তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-১৪+১৫

0
15

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৪

বিয়ের আমেজে চারদিক হইহই রব। ইরিশা জামানের বাড়ি নয় যেন গোটা ফুলের বাগান তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। জামান সাহেব এক চুল ও ছাড় দেন নি। তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে। রাজকীয় ব্যাপার! শানাই বাজছে। এখনকার যুগে বিয়েতে আবার কেউ শানাই বাজায়। অনেক অতিথির প্রশ্ন! পরক্ষণেই হেসে উড়িয়ে দিল, একমাত্র মেয়ে কি না! আত্মীয় স্বজনে পুরো বাড়ি ভর্তি। মেহমান প্রায় সকলেই হাজির। কিন্তু আসল অতিথি যে এখনো আসেনি। বরযাত্রী! তারা কোথায়? ফোনের উপর ফোন করা হচ্ছে। তিলোত্তমা বেগম একবার‌ ফোন তুলে শু*স্ক গলায় বলল, “আসছি!” উ*দ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে জামান সাহেব। হঠাৎ কেউ বলে উঠল, “ওই তো বরযাত্রী আসছে!” শানাই বেজে উঠল। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সকলে ছুটে এলো দোরগোড়া। বর এসেছে বর এসেছে বলতে বলতে পিচ্চি ছেলেমেয়েরা ছুটে এলো। কিন্তু একি! একটিমাত্র গাড়ি! এক গাড়িতে বরযাত্রী আসে কখনো? উৎসুক চাহনি সকলের। তিলোত্তমা বেগম আর ঊষাণ চৌধুরী বের হলো গাড়ি ছেড়ে। আর কেউ নেই নাকি? জামান সাহেব একগাল হেসে বোনের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “বর‌ কোথায়? জাওয়াদ ভাই আসেনি? অন্য গাড়িতে আসছে নাকি?‌ আর কতদূর?”

তিলোত্তমা বেগম মাথা নিচু করে ভাইয়ের দিকে ফিরে চাইলেন। মূহুর্তেই জামান সাহেবের মুখ নিমিয়ে গেল। কোনো কথাবার্তা নেই। চারদিকে নিরবতা ছড়িয়ে গেল। স*মা*চার রটিয়ে গেল। বর পালিয়েছে! বর পালিয়েছে! যেসব পিচ্চু ছোকরা বর এসেছে বলে চেঁচাচ্ছিলো তার উল্টো পথে “বর পালিয়েছে, বর পালিয়েছে” চেঁচাতে চেঁচাতে ফিরে গেল। ইরিশা জামানের সখীরা ছুটে এলো। বিয়ের আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ইরিশা জানান। তাঁর অ*শ্রুসি*ক্ত নয়ন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। সকলের কা*নাঘু*ষো শোনা যাচ্ছে। দু হাতে লেহেঙ্গা তুলে ছুটে এলো বাড়ির সদর দরজায়। ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে তিলোত্তমা বেগম। জামান সাহেব নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বোধহয় শো*কে পাথর হয়ে গেছেন। কিন্তু একনজর মেয়েকে দেখে এই পাথরের মনটাও গলে যেতে শুরু করল। তিনি হকচকিয়ে উঠলেন। ইরিশা জামান ছুটে এসে শুধাল, “কি হয়েছে? তোমরা কাঁদছো কেন?”

ঊষাণ চৌধুরী গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলল, “ভাইয়া পালিয়েছে!”
“কি?” কান দুটো কে বিশ্বাস করতে পারছে না ইরিশা জামান। এভাবে তাকে ধোঁ*কা দিল উষ্ণ চৌধুরী। এতো শত লোকের মাঝে তাকে তুচ্ছ*তাচ্ছিল্য করল। সকলে হাসছে তাকে দেখে! মজা পাচ্ছে! এইভাবে, তাহলে এভাবেই তার মান সম্মান নিয়ে খেললো উষ্ণ চৌধুরী। ইরিশা জামানের পাহাড় সমান দ*ম্ভে যেন নিমি*ষেই ফা*টল ধরল। সে যে ফা*টল নয়, এই ফাটলে মাথা উঁচু করে রাখা ইরিশা জামানের মাথাটাই যেন কে’*টে নিল। নিস্তব্ধ ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবারো ছুটে এলো ইরিশা জামান। সকলের কাছে সে হাসির পাত্র। গুনগুন স্বর উঠেছে তাকে নিয়ে। ইরিশা জামানের বর পালায়! এটাও হয় কখনো। কেউ ভাবতে পারে এসব। কিসের কমতি তার? সুন্দরী, শিক্ষিত, আ*ত্মসম্মানে ভরপুর ইরিশা জামান। এমন মেয়েটার এই পো’*ড়া কপাল হলো। মুখে কা*’লি লেপে দিল শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী। শুধু ইরিশা জামান কে নয়, তাদের দুজনের পরিবারকে।

বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিল ইরিশা জামান। জামান সাহেব দরজা ধা*ক্কাচ্ছে। তিলোত্তমা বেগম ও সমান তালে ডাকছে। ঊষাণ চৌধুরীর হেলেদুল নেই। সে বুঝতে পারছে না এতো রিয়েক্টের কি আছে? ইরিশা আর কি করবে? কিছু করবে না এই মেয়ে! এমন মেয়েই না ইরিশা। ব্রো চলে গেলেও এমন হাজারখানেক অপশন এখনো আছে ইরিশা জামানের কাছে।
বদ্ধ ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে ইরিশা জামান। আয়নাতে যেন প্র*তিচ্ছবি ভেসে উষ্ণ চৌধুরীর। সে তাকে দেখে হাসছে। তার অ*ট্টহাসিতে মাথা ধরে যাচ্ছে ইরিশা জামানের। ফুলদানি ছুড়ে মা*র’ল সেদিকে। আয়না গুড়গুড়িয়ে ভে*’ঙে পড়ল মেঝেতে। দু কান চেপে মেঝেতে বসে পড়ল ইরিশা জামান। হাসির খোরাক আজ সে। উষ্ণ চৌধুরী এতো বড় পদক্ষেপ নেবে এটা ঘু*না*ক্ষরেও টের পেলে উষ্ণ চৌধুরী কে শে’ষ করে ফেলতো সে। এতো বড় ধোঁ’কা। ফোনের উপর ফোন বাজছে। সকলে জেনে গেছে ইরিশা জামানের বর পালিয়েছে! ছিঃ ছিঃ! কেন হলো এটা? নিশ্চিত ইরিশা জামানের কমতি ছিল। নাহলে আবার তার বর পালায়। বুকের মধ্যে দা*উ দা*উ আ*’গু*ন জ্ব’*লছে প্রতি*শো*ধের। উষ্ণ চৌধুরী! উষ্ণ চৌধুরী কে দেখে নিবে ইরিশা। একবিন্দু ছাড় দিবে না। তাকে শে’ষ করে দিবে! একদম শে’ষ। গায়ের গয়না গাটি সব ছুঁড়ে ফেলে দিল। সাজ ন*ষ্ট করে ফেলল মূহুর্তে। সা*পের ন্যায় ফুঁস’ছে ইরিশা জামান। তার প্রতিটা নিঃশ্বাসে প্রতি*শোধের আ*গুন ঝরছে। রা*গে সর্বদেহ কেঁপে উঠছে। খিলখিলিয়ে হাসছে। তার বি*শ্রী হাসি গায়ে কাঁ*টা তুলে দিচ্ছে। অথচ চোখের কোণে দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এই অ*প*মানের শো*ধ সে তুলবে। ভা*ঙা কাঁচে নিজের বি*মর্ষ মুখখানি দেখছে স্থি*র নয়নে। তবে এটাই হোক। এই তো চেয়েছিলো উষ্ণ চৌধুরী।

জামান সাহেবের এতো অনুরোধে পরেও দরজা খুলছে না তার মেয়ে। এক পর্যায়ে রে*গে গিয়ে তিলোত্তমা বেগমের উপর চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। এই বিয়ের সুর তিনিই তো তুলেছিলেন। এভাবে তার মেয়েটার জীবন ন*ষ্ট করার অধিকার কে দিয়েছে তাকে? জাওয়াদ চৌধুরী কোথায়? মুখ লুকিয়ে বাড়িতে বসে আছে! ছাড়বে না! জাওয়াদ চৌধুরীকে তার ছেলে উষ্ণ এ কাউকে ছাড়*বেন না তিনি। তার মেয়ের এই অবস্থার যারা দায়ী সকলকে দেখে নিবেন। লোক ডাকিয়ে দরজা ভে*ঙে ফেললেন। ছুটে গেলেন ঘরের মধ্যে। মেয়েকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে ধক করে বুকটা কেঁ*পে উঠলো তার। মেয়ের এমন দশা তাঁর হৃদয়কে ছি*ন্ন বি*চ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। তিলোত্তমা বেগম এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। জামান সাহেব এক জায়গায় নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঊষাণ চৌধুরী পুরো ঘর দেখল আর ইরিশা জামান কে দেখলো। ঘরের কিচ্ছু আস্ত নেই কেবল ইরিশা জামান ঠিক আছে। জানত এই মেয়ের কিছু হবে না। আত্মীয় স্বজন দরজার সামনে থেকে উঁকি মা*র*ছেন। ভেতরের আসার সাহস করল না। বরলোক মেয়ের বিয়েও তবে ভে*ঙে যায়! আজ বিশ্বাস হলো তাদের!
.
তনয়া বেশ চিন্তিত। উ*দ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে কখন সেক্রেটারি জেএস আসে। এ নিয়ে ১০ বার কল করা হয়ে গেছে। এতো সময় লাগে আসতে। ঘরের মধ্যে কেবল পায়চারি করছে। মৌ এসে বলল, “এতো পা*গল কেন হচ্ছো? সবে ১৫ মিনিট হলো। মানুষ তো রকেট না যে উড়ে চলে আসবে!”
তনয়া বি*র*ক্তি প্রকাশ করে ঘরে চলে এলো। বিছানার উপর দেহখান পড়ে আছে। এভাবে স্যারকে দেখতেও তার খারাপ লাগছে। এগিয়ে এলো। দূর থেকে বেশ কয়েকবার ডাকল। দরজার বাইরে থেকে মৌ বলে উঠল, “লোকটার হুঁ*শ নেই আর তুমি ডাকছো? তোমার ডাকে সাড়া দিবে তিনি?” হ্যাঁ, তাই তো! এতো ছোট কথাটুকু তার মনে নেই কেন? এবার আরেকটু এগিয়ে গেল। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌ। তী*ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে। তনয়া বেশ দ্বিধাবোধ করছে হাতখান বাড়াতে। বির*ক্তি স্বরে বলল, “আহ ঢং কেন করছো? কি দেখবে দেখো না?”
তনয়া চমকে উঠল ‌। হাত বাড়িয়ে কপালে ঠেকাল। ইশ্! জ্ব*রে পু*ড়ে যাচ্ছে। মৌ বলে উঠল, “কি? জ্ব*রে পু*ড়ে যাচ্ছে তো! আমিও জানি। দেখেছি একটু আগে। এভাবে আর কিছুক্ষণ পড়ে থাকলে ম*রেই যাবে বেচারা।”
“আহ! এভাবে কেন বলছিস?”
“তো কি বলবো? আ*ধম*রা লোকটাকে এভাবে শুয়ে কেন রেখেছো।”
“তো কি করব? তার তো জ্ঞা*ন নেই। সেক্রেটারি না এলে তাকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো?”
“তাহলে জলপট্টি দাও। জ্ব*র তো নামবে।”
“আমি দেবো!”
“তা না হলে কে? আমি! যদি বলো দিয়ে দিচ্ছি। আমার পরিচিত হলে তো এভাবে ফেলে রাখতাম না! তোমার মতো নি*ষ্ঠুর তো নই আমি।”

কথাগুলো বলে বড় বড় পা ফেলে মৌ চলে গেল। মেয়েটা হঠাৎ রে*গে গেলো কেন? সত্যিই কি সে নি*ষ্ঠু*র আচরণ করছে! মনকে প্রশ্ন করল। স্যার এখানে কেন এলো? এতো শরীর খা*রাপ নিয়ে তার কাছেই কেন আসতে গেলো এসব চিন্তা কিছুক্ষণের জন্য মাথা থেকে সরিয়ে নিল। শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে বের হয়ে গেল ঘর ছেড়ে। এক টুকরো শুকনো কাপড় আর বোল ভর্তি পানি নিয়ে ফেরত এলো। টুকরো টুকু ভিজিয়ে ভালো করে নিংড়ে কপালে দিল। পরপর কয়েকবার একই কাজ করে যাচ্ছিল। সময় কখন চলে গেল টের পেলো না। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হলো। অবশেষে সেক্রেটারি জেএস এলো। সাথে ডাক্তার ও এসেছে। তনয়া একটু দূরেই সরে এলো। মৌ এগিয়ে কাছে গেলো। কি হচ্ছে জানা তো দরকার। আজ তনয়া আপুর এমন আচরণে সে একটু বেশিই অবাক। তার চেয়েও অবাকের বিষয় হচ্ছে তনয়া আপুর স্যার তাদের বাড়িতে! দুজনে একসাথে আছে ৪ বছরের বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে কেবল তার খালা আর খালাতো ভাই বোন ছাড়া অচেনা কাউকে আসতে দেখেনি। তন্ময় ছাড়া আর কোন ছেলের নাম ও মুখে নেয়নি। সেই মেয়ের বাড়িতে অফিসের বস হাজির। তাও আ*ধম*রা অবস্থায়। মানা যায় এসব। এরপর তনয়ার আপুর অদ্ভু*ত আচরণ। সন্দেহের অনেক কারণ রয়েছে মৌ সবকিছু উপেক্ষা করে বিছানার উপর উষ্ণের দেহটাকে দেখল। ভীষণ মায়া হচ্ছিল তার। তখন হাত রেখে দেখেছিলো, কতোই না জ্ব*র লোকটার। একটা অচেনা লোকের জন্য তারও মায়া হলো অথচ তনয়া আপুর চোখে মুখে মায়ার ছাপ যেন বড্ডই অ*স্পষ্ট!

ডাক্তার সাহেব উষ্ণ চৌধুরী কে ভালো করে দেখলেন। দেখে ভালো কিছু বললেন না। গম্ভীর মুখে বললেন, “শরীর বেশ দু*র্ব*ল! প্রেসার ও লো। এর মধ্যে জ্ব*রের প্রভাব তো মা*রা*ত্ম*ক কাজ করে ছেড়েছে। লোকটা কি স্বেচ্ছায় ম*রা*র প্রস্তুতি নিচ্ছিলো নাকি?”
জেএস কে ছুঁড়ে দিল প্রশ্নখান! সে জবাব দিতে পারল না। তনয়া কথাগুলো শুনে ঘাবড়ে গেল। আগ বাড়িয়ে শুধাল, “হা*সপাতালে ভর্তি করাতে হবে নাকি? খুব খা*রাপ *অবস্থা?”
“আপাতত দরকার নেই। কিছু ঔষধ দিয়ে যাচ্ছি,‌জ্ঞা*ন ফিরার পর সেগুলো খাওয়াবেন। অবশ্যই কিছু খেয়ে নিতে বলবেন। মনে হচ্ছে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করায় শরীর এতো দু*র্ব*ল। আর একটা স্যালাইন দেওয়া হলে ভালো হতো। সেটা কাল করা যাবে?”
“জ্ঞা*ন কখন ফিরবে?”
“জ্ব*রের ঘোর কমে গেলেই ফিরবে। ফিরবে, রাতের মধ্যেই ফিরবে। জলপট্টি যেভাবে দিচ্ছেন দিতে থাকুন। এরপরেও জ্ব*র না কমলে মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করুন। ঠিক আছে!”
তনয়া মাথা দুলাল। জেএস ডাক্তার সাহেব কে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তনয়া ফের এসে দাঁড়াল উষ্ণ চৌধুরীর পাশে। তার নরম কোমল হাতের আলতো ছোঁয়া কপালে ঠেকাল। জ্ব*র বোধহয় কমছে। আগের চাইতে একটু কমই আছে। আবারো বোলের পানি বদলে এনে জলপট্টি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মৌ বিছানার এককোণে চুপচাপ বসে দেখছে। হ্যাঁ এই তো। তনয়া আপু তার বেশে ফেরত চলে এসেছে। এই মেয়েটা তো এমনই!

ডাক্তার সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে শুধালেন, “আজকের রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করালে কিন্তু ভালো হতো। আপনার জন্য বলতে পারলাম না। কি চাইছেন আপনি বলুন তো? লোকটাকে মে*রে ফেলবেন?”
জেএস বির*ক্ত কণ্ঠে জবাব দিল, “আহ, এসব কি বলছেন? স্যার আমাকে যা বলতে বলেছে আপনাকে তাই বলেছি। আর আপনিও তাই বলবেন। যা বলব তাই বলবেন। স্যার এখানেই থাকবে, দরকার পড়লে পুরো হাস*পাতাল এখানে তুলে নিয়ে আসবো কিন্তু স্যার এই বাসা থেকে বের হবে না। কোন ভাবেই না!”
ডাক্তার সাহেব মুখটা কালো করে ফেললেন। এই লোকের কথাবার্তা শুনে তিনি বেশ বির*ক্ত। গাড়িতে চড়ে বললেন, “কাল সকালে আসব!”
জেএস মাথা দুলিয়ে তাকে বিদায় দিলেন। ফোন বাজছে। বড় স্যারের ফোন। রিসিভ করার দুঃ*সা*হস দেখালো না। ফোন বাজছে বাজতে কে*টে গেল। পরপর কয়েকটা মেসেজ দ্রুত ভেসে উঠল স্ক্রিনে। জেএস মেসেজ গুলো পড়ে চোখ শুধাল। ফের উষ্ণ স্যারের মেসেজ পড়ল। গত দুদিন ধরে স্যার নিখোঁজ ছিলেন। মেহেদির অনুষ্ঠানের পর থেকেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবুও জাওয়াদ স্যার ভেবেছিলো শেষ মুহূর্তে ছেলে চলে আসবে। কিন্তু উষ্ণ আসেনি। বেকায়দায় পড়ে গেলেন তিনি। উষ্ণ স্যার কোথায় ছিল জেএস নিজেও জানত না। জানার চেষ্টা ও করেনি। উষ্ণ স্যারের বারণ ছিল। কিন্তু সে জানত স্যার তনয়া ম্যামের বাসায় আসবে। নিশ্চিত ছিল পুরোপুরি। স্যার নিজেও তাকে মেসেজ করে জানিয়েছিলো। ডাক্তার আসার পর কি বলবে সবটাই বলিয়ে রাখা। স্যারকে এখান থেকে সরানো যাবে না। সরানো উচিত ও হবে না। বড় স্যার যা রে*গে আছে, স্যারের খোঁজ পেলে কাউকে জীবন্ত রাখবেন না। সব দো*ষ গিয়ে পড়বে তনয়া ম্যামের উপর। তখন বড় স্যারের হাত থেকে রেহাই পেলেও উষ্ণ স্যার তাকে ছাড়বে না। দুদিক থেকে ভালোই ফেঁসে গেছে সেক্রেটারি জেএস। কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কোনো দিক খুঁজে পাচ্ছে না।

প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ গুলো নিয়ে ফের এলো তনয়ার বাসায়। তনয়া বেশ চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করল, “স্যারের এমন অবস্থা কেন?”
জেএস রহ*স্যজনক ভাবে ফিরে তাকাল। যেন তাকে প্রশ্ন করাটাই খুব বড় ভু*ল হয়ে গেছে। এসব কেন সে জানবে? সত্যিই তো! যা হচ্ছে তাঁর জন্য কম করে হলেও সে দায়ী। তনয়া চোখ নামিয়ে ঔষধ গুলো নিল। চাঁপা স্বরে বলল, “আজ না স্যারের বিয়ে ছিল। স্যার এখানে কি ভাবে এলো?”
“জানি না। দুদিন ধরে নি*খোঁ*জ ছিল। আজ আপনি খবর দেওয়ায় খোঁজ পেলাম।”
তনয়া শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। একটু দূর গিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করল, “বড় স্যার জানে তিনি এখানে?”
“এখনো জানে না। জানা ঠিক ও হবে না। আমি আসছি, দরকার পড়লে ফোন করবেন!”
হম্বিতম্বি করে জেএস বেরিয়ে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তনয়া। তাকে দেখতে বি*ধ্ব*স্ত লাগছে। কেন যেন মনে হচ্ছে সবাই তাকে দো*ষী সাব্যস্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু সে করল কি? সামান্য তার জন্য এতো কিছু হয়ে গেল। স্যারের বিয়েটা ভে*ঙে গেলো!
.
জাওয়াদ চৌধুরী নিজের স্টাডি রুমে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। সামনেই দাঁড়ানো জেএস। আধো আধো অন্ধকারমুখো ঘর। চারদিক কেমন নিরব, নিস্তব্ধ! মনে হচ্ছে ঘরে কোন প্রাণের উপস্থিত নেই। তিনি ল্যাম্পশেডের আলো একবার জ্বালাচ্ছেন আবার বন্ধ করছেন। থমথমে কণ্ঠে শুধালেন, “উষ্ণের খোঁজ পেয়েছো?”
“না স্যার, আমার লোকেরা এখনো খুঁজছে কিন্তু…

চট করে জাওয়াদ চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে হাতের কাছের ফুলদানি ছুড়ে মা*র*লেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট আজ অবধি কখনো হননি। এবারের নিশানেও ফেল করেনি। বাতাসের বেগে ছুটে এসে সেটা ঠেকল জেএসের কপালে। বেচারা আহ্ করে শব্দ করে উঠল। ভা*ঙা ফু্লদানির অংশ মেঝের চারদিক জুড়ে। হাঁটু গেড়ে বসে আছে জেএস। কপাল থেকে গড়গড়িয়ে র*ক্ত ঝরছে। শক্ত হাতে চেপে ধরলেন। কপালে বাম চোখের উপরের অংশে কে*টে গেছে। ভাগ্যিস চোখে লাগে নি। এতো সৌভাগ্যের কিছু না। ডান চোখ মেলে তাকাল। স্যার এগিয়ে আসছে। হাতের সিগারেট ধরিয়ে তী*ক্ষ্ম কণ্ঠে বললেন, “কয়েকদিন ধরে কেবল শুনছি খুঁজছি। কাল আমি এই শব্দ শুনতে চাই না। উষ্ণ কে চাই। যেভাবে পারো তাকে খুঁজে আনো বুঝতে পারলে!”
ধমক পুরো ঘর যেন কেঁ*পে উঠলো। তার ধারালো দৃষ্টি যেন এখনই জেএস কে ক্ষ*তবি*ক্ষ*ত করে দিচ্ছিলো। ধপধপ জুতোর শব্দ পেলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। সেক্রেটারি জেএস উঠে দাঁড়াল। র*ক্ত থামছে না। পড়েই যাচ্ছে! এটা ব*ন্ধ করা দরকার। মনে হচ্ছে এবার তাকে রেহাই পাবার সম্ভাবনা বেশ কম!

#চলবে…..

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৫

মাথার উপর ফ্যানের শো শো শব্দ। ঘরের নিস্তব্ধতা নিস্তব্ধ শব্দের থেকেও প্রখর। তনয়া ফ্যাল ফ্যাল নয়নে উষ্ণ চৌধুরী কে দেখছে। তার গায়ের উপর একটি কম্বল দেওয়া। ঔষধ গুলো বিছানার পাশেই। বিছানার একদম শেষ কোণায় উষ্ণের পায়ের কাছে বসে আছে সে। নিঃশব্দে ঘরে এসে ঢুকল মৌ। নরম স্বরে শুধালো, “কিছু খাবে না?”
ক্লান্ত দৃষ্টিতে ফিরে চাইল। মৌ দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দে পুরো ঘর ভারি হয়ে উঠল। মিটিমিটি পায়ে হেঁটে উষ্ণের কাছে এসে ঠেকল সে। কপালে হাত রেখে বলল, “জ্বর কমেছে আপু!”
“হু, কমে এসেছে।”
“তোমার যত্ন পেয়ে লোকটা কেমন দ্রুত সেরে উঠল বলো।”
বিরক্তি হতে গিয়েও পারল না। মৌ একটু ভালো করে দেখে বলল, “মনে হচ্ছে গরম লাগছে। দেখো অনেক ঘেমে গেছে।”
“কম্বলটা সরিয়ে দিবো?”
“পুরো শার্ট ভিজে গেছে। ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিলে বোধহয় ভালো হতো।”
“তুই কি পাগল হলি মৌ। অচেনা একটা ছেলের জন্য এতো মায়া কেন হচ্ছে তোর।”
“অচেনা বলেই হয়তো হচ্ছে। চেনা লোকের দোষ ভুল সব চোখে লাগে বলেই হয়তো মায়া কম হয়। অচেনা লোকের প্রতি তখন মায়ার প্রকোপ বেড়ে যায় আপু।”
তনয়া বিছানা ছেড়ে নেমে গেল। জোরালো স্বরে বলল, “কাল অফিস নেই তোর? অনেক রাত হয়েছে যা ঘুমোতে যা। আর অচেনা লোকের প্রতি মায়া কম কর। যতো মায়া বাড়াবি ততো নিজের ক্ষতি বয়ে আনবি।”

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো তনয়া। মৌ কিছু তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। অতঃপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। ইদানিং লোডশেডিংয়ের প্রকোপ বেড়েছে। এবারো তার কমতি হলো না। হুট করে কারেন্ট চলে গেল। সেরেছে! ঘণ্টাখানেক ছাড়া কি আর আসবে? এই সময় কারেন্ট যাবার কি‌ খুব দরকার ছিল? রোজই তো যায়। আজকের দিনটে না হয় নাই যেত। তনয়া ড্রয়িং রুম ছেড়ে ছুটে এলো বেডরুমে। উষ্ণ স্যার এখনো ঘুমিয়ে আছে। লোকটা কতোদিন না ঘুমিয়ে ছিল? কতোখানি সময় যে পেরিয়ে পেল। ফোনের আলোর উপর ভরসা ছিল। ফোনের চার্জ ফুরিয়ে আসছে। তবুও খুঁজে একটা মোমবাতি জ্বালালো। বিছানার কাছে ছোট টেবিলের উপর রাখল সেটা। মোমের মৃদু মৃদু আলোয় উষ্ণের মুখখানা দেখা যাচ্ছে। মনের মধ্যে ব্যাকুল উত্তেজনা শুরু হলো। আসলেই কি এই লোকটার প্রতি মায়া করা অ*ন্যায়! উষ্ণ নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করছে। কি প্রশান্তির ঘুম তার। গরম লাগছে বোধহয়, গায়ের কম্বলটা সরিয়ে ফেলল। অস্বস্তি হচ্ছে বেশ। অতৃপ্ত বেদানায় নিজেকে আলিঙ্গন করে ফেলছে। ক্লেশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে তাকে। কি তীব্র অসহ্য বেদানা। হঠাৎ প্রশান্তির অনুভব করল। বহু বছর ধরে যে শান্তির নিঃশ্বাস সে চাইছিলো অবশেষে নিতে পারল। মিনমিন করে আঁখি মেলে চাইলো। কাঙ্ক্ষিত সেই রমনীর মুখশ্রী তার চোখ দুটিকে জুড়িয়ে দিল। মন জুড়িয়ে গেল তাকে এক ঝলক দেখে। সে কি ভয় পেয়েছে? কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছে যেন। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। উঠে বসার জোর পাচ্ছে না। টের পাচ্ছে হাতটা যেন তার বুকের উপরই আঁকড়ে আছে। নির্দ্বিধায় সেই হাতটা আঁকড়ে ধরল সে। চোখ দুটো ভয়ে আঁতকে উঠল ফের। উঠে দাঁড়াল সে। ভয়ার্ত কন্ঠে অস্ফুট স্বরে কিছু বলল। কানে শুনতে পেলো না সে। এক ঝলক তার হাসি দেখা গেল। আবারো চোখ বুজে ফেলল। সে কি ঘুমিয়ে পড়ল আবারো? তনয়া ভীষণ রকমের দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছে। স্যারের গায়ে শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছিলো কেবল। স্যার সত্যি সত্যি জেগে যাবে ভাবতেই পারেনি। উঠে আবার হাতটা যেভাবে ধরল। সত্যিই ঘাবড়ে গেছে সে। শুকনো ঢোক গিলল। স্যার আবারো ঘুমিয়ে পড়েছে। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে কষ্ট হলো না। অন্ধকারে এই কাজটা না করলেও পারত। কিন্তু স্যারের কষ্ট যে দেখতে পারছিলো না। লোকটা অসহ্য গরমে যে আরো অসুস্থ হয়ে যেত। না না, তনয়া! তুই ভুল কিছু করিস নি। একজন অসুস্থ রোগীর সেবা করেছিস কেবল। এটা ভুল নয়, অন্যায় করিস নি। মনকে বুঝাল! কারেন্ট চলে এলো আবারো। মাথার উপর ফ্যানটা শো শো শব্দ করে ঘুরছে। তনয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক। রাতের ঘুমটা তার ভালো হোক। কপালে আবারো হাত রেখে দেখল জ্বর আছে কি না। না নেই! অনেকটাই কমেছে। শার্টের বোতামগুলো আটকে দিতে গিয়ে কেঁপে উঠল। কিয়ৎকালের মধ্যে স্মরণ হলো। একটি যুবতী মেয়ে এমন যুবকের শার্টের বোতাম আটকে দিচ্ছে। ছিঃ! ভাবতেই কেমন বিচ্ছিরি ঠেকল তার কাছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষের বলিষ্ঠ বুকের আকর্ষণে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারল না সে। মস্তিষ্ক তরঙ্গের ন্যায় তন্ময়ের নামটা তাকে মনে করিয়ে দিল। আশ্চর্য! এতোক্ষণে একটিবারও তার নামটা মনে পড়ল না কেন? হম্বিতম্বি করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। ড্রয়িং রুমের বেসিনে চোখে মুখে পানি ছিটাল। মৌ এর ঘরে একবার উঁকি মেরে দেখল। সে ঘুমাচ্ছে! কিছুক্ষণ ঘরের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পায়চারি করে ঘরের দিকে পা বাড়াল। ঘরে ঢুকেই চমকে উঠল সে। দরজার সাথে ধপাস করে বাড়ি খেল একটা। আকস্মিক ঘটনায় সে পুরোপুরি হতভম্ব। ভুত দেখার মতো যেন সবটা। স্যার বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চোখ উঠিয়ে তনয়া কে দেখামাত্র হাসার চেষ্টা করল সে। চোখে মুখে মলিন হাসি তার। তনয়া এখনো যেন ভয়ের মধেই আছে। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল। নরম কণ্ঠে শুধাল, “স্যার!”

উষ্ণ ঠোঁট বাড়িয়ে হাসল। উঠে দাঁড়াল। লম্বা দেহখান নিয়ে হাঁটতে বুঝি বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো তনয়ার কাছে। তার এগিয়ে আসার ধরণ দেখে তনয়া ততোটাই পিছিয়ে যাচ্ছিল। বেশিদূর যেতে পারল না। পিছনে দরজার সাথে ঠেসে গেল পিঠ। উষ্ণ চৌধুরী ঝুঁকে পড়ল তার উপর। নিঃশ্বাস বন্ধ করে হতবুদ্ধির মতো চেয়ে রইল সে। উষ্ণের দৃষ্টি শীতল। চোখের পাতা বারংবার ফেলে ফেলে তনয়ার মুখশ্রীর দিকে চেয়ে রইল। তার পিপাসা বুঝি মিটে গেছে। তৃপ্তির রেশ চোখে মুখে উপচে পড়ছে। তনয়ার অস্বস্তি হচ্ছে। তারা কেউ কোনো কথা বলছে। কেবল দেখছে! নির্লিপ্ত নয়ন দুটো স্থির হয়ে দেখছে কেবল। এভাবে পারা যায় না। তনয়া চোখ নামিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে নিল। আচমকা হেঁচকা টানে ফেরত এলো উষ্ণের কাছে। উষ্ণ পিছন থেকে আগলে ধরে আছে তাকে। তনয়া বরফের ন্যায় শক্ত হয়ে গেল। এই বরফ এতো সহজে গলবে না। বারবার ঢোক গিলছে সে। কথা বলতে পারছে না। উষ্ণের নরম হাতের ছোঁয়া তার হাত দুটো কে জড়িয়ে ধরে রাখল। এই ছোঁয়াতে কোনো জড়তা ছিল না। তনয়া দ্রুতই সামলে উঠল। শক্ত কণ্ঠে বলল, “ছাড়ুন আমায়!”

উষ্ণ খুব সহজেই তাকে ছেড়ে দিল। তনয়া পিছন ফিরে চাইল। তার রাগ হচ্ছে না আবার ভালোও লাগছে না। কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। উষ্ণ মৃদু হেসে তাকে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে। তার পুরো মুখটা শুকিয়ে গেছে। মাথার চুলগুলো বড্ড এলোমেলো। শার্টের বোতামগুলো এখনো খোলা। তনয়া কঠোর হতে চেয়েও পারল না। বলল, “এখন কেমন লাগছে?”
“তোমাকে দেখে ভালোই লাগছে!”
“আমি আপনার শরীরের কথা জিজ্ঞেস করছি।”
“আমি তো আমার মনের কথা বলছি।”
তনয়া আর কথা বাড়াল না। বুঝে গেল এর সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই। বাথরুমের দিকে ইশারা করে বলল, “যান ফ্রেস হয়ে আসুন!”

উষ্ণ ওদিকে ফিরতেই তনয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মুচকি হেসে উঠল সে।
.
হাত মুখ ধুয়ে ড্রয়িং রুমে এসে পড়ল সে। এখন তাকে দেখতে একটু তরতজা লাগছে। রান্নাঘর থেকে বোধহয় শব্দ আসছে। উষ্ণ উঁকি মারল। তৎক্ষণাৎ রান্নাঘর থেকে তনয়া বেরিয়ে এলো। উষ্ণ চৌধুরী কে একঝলক দেখে বলল, “বসুন! খেয়ে নিন।”
উষ্ণ বাধ্য ছেলের মতো টেবিলে এসে বসে পড়ল। তনয়া খাবার বেড়ে দিল। একদম সাধারণ পরিবেশনা। ভাত, করলা ভাজি আর মাছের তরকারি। করলা ভাজি উষ্ণ কখনোই খায় না। সেই অভিযোগ করল না।

“তুমি খেয়েছো?”
তনয়া জবাব না দিয়ে সামনের টেবিলে বসে পড়ল। উষ্ণ মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করল। একটু বাদে বাদে চোখ ফেলে তনয়াকে দেখছে। খেতে খেতে বলল, “অনেকদিন পর এতো ভালো খাবার খাচ্ছি।”
“কেন? আপনার বাড়ির রান্না বুঝি ভালো না?”
“না! ভালো না।”
“কেন?”
“তাদের রান্নায় স্বাদ নেই। কেমন বিস্বাদ লাগে সমস্ত কিছু। সবকিছুতে আমার বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। তোমার হাতের রান্না দারুণ তনয়া!”
“আপনাকে কে বলল এসব আমি রেঁধেছি?”
ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ল তনয়া। উষ্ণ মুচকি হেসে আবারো খেতে আরম্ভ করল। খাবারের মাঝেও এক ধরণের তৃপ্তি থাকে, ভালোবাসা থাকে, স্নেহ থাকে। এসব তাদের বাড়ির কারোর মধ্যে নেই। কেমন সবাই অনুভূতিহীন রোবটের মতো চলাফেরা করে। যেন বাঁচতে পারলেই হলো। বাঁচার মতো বাঁচতে না পারলে বেঁচে থাকার স্বাদ কোথায়?

খাবার শেষে উষ্ণ ঔষধ গুলো খেয়ে নিল। রাত ভালোই হয়েছে। মধ্য রজনী প্রায় শেষের দিকে। তনয়ার ঘরের এক প্রান্তে উষ্ণ দাঁড়িয়ে অন্য প্রান্তে তনয়া। হালকা কেশে জিজ্ঞেস করল, “শরীর এখন কেমন? জ্বর এসেছে আর?”
উষ্ণ এগিয়ে গেল তার প্রান্তে। তার সামনে দেওয়ালের সাথে ঠেসে বলল, “চেক করে দেখো।”
“এমন অন্যা*য় আবদার করবেন না।”
“আমি অন্যা*য় করছি।”
“আমার বাড়িতে আসাই আপনার অ*ন্যায় হয়েছে।”
“তাহলে এই হতভাগা অপ*রাধীকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসতে পারলেই তো হতো। ঘরে জায়গা দিলে কেন?”
“অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে যান।”
“তোমায় দেখার পর আমার চোখের ঘুম ফুরিয়ে গেছে।”
“ভালো তো। তাহলে জেগে থাকুন।”
“কোথায় যাচ্ছ? থাকো না আমার পাশে। কথা দিচ্ছি ছুঁয়ে দেখবো না শুধু দু’চোখ ভরে দেখবো তোমায়।”
“আপনি কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবেন।”
“সে তো যাবোই।”
“এটার কি খুব দরকার ছিল?”
“কিসের?”
“বিয়েটা ভাঙার? কেউ একজন আপনার জন্য বধূ বেশে বসে ছিলো। অথচ আপনি তাকে এভাবে তিরস্কার করলেন।”
“তুমি কিছু জানো না তনয়া। আমি কাউকে তিরস্কার করিনি!”
“স্যোশাল মিডিয়া জুড়ে আপনার কীর্তিকলাপের গল্প জুড়েছে তা জানেন?”
“জানার ইচ্ছে নেই। তুমি বলো, আমার নিয়ে কি ভাবলে?”
তনয়া জবাব দিলো না। নিরবতার ভঙ্গিতে দরজার দ্বারে এসে দাঁড়াল। অতঃপর জবাব দিল, “আগে যা বলেছি তাই। সকালে এখান থেকে যাবার পর অবশ্যই একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিবেন।”

আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে মৌ এর ঘরে ঢুকে গেল তনয়া। দরজা বন্ধের শব্দ উষ্ণ এ ঘর অবধি পেল। মৃদু হেসে দু হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে পুরো ঘর চক্কর দিল। অবশেষে বিছানায় এসে মাথা গুজল সে।
.

সকালে উঠেই মৌ এর হইচই লেগে গেলো। উষ্ণের খোঁজ নিয়ে সে বিদায় হলো। তার সাথে দেখা করবার সুযোগ হলো না। তনয়া তাকে বিদায় দেবার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এই মেয়েটা রোজই এমন করে। প্রথমে ঘুম থেকে উঠতে চায় না। যখন দেরি হয়ে যায় তখনই তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে যায়। পুরো ঘর মাথায় তুলে ফেলে! তনয়া এবার পা বাড়াল তার ঘরের কাছে। উষ্ণ স্যার কি করছে দেখা দরকার। ঘরের দরজা চাপানো দিল। তনয়া কড়া নাড়ল। কি আশ্চর্য! নিজের ঘরে ঢুকতেই তার পারমিশন নিতে হচ্ছে? ভেতর থেকে অনুমতি পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল সে। মাথা এদিক থেকে ওদিক ঘুরিয়ে উষ্ণ স্যার কে খুঁজছে। ড্রেসিন টেবিলের সামনে উদাম গায়ে দাঁড়ানো অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষ কে দেখে চমকে উঠল সে। উষ্ণ পিছন ফিরে তাকাল। তনয়াকে দেখে কিঞ্চিত হাসল সে। অথচ তনয়ার মুখ কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে। শুষ্ক কণ্ঠে বলে উঠল, “এভাবে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থেকে কি ভেবেছেন, আমায় ভড়কে দিবেন।
উষ্ণ বিছানার উপর থেকে শার্ট হাতে নিয়ে বলল, “কেন? তুমি ভড়কে যাও নি? একচুয়েলি আমি একটু বেশিই হ্যান্ডসাম!”
“এসব চাল আমার উপর চলবে না। কি ভেবেছেন? এ যুগের মেয়েদের মতো সিক্স প্যাক দেখে গায়ে এসে পড়ব!”
তনয়া মহা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। উষ্ণ তাকে আরেকটু রাগি*য়ে দেবার জন্যই বলল, “ওহ! তুমি বুঝি তাদের দলের নয়। আচ্ছা তনয়া, তুমি না বললে তুমি একজনকে ভালোবাসো। কাকে পছন্দ করো বলো তো? সে আদৌও ছে*লে তো। না মানে এখনকার যুগে তো…
“মুখ সামলে কথা বলুন। আজগুবি গল্প একদম বানাবেন না। সবার টেস্ট এক না ওকে। আর সবচেয়ে বড় কথা, ইউ আর নট সো নাইস এন্ড এট্রাকটিভ! যার কারণে আমায় আপনার প্রেমে পড়তে হবে!”
“দূর থেকে দেখছো বলে, কাছে এসে দেখো! তুমি আলবাদ প্রেমে পড়বে!”
তনয়া মুখ বাঁকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে সরে দাঁড়াল। উষ্ণ বলে উঠল, “কি হলো? ভয় পেলে?”
“না। আপনি শার্ট কোথায় পেলেন বলুন তো?”
“জেএস দিয়ে গেল।”
“কখন?
“ভোরে।”
“ভালো‌। এখন আপনাকে দিব্যি সুস্থ লাগছে। এবার আমার বাসা থেকে বিদায় হন।”
“সকালের নাস্তা ছাড়াই বিদায় করবে।”
তনয়া জবাব না দিয়ে চলে গেল। উষ্ণ বলে উঠল, “আচ্ছা এক কাপ চা তো জুটবে? এই তনয়া। কি হলো?”
তনয়া এসব শুনেও না শোনার ভান করছে। এই লোকটা হঠাৎ করেই তার ঘাড়ে জাকিয়ে বসেছে। কেমন আবদার করছে। কি আশ্চর্য! লোকটা কি অধিকার ফলাচ্ছে। উষ্ণ চৌধুরী টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। চোখে মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে। এতো খুশির কারণ কি? উষ্ণ বলল, “অনেক ভাবলাম বুঝলে, তোমার ভালোবাসার মানুষ নাই বা হতে পারি। ফ্রেন্ড তো হতেই পারি তাই না!”
বলেই হাত বাড়াল। তনয়া রূঢ় স্বরে বলল, “আপনাকে তো আমার শত্রু ও বানাবো না।”
উষ্ণ হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “পাতানো ভাই বলোনি এই অনেক। সেটা বললে বেশি কষ্ট হতো। থাক আমি না হয় তোমার লাভার হয়েই থাকব! যেমন তুমি আছো!”
তনয়া উৎসুক চাহনিতে ফিরে তাকাল। উষ্ণ স্যার এটা কি বলল? যেমন তুমি আছো মানে? কিসের কথা বলছে তিনি? সে যে তন্ময়কে একতরফা ভালোবাসে এসবের কথা? কিন্তু এসব এই লোকটা কি করে জানল? ঠিক কতোটুকু জানে তার ব্যাপারে? কতোটুকু! রহস্য কেবল গাঢ় হচ্ছে। উন্মোচন করতে গিয়ে গোলক ধাঁধায় আঁটকে যাচ্ছে। এই লোকটাকে কালো মেঘের মতো মনে হচ্ছে। তার বজ্র*পাতে তার জীবন বদলে দিবে। ভয় গেঁথে যাচ্ছে মনের মধ্যে। অচেনা ভয়!

#চলবে