তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
21

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩২

চাকচিক্য ভাবে সাজানো হোটেলটি। চারদিক মিষ্টি মধুর ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কোথাও একটু ধুলো বালির জায়গা নেই। একটু বাদে বাদেই লোকজন লাগিয়ে পরিষ্কার করে ফেলা যায়। রূপায় বাঁধানো যেন প্রতিটা দেয়াল। আয়নাতে চকচক করছে এক রমণীর চিন্তিত মুখশ্রী। সে আরো কেউ নয়, স্বয়ং তনয়া! সে যে একটা ফাইভ স্টার হোটেলে তা বুঝতেই মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। উষ্ণ স্যার তাকে এতোক্ষণ এখানেই ব*ন্দি করে রেখেছিলো তবে। এদিক ওদিক ফিরে মানুষের খোঁজ করছে। চারদিক তার গোলক ধাঁধার মতো মনে হচ্ছে। বের যে কিভাবে হবে তাই ঠিক করতে পারছে না। অবশেষে লিফটের দেখা মিলল!

লিফটে করে দ্রুত হলে এসে পৌঁছাল সে। এতোক্ষণের ছটফটের রেশ এখন আর নেই। নিজেকে শান্ত করল। লিফটের আয়নাতে নিজের মুখটা শ’বার দেখা হয়ে গেছে। যেভাবে সেজে বেরিয়েছিল তেমনি আছে কেবল চুলগুলো একটু অগোছালো হয়ে ছিল। ঠিক করে নিল। শান্ত চাহনিতে দ্রুত বেগে হোটেল ত্যাগ করল সে।

এদিক ওদিক এসে চোখ বুলাচ্ছে। সবখানে কেবল ব্র্যান্ডের গাড়ির ছড়াছড়ি। কি আশ্চর্য! ব্যাগ ছাড়াই তো চলে এসেছে। এবার যাবে কি করে? দাঁড়িয়ে নিজের মাথায় জোরে থা*প্পড় মার*ল। ফোন ব্যাগ কিছুই তো আনা হয়নি। এখন তন্ময়ের সাথে দেখা করবে কি করে?

হয়রান হয়ে গেল নিমিষেই। তিমিরে ঢেকে গেল চোখ মুখ। ইচ্ছে করছে এখানে বসেই কান্নাকাটি শুরু করতে। সবকিছু ওই শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরীর কারণে। এখন উপরে গিয়ে যে রুমে যাবে সেই রুমের নাম্বার ও তার জানা নেই। যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। অগত্যা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইল।‌

তৎক্ষণাৎ একটা গাড়ি এসে থামল তার সামনে। তনয়া চমকে উঠল। জেএসের আগে বের হয়া সত্ত্বেও জেএস এখন তার সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেএস গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল। তনয়া গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়াল গাড়ির কাছে। জেএস ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলল,

“বিশ্বাস করতে পারেন। বসুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি!”

তনয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গাড়িতে বসে পড়ল। জেএস ড্রাইভিং সিটে বসতেই বলে উঠলো,
“আমি আপনাদের কাউকে বিশ্বাস করি না!”

জেএস গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “করতে হবে না। আমরা সবাই স্যারের গোলাম। কেবল স্যারের কথা মেনে চলি। এই আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া আমার জন্য হুকুম। আমি কেবল সেটাই করতে পারি!”

তনয়া শ্বাসরোধ করে কথাগুলো শুনল। সিটের পাশেই তার ব্যাগ আর ফোন রাখা। দ্রুত ফোনের লক অন করে ফেলল। তন্ময়ের অনেকগুলো মিসকল দেখে শুকনো ঢোক গিলল সে। সাথে সাথে কল ব্যাক করল!

“হ্যালো, হ্যাঁ তনু। কোথায় তুই? গত দু ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি। ফোন কেন তুলছিলি না?”

“সরি সরি তন্ময়। আমি চলে আসছি। এই তো রাস্তায় আছি!”

তন্ময় মাথা ঠান্ডা করল। রে*গে যাওয়া তার স্বভাব বিরোধী আর সেটাও যদি হয় তনুর প্রতি তবে তো কোনো কথাই নেই। তনুর উপর রা*গ করে থাকতে পারে না সে। তার জীবনে এখন একমাত্র সেই আছে। অতঃপর মৃদু স্বরে বলল, “আচ্ছা আমি অপেক্ষা করছি!”

তনয়া হুম হুম করে কল কেটে দিল। অস্থির মন নিয়ে বাইরে জানালার দিকে ফিরে তাকাল। এসব রাস্তাঘাট তার মোটেও চেনা পরিচিত নয়। কোথায় আছে কতোক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে কোনো ধারণা নেই। অগত্যা জেএস কে জিজ্ঞেস করল,

“কতোক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে?”

– আপনার বাসায় পৌঁছাতে দু ঘণ্টা। জ্যামে পড়লে ঘণ্টা তিনেক।

– আমি তন্ময়ের কাছে যাবো।

জেএস মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই তনয়া বলে উঠল, – আমি তন্ময়ের কাছেই যাবো।

– জি ম্যাম ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবো।

– তো চলো! যতো দ্রুত পারো!

জেএস ঘাড় নাড়িয়ে গাড়ি চালাতে লাগল। তনয়া বারংবার ফোনে টাইম দেখছে। বিকাল ৪ টায় দেখা করার কথা ছিলো। অলরেডি ৬ টা বেজে গেছে। আরো দু ঘণ্টা মানে পুরোপুরি ৮ টাই বাজবে। এতোক্ষণ কি তন্ময় কে অপেক্ষা করানো ঠিক হবে? ঠিক বুঝতে না পারছে না কিছু। গাড়িতে এসি ছাড়া তবুও ঘেমে একাকার সে। জেএস পানির বোতল এগিয়ে দিল। পাছে পানিতে আবার কিছু মেশানো থাকে এই ভেবে আর নিল না। কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ!

তখন ৭ টা বাজতে আর ১০ মিনিট বাকি! তনয়া এখনো গাড়ির মধ্যে। জ্যামে আটকা পড়েছে। একটু বাদে বাদে জেএস কে জিজ্ঞেস করছে, জ্যাম কখন ছাড়বে স্যার!

— সময় লাগবে ম্যাম। এই জ্যাম সহজে ছাড়বে না। আমাদের পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টাও লাগতে পারে!

তনয়ার মুখটা শুকিয়ে গেল। জিভটা যেন তেতো হয়ে গেছে। বার বার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। তন্ময় বোধহয় অভিমান করে আর একটা ফোন ও দিলো না।

সন্ধ্যার আলোয় উজ্জ্বল ক্যাফে। সোনালী আলোয় কাঁচের উপর এক অদ্ভুত নকশা এঁকেছে। ক্যাফের এক কোণে এক পুরুষের কাছে এগিয়ে গেল এক নারী। শুদ্ধ বাংলা ভাষায় ভদ্রতা সহকারে বলে উঠলো, “স্যার আর কিছু?”
এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছিলো সে। মেয়েটির কথায় ভাবনায় ছেদ ঘটল। একটু টেবিলের উপর নজর দিল। মোট ৬ কাপ কফির কাপ দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। ফোনের স্ক্রিনে টাইম দেখে মাথা দুলিয়ে বলল,

“না বিলটা দিন!” মেয়েটা হেসে চলে গেল। তন্ময় পাশের চেয়ারের দিকে ফিরে তাকাল। লাল গোলাপের মাঝে গোলাপী রঙের গোলাপ দিয়ে সাজানো এক তোড়া। বিশেষ করে তনুর জন্য কাস্টমাইজড করে সাজিয়ে এনেছিলো। সে বুঝে গেল তনু আর আসবে না!

ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে সাতটা ছুঁয়েছে। তন্ময় বিল মিটিয়ে ফুলের তোড়া সেখানেই রেখেই বেরিয়ে গেল। এখানে এসেছিল সাড়ে তিনটার দিকে। এতোক্ষণ বসে কেবল অপেক্ষার প্রহর গুনছিলো সে।

তখন সাড়ে ৮ টা বাজে। তনয়া হনহনিয়ে ক্যাফের মধ্যে ঢুকল। জেএস বাইরেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। কারণ স্যারের কথামতো ম্যাডাম কে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। চারদিক খুঁজেও যখন তন্ময় কে আর পেলো তখন মনটা পি*ষে গেল যুবতীর। একরাশ অভিমান ঠেকল কেবল উষ্ণ স্যারের প্রতি। চোখ ভিজে উঠছিলো বার বার। এরই‌‌ মধ্যে ফিমেইল ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করল,

“এক্সকিউজ মি ম্যাম, এনিথিং রং?”

তনয়া ঠোঁট উল্টে কেবল মাথা নাড়ল। অভিমান, রাগ ব্যাথায় জর্জরিত হৃদয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। মিনিট দশেক পর তনয়া বেরুলো। জেএসের অপেক্ষার পালা শেষ হলো। পিছনের সিটের গাড়ির দরজা খুলে অপেক্ষা করছিলো সে। তনয়া হাতের একটা ফুলের তোড়া সমেত পিছনে এসে পৌঁছাল। তন্ময়ের সাথে তবে দেখা হয়নি। যাক! তবে তনয়ার ভারী মুখখানা দেখে ভীষণ দুঃখ পেলো সে।

গাড়ি এবার চলছে বাসার গন্তব্যে। জেএস ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে সামনের আয়নাতে চোখ বুলিয়ে দেখছিল কেবল। মেয়েটি মাথা নুইয়ে ফুল আঁকড়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে। তার কান্নার কোনো শব্দ নেই। একদম নিশ্চুপ, নিরব!

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩৩

মেঘে ঢাকা পুরো শহর। ভোর রাত থেকেই এই হাল। সূর্য্যিমামার দেখা মিলেনি। মিলবে কি করে? শেষ রাতে আচমকা কি বৃষ্টিই না এলো। পুরো শহর যেন ডুবে যায়। ভোরে গিয়ে সেই বৃষ্টি কমেছে কিন্তু মেঘ সরেনি। ধূসর আস্তরণে ঢেকে আছে পুরো অম্বর। তনয়ার মন খারাপ রাত থেকেই। লজ্জায় তন্ময় কে একটা ফোন অবধি দেয়নি। তন্ময় ও যেন অভিমান করে আছে। বাসা থেকে বাইরে পা দিয়ে আবহাওয়ার এমন হালত দেখে মোটেও দুঃখ পেলো না সে। কেবল মনে হলো উত্তর থেকে আসা দমকা হাওয়ায় গুলো যেন তার দুঃখের গল্প বলে বলে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতির সবকিছু তার মনের দুঃখ টের পেয়েছে। তাইতো প্রকৃতি আজ এতো দুঃখে মাখা!

মন খারাপ সমেত ছাতা সারাই বেরিয়ে গেছে। বৃষ্টি এখন আর পড়ছে না, মেঘ ও গর্জে না। কেবল এক আস্তরন। মনের দুঃখ গুলো প্রকাশ পাচ্ছে ওই ধূসর মেঘে। ভাঙা হৃদয় নিয়ে পা বাড়াল অফিসের দিকে। যেতে ইচ্ছে করছে না। লজ্জায় দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। গেলেই যে তন্ময়ের সাথে দেখা হয়ে যাবে। তখন চোখে চোখ রেখে কথা বলবে কি করে? কথা বললে সবকিছুই বা ঠিক হবে কি করে?

দিনটাই শুরু হয়েছে একরাশ খারাপ লাগা নিয়ে। ঢালু পথগুলো কেমন স্যাঁতস্যাঁতে, কাঁদায় মাখামাখি করছে। মন খারাপে বেশিদূর হেঁটে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাস স্ট্যান্ড অবধি রিক্সা করে পেরুল। অন্যদিকে খারাপ আবহাওয়ার কারণে বাস স্ট্যান্ডের অর্ধেক লোক কমে গেছে। ভালোই হলো! কিন্তু এই ভালো লাগা মনে ধরল না বেচারীর।

অফিসে টাইম মতো পৌঁছে গিয়ে টেবিলে বসার আগে চোখ পড়ল উষ্ণ স্যারের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিল সে। উষ্ণের তীক্ষ্ণ নজর তো আর আলাদা হবার নয়। মেয়েটি শান্ত ভঙ্গিমায় চেয়ারে বসে ক্লান্তভঙ্গিতে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর। তার সাথে চোখাচোখি হবার পরেও কোনো উপলব্ধি নেই। সেই দৃষ্টিতে কিছু ছিলো না কেবল হতাশা ছাড়া। প্রিয় মানুষের সাথে হৃদয় বিয়োগের হতাশা। উষ্ণ চৌধুরী অদ্ভুত ভাবে তনয়ার মনের কথা পড়ে ফেলতে পারল। এই সকাল সকাল প্রিয়দর্শিনীর গোমরা মুখ তার সহ্য না। তাই তো গভীর ভাবনায় পড়ে হাতের তালু দিয়ে চুলগুলো আলতো মালিশ করতে করতে কেবিনে চলে গেল।

তন্ময়ের আগেই তনয়া এসে পৌঁছায়। তন্ময় আসার পরপরই সেই খবর চলে যায় তনয়ার কানে। তার হৃদয় থমকে যায়। কিভাবে গিয়ে দাঁড়াবে তন্ময়ের সামনে। কিসের অজুহাত দিবে সে? পুরো ৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করানোর পরেও তার দেখা পায়নি সে। চারটে ঘণ্টা কতোজন পারে ধৈর্য্য নিয়ে বসে থাকতে। সে ছিলো! ওই মেয়ে ওয়েটারের কাছ থেকেই জেনেছিল সে। গোলাপের তোড়া নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিলো সে। একের পর এক কপির মগ শূন্য করে অপেক্ষার প্রহর শুনেছে। সেসব কথা মনে পড়তেই অশ্রু যেন বাঁধ মানতে চায় না। কাঁদতে ইচ্ছে করে ভীষণ ভাবে!

আসার পর থেকে কথাই হচ্ছে না। কাজের ছুতোয় দুজনের মধ্যেই যেন দূরত্ব হয়ে যাচ্ছে।‌ অজানা এক দূরত্ব! সে ধরেই নিল লাঞ্চ টাইম ছাড়া দেখাই হবে না। ঠিক তাই হলো। অবশেষে লাঞ্চ টাইমে একটু ফুসরত মিলল। তনয়া এখনো নিজের চেয়ারে বসে বসে ভাবছে কি করবে? কিভাবেই বা মুখোমুখি হবে! কাঁচের দেয়াল ভেদ করে অপরজন দেখছে লুকোচুরি ভাবে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্বচ্ছ আর শক্ত কাঁচের দেয়াল রুখতে পারেনি।

তনয়া ভাবছে প্রথমে দেখা হলেই নরম সুরে বলবে, “সরি তন্ময় আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। তোকে এতোখানি অপেক্ষা করানো একদম উচিত হয়নি। তুই তো জানিস আমি কেমন? কখনো দেখেছিস তোকে এতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করিয়েছি। রাগ করিস না লক্ষ্মীটি!”

মনে মনে কথাগুলো চোখ বন্ধ করে আওড়াতে লাগল। চোখ মেলে তাকিয়ে সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখে চমকে উঠল সে। ভ্রু গুলো চোখের উপরে ভেসে আছে উঁচু ভাবে। ঠোঁট দুটো আপনা আপনি‌ খুলে গেল। তন্ময় টেবিলের উপর ঝুঁকে কপাল কুঁচকে তার মুখশ্রী পরখ করছিল। তনয়া চোখ মেলতেই সাথে সাথে বলে উঠলো,

“কিরে? কি বিরবির করছিলি?”

তনয়া মুখ বন্ধ করে নিল। হুঁশ ফিরেছে তার। এতোক্ষণ ধরে যেসব কথা আওড়ালো চোখের সামনে তন্ময় কে দেখামাত্র নিমিষেই সব ভুলে গেল। তন্ময় কিঞ্চিত হেসে তার মাথায় হাত রেখে বলল, “কিরে? কি ভাবছিস?”

“নননা ওই আরকি? তুই এখানে?”

“আমি এখানে মানে? লাঞ্চ করবি না?”

তনয়া লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। ছিঃ ছিঃ কি অদ্ভুত প্রশ্ন করে ফেলল। এতো দিন তো দুজনে একসাথেই লাঞ্চ করত। এখনি সব ভুলে গেল। তন্ময় দুই হাত বাহুতে গুঁজে বলল,

“হুম! ম্যাডামের তাহলে এখন আর আমার সাথে লাঞ্চ করতে ইচ্ছে করছে না!”

তনয়া হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল, “কি বলছিস? করব তো লাঞ্চ চল!”

তন্ময় মৃদু হেসে তার হাতটা নিজের আগলে নিয়ে পা বাড়াল। নিজের জিনিস অন্যের হাতে দেখেই চোয়াল শক্ত করে নিল উষ্ণ চৌধুরী! এতোদিন চুল বন্ধ থাকার কারণে তার তী*ক্ষ্ণ ধা*রালো চোয়াল নজরে আসেনি। চুল গুলো ছোট করে ফেলায় সেই চোয়াল এখন সকলের নজরে। স্যারের জ লাইন দেখেই একেকজন মুগ্ধ। দিন যেতে যেতে স্যার ভীষণ সুন্দর হয়ে গেছে। অন্যদের ধারণা দাঁতে দাঁত নিশপিশ করে উষ্ণ বলে উঠলো,

“সব শোধ তুলব তনয়া! সব! যত ইচ্ছে এখন উড়ে বেড়াও একবার আমার খাঁচায় বন্দি হলে তোমার সব তে*জ বের করে ছাড়ব। তখন দেখব এতো আদর সোহাগ কই থাকে?”

পরক্ষণে কেবিনে প্রবেশ ঘটল জেএসের। উষ্ণ তার গভীর , হিং*স্র মুখাবয়ব নিয়েই পিছন ঘুরল। স্যারের চাহনি বলে দিচ্ছে তিনি কতোটা রেগে আছে। ওসব বুঝতে জেএসের সময় লাগে না। বহু বছর বড় স্যারের হয়ে কাজ করেছে এখন করছে ছোট স্যারের হয়ে। যখন বড়স্যারের সাথে কাজ করত তখন সে ছিল তরুণ! বিশ বছর বয়সের তরুণ। তবে স্যারের সাথে থেকে থেকে অনেক বড় বড় কাজ করেছে। এখন করছে তার ছেলের জন্য?

উষ্ণ চৌধুরী দুই হাত পকেটে গুঁজে বলল, “কি খবর জেএস?”

“যা বলেছিলাম স্যার। একটু সময় লাগবে।”

“ফা*ক ইউর টাইম। ইরিশা জামানের কি খবর?”

“অনেক চেষ্টা করছে। আবারো কিছুদিন তনয়া ম্যাডামের উপর নজ*র রেখেছিলো। কিন্তু তিনি এখন তন্ময়ের সাথে ঘুরা ঘুরি করার কারণে কোনো দুশ্চিন্তা নেই।”

উষ্ণ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। পিছনের কাঁচের দেয়াল হেলান দিয়ে বলল, “আর তিলোত্তমা বেগম?”

“তিনি আর ইরিশা জামান এক নৌকার মাঝি!”

উষ্ণ মাথা নাড়ালো। ঠোঁট দিয়ে জিভ দুটো ভিজিয়ে বলল, “আর তোমার স্যারের?”

এতোক্ষণ অনেক কনফিডেন্সের সাথে জবাব দিলেও জেএস এবার চুপসে গেল। তার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ থেকেই উষ্ণ বাঁকা হাসল। জেএস হতাশার সুরে বলল,

“সম্ভব হয়নি। স্যারের উপর নজর রাখা এতো সহজ কাজ নয়। বার বার ধরে পরে যায় তারা।”

“তোমার স্যার বলে কথা। এতোই কি সহজ নাকি? শেহনেওয়াজ জাওয়াদ চৌধুরীর মাথায় কি চলছে তা কি এতো সহজে বেরুবো। খোঁজ লাগাও।”

একটু থেমে আবারো শুধায়, “তোমায় কি এখন আর ডাকে না?”

জেএস তীব্র আবেগে বলে উঠলো, “না স্যার। আপনার সাথে কাজ করার পর এখন আমায় আর ডাক পাঠান না!”

উষ্ণ মুখ টিপে হাসল। জেএসের কষ্ট সে বুঝতে পারছে। দীর্ঘ এতোবছর একজনের আন্ডারে কাজ করার পরে তার থেকে এমন তিরষ্কার পেয়ে হৃদয়ে তী*ব্র দহ*নের পো*ড়া গন্ধ এখান থেকে উষ্ণের নাকে জ্বালা*তন করছে। উষ্ণ কিছুটা নাক ঘসে বলল,

“আর তনয়ার?”

“ম্যাডাম গতকাল অনেক কান্নাকাটি করছিলো?”

“কার জন্য?”

জেএস উত্তর বলতে চাইছিল না। সে জানে উষ্ণ স্যার উত্তরটা জানে। তাও শুনতে চাইছে দেখে ছোট করে বলল, “তন্ময়ের জন্য!”

উষ্ণ সর্বশক্তি দিয়ে চেয়ারের এক লা*থি মারল। সেই চেয়ার ছিটকে জেএসের গা ঘেঁষে দেওয়ালে এসে ঠেকল। উষ্ণ চৌধুরী ঠোঁট কাম*ড়াতে কামড়া*তে বলল,

“কথা বুঝে নাও জেএস। এতোদিন আমি এসব নিয়ে এতো চিন্তা করিনি। কারণ তন্ময় এতো দিন অন্যের প্রেমে মেতে ছিল। তাই ভাবতে হয়নি। বাট নাও আই ডোন্ট ফিল উইল। ওই তন্ময়ের বাচ্চা আর তনয়াকে একসাথে দেখলেই আমার মাথা ঘুরা*নো শুরু করে। পাগল পাগল লাগে আর তুমি কি না বলছো আমায় দুই সপ্তাহ ওয়েট করতে! আর ইউ ক্রেজি!”

“স্যার আপনি চিন্তা করবেন না। তনয়া ম্যাডামের উপর আমাদের ২৪ ঘণ্টার নজরদারি চলছে। আপনি টাইম টু টাইম খবর পাবেন।”

উষ্ণ এসে দাঁড়াল জেএসের মুখোমুখি।
“আর টাইম টু কি খবর দিবে? কখন তন্ময় তনয়ার হাত ধরল, তারা কোথায় ঘুরতে গেলো, একসাথে ফুচকা গেলো এসব!” চেঁচিয়ে উঠল আচমকা। জেএস চোখ বন্ধ করে নিল। উষ্ণ মুখটা এগিয়ে কানের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

“মাইন্ড ইট জেএস, তোমার এসব ফা*কিং ননসেন্স শোনার আমায় একটুও টাইম নেই। যতদ্রুত পারো কাজ করো। যদি তন্ময় আমার তনয়ার গায়ে হাত ও বাড়ায় তাহলে তন্ময়ের হাত ভাঙা*র আগে তোমার বউকে তু*লে নিয়ে আরেক বেডার সাথে ধরে বি*য়ে দিয়ে দিব। তখন বুঝবে জ্বা*লা কাকে বলে? বুঝলে!”

জেএস শুকনো ঢোক গিলল। স্যার বেরিয়ে গেছে অথচ তার মুখের থেকে চিন্তার ভার যাচ্ছে না। তার মুখটা ভোঁতা হয়ে গেল। স্যার যে কেন কিছু থেকে কিছু হলেই তার বউ বাচ্চা নিয়ে পড়ে সে বুঝতে পারে না। সবকিছুতে তাদের নিয়ে টানাটানির কি দরকার!

—————

তন্ময় আর তনয়া দুজনকে ক্যান্টিন থেকে পাস্তা নিয়েছে খাওয়ার জন্য। মন খারাপের কারণে তনয়া আজ লাঞ্চ বানায়নি। তাই এখন পাস্তাই খেতে হচ্ছে। ক্যান্টিনে এটা ছাড়া আর ভালো কোনো খাবার নেই।

অনেকক্ষণ ধরেই কথাবার্তা বলছে। তনয়ার কাছে সবকিছু স্বাভাবিক লাগছে। তন্ময় যতটা রাগ করবে ভেবেছিল ওতোটাই রাগ করেনি। ইভেন ওই ব্যাপারটা নিয়ে কথাও তুলেনি। নিজের মনেই অনেকক্ষণ ধরে খচখচ করতে লাগল। তবুও সেধে জিজ্ঞেস করতে পারল না। তবে ভেবেছে করবে!

পাস্তার খাওয়ার পরেই দু কাপ চা। যদিও এটা মানায় না তবু দুজনে চা ঘোর। দুপুরে একটু চা না হলে জমে না। চা খেতে খেতে তন্ময় বলে উঠলো,

“কাল এলি না কেন?”

আচমকা প্রসঙ্গ টেনে ধরায় মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। একটু হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিল। শুকনো ঢোক গিলে বলল, “খালা অসুস্থ ছিল হঠাৎ খবর এলো তাকেই দেখতে গেছিলাম!”

“অসুস্থ? খালা এখন কেমন আছে? তাহলে ফোন ধরিস নি কেন? জানিস তুই আসছিলি না বলে মৌ কে কতো গুলো ফোন দিয়েছি। মৌ বলল তুই অনেক আগেই বেরিয়ে গেছিস!”

মৌ কেও কল করছিলি। মৌ বলল না তো! ওহ মৌয়ের সাথে দেখাই তো হয়নি। মনের দুঃখে কারো সাথে কথা বলিনি সে। তনয়া এবার প্রস্তুত হলো। লম্বা একটা শ্বাস টেনে ফরফর করে মিথ্যে বলতে লাগল,
“মৌ জানত না তো। আমি তো তোর সাথেই দেখা করব বলে বের হলাম। তখনি খালার ফোন। তাই সেখানে চলে গেছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ফোনের চার্জের শেষ। সেখানে চার্জার ও পেলাম। তারপর সেখান থেকে তবুও যা বের হলাম রাস্তায় দেখি লম্বা জ্যাম। ভেবেছিলাম সময়ের মধ্যে চলে আসব কিন্তু পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গেল!”

শেষের কথাটা অনেকটা আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলে উঠলো সে। তার কথা শুনতে শুনতে তন্ময়ের চায়ের কাপ শেষ হয়ে উঠল তনয়ার। কিন্তু এতো গুলো মিথ্যে কি তন্ময়ের কাছে গ্রহণযোগ্য! হ্যাঁ, তন্ময় বিশ্বাস করেছে! তনয়া সেখানে গিয়েছে শুনে বলে উঠলো, “তুই সত্যি এসেছিলি? ইশ, আমার আরেকটু অপেক্ষা করার ছিল তনু। সরি!”

“না না কি বলছিস। আমি আরো দেরি করে পৌঁছেছিলাম। যাই হোক সরি, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।”

তন্ময় তনয়ার চায়ের কাপ টেনে চুমুক দিয়ে বলল, “ব্যাপার না। বয়ফ্রেন্ডের একটু আধটু অপেক্ষা করতেই হয়!”

মূহূর্তের মধ্যেই তনয়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দেখা মিলল। এতোক্ষণের দুঃখী দুঃখী ভাবটা কেটে গেছে। অন্য দিকে তার মুখের হাসিও যেন উনার রা*গ কমাতে পারছে না। কি হিং*স্র চাহনি। যেন এখনি এসে গলা চে*পে ধরে। চোখ বুজে রাগ*টা সামলে নিল। সবকিছু তোলাই থাক তবে!

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩৪

ভালোবাসার দহ”নে পু”ড়ে ছারখার ব্যক্তিটির কাছে ভালোবাসার সঙ্গা চাইতে নেই।‌ এতে কেবল হৃদয়ের ব্য”থা বাড়ে, কোনো উপশম হয় না। ভালোবেসে না পাওয়ার কষ্ট একদিকে, অথচ ভালোবাসার মানুষটি তার সুপ্ত উষ্ণ হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা অপচয় করছে আরেক মানুষের দিকে। এর চেয়ে দুঃ”খের আর কিছু নেই। কখনো গরীব দুঃখী অস”হায় মানুষকে চেয়ে দেখেছো, যে একটি দামী পোশাকে আবৃত বাচ্চার হাতের রুটির দিকে বিস্মিত রূঢ় চোখে চেয়ে থাকে। বাচ্চাটি যখন রাগা*রাগি করে রুটিটা রাস্তায় ছুঁ*ড়ে ফেলে তখন অসহায় রুগ্ন ব্যক্তিটি ছুটে গিয়ে ধুলোবালিতে পড়ে থাকা রুটিটা নিয়ে আপ্রাণ গিলতে থাকে। তার কাছে জীবনের সুখ এখানে! জীবনের সুখের রঙ একেক রকম। একেক জনের সাদা পাতার জীবনে এই রঙ কখনো লাল কখনো কালো কখনো বা রংধনুর মতো রঙিন কিংবা ধূসর!

সেই অসহায় রূগণ ব্যক্তিটি রূপক অর্থে উষ্ণ চৌধুরী। তার ভালোবাসার চাহিদা দিন দিন ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। মাথা ঠি*ক থাকছে না ইদানিং। ওষুধ খেয়ে মন মস্তি*ষ্ক কন্ট্রো*ল করতে হয়। উষ্ণ মান*সিক রোগী। বিদেশে প্রায় অনেক বছর তার চিকিৎসা করা হয়েছে। এখন কিছুটা সেরেছে। রাগ হলেই মাথা ঠিক থাকে না। যা ই*চ্ছে করে ফেল*তে ইচ্ছে করছে। এই ভ*য়ংকর রোগটি পেয়েছে তার বাবা শেহনেওয়াজ জাওয়াদ চৌধুরী থেকে। উষাণ চৌধুরীর স্বভাব নিয়ে এখনো সন্দিহান। রাগে*র সময় এর মাথা ঠিক থাকে কিন্তু উষ্ণের থাকে না!

চেয়ে চেয়ে জেএস তার কাছে দুসপ্তাহ সময় চেয়েছে। এর মধ্যেই তনয়ার কাছ থেকে তন্ময়কে স*রিয়ে ফেলবে। কথা দিয়েছে জেএস। নিরুপায় উষ্ণ চৌধুরী সেই কথা বিশ্বাস করেছে। কারণ সে তার বাবার মতো ভুল করতে চায় না। একই পথে পা বাড়াতে চায় না। সবার সাথে জো*র করে ভালোবাসা হয় না। যেখানে তনয়ার মনে অন্যের জন্য ভালোবাসা একটু একটু করে বাড়তে গিয়ে আ*কাশচুম্বী হয়ে পড়েছে সেখানে তার ভালোবাসা নি*ছক নি*কোটিনের ধোঁয়ার মতো। এই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তনয়া সেই ভালোবাসা কখনো বুঝবে না। বুঝানোর একটাই মাধ্যম তন্ময় কে স*রিয়ে ফেলা।

সেটা করা উষ্ণ চৌধুরীর কাছে বিরাট ব্যাপার না। দুই আঙ্গু*লে টিপে মাছির মতো মে*রে ফেলাই যায়। কিন্তু ওই যে কথা, বাবার মতো একই ভুল সে করবে না। তনয়ার প্রতি তার ভালোবাসা হতে হবে স্বচ্ছ আর বিশুদ্ধ! এই ভালবাসায় যে দাগ সহ্য করা যাবে না। কোনো দাগ, অভিযোগ সইতে পারবে না। এই বিশুদ্ধ মনে তনয়াকে তাকে ভালোবাসতে হবে। হবেই হবে!

কিন্তু পৃথিবীর করুণ সত্য, তুমি যাকে পাগলের মতো হৃদয় দিয়ে ভালোবাসবে সে তোমার ভালোবাসা কখনো গ্রহণ করবে না। দু একজনের হয়তো হয়ে থাকে তবে সবার পক্ষে এই সত্য মানা সম্ভব না। আমরা সত্য থেকে পালা*তে ভালোবাসি, সত্য মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। উষ্ণের বিশুদ্ধ ভালোবাসা তনয়ার মনে আদৌও পৌঁছাবে কি-না তার ঠিক নেই। আবার তনয়ার ভালোবাসাও তন্ময়ের মনে আদৌও পৌঁছাবে কি-না তার ও ঠিক নেই। কারণ ভালোবাসার আদান প্রদান ঠিক অমাবস্যার রাতে চাঁদ হাতে পাবার মতো। অন্যের মনের খবর জানার মোক্ষম সুযোগ আমাদের নেই। অপর প্রান্ত আসলেও মন থেকে ভালোবাসছে নাকি ভা*ন ধরছে সেটা ধরা এতো সহজ নয়। যদি তাই হতো তবে ভালোবাসার মূল্য থাকত না। মুখে “ভালোবাসি” কথা বিশ্বাস করে যারা ভালোবেসেছে তারা বোকা! অথচ বোকারাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ!

দেখতে দেখতে ৬ দিন কেটেছে। এই ৬ দিন উষ্ণের জন্য ছিল এক নরকযন্ত্রণা। নরকের আগুনে যেন জ্ব*লে পু*ড়ে যাচ্ছিল তার পুরো দেহ। খল*সে পড়েছে চাম*ড়া। বার বার হৃদয় দহনে এখন যেন সব সয়ে যায়। তনয়ের থেকে দূরে থাকা অবস্থায় এতো ক*ষ্ট হয়নি কখনো! অফিসে কাজ কম কেবল তাদের উপর ২৪ ঘণ্টা নজর রাখা। জেনে বুঝে আগু*নে ঝাঁপ দেবার মতোই অবস্থা। নব্য কপোত কপোতীর সুখের নিশানা দেখে ক্ষণে ক্ষণে হৃৎক*ম্পন হতো। দেহের র*ক্ত চলাচল বা*ড়ত দ্রুত গতিতে। শ্বাস নিতে ক*ষ্ট হতো। মাথা যন্ত্রণা তো আছেই দীর্ঘ কালের বন্ধু। সে বুঝতে পারত সে অসু*স্থ হয়ে পড়ছে। খুব দ্রুত অসু*স্থ হয়ে যাবে। হৃদয়ে এই ব্যথার কোনো ঔষধ তার কাছে নেই। কারণ এর একটাই উপশম। সে হচ্ছে তনয়া! তার তনয়া! পুরো জীবনের এক মাত্র ভালোবাসা। জীবনের একমাত্র ভালোবাসা যাকে বলে। ক্ষণে ক্ষণে তনয়ার নাম জপ করে যায় কেবল। মস্তিষ্ক জানে সে তোমার না কিন্তু হৃদয় বুঝতে চায় না। সে তো পাগল, উন্মা*দের মতো চিৎ*কার করে কেবল তনয়াকে চায়। তখন বুকের বা পাশ টা চেপে ধরে। এতেও ব্য*থা কমে না। সব ভুলে ছুলে, মস্তিষ্ক কন্ট্রো*ল হা*রিয়ে নিজেকে আ*ঘাত করতে দ্বিধাবোধ করে না সে। তার ব্লেজার হাতার তলে সেই শত আ*ঘাত তার ভয়ং*কর ভালোবাসার প্রমাণ!

সেদিনের হাত কাটার ক্ষ*ত দ্রুত শুকি*য়ে গেছে। সে বোধহয় জানত এই হাতে আবারো আ*ঘাত আসবে। তাই দ্রুত সেরে উঠার প্রয়াস কর*ছিলো। কিন্তু ঠিকঠাক ভাবে সেরে উঠার আগেই আবার গাড়ির জানালার কাঁচের আঘা*তে ক্ষত*বিক্ষত হয়ে উঠেছে হাতটা। এক হাত শ*ক্ত করে চেপে ধরে অন্য হাতে ক্রমশ জানালার উপর ঘু*সি মারছি*লো উষ্ণ চৌধুরী। ফলাফল যা হবার তাই ঘটেছে। দীর্ঘ অনেকক্ষণ ঘুসি*র কারণে জানালা ভেঙ্গে*ছে। হাতে কাচে*র টুক*রো ভাসমান, র*ক্তে টুই*টম্বুর হাতটা। রক্তা*ক্ত হাতটা দেখে উষ্ণের জ্বা*লা মিলল। ভেতর থেকে বেরিয়ে হলো তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস। চোখ বুজে গাড়িতে হেলান দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চলছে। কয়েক পা দূরে দাঁড়ানো জেএস হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। তাকে মাটি আঁকড়ে ধরে আছে সর্বশক্তি দিয়ে। উষ্ণ স্যারের মাঝে বড় স্যারের ছায়া দেখে আঁত*কে উঠল সে। কি ভ*য়ংকর সেই ছায়া। দীর্ঘ কালো এক ছায়া! মানুষের চেয়ে উচ্চতায় কয়েকগুণ বড়। জেএস শুকনো ঢোক গিলল। গলা শুকিয়ে আসছে বার বার। হাত পা কাঁপ*ছে ধর*ধর। ভীষণ রকম ভ*য় পেলে মানুষ এরকমটি করে!

উষ্ণের এই আচমকা রাগের কারণ কি? তন্ময়ের প্রতি তনয়ার ভালোবাসা? সে তো কয়েক বছর ধরে দেখে আসছে। কিন্তু এতোটুকু ভেবে শান্তি পেতো ভালোবাসা এক তরফা। এর মাঝে কখনো সম্পর্ক হবেনা। তন্ময় কখনো তনয়াকে ছুঁয়ে দেখার আ*স্পর্ধা দেখাবে না।

কিন্তু আজ দেখিয়েছে। এই তো সবে মাত্র। উষ্ণ স্বচো*খে প্রমাণ পেয়েছে। তার হৃদয় ঘ*সে পরছে। মুখ থুব*ড়ে পড়েছে ভালোবাসা!

ভালোবাসার পরম পরশ চুম্বন। প্রিয় মানুষকে আঁকড়ে ধরে নির্লজ্জের মতো চুমু খাওয়ার ব্যাপারটা ভালোবাসায় প্রথম ধাপ বলা যায়। যেই আশা একমাত্র উষ্ণের! তনয়ার প্রথম ভালোবাসা কেবল সে হবে, তাকে প্রথম যে ছুঁয়ে সেই পুরুষ সেই হবে! সেখানে তন্ময়ের এই সা*হস তাকে রাগি*য়ে তুলেছে মাত্রা*রিক্ত! রাগে*র মাথা*য় নিজেকে শে*ষ করে দেবার কথা প্রথমে মাথায় আসে। অন্যকে মা*রা যতটা সহজ নিজেকে মা*রা ঠিক ততোটাই কঠিন!

কিন্তু স্বচোখে দেখলেও এর মাঝে যে খুঁত আছে। তখন প্রায় মধ্যরাত। ইদানিং তন্ময় আর তনয়ার ঘসাঘসির কারণ উষ্ণ স্যার ইচ্ছে করে তাদের কাজ দিয়ে অফিসে বসিয়ে রাখে। অফিসে যতক্ষণ থাকবে নজরে থাকবে। বাইরে গেলেই তো উল্টাপাল্টা কিছু! ভ*য় হয় সর্বক্ষণ!

যার কারণে দুজনে অনেকটা দেরি করেই অফিস থেকে বেরিয়েছে। এদের অফিস থেকে বের করেও শান্তি নেই। তন্ময় আগে বের হলে তনয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তনয়াও বের হয়ে তন্ময়ের জন্য দাঁড়াবে। উষ্ণ চৌধুরীর তো মাঝে মাঝে হিং*সে হয়, কেন যে সে তন্ময় হলো না। আচ্ছা একটিবারের জন্য সে তন্ময় হয়ে যেতে পারে না। কোনো কালেই কি সম্ভব না?

আজও তাই। দুজন অফিস শেষে বাইকে করে ফিরছে। রোজকার মতো তাদের ফলো করছে উষ্ণ চৌধুরী। তনয়া বাসায় না পৌঁছানো অবধি তার শান্তি নেই। কিন্তু আজ মাঝ পথেই বাইক থামিয়েছে তন্ময়। রাস্তার ধারে টং এর দোকানে চা খাবে । আবাসিক বাচ্চাদের পার্কে ছোট বেঞ্চের মাঝখানে বসে চা খাচ্ছে দুজন। পার্কের চারদিকে ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন আলো দুজনকে দেখা যাচ্ছে চমৎকার ভাবে। এদের কয়েক মিটার দূরেই উষ্ণ চৌধুরী পকেটে হাত দিয়ে দেখছে দুজনকে। তার উপস্থিতি অনেকটা হাওয়ার মতো। এই সুবাস পাওয়া যায় তো এই নেই। উষ্ণ চৌধুরীর উপস্থিতি নিয়ে আদৌও তনয়ার কোনো হুঁশ নেই। থাকার কথাও নয়। নির্জন রাত দুপুরে গা ঘেঁষে বসে দুজনে চা খাচ্ছে। এর চেয়ে রোমাঞ্চকর আর কি আছে?

তন্ময়ের কাছ থেকে আসা তার অনুভূতির জাগান দিচ্ছে, তার থেকে সুঘ্রাণে নিজেকে মাতোয়ারা করে তুলছে। যতখানি প্রেমে*ডুবু সে খাচ্ছে ততোখানি তন্ময় ডুব দিয়েছে কি না সন্দেহ। তবে তারও অনুভূতি হচ্ছে। এই যে একটু বাদে বাদে শরীরের লোমকূপ আচমকা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা কোনো হাওয়া নেই তবুও শরীরের এই শিহরণ! কেন? পাশে তনয়া? কখনো কি ভেবেছে তনয়ার প্রতি এই আবেগ জন্মাবে! অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত ঘটনার সাক্ষী হয়ে চমকে উঠেছে সে।

চায়ের কাপ শেষ সেই কবে! ওয়ান টাইম কাপ হাতে দুজনে বসে আছে। নিরবতায় ঘিরে আছে দুজন। এই নিরবতা উষ্ণ চৌধুরী হৃদয়ে উথা*ল পাতা*ল শুরু করে দিয়েছে। যা ভাবছে তাই কি? ওরা কি কাছাকাছি আসছে?

হ্যাঁ আসছে! তনয়া লজ্জা লজ্জা চাহনি তন্ময় কে ডাকছে। অথচ তনয়া ওর চোখে চোখ রেখেও তাকায়নি। কি অদ্ভুত হৃদয়*ঙ্গম! তন্ময় খানিকটা তার কাছে এগিয়ে এসেছে। টের পেয়ে তনয়া ও চেয়ে তাকাল। সে দূরে ছিটকে যায়নি। যৌবনের সেই পর্যায়ে আছে সে। ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে, দূরে ফেলে দিতে নয়। জীবনের ২৫ বছর নিসঙ্গতা কাটানোর পর এখন কাউকে কাছে চাওয়া ভুলের কিছু তো নেই। সে আগায়নি আবার দূরেও চলে যায়নি। এসব কি সম্মতির লক্ষণ।

তন্ময় সেই ভেবেই আগালো। তার হাত কাঁপছে! কাঁপা কাঁপা হাত তনয়ার গালে হাত রাখতেই তনয়া চোখ বুজে নিল। জীবনে তরী বাদে এই প্রথম কোনো রমণীর কাছে যাচ্ছে সে। যতই কাছে আগাচ্ছে ততোই তরীর মুখটা মানসপটে ভেসে উঠছে।

তখন দুজনের মাঝে কেবল কয়েক সেন্টিমিটারের দূরত্ব। উষ্ণ চৌধুরী আর দাঁড়াতে না পেরে চলে গেছে নিজেকে ক্ষত*বিক্ষত করতে। অন্যদিকে তন্ময় সেখানেই থমকে গেছে। সে আর আগাতে পারছে না। কোনো এক অদৃশ্য বাঁধায় যেন বাঁধা পড়ে গেছে। কেউ একজন তো আটকে ধরে রেখেছেই। আগের অনুভুতি আর এখন আসছে। এখন আর কোনো আবেগ কাছে টানছে না। বি*তৃষ্ণা এসে পড়ছে যেন। মুখটা তে”তো হয়ে উঠছে।

অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখা তনয়া এবার চোখ মেলে তাকাল। তন্ময়কে এক জায়গায় আটকে থাকতে দেখে তার মনেও আশং”কা দানা বুনছে। নিজেই একটু দূরে সরে গেল। তন্ময় স্তব্ধ! এই পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিবে?

তনয়া ম্লান হেসে বলল, “আমরা বোধহয় বড্ড তাড়াহুড়ো করছি, আরেকটু অপেক্ষা করা দরকার!”

তন্ময় দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ তাই! এতোদিনের বান্ধবীকে চুমু খেতে একটু অ*স্বস্তি লাগছে। আরেকটু সময় লাগবে!”

এক নিঃশ্বাসে এতোখানি কথা বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। তনয়া হেসে ফেলল চট করে। তন্ময় ও হাসল। মেয়েটা চমৎকার! কি দারুণ ভাবে পরিস্থিতি সামলে দিল! অথচ এসব অগত্যা থেকে গেল কেবল একজনের কাছেই!

#চলমান