#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১২
অফিসে কাজের তেমন চাপ নেই। শান্তশিষ্ট একটা দিন। কোনো ঝুট ঝামেলা নেই। আজকের সকালের আবহাওয়া যেন আরো দারুণ। তনয়ার মন আজ ভালো। বাসন্তী রঙের একটা থ্রি পিস তার পরনে। দুই হাতে দুইটি বালা পরেছে। চোখে এক কাজল এঁকেছে। এমন সাজগোজ সে রোজ করে না। আজ করতে ইচ্ছে করল। ভীষণ রকম ভাবে সাজতে ইচ্ছে করল। তাই সেজেও নিল। তন্ময় কিয়ৎকাল মুগ্ধ নয়নে তাকে পরখ করল। মৃদু হেসে বলল, “একটি টিপের বড় অভাব!” তনয়ার মনে দাগ কে*টে রইল। একটি টিপ! ইশ্! মনে কেন ছিলো না? পরে নিত। আফসোস হচ্ছে এখন ভীষণ। কিই বা ক্ষ*তি হতো টিপ পরে নিল। বহুক্ষণ টেবিলে বসে থেকে নিজেকে সে দু*ষছে। আজ যেন বড্ড অ*প*রাধ করে ফেলেছে। তার কানে কেবল একটি কথাই বাজছে, “একটা টিপের বড্ড অভাব!” ইশ! মনটা যেন কেঁদে উঠল। কি বি*ষ*ণ্ণ অনুভূতি! কিন্তু বি*ষ*ণ্ণতা নিয়ে বসে থাকলে যে হবে না। কাজ সারতে হবে। কাজ যে অনেকখানি বাকি। টেবিলের উপর ফাইল গুলো নাড়াচাড়া করতে শুরু করল তনয়া।
নতুন প্রোডাক্টের প্যাকেজিং ডিজাইনের যে কাজটুকু বাকি ছিলো সেটা শেষ করে ম্যানেজার সাহেবের কেবিনে নিয়ে এলো তনয়া। ম্যানেজার সাহেব তার কাজের বিশেষ প্রশংসা করলেন। ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “স্যারকে একবার দেখিয়ে নাও তনয়া।”
“স্যার কে তো দেখানো হয়েছে।”
“জানি। কিন্তু শেষবারের মতো একবার দেখিয়ে নিলে ক্ষ*তি নই। সব ফাইনাল হবার পর যদি বলে প্যাকেজিং তার পছন্দ হয়নি তখন কি করবে?”
তনয়া চোখ মুখ কুঁচকে নিল। বলল, “ম*ন্দ বলেননি স্যার। তাদের মতিগতির তো ঠিক নেই। আমি আরেকবার দেখিয়ে নিবো!”
ম্যানেজার সাহেব কথা শুনে খুশি হলেন। তনয়া ফাইল হাতে বেরিয়ে এলো। ফের গেলো স্যারের কেবিনের সামনে।
উষ্ণ স্যার ফাইলটি উল্টেপাল্টে দেখে রেখে দিল। সরস কণ্ঠে বলল, “ঠিক আছে!”
তনয়ার ম*নক্ষু*ণ্ণ হলো। একটু এপ্রিশিয়েট করল না। কি আশ্চর্য! টেবিলের উপর থেকে ফাইলটি নিয়ে বলল, “তাহলে স্যার ফাইনাল করে দিচ্ছি।”
“হ্যাঁ, দিন।”
বলেই নিজের ল্যাপটপে মনোযোগ দিল। মনোযোগ ছিলো তো একটা বাহানা কেবল। তনয়ার দিকে ফিরে তাকাতে তার যেন ভীষণ ল*জ্জা লাগছে। আজ মা*রা*ত্মক সুন্দরী লাগছে তনয়াকে। তাকে যতই অ*স্পৃহ কণ্ঠে বলুক না কেন? অথচ তাকে আরো একটিবার দেখার জন্য মন ব্যা*কুল হয়ে উঠেছে। তার আকুতি কি তনয়ার কানে পৌঁছেবে? তনয়া কেবিন থেকে বের হতেই যাচ্ছিল। উষ্ণ স্যার সাথে সাথেই তাকে শুধালো, “ফ্রাইডের প্ল্যান কি মিস তনয়া?”
– আমায় বলছেন স্যার?
– হ্যাঁ, ফ্রাইডে আপনার বিশেষ কোনো কাজ আছে?
তনয়া একটু ভাবল। এই ফ্রাইডে সে তন্ময়ের বাসায় আন্টি আংকেলের সাথে দেখা করতে যাবে। হ্যাঁ, বিশেষ কাজ তো আছেই। উষ্ণ সাথে সাথেই বলে উঠল, “কিছু ফরেইন ক্লাইন্টদের সাথে আমাদের মিটিং আছে। ম্যানেজার সাহেব সেদিন আসতে পারবে না। আপনি তো অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার, তাই আপনাকেই বলছি! ইদানিং আপনার হাতে বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে নতুন প্রজেক্টের দায়িত্ব আপনাকেই দেওয়া হবে!”
তনয়া কিয়ৎকাল নিশ্চুপ থেকে অবাক কণ্ঠে বলল,“সত্যি স্যার?”
উষ্ণ মাথা দুলাল। তনয়া দু সেকেন্ড চিন্তা করল। না! এই সুযোগ তো হাত ছাড়া করা যায় না। কিন্তু তন্ময় কে না বলবে কি করে? কিছুই যে ভাবতে পারছে না সে। দুটনায় পড়ে গেল যেন। উষ্ণ স্যারের তী*ক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করছে তার উপর। কাজল কালো ঘন আঁখি দুটি ছোটাছুটি করছে বেশ। উষ্ণ স্যার ফের বলল, “আমরা তাহলে যাচ্ছি মিস তনয়া। সন্ধ্যে বেলায় আপনার বাড়ির সামনে গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে!”
তনয়া স্ব*স্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক তন্ময়ের বাসায় সে দুপুরের লাঞ্চে যাবে। সন্ধ্যার আগে আগেই ফেরত চলে এলেই তো হলো। তনয়া মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে গেল। ইদানিং সবকিছু এতো ঠিকঠাক কি করে হচ্ছে?
অফ ডে তে তন্ময়ের বাসায় গিয়ে তনয়া বেশ অ*স্ব*স্তিক*র পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। কারণ তন্ময়ের মা তাকে জোর করছে তন্ময়ের জন্য মেয়ে দেখতে। তাকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে। এমন সব বি*ষা*দকর পরিস্থিতি সবসময় কেন যে তারই সাথে হয় সে বুঝতে পারে না। আজ এ বাসায় আসল বলে শাড়ি পরেই এসেছিলো সে। তন্ময় তখন খোঁচা মে*রে বলেছিলো, “শাড়ি পরে কেন এলি? এটা কি তোর শশুরবাড়ি?”
তনয়া হেসে উঠলো। খোঁচা টা তার গায়ে খোঁ*চার মতো নয়, ফুলের টোকার মতোই ঠেকল। তন্ময়ের মা তখন আড়চোখে চাইলেন। তিনি কি তবে অন্যকিছু ভাবছেন? তন্ময়ের বাবা মতিউর আলম বেশ রা*গী মানুষ। ভীষণ শক্ত তিনি। সবসময় গম্ভীর মুখে বসে থাকেন। কিন্তু তনয়ার সাথে আজ তিনি বেশ হেসেই কথা বলছিলো। এগুলো যেন চোখে লাগল মায়ের। তিনি যে কিছু স্থি*র করতে পারছেন না। কারণ তনয়া তো এতিম। এতিম মেয়ের কাছে ছেলে বিয়ে দেয়া তার সাথে বড়ই অযৌ*ক্তি*ক ঠেকল। একটিমাত্র ছেলে তাঁর। শশুরবাড়ির আদর পাবে না বুঝি? মেয়ে যতই ভালো, সুন্দরী আর সুশীল হোক না কেন? এতিম মেয়ের কাছে ছেলে বিয়ে দেয়ার মতে তিনি নেই। এখন তন্ময়ের বাপের পছন্দ হলেও তিনি এতে মত দিবেন না বলেই স্থি*র করে নিয়েছেন!
খাবারের টেবিলে বেশ কথাবার্তা হলো। তন্ময় এখনো ওখানকার বাসা ছেড়ে দেয়নি। এর কারণ তার অফিস। এ বাড়ি থেকে অফিস যে অনেক দূরে। তাই ওখানকার বাসায় থাকার মনস্থি*র করে নিল তন্ময়। এসব কথা শুনে মায়ের মন আরো বিচলিত হয়ে উঠলেন। ছেলেটা একা থাকবে? মেয়েটা যদি কিছু করে নেয়। না না! খোদা তুমি দেখো। মনে মনে ইয়াছিন সূরা খতম দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাতে করে তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব হয়ে যায়। ছেলেটা যেন এবার আর কোনো মেয়ের ফাঁদে পা না দেয়। আগের মেয়েটাও তো মা ছিলো না। এসব মা ম*রা মেয়েরা সংসার বুঝে না। তাঁরা সংসার সামলাতে পারে না। কি অদ্ভুত তার চিন্তা ভাবনা। ভা*গ্যি*স মনের কথা মানুষ শুনতে পারে না। নাহলে তনয়ার কি হতো? সে কতোটা ক*ষ্ট পেতো এসব শুনে?
বিকেলের দিকেই তনয়াকে রওনা হতে হলো। তন্ময় কোনভাবেই তাকে একা ছাড়তে রাজি না। বাইকে করে দিয়ে আসবে বলে উঠে দাঁড়াল। মা তৎক্ষণাৎ শুধাল, “তোর যাবার কি দরকার?”
কথাটা শুনেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেল তনয়ার। আন্টি ওমনভাবে কেন বলল? তিনি কি তাকে পছন্দ করে না। কেমন আড়চোখে তাকাল মনে হলো। তনয়ার ভ*য় হচ্ছে। ভীষণ রকমের ভ*য়ে*র চাদরে নিজেকে জড়িয়ে নিলো সে। তন্ময় হেসে উঠে বলল, “তা কি করে হয় মা? ও একা একা এতো দূর যাবে?”
বাবাও সাথে তাল মিলিয়ে বললেন, “তাই তো! মেয়েটি কি একা যাবে। তন্ময় সাবধানে দিয়ে আসিস তাকে।”
মা বোধহয় একটু রে*গেই গেলেন। চাপা রা*গ নিয়ে হাসলেন তিনি। এই মেয়েটি কি তার সংসারে অস্তি*ত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে? এখন থেকেই! বুঝতে পারছেন না ঠিক করে!
.
তন্ময় বাসার সামনে নামিয়ে দিল তনয়াকে। গাড়ি এখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে। তন্ময় হেসে বলল, “মনে হচ্ছে এবার তোর প্রোমোশন কেউ আটকাতে পারবে না তনু!”
তনয়া হেসে উঠল। এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে। একটিবার পিছন ফিরে চাইলো সে। তন্ময় হাত নাড়িয়ে তাকে বি*দায় দিয়ে হেলমেট পরে নিল। গোধূলি এই লগ্নে এমন বি*দায় যেন বি*ষাদ*কর হয়ে উঠল তনয়ার কাছে। গাড়িতে বসার পরে থেকে তার অ*স্ব*স্তি শুরু হচ্ছে। মনে হচ্ছে কি যেন নেই। কিছু একটা হা*রিয়ে ফেলল। হ্যাঁ, তন্ময়ের সঙ্গ! সেই সময়, তার পারফিউমের গন্ধ সবকিছু যেন আলাদা হতে শুরু করেছে। কিন্তু তনয়া একদম এসব চায় না। সে আরো আঁকড়ে ধরতে চায় এসব। গন্ধ যেন চলে না যায়। এই ভেবেই দু হাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরল। কি অদ্ভুত বোকামো তার। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে!
গাড়ি এসে থামল ফাইভ স্টার এক হোটেলের সামনে। তনয়ার বোধহয় একটু দেরি হয়ে গেল। মাথা উঁচু করে হোটেলের উচ্চতা পরখ করল। হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে থেকে দ্রুত ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। লিফটে উঠে শেষবারের মতো নিজেকে ছোট আয়নাতে দেখে নিল তনয়া। একবার ওয়াশ রুমে যাবে কি? না! ঠিকঠাকই লাগছে। এভাবে জায়গা সুন্দর হলে সবকিছুই সুন্দর লাগে। তখন মুখের ক্লান্তি আর দু একটা খুঁত চোখে পড়ে না। নিজে কনফিডেন্স থাকলে সবকিছুই সহজ হয়ে যায়। লিফট থেকে বেরিয়ে সামনে তাকাতেই চমকে উঠল তনয়া। এতো সুন্দর জায়গা সে বোধহয় আগে কখনো দেখিনি। এতো বড় আর সুন্দর ভাবে সাজানো জায়গাটি দেখে একটু অবাক তো হতেই হলো তাকে। চারদিকের লাইটিং আরো আকর্ষণীয়। সবকিছু কেমন শান্ত আর নিরব। পুরোই ভিআইপি জায়গা। কিন্তু মানুষ নেই কেন? একজন লোক তাঁর দিকে এগিয়ে এসে বলল, “ম্যাম আমার সাথে আসুন!”
কি আশ্চর্য! জিজ্ঞেস ও করল সে কে? এখানে আদৌও হচ্ছেটা কি? লোকটার পিছন পিছন তনয়া চলতে লাগল। মনে হচ্ছে সে এখনকার ওয়েটার। চারদিকে নজর দিচ্ছে বারংবার। মানুষের অনুপস্থিতি তার মনে সন্দেহ জাগ্রত করছে। লোকটা এগিয়ে এসে থেমে গেল। সামনে থেকে সরে দাঁড়াতে তনয়ার ভারী বিস্মিত হলো। এখানকার আকাশ! কি সুন্দর! সৌষ্ঠবপূর্ণ আকাশ। কতোটা স্বচ্ছ আকাশ। চিকচিক করছে তারাগুলো। চঞ্চল আঁখি জোড়া খানিকক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। সে যেন কতো ভবনে ছিলো? ফিফটিন ফ্লোর না? এখানে কাঁচের দেওয়ালের বাইরে স্বচ্ছ আকাশ তনয়ার মনোযোগ কেড়ে নিল। পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ? স্যার নাকি? হ্যাঁ, লম্বা চুল তার ছাড়া আর কার আছে শুনি? তনয়া নরম গলায় শুধাল, “স্যার!”
উষ্ণ চৌধুরী পিছন ফিরে তাকাল। তনয়ার চোখে যেন ঝিলিক এসে পড়ল একবিন্দু। উষ্ণ স্যারকে আজ যেন একটু বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে। উষ্ণ স্যারের এক হাত প্যান্টের পকেটে অন্য হাতে ওয়াইনের গ্লাস। সে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে একবার তনয়াকে পরখ করল। তার চোখ সরতে চাইছে না। প্রথমদিন অফিসে এসেও শাড়ি পরিহিত তনয়াকে দেখে সে মুগ্ধ হয়েছিলো। আজ আবারো হলো। এই মুগ্ধতার রেশ অন্যরকম। বিভোর হয়ে ছিল সে। প্রতি বার তনয়াকে দেখলে তার হাল এমন হয়। কোনো নে*শা ছাড়াই নে*শাক্ত হয়ে পড়ে তার হৃদয়। কি ভ*য়া*বহ সাং*ঘা*তিক কথাবার্তা! প্রেমের চেয়ে নে*শাক্ত আর কিছু আছে নাকি? ভালোবাসার চাদরে একবার নিজেকে ঢেকে নিলে বের হবার উপায় নেই যে। ঘোরের তীরে ভা*ঙ*ন ধরল তনয়ার স্বরে। তনয়া শুধাল, “তারা এখনো আসেনি স্যার?”
– এসে যাবে, আপনি বসুন মিস তনয়া।
চেয়ার এগিয়ে দিল সে। তনয়া বসে পড়ল। তার মুখোমুখিতে উষ্ণ বসে পড়ল। কিছুক্ষণ কাটলো নিরবতায়। তনয়া এদিক ওদিক ফিরে বলল, “আর লোক নেই কেন?”
“পুরোটা আমরা রিজার্ভ করে নিয়েছি এই কারণেই!”
তনয়া একটু অবাক হলো। কিন্তু অবাকের কারণ ছিলো না। তাদের অঢেল টাকা আছে। যা খুশি তাই করতে পারে। ওয়েটার এসে বেশ কিছু খাবার রেখে গেল টেবিলের উপর। কিন্তু তনয়ার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। সে কেবল খাবারগুলো দেখছে। উষ্ণ চৌধুরী হাতে চামচ টা নিয়েও রেখে দিল। তনয়ার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। উষ্ণ চৌধুরী বলল, “তাদের আসতে বোধহয় একটু দেরিই হবে। আমরা ডিনার শুরু করি।” তনয়া মাথা নেড়ে বারণ করল। এই তো সবে খেয়ে এলো। এখন আর ইচ্ছে করছে না। তনয়া অনেকটা বিব্রত বোধ করল। চাপা স্বরে বলল, “স্যার আমি খেয়েই এসেছি!”
উষ্ণের হাসি পেলো। এই তো একটু সময় কাটানোর সুযোগ পাচ্ছিলো সে। এটাও হাতছাড়া হয়ে গেল এভাবে। তনয়া বলল, “স্যার আপনি তাদের ফোন করুন। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। আমার তো আবার যেতেও হবে!”
উষ্ণ চৌধুরী হেসে ফোনটা বের করল। কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে উঠে দাঁড়াল। বলল, “তাদের আসতে একটু দেরি হবে। ডিনার যখন করবে না চলো একটু হেঁটেই আসি।”
হাঁটতে কেন বের হবে? এই তুচ্ছ প্রশ্ন করার সাহস তনয়ার হলো না। এতো বড় রেস্টুরেন্টে যে পুরো একটা চক্কর দিতে আধ ঘণ্টার মতো তো লাগবেই। তবুও তারা দু’জন হাঁটছে খুব নিশ্চুপ ভাবে। এতোক্ষণ সবকিছু নিস্তব্ধ থাকলেও এখন যেন মিউজিকের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মিউজিক বাজছে কোথাও যেন। তনয়া কেবল নিচের দিকে তাকিয়ে স্যারকে অনুসরণ করছে। মিটিংয়ের ব্যাপারে অনেককিছুই তার জানার ছিলো। এখন আর কিছু মাথাতে আসছে না। মিউজিকের শব্দ তী*ব্র থেকে তী*ব্রতর হচ্ছে। তনয়া কিছু সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ করে থেমে গেল। মাথা তুলে সামনে চাইল। স্যার তার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। অমায়িক হাসি তার চোখে মুখে। বুঝতে বাকি নেই, এখানে কোনো মিটিং হবে না আদৌও। বিষয়টা অন্য কিছু। কিন্তু কি?
পিছনের দেওয়ালের লাইটিং জ্বলে উঠলো। তনয়ার আর্কষন কেড়ে নিল ওটা। ঠোঁট নাড়িয়ে পড়ল তনয়া “উইল ইউ মেরি মি তনয়া!” ফ্যালফ্যাল করে চাইল ওদিকে। হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা হচ্ছে। স্যার তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। তনয়া চমকে উঠল। দুই পা পিছিয়ে গেল। বোধ হলো পুরো রেস্টুরেন্টের একদম মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে সে। হঠাৎ উপর থেকে একটা শব্দ হলো। উষ্ণের হাতে একটা আংটির বাক্স। সেখানে একটি আংটি চকচক করছে। তনয়া বিস্ময়ে বিমূর্ত। উষ্ণ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। মনে অনেকখানি সাহস জুগিয়ে বলল, “আই লাভ ইউ তনয়া। আই রিয়েলি লাভ ইউ, উইল ইউ মেরি মি!”
ঠিক এই ভ*য়টাই তনয়া পাচ্ছিলো। মনের মধ্যে হৃৎ*পিণ্ড ধকধক করে শব্দ করছে। তনয়া অসহায় দৃষ্টিতে আংটির দিকে চেয়ে থেকে বলল, “আমি আপনাকে ভালোবাসি না!”
উষ্ণ হাতের আংটির বাক্স বন্ধ করে নিল। এটা তো জানাই ছিলো। হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমিও জানি বাসো না। কিন্তু ভালোবাসতে ক্ষ*তি কি?”
বলেই খানিকটা এগিয়ে এলো সে। তনয়া একটু থতমত খেয়ে গেল। স্যার এতো তাড়াতাড়ি বুঝে গেল বিষয়টা। একসাথে অনেককিছু মাথায় ঘুরছে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তনয়া চট করে শুধাল,
– কারণ আপনি অলরেডি এনগেজড। কিছুদিন পরেই বিয়ে হতে যাচ্ছে।
– শুধু এতো টুকু ব্যাপার! ভে*ঙে দিচ্ছি বিয়ে!
তনয়া আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। এতো সহজে স্যার কথাগুলো কিভাবে বলছে। তার মাথা ভনভন করছে। তনয়া মাথা নেড়ে বলল, “না না। এ হয় না। আপনি একজনের মন ভে*ঙে আমার সাথে জুড়তে চাইছেন।”
“আমার সাথে কারো মন জোড়া নেই তনয়া!”
“কিন্তু আমার আছে! আমি ভালোবাসি একজনকে। এবার বুঝতে পারছেন।”
উষ্ণ মৃদু হাসল। ঈষৎ পরিহাস করে বলল, “কিন্তু সে যে তোমায় ভালোবাসে না।”
তনয়ার মস্তিস্কে বি*স্ফো*’রণ ঘটল। এই লোকটা এতো কিছু জানে তার সম্বন্ধে!
“আপনি কি করে জানেন?”
“অনেক কিছুই জানি।”
“না। আপনি ঠিক করছেন না। সব জেনেও আমাকে এই ভাবে বলা পুরোটাই অ*যৌ*ক্তিক।
উষ্ণ চৌধুরী হাঁপিয়ে উঠল। তনয়া হাইপার হয়ে যাচ্ছে। টেনশন করছে ভীষণ। সে হাত বাড়িয়ে নিতেই তনয়া পিছিয়ে গেল। হাতের নাগালে ধরা দিলো না। তনয়া স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল, “সেদিন বলেছিলাম তো আপনাকে, আমাদের মাঝে দূরত্ব থাকবে। আর শুনুন, আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আপনি যতই বড়লোক হন না কেন? যতই টাকাপয়সা থাকুক না কেন আপনার আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারব না। আমি অন্য জনকে ভালবাসি। পুরোপুরিভাবে আমি অন্যজনের। আসছি!”
তনয়া পিছনে পা বাড়াল। দু কদম এগিয়ে যাবার পর বড্ড বি*ষ*ণ্ণ কণ্ঠ তার কানে এসে ঠেকল। পুরুষালি এই বি*ষ*ণ্ণ কণ্ঠে তার হৃদয়ে গাধল যেন। “আমার তোমাকেই প্রয়োজন তনয়া। শুধু তোমায়!”
কেমন অদ্ভুত সেই কণ্ঠস্বর! তনয়ার পুরো দেহ অসাড় হয়ে গেল। শাড়ির আঁচল চেপে ধরল সে। আশ্চর্য! দু*র্ব*ল হয়ে কেন যাচ্ছে সে। এসব কি তাকে মানায়! উষ্ণ স্যার তার উপর বলপ্রয়োগ করছে। কিন্তু কিভাবে? কিভাবে তার মনের মধ্যে লোকটা বিস্তার করতে চাইছে? না না, তনয়া। আর এক মূহুর্ত নয়। হনহন করে বেরিয়ে এলো। অদ্ভুত উ*ত্তেজনা তাকে ঘিরে ধরেছে। এমনটা আগে কখনো হয়নি। কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছিল স্যার কাঁদছে! সত্যিই কি তাই? তাদের পরিচয় কদ্দিনের? এর মধ্যেই স্যার এতো মায়ায় জড়িয়ে গেল! হতেই পারে না। লোকটা ভান ধরছে। না, তনয়া! ফাঁদে পা দিলে চলবে না। লক্ষ্যভ্র*ষ্ট হওয়া যাবে না। লিফটে করে নিচে নামতে সময় লাগল। বেরিয়ে এসে সিএনজি খুঁজছে বাসায় যাবার জন্য। মূহুর্তের মধ্যেই একটা গাড়ি এসে থামল তার সামনে। সেক্রেটারি জেএস বেরিয়ে এলো। গাড়ির দরজা খুলে বলল, “ম্যাম চলুন!”
“আপনি?”
“স্যার বলেছে আপনাকে পৌঁছে দিতে।”
তনয়া অবাক দৃষ্টিতে তার পানে চেয়ে রইল। এই লোকটা চাইছে কি আদৌও!
.
উষ্ণ ক্লান্ত হয়ে উঠল। বার বার হৃ*দ*য় ভা*ঙার পর এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই তার। নয়নে এসে জমছে অশ্রু কণা। এরা কেন কথা শুনতে চায় না। উষ্ণ এদিক ওদিক ফিরে চাইছে। কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। সফল হলো! কিন্তু ভীষণ রকমের দু*র্বল হয়ে পড়ল। তার চোখের সামনে সমস্ত কিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। এলোমেলো ভাবে হেটে সামনে একটা টেবিল শক্ত করে ধরে নিল। ঘাড়ের র*গ স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠছে। উষ্ণের হাত কাঁপছে। বারংবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে। তাঁর মাথা ঘুরছে। এতো কেন খা*রা*প লাগছে! এতোটাও তো আশা করেনি সে। এতো ক*ষ্ট, বে*দ*নাদা*য়ক কেন লাগছে সবকিছু। তুচ্ছ মনে হচ্ছে নিজেকে। একদম তুচ্ছ!
.
সারাটে রাত ভালো মতো ঘুম হয়নি তনয়ার। সকালে অফিসে আসার পর থেকেই মন ম*রা হয়ে আছে। তন্ময় এসে তার মন ভালো করার পুরো চেষ্টা করছে। বেলা অনেক গড়িয়েছে, কিন্তু উষ্ণ স্যার যে এখনো এলো না। কেন এলো না। কানে কথা আসছে। সামনের সপ্তাহেই উষ্ণ স্যারের বিয়ে। বোধহয় এখন থেকেই আর অফিসে আসবে না। কি আশ্চর্য! দুদিন পর যেই লোকটার বিয়ে সে তাকে কিভাবে বলে ভালোবাসার কথা! এই হিসেবটাই যেন মিলছে না। তবে এখন এতো হিসাবনিকাশে যে কাজ নেই। তার পাশে দাঁড়িয়ে তন্ময় হেসে কথা বলছে জ্যোতির সাথে। এই তো তার শান্তি লাগছে। কি অপূর্ণ তৃপ্তি! এটাই তো ভালোবাসা। এখন ভালোই ভালোই স্যারের বিয়ে হলেই হলো। সে তবে মুক্ত পায়! হয়তো গতরাতের কথা স্যার ভুলে যাবে। ভুলে যাওয়া উচিত। অতীত যে মনে রাখতে নেই! যতই অতীত মনে রাখবে ততোই ক*ষ্ট আঁকড়ে ধরবে।এর অভিজ্ঞতা তনয়ার চেয়ে ভালো আর কে জানে!
#চলবে….
#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৩
কালো*জাদুর বৈশিষ্ট্য কি? সত্যিই কি কালো*জাদু করে যে কাউকে নিজের বশে আনা যায়! হবে বোধহয়? কিন্তু এতে যদি তার ক্ষতি হয়? আচমকা হেসে উঠলো উষ্ণ চৌধুরী। তার এসব বাচ্চামি ভাবনাচিন্তার কোনো দাম আছে আদৌও। টসটসে যুবক সে। যৌবনের অনেক বছরই পেরিয়ে গেছে কিন্তু শেষ হয়ে তো যায় নি। তনয়ার উপর অবশ্যই তাকে এবার কালো*জাদু করতে হয় নয়তবা এই যৌবন ও শেষ হয়ে যাবে কিন্তু তনয়ার দেখা মিলবে না। কিন্তু কিভাবে তার উপর কালো*জাদু করা যায়? তাঁর প্রেমের কালো*জাদু করবে? ভালোবাসায় কালো*জাদু করলে কি খুব দোষের কিছু হবে? তনয়াকে সে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে। তাকে পাবার জন্য যে সবকিছু করতে পারে! ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালো। ললাটে ভাঁজ পড়ল। দমকা হাওয়ায় গায়ের কালো শার্টটি নদীর স্রোতের মতো ঢেউ খেলাচ্ছে। উষ্ণ চৌধুরীর লম্বা খোলা চুলগুলো কেবল উড়ছে। মুখের উপর আঁচড়ে এসে পড়ছে। হাতের কব্জি থেকে তুলি দিয়ে চুলগুলো আটকে দিল। তার বয়সে অনেকেই এখন বউয়ের চুল সামলাচ্ছে অথচ সে এখনো নিজের চুল সামলাচ্ছে। হাস্যকার! হাতের আঙুল দিয়ে থিতুনিতে হাত বুলাচ্ছে। শান্ত নিরব পরিবেশ মূহুর্তেই কেমন রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল। ঘুম ঘুম চোখ গুলো লাফিয়ে উঠল। ওহ হ্যাঁ! আজ থেকে তার বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু। টানা তিনদিন চলবে এই অনুষ্ঠান! আজ কি যেন? হ্যাঁ, মেহেদির অনুষ্ঠান! ইরিশা জামান তার পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছে বোধহয়। অনেক মেয়েদের শোরগোল সে পেয়েছে। পুরো বাড়ি সাজানো। বাইরে সাজানোর কাজ এখনো বাকি। কাজ চলছে! আজ রাতেই বোধহয় শেষ হয়ে যাবে। কি আশ্চর্য; তাঁর বিয়ের কি বিরাট আয়োজন! দেখলেই যে কেউ হিংসা করবে। মেহমান এসেছে ঘরভর্তি। উষ্ণ চৌধুরী ঘুরে ফিরে দাঁড়াল। গ্রিলের উপর হাতটা রেখে নিচে তাকাল। বাড়ির সামনে বিরাট জায়গা জুড়ে স্টেজ সাজানো হয়েছে। ইরিশা জামান কে এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা সুন্দরী! সত্যিই ভীষণ সুন্দরী! কিন্তু এসব সুন্দরী কে ভুলক্রমে একবার দেখে ফেললে দ্বিতীয়বার দেখতে ইচ্ছে করে না। এদের মুখছবি হৃদয়ে গেঁথে রাখা যায় না। চোখ বুজে ফেললে তনয়ার মুখটা যেমন স্পষ্ট ভেসে উঠে এদের ছবি তেমন আঁকা যায় না। তাহলে এতো সুন্দরী হয়ে লাভ টা কি হলো? ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলল সে। ইরিশা জামান হচ্ছে সুযোগ সন্ধানী মেয়ে। ঠিক তার সৎ মায়ের মতো। হবে নাই বা কেন? একই তো রক্ত! ভাইয়ের মেয়ে না! কিন্তু উষ্ণ চৌধুরী নিজেও সুযোগ সন্ধানী। গাল বাঁকিয়ে হাসল সে। সৎ মা ইরিশা জামান কে তাঁর ঘাড়ে বসিয়ে দিতে চান। সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেছে। বাপের সব সম্পত্তি ৪ ভাগ হয়েছে। সবাই সমান ভাবে এক ভাগ পেয়েছে। কিন্তু মায়ের ভাগের রেজিস্ট্রি এখনো ঠিক করাহয়নি। ফের গাল বাঁকিয়ে হাসল। গালে হাত রেখে ভাবতে লাগল, তার আসল বাপ স’ৎ মায়ের নামে সম্পত্তি এখনো করে দিলো না কেন? বুড়ো টার কি ভয় হয়? কিসের ভয়? সম্পত্তি দিয়ে দিলে যদি ছেড়ে চলে যায় সেই ভয়!” খোলা ছাদে অট্টহাসি দিয়ে উঠল উষ্ণ চৌধুরী। এই বুড়ি এখন বুড়ো কে ছেড়ে কোথায় যাবে শুনি। যেতেও পারে! ঠিক নেই তো। কিন্তু তবুও বুড়ির সাধ মিটে না। সে নিশ্চিত। বাপ মরা*র পর তার ভাগের সম্পত্তিও আমার নামেই হয়। তাই ভাইয়ের মেয়েকে গছিয়ে দিয়ে তা নেবার ফাঁদ পেতেছে! কি ভেবেছে? উষ্ণ চৌধুরী কিছু বুঝে না। বোকা সব! সব বোকা। এদের তো ফতুর করে ছাড়বে সে। আবারো তার ভ*য়ানক হাসি। গানের আওয়াজে এই হাসি মিলিয়ে গেল। কেউ টের পেলো না। কিন্তু গানের তীব্রতা থেকেও তার ঘৃ*ণা যে অনেকখানি। তাঁরা টিকতে পারবে তো!
নাকের কাছে অ্যা*লকোহলের তীব্র গন্ধ ঠেকছে। উপস্থিতি বলছে ঊষাণ চৌধুরী। তার দুই নাম্বার ভাই। দুই নাম্বার মায়ের মতো দুই নাম্বার ভাই। ঊষাণ চৌধুরী তাঁর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। উষ্ণ চৌধুরী চরম বিরক্ত লাগছে। তাকে যতই বলুক আমার ধারে কাছে ঘেসবি না ততোই দামড়া শরীর নিয়ে ঘসাঘসি শুরু করে দিবে। উষ্ণের একদম পছন্দ নয়।দুজনের বাপ এক হলেও তাকে ভাই হিসেবে মেনে নিতে তার খুব আপত্তি আছে। কেন যেন নিজের রক্তকেও বিশ্বাস করতে সন্দেহ হয়। ঊষাণ চৌধুরী দাঁত এক পাটি বের করে হেসে বলল, “ব্রো কি করছো?”
— নাচছি! দেখতে পাচ্ছিস না।
— এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কি নাচবে? নাচবে তো নিচে। বিয়ে তো নিচে হচ্ছে তোমার।
উষ্ণ ভ্রু যুগল কুঁচকে নিল। ঊষাণ তাঁর ঘাড়ে হাত রেখে শুধাল, — তুমি কি পালা*নোর প্ল্যান করছো। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিউর এই বিয়ে তুমি করবে না। পালাবে কখন? আমায় বলো, আই উইল হেল্প ইউ। বিশ্বাস করো!”
উষ্ণ তার মুখের দিকে ফিরে তাকাল। তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসছে। ঘাড় থেকে হাত ছাড়িয়ে কঠোর কণ্ঠে জবাব দিল, “বেশি লাফাস না ঊষাণ।
— আমি কাউকে বলবো না। সত্যি! এই যে একদম চুপ!
বলেই ঠোঁটের মাঝে হাত রাখল। ঊষাণ দুলছে। বেশি খেয়ে ফেলেছে। অ্যাল*কোহল দেখলে এদের সহ্য না। উষ্ণ মিনমিন স্বরে কটুক্তি করে বলল, — মাতা*ল একটা!
ঊষাণ রেগে গেলো না। হেসে উঠল । হাতের ওয়াইনের বোতলটা সাধল তাকে। উষ্ণ চৌধুরী তার থেকে মনোযোগ সরিয়ে হাঁটা ধরল। যেতে যেতে ইন করা শার্টটি ছাড়িয়ে নিল। আজ তার বিয়ের অনুষ্ঠান আর সে নাচবে না। এমনটা কি হতে পারে? বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়ল সোজা। সবাই নাচানাচি করছিলো। উষ্ণ গিয়ে যোগ দিল সেখানে। ইরিশার বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে সে কি নাচ। একেকজন হা করে দেখছে। বিয়েতে যেন ওর চাইতে খুশি আর কেউ নেই। ছাদ থেকে দাঁড়িয়ে নাচ দেখে মজা নেই। ঊষাণ চৌধুরী তাই দাঁড়ালো না। দ্রুত নেমে পড়ল।
তিলোত্তমা বেগমের সূক্ষ্ম দৃষ্টি উষ্ণের উপর। জাওয়াদ চৌধুরী পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। ওদিকের স্টেজে ইরিশার হাতে মেহেদি পড়ানো হচ্ছে। অতিথিরা জাওয়াদ চৌধুরী কে ধরে বললেন, “বাহ বাহ! আপনার দুই ছেলের তো কোনো তুলনা নেই। দুটোই রত্ন!”
আরেকজন গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “মনে হচ্ছে এই বিয়েতে আপনার ছেলে বিরাট খুশি। হোক! বিয়ের আগে খুশি হওয়া জায়েজ আছে। বিয়ের পর বাকিটা দেখা যাবে। হা হা হা!” অট্টহাসিতে মেতে উঠলেন তারা। তিলোত্তমা বেগম সেখান থেকে সরে এলেন। দেখা করল ভাইয়ের সাথে। উষ্ণ নাচ শেষ সবে বারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তিলোত্তমা বেগম সেখান থেকে তাকে ডাক পাঠিয়ে নিয়ে এলো। হবু শ্বশুরের সাথে কথা বলতে বলল। ইরিশা জামানের মা নেই। একমাত্র মেয়েকে ভারী ভালোবাসেন জামান সাহেব। উষ্ণের হাতখান ধরে বলল, “আমার মেয়েটাকে ঠিক করে দেখে রেখো বাবা।”
উষ্ণ হেসে উঠল। বলল, “আংকেল এই ডায়লগ তো বিয়ের দিন দিবেন। বিয়ে আসতে এখনো অনেক দেরি।”
জামান সাহেবের হকচকিয়ে উঠলেন। বোনের দিকে তাকালেন। তিলোত্তমা বেগম হেসে উঠে উষ্ণের ঘাড়ে হাত রাখলেন। বললেন, “মজা করছে। হবু শ্বশুরের সাথে মজা করছে ভাই।” জামান সাহেবের চোখে মুখে যেন প্রাণ ফিরে এলো। বুকে টেনে নিলেন মেয়ের হবু জামাইকে। এই জামাইকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন!
উষ্ণ গেলো স্টেজে। মেহেদি পড়ানো প্রায় শেষের দিকে। ইরিশা জামানের বান্ধবীরা একেকজন খোঁচা মেরে কথা বলতে লাগল। উষ্ণ নরম গলায় ইরিশাকে শুধাল, “আমার নাম লিখেছো। দেখি একটু!”
ইরিশা জামান যেন লজ্জা পেল। উষ্ণ গাল বাঁকিয়ে হাসল। ঢং! এই মেয়ে পাবে লজ্জা। লজ্জার ছিটেফোঁটা না থাকলেও অভিনয়ের আছে। ভান ভালোই ধরতে জানে। বান্ধবীরা একেকজন ঘিরে ধরল। না না দেখানো যাবে না। একদম বিয়ের দিনই দেখতে হবে। ইরিশা জামান মুখ লুকিয়ে হাসল। এসকল অভিনয় দেখে উষ্ণের পেট উল্টে আসছে। মনে হচ্ছে বমি করে দিবে। তবুও খানিকটা ভাব নিয়ে বান্ধবীদের বলল, “শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরীর নামটাই এমন। যে লেখবে তার হাতেই মানাবে!” খানিকটা ভান নিজেও ধরে আবারো ফিরে এলো বারের কাছে। ইরিশা জামান তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করছে তার উপর। তার বান্ধবীদের সামনে স্মার্ট সাজা হচ্ছে। উষ্ণ চৌধুরী নিজেও জানে না ইরিশা জামান কি? যার নাম তার হাতে লেখা হবে তারই ভাগ্য খুলে যাবে। কিঞ্চিত ঠোঁট বাড়িয়ে হাসল সে। চোখাচোখি হলো দূর প্রান্তে উষ্ণ চৌধুরীর সাথে। ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিল উষ্ণ। অথচ দৃষ্টি একদম সামনের দিকে। তাদের দুজনের দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে, কতোটুকু ঘৃ*ণা জমে রেখেছে একজন আরেকজনের উপর। বিয়ের পর যেন প্রতিশোধের আ’গুনে মেতে উঠবে দু’জন।
.
শুক্রবার দিন দুপুরবেলা। তনয়ার ড্রেসিন টেবিল পুরো এলোমেলো। কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই তো এখানেই রেখেছিলো কানের দুল জোড়া। একটা কানে পড়েছে এখন আরেকটা খুঁজে পাচ্ছে না। শাড়ির আঁচলটুকু কোনভাবে দিয়ে এবার কুঁচি ঠিক করছে। মৌ একবার এ ঘর আরেকবার এ ঘর ছোটাছুটি করছে। মেয়ে মানুষ সাজতে গেলে এমনই হয়। সবকিছু ছড়িয়ে ছিটে থাকে। কোনো একটা জিনিস ঠিকমতো খুঁজে পাওয়া যায় না। কাজল পেলো তো টিপ পায় না। লিপস্টিক পেলে কানের দুল পায় না। কি দারুণ অবস্থা! এদিকে কানের দুল পাচ্ছে না অন্যদিকে মৌ এসে চেঁচাচ্ছে শাড়ির কুচি ঠিক করে দেখার জন্য। তনয়া হাঁপিয়ে উঠল। আজকে ঘুরার প্ল্যান যেন সব রসাতলে যাবে মনে হচ্ছে। বিছানার উপর ধপ করে বসে বলল, “ধুর। যেতে ইচ্ছে করছে না কোথাও?”
“কেন? এখন আবার কি হলো?”
“জানি না। ভালো লাগছে না।”
“হ্যাঁ, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন তো সব জায়গায় ভিড় থাকবে।
“ঢাকা শহরে শুক্রবার ভিড় থাকবে না এমনটা হয় কখনো।
“থাক। ছাদে গিয়ে দুটো ছবিই না হয় তুলে আসবো। উঠো না।
“তোর জ্বালায় বাঁচা যায় না। সবসময় এমন করিস।
“পাশের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে। রোস্টের ঘ্রাণ এখান অবধি আসছে। ইশ্ কতোদিন ধরে কোনো বিয়ের দাওয়াত খাই না বলো।”
“বিয়ে! ওহ, আজ আমার বসের বিয়ে।”
“তাই। তোমাকে দাওয়াত দিছে।
“না, আমাকে কেন দাওয়াত দিবে।
“কি বলো। এতো কিপ্টা তোমার বস। কয়েকজন স্টাফ কে দাওয়াত দিলে কি এমন দোষের এতো। ভালো একটা বিয়ের দাওয়াত পেতাম। পোলাও, রোস্ট, খাসির রেজালা!”
“হ্যাঁ, স্টাফের সংখ্যা জানিস। ওটা কয়েকজন না কয়েক হাজার জন! এতো জনকে বিয়ের দাওয়াত দিলে হতো।
“কি হতো? তোমার কোটিপতি বস কি ফকির হয়ে যেত।
“না তা হতো না। কিন্তু সে দাওয়াত দিলেও আমি যেতাম না।
মৌ এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী সুরে বলল, “কেন যেতে না। একশবার যেতে, আমায় নিয়ে যেতে।
“আচ্ছা কান্না কাটি করিস না। রেডি হ দেখি কোথায় যাওয়া যায়। বিকেল হয়ে আসছে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে একটুপর।”
কলিং বেল বেজে উঠল। মৌ বলে উঠল, “কে এলো গো? তন্ময় ভাইয়া! তুমি আসতে বলেছিলে তাকে?”
“না তো। ও কেন আসবে?”
মৌ মুখ টিপে হেসে বলল, “তোমায় দেখতে আসবে।”
“উফ এতো বাজে বকিস না তুই।”
“তনয়া আপু বিয়েটা তুমিই করে নাও গো। ভালো একটা দাওয়াত পাবো। রোস্ট দুটোর বদলে তিনটা পাবো।”
“দিবো একটা। সর এখান থেকে।”
কলিং বেল আবারো বেজে উঠল। তনয়া এবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেকেন্ডের জন্য তারও মনে হলো তন্ময় আসেনি তো। কিন্তু সে কেন আসবে? আর এলেও ফোন করেই আসতো। এই মৌ এর চক্করে পড়ে তার মাথাটাও যাচ্ছে। কিন্তু এই সময় এলো কে? কানের দুলটা ঠিক করে দরজা খুলে দাঁড়ালো সে। চক্ষু মেলে সামনে ফিরতেই থতমত খেয়ে গেল। স্তব্ধ তার চাহনি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। বাতাসের তোড়ে তার চুলগুলো উড়ছে। এক কানে পরা দুলটাও নড়ছে। চোখের পাতা পিটপিট করে নড়ছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে চোখজোড়া। তার সামনে লম্বা দেহখান নিয়ে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি কিঞ্চিত নড়েনি। কেমন অদ্ভুত, আশ্চর্য নয়নে চেয়ে আছে। চোখগুলো ভারী লাল হয়ে আছে। উস্ক শুষ্ক মুখখানি দেখে যে কারো মায়া লাগবে। মৌ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলল, “কে এলো গো?”
তনয়ার ঘোর ভাঙল। খানিকটা নড়েচড়ে উঠে চাঁপা স্বরে বলল, “স্যার আপনি?”
উষ্ণের ঠোঁট দুটো নড়ছে। কিছু বলছে বোধহয় সে। গভীর গাঢ় স্বরে কেবল মুখ ফুটে “তনয়ার” নামটুকু নিল। এতেই কেঁপে উঠলো তনয়া। কেমন আর্তনাদ মিশ্রিত স্বর। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সে। তার নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে যেন প্রাণ ফিরে এসেছে। স্থির দৃষ্টি এবার চঞ্চল হয়ে উঠল। তনয়া ভারি বিস্ময় নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। তাঁর হৃৎস্পন্দন বাড়ছে। নিঃশ্বাস উঠানামা করছে। উষ্ণ স্যার তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। কিছু একটা ঠিক নেই বলে মনে হচ্ছে। আচমকা সে এসে পড়ল তার গায়ের উপর। তনয়ার মনে হলো স্যার তাকে জড়িয়ে ধরেছে। সেখান থেকে ছিটকে যাবার আগেই বোধ হলো, না! সে তো জড়িয়ে ধরেনি। পড়ে যাচ্ছে। অ*জ্ঞান হয়ে গেলো নাকি? মৌ ছুটে এলো। এই লম্বা ভারি লোকটাকে দু’জনে কি করে সামলালো তখনকার পরিস্থিতিই ভালো করে জানে। তাকে টেনে হিচড়ে এনে রাখল বিছানার উপর। মৌ দুই হাত কোমরে রেখে হাঁপাতে লাগল।
– কে এই লোকটা?
– আমার বস। মৌ একটু পানি দে তো।
মৌ পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, যার বিয়ে! এ বিয়ে রেখে তোমার বাসায় কি করতে এলো? এখন দেখো তোমার বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
তনয়া চোখে মুখে পানি ছিটালো। না! স্যারের জ্ঞান ফিরছে না তো। মৌ ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, “এই! বেঁচে আছে তো! দম নিচ্ছে তো। দেখো দেখো! ম*রে গেলো নাকি?”
তনয়া চোখ কপালে তুলে ফেলল। কি সাংঘা*তিক কথাবার্তা বলে মেয়েটা। মুখটা সামনে নিয়ে নাকের উপর হাত দিয়ে দেখল। যাক নিঃশ্বাস তো ফেলছে। মৌ আলহামদুলিল্লাহ বলে মেঝেতে বসে পড়ল। অসহায় কণ্ঠে বলল, “তুমি আমায় বলবে কিসব হচ্ছে?”
– সব বলব। আগে আমার ফোনটা নিয়ে আয়। একজনকে ফোন করতে হবে। জলদি!”
মৌ আবারো উঠে দাঁড়াল। ফোনটা কোথায় রেখেছিলো? এখানেই তো। খুঁজে এনে তনয়ার হাতে দিল। তনয়া বিমর্ষ মুখে উষ্ণ স্যারের দিকে চেয়ে আছে। কি হচ্ছে এসব! এগুলো কি কল্পনা না বাস্তব! স্যার তার বাসায় এখন কি করছে? তার না আজ বিয়ে। স্যারের গায়ে ভীষণ জ্বর। তখন তাকে ছুঁয়েই টের পেয়েছে সে। জ্বরের ঘোরে কি অজ্ঞা*ন হয়ে গেলো? সেক্রেটারি জেএস কে এবার ফোন করা দরকার। এই সমস্যার একমাত্র সমাধান এবার তার কাছেই আছে!
#চলবে