বেরিয়ে গেল।
“তোকে দেখে ভালো লাগছে দীপ্ত। কীভাবে উদযাপন করলে তুই খুশি হবি গত কিছুদিন থেকে শ্রেয়সী সেটাই ভেবে গেছে শুধু। তোর মুখে কাঙ্ক্ষিত হাসি দেখে দেখ আঙ্কেল আর শ্রেয়সী কত খুশি হয়েছে। এভাবেই হাসিস সবসময়।” শিমুল যাবার আগে দীপ্তকে জড়িয়ে ধরে সবার অলক্ষ্যে কথাটা বলল।
“সৌম্যকে একবার টাইট দেয়া লাগবে।” দীপ্ত বলতে শিমুল বলল,
“সৌম্যর কথাকে পাত্তা দেয়ার কিছু নেই। ব্যাটা তোর নামে উল্টাপাল্টা কথা ছড়াচ্ছে।”
“পাত্তা দিচ্ছিও না। কিন্তু খুব বিরক্ত লাগছে।”
“আজকের আয়োজনে মদ দে। আমরা পরে এটা নিয়ে কথা বলব। আসি।”
মোহসীন সাহেব দীপ্ত আর শ্রেয়সীর হাতে গাড়ির চাবিটা ধরিয়ে দিলেন।
“বাবা, তুমি এত নাছোড়বান্দা কেন?”
“তোর বাপ তাই।”
“তুমি নিজেই জীবনের সবচাইতে বড় উপহার। তুমি সবসময় আমার মাথার উপরে বটবৃক্ষের মতো থেকো। তাহলেই হবে। অন্য উপহারের আবার আলাদা করে দরকার কী!”
মোহসীন সাহেবের চোখে জল জমেছে, তিনি ছেলেকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমার যা আছে সবই তো তোর। বেঁচে থাকতে তোকে সুখী দেখার যে আকুলতা তা পূর্ণ হয়েছে। এভাবেই দেখতে চাই যতদিন বেঁচে আছি।”
দীপ্ত মনে মনে যা অনুভব করে মুখে সবসময় বলা হয় না, তাই আজ বলল, “বাবা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”
বাবা জানেন সেটা, তবুও অন্তর থেকে উৎসারিত এমন ভালোবাসা মাখা কথাটায় তিনি আরেকবার আপ্লুত হলেন৷ বলতে গিয়ে দীপ্তও আপ্লুত হলো। শ্রেয়সী পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল, ওর চোখের কোণও ভিজে উঠল।
দীপ্তর জন্মদিন সবাই ভুলে যাবার প্রতিবাদস্বরূপ যে উপহার কিনেছিল, এমন আয়োজন দেখে সেটা কোনোরকমে সরিয়ে রেখেছিল। এবার সেটা বের করল। বাবার পাঞ্জাবি আর শ্রেয়সীকে শাড়িটা দিল।
মোহসীন সাহেব হেসে বললেন, “তোর ন্যাকামির লিস্টে কিন্তু আজকের কাণ্ডটাও যোগ হবে।”
দীপ্ত বলল, “কী করেছি আমি?”
শ্রেয়সী পাশ থেকে ফোঁড়ন কেটে বলল, “ধেড়ে খোকা জন্মদিনের উইশের জন্য কেমন ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। সেটা।”
দীপ্তর মুখটা আবারও সকালের মতো হয়ে গেল, কিছু বলতে গিয়েও আবার হেসে ফেলল। আসলেই ভীষণ ছেলেমানুষি হয়ে গেছে। কিন্তু কী করবে সে! বড় হয়েছে বলে কি খানিকটা আহ্লাদ ধরে রাখা যাবে না!
“মোটেও ন্যাকামি ছিল না। আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছিলে। সেটা মেনে নিতে পারিনি।”
“তা এখন কিছু বল। আজকের রান্না সবটা কিন্তু আমি করিনি। শ্রেয়সীও করেছে।”
“সে তো তুমি ট্রেইনার হিসেবে ভালো বলে এত দ্রুত রান্না রপ্ত করেছে।”
শ্রেয়সী রেগে দীপ্তর দিকে তাকালে সে বলল, “ওই আরকি, মানে ট্রেইনিরও একাগ্রতা ভালো ছিল।”
সবাই হেসে ফেলল এবার।
সবাই একসাথে গাড়ি দেখতে পার্কিংয়ে এলো। দীপ্ত শিমুলের সাথে ড্রাইভিং শিখেছিল। এখন রাতেই কিছুক্ষণ তিনজন গাড়িতে বসে ঘুরে এলো। এরপর মোহসীন সাহেব ঘুমুতে চলে গেলেন।
দীপ্ত নিজের ঘরে আসতেই শ্রেয়সী বলল, “তোমাকে কিন্তু কিউট লাগছিল সকালে। বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল দেখতে।”
“এখনো মজা করছো?”
“সত্যিই, মনে হচ্ছিল শিশুরা যেমন প্রত্যাশিত খেলনা না দিলে কাঁদো কাঁদো চেহারা বানায় তেমন আদুরে লাগছিল।” বলেই এগিয়ে এসে শ্রেয়সী দীপ্তর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে সরে গেল। এরপর বলল,
“তখনকার পাওনাটা দিয়ে দিলাম।”
দীপ্ত এগিয়ে গিয়ে আদর ফেরত দিয়ে বলল, “এটা রিটার্ন গিফট। এই শাড়িটা আজ প্রথম পরলে, তোমাকে ভীষণ মানিয়েছে।”
এই শাড়িটা বিয়ের কিছুদিন পরে দীপ্ত কিনে দিয়েছিল, প্রথম উপহার ছিল এটা। তাই আজকের দিনে এটাই পরেছিল। সাথে হালকা কিছু গহনা পরেছে।
দীপ্ত ওর চুল খুলে দিয়ে বলল, “এখন আরও সুন্দর লাগছে।”
শ্রেয়সী হাসল। সে ভেবেছিল দীপ্ত শাড়িটার কথা মনে করতে পারবে না, কিন্তু পেরেছে। তার মানে সে দেখে পছন্দ করেই এই শাড়িটা ওকে দিয়েছিল। সে অনেক বান্ধবীদের কাছে শুনেছে তাদের হাজব্যান্ডরা কখন কোন শাড়ি দেয় পরে মনে করতে পারে না অনেকেই।
শ্রেয়সী বলল “এবার চোখটা একটু বন্ধ করো।”
“কেন?”
“সেটা জানতে হলে চোখ বন্ধ করতে হবে। এত প্রশ্ন করো কেন?”
দীপ্ত হেসে চোখ বন্ধ করল। শ্রেয়সী দীপ্তের হাত ধরে দেয়ালের সামনে নিয়ে এলো। এরপর বলল, “এবার চোখ খোলো দীপ্ত।”
দীপ্ত চোখ খুলল, ওর সামনে দেয়ালে বেশ বড় করে বাঁধানো ওদের বিয়ের একটা চমৎকার ছবি ঝুলছে। যে ছবি তোলার জন্য একসময় মনে মনে ফটোগ্রাফারকে গালাগালি করেছে, সেই ছবিটা আজ ওর চোখে একরাশ মধুময় স্মৃতি হয়ে ধরা দিল। শ্রেয়সী বসে আছে, ওর পেছেন দীপ্ত দাঁড়িয়ে খানিকটা ঝুঁকে মাথাটা ওর বরাবর এনে হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রেয়সীর মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত। দীপ্তর সেদিন মনে যা চলছিল ভাগ্যিস ছবিতে তা ধরা পড়েনি!
আরেকটা ছবি পাশে, দীপ্ত কাঁদছিল, মোহসীন সাহেব ওকে কোলে নিয়ে একটা খেলনা হাতে কান্না থামাবার চেষ্টা করছিলেন। এই ছবিটা দীপ্ত লুকিয়ে রাখে, কান্নাকাটি করছিল, সবাই দেখলে মজা করবে বলে।
“এই ছবি কই পেলে? বুঝেছি, বাবা দিয়েছে। ঘরের শত্রু বিভীষণ।”
“এত কিউট একটা ছবি। আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।”
আজ দীপ্তরও ভালো লাগল, দীপ্তর ভালো লাগার মানুষগুলোকে শ্রেয়সী বাঁধিয়ে এনে দিয়েছে।
***
ওদের নিরপদ্রুপ, নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের আরও একমাস কেটে গেল। দুজন দুজনকে আরও অনেকভাবে আবিষ্কার করল। সময়টা কেটে গেল রঙিন ঝলমলে আবহে।
দীপ্ত এখন গাড়ি নিয়ে আগে শ্রেয়সীকে অফিসে দিয়ে নিজের অফিসে যায়। ফেরার সময় আবার নিয়ে আসে।
মোহসীন সাহেবের এই সুখ দেখে ভারি ভালো লাগে।
দীপ্ত অফিসে বসেছিল। তূর্য এলো দেখা করতে। ওর আরেকজন বন্ধু। বলল, “জরুরি কিছু কথা বলতাম। সময় হবে তোর?”
লাঞ্চ আওয়ার ছিল, ওর সাথে দীপ্ত অফিসের পাশের একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসল।
“তোর চেনাজানা ভালো কোনো উকিল আছে?”
“কেন? কোনো সমস্যা?”
“ডিভোর্সের জন্য। আমি তরুকে আমার কাছে রাখতে চাই, কিন্তু তুলি কিছুতেই দেবে না।”
“ডিভোর্স মানে?”
“তুলির সাথে আর এডজাস্টমেন্ট হচ্ছে না রে। রোজ রোজ অশান্তির চাইতে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো।”
“কিন্তু তরু বয়স অত অল্প, ওর জন্য…” বলতে বলতে থেমে গেল দীপ্ত। নিজের ছেলেবেলাটা তরুর মধ্যে দেখতে পেল যেন।
“তাছাড়া তোরা তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলি। হঠাৎ…”
তূর্য আর তুলির ভালোবাসা অনেকের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল। তুলি হল থেকে রান্না করে নিয়ে আসত তূর্যর জন্য। তূর্যও তুলি বলতে অজ্ঞান ছিল। বিয়ে নিয়েও কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি ওদের। ওমন প্রগাঢ় প্রেমও ফিঁকে হয়ে যায়!
“ভালোবাসা ছিল, কিন্তু পাশাপাশি থাকতে থাকতে একসময় রঙ হারিয়ে যায়। তখন বড্ড রেগুলার, একঘেয়ে হয়ে যায় সব। চাওয়া পাওয়া বদলে যায়। তখন হিসেবের খেরোখাতায় কাটাকুটি চলে। ওত হিসেব করে তো আর সংসার হয় না৷ তখন ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়।”
দীপ্তর মনে ভীতিটা ফিরে এলো আচমকা। ভালোবাসা মরে যায়… কেন এমন হয়! তবে কি ওর জন্য শ্রেয়সীর মনে যে অনুভূতি আছে তাও শুকিয়ে যাবে কোনোদিন! তখন দীপ্ত কী করবে! অসহনীয় এক অস্থিরতা ওকে গ্রাস করল।
…………
ক্রমশ