#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_২৯
তনয়া আগে আগে হাঁটছে। তার পিছন পিছন হাঁটছে তন্ময়। সে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে কিন্তু তনয়া কোনো জবাব দিচ্ছে না। একপর্যায়ে তন্ময় ফট করে তনয়ার হাত ধরে টানল। অফিসে উপস্থিত সবাই তাদের দেখছে। তনয়া চমকে উঠে বলে উঠলো, “তন্ময় সবাই দেখছে!”
তন্ময় আশপাশে নজর দিয়ে ফট করে তার হাত ধরে বেরিয়ে গেল। পুরোটা দৃশ্য কেবিন থেকে দেখল উষ্ণ চৌধুরী। গলার টাই হালকা লুজ করিয়ে পিছন ফিরল। নজরে এলো জেএস। উষ্ণ খানিকটা স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে শুধাল, কেমন লাগছে আমায় জেএস?”
জেএস জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেল। শা লার ঢং ও কম না। মিনমিন করে উষ্ণ তাকে দুটো গা লি দিল।
ক্যান্টিনের কাছে পৌঁছানো মাত্র তন্ময় তনয়ার হাত ছাড়িয়ে দিল। তনয়া আশপাশ চাইছে। এখন লোকজন তেমন নেই। তন্ময় তার সামনে দাঁড়িয়ে। উত্তেজ*নায় তার কান, গাল লাল হতে শুরু করেছে। কিন্তু উত্তেজ*নার কারণ কি? উষ্ণ স্যার তখন তনয়ার এতো কাছাকাছি থাকায়? তন্ময় কি জেলা*সি ফিল করছে? তবে কি তার মনে কিছু আছে? ভালোবাসা কি অন্য অনুভূতি!
মনের আবেগে আপ্লুত হয়ে ভেসে গেলো না তনয়া। বরং শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, “এটা কি হলো?”
তন্ময় ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুই আমার থেকে কি লুকাচ্ছিস তনু?”
“ওমা আমি কি লুকালাম? কি হলো আবার?”
“তুই বুঝতে পারছিস না। লিফটে আমি কি দেখলাম।”
তনয়া চোখ আশপাশ ঘুরিয়ে বলল, “আরে ওই তো কথা বলছিলাম।”
“ডোন্ট টক রা*বিশ। এটা কোনো নরমাল কথাবার্তা না। বাই এনি চান্স তুই স্যারকে ডেট করছিস?”
তনয়া চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কি বলছিস? পাগল হয়ে গেলি নাকি?”
“তো? স্যার তোর সাথে ফ্লার্টি করছে? তোকে বিরক্ত করছে? আমায় বল তনু। ভ*য় পাবার কিছু নেই। স্যার তোকে জোর করছে!”
“না না এসব কিছু না। তুই বেশি ভাবছিস!”
“আর ইউ শিউর তনু?”
তনয়া একগাল হেসে বলল, “একদম। আমরা যাস্ট কথা বলছিলাম। আর তুই তো আমায় চিনিস।”
তন্ময় বুঝি শান্ত হলো। আলতো করে তার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “শোন তনু, যা কিছু হয়ে যাক না কেন, আমি তোর সাথে আছি। সবসময় থাকব। তোর যখন কোনো সমস্যা হবে, কোনো দরকার হবে যাস্ট কল মি। আমি সবসময় তোর পাশে আছি!”
তন্ময় তাকে কথা দিচ্ছে, তার পাশে আছে। এতোটুকু কথাই তনয়ার জন্য ভীষণ বড় হয়ে দাঁড়াল। সবকিছু ভুলে তার আঁখি পানে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। এই তো আর দুটো দিন, এরপরেই তন্ময় কে প্রপোজ করবে সে। তাকে পার্মানেন্টলি নিজের করে পাবার জন্য।
.
উষ্ণ চৌধুরী তার লম্বা চুল কেটে ফেলার পর থেকেই অফিসের সকল ফুল পরীর নজর তার দিকে। নজর আগেও ছিল এখন তা আরো দ্বিগুণ হয়েছে। সকলের এক অজুহাত স্যারকে এখন আরো বেশি হ্যান্ডসাম আর হট লাগছে। অনেকের অভিমত লম্বা চুলেই উষ্ণ স্যার কে ভালো লাগতো বেশি, এখনো লাগছে। কিন্তু সেই লম্বা চুলের অভাব সকলে পাচ্ছে। মেয়েগুলো উসখুশ করছে স্যারের সাথে কথা বলার জন্য।
ব্লেজার ছাড়া কেবল ইন করা সাদা একখান শার্ট পরে সকলের সামনে এসে মেয়েদের হার্টবিট বাড়িয়ে দিয়েছে উষ্ণ চৌধুরী। মেয়েগুলোও কম যায় না। ফ্লার্টিং যেন তাদের রগে রগে। উষ্ণ জবাব দেয় না, বরং হেসে উড়িয়ে দেয়। এই হাসিও তাদের হৃদয় খায়ে*ল করে দিচ্ছে। এরই মধ্যে উদয় হয় তন্ময় আর তনয়া। উষ্ণ চৌধুরী দুজনকে পরখ করে সহসা বলে উঠে, “আপনাদের দুই বন্ধুর কথোপকথন শেষ হলে আমরা কাজে লেগে পড়ি। মিস তনয়া আমার রুমে আসুন!”
তন্ময়ের দিকে ফিরে ইচ্ছে করে ঠেস মে*রে কথাটা বলে সে। তন্ময় চোখ মুখ শক্ত করে উষ্ণ স্যার কে দেখছে। উষ্ণের যেন ভারী মজা লাগছে। তনয়া চোখের ইশারায় তাকে রাগ*তে বারণ করে।
———
আজ ভালোবাস দিবস তার সাথে পহেলা ফাল্গুন। এই কারণে তাদের কোম্পানিতে ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এই আয়োজন করেছে উষ্ণ চৌধুরী। তার সাথে তনয়ার কথাবার্তা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানেই তন্ময় কে প্রেম নিবেদন করবে সে। তন্ময় যদি প্রত্যাখ্যান করে তবে দ্বিতীয়বারের মতো এখানেই তনয়াকে আবারো বিয়ে প্রোপোজাল দিবে সে। এই কারণেই ইচ্ছে করে এখানে আজ এতো আয়োজন। একদল তরুণী এই সুবাদে শাড়ি পরে হাজির। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে তনয়াও শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ি পরেছে না উষ্ণের বুকে ছু*রি ঢুকিয়েছে। তাকে দেখার পর থেকেই নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে তার।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে বিকাল থেকে। একদল তরুণী রবীন্দ্র সংগীত করল, কেউবা নৃত্য। কেউ কেউ আবার আবৃত্তি ও করল। তার অফিসের স্টাফরা এতো ট্যালেন্টেড উষ্ণ চৌধুরী তা আগে জানত না। বস্তুত সে খানিকটা চমকেই উঠল বলা যায়।
তবে তার অপেক্ষা প্রতীয়মান। একটি কারণেই আজকের এসব। বরাবরের মতোই ব্লেজার সুট টাই পরে হাজির সে। অন্যদিকে ছেলেরা সেখানে রঙ মিলিয়ে পাজামা পাঞ্জাবী পরে এসেছে এতে উষ্ণের একরাশ বিতৃষ্ণা চলে আসছে। সবার দেখাদেখি তন্ময় ও হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে হাজির। তাকে দেখামাত্র তনয়া দিন দুনিয়া ভুলে যায়। কেবল আহম্মকের মতো চেয়ে থাকে। উষ্ণ বেশ অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে পিছন ফিরে জেএসকে শুধায়,
“আমারও কি পাঞ্জাবি পরে আসা উচিত ছিল জেএস!”
বে*ডা খবিশ জেএসের বাচ্চা। স্যারের মন রাখার জন্য হলেও না বলতে পারত। তা না বলে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। উষ্ণের তৎক্ষণাৎ ইচ্ছা করলে তাকে এই মূহুর্তে চাকরি থেকে নট করে দিব। একদম শেষ করে দিবে। মাথা গর*ম হয়ে উঠেছে দিব্যি।
পরক্ষণেই মাথা ঠান্ডা করল। জেএস ব্যাটা খারাপ হলেও কাজের লোক। তাই দু একটা ভুল মাফ করা যায়। কিন্তু মনে মনে তাকে গালিগা*লাজ করতে ভুলে গেলো না উষ্ণ।
তারা এই দুজন থেকে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকটাই দূরে। তন্ময় এগিয়ে আসছে দেখে তনয়া কানে গোঁজা গোলাপটা হাতে নেয়। পিনপিন নিরবতা কাজ করছে উষ্ণের ভেতর। মনে পড়ছে তার কথা। খানিকক্ষণ আগেই তনয়া বলেছে, এই ফুল দিয়েই তন্ময়কে প্রেম নিবেদন পাঠাবে সে। তন্ময় ফুল গ্রহণ করা মানেই তাকে গ্রহণ করা।
এখন যতই ফুল হাতে তনয়া এগিয়ে যাচ্ছে ততোই উষ্ণের দম*বন্ধ হয়ে আসছে। সে নিশ্চিত জানে, তন্ময় তাকে গ্রহণ করবে না। প্রত্যা*খান করবে। ওই ফুল তন্ময়ের ভাগ্যে নেই। উষ্ণ চৌধুরী সেই ফুল দিয়ে শুরু করে ফুলের বাগান তৈরি করবে কেবল তার তনয়ার জন্য। তার রাণীর জন্য!
তবুও যতো কাছে তনয়া এগুচ্ছো ততোই যেন হৃদয় ভার হয়ে উঠছে। তনয়া আর তন্ময় মুখোমুখি। তনয়া ফুলটা তাকে বাড়িয়ে দিল। তার হাত কাঁপছে! কম্পিত হাতখানা থেকে কপাল কুঁচকে আনল উষ্ণ চৌধুরী। অনুভব করল তার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে ধকধক করে।
তনয়া চোখ বন্ধ করল। বহু সাহস নিয়ে ভালোবাসার কথা বলল। বলামাত্র মাথা নুইয়ে ফেলল। দৃষ্টি মেঝেতে। যেই সাহস নিয়ে সে এতোবড় কাজ করেছে, সেই কাজের ফল সে জানে না। আশা করছে ভালো কিছুই হোক। কিন্তু তন্ময় কে তো সে চিনে।
সকল জল্পনা কল্পনা শেষ হলো। উষ্ণের ঠোঁটের রেখা টেনে হাসল। মূহূর্তেই সেটা মলিন হয়ে উঠল। তন্ময় ফুল টা নিয়েছে। এ তো হবার ছিলো না। কেবল ফুল নয়, তনুর হাতের পিঠে একটা চুমুও খেয়েছে। উষ্ণের রক্ত গর*ম হয়ে উঠল। মুখটা নিভিয়ে গেল সাথে সাথে। তনয়ার চোখে মুখে হাসির ঝিলিক দেখছে। এই হাসি কোনো সাধারণ হাসি নয়। উষ্ণ এর অর্থ জানে। চোয়া*ল শক্ত করে হাত মুঠ করল। শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, “আমি কি ভুল দেখলাম নাকি তুমি ঠিক দেখলে জেএস?”
জেএস সহসা উত্তর দিল, “আমি ঠিক দেখেছি। তন্ময় তনয়ার প্রপোজাল গ্রহণ করেছে!”
উষ্ণ শব্দ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। অতঃপর হনহন করে বেরিয়ে গেল অনুষ্ঠান ছেড়ে। তার পিছু নিল জেএস। এদিকে তনয়ার যেন আজ হাসির বাধ আর মানে না। অনা*কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে গেলে আমরা মূহূর্তেই উত্তেজিত হয়ে উঠি। দোটনা*য় ভুগি। তনয়ার হয়েছে সেই হাল। সে এসব বিশ্বাস করতেই পারছে না। তন্ময় ফুলটা পকেটে ঢুকিয়ে উপস্থিত সকলের সামনে তনয়া কে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ হাত তালির কলরব শোনা যায়। তনয়া নিজের ভাগ্যকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার নেত্রপল্লব দিয়ে। এই ভালোবাসা কি দিয়ে বরণ করবে সে?
#চলমান
#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩০
বাসন্তী রঙের শাড়ির পার ছুঁয়েছে মেঝে। আঁটসাঁট করে বাঁধা মাথার খোঁপাটা। আচমকা সেই খোঁপায় কেউ একজন গোলাপ গুঁজে দিল। তনয়া চট করে পিছন ফিরল। অনাকাঙ্ক্ষিত মুখখান দেখে নিজেকে ধাতস্থ করল। ফুলটা খুলে হাতে নিল। উষ্ণ মৃদু হেসে পরখ করতে ব্যস্ত। শাড়িতে এই নিয়ে তার দ্বিতীয়বার দেখা। প্রথমবার চোখে চোখ রেখে দেখতে পারেনি। আজ পেরেছে! তার চোখের ঘন গাঢ় কাজল ছার*খার করে দিচ্ছে হৃদয়ের অস্তিত্ব। নিজেকে ঠেকিয়ে রাখা বড্ড দায়। তাও এখন, এই যৌবনে! জীবনসঙ্গীর বড় অভাব বুঝে সকলে এই যৌবনে এসে। একজন জীবনসঙ্গীর যে বড় প্রয়োজন। একটা বিশ্বস্ত হাত, এক টুকরো ভালোবাসা, হৃদয়, অনুভূতি আবেগ। কতোকিছুই না দরকার পড়ে জীবনে। এর অভাব কি সকলের হয় না?
উষ্ণ ভেবেছিলো তনয়া রা*গ করবে। করেনি! ফুলটা পুনরায় কানে গুঁজে বলে উঠলো, “আজ এই ফুলই তন্ময় কে দিব।”
তনয়াকে দেখামাত্র যে জৌলুস মুখাবয়ব ছেয়ে ছিল তা মুহূর্তে মলিন হয়ে উঠল। মস্তিস্ক এসে তাড়না দিতে লাগল। এই শাড়ি পরা, এই সাজ এসব তার জন্য নয়। তন্ময়ের জন্য! হৃদয় ছিঁ*ড়ে খান খান। দেহের ম*রণ না ঘটলেও মনের ম*রণ তার হয়েছিল। যখনি তন্ময়ের হাতে ফুলটা দেখতে পেলো। এতোকিছুর পরেও তন্ময় ফুলটা নিল! কেন? কি কারণে?
ফুলটা এগিয়ে দিয়ে তনয়া “ভালোবাসি” কথাটা বলেছিল। তন্ময় প্রথমে একটু অবাক হলো। এই ভালোবাসা বন্ধুদের ভালোবাসা নয়, সেই আবেগ সেই স্নেহ নয়। এটা অন্যরকম, অদ্ভুত আর্কষনীয়! তনু কে আজ ভারী সুন্দর লাগছে। তার ঘন আঁখি পল্লব খানিকক্ষণ বাদে বাদে উঠানামা করছে। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেল। একরাশ আশা নিয়ে হাতের গোলাপ দেখছে! । তন্ময় অবুঝ নয়! বন্ধুত্বের নামে তনয়ার মনে যেই সুখের বাসা বেঁধেছে তা সে টের পেয়েছে। টের পাবারই কথা। অতঃপর নিজেকে সামলে নিল। এখনো কনফিউজড! কি করবে? বন্ধুকে ফিরিয়ে দিবে। কেন? তাকে ভালোবাসে না বলে। এ তো সত্য কথা। তনয়া ও তাই জানে। তরীই সব! কিন্তু তরী যে নেই।
কারো জন্য জীবন আটকে থাকে না। জীবন নিজের ইচ্ছে মতো চলতে ভালোবাসে। তরীর আশা তন্ময় ছেড়েছে। ভালোবাসা ছাড়তে পারেনি। সময় লাগবে। তবে আজ থেকেই শুরু হোক না। ফুলটা হাতে নিয়ে প্রেম নিবেদন গ্রহণ করল। মুখে ভালোবাসি না বললেও তার চোখ বলছিলো ভালোবাসার কথা, প্রেমের কথা, অনুভূতির কথা!
তনয়া তন্ময় কে চিনত। তার চোখের ভাষা বুঝতে সে ব্যর্থ হয়নি। কেবল বিশ্বাস করতে পারছিলো না। আঁখি জোড়া অশ্রুতে টুইটুম্বর হয়ে উঠেছে। তনয়া নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করল। সবকিছুই যেন স্বপ্ন। স্বপ্নের মতো রঙিন মনে হচ্ছে নিজেকে। আচ্ছা এসব সত্যি তো? তন্ময় তাকে গ্রহণ করেছে। বহু বছর যেই সুখের বাসা সে বাধছিলো সেটা তাহলে বৃথা যায়নি। সত্যি সত্যিই সেই বাসায় তারা সুখের সংসার গড়বে। তাদের সংসার হবে! উষ্ণের কথা মাথা থেকে গায়েব হয়ে গেল তুড়ি বেজে।
আশপাশ অনেক মানুষ। তন্ময় গোলাপটা পকেটে ঢুকিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরল। সেই হাত ধরতে তনয়া ভ্রুক্ষেপ করল না। বেরিয়ে গেল তার সাথে। জেএস ও সরে এলো। তার কাজ এই পর্যন্তই ছিলো। অফিসের ছাদে চলছিলো অনুষ্ঠান। গান বাজনার তীব্র আওয়াজে অনেক কিছুই চোখ ফাঁকি দিয়ে উঠল। উষ্ণ রাগে সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর নামল। এরপর একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট খাওয়া তার স্বভাবের মধ্যে পড়ে না। ইদানিং নতুন করেই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সিগারেটের ব্যাপারটা সে নিজেও ছাড়তে চায়। এই যেমন আজ ৬ দিন পর সিগারেট হাতে নিল। তার চিকন শুষ্ক ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণ ধোঁয়া উড়াল। আর সইলো না। অর্ধেকটা ফেলে পায়ে পি*ষিয়ে ফেলল। এভাবে তন্ময় কে পিষা*তে পারলে ভালো লাগত!
ব্লেজারের বোতাম খুলে গলার টাই লুজ করল। অকস্মাৎ তার গরম লাগছে। মনে হচ্ছে পুরো শরীর জ্ব*লে যাচ্ছে। লিফটের সামনে এসে বোতাম চাপতেই সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে লিফটের দরজা খুলে গেল। উষ্ণ চোখ মেলে তাকাল। এই অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতের আশা সে করেনি।
তনয়া তন্ময়ের বাহু আঁকড়ে গায়ের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে তার শরীর থেকে তীব্র পারফিউমের ঘ্রাণ নিচ্ছে। একটু বাদে বাদে তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে। এই স্বপ্ন যে তার কতো সাধনার ফল একমাত্র সেই জানে। দরজা খুলতেই উষ্ণের সামনে তাদের প্রেম প্রেম মূহুর্ত প্রকাশ পেলো। নব্য কপোত কপোতী দেখছে একে অপরকে। পরনে শাড়ি পাজামা রঙ মিশে একাকার। উষ্ণ শুকনো ঢোক গিলল। তন্ময় তনয়া জানতেও পারল না তাদের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে। তারা যেন হারিয়ে গেছে। বিলীন হয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে। নতুন জগতে তাদের সংসার। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল আপনাআপনি। শেষে তনয়া এদিক ফিরে কাউকেই পেলো না।
তনয়া জানতে পারল না তার সুখে আরেকজনের হৃদয় দ*হন হচ্ছে। ক্ষ*ত বিক্ষ*ত হচ্ছে পুরো দেহ। উষ্ণের শরীর থেমে গেছে। নিস্তেজ হয়ে পড়েছে পুরো দেহ। লিফটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেশ অনেকক্ষণ। আছে ঘোরের মধ্যে! কি দেখল সে? কাকে দেখল? তনয়া কে? তার জীবনসঙ্গী, তার ভালোবাসা কে? সে তো এখন সুখী! অন্যের ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে সুখী দাবি করছে। উষ্ণ বির বির করে বলে উঠলো,
“তুমি তবে তাকে পেয়েই সুখী হলে তনয়া। এটা তো হবার ছিলো না। আমি যে সুখী হতে পারছি না। তোমায় অন্য কারো সাথে সুখী হতে আমি যে দেখতে পারব না। আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট!” বলতে বলতে বুকের বা পাশ চেপে ধরল সে। চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে। মাথা ভনভন করছে। পুরো মস্তিষ্ক যেন তনয়াতে বিভোর হয়ে উঠেছে। সকল জাগান দিচ্ছে তনয়া তার! অন্যকারো হতে পারে। কখনোই না! নিজের এতো দুবর্লতা, ভেঙ্গে পড়া প্রতি মূহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে তনয়াকে সে কতো ভালোবাসে। কতোখানি!
জেএস হুলস্থুল করে নামল। লিফটের সামনে কাউকে পেলো না। সিঁড়ি বেয়ে ছুটে নেমে গেল স্যারের কেবিনে। দরজা খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেল। সে দেরি করে ফেলেছে! কেবিনের উপর দিয়ে যেন ঝ*ড় বয়ে গেছে। সেই ঝড়ের নাম শেহনেওয়াজ চৌধুরী। ফাইল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এদিক ওদিক, চেয়ার ভে*ঙে পড়ে আছে। ফুলদানি, ফটোশপ কিছু নেই। ল্যাপটপ এক আছা*ড়েই অকেজো। গায়ের ব্লেজার মেঝেতে লুটিপুটি খাচ্ছে। দেওয়ালে র*ক্তের ছাপ। কতো গুলো ঘু*সি দিয়েছে কে জানে। হাত কেটে র*ক্ত ঝড়ছে। তোয়াক্কা করছে না সেদিকে। রুমের এসি চলছে সর্বোচ্চ ট্যাম্পাচারে। উষ্ণ সোফার উপর শরীর ছেড়ে বসে আছে। তার সাদা শার্টের কিছু বোতাম খুলে আছে। দেখা যাচ্ছে বক্ষ*পটের অংশ। উষ্ণের চোখ বন্ধ, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের চিহ্ন। জেএস এতোটা করুণ দশাও আশা করেনি। দরজা বন্ধ করে ঢোক গিলে ছোট করে বলল, “স্যার!”
উষ্ণ চোখ মেলে তাকাল। তার রুক্ষ, ফ্যাকাশে মুখের করুণ দশা। অক্ষিকোটরে অ”শ্রু রেখা চিকচিক করছে। স্যার কাঁদছিল নাকি? উষ্ণ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গাল মুছে বসল। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ঘাড়ের কাছে র*গ ফুটে উঠেছে ভয়ং*কর ভাবে। হঠাৎ ঝড়ের পর স্যার ঠান্ডা হয়ে গেছে। এই ঠান্ডা, শীতল ভাব আরো ভয়ং*কর ঝ*ড়ের আভাস দিচ্ছে। জেএস সেসব টের পেয়েছে। ভ*য় পাচ্ছে। নরম স্বরে বলে উঠলো, “স্যার র*ক্ত পড়ছে?”
উষ্ণ যেন শুনতে পেলো না। কিছুক্ষণ ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে ফের নিজের হাতের দিকে তাকাল। র*ক্ত অনেকখানি পড়েছে। এবার থেমে গেছে তবুও ফোঁটা ফোঁটা করে গড়িয়ে পড়ছে। জেএস হাতের রুমাল বের করে এগিয়ে এসে স্যারের হাতে বাঁধতে নিল। উষ্ণ হাতটা সরিয়ে বলল,
“থামো কিছু হয়নি। এতে আমি ম*রে যাচ্ছি না!”
“আমি জানি স্যার এতে আপনি মর,বেন না। তবু বলছি শান্ত হন। তনয়া ম্যাডাম কে পেতে হলে আপনাকে শান্ত থাকতে হবে। রে*গে গেলেন তো হেরে গেলেন। শুনেননি কথাটা?”
উষ্ণ চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। জেএস রুমাল দিয়ে হাতটা পেঁচিয়ে বলল, “নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস রাখুন।”
উষ্ণ মুখ তুলে তাকাল। রুষ্ট স্বরে বলে উঠলো, “তোমার কি মনে হয় জেএস? তনয়াকে আমি পাবো?”
“ভাগ্যে কি আছে আমরা বলতে পারি না। তবে বিধাতা আমাদের এতোটুকু শক্তি দিয়েছেন পথ বেছে নেবার জন্য। নিজের ভাগ্য গড়ে নেবার জন্য।”
“আমার ভাগ্য সবার মতো নয় জেএস।”
জেএস পুনরায় কিছু বলার পূর্বেই উষ্ণ তাকে থামিয়ে দিল। মৃদু হেসে বলে উঠলো, “এমন ভান ধরো না তুমি কিছুই জানো। তুমি সব জানো। আমি ছোট থেকে তোমায় দেখে আসছি জেএস।”
জেএস চুপ করে গেল। স্যারের ছোট বেলার সব অতীতের সাক্ষী একমাত্র সে। এই কারণেই কি তবে বড় স্যারকে ছেড়ে উষ্ণ স্যারের সঙ্গ দিচ্ছে। উষ্ণ হেসে উঠে আচমকা।জেএস চোখ মুখ কুঁচকে তাকায়। উষ্ণ বলে উঠলো,
“ভাগ্যের দোহাই দেওয়ার মানুষ আমি নই। ভাগ্যের সাথে আমার জন্ম থেকেই দুশম*নি। তনয়া আমারই হবে তুমি টেনশন নিও না জেএস। তনয়াকে পেতে আমার যা করতে হয় আমি তাই করব। ছল*চাতুরি, প্রতা*রণা সব করতে পারি। এমনকি মানুষ খু*নও!”
উষ্ণের কথা শুনে জেএস আঁত*কে উঠে। এই ভয়*টাই সে পাচ্ছিল। উষ্ণ মলিন দৃষ্টিতে জেএসের দিকে ফিরে। নেত্রপল্লব নড়েচড়ে উঠে। উষ্ণ শান্ত গলায় বলে উঠে, “তন্ময় কে মে*রে ফেলো জেএস!”
জেএস বিস্মিত হয়নি। এতোটুকু ধারণা আগে থেকেই ছিলো তার। সে ভ*য় পেলো কেবল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। শুকনো ঢোক গিলে স্যারের দিকে তাকায়। কি হবে এবার?
.
তনয়া ফুচকা খাচ্ছে। তন্ময় তার সামনেই বসা। দৃঢ় লোচনে দেখছে তনয়াকে। তনয়ার ভালোবাসা সে স্বীকার করে নিয়েছে কিন্তু আদৌও তনয়াকে ভালোবাসতে পারছে না। তনয়াকে বন্ধু হিসেবে সম্মান করে, ভালো ও বাসে কিন্তু ওই রকম ভালোবাসা তার আসছে না। তবে ধীরে ধীরে অনুভূতি জাগতে পারে। জাগতেই হবে! আর যাই হোক তনয়াকে স্যারের পাল্লায় পড়তে দেওয়া যাবে না।
ঘটনাটি গতকালের, যখন তন্ময় উষ্ণ স্যার আর জেএসের কথাগুলো আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিলো! উষ্ণ স্যার জেএস কে বলছিলো,
“তুমি বলো জেএস, তন্ময় কাল কি করবে?”
জেএস শান্ত স্বরে বলল, “যতটুকু ধারণা তনয়া ম্যাডাম কে তিনি ফিরিয়ে দিবেন। তাকে ভালোবাসতে পারবেন না।”
“হুম ঠিক বলেছো। তন্ময় আলবাদ তনয়ার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিবে। তন্ময় আজীবন তনয়াকে বন্ধু ভেবেছে। তাই তনয়াকে হুট করেই ভালোবাসতে পারবে না। কালকে তনয়াকে প্রত্যাখ্যান করলেই তাদের মাঝে দূরত্ব বেড়ে যাবে। আর সেই সুযোগ আমি নিবো। তনয়াকে বিয়ে করব।”
জেএস চওড়া কপাল কুঁচকে বলে উঠলো, “তন্ময় প্রত্যাখান করলেই ম্যাডাম আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
“রাজি না হলে করাবো। দরকার পড়লে জো*র করে বিয়ে করব।”
জেএস চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল স্যারের দিকে। উষ্ণ হাসছে! না উষ্ণ স্যার তনয়া ম্যাডাম কে জোর করে বিয়ে করবেন না। যদি তাই করত তাহলে এতো দিন অপেক্ষা করতেন না। প্রথমেই ধরে বেঁধে বিয়ে করে ফেলতেন। তার ঘরে বাঁধা কোনো গরু ছাগল চাই না। চায় একজন ভালোবাসার মানুষ। সে সর্বক্ষণ তার হাত ধরে পাশে থাকবে। একটু আগে বলা কথাটা উষ্ণ মজা করেই বলেছে। জেএস এটা ধরে ফেলেছে। কিন্তু উষ্ণ স্যারের কোনো কথাই তন্ময় মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।
কয়েকদিনের আগের কথা তো ভুলতেই পারছে না। উষ্ণ স্যার ইরিশা জামান কে বিয়ের আসরে রেখে পালি*য়েছে। সেই লোক এবার তনয়ার জীবন ধ্বং*স করতে মেতে উঠেছে। তনু তাকে ভালোবাসে এই কথা শুনে যতটা না চমকে উঠেছে তার চেয়ে বেশি চিন্তিত হলো উষ্ণ স্যারের কথা ভেবে। উষ্ণ স্যারের চোখ পড়েছে তনয়ার উপর। বন্ধু হিসেবে তার মনে তনয়ার জন্য যেই ভালোবাসা তাই জেগে উঠল প্রথমে। না! তনু কে বিপদে পড়তে দেওয়া যায় না। স্যারের হাত থেকে তাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু মিথ্যে প্রতিশ্রু*তি ও তো দেওয়া যায় না। বিড়ম্বনায় পড়ে গেল সে। এবার কি করবে? অতঃপর সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল। এবার দেখার পালা তার সিদ্ধান্ত ঠিক কতোটা ঠিক। আর যাই হোক, তনয়া যেন দুঃখ না পায়!
তনয়া হুট করেই ভীষণ আহ্লাদী হয়ে উঠল। ফুচকা কেবল সে একাই খাচ্ছে। তন্ময় এসব খায় না। তাই সে একটা তার মুখের সামনে ধরল। তন্ময় প্রথমে না করলেও পরে খেলো। বিশেষ এতোটা ভালো লাগল না। ঝাল আর টকের এই কম্বিনেশন তার জন্য নয়। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিল। তনয়া আচমকা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। তন্ময়ও হেসে উঠল তার সাথে। মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“এসব কি করে খাস তুই?”
“আচ্ছা আরেকটা খা। তখন বুঝবি।”
“মাপ কর। আর না। বাপরে! ভীষণ ঝাল!”
তনয়া আর সাধলো না। তন্ময়ের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে ঝালে তার অবস্থা খারাপ হয়ে আসছে। হেসে উঠে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিল। তন্ময় পানির পুরোটা বোতল শেষ করে ফেলল। ঝাল একদমই খেতে পারে না সে। তনয়া উঠে দাঁড়াল। চিন্তিত হয়ে বলল, “কমেছে? আরো ঝাল লাগছে বুঝি? দেখি দেখি!”
বলেই মাথায় ফু দিতে লাগল। পাবলিক প্লেসে তনয়ার কাণ্ডে তন্ময় খানিকটা চমকে উঠল। পরক্ষণে আবার হেসে উঠল। বলল, “ঠিক আছি, ঠিক আছি! বস!”
এরই মধ্যে এক পিচ্চি এসে সাধলে লাগল, ফুলের মালা কেনার জন্য। তনয়া মুখ ফুটে বলার আগেই তন্ময় তার কাছ থেকে দুটো ফুলের মালা নিল হাতে পরার জন্য। তনয়া দুই হাত বাড়িয়ে দিল। তন্ময় খুব যত্নে তার হাতে মালা পড়িয়ে দিচ্ছে। পিছনেই ফুচকার দোকান। ফুচকার দোকান ঘেসেই মেইন রোড। যেই রোডে বহু গাড়ি যাতায়াত করছে। এরই মধ্যে এক গাড়ি দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তাদের। রা*গে সে দাঁত কিড়মিড় করছে, রক্তিম হয়ে উঠছে মুখখান। সামনে পেলে বুঝি ওই তন্ময় কে আ*স্ত চিবি*য়ে খেত। না অনেক হয়েছে! উষ্ণ হাত দিয়ে চুল গুলো পিছনে ফেলে ঠোঁট কাম*ড়ে ধরল। বির বির করে বলে উঠলো,
“আমার প্রেয়সী অন্য কারো সঙ্গে প্রেমালাপ করবে এ দেখার জন্য আর তাকে ভালোবাসি নি। আর অপেক্ষা নয় তনয়া। তুমি খুব দ্রুতই আমার হবে। খুব জলদি তোমাকে নিজের পাবো আমি। ততোদিন না হয় একটু প্রেম প্রেম খেলাই খেলো নাও!”
অতঃপর গাড়ির স্টার্ট দিয়ে গতি বাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো সে। এদিকে তনয়া তখনো তন্ময়তে মগ্ন। তন্ময়ের ভূত যেন তার মাথা থেকেই যায় না!
দুজনে সারা বিকাল ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরল সেই রাতের বেলা। তন্ময় রিক্সা করে এসে পৌঁছাল তনয়ার বাসার সামনে। হাত ধরে তনয়াকে নামালো। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওয়ালেট পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “তাহলে কাল দেখা করি।”
“তুই যাবি কিভাবে?”
“এখান থেকে রিক্সা যাবে না। দেখি সামনে থেকে বাস ধরব।”
তনয়া মৃদু স্বরে বলল, “ওহ!” বলেই মাথা নাড়ল। খানিকটা লজ্জা পাচ্ছে বলতে। যৌবনের এই হৃদয় কিশোরী হয়ে উঠেছে। তার ইচ্ছে করছে তন্ময় কে তুমি করে বলতে। কিংবা আপনি! ধুর আগে থেকে কেন বলতো না। এখন তো বলতেও পারছে না। তন্ময়ের চোখে তাকাতেই লজ্জায় পড়ে যায়। রাঙা হয়ে উঠে মুখখানি। এতো লজ্জা কোথায় রাখবে সে।
আচমকা তন্ময় বলে উঠে,
“দাঁড়িয়ে থাকবি? বাসায় যাবি না?”
তনয়া চমকে উঠে। ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটল। মাথা নাড়িয়ে এক পা বাড়িয়ে বলল, আসছি! পরক্ষণেই পিছন ফিরল। তন্ময় বলতে যাচ্ছিল, “আবার কি?”
বলার আগেই তনয়া ধপ করে তাকে জড়িয়ে ধরল। এরকম রাস্তার উপর তাকে জড়িয়ে ধরায় প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেল তন্ময়। অতঃপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, মানুষজন নেই তেমন রাস্তায়। পুরো রাস্তাই খালি। আসলে রাত ও কম হয়নি। কম করে হলেও রাত্রির ১০ টা বাজে। এতো রাতে রাস্তায় থাকবেই বা কে? তবু একটু অবাক হলো। তনয়া এখনো জড়িয়ে ধরে আছে। কিসের অপেক্ষা করছে? তন্ময়ের!
তন্ময় মুখ খুলে শ্বাস নিল। আলতো ভাবে এক হাত তার পিঠ অন্যহাতে মাথা জড়িয়ে ধরল। কোনো শব্দ করল না। তনয়া ছেড়ে দিতেই সে ছেড়ে দিল। তনয়া ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। এই কাজটা বুঝি না করলেও হতো। তন্ময় তার সামনের অগোছালো চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে গালে হাত রাখল। তনয়ার পুরো শরীর মূহূর্তে কেঁপে উঠল। চোখ বুঝে নিল সাথে সাথে। শক্ত হাতে তার পাঞ্জাবি খামছে ধরল। তন্ময় বলে উঠলো, “সামলে তনু, এতো ছটফট করলে কিভাবে হবে? রাতে ঠিক করে ঘুমাস! জেগে থাকিস না আবার!”
তনয়া অবাক লোচনে তার মুখপানে চাইল। তন্ময় কি করে বুঝল তার মনের কথা। তন্ময়ের মুচকি হাসিতে নিদারুণ লজ্জা পেয়ে গেলো সে। ছুটে চলে গেল বাড়ির মধ্যে। তন্ময় না হেসে পারল না। সে ধরেই নিল, তনয়ার প্রেমে পড়তে তার সময় লাগবে না!
দূর থেকে শকু*নের দৃষ্টিতে দেখছে সে! চওড়া কপাল ভাঁজের ছাপ। শীতল ঠান্ডা চাহনি এদিকে। তন্ময় এবার বেরিয়েছে। অন্যদিকে তনয়া ঘরে ঢুকতেই মৌ ছুটে এসেছে। নিচের কোনো কাণ্ডই তার চোখ থেকে আড়াল হয়নি। কাহিনী কি বিস্তারিত জানতেই ছুটে এসেছে। তনয়া তাকে কোনো জবাব না দিয়েই জানালার কাছে ছুটে গেল। তন্ময় কে দেখবে বলে। কিন্তু তন্ময় তার আগেই চলে গেছে। অপেক্ষা করেনি। একটু মন খারাপ হলেও মানিয়ে নিল। তন্ময় কি করে জানবে সে এখানে এসে তাকে খুঁজবে। বলে তো আর আসেনি। অতঃপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে আকাশের চাঁদ দেখতে লাগল। আজকের চাঁদ যেন একটু বেশিই সুন্দর!
এদিকেল মৌয়ের যেন তর সইছে না। কিভাবে কি হলো সবটাই তার জানা চাই। এই অসাধ্য তনয়া কিভাবে সাধন করল তাকে জানতেই হবে। তার প্রতিটা প্রশ্নে তনয়া হেসে উঠছে। আচমকা চোখ পড়ল দূর জানালার ওদিকে গাড়ির কাছে। গাড়ির কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। উষ্ণ স্যার না? সে অবাক হলো! সারাদিনের পর এখন তার উষ্ণ স্যার কে মনে পড়েছে তাও উষ্ণ স্যারকে দেখার পর। আচমকা মুখটা মলিন হয়ে উঠল। সকালের কথা তার মনে আছে। তিনি আবার এখানে কেন?
উষ্ণ যেন এজন্যই অপেক্ষা করছিলো। চোখাচোখি হতেই পাথরের মূর্তি নড়েচড়ে উঠল। গাড়িতে বসে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। তনয়া দৃষ্টি মেলে সেদিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। স্যার বলেছিলো থেমে যাবে। তবে তিনি কি সত্যিই থেমে যাবেন…
#চলবে
#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩১
নতুন নতুন প্রেমে পড়ার অনুভূতি হচ্ছে তনয়ার। প্রেমে তো সে বহুবছর আগেই পড়েছিল। তবুও এখন নতুন প্রেমের ঘ্রাণ নিচ্ছে, নতুন অনুভূতির আবেশ। অফিসের কাজের চাপে তাদের দেখা সাক্ষাৎ তেমন একটা হয় না। ওই লাঞ্চ টাইমে দু’জনের একসাথে একটু লাঞ্চ, ব্রেক টাইমে চায়ের আড্ডা, অফিস শেষে বাড়ি ফেরা। এরপর আর কথা হয়না ঠিক করে। বাড়ি ফিরে তনয়ার আর ইচ্ছে করে না কল দিতে। ছেলেটা সারাদিন ঘেঁটেঘুটে বাসায় ফিরে বিশ্রাম নেয়, এখন কথা বলে প্রেমালাপ করতে তার খারাপ লাগে। তবে মনে মনে সে চায় তন্ময় তাকে একটা ফোন করুক, কথা বলুক। একটু ফোন করেই জিজ্ঞেস করুক না সে খেয়েছে কি না, ঘুমাচ্ছে কি না?
পরপর দুদিন কেটে গেছে। রাতে তন্ময়ের ফোন আসে না। তনয়া ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছে। ফোন তার টেবিলের কাছেই। তার মন বলছে তন্ময় ফোন করবে। সেই আশায় খানিকক্ষণ পর পর কেবল ফোনের দিকে তীব্র নজর দেয়। যদি একবার ফোন করে!
মৌ তনয়ার হাবভাব গম্ভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠলো, “এবার থামো তুমি? এরপর তো পাগল হয়ে যাবে। এতো পাগলামি কেন করছো?”
তনয়া অবাক স্বরে বলে উঠলো,
“আমি পাগলামি করছি মৌ?”
“অবশ্যই। তার কথা বলার ইচ্ছে হলে ফোন দিবে। ফোন হাতে তো আর বসে থাকতে হবে না। ধৈর্যে না কুলালে তুমি একবার ফোন দিয়ে দেখো না।”
মনের কথা না বললেও মৌ এভাবে বুঝে যাবে আশা করেনি সে। কিন্তু যেচে ফোন দিতেও ইচ্ছে করে না। তন্ময় কি না কি ভেবে বসে। ভাবতে ভাবতেই ফট করে ফোনটা বেজে উঠলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষের নাম্বার থেকে মুখ থেকে হাসির ঝলক যাচ্ছে না তার। চট করে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। মৌ কেবল চেয়ে চেয়ে দেখছে। তনয়া ফোন হাতে ছুটে গেল ঘরের মধ্যে। অন্ধকার ঘরে বিছানার উপর বসে পড়ল লাফিয়ে। উত্তেজনায় তার হাত পা কাঁপছে। না তনয়া এভাবে না। আগে শান্ত হ! নিজেকে শান্ত কর! বলেই শান্ত করল নিজেকে। অতঃপর শব্দ করে শ্বাস নিল। ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে নিয়ে বলল,
“হ্যালো?”
“তনু!”
“হুম।”
“কি করছিস?”
“এই বসে আছি। খাওয়া দাওয়া করেছিস।”
“হু মাত্র শেষ করলাম। তুই?”
“হু আমিও!” মিথ্যে কথা বলে জিভ কামড়ালো সে। যাক কিছু হয়নি। নিজেকে ধাতস্থ করে বসে পড়ল চুপচাপ। কি নিয়ে কথা বলবে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে কথা ফুরিয়ে আসছে। কি বলার থাকবে আজ। ওপাশ থেকেও সব নিশ্চুপ। তন্ময় কেন চুপচাপ? কিছু একটা নিয়ে কথা বলুক। কিছু অনন্ত বলুক!
অবশেষে তন্ময় শুরু করল। সেই অফিসের কাজের আলাপ। যাক শুনতে অসুবিধে নেই। কথা বলছে এই তো বেশি। এক ফাঁকে মৌ এসে শুধালো,
“খাবার কি খাবে না?”
ধীরেই বলেছিল। ওপাশে পৌঁছায় নি কথাটা। তনয়া মাথা দুলিয়ে না করল। মৌ আর কথা না বাড়িয়ে বাকি সব খাবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখল। তনয়া এবার বিছানায় উল্টে শুয়েছে। ওপাশ থেকে তন্ময় বলল,
“আচ্ছা তনু, স্যার কি এখনো তোকে ডিস্টার্ব করে?”
“না না, উনার সাথে আর কথা হয়নি।”
“ঠিক আছে। বিরক্তি করলে বলবি, কিছু লুকিয়ে রাখবি না।”
“আচ্ছা বাবা বলব।”
“হুম।জানিস উষ্ণ স্যার কে দেখলে কার কথা জানি মাথায় আসে। মনে হয় আগেও কোথায় দেখেছিলাম তাকে।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ, কিন্তু মনে করতে পারছি না। মনে করার চেষ্টা করছি!”
“ওহ আচ্ছা।”
“শোন, শুক্রবার তো ফ্রি থাকবি! বের হই আমরা!”
তনয়া খুশিতে দুই ঠোঁট চেপে ধরল। এটাই শুনতে চেয়েছিল সে। পাশাপাশি নিরিবিলি কোথায় বসে নিজের মতো করে সময় কাটাক। দু’জন দু’জনকে আরেকটু জানুক। তনয়া পুরোপুরি তন্ময় কে জানলেও তন্ময় এই তনয়াকে চিনে না। এ তো অন্য তনয়া!
কথাবার্তা আরো কিছুক্ষণ চলল। অতঃপর বিদায় জানিয়ে তনয়া বিছানা ছেড়ে উঠল। বিছানার এককোণে এতোক্ষণ মৌ বসা ছিল। তনয়াকে উঠতে দেখেই বলে উঠলো, “কথা বলা শেষ?”
তনয়ার মন এখন বেশ ফুরফুরে। তাই আহ্লাদী সুরে বলল, “হ্যাঁ শেষ!”
মৌ হাসল। “কি কথা বললে?”
“অনেক কথা!”
“অনেক কথা তো বুঝলাম। ভালোবাসির কথা কি বলিনি? ভালোবাসার কথা শুনো নি!”
তনয়া হেসে বলল, “হ্যাঁ বলেছি।”
মৌ উঠে দাঁড়াল। জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, যাক ভালো। সবার ভাগ্যে তো ভালোবাসার কথা শোনার মানুষ থাকে না।
মৌ বেশ ভণিতা করে কথা বলছে। এর কারণ তনয়া বুঝতে পারছে না তবে খানিকটা আন্দাজ করল। এসে দাঁড়াল জানালার কাছে। দৃষ্টি জানালার বাইরে যেতেই চমকে উঠল সে। আরে! এ তো উষ্ণ স্যারের গাড়ি। তিনি এখনো রোজ আসেন এখানে?
কথাটা ভাবতেই কপাল কুঁচকে গেল। মৌ যেন মনের কথা টের পেলো। বলে উঠলো, “উনি রোজ আসেন।”
“তুই জানলি কি করে?”
“আমি দেখি তো রোজ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। লোকটার ভালোবাসা কি অদ্ভুত না আপু!”
তনয়া নিশ্চুপ রইল। কেবল শান্ত ভঙ্গিতে জানালার বাইরে দাঁড়ানো কালো রঙের গাড়িটি দেখল। লোকটি কিভাবে সারারাত এখানে বসে থাকে। কেন থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর আজও পায়নি সে। তনয়া মনে মনে আওড়ালো, “তিনি তো জানেন আমি তন্ময় কে ভালোবাসি! তার সাথে আছি। তাহলেও তিনি কেন এমনটা করেন? কোন কারণে আমায় আশা করেন?”
মৌ বলে উঠলো, “নিচে একবার যাবে আপু, মানুষটার সাথে দেখা করে আসবে?”
তনয়া সহসা জানালার পর্দা টেনে দিল। মাথা ডান থেকে বামে ঘুরাল। যার অর্থ না। হুট করেই যেন তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আচমকা মৌয়ের হাসির ফোরাক উঠল যেন। তনয়া চমকে উঠে শুধায়,
“হাসছিস কেন?”
“তিনি একদম তোমার মতো!”
“আমার মতো মানে?”
“তোমার মতো মানে তোমার মতো। তুমি যখন তন্ময় কে ভালোবাসতে তখন জানতে তন্ময় তরীকে ভালোবাসে। তবুও ভালোবাসতে। ঠিক সেরকমটা তিনিও করছেন।”
তনয়া নাক মুখ কুঁচকে নিল। বিরক্ত হয়ে শুধাল, “আমি আর তিনি এক হলাম? তার আর আমার ভালোবাসা এক?”
“ভালোবাসার কি আবার ভিন্নতা হয়। স্বচ্ছ ভালোবাসা তো কাঁচের মতো। পার্থক্য করো কিভাবে? তুমি কি তাকে একবারও বুঝতে পারছো না। তার জায়গায় তুমি কি একসময় ছিলে না?”
তনয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম বছর যেই কষ্ট সে পেয়েছে সে কষ্ট আর কেউ না পাক। মৌয়ের কথায় যুক্তি আছে। কষ্ট কি আর সে কম পেয়েছে। সেসব কষ্টের কথা মনে পড়লে এখনো বুকের বা পাশ টা চিনচিনে ব্যাথা হয়। অসহায় মনে হয় নিজেকে! উষ্ণ স্যারের জন্য সে কিছুই করতে পারবে না। কেবল একটা জিনিসই করতে পারবে। বিধাতার কাছে প্রার্থনা করবে যেন উষ্ণ স্যার তাকে ভুলে যায়। এটাই কেবল সম্ভব তার দ্বারা!
কিছুক্ষণ আগেও তনয়ার ছাড়া পড়ছিলো জানালার ওদিকে। এখন হঠাৎ পর্দা টানা দেখে উষ্ণ স্যার কিঞ্চিত পরিমাণ হাসল। সে আবারো সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। এর মধ্যে দুটো কুকুর এসে চেঁচামেচি করতে লাগল। এদের কে আজ খাবার দেওয়া হয়নি!
———-
আজ শুক্রবার! তনয়া দুপুরবেলা বেশ সেজেগুজে বেরিয়েছে। ভেবেছিলো শাড়ি পরবে। আকাশে মেঘ জমেছে দেখে সেই আশা বাদ দিলো। আপাতত একটা কামিজ আর জিন্স প্যান্ট পরে সে তৈরি। হালকা সাজগোজের যেন বাহার লেগেছে। একটু কাজল, একটু টিপ ছাড়া যেন সাজ জমে না। সাদা রঙের কামিজের সাথে সাদা ওড়না। তন্ময়ের শুভ্র রঙ ভারী পছন্দ কি না!
দেখা করার কথা বিকেলে। ঘণ্টা দুয়েক আগেই তনয়া বেরিয়েছে। উত্তেজনা কমছে না। মনের ভেতরে কেবল অস্থিরতা। একটা সিএনজি দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ল তাতে। সিএনজি চলছে ধীর গতিতে। তাদের বাসার গলিটা পেরিয়ে আরেক গলিতে ঢুকতেই একটা গাড়ি এসে থামল তাদের সামনে। গাড়ি থেকে লোকজন নামছে দেখে তনয়া চমকে উঠল। মনে ভীতি বাড়ছে। সিএনজি চালককে কিছু বলার আগেই তিনি এদিক ফিরে কিছু একটা স্প্রে করল। চোখের সামনে নিমিষেই জ্ঞান হারা*লো তনয়া!
তনয়ার জ্ঞান ফিরল ঘন্টা দুয়েক বাদে। নরম তুলতুলে বিছানার উপর আবিষ্কার করল নিজেকে। ভীষণ আরামদায়ক বিছানায় চোখ লেগে আসছে কেবল। তনয়া ভারী চোখ দুটো মেলে দেখার চেষ্টা করল। ঘরের উপরের দেওয়াল দেখা যাচ্ছে কেবল। শরীর ভার হয়ে আছে। গায়ের উপর সাদা চাদর দেখে টনক নড়ে উঠল তার। তড়ফড় করে উঠে বসল। সামনের চেয়ারে উষ্ণ স্যারকে বসা দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ।
শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। হাতে ওয়াইনের গ্লাস। তনয়ার সাথে চোখাচোখি হতেই এক চিলতে হাসি ফুটল ঠোঁটে। ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, “গুড মর্নিং তনয়া!”
তনয়ার মাথায় যেন ছাদ ভেঙে পড়ল। মিনিট দুয়েক সে কেবল হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। তার পুরো শরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতে চাদরের নিচে নিজের পোশাক দেখতে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে। কিন্তু পরক্ষণেই স্যারের বলা “গুড মর্নিং” কথাটা পুরো শরীরে শিহরণ জাগিয়ে দিল। সে কি তবে গতকাল থেকে এখানে? তারা রাতে একসাথে ছিল! না আর ভাবা যাচ্ছে না।
তনয়াকে উত্তেজিত হতে দেখে উষ্ণ চৌধুরী হেসে উঠল। তার হাসির শব্দ তনয়ার চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। উষ্ণ চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ভয় পেয়ো না, বিকেল হয়েছে কেবল। তুমি আমার কাছে এসেছো কেবল দু ঘণ্টা হলো!”
তনয়া বেশ বড়সড় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মূহূর্তেই তার মুখটা রক্তি*ম হয়ে উঠল। বিছানা থেকে চট করে নেমে স্যারের কাছে এগিয়ে গেল।
“এসব কি? আপনি আমায় তু*লে কেন এনেছেন?”
উষ্ণ যেতে যেতে একটা দেওয়ালের সাথে ঠেসেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “ওভিয়েসলি তোমাকে দেখতে!”
“মশকরা করছেন। আপনি আমায় তুলে এনেছেন, জোর করিয়ে। এর মানে জানেন?”
“হ্যাঁ, কিড*ন্যাপ। কিন্তু তুমি তার চাইতেও ভালো অবস্থায় আছো। তোমার হাত পা বেঁধে রাখেনি।”
“হুম*কি দিচ্ছেন?”
উষ্ণ হাসল। গ্লাসের ওয়াইন পুরোপুরি শেষ করে টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল। তার পিছন পিছন তনয়া হাঁটছে। মাথায় সবকিছু জটলা পাকিয়ে গেছে তার। নিজেকে প্রথমে শান্ত করার চেষ্টা করল। অতঃপর বলে উঠলো,
“আমি বাসায় যাবো।”
“উহু তুমি বাসায় তো যাবে না। তুমি যাবে তন্ময়ের কাছে। আজ তোমাদের ডেট আছে!”
“ওহ, তাহলে এই কারণে আপনি আমাকে তুলে এনেছেন যাতে আমাদের ডেট ভেস্তে দিতে পারেন?”
উষ্ণ তার দিকে ফিরল। দুই আঙুল একসাথে এনে তার কপালে টোকা দিয়ে বলল, “এই কারণে তোমায় আমি এতো ভালোবাসি!”
তনয়া রে*গে যাচ্ছে। তার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এদিক ওদিক ফিরে ঘড়িতে টাইম দেখল। হ্যাঁ, সময় হয়ে গেছে। এই সময় তার তন্ময়ের সাথে থাকার কথা ছিল। অতঃপর তড়িঘড়ি করে দরজার কাছে এগিয়ে দরজা ধরে টানতে লাগল। বরাবরই সে ব্যর্থ হলো। দরজা খুলতে পারল না। উষ্ণ মুখ টিপে হেসে বলল,
“পারবে না ছেড়ে দাও।”
“দরজা খুলুন।”
“চাবি আমার কাছে নেই।”
তনয়া তড়িৎ গতিতে কাছে এগিয়ে এসে বলল, “আপনি চান টা কি?”
“তোমাকে!”
“পাবেন না। আপনি এজন্মে আমায় পাবেন না!”
উষ্ণ এই ওয়াইনের গ্লাস ও শেষ করে তার দিকে ঝুঁকে গেল। হাতটা বাড়িয়ে দিল তার গালের কাছে। তার ঠান্ডা হাতের স্পর্শে তনয়া খানিকটা কেঁপে উঠলো। উষ্ণ ফিসফিস স্বরে বলে উঠলো, “তোমাকে পাবার জন্য যদি শত জন্ম অপেক্ষা করতে হতো আমি তবে তাই করতাম। কিন্তু আফসোস এটা সম্ভব না!”
তনয়া হাতটা সরিয়ে দিল। এদিক ওদিক চক্ষু ঘুরিয়ে নিল। পুরো ঘরের কোথাও ব্যাগের হুদিশ পেলো। দু হাতে মাথা চেপে বসে পড়ল। উষ্ণ মুচকি হাসল। তার যেন মজাই লাগছে। এবার গ্লাস ছেড়ে ওয়াইনের বোতল হাতে নিল। চেয়ারের উপর বসে পড়ল আরাম করে। এক হাত চেয়ারের উপর রেখে অন্যহাতে ওয়াইনের বোতল নিয়ে একটু পর পর চুমুক দিতে লাগল। তার সামনেই তনয়া বসে আছে হতাশ ভঙ্গিতে। পাঁচ মিনিট কাটল নিরবতায়। আচমকা উষ্ণ বলে উঠলো, “সুন্দর লাগছে তোমায়!”
“আমি তন্ময়ের জন্য সেজেছি।”
উষ্ণ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “আমায় কষ্ট দিতে ভালো লাগে তোমার।”
“আমায় এখানে কতোক্ষণ আটকে রাখবেন?”
“কেবল আজকের দিন।”
“বাহ খুব দারুণ। আপনার কি মনে হয় এসব করে আপনি তন্ময়ের থেকে আমাকে আলাদা করতে পারবেন।”
“না আমার কাছে আরো অনেক পথ আছে।”
বলেই ওয়াইনে চুমুক দিল। তনয়া চোখ মুখ কুঁচকে উঠে দাঁড়াল। আর তার ধৈর্য্যে কুলাচ্ছে না। ছটফট করছে সে। উষ্ণ হেসে উঠে দাঁড়াল। তনয়া তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
“আমি ভেবেছিলাম আপনি থেমে যাবেন!”
“কেন? আমি কি সেটা বলেছিলাম!”
“আপনিই তো বলেছিলেন..
“বলেছিলাম! তন্ময় তোমায় রিজেক্ট করলে আমায় বিয়ে করতে হবে। তন্ময় তোমায় রিজেক্ট করেনি এর মানে এটা নয় আমি তোমায় ছেড়ে দিব। এমন কথা তো হয়নি!”
তনয়া মুখ ভেংচি কাটলো। জানালার কাছে গিয়ে নিচে উঁকি দিতে দিতে বলল,“ভাদাইম্মা একটা!”
কথাটা উষ্ণের কানে এসে পৌঁছাল। সে এগিয়ে এসে তনয়ার পিছন দাঁড়িয়ে বলল,
“মিস তনয়া!”
তনয়া পিছন ফিরল। উষ্ণ বলে উঠলো, “কি ভাবছো আমায় নিয়ে?”
“ভাবছি এখান থেকে বের হয়েই আপনার নামে মাম*লা করতে যাবো।”
“কথাবার্তা হুশ করে বলো! নাহলে বিপদে পড়বে।”
“কেন কি করবেন?”
“বিয়ে করব। তোমার একুল ওকুল দুইকুলে কেউ নেই। তুলে নিয়ে বিয়ে করে নিলেও কেউ পু*লিশ কেস করতে পারবে না।”
কথাটা শুনে তনয়া ধাক্কা গেল। হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। উষ্ণ স্যার তাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করার হুমকি দিচ্ছে! বিশ্বাস হচ্ছে না। উষ্ণ গাল বাঁকিয়ে হেসে বলল, “কিন্তু আমি চাই তুমি নিজে আমায় বিয়ের কথা বলো।”
“কস্মিনকালেও সম্ভব না। আপনি থেমে যান। আমার চেয়েও ভালো কাউকে পাবেন!”
“আমার তোমার বিকল্প নয়, তোমাকেই চাই তনয়া!” ভীষণ আবেগীস্বরে কথাটা বলল উষ্ণ। কথাটা বলার সময় যেন তার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। তনয়ার নজর গেলো স্যারের হাতের দিকে। আঘা*তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বেশ পুরনো নয়। স্যারের মাথায় কি চলছে সে জানে না। এবার তনয়ার ভয় করছে। থেমে গেল সে।
উষ্ণ ফের চেয়ারে বসে ওয়াইনের বোতলে চুমুক দিতে লাগল। তনয়া এসে বসে পড়ল বিছানায়। হাত ঘসতে লাগল কেবল।
ঘন্টা দুয়েক পার হলো আরো। এতোক্ষণ কেবল তনয়া বসেছিলেন। উষ্ণ তার সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে তাকে দেখছিলো। একবার খাবারের জন্য ও সাধল। তনয়া মুখ ভেংচি কেটে না করে দিল। এরই মধ্যে দরজা খোলার শব্দ। তনয়া এদিক সেদিক না তাকিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। দরজার কাছেই জেএস দাঁড়িয়ে ছিল। সেও তাকে যেতে দিল। জেএস এগিয়ে এলো উষ্ণের কাছে। উষ্ণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওকে বাসায় পৌঁছে দিও। আর আমাদের আর কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে?”
“দু সপ্তাহ স্যার!”
“ড্যাম ইট!” বলেই চেয়ারে লাথি মা*রল। রাগে ফুঁ*স ফুঁ*স করে বলল, “তোমার মনে হয় আমি ওদের দু সপ্তাহ স*হ্য করতে পারব।”
“করতে হবে স্যার!”
উষ্ণ রক্ত*বর্ণ দৃষ্টিতে জেএসের দিকে ফিরে বলল, “শুধু তোমার জন্য জেএস। তুমি বলেছ বলে আমি এসব করছি। যদি এরপরেও আমি তনয়াকে না পাই তাহলে আমি দুটো গু*লি করব। একটা তোমার বুকে আরেকটা তন্ময়ের! মাইন্ড ইট!”
জেএস কেবল মাথা নাড়ল। উষ্ণ রে*গে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। জেএস শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। নরম স্বরে বলে উঠলো, “আমাকে পারতেই হবে স্যার। নাহলে আবারো সেই সব হবে। অতীতের পুনরাবৃত্তি। এবার আমি আর কোনো খু”ন হতে দিতে পারি না। কখনোই না!”
#চলমান