#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৩৫)
নুসরাত জাহান লিজা
দীপ্ত সকালে খাবার পরে মোহসীন সাহেবের ঘরে এলো, ওকে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে বলেছিলেন তিনি। তখন বাবার মুখোমুখি হতে যতটা ভয় পেয়েছিল, এখন শ্রেয়সীর সাথে কথোপকথনের পরে তা অনেকটাই কেটে গেছে। বুকে সাহস ফিরে আসছে। মোহসীন সাহেব বিছানায় নিজের পাশে ইশারা করে ওকে বসতে বললেন।
তিনি কথা শুরু করার আগে দীপ্তই বলল, “বাবা, আমি স্যরি।”
দীপ্তর মাথা নিচের দিকে, সে তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের দিকে।
“স্যরি আমাকে বলে লাভ নেই দীপ্ত। তুই এখন এই যে মাথা নীচু করে আছিস, তোকে কি আমি এই শিক্ষা দিয়েছিলাম? এমন কাজ কেন করিস যখন নিজের কাছেই নিজের মাথা হেট হয়ে যায়? মেয়েটা কতটা অপমানিত হয়েছে কালকে তোর ধারণা আছে? তোর সাথে যাবে বলে উৎসাহ নিয়ে রেডি হয়ে বসেছিল। ওর চোখ মুখ খুশিতে ঝলমল করছিল। শান্তার ফোন পেয়ে ওর হাসিমুখে যে অপমানের ছায়া পড়ল, ওর দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। তোর জন্য আমাকে এতটা লজ্জায় পড়তে হলো। মেয়েটাও আমার সামনে বসে থাকতে পারল না। পালিয়ে গেল। সম্পর্ক এত সহজ নয়। অনেক মূল্য দিতে হয়।”
দীপ্ত বিছানা থেকে উঠে বাবার পায়ের কাছে বসল, তার কোলের উপরে মাথা রেখে নিশ্চুপ বসে রইল। গতকাল ওই শাড়িটা ভেজানো দেখেই ওর ভেররের ঝড় সাইক্লোনে পরিণত হয়েছিল। শ্রেয়সী ওর মতো এতটা গোছানো নয়, শাড়ি গহনা নিয়ে গদগদও নয়। তবুও সবকিছুর জন্য ওর মমতা সে দেখেছে। ওই শাড়িটা দীপ্তই পছন্দ করেছিল। জানে শ্রেয়সীর কাছে ওটা কতটা স্পেশাল। শ্রেয়সীর মনের উপর দিয়ে যে কতটা ঝড় বয়ে গেছে, জলপাই রঙের জামদানীটা তারই প্রমাণ।
শ্রেয়সীর মন ওই দিগন্তের মতো বিশাল, তাই এতকিছুর পরেও ওর সাথে সহজভাবে কথা বলেছে, ওর ভেতরের বিষাদ মন দিয়ে শুনেছে। আর তার সাথেই কিনা দীপ্ত ওরকম নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ করেছে! এই লজ্জা সে কোথায় রাখবে।
“বাবা, আমি জানি না, আমি চাই না। তবুও বারবার ছেলেবেলা ফিরে আসে। কেন আসে বাবা? তুমি তো সব পারো, আমার সেই স্মৃতিগুলো মস্তিষ্ক থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারো না? আমি সহ্য করতে পারি না।”
মোহসীন সাহেব অসহায়বোধ করেন। নিজেকে একজন অক্ষম পিতা বলে মনে হয়। তার একজন ভুল মানুষকে পছন্দ করার খেসারত তার সন্তানকে এভাবে দিতে হবে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না।
“তুই শ্রেয়সীকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আয় বাবা। তোর ভালো লাগবে। আপাতত শ্রেয়সীদের বাড়িতে যা। দু’দিন থাক। এরপর সময় নিয়ে দূরে কোথাও যা। কক্সবাজার, রাঙামাটি, সিলেট যেখানে তোদের ভালো লাগে৷ দূরত্ব মিটিয়ে নে পুরোপুরি। দূরত্ব যেকোনো সম্পর্কে ঘুণপোকার মতো। ছোট্ট, কিন্তু বিশাল ফোকর তৈরি করে ভেতরে।”
শ্রেয়সী এদিকেই আসছিল, কিন্তু বাবা-ছেলের এমন আবেগী মুহূর্তে সে ঢুকতে চাইল না। দুটো নিঃস্ব মানুষ এতগুলো বছর নিজেদের অবলম্বন হিসেবে বেঁচেছে। দৃশ্যটা ওর বড্ড ভালো লাগল। তবুও সে ফিরে এলো নিজের ঘরে।
***
শিমুলের অফিসের সামনের ক্যাফেটেরিয়ায় দীপ্ত এসে বসতেই সে বলল, “তোকে হাসিমুখে দেখে ভীষণ ভালো লাগছে দোস্ত।”
দীপ্তর হাসি চওড়া হলো। সে বলল, “শান্তা কেমন আছে?”
“ভালো আছে। তোর খবর বল। কী জরুরি কথা?
“শ্রেয়সীকে যখন প্রথম দেখেছিলাম। তখন ওকে খুব নাকউঁচু ঝগড়াটে মেয়ে মনে হয়েছিল। আমি প্রতিশোধ নিতে চাইছিলাম বলে ওর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে চাইছিলাম।”
“এটা পুরোনো কথা। এখন তুই ওকে ভালোবাসিস এটাই তো সবথেকে বড় কথা, তাই না?”
“হ্যাঁ। তা ঠিক। কিন্তু, দেখ, আমি কিন্তু প্রিটেন্ট করছিলাম তখন যে আমি ওকে পছন্দ করি। শ্রেয়সীও তাই ভেবেছিল। তাই বিয়েতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু তখন তো সত্যি সত্যি আমি ওকে ভালোবাসিনি। আমি মিথ্যে অভিনয় করতে করতে ওর প্রতি একটা সম্মানবোধ তৈরি হয়েছিল৷ ভেবেছিলাম সরে আসব। তারমধ্য সব হয়ে গেল। আমার মধ্যে এটা নিয়ে একটা গিল্টি ফিলিং আছে।”
“দীপ্ত, তুই একজনের অনুভূতি নিয়ে খেলতে চেয়েছিলি। যা অত্যন্ত অন্যায় ছিল। কিন্তু এখন ব্যাপারটা ভুলে যা। এখন তুই ওকে ভালোবাসিস। হয় ওকে তুই নিজেই একদিন জানিয়ে দে, নাহয় বেমালুম ভুলে যা। শ্রেফ ভুলে যা।”
দীপ্ত কিছু বলতেই যাচ্ছিল, একটা পরিচিত কণ্ঠস্বরে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল সৌম্য।
“সৌম্য, তুই কখন?”
“তোর সাথে একটা দরকার ছিল শিমুল। সেজন্যই তোর অফিসের দিকে এসেছিলাম। তোদের দুজনকে গভীর আলোচনায় মত্ত দেখলাম। ভাবলাম অপেক্ষা করি। তাই পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
দীপ্তর ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। ওর মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে শিমুল পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলল, “কেন এসেছিস বল।”
“এসেছিলাম তো অন্য একটা দরকারে। কিন্তু পেয়ে গেলাম অন্যকিছু। আহারে, শ্রেয়সীর জন্য খারাপ লাগছে। আমার পাত্রী বাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করলি, মেয়েটা ঠকে গেল।”
দীপ্ত উঠে দাঁড়িয়েছে, হাত মুঠো করেছে নিজেকে শান্ত রাখতে, কিন্তু পারছে না। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সৌম্য, একটা বাজে কথাও বলবি না তুই।”
“বাজে কথা? সত্যি কথাই তো বললাম। আর তুই নিজেই তো একটা আগে বললি কথাগুলো। তুই করতে পারবি আমি বললেই দোষ?”
দীপ্তর ভেতরে আবারও ভয় জেঁকে বসছে। প্রচণ্ড রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে।
“তোর ওই লাল্ট মার্কা চেহারা দেখে পটেছে নিশ্চিত। এটাই মেয়েদের সমস্যা।”
দীপ্ত শ্রেয়সীকে চেনে, তাই ওকে নিয়ে এধরণের কথা ওর সহ্যসীমার বাইরে। আর ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওর স্ত্রীকে নিয়ে কেউ কথা বলবে আর সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে এতটা অক্ষম সে নয়।
দীপ্ত ওর মুঠো পাকানো হাত দিয়েই সৌম্যর মুখ লক্ষ্য করে ঘু ষি চালিয়ে দিল। সৌম্যও তেড়ে এলো। দীপ্তর ঠোঁট থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে৷ শিমুলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল পরিস্থিতি। দীপ্তর অতিরিক্ত রাগকে আরও উস্কাচ্ছিল সৌম্য। দীপ্ত ওর চেপে ধরে আরেকবার ঘুষি মারতে গেল, কিন্তু সৌম্যর কথা শুনে ওর হাত থেমে গেল।
“তোর বউ যদি এসব শুনে কী হবে দীপ্ত? নিজেকে নিয়ে তোর খুব দম্ভ তাই না? আমার গায়ে হাত দিয়ে তুই একদম ঠিক করিসনি।”
দীপ্ত পিছিয়ে এলো। চিৎকার করে বলল, “ওকে তুই কিচ্ছু বলবি না।”
সৌম্যের মুখে পৈশাচিক হাসি, শিমুল বলল, “তুই তো বিয়ে করছিস। এখন এসব কেন তুলছিস সৌম্য?”
ফুঁসে উঠল সৌম্য, “কেন? অপমানবোধ শুধু ওর আছে? আমার নেই? আমি অপমানিত হইনি? আমি কিছুই করব না। ভয় পাস না দীপ্ত। শুধু তোর বউকে সত্যি কথাটা বলব। ও শুধু জানুক এত বেছে বেছে কাকে বিয়ে করেছে। ওর ফোন নম্বরটা আমার কাছে এখনো আছে।” ওর মুখের হাসিটা ফিরে এলো।
দীপ্ত নরম হয়ে এলো মুহূর্তে, “সৌম্য, প্লিজ, আমি তোকে রিকোয়েস্ট করছি।”
সৌম্য সশব্দে হেসে ফেলল, “দাম্ভিক লোকেরা রিকুয়েষ্টও করতে জানে, আরেকটু ভালো করে রিকুয়েষ্ট কর তো৷ আমার মন পরিবর্তন হতেও পারে! দেখতে বড্ড মনোরম লাগছে। এখনকার মারটাও ভুলে যাইনি আমি।”
দীপ্ত একটা ঘোরের মধ্যে আছে। কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। শুধু শ্রেয়সীর চোখে জল সে সহ্য করতে পারবে না।
সে দুই হাত একসাথে জড়ো করে অস্ফুটস্বরে বলল, “স্যরি।”
সৌম্য দীপ্তর এই অসহায়ত্ব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল। শিমুলের পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হলো না।
সৌম্যকে ঠেলে গায়ের জোরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
দীপ্তর মনে হলো, ওর পৃথিবীটা দুলছে। নিজের অপমানবোধ, আত্মসম্মানবোধ সবকিছুর বিনিময়ে হলেও সে কেবল শ্রেয়সীকে ওর পাশে চাইল। শ্রেয়সীর জন্য সে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারে।
দীপ্ত চেয়ারে বসে পড়ল। দৃষ্টিতে এক পৃথিবী শূন্যতা। চারপাশে অনেকেই ওদের দেখছে, অতি উৎসাহী কেউ কেউ মুঠোফোনে ভিডিও করছিল, এসব কিছুই দীপ্তর মাথায় ঢুকছে না।
ওর কেবলই মনে হচ্ছে সব শেষ হয়ে গেল। চারপাশ জুড়ে ভয়াবহ স্থবিরতা যেন!
…………
(ক্রমশ)