তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
15

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩৫

আজ শুক্রবার! বন্ধের দিন হিসেবে আরামের বিছানায় বেলা করে ঘুমানোর বদলে অফিসের চেয়ারে শরীর টান টান করে বসে থাকতে থাকতে কোমর ধরে যাচ্ছে তনয়ার। ঠোঁট দুটো চেপে রেখে স্যারের কেবিনের দিকে অ*গ্নি দৃ*ষ্টি নিক্ষেপ করল। এই দৃষ্টিতে স্যার জ্বলে*পুড়ে গেলে শান্তি পেতেন মহারাণী। সপ্তাহের ৬ টা জ্বা*লিয়ে তিনি শান্তি পান না এখন বন্ধের দিনেও ঘাড়টা ধরে কাজে বসিয়ে দিয়েছে। মাথা ব্যথা এখন শরীর ব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরম চায়ের দুই কাপ কোনো উপকার করতে পারেনি। স্যারের মাথা চিবি*য়ে খেলে শরীরের জ্বা*লা বুঝি কমত!

অফিসের কাজের চাপ আহামরি কিছু না। তাই বন্ধের দিনেও কাজের চাপ অন্যরা সইতে পারছে না। তনয়ার মতো বাকি সবার মেজাজই তিরি*ক্ষি। কোথায় ভেবেছিলো বন্ধের দিনটা আরামে ঘুমিয়ে কিংবা ফোন ঘেঁটে কাটিয়ে দিবে। কেউ কেউ বিকেলে সেজেগুজে বেরুবে প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করতে। সবকিছুতে উষ্ণ স্যার নামক জল্লাদ এক বালতি পানি ঢেলে দিল। প্রিয় মানুষের সাথে ঘুরে বেড়ানোর দলে তনয়া আর তন্ময় ও ছিল!

তারা ছিল বলেই অফিস শুদ্ধ সকল লোককে বন্ধের দিনে কাজ করার হুকুম তামিল করেছে উষ্ণ চৌধুরী। মনে ভয়ে*র আশংকা, এরা দুজন একসাথে থাকলেই বিপ*দ। বিপদে*র প্রথম পর্যায় পেরিয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে কোনোভাবেই যেতে দেওয়া যাবে না। রা*গে তার মেজাজ ও গর*ম হয়ে যাচ্ছে। শা*লা জেএসের জন্য এতো ক*ষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। রক্ত*শূন্য মুখে হাসি ফুটল হুট করে। দেওয়ালের আড়ালের ওপাশ থেকে তার রাগিনী রঙি*ন মুখখানা তার অধরপুটে এক অনন্য হাসির রেখা টানল। উষ্ণের মনে প্রবাহিত স্রোতের ঠান্ডা মিষ্টি সুবাস যেন দেহের আস্ত*রণ ভেদ করে সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে।

অফ ডে তে অফিসের ফরমাল গেটাপে আজ আসেনি সে। সকলের মতোই ক্যাজুয়াল পোশাকে বের হয়েছে। ধূসর রঙা এক শার্ট আর জিন্স প্যান্টে তাকে আকর্ষণীয় লাগছে। সেই সাথে শার্ট ইন করে হাতা কনুই অবধি ফ্লোট করতে করতে অফিসে প্রবেশের সময় সকল রমনীর মনের ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল সে। যেসব রমণী খানিকক্ষণ আগেই রে*গে পুড়ে যাচ্ছিল তারাই তখন স্যারকে দেখে খুশিতে হাততালি দিচ্ছিল। পেটে যেন মেঘের গুরুগুরু শব্দ শোনা যাচ্ছে। স্যার কে টিটকিরি মার*তেও ছাড়ল না কয়েকজন। তনয়ার মেজাজ খারা*প হয় আরোও। এই ভাদাইম্যার প্রতি এতো মেয়ের প্রেম নিবেদনের কারণ আদৌও খুঁজে পায় না সে। তাই তো আড়চোখে ফিরে চায়। এতোই কি সুদর্শন লাগছে!

চোখে কালো রোদচশমা, হাতে উজ্জ্বল করছে ব্র্যান্ডের ঘড়ি! লোকটা শো অফ করতে একদম ওস্তাদ। সুদর্শন! হ্যাঁ ওই ১০ এ ৮ দিলে মন্দ হয় না, না না তার সাথে বাদমারি করার কারণে আরো এক কেটে নিল। ৭ দিল! মনটা খারাপ হয়ে গেল আচমকা। ৭ তার খুব প্রিয় সংখ্যা। অপ্রিয় মানুষকে প্রিয় সংখ্যা দেওয়া যায় না। ঘুরে ফিরে আবারো ৮ এ নামল। মনে যখন এসব অংক কষছিল তখনি খেয়াল করল তার হাতের সাদা ব্যান্ডেজ। তনয়া অবাক হলো, কিছুদিন ধরেই হাতে ব্যান্ডেজ দেখতে পাচ্ছে। এই লোক কি রোজ মার*পিট করে নাকি? গু*ন্ডা একটা! হুহ! মুখ ভেংচি কেটে চোখ ফিরিয়ে নিল। এতোক্ষণ ধরে কাউকে দেখা যায় নাকি আবার!

কাউকে ভালো লাগা ইজ নরমাল। আজকাল ক্রাশ খাওয়া দুধ ভাত হয়ে গেছে। সবাই খেতে পারে। দ্রুত হজম করে আবার আরেক প্লেট ও খেয়ে নেয়। নতুন ক্রাশ খাওয়ার মতো। তনয়া আবার সেদিক থেকে নয়। পর পুরুষের প্রতি তার আকৃষ্ট বরাবরই কম। এতিম মেয়ে আগে পিছে কেউ নেই বলে খুব কম বয়সেই ম্যাচিউরিটির খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছিল। ওসব দুরন্তপনা, উড়নচণ্ডী স্বভাব কখনোই ছিলো না। আহ্লাদী ও ছিলো না। যতটুকু করতো তন্ময়ের সামনে কারণ তন্ময় মেনে নিত। সবাই তো আর মানতে পারবে না। এই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে। মুখ কালো করে ফেলবে। ওসব কালো মুখ দেখতে ভালো লাগে না!

ভাবনার সুতোয় টান পড়ল ফোনের আওয়াজে। খালার ফোন! আজ নিয়ে দুবার ফোন। ভীষণ অসুস্থ! বার বার আক্ষেপ করছে একটিবার তাকে দেখার জন্য। তনয়া ফোন হাতে মুখ ভার করে রইলো। খালাকে কে বুঝাবে, তাদের অফিসের জল্লাদ বস তাদের ছুটির বদলে বাঁশ হাতে ধরিয়ে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে। অসুস্থ মানুষ কি পরিস্থিতি বুঝে, তারা অজুহাত মনে করে বসে থাকে। মিথ্যে কিছু মাথায় আসছে না বলে তনয়া ফোনটাও ধরল না। মুখ ভার হয়ে গেল আরো খানিকটা। চেয়ার থেকে আচমকা উঠে মার্কেটিং টিমের দিকে আগালো। তন্ময়ের মুখদর্শন করেই না হয় দিনটা ভালো করা যাক!

অধরপুটে থাকা মৃদু হাসিটা যেন মলিন হয়ে গেল। ঘুরে ফিরে দাঁড়িয়ে ফেরত এলো চেয়ারের কাছে। হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে পড়ল সে!

ওদিকে তনয়া চেয়ার ছেড়ে উঠার সাথে সাথেই মিতু নামের এক মেয়েও উঠে পড়ল। তনয়ার পথ অনুসরণ করে পিছু নিল। মার্কেটিং টিমের দিকে তনয়াকে এগিয়েছে যেতেই দু দণ্ড দাঁড়াল। স্থির নয়নে কিছুক্ষণ তাদের পরখ করল। অতঃপর তনয়া ফিরে আসার আগেই গায়েব হয়ে গেল। কেউ দেখতে পেলো না মিতুকে। মিতু বড় চালাক মেয়ে!

গায়েব হয়ে যেখানে গেলো সেখান থেকে কল করল একজনকে। ওপাশে ব্যক্তির বলা কথায় কেবল জবাব দিতে লাগল,

“হ্যাঁ ম্যাডাম, তনয়ার প্রেম চলছে তন্ময়ের সাথে। আমি ১০০% শিউর ওরা প্রেম করছে। আচ্ছা ম্যাডাম আমি আরো খোঁজ নিচ্ছি। তবে মত বদলাবে বলে মনে হয় না!”

ফোন কেটে দাঁতে দাঁত চেপে কতো গুলো অ*শ্রাব্য গালি দিল ওপাশের ব্যক্তিকে। সাথে দিল তনয়া কে। কি আছে এমন মেয়েটার মাঝে? সবাই যেন চোখে হারায়। আগে কথায় কথায় বড় স্যার তার প্রশংসা করত, ম্যানেজার সাহেব এখনো তাকে তোল্লাই দিছে, নতুন বসের তো যেন ফুসরত নেই। একটু বাদে বাদেই ডাক পড়ে। এরপর অফিসের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটাকে পটিয়ে নিল। ইশ! তন্ময় দেখতে কতোই না হ্যান্ডসাম! তনয়ার উপর একরাশ রাগ জমানো কথাগুলো বলেই কতো গুলো গা*লি দিয়ে বসল। চেহারায় ফুটে উঠছে তার জন্য ঈর্ষা! সবকিছুতে তনয়াই কেন? এখনো তনয়ার খবর দিতে পারলে লাখ লাখ টাকা পাবে। মিতু বুঝতে পারে না, কি আছে এই তনয়ার মাঝে। ইচ্ছে তো করে সিঁড়ি থেকে ধা*ক্কা মে*রে ফেলে দিতে। বলেই মিটিমিটি হাসল মিতু।

“কোনো একদিন সুযোগ পেলে ওই তনয়া কে টু*প করে সিঁ*ড়ি থেকে নিচে ফে*লে দিব। সিঁড়ির থেকে ও গড়ি*য়ে পড়বে, সাথে গড়িয়ে পড়*বে ওর দম্ভ। এই তনয়ার জন্যই আমার প্রমোশন আটকে গেছে। নয়তো কবেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে যেতাম! ধ্যাত!”

অভিমান মুখে নিচে দিকে তাকাল। সে এখন অফিসের শেষ কোনে সিঁড়ির মাথায়। অফিসের সবাই লিফট ব্যবহার করে বলে সিঁড়ির কাছে কারো এতো যাওয়া আসা নেই। অফিসের সিঁড়ি গুলোয় সাপের মতো পেঁচানো। এই সাত তলা থেকে ফে*লে দিলে নিচতলা গিয়ে মাথা ঢুক*বে। বেঁচে থাকার চা*ন্স কয়েক পার্সেন্ট মাত্র! ভাবতেই পৈশা*চিক হাসির দেখা মিলল চোখে মুখে। মানুষ কি ভয়ং*কর জীব!

মিতু একাই ভয়ংক*র নয়, তার চেয়েও ভয়*ঙ্কর নেশায় আসক্ত আরেকজন। মিতু হাসি শেষ হওয়া মাত্রই পিছন ঘুরল সে। পিছনের অনাকা*ঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে দেখেই তার হৃদয় থ*মকে গেল। হকচকিয়ে উঠল। বিস্ফো*রিত দৃষ্টি দুটো যেন তাকে ঝল*সে দেয়। মিতু অস্ফুট স্বরে কিছু বলার আগেই শক্ত পেশিবহুল হাতে তাকে জোরে ধা*ক্কা মে*রে ফেলে দিল সে। হাতের সদ্য কেনা স্মার্ট ফোনটা ভে*ঙ্গে চুর*মার হয়ে গেল। সাথে সাথে চুর*মার হয়ে গেল নরম দেহ*টা। র*ক্তে রাঙি*য়ে গেল প্রতিটা সিঁড়ি। মিতু মূ*র্ছা গেছে আরো আগেই, ছিন্ন*ভিন্ন হয়ে গেছে তার পুরো শরীর। দ্রুতই র*ক্ত প্রবাহ তার শরীর ছে*ড়ে সাদা ঝকঝকে মেঝের উপর দারুণ কারুকার্য করতে আরম্ভ করল।

উপর থেকে তার নিথ*র দেহ দেখে একজন হাসল কিঞ্চিত। তার হাসি সাধারণ নয়। এই বাঁকানো হাসি দেখলে যেকোনো মানুষের শরীর শি*উরে উঠবে। ভয়ংক*র হাসিটা যেন বরাবরই ঠোঁটে লেগে থাকে। রেলিং উপর হাত দুটো ছড়িয়ে পৈশা*চিক হাসি দিয়ে উঠল উষ্ণ চৌধুরী। দাঁতে দাঁত চে*পে বলে উঠল, “এখন দেখলে তো সিঁড়ি থেকে পড়ে যেতে কেমন লাগে, সত্যিই বাঁ*চার কোনো চান্স থাকে না। তোমারও নেই!” বলেই আরেক দফা মিষ্টি হাসি দিল।

সিসিটিভি ক্যামেরায় জেএস নির্বাক নয়নে পুরো ঘটনার সা*ক্ষী হলো। কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক থাকলেও পরক্ষণেই দ্রুত হাত চালালো। সিসিটিভির ফুটেজই গায়েব করে দিল মিনিটের মধ্যে। কাজ শেষে মুখ খুলে নিঃশ্বাস ফেলল সে। মিতু মেয়েটা এখনো মা*রা যায়নি তবে বাঁচবে কি না তারও ঠিক নেই। কদিন মৃ*ত্যুর সাথে লড়বে তাও জানা নেই। জেএস আফসোসের সুরে বলতে লাগল, “তুমি ভয়ংকর অ*ন্যায় করে ফেলেছো মিতু, তনয়া ম্যাডামের উপর নজর রাখা তোমার উচিত হয়নি। একদমই না। স্যারের শ*কুনের মতো চোখ ফাঁকি দিয়ে তুমি এতো বড় কাজ করবে তা ভাবলে কি করে? বেহুদা এসবে জড়িয়ে নিজের প্রাণ*টা নিয়ে পড়েছো!” আবারো ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস!

——–

ইরিশা জামান বেশ অনেকক্ষণ মিতুর ফোনে ট্রাই করে পাচ্ছে না। মেজাজ দ্রুতই বিগ*ড়ে যায় মেয়েটার। এতো ছোট কাজটা সারতে পারে না। তনয়ার উপর নজর রাখা এতোই কি কঠিন কাজ? বিড়বিড় করেই বলেছিল কথাটা। তবুও উষাণ শুনে ফেলল কথাটা। কথাটা শুনে গাল বাঁকিয়ে হাসল। তার হাসিও অবিকল উষ্ণ চৌধুরীর মতো। যতই হোক ভাই তো, মা আলাদা হলে কি হবে? বাপ তো একটাই। রক্ত তো আর আলাদা নয়।

ইরিশা জামান এবার রে*গে গিয়ে বলে উঠলেন,

“তুমি ঠিক তো উষাণ! আমরা ঠিক পথেই আগাচ্ছি।”

“আলবাদ। তনয়ার উপর নজর রাখলেই সব আগাগোড়া খবর বেরিয়ে যাবে।”

ইরিশা ধপ করে ফোনটা রেখে বলল, “জানি না কি বলছো? তনয়া কে আমার আহামরি কিছু লাগে না। সাধারণ একটা মেয়ে, প্রেম করছে বন্ধুর সাথে। এদের উপর নজর রাখার কি হলো? ও তো অন্যের সাথে প্রেম করছে তাই না।”

“সবসময় আমরা চোখে যা দেখি তা সত্য হয়না ইরিশা জামান। কথাটা কি ভুলে গেছো।”

“ভুলে যায়নি। তোমার কথামতোই আগাচ্ছি। কিন্তু কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। বাই দা ওয়ে, তুমিও তোমার ভাইয়ের মতো আমাকে ঠকাচ্ছো না তো উষাণ। যদি তা হয় তাহলে সাব*ধান। এই ইরিশা জামান কে তুমি চেনো না।”

উষাণ দাঁত একপাটি কেলিয়ে বলল,
“চিনি! আমার মামাতো বোন তুমি। ভাই হই, চিন্তা করো না। ঠ*কাবো না।”

“ছাই হও। ওহ, এই মেয়েটাও না। ফর গড সেক মিতু ফোনটা তুলো। কি আশ্চর্য! ফোনটা বন্ধ করে কোথায় লুকালো!”

উষাণ আশ্চর্য গলায় বলল, “ফোন বন্ধ!”

“হ্যাঁ, অনেকক্ষণ যাবত।”

উষাণ তৎক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। থমথমে গলায় বলে উঠলো, “ইরিশা, মনে হচ্ছে মিতু ধরা পড়ে গেছে। তুমি তার থেকে কোনো খবর পাবে না।”

ইরিশা বিরক্ত হয়ে বলল, “কি আশ্চর্য! কি বলছো এসব।”

“ঠিক বলছি। খোঁজ নিয়ে দেখো মেয়েটা বেঁ*চে আছে কি না। তোমাকে কতোবার বলেছি ভালো কাউকে দিয়ে খোঁজ করাও। কথাই শুনতে চাও না। বেহু*দা একটা মেয়ের জা*ন গেলো।”

উষাণের কথা বোধগম্য হচ্ছে না ইরিশার কাছে। সে উল্টো আরো *বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। চোখ মুখ কুঁচকে বলল, “পাগল হলে। তনয়ার খোঁজ করাচ্ছি কেবল। এতে মিতুর কি হবে? উষ্ণকে তো আর চোখে চোখে রাখতে বলি নি। সামান্য একটা মেয়ের কারণে…

“ও সামান্য নয়। আমি কতোবার তোমায় বলব তনয়া সামান্য কেউ নয়। ভাইয়ের কাছে ও বিশেষ কেউ। শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী এভাবেই এতো বছর পর হঠাৎ করে বিদেশ থেকে ফেরত আসেনি। একটা কাজে এসেছে। তোমাকে বিয়ের আস*র থেকে ফেলে তো আর এভাবেই চলে যায়…

কথা শেষ করার আগেই সটাং এক চ*ড় পড়ল উষাণের গালে। ইরিশা দাঁত নিশপিশ করে বলল, “যাস্ট শাট আপ। আমার হাতে মর*তে না চাইলে চুপ থাকো।”

উষাণ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে আচমকা হেসে উঠল। বলে উঠলো, “সাবধানে থেকো, এরপর তোমার পালাও হতে পারে। শকু*নের চোখ একবার পড়লে রক্ষে থাকে না কিন্তু ইরিশা।”

ইরিশা উঁচু জুতোর ঠকঠক শব্দ করে দরজা খুলে বলল, “গেট আউট!”

উষাণ মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বের হয়ে গেল। সে বের হতেই ইরিশা ধপ করে দরজা বন্ধ দিল। দুই হাতে শক্ত করে চুলগুলো চে*পে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রেখে বিরবির করতে লাগল, “বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার বিশ্বাস হচ্ছে ওই এতোটুকু মেয়ের কাছে আমি হে*রে গেলাম। সামান্য তনয়ার কাছে। কি এমন আছে মেয়েটার মাঝে, কিসের জন্য উষ্ণ চৌধুরী আমাকে বিয়ের আসরে রেখে পালিয়ে গেল। সামান্য এই মেয়ের কারণে! তনয়ার কারণে!”

তনয়ার নাম বার বার নিতে নিতেই হকচকিয়ে উঠল সে। ভাবতেই পারছে না। কি করে? এসব সম্ভব কি করে? উষ্ণ শেষে কি না তনয়ার প্রেমে মত্ত। এমন সাধারণ এক মেয়ের প্রেমে! নিজেকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল সে। ডাক্তার বলেছে স্ট্রে*স একদম নিতে না অথচ যতবার তনয়ার কথা ভাবছে ততোই যেন মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। র*ক্ত চলাচল বাড়ছে। সে কি স্ট্রো*ক করবে নাকি? চেয়ারে বসে পড়ল ধপ করে। গ্লাসের পানি এক চুমুকে শেষ করে টেবিলে মাথা রাখলো । শান্ত হওয়া দরকার। দাবা খেলতে হয় ঠান্ডা মাথায়। রেগে গিয়ে এক চাল দিলেই প্রতিপক্ষ কেল্লাফতে করে ফেলবে। অগত্যা ইরিশা জামান এখন ঠান্ডা হবার চেষ্টা করছে। নাহলে তার সূক্ষ্ম চাল দিতে ব্যর্থ হবে সে। আগেরবারের মতোই ব্যর্থ!

————-

আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। রাত বেরাতে এমন বৃষ্টি দেখে তনয়ার রাগ সপ্তম আসমানে। এখন দাঁড়িয়ে অফিসের পার্কিং লটে। এই তো অফিসের কাজ শেষ করল মাত্র। ভেবেছিল হাওয়ায় গতিতে তন্ময়ের বাইকে তার সাথে ফেরত চলে যাবে। তার পিঠের সাথে লেপ্টে থাকবে সে। ঘ্রাণ নিবে গায়ের। সেই অনুভূতিতে এক বালতি জল ঢেলে দিল এই বৃষ্টি। এই সেই বৃষ্টি তো নয় যেন আকাশ ভেঙ্গে মাটিতে আছড়ে পড়ে। কি আশ্চর্য! এই মূহুর্তে বৃষ্টির কি দরকার ছিল?

বৃষ্টি তনয়ার অপছন্দ কিছু নয় কিন্তু আজ তার মোটেই বৃষ্টি ভালো লাগছে না। এর কারণ তন্ময়! গত দু দিনের গরমে ছেলেটার সর্দি লেগে গেছে। আজকের বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর তো আসবেই আসবে। এর মধ্যে এতো রাত, ছাতাও নেই, এখানেই বা কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে কাটাবে তারা। কখনই বা শেষ হবে বৃষ্টি!

মাথাটা একটু বাইরে এনে বৃষ্টির তোপ দেখতে লাগল। ইশ! গরমের উপর রাগ করে জেদ ঢালছে তাদের উপর। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা দানা কয়েক মুখের উপর এসে আঁচড়ে পড়ল। তনয়া চোখ বন্ধ করে নিল। জিহ্ব বের করল সামান্য। বৃষ্টির পানি তার পছন্দ কি না।

বৃষ্টির পানি আর অনুভব না করায় চোখ মেলে তাকাল। দেখল তার মাথার উপর একটা ছাতা ধরা। পুরোপুরি হলুদ না তবে হলুদের মতোই ছাতার মাঝে কালো দাগকাটা চেক। দামী ছাতা! দেখেই একজনের নাম মাথায় এলো। চোখ মুখ কুঁচকে পাশে ফিরে তাকাল। উষ্ণ স্যার কে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখটা মলিন হয়ে উঠল তার। একটু লজ্জাও পেল। খানিকক্ষণ আগে নিজের বাচ্চামো স্যার দেখে ফেলল নাকি আবার?

উষ্ণ হালকা কাশল। এরই মাঝে বজ্রপাতের ধরাম আওয়াজে তনয়া কেঁপে উঠল। চোখ মুখ বন্ধ করে নিজের জায়গায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। উষ্ণ তার বদ্ধ মুখের পানে কিয়ৎকাল চেয়ে থেকে একটু কাছে এসে দাঁড়াল। তনয়া চোখ মেলে তাকিয়ে পাশের উষ্ণ স্যারকে দেখে চোখ পাকাল। মুখ ফুলিয়ে বলল,

“আপনি এখানে?”

“বৃষ্টির টেস্ট কেমন?”

তনয়া মুখ ভেংচি কেটে চোখ সরিয়ে ফেলল। লোকটা ঠিক দেখে ফেলেছে। শকু*নের চোখ বলে কথা। আড়চোখে আবার ফিরে তাকাল। স্যারের চুলগুলো ছোট করে ফেলায় একটু অন্যরকম লাগছে। এই অন্যরকম মানে কি? সুদর্শন নাকি? মনে মনেই কয়েকবার তওবা পড়ে নিল সে। না না, তার তো বিএফ আছে তাই না।

উষ্ণ মৃদু হেসে বলল, “আমার চোখে চোখ রেখেই তো আমায় দেখতে পারো।”

তনয়া হকচকিয়ে বলল, “কি বললেন?”

“বললাম, আমি তো তোমায় আর খেয়ে ফেলছি না। আর এছাড়াও ভালো জিনিস দেখতে ক্ষতি নেই। এই ফাঁকে আমিও তোমায় একটু দেখে নিলাম!”

বলেই চোখ টিপ মারল। তনয়া চোখ মুখ কুঁচকে নিল। চুল কেটে ফেললে কি হবে? ভাদাই*ম্যার স্যারের ভা*দাইম্যা গিরি আর কমবে না। হুঁ আস্তা ভাদাইম্যা। উষ্ণ হেসে বলল,

“আমায় এতো গালিগালা*জ করো না।”

নিজের মনের কথা স্যার জেনে ফেলায় আশ্চর্য হলো সে। সামলে উঠে বলল, “আমি গালি দিই না।”

“তাহলে ওই যে ভাদাইম্যা না কি যেন বলো ওটা কেন বলো? ভালোবেসে ডাকো বুঝি!”

তনয়া এদিক ফিরে রুদ্রমূ*র্তি ধারণ করল। উষ্ণ দাঁত বের করে হেসে বলল, “কথায় কথায় এতো রে*গে কেন যাও।”

“এখানে কি চাই?”

“তোমাকে!”

কথাটা শেষ করতেই আচমকা মেঘ গ*র্জে উঠল। বজ্র*পাতের তীব্র আওয়াজে আলগোছে তনয়া দুই আঙুল আঁকড়ে ধরল উষ্ণের শার্টটা। উষ্ণ সেখানে দৃষ্টিপাত করে বিরবির করল, এই দুই আঙুলের‌ সমান পরিমাণ ভালোবাসলেও আমি তোমাকে আকাশসম ভালোবাসব তনয়া। আমার ভালোবাসা বজ্রপা*তের মতোই ক”ঠোর হবে। তার বৃষ্টি ফোঁটা হয়ে ঝরবে তুমি। মেঘের গুরুগুরু শব্দ, এই ঠান্ডা হাওয়া তোমার আমার ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকবে। এমনটা কি হতে পারে না তনয়া?” অতঃপর দৃষ্টি সামনে রাখল। কারণ তনয়া হাতটা ছেড়ে দিয়েছে। ছাতাটা হুট করে তনয়ার হাতে দিয়ে বলল, “সাবধানে যাও!”

বলেই বৃষ্টির মাঝে হারিয়ে গেল। তনয়া ছাতা হাতে বেরিয়েও তাকে খুঁজে পেলো না। সেকেন্ডের মধ্যে লোকটা গেলো কোথায়? আরো একবার খোঁজ করার আগেই তন্ময় ছুটে এলো। তনয়ার আর খোঁজা হলো না লোকটাকে। ছাতা আঁকড়ে ধরে তন্ময়ের বাইকে চড়েই বিদায় নিল সে!

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩৬

১৯ দিন! গুনে গুনে তন্ময় আর তনয়ার সম্পর্কের ১৯ টি দিন। এই উনিশ দিনের প্রতিটি প্রহরে কতোটা অস*হনীয় মান*সিক যন্ত্র*ণায় মধ্যে বেঁচে আছে তা বলার মতো নয়। মন তো অবুঝ! ব্যথা*তুর হৃদয় কিছু বুঝতে চায় না। অতিরিক্ত ভালোবেসে ভালোবাসা বোঝাতে ব্যর্থ হবার অক্ষ*মতার মতো অভি*শপ্ত আর কিছু নেই। কারো জীবন দুর্বি*ষহ করতে চাইলে তার ভালোবাসাকে অভি*শপ্ত করে দাও। তাহলে বেঁ*চে থাকতে থাকতে তার জীবনটা মরুভূ*মির মতোই নি*ষ্প্রাণ আর শূন্য হয়ে যায়।

তৃতীয় শুক্রবার! প্রথম শুক্রবারের কথা মনে আছে, দ্বিতীয় শুক্রবার তো গেলো জলে জলে। ডানে ডানে তিন ডান। কথাটা তনয়া যেন আজ খুব বিশ্বাস করছে। মনে মনে খুঁত ধরেছে, স্যার আজও নির্ঘাত কিছু করবে। অফ ডে, অফিস ছুটি। এই সুযোগে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা রিক্সায় চড়ে শহর ঘুরবে। ঢাকা শহরে প্রেম করবে আর রিক্সায় করবে না এতো যেন পানি ছাড়া পানি ভাতের মতো। হয় কখনো?

প্রেম করেও শান্তি নেই। স্যারের ভয়ে চব্বিশ ঘণ্টা কাটাতে হয়। তনয়া আজ ভেবেই নিয়েছে। এরপর স্যার বাড়াবাড়ি করলে চাকরিটাই ছেড়ে দিবে। করা লাগবে না এসব চাকরি! টাকার বিশেষ অভাব নেই। নতুন চাকরি খুঁজতে সময় লাগবে কিন্তু চাকরি ঠিকই খুঁজে পাওয়া যাবে। অসম্ভব কিছু নয়। ততোদিন জমানো টাকায় দিব্যি চলে যাবে। তনয়ার তো আর পিছুটান কিছু নেই।

দুপুরের দিকে আজও বেড়িয়েছে। শাড়ি পড়েছিল। মৌ যত্ন নিয়ে শাড়ির প্রতিটা কুঁচি ঠিক করে দিয়েছে। আঁচলে ভাঁজ করে টানটান করে সেফটিপিন আঁটকে দেবার পর চোখে গাঢ় কাজল টেনেছে। চুলগুলো শক্ত করে খোঁপা বেঁধে সুগন্ধি গায়ে মেখে বের হতে যাবার সময় মৌ বলে উঠলো,

“ছাতাটা নিয়ে যাও, মনে হয় বৃষ্টি আসবে!”

তনয়া ছাতার দিকে তাকাল। দুদিন আগে স্যারের ছাতাটা এনেছিল, না ওটা স্যারই সেধে দিয়েছিল। স্যারকে ফেরত দেওয়া হয়নি। দিবে কি করে? দুদিনের অতিরিক্ত গরমে সিদ্ধ হবার জো, ছাতার কথা মনেই ছিল না। আজ আবার মেঘ করেছে। তনয়া ঠিক টের পাচ্ছে, প্রকৃতি তার সাথে দু*শমনি করছে। তা না হলে সবসময় কেন এমনটা হবে। আজই মেঘ করতে হলো। বৃষ্টি হলে হোক, ঠান্ডা পানির তলে ভিজবে দুজন, আদলে পড়বে বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা, আবেগ ছুঁয়ে দেখবে বৃষ্টির পরশ। তাই তো এতো সাহস নিয়ে বেরিয়েছে।

ঝুলন্ত ছাতাগুলো থেকে নিজের ছাতাটা বেছে নিতেই মৌ সেধে বলল, “এটা নাও, এটা তো অনেক সুন্দর!”

তনয়া মাথা দুলিয়ে না করে, ছাতা ব্যাগে রাখল। বিরবির করে বলল, “তন্ময়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। মাঝে উনাকে নিয়ে কি করব। উনি না হোক, ওনার জিনিস তো। একই হলো।”

————

তন্ময় বাসার নিচেই ছিল। তনয়া কাছে আসতেই ফিরে চাইল তার পানে। নীল রঙের শাড়িতে অপরূপা লাগছে। কিঞ্চিত সময়ের জন্য হলেও তন্ময় ঘোরে চলে গেল। তার দৃষ্টিতে কামুকতা ধরা পড়তেই যাচ্ছিল তৎক্ষণাৎ মনটা কি করে যেন ঘুরিয়ে নিল। চোখ নামিয়ে ফেলল তৎক্ষণাৎ। অদৃশ্য এক অপরাধ*বোধ কাজ করতে লাগল মনের ভিতর। মন তাকে দুষ*ছে। হৃদয় বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, এই মন এই হৃদয় কেবল তরীর জন্য। তুমি তাকে ঠকা*তে পারো না। অদ্ভুত এক বোঝাপড়ায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দিল সে।

তনয়া কাছে এসে দাঁড়াতেই তন্ময়ের থেকে সুঘ্রাণে তটস্থ হয়ে দাঁড়াল। তার তীব্র সুগন্ধ তাকে মা*তাল করে তুলছে। কি মিষ্টি ঘ্রাণ। ঠোঁট দুটো চেপে ধরল। শুভ্র রাঙা পাঞ্জাবিতে তাকে মানিয়েছে অনেক। ইচ্ছে করছে বলেই ফেলতে, “চলনা বিয়ে করে ফেলি!”

ভেবেই মুখ টিপে হাসল। নিজের মনকে সংয*ত করে নিল তন্ময়ের হাতটা চেপে ধরল। ঘোর থেকে তন্ময় বেরিয়ে এলো। তার বোঝাপড়া এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে এমন মনে হতো না। তনয়ার কাছে আসা তার মনে অ*স্বস্তি সৃষ্টি করছে। কোথায় যেন ভু*ল হচ্ছে। অথচ ভুলে*র কি আছে? এই পথ তো সে স্বচ্ছায় বেছে নিয়েছিলো!

একটা রিক্সা ভাড়া করে দুজন উঠে চড়ল তাতে। গা ঘেঁষে বসে ছিলো দুজন। তনয়া নিশ্চুপে তার বাহু আঁকড়ে চেপে কাঁধে মাথা রেখে নিল। শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে আসা সুঘ্রাণ প্রতি মূহূর্তে হৃদয়ে শিহ*রণ জাগিয়ে তুলছে। অথচ তন্ময় তখনো নিজের মনের যুদ্ধেই ব্য*স্ত। আশ্চর্য ভাবে পাশে বসা অপরূপা তনয়াকে উপেক্ষা করে তরীর ভাবনায় ডুব দিল সে। এই জীবনে কতো সাধ ছিলো তার,‌তরীকে শাড়ি পরা দেখবে। অথচ মেয়েটা কখনোই শাড়িতে অভ্যস্ত নয়। একবার চেষ্টাও করল না। তু*চ্ছ অভিমান করল সে। তার মান অভিমানের আদৌও কোনো দাম আছে কি?

রিক্সাটা গলির মুখ ছেড়ে মেইন রোডে কি উঠতে যাবে তার আগেই পুলিশের গাড়ি এসে থামল সামনে। দুজনেই নিজেদের কল্পনার জগত ছেড়ে বাস্তবের জগতে পা রাখল। পুলিশের গাড়ি দেখে রিক্সাওয়ালা মামা ও ভ*য় পেলেন খানিকটা। ভু*ল রুটে রিক্সা তো নেয়নি। তাহলে?

পুলিশি ইউনিফর্ম পরে এক মহিলা আর পুরুষ কনস্টেবল বেরিয়ে এলো। দুজনেই তনয়ার দিকে এগিয়ে এসে বলল,‌

“মিস তনয়া?”

“জি!”

“শেহনেওয়াজ কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার তো আপনি?”

তনয়া মাথা দুলিয়ে আবারো বলল, “জি!”

তন্ময় বলে উঠলো, “কোনো সমস্যা?”

তন্ময়কে উপেক্ষা করে নারী কনস্টেবল বলে উঠলো, “আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে ম্যাডাম। এখুনি। আপনার নামে কম*প্লেইন এসেছে।”

তনয়া পড়ল সপ্তম আসমান থেকে। সে আবার কি করল? তন্ময় আবারো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পুরুষ কনস্টেবল বলল, “ওখানে গেলেই জানতে পারবেন, চলুন!”

রিক্সা থেকে নামিয়ে দুজনকে তোলা হলো পুলিশের গাড়িতে। রিক্সাওয়ালা মামা জান বেঁচে যাওয়ায় আল্লাহর শুকরিয়া করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেছে। এদিকে গাড়িতে বসতে গিয়ে তনয়ার আ*ত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। তন্ময়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। স্যার আবারো কিছু করেনি তো? তন্ময় তার হাতের উপর হাত রেখে আশ্বাস দিল। ফিসফিস করে বলল, “ভয় পাস না, আমি আছি তোর সাথে!”

তনয়া মুচকি হাসল। তন্ময় মাথা দুলাল। বিরবির করে বলল, “যোগ্য প্রেমিক না হতে পারি, যোগ্য বন্ধু হবার ক্ষমতা আমার আছে তনয়া!”

———-

থানার ওসি মোতাহের হক। পুলিশ বাহিনীর উচ্চ পদেই আছেন তিনি। তার কামরার একদিক সজ্জিত বিভিন্ন সম্মাননায়, আরেক দিন বিশাল এক আলমারি। সেখানে ঠাসা ঠাসা ফাইল তো থাকবেই। টেবিলের উপরেই গোটা কয়েক ফাইল। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ তার সাথে একরোখা। তবে এই একরোখা মানুষ আজ ভীষণ নরম সুরে কথা বলছেন। কারণ তার সামনেই বসে আছে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী। বিশিষ্ট জাওয়াদ চৌধুরীর বড় ছেলে। এই সুবাধে সম্মান দেওয়া তো সাজে। তাই চা নাস্তা থেকে শুরু করে ফাস্টফুড অবধি চলে গেছিলেন। উষ্ণ চৌধুরী কেবল বলেছিলেন, শুধু চা!

চা এসেছে। গরম চা ধোঁয়া উড়িয়ে ঠান্ডা হয়েছে অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে অথচ তিনি চায়ের কাপে চুমুক দেননি। ওসি মোতাহের হক বসে ছিলেন না। তার টেনশন হচ্ছিল বিধায় চা খুব দ্রুত শেষ করেছেন। লোকটার বয়স আছে। সাদা চুল কলব দিয়ে কালো রঙ করিয়ে রাখেন সবসময়। বয়স কমানোর ধান্দা, অথচ সব বিফলে। মুখেই বয়সের ছাপ ধরা পড়ে গেছে।

তিনি দাঁত এক পাটি হাসলেন। এসব বড় ব্যবসায়ী দিয়েই তো পকেট ভরেন তারা। তোল্লাই না দিলে কি হয়।

“স্যারের জন্য তো আরেক কাপ চায়ের কথা হলো। না মানে চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল।”

উষ্ণ কিছু বলার প্রয়াস ও করল না। জেএস বলে উঠলো, “না, তারা আর কতোদূর?”

“এই তো এসে গেছে। দেখি ফোন করছি।”

ফোন ধরার আগেই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। তারা এসে গেছে। তনয়া এসে গেছে শুনেই উষ্ণের মুখের কঠোরতা কেটে গেল। মুখটা মলিন হয়ে উঠল। দরজা খুলে তনয়া প্রবেশ করতেই চেহারায় হাসিও ফুটল। এসব দেখে মোতাহের হক খুশিই হলেন। আজ পকেট গ*রম হবে ভালো!

উষ্ণ চৌধুরী কে দেখে তনয়া বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। মন আগে থেকেই সাবধান করছিলো কিন্তু তাই বলে এসব! থানা পুলিশ! কিন্তু তন্ময় অবাক হয়েছে। প্রথমে বিস্মিত অতঃপর রা*গ তার হিমালয় পাহাড়ে চূড়ায় উঠেছে। এসব তাহলে এই লোকটার কাহিনী। অফিসের কথাবার্তা ছাড়া কখনোই উষ্ণ স্যারের সাথে তার দ্বিতীয় কোনো আলোচনা হয় না। বিনা বাক্যেই তো যু*দ্ধ শুরু। আজকের ঘটনার পর সেই বাঁ*ধ ভেঙে যাচ্ছে!

জেএস উঠে দাঁড়িয়েছে। সেখানেই বসেছে তনয়া। উষ্ণের পাশে! তনয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তন্ময়। তন্ময় বলে উঠলো,

“স্যার কি হয়েছে?”

মোতাহের হক তার বিখ্যাত দাঁত কপাটি বের করে বলল, “সেইজন্যই তো ডেকেছি। আপনি কে?”

তন্ময় সহসা বলে উঠলো, “বন্ধু!”

তিনি বাঁকা হেসে বললেন, “শুধুই বন্ধু!”

“জি না বয়ফ্রেন্ড!”

বয়ফ্রেন্ড শব্দটা শুনেই মোতাহের হক তাকালেন উষ্ণ চৌধুরীর দিকে। ওদিকে চেহারায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি সমস্ত ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন। একটু কেশে বললেন, “মিস তনয়া, আপনার নামে একটা কমপ্লেইন এসেছে!”

তনয়া দাঁতে দাঁত চে*পে আড়*চোখে একবার উষ্ণ স্যার কে দেখে বলে, “কিসের কমপ্লেইন?”

“ছাতা চু*রির!”

তনয়া আশ্চর্য গলায় বলল, “ছাতা!”

তনয়ার পিছনে উপস্থিত দুজন কনস্টেবল আহম্মক বনে গেল। কি বলে, ছাতা চুরি*র দো*ষে এই মেয়েকে তারা তুলে এনেছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

তন্ময় ও শিউর হবার জন্য বলল, “ছাতা!”

“জি দামী একখান ছাতা। শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরীর ছাতা। ব্র্যান্ডেড ছাতা কি না। বেশ দামী ছাতা। সেটা নাকি আপনি নিয়ে আর ফেরতই দিচ্ছেন না। তাই তিনি এখানে এসে আপনার নামে কমপ্লেইন করেছে।”

তনয়া ঠোঁট দুটো চেপে রেখে উষ্ণের দিকে ফিরে তাকাল। মশকরা করছে লোকটা। একে তো নিজে ছাতা দিল এখানে এসে আবার ছাতা চুরি*র অভিযোগ ও দিচ্ছে।

উষ্ণ মুখখানা এদিক ফিরে মৃদু হাসল। তন্ময় বলে উঠলো, “কতো দাম ছাতার?”

“বিদেশী ছাতা তো, এই দেশীয় টাকায় প্রায় ৬৭০০০ টাকা দাম হবে!”

এবার পিছনের দুই পা কনস্টেবলের আক্কেল গুড়ুম! ৬৭০০০ টাকার ছাতা। তার নিজেদের মধ্যেই নেই যেন। গোল গোল চোখ করে উষ্ণ চৌধুরী কে দেখছে। এই লোক কে ভাই? এতো দামী ছাতা কিনে!

তনয়া অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে। তার চোয়া*ল ঝুলে আছে। মানছে ছাতাটা দামী তাই বলে এতো দামী। তন্ময় নিজেও বেশ অবাক। জেএস এবার বলে উঠলো,
“‌এই‌ ছাতার নাম হলো চেক ফোল্ডিং অ্যামব্রেলা ইন বাফ। ব্রুবেরি ব্র্যান্ডের ছাতা। এটি Burberry এর আইকনিক চেক প্রিন্টের একটি ফোল্ডিং টাইপ ছাতা। এটি নাইলন-কটন ফ্যাব্রিক, বিচ কাঠের হ্যান্ডেল, এবং প্যালাডিয়াম-প্লেটেড ফিনিশ। ছাতাটা স্যার শখ করে বিদেশ থেকে কিনে এনেছেন। স্যার একটু শৌখিন মানুষ। বাংলাদেশী টাকায় ৬৭০০০ টাকা দাম পড়বে প্রায়!

ছাতার বর্ণনা শুনে চারদিকে শুনশান নিরবতা বিরাজ মান। তনয়া নিজেকে সামলে বলে উঠলো,

“কিন্তু ছাতাটা তিনি নিজে যেচে আমায় দিয়েছেন।”

জবাবে উষ্ণ বলে উঠলো, “হ্যাঁ, কারণ বৃষ্টি হচ্ছিল। ভদ্রতাবোধ থেকে ছাতাটা তোমায় দিয়েছি। কিন্তু তুমি ছাতাটা আমায় ফেরত দাও নি।”

“কালই দিয়ে দিতাম। আমার মনে ছিল না, নাহলে।”

উষ্ণ ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “আমি কিভাবে জানব তুমি কাল দিবে। তুমি তো আর আমায় বলোনি। বেচে ফেললে?”

তনয়া দাঁতে দাঁত চে*পে জবাব দিল,
“ওই ছাতা বেচে আমি কি করব?

“কেন বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরবে।”

“আপনি তো খুব খারাপ লোক।”

উষ্ণ তার দিকে ফিরে কিঞ্চিত হাসল। তন্ময় বলে উঠলো, “এখন আপনারা কি চান?”

মোতাহের হক এতোক্ষণ হা করে দুজনের কথা শুনছিলো। তন্ময়ের কথায় হুশ ফিরল। বললেন, “ম্যাডাম ছাতা এখনি ফেরত দিলে ঝামে*লা মিটে যায়।”

তনয়া চট করে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি এখুনি নিয়ে আসছি।”

উষ্ণ তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো, “তুমি ফেরত আসবে তার প্রমাণ কি?”

অগ্নি*দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তনয়া। চোখ দিয়ে আ*গুন জ্ব*লছে। রা*গে ফুসে উঠছে। নাক ফু*লে লাল হয়ে উঠেছে। গাল লাল হতে শুরু করেছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে! তার এমন অপরূপা মুখে উষ্ণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। সে যেন আর নিজের মধ্যেই রইল না। তন্ময় বলে উঠলো, “আমি নিয়ে আসছি।”

তনয়া বলল, “আমিও যাবো।”

মোতাহের হক বললেন, “না ম্যাডাম আপনি বসুন। স্যার সযত্নে ছাতাটা নিয়ে ফেরত এলেই আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।”

“হ্যাঁ, তাই। আমি একা যাই তাড়াতাড়ি যেতে পারব। দ্রুত চলে আসব ঠিক আছে!” আশ্বাসের হাত রাখল তনয়ার গালে। উষ্ণ কাঁধ বাঁকিয়ে তাদের দুজনকে দেখছে। অল্প কিছুক্ষণের জন্য তন্ময় আর উষ্ণের চোখাচোখি হলো। সেখানে কেবলই রা*গ, হিং*সা আর ঘৃ*ণা!

তন্ময় হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। তনয়া ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। উষ্ণ শুধাল,
“পানি খাবে?”

“পানি আপনার মাথায় ঢাল*বো!”

উষ্ণ চৌধুরী গ্লাস সামনে ধরে বলল, “চাইলে ঢালতেই পারো।”

তনয়া সময় নষ্ট করল না। গ্লাসের পানি সহসা তার মুখে ছু*ড়ে মারল। ওসি সাহেবের দু ঠোঁট আগলা হয়ে গেল তনয়ার সাহস দেখে। জেএস মুখ টিপে হাসছে। উষ্ণ এতো টুকু বি*রক্ত না হয়ে কেবলাকান্তের মতো হেসে উঠল। তনয়ার *রাগ কমেনি, উল্টো স্যারের হাসি দেখে মাথা ঘু*রে গেল।

“আশ্চর্য লোক আপনি?”

“তুমি তার চেয়েও বড় আশ্চর্য। এভাবে পুলিশের সামনে বসে অপ*রাধ করলে। একে তো অপ*রাধ করেই বসে আছো, এরপর আরেক অপরা*ধ জুড়ে দিলে। শা”স্তি কি তোমার প্রাপ্য নয়!”

তনয়া সামলে নিল নিজেকে। ওসির কিৎকর্তব্যবিমূঢ় মুখপানে চেয়ে থেকে লজ্জিত হলো সে। উষ্ণ মুখটা তার কান বরাবর নিয়ে বলে উঠলো, “শা*স্তি হিসেবে আমার সাথে সারাটে জীবন পার করবে।”

বাতাসের তোপে জ্ব*লন্ত আগু*নের শি*খা নিভার বদলে তীব্র ভাবে যেভাবে অঙ্গা*র তুলে তেমনি তনয়ার তট*স্থ হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চে*পে বলল, “হ্যাঁ আপনার স্বপ্নে।”

“আমার স্বপ্নে তো কেবল তুমিই থাকো রাগিনী।”

উষ্ণের কথায় রা*গে তনয়ার নাক ঘামছে। সে ওসির দিকে দাঁত চি*বিয়ে চেয়ে আছে। ওসি মশাই পড়েছেন বিপাকে। এরা তো স্বামী স্ত্রীর মতো ঝগ*ড়া করছে। এদিকে মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড ও আছে। যদিও ছাতা চুরি*র অভিযোগ তার কাছে বোধগম্য হয়নি। ভেতরে কাহিনী আছে আগেই ভেবেছিলো। কিন্তু এখন সব আউলা ঝাউলা লাগছে। এটা কি ত্রিকোণী প্রেম। মেয়েটা কি দুটো ছেলেকে একসাথে ঘুরাচ্ছে!

সময় অতিবাহিত হচ্ছে নিজের ইচ্ছে মতো। তনয়া একটু পর পর ফোনে টাইম দেখছে। তন্ময়ের নাম্বার ডায়াল করেও কল করছে না। উষ্ণ টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে গায়ের স্যুট খুলে ফেলল। এখন তার পরনে কালো শার্ট আর ফরমাল প্যান্ট। নিজের উপরও একটু বির*ক্ত সে। কেবল একটা ডেট আটকে রাখতে কি না কি করতে হচ্ছে। তনয়াকে থা”না অবধি নিয়ে আসতে মোটেও ইচ্ছে করছিলো না। সাথে আবার প্রেমিক মহাদয়।

আড়চোখে পাশে ফিরল। নীল শাড়িতে তাকে অপ্সরা লাগছে। নীল রাঙা বি*ষ যেন! এই বি*ষ পান করলে মৃ*ত্যু নিশ্চিত। জেনেশুনে বি*ষ পান করার জন্য ছটফট করছে সে। তনয়া কি মনে করে এদিক তাকাল। উষ্ণের সাথে চোখাচোখি হলেও চোখ সরিয়ে নিল না। তনয়ার কাজল কালো আঁখির তোপে উষ্ণ চৌধুরীর শ্বা*সরুদ্ধ অবস্থা। হা হয়ে বেহায়ার‌ মতো চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তনয়া মুখ ভেংচি কেটে মুখ সরিয়ে নিল!

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩৭

“ঠান্ডা পানি আমার মুখে না ঢেলে তোমার মাথায় ঢালার দরকার ছিল। তাহলে মাথা আর গ*রম থাকত না, ঠান্ডা হয়ে যেত!”

তনয়া চোখ পাকিয়ে বলল, “আপনি কি দুটো মিনিট চুপ থাকতে পারেন।”

“অনুরোধ করছো?”

“হ্যাঁ, তাই।”

“আচ্ছা মান্য করলাম।”

তনয়া বিরবির করে বলল, “আসছে কোথাকার কোন রাজামশাই, হুঁ মান্য করলাম!”
বলার পর ফের আবার ফোনের স্ক্রিনে ঢুকে গেল। ওদিকে উষ্ণ আঙ্গুল দিয়ে তাকে গুঁতো দিচ্ছে। তনয়া দাঁত নিশপিশ করে জবাব দিল,

“কি হয়েছে?”

“তোমার খোঁপায় ফুল গুঁজে রাখলে সুন্দর লাগত। লাগাও নি কেন? বয়ফ্রেন্ড কিনে দেয়নি বুঝি!”

“আপনাকে না বললাম চুপ থাকতে।”

“পাশে এমন সুন্দরী কন্যা বসে থাকলে কি আর চুপ করে থাকা যায় নাকি।”

“তাহলে আমি উঠে যাচ্ছি।”

“আচ্ছা থাক বসো। আর কিছু বলব না!”

তনয়া শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। দু মিনিট যেতে না যেতেই উষ্ণ ফের বলে উঠল,

“চা খাবে!”

“না‌ বি*ষ খাবো।”

“এখানে নেই তো, আনিয়ে দিব।”

“মশকরা‌ করছেন!” চ*ড়া গলায় বলল তনয়া। সাথে সাথে থতমত খেয়ে সামনে বসা ওসির দিকে নজর দিল। তিনি এখন নিশ্চুপ হয়ে তার ফাইলে মাথা গুঁজে আছে। এর কারণটা তনয়া অবশ্য ধরতে পেরেছে। তাও লজ্জা পেলো। কণ্ঠে খাদ নামিয়ে বলল,

“আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।”

উষ্ণ চৌধুরী বেপরোয়া ভঙ্গিতে জবাব দিল, “আমায় দিয়ে তুমি করাচ্ছো।”

“আমি কালই এসে রেজিগনেশন লেটার দিয়ে যাবো। চাকরিটা আর করব না।”

উষ্ণ একটু নড়েচড়ে উঠল। পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে আরাম করে বসে বলল,
“ভালোই হবে। আমার বউ চাকরি করবে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না!”

উষ্ণ স্যারের দম্ভ আর আত্মবিশ্বাসের ঘাঁটি দেখে তনয়া হাঁপিয়ে উঠল। এই লোককে কোনোভাবেই কাবু করা যায় না। উষ্ণ ঘাড়টা বাঁকিয়ে তনয়ার কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “চাকরি ছেড়ে তোমার কোনো লস নেই। তবে একজনের কাছে। তোমার চাকরি না থাকলে তোমার বয়ফ্রেন্ডের চাকরিও নট করে দিব। মনে রেখো!”

সাংঘা*তিক হুম*কি। তনয়া কথাটা গিলে ফেলে চুপ করে রইল। লোকটা খুব ধুরন্ধর। তনয়ার পিছুটান নেই জানে কিন্তু যার পিছুটান আছে তাকে দিয়েই চালটা দিয়ে দিল।

বৃষ্টির যেই আশংকা করছিলো তা হলো। আচমকা আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতেই তন্ময়ের দেখা মিলল। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ছাতা নিয়ে হাজির সে। যার ছাতা তাকে বুঝিয়ে দিয়ে তনয়ার হাত ধরে বেরিয়ে গেল। অপেক্ষা করল না কোনো কিছুর। যেন তনয়া তার অধিকার, ব্যক্তিগত সম্পদ! চো*য়াল শক্ত করে বসে রইল উষ্ণ চৌধুরী!

সাদা ফকফকে পাঞ্জাবী শরীরে আটকে আছে। তনয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে থানার বাইরে এসে দাঁড় করালো তন্ময়। কড়া গলায় বলে উঠলো, “তুই ঠিক আছিস? লোকটা তোকে কিছু বলেনি তো?”

“ঠিক আছি। কিছু বলেনি। তুই তো পুরো ভিজে গেছিস। দেখি, কি যে করিস। এক্সট্রা ছাতা নিয়ে বেরুবি না।”

“তোর বাসা থেকে বের হবার টাইমে বৃষ্টি ছিল না। তাই নিই নি।”

তনয়া হাতটা নড়চড় করতেই তন্ময় ছেড়ে দিল। তনয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে তন্ময়ের মাথা মুছিয়ে দিল। বলতে লাগল,

“ইশ, এভাবেই তোর সর্দি। এখন আর বাড়বে।”

তন্ময় মিটিমিটি হাসল। আবারো ভাবনায় পড়ে গেল। ভেবেছিল সম্পর্কে জড়ালে উষ্ণ স্যার এদিকে আর নজর দিবেন না। কিন্তু তিনি তো দেখছি পিছনই ছাড়ছেন না। কেমন আঠার মতো লেগে থাকে। মনের কথাগুলো চাপা রেখে মুখে বলল, “হ্যাঁ রে স্যার কি অফিসে তোকে এখনো বিরক্ত করে।”

“না তো।”

“মিথ্যে বলিস না। সত্যি বল আমায়!”

“সারাক্ষণ তো তোর সাথেই থাকি। তুই বল না!”

তন্ময় মাথা নেড়ে বলল, “এখন যাবি কিভাবে? বৃষ্টির যা তেজ কমবে না বোধহয়!”

“আমার কাছে ছাতা আছে। চল সামনে গিয়ে দেখি রিক্সা পাই নাকি।”

ব্যাগ থেকে ছাতা বের করল সে। একটি ছাতার নিচে দুজনে একসাথে পা মিলিয়ে হেঁটে সামনে আগালো। পেছনে দাঁড়ানো উষ্ণ চৌধুরী দাঁতে দাঁত চেপে দেখতে লাগল। তার চোখের সামনেই তারা অদৃশ্য হতে গেল।

———————

চাকরি ছাড়ার কথাটা মাথা থেকে আপাতত উগড়ে ফেলেছে তনয়া। সেদিনের পর আজকের ৩ টা দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। স্যার ৩ দিন ধরে অফিস আসেনি। এজন্য তনয়ার উচিত খুশিতে নাচা। কাপল ডান্স করতে পারলে ভালো লাগত। অথচ পারছে না! কারণ তার পার্টনার নেই।

হ্যাঁ তন্ময়ের দেখা নেই আজ দুদিন যাবত। ফোন করলে ফোনটাও ধরে না। কি হলো বুঝতে পারছে না। প্রিয় মানুষের দেখা না পাওয়ায় হৃদয় তার বিরহে গেছে ছুটি কাটতে। শুকনো মুখে টেবিলের সামনে বসে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। স্যারের আসা না আসায় কোনো প্রভাব পড়ে না। কিন্তু তন্ময়কে এক দন্ড না দেখতে পারলে যে ভালো লাগে না।

ভেবেই নিল, অফিস ছুটির পর তন্ময়ের সাথে দেখা করতে যাবে। দরকার পড়লে বাড়িতেই যাবে। কিন্তু সম্পর্কে যাবার পর এখন ওর বাড়ি যেতে লজ্জা পায়। পাছে ও উল্টা পাল্টা কিছু ভেবে বসে। মন সায় দেয় না। তবে আজ যাবে। ও যাই না ভাবুক না কেন আজ তাকে যেতেই হবে। এক পলক দেখার জন্য হলেও।

কিন্তু এখানে এসেও কোনো সুবিধা করতে পারল না। তন্ময়ের ঘরের দরজার বাইরে তুলছে এক তালা। ও বাসায় নেই। তবে গেলো কোথায়? তনয়া ফোনে একবার নজর দিল। রাত্রির ১১ টা বাজে। এতো বাইরে ওর কি কাজ? আচ্ছা আন্টি আংকেলের কিছু হয়নি তো আবার। চট করে ফোনটা হাতে নিয়ে তন্ময়ের মায়ের নাম্বার ডায়াল করল। ফোন দিতে গিয়ে থেমে গেল। এতো রাতে ফোন দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি অন্যকিছু ভেবে বসবেন। সকালে দেওয়া যাবে খন। অতঃপর আবারো ফিরে চাইল দরজার দিকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা ও করল। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না!

রাত্রি বাড়ি ফিরে জানালার কাছে বেশ অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। মনটা কেমন খচখচ করছে। উষ্ণ স্যার প্রায় গাড়ি নিয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। আজও কি আসবেন? আচ্ছা গতকাল এসেছিলো? জানা নেই, কখনো খোঁজই তো করেনি সে!

তাকে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৌ এসে জিজ্ঞেস করল,

“কি করছো?”

জবাবে তনয়া হকচকিয়ে উঠল। কিভাবে উত্তর দিবে ভেবে পেলো না। কেবল আমতা আমতা করে বলল, “কিছু না!” জানালা ছেড়ে সরে গিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। বিনা নিদ্রায় গোটা একটা রাত পেরুলো।

———

তনয়ার সন্দেহ হচ্ছে, এতো ফোন এতো মেসেজ কোনোটার রিপ্লাই নেই। আন্টিকে কল করে কৌশলে খবর নিল। ওখানে সবই ঠিক আছে। তাহলে তন্ময়ের হঠাৎ গায়েবের কারণ কি? শুধু সে না, সাথে স্যারও গায়েব। কোনো যোগসূত্র আছে নাকি?

স্যারের গায়েব হওয়ার কারণ জানা গেল অবশেষে। তার বাবা অসুস্থ, হঠাৎ হা*র্ট অ্যাটাক করেছেন। বড় স্যারের অসুস্থতার খবর পুরো অফিসের সবাই জেনে গেল। এখন তিনি সুস্থ আছেন। স্যার আজ খুব দেরি করেই অফিসে এসেছেন। তাকে দেখা মাত্র তনয়া মাথা নিচু করে ফেলল। লোকটাকে নিয়ে আজেবাজে কতো কিছু ভাবছিলো অথচ তিনি বাবার অসুস্থতায় ব্যস্ত ছিলেন তাই অফিসে আসেনি। ভাবতে গিয়ে নিজেকে অপ*রাধী মনে হলো তার।

স্যার আসতে না আসতেই স্যারের ডাক পড়ল। স্যার বোধ হয় কিছুটা শুকিয়ে গেছেন। ফ্যাকাশে হয়ে আছে মুখটা। নির্ঘাত বাবার চিন্তায় এরকম দশা হয়েছে। তনয়া ড্যাবড্যাব করে তাকে দেখছিলো। উষ্ণ চৌধুরী এদিকে ফিরতেই চট করে মুখটা নামিয়ে নিল। উষ্ণ স্যার ডেকে উঠলেন,

“মিস তনয়া! আপনাকে একটা জরুরী কাজ দিচ্ছি। আপনি এখুনি আমাদের ফ্যাক্টরিতে যাবেন। সেখানে নতুন প্রোডাক্টের ফুড টেস্টিং এর রিপোর্ট নিয়ে ফিরবেন। আর হ্যাঁ, দেশের বাইরে যে প্রোডাক্ট গুলো লঞ্চ করার কথা সেগুলোর রিপোর্ট ও আনবেন।”

“স্যার ওগুলো তো মাসখানেক আগেই জমা দিয়েছিলাম।”

“হ্যাঁ, দিয়েছেন। তবে দেশের বাইরে থেকে আমাদের যে ক্লাইন্ট আসছে তারা দু’দিন পর আসবে। তাই নতুন করে আবারো লাগবে। অফিসের গাড়ি নিয়ে এখুনি বেরিয়ে পড়ুন।”

কথাগুলো বলে ল্যাপটপে মুখ গুজল। তনয়া ভারী অবাক হলো। মাথা দুলিয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে বিরবির করে বলতে লাগল,

“ভ্যাদাইম্মা দেখি আজ বাদড়ামি করল না। শুধরে গেছে নাকি? শুধরে গেলেই ভালো!”
এসব ভেবে রওনা দিল সে।

রওনা দিয়েছিলো দুপুর নাগাদ। সব কাজ শেষ করে অফিসের গাড়ি করে ফিরতে ফিরতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল। মাঝপথে আবার গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল,

“কি হয়েছে?”

কমবয়সী ড্রাইভার।চাবি ঘুরিয়ে দুবার গাড়ি স্টার্ট দিলেও চলল না। আয়নার দিকে ফিরে বলল, “ম্যাডাম বুঝতে পারছি না। আপনি একটু নেমে দাঁড়ান। আমি দেখছি!”

তনয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি ছেড়ে নামল। মনটা সকাল থেকেই খারাপ তার। গোধূলি বেলায় পশ্চিমা আকাশের রক্তিম আভা সেই মন খারাপ বাড়িয়ে দিল কয়েকগুন। আশপাশ দেখতে লাগল সে। গাড়িটা থেমেছে হাতিরঝিলের কাছে। মানুষের বড্ড ভিড় ওদিকে টায়। ছুটির দিন ছাড়াও এতো ভিড় হয় হাতিরঝিলে।

হাঁটতে হাঁটতে তনয়া এসে দাঁড়াল ব্রিজের কাছে। এদিকে দমকা হাওয়া মন হালকা করল তার। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিল। মনের অস্থিরতা কমে গেছে। বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল বলে সাইড ব্যাগ থেকে একটা রাবার ব্যান্ড বের করে আঁটকে দিল। পরনে তার চুড়িদার! ভার্সিটিতে থাকা কালে বেশিরভাগ সময়ই চুড়িদার পরে যেত সে। তন্ময় তখন ভারী প্রশংসা করত তার। সেখান থেকেই একটা পড়েছে আজ। এতো পুরনো চুড়িদারের রঙটা এখনো দারুণ!

তবে ঢিলে হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের ওজন বাড়ে, মোটাতাজা হয়। অথচ সে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে। যাবেই না কেন? দেখার কেউ তো নেই। আহারে, মায়া হয় নিজের উপর। এতিম মেয়েটা!

কপালের ছোট ছোট চুল গুলো কানে গুঁজে পাশ ফিরে চাইতেই অকল্পনীয়, অপ্রত্যাশিত ঘটনার সাক্ষী হলো সে। অকস্মাৎ ঠোঁট দুটো আগলা হয়ে গেল। চোখ দুটো গোল গোল করে চেয়ে রইল ওদিকে। ওটা কে? তরী না?

দ্রুত কয়েকবার চোখের পলক ফেলে দ্বিগুণ তেজে দেখতে লাগল। গোধূলির শেষ মূহুর্তে দূরের সবকিছুই ঝাপসা লাগে। আধো আধো আলোয় কোনোকিছুই স্পষ্ট নয়। তরীও যেন ইচ্ছে করে অন্ধকারের দিকটায় দাঁড়িয়েছে। তনয়া নিজেকে সংযত করল। শুকনো ঢোক গিলল। হ্যাঁ ওটা তরীই তো। তরী এখানে মানে, তন্ময় ও এখানে! ভাবতেই শরীরে অদ্ভুত ধরণের ঝাকানি গেল। শক্ত হাতে ব্রিজের রেলিং চেপে ধরল। বুঝতে পারল দু চোখ নোনা জলে ভর্তি হয়ে পড়ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা জোর করে এসে ভিড়েছে। দ্রুতই গাল গড়িয়ে পড়বে।

তনয়া মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। শরীর খারাপ লাগছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলতে পারছে না। তৃষ্ণায় গলা ফেটে যাচ্ছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। আঁখি পল্লব ভারী হয়ে উঠল নোনাজলে। সাহস নিয়ে চোখ তুলে তাকাল সে। এবার তরীকে একা দেখা যাচ্ছে না। পাশে কেউ আছে। হ্যাঁ আছে, ওই তো।

তাকে দেখা মাত্রই তনয়া নিস্তব্ধ হয়ে গেল। চারপাশের এতো শত গোলমাল তার কানে ঠেকছে না। নোনাজল অবাধ্য হয়ে গাল বেয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে। তন্ময় তার পাশেই দাঁড়িয়ে। এই তবে কাজ! এই কাজের কারণে তনয়ার ফোন তোলার সময় হচ্ছে না তন্ময়ের। কারণটাও যে তুচ্ছ কেউ নয়, স্বয়ং তরী!

এরপর আর কিছু মনে নেই তনয়ার। কি করে ওখান থেকে ছুটে এসে গাড়িতে উঠল মনে করতে পারছে না। গাড়িতে বসেই দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। হেঁচকি তুলে কান্নাকাটি যাকে বলে। ড্রাইভার সাহেব আহম্মক বনে গেল। গাড়ি ঠিক হয়ে ছিল সে নিজেই তো ডাকতে যাচ্ছিল। ম্যাডামের আবার কি হলো এখন?

গাড়ি অফিসে এসে দাঁড়িয়েছে। ততোক্ষণে তনয়া কান্নাকাটি থামিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে। মুখটা শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। দুঃখী দুঃখী ভাবটা যেন স্পষ্ট। দ্রুত কাগজপত্র নিয়ে স্যারের কাছে জমা দিল। উষ্ণ চৌধুরী ফাইলের পাতা উল্টাতে উল্টাতে তীক্ষ্ণ নজর গিয়ে পড়ল তনয়ার উপর। বলে উঠলো,

“আপনি কি কেঁদেছিলেন মিস তনয়া? কিছু হয়েছে? আর ইউ ওকে?”

তনয়া চমকে উঠল, লজ্জা পেল। স্যারের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তনয়া আমতা আমতা করে বলল, “ঠিক আছি স্যার। আমি আসছি!”

বলেই বেরিয়ে এলো। সোজা গেল ওয়াশ রুম। মুখে পানি ছিটাতে লাগল বারংবার। মুখের দুঃখী ভাবটা যেন যাচ্ছেই না। কেমন আঠার মতো লেগে আছে!

তনয়ার ভারী মুখটা উষ্ণের মনটাও ভারী করে তুলল। সে কখনোই চায় না তনয়া কষ্ট পাক, কাদুক। তনয়ার কান্না তার সহ্য হয় না। অগত্যা নিদারুণ এক দহ*ন যন্ত্র*ণায় পোড়া*তে লাগল নিজেকে!

———–

গোটা চারটে দিন তন্ময়ের খোঁজ নেই। তনয়া আজ অফিসে যায়নি। ছুটি নিয়েছে। অজুহাত দিয়েছে শরীর খারাপ। মৌ অনেকক্ষণ যাবত দরজা ধাক্কা দিয়েও কোনো সুরাহা করতে পারেনি। তনয়া তো দরজা খোলার নামই নিচ্ছে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেঁদেছে গোটা রাত। ভাগ্য তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, তন্ময় তোর না! তুই তন্ময়ের হতে পারবি না, ও ভালোবাসা পাবার যোগ্য না তুই। তুই তরী হতে পারবি না তনয়া!” নিজের এই হারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। “এই তো ভালোবেসেছিলো, সবে কাছাকাছি এসেছিলো তারা, এখনই তরীর আসতে হলো। এখনি!”
মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। এ তো হবারই ছিল,‌ তাই না। অতীত যে পিছু ছাড়ে না।

তন্ময়ের সাথে তরীর কোনো যোগাযোগ করেনি। ইন্সটাগ্রামে বেশ এক্টিভ তরী। নিজে না চাইলেও মনের ছুতোয় বার বার তরীর ইন্সটাগ্রাম চেক করত তন্ময়। এই করতে করতে জানতে পারল তরী বাংলাদেশে। জানার পর থেকেই তার মন ছটফট করে উঠছিলো। তরীকে দেখার জন্য, তার সাথে কথা বলার জন্য। নিজেকে কোনোভাবেই আঁটকে রাখতে পারছিলো না সে।

তাই তো অফিস থেকে সপ্তাহ খানেক ছুটি তরীর উদ্দেশে বেরিয়ে গেল সে। কোনো হুদিশ নেই, কোথায় থাকে তাও জানে না। পুরোপুরি অগত্যা সে সবকিছু থেকে। কেবল ইন্সটাগ্রামে তরীর ছবি দেখেই খোঁজ চালালো। একটা ক্যাফের ছবি! এবার শুরু হলো তন্ময়ের চিরুনি তল্লাশি। আদৌও তরীকে নিজের পাবে কি না ঠিক নেই, তবে তাকে এক নজর দেখা থেকে কিছুতেই মনকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। তাই বর্তমানের সবকিছু্কে তুচ্ছ করে চলে গেল। মা বাবা এমনকি তনয়ার কথাও বেমালুম ভুলে গেল। কিংবা মনেই করতে চায়নি। ভারী অন্যা*য় করল তন্ময়! ভীষণ অ*ন্যায়!

তাই তো নাম না জানা সেই ক্যাফে খুঁজে বের করল। এরপর শুরু হলো অপেক্ষা। সকাল থেকে শুরু করে রাত অবধি বসে থাকত ক্যাফের বাইরে। ফের আরেকবার দেখা হয় তরীর সাথে। আরেকবার! ভাগ্যের দোহাই দিতে লাগল বার বার। ২ দিন এমন অপেক্ষার পর শেষে তৃতীয় দিন গিয়ে তরীর দেখা পেল তন্ময়। একাই এসেছিলো তরী। কোমরের লম্বা চুলগুলো কেটে ঘাড় অবধি করে ফেলেছে। পরনে আকাশী রঙের জিন্স আর একটা কুর্তি। তরীকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে। ছোট চুল তার সৌন্দর্য কমাতে পারেনি। একটু শুকিয়ে গেছে মনে হয়।

টেবিলের এক কোণে বসে পড়ল। হাতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ।‌ নিশ্চিত ঘুরে ঘুরে শপিং করছিলো। এখন তরীর ক্ষুধা পেয়েছে। তন্ময় দূর থেকেই দেখছে তাকে। ওয়েটার আসতেই গড়গড় করে তরী অর্ডার করল। এতো দূর থেকে কিছুই শোনা যায় নি। কিন্তু তন্ময় ধরেই নিল, তরী এখন একটা চিকেন বার্গার, চিকেন স্যান্ডউইচ আর এক কাপ ব্লাক কফি অর্ডার করবে। তরীর মুখ দেখেই মনের কথা পড়ে ফেলল তন্ময়। কিছুক্ষণ বাদে ওয়েটার সেই খাবার গুলোই পরিবেশন করতে দেখে আনমনেই হেসে উঠল তন্ময়। না তরীকে চিনতে ভুল হয়নি তার। এখনো তরীকে চিনতে পারে সে। আর অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়াল। সোজা গিয়ে হাজির হলো তরীর সামনে। ব্লাক কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে আহম্মক হয়ে গেল তরী। তন্ময়কে এখানে যেন কোনোভাবেই প্রত্যাশা করেনি সে। চোখে মুখে অদ্ভুত এক অস্থিরতা। বেখেয়ালি হয়ে হাতের গরম কফিই ফেলে দিতে যাচ্ছিল। তন্ময় ছুটে গিয়ে সেটা আগলে ধরল। তরীও চমকে উঠল। গরম কফি গিয়ে পড়ল তন্ময়ের হাতের উপর। সে টু শব্দ অবধি করল না। কেবল অপলক দৃষ্টিতে তরীকে দেখতে লাগল। এদিকে তরী উঠে দাঁড়িয়ে ওয়েটার কে ডাকছে। ইশ ইশ, গরম কফি হাতে প*ড়ে গেল। তন্ময়ের হাতটা ধরে ফুঁ দিচ্ছে। এতো বছরের সকল অভিমান কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কিছু একটা হয়ে গেল তাদের মধ্যে। অতীত বর্তমান ভুলে কেবল দুজন দুজনে আটকে গেল অবিশ্বাস্য ভাবে! ভালোবাসা কি এমনই হয়!

#চলমান