তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
16

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_২৬

চলন্ত বাস চলছে দ্রুতবেগে। এই মধ্যরাতে রাস্তাঘাট ফাকাই থাকে। কোনো রকম ব্যস্ততা ছাড়া ছুটে চলে যায়। বাসের আলো নিভো নিভো। ঘুমে বিভোর একেকজন। যাত্রীদের মধ্যে জেগে আছে কেবল দুটি প্রাণ। উষ্ণের পাশে বসার পর থেকে তনয়ার ঘুম উধাও। এদিকে উষ্ণের হৃৎপিণ্ড কাঁপছে বাসের গতি মিলিয়ে। এভাবে পাশাপাশি ঘেসে বসে থাকার আনন্দ অন্যরকম। একে অন্যের ঘ্রাণ নেওয়া, কিছুক্ষণ সময় কাটানো সবটাই যেন এক স্বপ্ন। কিন্তু বার বার তার দুঃস্বপ্ন মনে করিয়ে এই স্বপ্ন তার পূরণ হবার নয়।

বাস চলছে দ্রুতবেগে। এই বাস থামবে কুমিল্লার কাছে এসে তার আগে নয়। সেখানেও থামে কি না ঠিক নেই। তনয়া অনেকক্ষণ ধরেই উসখুশ করছে। এখান থেকে উঠে যেতে পারলে বোধহয় ভালো লাগত। তার অস্বস্তি টের পেয়েছে উষ্ণ। তনয়া ফোন হাতড়াতছে। ফোনের ওয়ালপেপারে দুজন অজ্ঞাত নরনারীর ছবি ভেসে উঠল। উষ্ণ তাদের প্রথমে না চিনতে পারলেও এবার পারল। কথার একটা ছুতো পেয়েই বলে বসল,

“তোমার কেউ নেই তনয়া?”

তনয়া আচমকা ফিরে তাকাল। প্রশ্নটা কেমন অদ্ভুত আর অপ্রাসঙ্গিক। এখন এই প্রশ্নের মানে কি? উষ্ণ চেয়েছিল তাকে ঘাবড়ে দিতে। ঘাবড়ে দিলে বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভুলে যেতে পারে। তনয়া নিঃশব্দে মাথা দুলিয়ে জানালার দিকে তাকাল। বস্তুত বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারে যেন সবকিছু খেয়ে নিয়েছে। তবুও এমন ভণিতা করল যে সে খুব ব্যস্ত। কথাটা এড়িয়ে যেতে চায়।

উষ্ণ নিজেই যেচে বলল, “হ্যাঁ, আমি শুনেছিলাম এ*ক্সিডেন্টে তারা দু’জন মা*রা গেছেন। তুমি তখন খুব ছোট ছিলে।”

এসব কথা তনয়ার শুনতে ইচ্ছে করছে না। ভালোও লাগছে না। সে জবাব দিল না। উষ্ণ বেমালুম বলে বসল, “তোমার কষ্টটা আমি বুঝি তনয়া?”

অশ্রু ভিড়েছে আঁখিজোড়ায়। মন চাতক পাখির মতো জেগে উঠল। এদিক ফিরে রু*দ্ধ স্বরে বলে বসল, “আপনি বুঝবেন না। কেউ বুঝে না?”

আবারো মুখ ঘুরিয়ে নিল। অপ্রত্যাশিত চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়লে মুছে নিল। দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল খানিকক্ষণ। আচমকা মনে পড়ল স্যারের কথা। তিনি বললেন, কষ্ট বুঝেন! কি করে? মনে পড়ল তার মায়ের কথা। তিলোত্তমা বেগম তো তার আসল মা নন। সৎ মা। সৎ মায়ের সাথে সম্পর্ক ভালো নয় সেটা সেদিন ইরিশা জামানের ওখানে আঁচ করতে পেরেছে। তথাপি মনে তার অপ*রাধবোধ জেগে উঠল। নিজেকে শান্ত করিয়ে লজ্জাবির্মষ মুখ নিয়ে স্যারের দিকে ফিরল। স্যার সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। নিশ্চিত ঘুমায় নি। তনয়া নাক টেনে শুধায়,

“সরি!”
উষ্ণ জেগে উঠল আচমকা। অবাক গলায় বলল, “আমায় বলছো?”
তনয়া চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। উষ্ণ জানালার দিকে ফিরে বলল, “কি ব্যাপার রাতের আকাশে সূর্য উঁকি দিল নাকি?”

“মজা করবেন না।”

উষ্ণ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে দৃষ্টি মিলিয়ে বলল,
“আমি মজা করতে পারি না তনয়া, সবকিছুতে সিরিয়াস থাকি।”

তনয়া মাথা নিচু করে ফেলল। মিনমিন স্বরে বলল, “আপনার মায়ের কি হয়েছে?”
উষ্ণ সিটের উপর আরাম করে বসে বলল, “জানি না।”
“মানে?”
“মানে তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। দেখলাম একদিন মা ব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরে এলেন না।”
তনয়া মুখ ফসকে বলে ফেলল, “কেউ আটকায়নি তাকে?”
“কেউ? বাবার কথা বলছো? তিনি তো তার পা দুটো ধরা বাকি রেখেছিলেন। অনেক কেঁদেছিলেন কিন্তু মা থামেননি।”
তনয়া আগ বাড়িয়ে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিলো কিন্তু থেমে গেল। খামোখা এসব ব্যাপারে কৌতূহল বাড়ানো ভালো না। তবু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। বিবেক বাঁধা দিচ্ছে। সে বিবেকের কথা শুনল। উষ্ণ আগ বাড়িয়ে বলল, “আমার বাবা মা কে অনেক ভালোবাসতেন। কিন্তু মা কখনো বুঝলেনই না।”

“আপনার সাথে দেখা হয়?”
“না, সেদিনের পর আর দেখি নি।”
“খোঁজ নেননি?”
উষ্ণ মৃদু হাসল। এই হাসি তার সব ক*ষ্ট লুকিয়ে রাখতে সক্ষম। মলিন কণ্ঠে বলে উঠলো, “আমি জানিও না তিনি বেঁচে আছেন কি ম*রে গেছেন। যেহেতু আমি খোঁজ পায়নি তবে আর নেই। থাকলে খুঁজে পেতাম। কম তো আর খুঁজি নি।”

তনয়া এবার সত্যি সত্যি চুপসে গেলো। আর কথা বলতে ভালো লাগছে না তার। এমনও হয় বুঝি। উষ্ণ স্যারের সাথে এদিক থেকে তার যেন মিল পাওয়া যায়। তার কষ্ট সে বুঝতে পারছে। কি অদ্ভুত? সে তাকে বুঝতে শিখে গেছে!

——–

বাস থামার কথা না থাকলেও থেমেছে। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। ভোরের আলো ফুটতে আর কিছুক্ষণ বাকি। কেউ কেউ নেমে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। তনয়া নামেনি। সিটের সাথে হেলান দিয়ে বন্ধ জানালার উপর মাথা রেখে বসে আছে। চোখ পড়ল সিটের উপর রাখা স্যারের ফোনের উপর। নিজের কাজের কথা মনে পড়ল তার। একটা দায়িত্বের ভার পড়েছে তার উপর। উষ্ণ স্যারের প্রেমিকাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব!

পাঠকরা এখানে এসে আশ্চর্যান্বিত হতে পারেন। কারণ তারা মনে করছেন তারা যেই মেয়ের খোঁজ করছেন সে নির্ঘাত তনয়া। তবে গল্পটা যে এতো সহজ নয়। তনয়ার নিজেরও তাই মনে হয়েছিল মেয়েটি সে নিজেই। তবে তার ভুল ভেঙেছে আজ সন্ধ্যায়। যখন দূর থেকে শুনতে পেলো স্যার ফোনে অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা বলছে। একজন পুরুষ ভালোবাসার কথা কেবল একজন নারীকেই বলতে পারে। কিংবা মা আর বোন। তেমন তো কেউ নেই। তবে কি সে ঠিক ধরছে। উষ্ণ স্যারের প্রেমিকা আছে!

দ্বিধা কম হচ্ছে নাই তনয়ারও। স্যারের মতলব বুঝতে সে ব্যর্থ। এই তার সাথেও ফ্লার্টিং করছে। আবার ফোনে অন্য মেয়েকে ভালোবাসার কথাও বলছে। তাজ্জব কাহিনী। তবে বড়লোকের ছেলেপেলেদের গার্লফ্রেন্ড তিন চারটে থাকেই। এরা নিজেরাই ভেবে পায় না কাকে বউ বানাবে।

ফোন সাইলেন্টে ছিল কিন্তু আলো জ্বলে উঠলো। মেসেজ এসেছে বুঝি। তনয়া এদিক ওদিক তাকালো চোরের মতো। বিবেকের বাঁধা এইবার না শোনার ভান করে ফোনটা হাতে নিয়ে নিল। হ্যাঁ মেসেজই তো। ভালোবাসার কথা ভাসছে ফোনের স্ক্রিনে। কেউ একজন মন প্রাণভরে ভালোবাসার কথা লিখে পাঠিয়েছে। নাম শো করছে ডার্লিং নামে। কি ভেবে মেসেজে টাচ করল। অমনি ফোনে পাসওয়ার্ড চাইছে।তা জানার কথা তনয়ার নয়। অগত্যা তাকে ফোনটা রেখেই দিতে হলো। ভাগ্য কি ভালো, ফোনটা রাখতেই স্যার বাসে উঠে বসল। ইশ্, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তনয়া!

বাস ফের ছুটছে দিগন্ত বেয়ে। সারাটে রাত জেগে থাকলেও এবার রাত পোহানোর সাথে সাথেই তনয়ার চোখে এসে জড়ো হলো রাজ্যের ঘুম। ঘুম তাকে কাবুতে করতে চাইছে। কিন্তু তনয়া চাইছে না। তবে তার চাওয়া না চাওয়াতে বিশেষ সুবিধা হলো না। কারণ সে ঘুমিয়ে গেল। পাশের সিটে থাকা উষ্ণের নজর কাড়ল সেই ঘুমন্ত মুখখানা। সে হত বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল বেশ খানিকক্ষণ। বাসের ঝাঁকুনি খেয়ে এলোমেলো চুল এসে জড়ো হচ্ছে মুখের উপর। উষ্ণ তা সরিয়ে দিলো নির্বিঘ্নে। আলতো করে মাথাটা এনে রাখল তার ঘাড়ের উপর। এতটুকুই যেন চেয়েছিল সে। মনের আশা পূরণের খুশিতে অদ্ভুত শান্তির স্রোত বয়ে গেল মনের ভিতর। চোখ বন্ধ করে সেই শান্তির স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে বয়ে যাচ্ছিল সে। আচমকা গাড়ি থেমে গেল। ভাগ্যের সাথে উষ্ণের দুশ*মনি সেই অনেক আগে থেকেই। তার সুখ কপাল সইতে পারে না। সবে পাঁচ মিনিটই হবে সে চোখ বুজেছিল। এরই মধ্যে গন্তব্য শেষ হয়ে গেল। বাস এসে থেমে গেল। সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। বাড়ি ফিরার পালা যে। তবে এই খানিকক্ষণ সুখের রেশ যেন থেকে যায় আজীবন।

বাস ছেড়ে নেমে সবাই বিদায় জানাচ্ছে। তনয়ার ঘুমের রেশ তখনো কাটছে না। একটু পর পরই হামি দিচ্ছে। উষ্ণের মাথায় বুদ্ধি আটল। তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যাক। আরো কিছুক্ষণ একসাথে থাকার অজুহাত তৈরি হয়ে গেল। তনয়া ব্যাগপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছে। পিছন থেকে উষ্ণ পা কি বাড়াল ঝড়ের গতিতে বাইক নিয়ে হাজির তন্ময়। হঠাৎ ঝড়ের পর যেই নিস্তব্ধতা বয়ে যায় ঠিক তেমন নিস্তব্ধতা নেমে এলো উষ্ণের চোখে মুখে। তনয়ার চোখ মুখ থেকেও ঘুমের রেশ উধাও। সে ছুটে চলে গেল তন্ময়ের কাছে। একটা চাঁপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল উষ্ণ। আর কেউ খেয়াল করুক আর না করুক জেএস নজরে রাখছিলো সবকিছুই। সে এগিয়ে এসে স্যারের পাশে দাঁড়াল।

তনয়া খুশিতে গদগদ হয়ে তার বাইকে উঠে বসছে। জেএস যথাসম্ভব গলা নামিয়ে শুধাল, “স্যার!”
উষ্ণ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “একটা কথা খুব ভালো বুঝে গেছি জেএস। এই তন্ময় থাকতে আমি তনয়া কে পাবো না। আমাদের মাঝে থেকে এবার তন্ময় কে সরিয়ে ফেলতেই হবে। বুঝলে তুমি!”

জেএস নিশ্চুপ। এসব সরিয়ে ফেলার কথা শুনলেই তার ভ*য় করে। স্যারের পাগলামি দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। তনয়া ম্যাডামের জন্য কি কি করতে পারেন সে?

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_২৭

‌‌“ভালোবাসি শব্দে প্রকাশ করা যায় না।” ততোখানি প্রকাশ করা যায় না যতখানি ভালোবাসা যায়। ভালোবাসতে যেমনি তনয়া জানে, তেমনি উষ্ণ জানে। ভালোবাসতে কম জানে না তন্ময় ও। তারা তিনজনই তিন রাস্তার পথিক। তাদের ভালোবাসার রকম ভিন্ন। তিনজনের ভালোবাসায় শুদ্ধ, গাঢ়। তবে তিনজনই ভালোবাসে ভুল মানুষকে। ব্যাপার না, এই ভুল আমরা সকলে করি! ভুল মানুষকে ভালোবেসে বসি!

তন্ময়ের মা এখন আগের থেকে অনেকখানি সুস্থ। তার হঠাৎ করে অসুস্থতার পিছনে উষ্ণের হাত থাকতে পারে কিংবা চালাকি। আবার নাও। সে এক রহস্য! দু একটা রহস্য এভাবেই পড়ে থাকুক। কারণ ভাগ্য উষ্ণের সঙ্গ কখনো দেয়নি কখনো।

ছুটি কাটানোর পর সবাই আবার কাজে লেগে গেছে। লাগতেই যে হতো। এই করেই তো সবার সংসার চলে। তনয়াও বসে আছে ডেস্কের সামনে। সে হাতের পেন্সিল খানা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে কেবল। দৃষ্টি জোড়া স্যারের কেবিনের দিকে। তাকে স্যারের পিছন পিছন গোয়ে*ন্দাগিরি করতে পাঠানো হয়েছে। এই কাজটা তনয়া করছে। মন সায় না দিলেও সে করছে।

সেক্রেটারী জেএসের সাথে উষ্ণ বেরিয়ে এলো। স্যারের সিডিউল তনয়ার জানা। হাতের ঘড়ি চেক করল সে। স্যারের মিটিং আছে। ঘণ্টাখানেক বাদে সে আসবে না। এদিক ওদিক নজর দিল। লাঞ্চ টাইম হতেও ঘণ্টাখানেকই বাকি আছে। চোখ বন্ধ করে ভেবে নিল। না তাকে করতেই হবে। ফাইল হাতে উঠে দাঁড়াল। কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটা ধরল স্যারের কেবিনের কাছে। দরজা অবধি পৌঁছে গেছে। দরজা খুলে ঢুকতে যাবে অমনি ম্যানেজারের আওয়াজ,

“তনয়া, স্যার তো কেবিনে নেই!”

থতমত খেয়ে উঠল সে। সামলে নিল পরক্ষণেই। মেকি হাসির রেখা টেনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে উঠলো, “জানি স্যার। স্যারের টেবিলে একটা ফাইল ছিল ওটাই আনতে যাচ্ছি!”

ম্যানেজার সাহেবের সন্দে*হ করার কোনো কারণ ছিল না। সে হেসে মাথা নেড়ে চলে গেল। তনয়া ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। মুখ খুলে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। চোখ পড়ল উপরের সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে। স্যার তো জানবেই, তবে তার কাজ শেষ হবার পরেই জানুক। চিরুনি তল্লাশি চলল কেবিনের উপর। তনয়া কি খুঁজছে সে নিজেও জানে না। কেবল হাইহুতাশ করে খুঁজছে।
তন্ন তন্ন করে খুঁজছে তবুও কিছু পেলো না।

তবে শেষ অবধি পেলো। টেবিলের কোণায় পড়ে থাকা কিছু ফটোগ্রাফি! এগুলো কি তনয়ার কাজের কিছু? উল্টো হয়ে ছবি গুলো পড়ে থাকায় উপরের সাদা মসৃণ পৃষ্ঠা দেখা যাচ্ছে। তনয়ার হাত কাঁপছে। আজ অবধি জেনেশুনে অ*ন্যায় কাজ কখনো করেনি সে। কিন্তু এবার করছে, তাকে করতেই হতো।

হাত পৌঁছে গেছে ছবি গুলোর দিকে। তুলে দেখার আগেই আচমকা এক শক্ত হাত এসে ধরে ফেলল তাকে। ভিমড়ি খেয়ে উঠল সে। আপাদমস্তক কেঁপে উঠলো ভয়ে*তে। চোখে মুখে ভয়ে*র ছাপ। ও প্রান্তের ব্যাক্তিকে দেখার আগেই তার পারফিউমের ঘ্রাণে সে চোখ বন্ধ করে নিল। সে ধরা পড়ে গেছে!

উষ্ণ ঠিক তার পিছনে পিঠ ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতটা তার হাতের উপর। শক্ত করে হাতটা ধরে কানের কাছে মুখ এগিয়ে বলে উঠলো, “কি করছেন মিস তনয়া?”

রক্ত*শূন্য চাহনি, ফ্যাকাশে মুখে তনয়া তার সামনে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি মেঝেতে, মাথা তোলবার সাহস নেই।‌ তনয়া নিশ্চুপ! উষ্ণ তার থিতুনিতে হাত রেখে মুখটা উঁচু করিয়ে শুধাল, “আপনি মাথা কেন নিচু করছেন তনয়া? কি করেছেন?”

তনয়া চোখ মিলাতে পারছে না। এদিক ফিরে দেখল জেএস তাকে দেখছে। লজ্জা*য় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। তা কথা ফুরিয়ে আসছে। উষ্ণ হাত সরিয়ে নিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে টেবিলের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনার থেকে এটা আশা করা যায় না। এই তনয়া কে আমি চিনি না। টাকার জন্য তনয়া বি*ক্রি হতে পারে না। তো কার কাছে বি*ক্রি হলেন? ইরিশা জামান নাকি তিলোত্তমা বেগম?”

আঁখি জুড়ে তার অপরা*ধবোধ স্পষ্ট। এবার চোখ তুলে তাকাল। লজ্জা, বিস্ময়তায় ছেয়ে গেছে। শুকনো ঢোক গিলল সে। তার ঠোঁট নাড়ছে অথচ কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কার কথা বলছে সে। উষ্ণ চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে বললেন,

“কার নাম বললেন?”

তনয়ার অস্ফুট জবাব, স্যার বলেছে!”

“স্যার মানে?” অতঃপর স্তব্ধ চাহনিতে ফিরে তাকাল জেএসসের দিকে। জেএস বিমূর্ত! ফিসফিসিয়ে বলল, “বস বলেছে!”

তনয়া মাথা নাড়ল। উষ্ণ স্যার মুখে হাত দিয়ে শুধাল, “বাবা! বাবা আপনাকে বলেছে এই কাজ করতে?”

দ্বিতীয়বারের মতো মাথা নাড়ল তনয়া। তার হৃদয় চূর্ণ*বিচূর্ণ হয়ে গেছে। লজ্জা, আত্ম*সম্মান এসে মাথা ঠুকছে মাটিতে। নিজেকে এতো অপমা*নিত আগে কখনো মনে হয়নি তার। উষ্ণ ফট করে হেসে উঠলো। বলল, “লাইক সিরিয়াসলি বাবা তোমাকে বলেছে এই কাজ করতে? তোমাকে!”

তনয়া ভি*মড়ি খেয়ে চোখ মুখ ছোট করে নিল। উষ্ণ মুখ ফিরে হাসল জেএসের দিকে। তাচ্ছিল্য সুরে বলল, “তোমার বস তোমাকে আর বিশ্বাস করে না জেএস!”

সে নিশ্চিত অপ*মানিত হলো। তবুও কণ্ঠে দৃঢ়তা রেখে বলে উঠলো, “আমি আপনার জন্য কাজ করি স্যার!”

“হুম, বাইরে যাও। মিস তনয়ার সাথে আমার একান্ত কথা আছে!”

জেএস বেরিয়ে যেতেই তনয়া বলে উঠলো, “আমি কালই রি*জাইন লেটার দিয়ে দিব।”

বলেই পাশ কাটিয়ে চলে আসবে। তৎক্ষণাৎ উষ্ণ চৌধুরী বলে উঠলো, “আমি আপনাকে চাকরি ছা*ড়তে বলিনি মিস তনয়া!”

“এসবের পরেও আপনি চান আমি এখানে থাকি।”

“অবশ্যই কেন নয়? আপনি আপনার স্যারের কথা শুনেছেন। তিনিও এই কোম্পানির বস। তার কথা শুনতে আমি বাধ্য!”

হৃদয়ে এতোক্ষণ যেই বি*মর্ষ বেদনায় ছটফট তা এতোক্ষণে শান্ত হলো। যেই কথাটা হৃদয়কে সে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করছিল। সে কাউকে ধোঁকা দেয়নি। তার বসের কথা শুনেছে। শেহনেওয়াজ জাওয়াদ চৌধুরী তার বস। সে তো তার কথা শুনতেই পারে। হৃদয়ে যে ঝড় ছিল তা কমে গেল। কিন্তু এবার শুরু হলো দ্বিতীয়ভাবে। সে কোনো সাধারণ ঝড় নয়। হৃদয় তোলপাড় করা ঝড়। উষ্ণ মূহুর্তে এসে তার ঘাড় ধরে তাকে কাছে টানল। এসবের জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল রীতিমতো। আঁকড়ে ধরল তার হাত। চোখে মুখে ভিষণ অস্থি*রতা। উষ্ণ তার কাছে এগিয়ে বলছে, “আপনার বসকে গিয়ে উত্তর বলে আসবেন। বলে আসবেন সেই মেয়েটির কথা!”

“সেই মেয়েটি কে?”

উষ্ণ কাছে ঘেসল। তনয়া পুরো শরীর যেন নিস্তেজ হয়ে উঠেছে। কি হতে যাচ্ছে এখন। যা হওয়া উচিত! না, এ হতে পারে না। সে তন্ময়ের। শুধু তার। কিন্তু উষ্ণ স্যার যে.. শক্তি নেই। নড়চড় করতে পারছে না। হাত খামছে ধরে আছে। ছটফট করছে। এই, এই বার বার। তিনি বার বার তার কাছে চলে আসে। অনেক কাছে বহু কাছে। ভয়ে তনয়া চোখ বন্ধ করে নিল। ফট করে উষ্ণ ছোঁয়ায় শরীরে তরঙ্গ ছুটে গেল। পুরো শরীর উ*ত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। যৌবনে কিংবা জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষের সাথে এতোখানি ঘনি*ষ্ঠতা। ঠিক এতোখানি আগে কখনো হয়নি। উষ্ণ স্যারের উষ্ণ ছোঁয়া ছুঁয়েছে তার গলার কাছে। কানের কাছে গরম নিঃশ্বাসের আভা। ফিসফিস কণ্ঠ, “গিয়ে বলবে, সেই মেয়েটি আর কেউ নয়। কেবল তুমি, শুধুমাত্র তুমি!”

বলেই ফিরল তার মুখের কাছে। চোখে চোখে কথা বলছে দুজন। উষ্ণ স্যারের চোখেতে কিছু একটা তো আছেই। তনয়া চোখের ভাষা বুঝার অযথা চেষ্টা করছে না। পলকহীন দৃষ্টির ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হলেও উষ্ণ স্যার বলতে ব্যর্থ হয়নি। তিনি বলে উঠলেন, “ইউ আর দ্যা গার্ল! বিকজ মাই আইজ অলওয়েজ অ্যাডমায়ার ইউ! যাস্ট ইউ তনয়া!”

তনয়া মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। এই কাছে আসা, এই চুম্বন সে মেনে নিতে পারছে না। তার হৃদয় মেনে নিতে চাইছে না। অথচ শরীরের চাহিদা অন্যরকম। মনকে বাঁধিয়ে রাখা যায় শরীর কে নয়। সর্বস্ব মানসিক শক্তি দিয়ে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো ডুবে যাবার আগে। আবেগে ভেসে যেতে নেই। অন্য সবার মতো স্রোতের সাথে ভেসে যেতে পারবে না। পারবে না! মূহূর্তে নিজেকে টেনে তুলল। খানিকক্ষণের সে সন্ধিকে অগ্রাহ্য করে, অস্বীকার করে সে ছুটে পালিয়ে এলো। তাকে যে পালাতেই হতো!

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_২৮

ট্যুরে যাবার একদিন আগের কথা। তনয়াকে ডেকে পাঠিয়েছে জাওয়াদ শেহনেওয়াজ চৌধুরী। তনয়া এসেছে চৌধুরী ভবনে। তাকে কি কারণে ডেকে পাঠিয়েছে এসব তার জানা নেই। তবে কিছু তো একটা ঘটেছেই। ধারণা ছিল বৈকি। তার দুদিন আগেই ইরিশা জামান আর তিলোত্তমা বেগমের প্রস্তাবকে নাকোচ করে এসেছে। তাদের কাজ করতে তনয়া বাধ্য নয়। তাদের ভয় ও পায় না। তবে জাওয়াদ স্যারকে একটু যেন ভয় পায় সে। পাবে নাই বা কেন? বস তো! এককালে অফিসে তার হয়েই কাজ করেছে সে। যেমন রা*গী লোক ছিল। তার ভয়ে অফিসের সকলে তটস্থ থাকত। তনয়ার সেই ভ*য় আজ ও আছে।

চৌধুরী বাড়িতে বোধহয় কেউ নেই। কাউকে নজরে পড়েনি বিশেষ করে। সে আসতেই একজন সার্ভেন্ট তাকে নিয়ে চলে গেলো সোজা স্যারের স্টাডি রুমের সামনে। দরজায় নক করা হলে অনুমতি পেয়ে দুজনেই প্রবেশ করল। ইশারায় সেই সার্ভেন্ট বেরিয়ে গেলেন। বন্ধ কামরায় একা রইলেন স্যার আর সে!

জাওয়াদ মুখের সামনে থেকে ফাইল সরিয়ে রাখলেন। ইশারায় তনয়াকে বসতে বললেন। তনয়ার যে অস্বস্তি হচ্ছিল না তা না। তবু বিনা সংকোচে বসে পড়ল। জাওয়াদ স্যার পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন,

“চায়ের কথা বলি।”

“না স্যার,‌আমি সবে চা খেয়েই এসেছি।”

“আচ্ছা, ভণিতা না করে কাজের কথা বলি তনয়া।”

তনয়া মেরুদন্ড সোজা করে টান টান হয়ে বসল। পারে না দম বন্ধ হয়ে বসে থাকতে। স্যার তার দিকে ফিরে কয়েক সেকেন্ড কিছু ভেবে শুধায়,

“অফিসের কাজ কেমন চলছে?”

“ভালো স্যার।”

“নতুন বসের কাজ কেমন লাগছে? কি মনে হয় তিনি সামলাতে পারবেন? ভ*য় পেয়ো না তনয়া, তুমি অনেক বছর ধরে আমার অফিসে কাজ করছো। তাই জিজ্ঞেস করছি।”

“না স্যার তিনি পারবেন। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন!”
বলেই সে শুকনো ঢোক গিলে বিরবির করল, “কচু পারবে। সারাদিন কেবল মেয়েদের পিছনে ছুটে। ধুরি তার পিছনে ছুটে। কাজের নামে অষ্টরম্ভা! স্যারের কাছে তার ছেলের নামে বদনা*ম করে শুলে চড়বে নাকি। অতঃপর ওই ভাদাইম্যার প্রশংসা তাকে করতেই হবে।”

জাওয়াদ কিয়ৎকাল ভাবনায় মগ্ন থাকার পর একটু নড়েচড়ে উঠলেন। অতঃপর বললেন, “তোমায় এখানে একটা কাজের জন্য ডেকেছি তনয়া।”

তনয়াও যেন নড়েচড়ে উঠল। হ্যাঁ সেটাই শুনতে এসেছে সে। স্যার ফের বললেন,
“তোমায় একটু উষ্ণের উপর নজর রাখতে হবে। তোমরা সবাই জানো, সে জামান পরিবারের সাথে কি করেছে। এই নিয়ে একটা রেষা*রেষি চলছে। আমার ধারণা উষ্ণ কোন এক মেয়ের পাল্লায় পড়ে এসব করেছে। মেয়েটা অফিসের কেউ। তুমি কি তাকে খুঁজতে আমায় হেল্প করবে?”

তনয়া স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ! বিস্মিত চাহনিতে স্যারকে দেখছে। এরা সবাই কোন মেয়ের খোঁজ করছে? মেয়েটিকে নিয়েই পড়ে আছে কেন? মনে সুপ্ত ভয়ের আভাস আছে। আচ্ছা মেয়েটা আবার সে না তো। এমন হলে সামনে তার জন্য ঘোর বিপদের অপেক্ষা করছে। কিছু না করেও বিপদের ভাগিদার হওয়াটা যেন সে মানতে পারছে না। অতঃপর নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে রইল। জাওয়াদ স্যারের কথার অমান্য সে করতে পারে না। বরাবরই স্যারকে সে পিতৃতুল্য মেনেছে। তনয়ার একটাই সমস্যা, যাকে মনের অতলে বিশেষ স্থান দিয়ে ফেলে তাকে সে না করতে পারে না।

আজ সেখানে দ্বিতীয়বার। এবার যেন ভ*য়টা একটু বেশিই করছে। আজ স্যারকে কি বলবে সে? কি করেই বা বলবে? সেই মেয়েটি যে আর কেউ নয়। সে নিজেই! উষ্ণ স্যার নিজে বলেছে সেই কথা। তার জন্যেই বিয়ে ভে*ঙেছে, দু পরিবারের মাঝে আজ বিশাল দ্ব*ন্দ্ব। অথচ এর গোড়াতে তনয়া নেই। সে জানেই না এসব কিছু। এরপরেও দো*ষের ভাগিদার কি করে হবে সে।

চৌধুরী বাড়িতে তনয়ার আগমন আজ টের পেয়েছে উষ্ণ চৌধুরী। তার প্রতিক্ষায় ছিল সে। আড়াল থেকে তার উপর নজর রাখছে। তনয়া এসে সোজা ঢুকেছে বাবার স্টাডি রুমে। এতোটুকু দেখেই সে বাঁকা হাসল। ভেতরে কি হবে এটা তার ধারণায় আছে।
.
জাওয়াদ চৌধুরী ভ্রু কুঁচকে বললেন, “অফিসের কেউ না?”
তনয়া মাথা দু পাশে দুলিয়ে বলল, “না অফিসের কেউ না। আপনার কথামতো আমি স্যারের উপর নজর রেখেছি। ট্যুরে যাবার পর থেকেই স্যার আমাদের সাথে ছিলেন। কিন্তু ফোনে কার সাথে যেন বার বার কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। আসলে আমি ফোনে তাদের মেসেজ ও দেখেছি। তাই মনে হচ্ছে মেয়েটা অন্যকেউ!”

“মেয়েটার কোনো ছবি?”

“না পাইনি স্যার।”

জাওয়াদ চৌধুরী মাথা দুলিয়ে বললেন, “তুমি এবার আসতে পারো। যা করেছে সেজন্য তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ!”

বাইরে বেরিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল তনয়া। ভেতরে এতোক্ষণ কি সহজেই মি*থ্যে কথাগুলো বলে এলো। ইশ একবারও বাঁধলো না তার। এতো ভালো মিথ্যে সে বলতে পারে আগেও তো কখনো ভাবেনি। শরীর কাঁপছে, কপাল ঘামছে। ভিতরে এতোক্ষণ ভ*য় টের পায়নি বাইরে আসার পর থেকেই পাচ্ছে। এ বাড়িতে আর এক মিনিট ও নয়। এখুনি চলে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু তার চলে যাবার আগেই এক সার্ভেন্ট এসে আটকে দিল তাকে। তনয়া খানিকটা হকচকিয়ে উঠল। সার্ভেন্ট তাকে ইশারা দিয়ে ওদিক দেখাচ্ছে। তনয়া সিঁড়ির গোড়ায় চোখ রেখে শুধায়, “কে ডাকছে আমায়?”

“স্যার ডাকছেন।”

তনয়া নিশ্চুপ। এই সবেমাত্র স্যারের সাথেই তো দেখা করে এলো। এখন কে ডাকছে? উষ্ণ স্যার। ভ্রু দুখান কুঁচকে চেয়ে রইল। যাবে কি? উঁহু যাবে না। কে যাবে তার সাথে কথা বলতে। বলেই উল্টো পায়ে হাতা দিবে অমনি সার্ভেন্ট তার হাত চেপে ধরে বলল, “স্যার আমার সাথে যেতে বলেছে!”
আরে কি বিপদ! এই মেয়ে তো দেখি নাছোড়বান্দা। থামছেই না। অগত্যা তনয়াকে যেতে হলো।

স্যারের ঘরের মধ্যে সে উঁকি দিচ্ছে। মেয়েটি তাকে ধরে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে বেরিয়ে গেল। পুরো কামড়া খালি। স্যার কোথায়? ধপ করে দরজা বন্ধের শব্দে কেঁপে উঠল সামান্য। পেছন ফিরে দেখল দরজার সামনে উষ্ণ স্যার দাঁড়িয়ে। দরজা লক করে দুই হাতে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে তনয়াকে দেখছে। তার দেখার ধরণ খানিকটা ভিন্ন। ঘাড় বাঁকানো, চোখ দুখান ছোট ছোট করে দেখে। বাজ পাখির চোখ! যেন তাকে ছাড়া আর কাউকেই দেখতে চায় না!

তনয়া জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “আমায় ধরে নিয়ে আসলেন কেন?”

“মন চাইলো তাই। বসো কথা আছে। স্যারকে কি বলেছো?”

“কোন ব্যাপারে?”

“মেয়েটির ব্যাপারে।”

তনয়ার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। সে এক পা এগিয়ে বলল, “আমি কিছু বলিনি।”

উষ্ণ সামনে এগিয়ে বলল, “কি বলোনি”

তনয়া এবার আগানোর বদলে পিছিয়ে গেল। বলল, “আপনার ব্যাপারে।”

“আমার কথা তো জানতেই চায়নি।”

“ওওওই আমায় ব্যাপারে।”

“কি বলেছো?”

“বলেছি আমি জানি না মেয়েটি কে!” “অ্যাআআ” ধপ করে বিছানার উপর পড়ে গেলো সে। পিছনের বিছানার কথা তো খেয়ালই ছিলো না তার। উষ্ণ মুখ টিপে হেসে বলল, “তুমি তো ভীষণ ফার্স্ট!”

“মানে?”

“সোজা আমার ঘরের বিছানায়, বাহ!”

কথার অর্থ বুঝতে পেরেই তনয়া দ্রুত উঠে দাঁড়াল। চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো, “আপনি আমায় অ*পমান করছেন। এখানে আমি আসিনি আপনি নিয়ে এসেছেন। তাও জো*র করিয়ে। এখন যেতে দিন আমায়।”

উষ্ণের পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিল অমনি উষ্ণ তার হাতটা শক্ত ধরে নিল। তনয়ার ছটফটানি শুরু সাথে সাথেই। তাকে ধরে নিয়ে দেওয়ালের সাথে চে*পে ধরল। সেও আছে কাছাকাছি, ঘনিষ্ঠ ভাবে। তনয়া থমকে গেল। ছটফটানি না করে শান্ত হলো। ঠান্ডা গলায় বলল, “যেতে দিন আমায়, নাহলে আমি চেঁচামেচি করব।”

“এই ঘরের বাইরে তোমার আওয়াজ কেউ শুনতে পারবে না তনয়া, তাও ইচ্ছে করলে চেঁচাতে পারো। আমার কোনো সমস্যা নেই?”

তনয়া হাঁপাচ্ছে। লোকটার সাথে সে পেরে উঠবে না। সে তার খুব কাছে, হাতের কব্জি চেপে ধরে আছে। ব্য*থা লাগছে, ভয় লাগছে, লজ্জা লাগছে, অস্বস্তি হচ্ছে। একই সঙ্গে অনেক অনুভূতি টের পাচ্ছে সে। শুকনো ঢোক গিলে তার মুখের দিকে তাকাল। তার তী*ক্ষ্ণ চোখজোড়া কেবল তাকেই দেখছে। বাজপাখির চোখ যেন, কি তী*ক্ষ্ণ নজর। এই যেন খেয়ে ফেলে। তনয়া কিছু বলছে না। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে কেবল। ওপর প্রান্তের লোকটার শ্বাস প্রশ্বাসের শুনতে পাচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস যেন গাঢ় হয়ে উঠছে।

উষ্ণ তার এক হাত ছাড়িয়ে অন্যহাতে ঘাড়ের কাছে নিয়ে রাখল। আলতো করে তার মুখটা ধরে তার কাছে নিয়ে আসল। অন্যহাত ছেড়ে কোমর চেপে ধরেছে শ*ক্ত করে। তনয়া হতভম্ব! তার শরীর জমে গেছে ইতিমধ্যে। লোপ পেয়েছে জ্ঞান। উষ্ণ চাইলেই পারত পুরোপুরি সুযোগটা নিয়ে নিতে। নিলো না।কেবল কপালে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো, “আমার কাছে চলে এসো তনয়া, আমি তোমাকে সুখে রাখব। তোমাকে ভালোবাসব।আগলে রাখব তোমায়, একটুও অযত্ন হবে না তোমার। ভালোবাসবো তোমায়!”

তনয়া চোখ নামিয়ে ফেলল। স্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, “আমি তন্ময়কে ভালোবাসি!”

সাথেই সাথেই সবকিছু আগলা হয়ে এলো। আর জো*র করে ধরে রাখেনি সে। ছেড়ে দিল তাকে। দুই পা পিছিয়ে সরে দাঁড়াল। তনয়া সুযোগ পেয়েই দরজা খুলে ছুটে পা*লাল। দরজা বারি খেয়ে আবারো খুলে যাচ্ছে। উষ্ণ তার চলে যাওয়ার প্রান্তে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থেকে বলে উঠলো, “তোমাকে পাবার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি, এখানে আমি কোনো নায়ক হতে আসিনি কোনো ভিলেন ও না। তোমায় পাবার জন্য কখন কি হতে হয় আমি জানি না। বহুরূপী হতে পারি, ভণিতা করতে পারি। কেবল তোমায় জোর করতে পারি না। কারণ তোমার ভালোবাসা চাই! তোমাকে আমার চাই তনয়া, শুধু তোমাকেই চাই!
.
উষ্ণ চৌধুরীর সামনে তার আগন্তুক! আগন্তুক বোধহয় খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। প্রশ্ন আজ উষ্ণ নয়, জেএস করল। জিজ্ঞেস করল,

“তনয়ার ম্যাডামের উপর ২৪ ঘণ্টার ন*জর রাখতে বলা হয়েছিলো। এরপরেও তনয়া ম্যাডাম জাওয়াদ স্যারের সাথে দেখা করেছে সেই খবর তুমি আমাদের দিলে না কেন?”

আগন্তুক আমতা আমতা করছে। উষ্ণ চৌধুরী গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে উঠলো, “এই তোমার প্রথম আর শেষ ভুল! এরপরের ভুলের ক্ষমা নেই। যাও এবার!”

আগন্তুক মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বের হবার সাথে সাথেই উষ্ণ চৌধুরী উঠে দাঁড়াল। জেএসের দিকে ফিরে সানগ্লাস খুলে বলল, “ওর পিছু নাও!”

জেএস বুঝতে পেরে সাথে সাথেই বেরিয়ে গেলো। আগন্তুকের গাড়ি ফলো করে জেএস এসে পৌঁছাল তার বাড়ির কাছে। তার কিছু দূরেই তনয়ার বাড়ি। এখান থেকেই রোজ তার উপর নজর রাখে সে। জেএস ঘণ্টাখানেক সেখানেই অপেক্ষা করল। তার কাছে কিছু সন্দেহজনক মনে না হওয়ায় বেরিয়ে গেলো।

জানালা দিয়ে জেএসের গাড়ি বেরিয়ে যেতে দেখে উষাণ চৌধুরী দেওয়ালের সাথে ঘেসে দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠল। আগন্তুকের চোখে মুখে ভ*য়ের ছাপ। ঢকঢক করে কয়েক গ্লাস পানি খাওয়ার পর বলে উঠল, “আপনি আর এখানে কখনো আসবেন না। বেরিয়ে যান, এখুনি বেরিয়ে যান। স্যার আমায় স*ন্দেহ করছে!”

উষাণ চৌধুরী এগিয়ে এসে তার ঘাড়ে হাত রেখে বলে উঠলো, “আরে চিল, এতো চ্যাএ চ্যাএ করলে হবে। তোমায় শুধু আর একটা কাজ করতে হবে আমার জন্য!”

“আমি আর কোনো কাজ করতে পারব না। আপনি প্লিজ বেরিয়ে যান।”

উষাণ মৃদু হাসল। তার ঘাড়ে হাত রেখে পকেটের মধ্যে একটা টাকার চেক ঢুকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “শুধু আর একটা কাজ!”

বলেই দূরবীন হাতে তনয়ার বাড়ির কাছে উঁকি মারল। তনয়াকে দেখা যাচ্ছে। তার সাথে আরেকটা মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে। দুজনে একসাথে হাসাহাসি করছে। তার হাসি দেখে উষাণ চৌধুরীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। মেয়েটার হাসি সুন্দর তো!
.

পরদিন তনয়া অফিসের লিফটে ঢুকতেই তড়িঘড়ি করে আরেকজন ঢুকে পড়ল। তার দিকে তনয়া নজর না দিয়েই বোতাম চাপল। পাশের ব্যক্তিও বোতাম চেপে দেওয়াল ঘেসে দাঁড়াল। তনয়া তার ফোন ঘাটছে। আচমকা পাশে থাকা আগন্তুক বলে উঠলো, “কি ব্যাপার মিস তনয়া? চিনছেন না আমায়?”

তনয়া ভিমড়ি খেয়ে উঠল। এই স্বর তার চেনা। তড়িঘড়ি করে এদিক ফিরতেই আবার ভিমড়ি খেলো। এতো স্বয়ং উষ্ণ স্যার। শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী! ওমা! একি তার আমূল পরিবর্তন। তার ছাগলের লেজের মতো চুলটুকু কেটে ফেলায় একদম ভিন্ন রকম লাগছে। তনয়া সত্যি সত্যি তাকে চিনতে পারেনি। এমনকি বেশভুষায় তাকে আজ উষ্ণ স্যার বলে মনে হচ্ছে না। চেহারার পরিবর্তন হয়ে গেছে যেন। তনয়া রীতিমতো হা হয়ে চেয়ে আছে। উষ্ণ স্যার তার মুখটা বন্ধ করে থিতুনি হাত রেখে খানিকটা নিচু হয়ে বলল,

“হ্যান্ডসাম লাগছে?”

তনয়া নিজেকে সামলে নিল। সরে গিয়ে বলল, “হুঁ!”

“কি? শুনতে পাই নি?”

“বললাম ভালোই লাগছে। এখন একটু ভাদাইম্যা গিরি বাদ দিলেই হয়।”

“হোয়াট ইউ মিন বাই ভাদাইম্যা?”

“ইটস মিন ইউ!”

“হে ইউ!”

তনয়া সামলে উঠে নরম গলায় বলল, “সরি স্যার।”

বলতে বলতে লিফট গন্তব্যে চলে এলো। তনয়া বের হতেই যাবে উষ্ণ ফট করে তার হাত টেনে পিছনে নিয়ে এসে আবারো লিফটের বোতাম চাপল। তনয়া হকচকিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল,

“আরে আরে, এটা কি হলো?”

“কথা শেষ হয়নি। দাঁড়াও।”

“কি আজব। এখন এই লিফটে দাঁড়িয়ে কথা বলব।

“আলবাদ বলব।”

“আর কি কথা বলবেন?”

উষ্ণ হালকা কেশে গলার টাই ঠিক করে বলল, “তুমি তন্ময় কে প্রপোজ করেছিলে?”

তনয়া চোখ কপালে তুলে শুধায়, “এ কথা আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?”

“না বলছি, প্রপোজ করেছিলে?”

“না করব!”

“কবে?”

“সামনেই ভালোবাসা দিবস। তখন…

উষ্ণ মুখ থেকে নিমিষেই হাসি উধাও হয়ে গেল। মলিন হয়ে উঠল মুখখানা। গম্ভীর স্বরে শুধায়,
“যদি না বলে তখন?”

তনয়া চোখ মুখ কালো হয়ে গেল। উড়ে গেল মুখের রঙ। এসব যে সে ভাবেনি তা না। বহুকষ্টে সাহস জুগিয়েছে। এবার নয়তো আর কখনো নয়। এবার মনের কথা সে বলেই ফেলবে। ফ্যাকাশে মুখখানা ঠিক করে বলল,

“সেটা নিয়ে আপনার কোনো দরকার আছে?”

উষ্ণ বাঁকা হেসে বলল, “অবশ্যই আছে!”

বলেই ঝুঁকে পড়ল তার উপর। তনয়া দ্রুত দেওয়ালের সাথে মিশে দাঁড়াল। উষ্ণের হাত পড়েছে তার কাছেই দেওয়ালের উপর। দেওয়ালের উপর ভর দিয়ে তনয়ার কাছে এগিয়ে গেল। তনয়ার তাজ্জব লাগছে। লোকটা কথায় কথায় কাছে আসার বাহানা খুঁজে। তনয়া চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে রীতিমতো।

“তন্ময় তোমার রিজেক্ট করলে তুমি আমায় বিয়ে করবে!”

উষ্ণ স্যারের কথা তনয়ার মাথার উপর দিয়ে গেল। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “ কি? মামা বাড়ির আবদার নাকি?”

“উহু তোমার হবু বরের আবদার!”

“জি না। কখনো না। আমি আপনাকে কখনো বিয়ে করব না।”

“অবশ্যই করবে। দরকার পড়লে তোমার পুরো চৌদ্দ পুরুষ বিয়েতে থাকবে।”

“হি হি কবরস্থানে গিয়ে যোগাযোগ করুন। তারা সেখানেই আছে। ঠিক আছে স্যার।”

“তোমায় আমি…

কথাটুকু শেষ করার আগেই তন্ময়ের কণ্ঠের “তনু” শব্দটা দুজনকেই চমকে। কথাবার্তায় মগ্ন থাকায় কখন লিফট এসে থেমেছে তাদের কারোরই খেয়াল নেই। তনয়া এদিক ফিরে তন্ময়কে দেখতে পেয়েই স্তব্ধ। বিস্মিত তন্ময় ও। উষ্ণ স্যার মৃদু হাসল কেবল। দেখতে দেখতে চোখের পলকে আবারো লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তনয়া উষ্ণ কে সরিয়ে দ্রুত বোতাম চাপল। ওদিক থেকে চাপছে তন্ময় ও। উষ্ণ দ্রুত তার হাত ধরে টেনে বলল, “মনে রেখো কথাটা। আমাদের ডিল এটা!”

তনয়া হা হয়ে উষ্ণ কে দেখছে। এই লোক মাথাছিঁড়া পাগল কি বলে? দরজা খুলে গেল আবারো। তন্ময় দাঁড়িয়ে বাইরে। তন্ময় কে দেখতে পেয়েই তনয়া দ্রুত হাত ছাড়াল। বেরিয়ে এলো লিফট ছেড়ে। উষ্ণ স্যার বেরিয়ে তাদের পাশ বেয়ে চলে গেলো। তন্ময় চোখ মুখ শক্ত করে তনয়াকে দেখছে। কিছু একটা তো তার অগোচরে হচ্ছে। কি সেটা?

#চলবে