তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-৮+৯

0
123

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৮+৯)
নুসরাত জাহান লিজা

শ্রেয়সী প্রতিদিন নিয়ম করে খোঁজ নিল দীপ্তর শারীরিক অবস্থার। ওষুধ ঠিকঠাক মতো খাচ্ছে কি-না তাও জিজ্ঞেস করল। কেমন যেন রুটিনের মতো হয়ে গেছে। তবে দীপ্ত যে মাঝেমধ্যে ওকে ইচ্ছে করে রাগিয়ে দেয় তা সে বুঝতে পারে। খুঁনসুটিটা ওর কাছে বিরক্তিকর থেকে কখন যে উপভোগ্য হয়ে উঠল সে ভেবে পেল না।

সব মিলিয়ে নিজের মধ্যে আশ্চর্য এক পরিবর্তন টের পেল শ্রেয়সী। দীপ্তকে ওর ভালো লাগতে শুরু করেছে, পরিবারের বাইরে প্রথমবার কারো জন্য এমন টান অনুভব করছে। বাড়ি এসেও খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল মাঝেমধ্যেই। জন্মদিনের ঠিক আধাঘণ্টা আগে দীপ্তর টেক্সট মেসেজ পেল।

“ওষুধের জন্য ঘুমিয়ে পড়ব, বারোটা পর্যন্ত বাবা জাগতে দিচ্ছে না এই জন্য। পরে দেখা যাবে সকালের আগে উইশ করাই হলো না। তোমার সাথে পরিচয় না হলে কিছু অনুভূতি আমার জন্য অচেনা থেকে যেত। পৃথিবী আলোকিত হোক তোমার আলোয়। জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন, অত্যন্ত ঝগড়াটে কিন্তু ভীষণ ভালো মনের মেয়েটা।
শ্রেয়সীকে দীপ্ত।”

শ্রেয়সী কতবার যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ল! খুবই ছোট্ট সাধারণ কিছু কথা, তবুও একরাশ ভালোলাগার নির্মল বাতাস ওর হৃদয়কে যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাচ্ছিল মিষ্টি আদুরে একটা সৌরভ, ভালোবাসার পালে জোর হাওয়া দিচ্ছিল। হঠাৎ করেই শ্রেয়সীর মনে হলো, জীবন সুন্দর।

বাবা ওর মধ্যে স্বভাববিরুদ্ধ অন্যমনস্কতা দেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, “কী রে মা, কী এত ভাবিস?”

শ্রেয়সী চমকে উঠে বলল, “কই, কিছু না তো বাবা।”

বাবা আর মা দু’জনেই ওর চমকে উঠা খেয়াল করলেন।

“ঠিক তো?”

শ্রেয়সী ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে, মৃদু হেসে বলল, “একদম ঠিক। আমার আবার কী হবে!”

মা বললেন, “এবার তাহলে আর বাহানা করিস না। বিয়ে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাব।”

শ্রেয়সী সত্যিই ভাবছে এবার। দীপ্ত বর হিসেবে খুব একটা খারাপ হবে না। একটু ঘাড়ত্যাড়া গোছের, তবে শ্রেয়সী তার দাওয়াই জানে। সন্তর্পণে হাসল সে, মিষ্টি হাসি।

***
দীপ্তর ক্ষত শুকিয়ে গেছে প্রায়। মোহসীন সাহেব ওকে এই কয়দিন একটুও বাইরে যেতে দেননি। অফিসে বেশকিছু ছুটি জমেছিল, তা নিতে দীপ্তকে রীতিমতো বাধ্য করেছেন।

তিনি খেয়াল করেছেন দীপ্ত ইদানিং মোবাইলে কথোপকথন চালায়, ওই পারে যে শ্রেয়সী তা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি খেয়াল করেছেন তার ছেলেটা সেই সময় হাসিখুশি থাকে। মেয়েটাও তো তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করেছে। তার সাথেও তো একদিন কথা হলো।

তিনি দীপ্তকে খেতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বাসায় অলস সময় কেমন কাটছে তোর?”

“তুমি তো জোর করে অলস বানিয়ে রেখেছ বাবা।” গোমড়া মুখে উত্তর দিল দীপ্ত।

“হ্যাঁ রে দীপ্ত, শ্রেয়সী মেয়েটা তোর শারীরিক অবস্থা নিয়ে কনসার্ন ছিল অনেক। মেয়েটা তোকে নিয়ে চিন্তা করে, তাই না?”

দীপ্ত বাবার সুরটা ধরতে পারল না, বলল, “হ্যাঁ, তা করে।”

“মেয়েটা কেমন রে?”

দীপ্ত খেতে খেতে উত্তর দিল, “ভালো। মাথায় তার একটু ছেঁড়া আছে, তবে এমনিতে মনটা ভালো।”

মোহসীন সাহেব বললেন, “তোর সাথে তো ভালোই কথা হয় দেখি।” তিনি দীপ্তকে বুঝতে না দিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করছেন।

“হ্যাঁ। বন্ধুত্ব হয়েছে ওর সাথে, সেইজন্য।” বলতে বলতে দীপ্ত এবার খানিকটা সরু চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করে বলল, “শুধুই বন্ধুত্ব, বাবা। এর বেশি কিছু ভেবো না।”

মোহসীন সাহেব অভিজ্ঞ মানুষ, তিনি বুঝলেন তার ছেলে এখনো বন্ধুত্ব পর্যন্তই আছে। এর বেশি এগোয়নি। এখন যদি দীপ্তকে বিয়ের কথা বলেন, নির্ঘাৎ একশো আশি ডিগ্রি ইউটার্ন নিয়ে নেবে। তাই এখন আর কথা তুললেন না।

তবে শ্রেয়সীর সম্পর্কে দীপ্ত ইতিবাচক এখন, এটাকে তিনি কাজে লাগাবেন বলে ঠিক করলেন। দীপ্ত অফিসে যাওয়া শুরু করতেই তিনি শ্রেয়সীর বাবাকে কল দিলেন। বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিলে তিনি জানালেন শ্রেয়সীকে জিজ্ঞেস করে তিনি উত্তর দেবেন।

***
শ্রেয়সী ঢাকায় চলে এসেছে কয়েকদিন আগে। আজ হঠাৎ বাবা এসেছেন ওর সাথে দেখা করতে।

“বাবা, তুমি এসেছো!” শ্রেয়সী বাবাকে অপ্রত্যাশিতভাবে সামনে দেখে শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠল।

বাসায় এসে বসার ঘরে বসল দু’জন।

“মা আসেনি?”

“ও তোর নানু বাড়িতে গেছে।”

দুজন আরো কিছু কথা বলার পরে শ্রেয়সী রান্না ঘরে গেল। রাইস কুকারে ভাত দিয়ে গতকালের মুরগিটা গরম করে নিল, সাথে আসার সময় হোটেল থেকে কিছু ভাজি কিনে এনেছিল সেগুলো রাখল টেবিলে। সে টুকিটাকি রান্না পারে, এটা ওর কাছে পৃথিবীর সবচাইতে ধৈর্যের কাজ বলে মনে হয়। সোমাটা বাড়িতে গেছে পরশুদিন। সে একাই বাসায় এখন।

দুপুরে খেতে খেতেই বাবা বললেন, “দীপ্তির বাবা মোহসীন ভাই সেদিন কল করেছিলেন।”

শ্রেয়সী উৎকর্ণ হয়ে রইল পরের কথাটুকু শোনার জন্য, প্লেটে ওর হাত থমকে গেল ক্ষণেকের জন্য।

“উনি বিয়ের প্রস্তাব আবার দিলেন। তুই তো সেদিন বাসের ঘটনাটা বলেছিস। ও তোকে সাহায্য করেছে। তোর মাকে এখনো বিষয়টা জানাইনি৷ ভাবলাম আগে তোর মতামতটা নিই। মোহসীন ভাইও তোর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে।”

শ্রেয়সীর পৃথিবীটা মুহূর্তের জন্য যেন অন্য এক আবেশে ভরে উঠল। দীপ্তর সাথে একটা সুখী সুখী সংসারের ছবি খেলে গেল ওর চঞ্চল দুটো চোখের তারায়। দীপ্ত নিশ্চয়ই তার বাবাকে বলেছে, নইলে তিনি তো আর বিয়ের প্রস্তাব দেবেন না৷ এটাই মনে হলো শ্রেয়সীর।

“কী হলো? বল মা? তুই কি রাজি নোস?”

শ্রেয়সী একটু সময় নিয়ে ধাতস্থ হয়ে বলল, “তুমি ভাবতে পারো বাবা, আমার আপত্তি নেই।”

বলতে গিয়ে যে কী ভীষণ লজ্জা করল, লাল নীল বেগুনি সব রঙের ছাপ যেন বাবা দেখে ফেলল এটা ভেবে।

বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তুই ভীষণ সুখী হবি মা। পৃথিবীর সব সুখ আল্লাহ তোকে দিক, এই দোয়া রইল।”

শ্রেয়সী এখনো বাবার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। নিজের এই দিকটা ওর কাছে বড্ড অচেনা লাগল। বাবাকে সে অকপটে সব কথা বলতে পারে। তবে আজ এত লজ্জা কোত্থেকে এসে ভীড়ল ওর মনে!

“আলহামদুলিল্লাহ। এবার তাহলে তোর মায়ের সাথে কথা বলে মোহসীন ভাইকে গ্রিন সিগনাল দিয়ে দেই।”

***
শ্রেয়সীর বাড়ি থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে তিনি আজ দীপ্তের কাছে কথাটা পারলেন৷ সব শুনে দীপ্ত প্রথমে হকচকিয়ে গেল এরপর ক্ষ্যাপা স্বরে বলল,

“বাবা, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত তুমি নেবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করবে না?”

“সমস্যা কোথায়?”

“আমি বললাম আমরা ভালো বন্ধু, এর বেশি কিছু নই। তাহলে?”

“বন্ধু, ভালো মেয়ে, তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায় তোর? তোকে আমি সুখী দেখতে চাই। তাই তোর সুন্দর একটা সংসার হোক সেই ব্যবস্থা করছি।”

দীপ্ত রেগে গেলে ওর মাথা ঠিক থাকে না। সে এরকম একটা সময়ের জন্য একসময় অপেক্ষা করেছে। এখন প্রত্যাখ্যান করে জ্বালা জুড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু এখন ওর মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা নেই৷ সত্যি সত্যি সে শ্রেয়সীকে ভালো বন্ধু ভাবে। একটা সম্মানবোধ তৈরি হয়েছে ওর জন্য। কিন্তু তাই বলে বিয়ে? সে রেগে বলল,

“সংসার করলেই সুখী হবো? তুমি তো সংসার পেতেছিলে। সুখী হতে পেরেছিলে? তুমি অন্তত এটা বলো না যে বিয়ে করে মানুষ সুখে থাকার জন্য।”

কথাটা মোহসীন সাহেবের যে কোথায় গিয়ে লাগল, তা কেবল তিনিই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন। দুনিয়ার কারো কথাই তিনি গায়ে মাখেন না বহুকাল হলো। কিন্তু নিজের একমাত্র সন্তান যখন তার একটা অপূর্ণতাকে তীর হিসেবে ব্যবহার করে, সেটার আঘাত তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। তিনি ভাঙা গলায় বললেন,

“নিজের প্রাণাধিক প্রিয় মানুষকে সুখী দেখতে চাওয়ার জন্য যে আগে নিজেকে সুখী হতে হবে এটা জানা ছিল না। তোর লাইফ, তুই ডিসাইড কর। খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নিস। আমার ঘুম পেয়েছে।”

দীপ্তর সম্বিৎ ফিরল। সে বুঝতে পারল বড্ড ভুল করে ফেলেছে। ম্যাসিভ ব্লান্ডার হয়ে গেছে রাগের মাথায়। সে খাবার আর খেল না, সাথে সাথে উঠে বাবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। কিন্তু ভেতর থেকে বন্ধ।

“বাবা, প্লিজ, দরজাটা খোলো। আমি মিন করে কিছু বলিনি। স্যরি, বাবা, তোমার সাথে এখনই একবার কথা বলব।”

কিন্তু দরজা খুলল না, “বাবা, তুমি তো চেনো আমাকে, আমি এভাবে বলতে চাইনি। তুমি ছাড়া আমার কে আছে।”

“গিয়ে ঘুমিয়ে পড় দীপ্ত। সকালে কথা বলব। আমি এখন একা থাকতে চাই। তাতে তোর সমস্যা নেই আশা করি।”

দীপ্ত বাবাকে সবসময় সহজ আর প্রাণবন্ত দেখেছে। মজার ছলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছে। কিন্তু আজকে পুরো অন্যরকম। এত কঠোর তিনি ওর উপরে কোনোদিন হননি। তার চোখে এমন গভীর বিষাদের ছায়াও সে কোনোদিন দেখেনি। তবে বাবার কথা সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। কখনো কখনো মানুষকে একা থাকতে হয় নিজের সাথে যুঝতে। তাই সে স্পেসটা দিল।

সেই রাতে বাবা-ছেলে কারোর চোখেই ঘুম নামল না। একটা দীর্ঘ নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিতে দিতে দীপ্ত ভাবছিল ওর ভবিতব্যকে। সংসার মানে ওর কাছে একটা অসুস্থ পরিবেশ, একটা অসুখী সোনার উত্তপ্ত খাঁচা। যেখানে সারাক্ষণ বিষদাঁত বের করে র ক্তা ক্ত করা আর র ক্তা ক্ত হওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। বিয়ে করলে জৈবিক নিয়মে সন্তান আসবে পৃথিবীতে। নিজে যার মধ্য দিয়ে গেছে ওর সন্তানকে সে কীভাবে তেমন একটা অসুস্থ পরিবেশে আনবে। ওর বাবাকে যে দুঃসহ বেদনার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়েছে, সমাজ তাদের যেভাবে হিংস্র নখদন্ত বের করে আঁচড়েছে, তেমন বিষাক্ত পরিস্থিতিতে সে নিজেকে দাঁড় করাতে পারবে না। কিছুতেই পারবে না।

নিজের ছেলেমানুষির জন্য শ্রেয়সীকে ইমপ্রেস করতে চাওয়ার কৌশল ওর উপরে আজ কটাক্ষ হেনে হাসছে। এই পরিস্থিতি ওর নিজের হাতে তৈরি করা। কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন তাও সে আর করতে পারবে না। শ্রেয়সীর হাসি মুখটা ভেসে উঠল। না, দীপ্ত ওকে এখন আর অপমান করতে পারবে না। ওর কিছু হয়ে গেল কি-না সেই চিন্তায় মেয়েটার চোখে সে সত্যিকারের আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখেছিল। ও যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে তার জন্য অবিরাম ওর আরোগ্য কামনা করে গেছে। তার মধ্যে ভীষণ আন্তরিকতার ছাপ ছিল। আরমান ভাইয়ের চ্যারিটিতে সে স্বপ্রণোদিত হয়ে একজন মেম্বার হয়েছে, কারো মধ্যে সত্যিকারের মমত্ববোধ না থাকলে তা সম্ভব হয় না।

কিন্তু একসময় তো সম্পর্ক রঙ হারায়, এক ছাদের তলায় থাকতে থাকতে ধূলো পড়ে যায় সম্পর্কে। তখন যদি পরস্পরের কাছে অসহ্য হয়ে উঠে, সেটাও সহ্য হবে না ওর।

দীপ্ত ঠিক করল অসম্মান না করে খুব ভালোভাবে শ্রেয়সীকে ওর উদ্দেশ্যটা খুলে বলবে। এখনকার অনুভূতি খুলে বলবে। তারপর মেয়েটা যে সিদ্ধান্ত নেবে, তাই সে তখন নাহয় মেনে নেবে।

***
সকালে দীপ্তর সাথে বাবার দেখা হলো না, তিনি একটা চিরকুট লিখে বেরিয়ে গেছেন৷ চিরকুটটা দীপ্তর টুথপেষ্টের উপরে রেখে গিয়েছেন। ভোরের আগে আগে ওর ঘুম এসেছিল।

“রান্না করা আছে। আমি বাজারে গেলাম৷ ফিরতে দেরি হবে।”

এটুকুই লেখা। দীপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। আজ অফিসে না গেলেই নয়। কিছুদিন আগেই বেশকিছুদিন ছুটি কাটিয়েছে। আজ মিস করার উপায় নেই। সে ব্যর্থ মনোরথে অফিসে চলে গেল। খেতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু খাবার গলা দিয়ে নামল না। বাবার সাথে একবার অফিসে যাবার আগে কথা না বলে ও শান্তি পাচ্ছিল না।

সাড়ে এগারোটার দিকে মিটিং শেষ করে ডেস্কে বসে শ্রেয়সীকে মেসেজ লিখছিল, যে দেখা করতে চায়, তখনই ওর ফোনে পাশের ফ্ল্যাটের শফিকুল আঙ্কেলের কল এলো। সে ভয়ে কলটা ধরল। সচরাচর তো উনি কল দেন না।

“দীপ্ত, মোহসীন ভাইয়ের হঠাৎ করেই ব্লাড প্রেশার ভীষণ বেড়েছে। আমি শব্দ পেয়ে বেরিয়ে দেখি উনি তোমাদের দরজার সামনে পড়ে গেছেন। আমি হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। চলে এসো।”

দীপ্তর ভেতরে অসহনীয় এক ভয় ওর হৃৎপিণ্ডকে যেন খামচে ধরল। ছুটে বেরিয়ে এলো, অফিসের গাড়ি দিয়ে দিল ওকে।

বাবার সামনে এসে বসল দীপ্ত। অপরাধবোধে সে এতটুকু হয়ে গেছে। ডাক্তার জানিয়েছে, অতিরিক্ত টেনশন থেকে ব্লাড প্রেশার বেড়েছে। দীপ্ত জানে গতকাল ওর কথার জন্যই বাবা কতটা গভীর কষ্ট পেয়েছেন।

“স্যরি বাবা। আমি…”

মোহসীন সাহেব দীপ্তর হাতটা ধরলেন পরম স্নেহে, বললেন, “সবার ভাগ্য একরকম হয় না বাবা। আমি সংসার করতে পারিনি, কিন্তু অনেকেই তো আমৃত্যু একসাথে কাটিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে। একটা ইনসিডেন্ট দিয়ে সম্পর্কগুলোকে বিচার করা অন্যায়। তাছাড়া দেখ, আমার মধ্যে আজ হঠাৎ করে মৃত্যু চিন্তা ঢুকে গেছে।”

দীপ্ত বাবার হাত শক্ত করে চেপে ধরল, কথা বলতে পারল না সহসা।

“যাবার আগে তোর জীবনটা গোছানো সেটা দেখে না গেলে শান্তি পাব না বাবা।”

দীপ্ত বাবার বুকের উপরে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

“তুমি এসব বলো না বাবা। আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি ছাড়া তো আমার কেউ নেই, তবুও এমন নিষ্ঠুর কথা কী করে বলছ তুমি?”

মোহসীন সাহেব কিছু বললেন না, কেবল দীপ্তর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম স্নেহে।

দীপ্ত খানিক পরে বলল, “আমি বিয়েটা করব বাবা।”

“তুই নিজের মনের কাছে পরিষ্কার তো?”

সে পরিষ্কার নয়, জানে সবটা জানলে শ্রেয়সী ওকে ভুল বুঝবে। তবুও সে বলল,

“পরিষ্কার। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো আগে। তার পরপরই বিয়ে হবে।”
…………..
(ক্রমশ)