তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
18

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩৮

শনিবার দিন অফিসে,
আজ তন্ময়ের সাথে দেখা হলো তনয়ার। পুরো এক সপ্তাহ পর দেখা। তন্ময় কে দেখতে পেয়েই তার হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠল। যাকে একটি নজর দেখার জন্য দিনরাত্রি তোল*পাড় করে ফেলছিলো আজ অবশেষে তার সাক্ষাৎ। কোনোভাবে উত্তে*জনা ধরে রাখতে পারছিলো না। চোখাচোখি হতেই তন্ময় নিজে আগ বাড়িয়ে এলো। হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,

“সরি!”

আচমকা কেঁ*দে উঠল তনয়া। কেন তা সে জানে না। হঠাৎ তনয়ার কান্না দেখে অফিসের অনেকেই অবাক হলো। তন্ময় কূলকিনারা না পেয়ে তনয়ার হাত ধরে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসেই তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আরে আরে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?”

“জিজ্ঞেস করছিস কি হয়েছে? এক সপ্তাহ ধরে ফোন তুলছিস না, ফোন করলেই বলে ফোন বন্ধ। না কোনো কল না কোনো মেসেজ। আমার হাল বুঝতে পারছিস। এতো কেন ক*ষ্ট দিচ্ছিস আমায়!”

“সেইজন্যই তো সরি বললাম বাবা। আচ্ছা আবারো সরি! সত্যি আমার ভুল হয়ে গেছে!”

“কোথায় ছিলি তুই এতোদিন?”

“ঢাকায় ছিলাম না। আবারো কাঁদছিস! দেখি ( চোখের জল মুছিয়ে বলল) আরে আমার ফোনটা চু*রি হয়ে গেছে। এই দেখ নতুন ফোন কিনেছি। চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। আমার এক বন্ধু হঠাৎ এক্সি*ডেন্ট করে তাকেই দেখতে। বাসের মধ্যে ফোনটা চু*রি হয়ে গেল। তাই তোকে কল করতে পারিনি। সত্যি তনু, এই যে সরি। কান ধরছি। বিশ্বাস কর!”

তনয়া হাসিমুখে তন্ময়ের মি*থ্যে কথাগুলো শুনল। কি সুন্দর করে একের পর এক মিথ্যে বলছে তন্ময়। বলতে ইচ্ছে করল, ভালো মিথ্যে বলতে শিখে গেছিস তন্ময়! এতো মিথ্যে কেন বলছিস? কেন বলছিস না তুই তরীর সাথে ছিলি। কেন?”

তন্ময় নিজ থেকে না বলায় তনয়া নিজেও চেপে গেল। কেবল অপেক্ষা করতে লাগল তন্ময় কখন নিজে থেকেই তরীর কথা বলে। এসব সে শুনতে চায় তন্ময়ের মুখ থেকেই। কেবল একবার শুধালো, “সব ঠিক আছে তন্ময়?”

তন্ময় হেসে বলল, “হ্যাঁ, ঠিক আছে। কি আবার হবে!”
তনয়া মাথা দুলিয়ে না করল। কি অস্বস্তি*কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছে সে।

ওদিকে তন্ময় ইচ্ছে করে কথাটা চেপে যাবার কারণ ছিল সময়! সে চাইছে একটা উপযুক্ত সময় দেখে তনয়াকে সবটা বলার। বুঝিয়ে বলবে যাতে তনয়া কষ্ট না পায়। কিন্তু নিজের অজান্তেই তনয়াকে সবচেয়ে বড় কষ্টটা দিয়েই ফেলল সে!

লাঞ্চ টাইমের পর স্যারের কেবিন থেকে ডাক পড়ল তনয়ার। আশ্চর্য হলেও সত্যি গত কয়েকদিন স্যার ও অনেকটা শুধরে গেছেন। সত্যি সত্যি শুধরে গেছেন। বির*ক্ত করছেন না একদমই। তনয়ার এবার ভেজা*ল লাগছে।

কেবিনে ঢুকতেই উষ্ণ চৌধুরী বলল,
“বসো তনয়া, তোমার সাথে ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে!”

“জি স্যার!”

উষ্ণ চৌধুরী সোজা হয়ে বসল। তনয়ার চোখে চোখ রাখল। তনয়াও একটু নড়েচড়ে উঠল। উষ্ণ শুকনো ঢোল গিলে বলল,

“আমি তোমাকে এখন আর বিরক্ত করব না। আমি বুঝে গেছি জোর করে ভালোবাসা হয় না। তোমার আর তন্ময়ের মাঝে আমি আর আসবো না। তোমরা তোমাদের মতো থাকবে। তুমি চাইলে চাক*রিটাও ছেড়ে দিতে পারো। এতে তন্ময়ের সাথে আমি কিছু করব না!”

তনয়া আহম্মক বনে গেল। দু সেকেন্ডের জন্য তার মনে হলো স্যার তার সাথে মজা করছে, নাকি সে স্বপ্ন দেখছে। উষ্ণ স্যার সত্যি সত্যি এতো শুধরে গেলেন কি করে? ভারী আশ্চর্যের কথা তো।

হতভম্ব হয়ে কেবিন ছেড়ে বের হতে যাচ্ছিল তনয়া। উষ্ণ স্যার তখন বলে উঠলেন, “সরি তনয়া!”
তনয়া দ্বিতীয়বারের মতো স্ত*ব্ধ হয়ে গেল। নির্বাক নয়নে চেয়ে রইল কেবল। এ দুদিনে তার মনে হচ্ছে সবাই বদলে গেছে। এই উষ্ণ স্যারকে সে চিনে না। তন্ময়কেও চিনতে পারছে না। সব কেমন গোলমেলে ঠেকছে।

———–

সেই কখন থেকে দরজা ধাক্কা*চ্ছে উষাণ চৌধুরী। অথচ তার দরজা খোলার কোনো নাম নেই। রাগে*র মাথায় খেয়ালই করেনি দরজায় তালা তুলছে। হুড়মু*ড়িয়ে ঢুকেই দরজায় করা*ঘাত। তাই হয়তো নজরে পড়েনি। নজরে আসার পরপরই নিজেকে শান্ত করল। জিভ দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে দরজায় সজোরে লা*থি মা*রল। হাতের কাছে খুঁজে দেখছে কিছু পায় কি না। একটা বড় সাইজের ইট পেয়ে সেটা নিয়েই তালা ভা*ঙতে সদয় হলো। সস্তা তালা! কয়েকবার আঘাত করতেই তালা ভেঙে গেল। উষাণ ভেতরে ঢুকে গেল। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। আগন্তুক পালি*য়েছে। পুরো ঘর খালি। একটা জিনিসপত্র নেই। আগে তবুও ঘুমানোর কাঁথা বালিশ ছিল। ওসব নিয়েই ভেঙেছে লোকটা। রা*গে দাঁত নিশপিশ করতে লাগল উষাণ চৌধুরী। উষ্ণ চৌধুরী তার চাল চেলে দিয়েছে। দাবার পরবর্তী গুটি দিয়ে চাল দিয়ে ফেলেছে সে। উষাণ সামনে এগিয়ে এলো জানালার কাছে। ছোট ছোট চোখ করে তাকাল দূরের বাড়িটার দিকে। তনয়া তো ওখানেই থাকে তাই না। মনে শত রকম চিন্তা ভাবনা করল। অতঃপর ঘাড় বাঁকি*য়ে হাসল। তার হাসি অবিকল উষ্ণ চৌধুরীর মতো। ভ*য়ংকর আর তিতকুটে!

আগন্তুক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে উষ্ণ চৌধুরীর সামনে। কিং সাইজের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে উষ্ণ চৌধুরী। তার পিছনেই জেএস। উষ্ণ সব কথা শুনে নিজের মাথা চুলকাতে লাগল। অবাক কণ্ঠে বলল,

“ওকে কি করা যায় জেএস? ছেড়ে দিব না মে*রে ফেলব?”

আগন্তুক শুকনো ঢোক গিলল। এখানে এসে সবকিছু স্বীকার করেছে কেবল ক্ষ*মা পাবার আশায়। মরার* হুম*কি শুনে তার গলা শুকিয়ে এলো। জেএস মৃদু স্বরে বলল, “ছেড়ে দিন স্যার, ওকে আমাদের পরে লাগবে!”

উষ্ণ ভ্রু কুঁচকে পিছনে ফিরে তাকাল।
“সিরিয়াসলি! যদি আবারো ধোঁ*কা দেয়!”

আগন্তুক সহসা তার পায়ে পরে গেল। মিনতি করতে লাগল সাথে নিজের প্রাণভিক্ষা।
“স্যার ক্ষমা করে দিন। আমি আর কখনো আপনাকে ঠকাবো না। এই জীবনে তো কখনোই না। প্রাণের ভ*য় আমার আছে। আমি, আমি সবকিছু আপনাকে খুলে বলেছি। প্লিজ স্যার!”

উষ্ণের‌ মন গলল কি না জানা নেই। তবে সে খানিকটা ঝুকে গেল তার উপর। ফিসফিসিয়ে বলল, “উষাণের পরের প্ল্যান কি ছিল?”

আগন্তুকের চোখে মুখের রঙ উড়ে গেল সহসা। সে হা হয়ে চেয়ে রইল। উষ্ণ ভ্রু যুগল উঠিয়ে নাচাতে লাগল। এদিকে ভয়ং*কর কথাটা বলার আগে আগন্তুকের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠছে। এটা বলার পর যদি স্যার রে*গে যায়, আর সেই রা*গে যদি তাকেই কে*টে টুকরো টুকরো করে ফেলে তখন! ভীষণ দু*শ্চিন্তায় পড়ে গেল সে!

———-

ফাইভ স্টার বিরাট হোটেল। হোটেলের সবচেয়ে উঁচু ফ্লোরে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। রেস্টুরেন্ট টা একদম হোটেলের ছাদে। হোটেলের বরাদ্দকৃত কাস্টমার ছাড়াও বাইরের লোকেরা ও এখানে এসে সময় কাটাতে পারে। নাম ডাক আছে বেশ। সেই রেস্টুরেন্টের এক কোণের টেবিলে অপেক্ষা করছে তনয়া। পরনে তার হালকা গোলাপি রঙের এক লং ফ্রক। চুলগুলো একটু উঁচু করে ঝুঁটি করা। সাজগোজ তেমন কিছু নেই। মনের যা অবস্থা সাজতে ইচ্ছে করে না। এখানে এসেছে কেবল একটা ফোন কলে।

২ ঘণ্টা আগে একজন কল করে তাকে বলেছে এখানে আসার কথা। শুধু আসার কথাই বলেনি, বলেছে এখানে আসলে তন্ময় আর তরীকে একসাথে পাবে। তাই স্বচোখে দেখতে এলো। এর আরেকটা কারণ ও আছে। আগন্তুক সে যেই হোক তাকে আর তন্ময় কে খুব ভালো করে চিনে, এমনকি তাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ও জানে। তাই আর কৌতূহল দমাতে পারেনি। চলে এসেছে।

অপেক্ষা করছে ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল। এরমধ্যে এক কাপ কোল্ড কফি অর্ডার করে খেল। এসেছিলো বিকালের দিকে। পড়ন্ত বিকেল শেষ হয়ে আসছে। রেস্টুরেন্ট ছাদের উপর হওয়ায় আকাশকে খুব কাছে মনে হয়। সত্যি বলতে আশপাশের ভিউ চমৎকার। মন ভালো করে দেবার মতো। তার সাথে বাতাসের দমকা হাওয়া তো আছেই। বহুদিন পর দম খুলে শ্বাস নিল সে।

একটা জিনিস খেয়াল করল। এখনকার বেশির টেবিলই ফাঁকা। এগুলো নাকি আগে থেকে রিজার্ভ করা। কথা শুনেই মনে হচ্ছে বেশ নামি দামি রেস্টুরেন্ট। তনয়া আসার পর ধীরে ধীরে মানুষ আসতে শুরু করল। এখন চারদিকে মোটামুটি মানুষের ভিড় করেছে। সন্ধ্যে হবার আগে আগেই চারদিকের লাইটিং গুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। সোনালী বাতিগুলো এখন ঝলক দেখাতে পারছে না। তিমিরের অপেক্ষা আসলে!

তনয়া উঠে দাঁড়াল এবার। হাতের ফোনটা নিয়ে কয়েকবার আগন্তুকের নাম্বারে ডায়াল করল। ফোন বন্ধ! কি আশ্চর্য। ইদানিং যাকেই কল করছে তারই ফোন বন্ধ। তনয়া আশপাশ ঘুরে দেখতে লাগল। যার জন্য এসেছে তার সাথে দেখা না হলেও তন্ময়কে দেখতে ইচ্ছে করছে।

আবারো টেবিলে এসে বসে পড়ল সে। এবার সে বসে পড়তেই তার সামনে এসে দাঁড়াল এক ভদ্রলোক। গাঢ় নীল রঙের শার্ট পরে ফরমাল ড্রেসআপে উপস্থিত একটা লোক। চোখে কালো রোদচশমা। তনয়া পিট পিট করে চোখের পাতা ফেলছে। লোকটা চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছে। কিংবা কারো সাথে খুব মিল আছে চেহারায়। লোকটা রোদচশমা খুলে হাত বাড়িয়ে বলল,

“হাই, আমি উষাণ চৌধুরী। আপনাকে এখানে আমিই ফোন করে ডেকেছি!”

তনয়া উঠে দাঁড়াল। লোকটা উষ্ণ স্যারের মতো দেখতে না। উষাণ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তনয়া হাত না বাড়ানোতে সে নিজেই তনয়ার হাতটা ধরে বলল,

“শেহনেওয়াজ উষাণ চৌধুরী, উষ্ণ চৌধুরীর ছোট ভাই!”

তনয়া মাথা দুলাল। এখন মন পড়েছে। লোকটা স্যারের ছোট ভাই। চেহারায় এজন্য বুঝি এতো মিল। কিন্তু লোকটা তাকে হঠাৎ কেন ডাকল। পরক্ষণেই বোধ হলো, লোকটা এখনো হাত ধরে আছে। তনয়া কপাল কুঁচকে নিতেই উষাণ হাত ছেড়ে দিল। বসে পড়ল সামনের চেয়ারে। তনয়া এখনো কিছুটা বিস্মিত!

নিজের চেয়ারে বসে উসখুশ করছে। স্যারের ভাই তার সাথে হঠাৎ দেখা করার কারণ কি? তিনিই বা তন্ময় কে চিনেন কিভাবে? কতো কিছু আসলে হয়ে যাচ্ছে তার পিছনে!

“কিছু অর্ডার করোনি, আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে বুঝি। সরি, লেট হয়ে গেল। আসলে জরুরি কাজে আটকে গেছিলাম।”

“আমায় এখানে ডাকার কারণ?”

“বলছি, অর্ডার দিয়ে নিই একটু, প্লিজ।”

ওয়েটার কে অর্ডার দেবার এবার সোজা হয়ে বসল উষাণ। পলকহীন ভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে তনয়ার দিকে। তার চাহনিতে তনয়ার অস্বস্তি হচ্ছিল। তনয়া একটু নড়েচড়ে উঠল। উষাণ বলে উঠলো,

“ইউ আর সো বিউটিফুল!”

“এক্সমিউজ মি!”

“আই সে ইউ আর গর্জিয়াস! আই লাইক ইউ।”

“এসব বলার জন্য ডেকেছেন।”

“না তোমার জন্য একটা গিফট ও আছে!”
মুচকি হাসল। চোখের ইশারায় পিছনে তাকাতে বলল। তনয়া পিছন তাকাল। তার হৃদয় থম*কে গেল। শরীরের সব লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল আচমকা। তন্ময় আর তরী তাদের থেকে অনেকটা দূরে বসে আছে। একটু ঘনি*ষ্ঠ ভাবেই বসে আছে দুজন। তাদের একসাথে দেখে তার হৃদয় ভে*ঙ্গে চুরমা*র হয়ে গেল।

হালকা কাশির শব্দে এদিক ফিরল সে। উষাণ মৃদু হেসে বলল,
“আমার গিফট পছন্দ হয়েছে তোমার?”

“তন্ময়কে কিভাবে চিনেন?”

“তোমার সূত্র ধরে। তোমায় ফলো করতে করতে তন্ময়ের খবর পেলাম। তোমার কারেন্ট বয়ফ্রেন্ড। না, এখন তো আর নেই। সে তার এক্সের সাথে মিলে তোমায় চিট করছে। ভেরি সেড!”

প্রথম সাক্ষাতেই অপরিচিত ব্যক্তির সামনে কান্নাকাটি করতে চাইছিলো না তনয়া। তাই নিজেকে সামলে নিল। একটু শক্ত গলায় বলল,

“আপনি আমার পিছু কেন করছিলেন?”

উষাণ পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসল। হাতের ভরের উপর মুখটা রেখে বলল,

“তোমায় পছন্দ করি বলি। প্রথমেই তো বললাম আই লাইক ইউ।”

“আমি আপনাকে চিনি না।”

“আমি তোমায় চিনি, তোমার সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য জানি তা তুমি নিজেও জানো না।”

তনয়া নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার ভ*য় লাগছে। চারদিকে এতো মানুষ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে ভীষণ একা মনে হলো তার। তনয়া শুকনো ঢোক গিলল। এরই মধ্যে ওয়েটার এসে খাবার গুলো রেখে দিল।

উষাণ আবারো নড়চড়ে বসল। বলল,

“তোমাকে আমি এখন একটা প্রস্তাব দিব মিস তনয়া!”

তনয়া মাথা তুলে তাকাল। উষাণ বলে উঠলো,

“উইল ইউ মেরি মি তনয়া?”

“হোয়াট!?”

“সেটাই বিয়ে করবে আমায়।”

“কেন?”

“কারণ আমি তোমাকে পছন্দ করি।”

“পাগল হয়ে গেছেন। কখনো না। আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, আপনি একটা পাগল!”

“আই’ম ফাকিং লাভ ইউথ ইউ। এটা কি কোনো খারাপ কাজ হলো। পাগ*ল মানছি খারাপ তো না।”

না আর বসে থাকা যায় না। তনয়া এবার উঠে দাঁড়াল। সাইড ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, “আমি আসছি!”

“আর আমার প্রস্তাব?”

“প্রত্যা*খান করছি, আপনাকেও আর আপনার প্রস্তাব কেও! আপনার পরিবারের সবাই কি এমন।”

“সবাই বলতে?”

“আপনার মা, বাবা, আপনার ভাই আর আপনিও। পাগলের বংশ*ধর!”

“ডোন্ট সে মাই মাদার নেইম তনয়া। তোমাকে আমি ভালো একটা অফার দিয়েছিলাম রাখলে না। এর চেয়েও ভালো অফার আছে।”

“মানে?”

“তন্ময় আর তরী আজ রাতে এই হোটেলের একটা রুমে রাত কাটাবে। রুম নাম্বার জানো? ৪০২! পাশেই ৪০৩ নাম্বার রুম। ইফ ইউ ওয়ান্ট দ্যান উই ক্যান স্প্যান্ড অ্যা নাইট টুগেদার ইন দিস রুম!”

কথা শেষ করার সাথে সাথেই সামনের জুসের গ্লাস ছুঁড়ে মা*রল উষাণ চৌধুরীর মুখে। রা*গে তার সর্বা*ঙ্গ কাঁপ*ছে! ঠোঁট দুটো থর*থর করে কাঁপছে। রা*গে উষাণের চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ইউ!”

“ইউ আর অ্যা গাধার বাচ্চা, গো টু হেল ইউ ইডিয়েট!”

আর এক মূহুর্ত সেখানে নষ্ট না করে হনহন করে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। নিজেকে এখন একটা চ*ড় মারতে ইচ্ছে করছে। এখানে তার আসাই ভুল করেছে। শেহনেওয়াজ পরিবারের সবগুলোই এক একটা গা*ধা! গাধা*র বাচ্চা গা*ধা।

সোজা চলে এলো লেডিস ওয়াশরুমে। বুকে হাত রেখে দম নিতে লাগল। চারপাশের এসব কাণ্ডে খুব দ্রুতই মনে হচ্ছে অসুস্থ হয়ে পড়বে সে। জীবনটাই বৃ*থা লাগছে। বাঁচার ইচ্ছে টুকু ম*রে যাচ্ছে। ওয়াশরুম বন্ধ করে মুখ চেপে কেঁ*দে উঠল সে।

বেশ অনেকক্ষণ পর বের হলো সেখান থেকে। বেসিনের কাছে এসে চোখে মুখে পানি ছিটাতে লাগল। মুখটা ধুয়ে সামনের আয়নার দিকে তাকাল। নিজেকে ভীষণ ক্লা*ন্ত লাগছে তার। ক্লান্তির কালো দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। আর পারছে না এভাবে বেঁ*চে থাকতে!

————-

তনয়া ফের এসে দাঁড়াল রেস্টুরেন্টের সামনে। কাঁচের দেওয়ালের বিপরীত দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের দুজনকে। পাশাপাশি দুজন বসে গল্প করছে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। পুরো রেস্টুরেন্টে সোনালী আলোয় সজ্জিত। এদের মধ্যে তাদের দুজনকে বেশ সুন্দর লাগছে। তরীর‌ পরনে কালো রঙের একটা ওয়েস্টার্ন গাউন। পাশেই ফরমাল ড্রেসআপে তন্ময়। কথায় কথায় তন্ময় তার হাতের উপর হাত রাখতেই ব্যথা*য় কুঁ*কড়ে উঠল তনয়ার বুকটা। কি অসহ্য ব্য*থা! আপনাআপনি চোখে জল চলে এলো।

“মিস তনয়া?”
পরিচিত কণ্ঠস্বর পেতেই তনয়া কেঁ*পে উঠল। দ্রুত চোখের জল মুছে সামনে তাকাল। উষ্ণ চৌধুরীকে দেখে খানিকটা চমকে গেল। আবারো তাকাল ভেতরের দিকে। উষাণ চৌধুরী নেই। চলে গেছে। তনয়া এদিক ফিরতেই উষ্ণ বলে উঠলো,

“আপনি এখানে? কি করছেন?”
ভ্রু নাচিয়ে কথাটা বলে কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে তাকাল। মূহূর্তেই তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। তনয়া সবটা দেখল। উষ্ণ বলে উঠলো,

“ওটা তন্ময় না? তার পাশে ওইটা কে? হুমম!”

বলেই তনয়ার দিকে ফিরল। তনয়ার মুখটা ছোট হয়ে গেছে। সে কেবল নিজের ঠোঁট কাম*ড়াচ্ছে। কিছুদিন আগেও‌ তন্ময় স্যারের সামনে চড়াও গলায় বলেছিলো, সে তার বয়ফ্রেন্ড! আজ একি হাল তার বয়ফ্রেন্ডের! উষ্ণ স্যার নিশ্চিত মনে মনে তাকে নিয়ে হাসছেন। তুচ্ছতা*চ্ছিল্য করছেন!

তনয়া জবাব না দেওয়ায় উষ্ণ ফের বলে উঠলো, “তন্ময় আপনার সাথে চিট করছে মিস তনয়া?”

অকস্মাৎ কথায় তনয়া চমকে উঠে তার মুখের পানে চাইল। উষ্ণ হকচকিয়ে উঠে বলল,

“না না, আজ আমি তোমাদের পিছু নেইনি। আমি এখানে এসেছি আমার কাজে। বিদেশ থেকে যেসব ক্লাইন্ট আসার কথা ছিল তারা এসে এইখানেই উঠেছে। তাদের সাথে আমার মিটিং আছে। বিশ্বাস করছো না তুমি?”

তনয়া নিরবে উষ্ণের কথাগুলো শোনার পর পিছনে দেখতে পেল জেএস কিছু লোকদের নিয়ে অন্যদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পথিমধ্যে তারা থেমে গিয়ে এদিক ফিরল। জেএস আর তনয়ার চোখাচোখি হতেই জেএস ইশারা করল। তনয়া হালকা কেশে বলল,

“স্যার , আপনাকে ডাকছে!”

উষ্ণ পিছন ফিরল। জেএস হাত নাড়িয়ে তাকে ডাকছে। পিছনে ক্লাইন্ট দাঁড়িয়ে। উষ্ণ মৃদু হেসে বলল, “দেখলে আমি সত্যি বলছিলাম। আমি কথা দিয়েছিলাম তো তোমায় আর কখনো তোমাকে জ্বালা*বো না। আচ্ছা আসছি!”

বড্ড তাড়াহুড়ো করে উষ্ণ চলে গেল সেখান থেকে। তনয়ার মনে হলো উষ্ণ স্যার আসলেই শুধরে গেছেন। দৃষ্টি ভীড়াল আবার তাদের দিকে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যের জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। যে তন্ময় কিছুদিন আগে তার ঠোঁটে*র কাছ অবধি এসে ফিরে গেছিল সে আজ রেস্টুরেন্টে বসে সকলের সামনে নির্লজ্জের মত তরীর ঠোঁটে চুম্বন করছে। তার ঠোঁটের স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তনয়ার চো*য়াল যেন ঝুলে পড়ে যাচ্ছে। হৃদয় ভে*ঙ্গে খান খান। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখকে বিশ্বাস করতে হলে তন্ময়কে অবিশ্বাস করতে হয়। অথচ তন্ময়কে অবিশ্বাস করতে চাইছে না সে। কোনভাবেই চাইছে এসব সত্যি হোক। কিন্তু এসব তো সত্যি! দিনের আলোর মতো সত্যি!

পা ছিঁ*ড়ে পড়ে যাচ্ছে। আর এক বিন্দু সেখানে না দাঁড়িয়ে ছুটে পা*লিয়ে গেল সে। সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি সামর্থ্য কোনোটাই ছিলো না তার। আর এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকলে শ্বাস বন্ধ হয়ে সে মা*রা পড়ত। জীবন্ত ফিরতে পারত না!

———-

এলোমেলো ভঙ্গিতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে সে। দিন দুনিয়ার কোনো খবর নেই তার মধ্যে। আকাশে মেঘ জমেছে। রাতের কালো আঁধার কালো মেঘে ভয়ংক*র রূপ ধারণ করেছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি থেকে শুরু করে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মানুষ প্রাণপণে ছুটে পালাল। কেবল সদ্য হৃদয় ভা*ঙ্গা মেয়েটি বৃষ্টির মধ্যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল নির্বিকারে। এসব বৃষ্টির পানি যেন তাকে কোনো বাঁ*ধা দিচ্ছিল না। নিশ্চল, নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছিল সে।

এতোটুকুনি বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে যাচ্ছে। ধুলো বৃষ্টি মিলে কর্দমায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাস্তার ছোট ছোট গর্ত সেই কাঁদায় পরিপূর্ণ। উষাণ চৌধুরী গাড়ি নিয়েই ফিরছিল। সামনে তনয়াকে দেখতে পেয়ে তটস্থ হলো সে। কিছুক্ষণ আগের অপমা*নের প্রতি*শোধ নিতেই আ*ক্রোশে ফুঁসে উঠল।

মনপ্রাণ সকল কিছু অচল থাকলেও মস্তিষ্কে চঞ্চল ছিল তনয়ার। তাই তো পিছন থেকে ধেয়ে আসা গাড়ির শব্দে পা সরিয়ে হাঁটতে গিয়ে গর্তে পড়ে গেল। মূহূর্তেই কাঁদায় মাখামাখি হয়ে পড়ল। বি*রক্ত হলো, কষ্ট লাগল না। গাড়ি চলে গেছে। এখনো কাঁদায় মাখামা*খি হয়ে রাস্তার কোনায় পড়ে আছে সে। সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বিফল হলো। দ্বিতীয়বার উঠতে গিয়ে আবারো কাঁদায় পড়ে গেলো। চোখে মুখে কাঁদা ছিটে বির*ক্তিকর অবস্থা। তনয়া এবার ভে*ঙ্গে পড়ল। মনের ভেতরের যেই দহ*ন এতোক্ষণ করে তাকে যন্ত্র*ণা দিচ্ছিল সমস্ত টুকু বেরিয়ে এলো। রাস্তার কোনায় বসে হা*উমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। লজ্জা শরম সব জলাঞ্জলি দিয়ে ছোট বাচ্চার মতো কাঁ*দায় মাখামাখি হয়ে চেঁচি*য়ে কাঁদ*তে লাগল। তার কান্নার স্বর বৃষ্টির আওয়াজে স্মান হয়ে গেল। ভেতর থেকে ডুকরে আসা ক*ষ্ট গুলো যেন আর বাঁধ* মানছিলো না!

এদিকে তনয়া চলে যাবার পরপরই সেখানে উপস্থিত হয়েছিল উষ্ণ। তনয়াকে না পেয়ে পুরো হোটেল খোঁজার পর এবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। তনয়ার মনের অবস্থা আঁচ করতে পেরে টেনশনে তার হাত পা কাঁপতে লাগল। উষ্ণ চৌধুরীর ও তাহলে টেনশনে হাত পা কাপে! তাও কেবল তার রাগিনীর জন্য! তার নীলাম্বরীর জন্য!

বৃষ্টির মধ্যে যখন তনয়া খুঁজে না পেয়ে হাই হুতাশ করছিলো তখনি চোখ পড়ল রাস্তার ধারে কর্দমাক্ত ময়লা আবর্জনার মধ্যে একটি মেয়ে বসে কাঁদছে। উষ্ণ চৌধুরীর হৃদয় সমেত কেঁ*পে উঠল। দ্রুত গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। তনয়ার শোচনীয় অবস্থা দেখে নির্বাক হয়ে পড়ল. মনে পড়ে গেল ঠিক ১৫ বছর আগের ঘটনা। এমনি কোন বর্ষাকালে স্কুল ড্রেস পরা ছোট একটি মেয়ে রাস্তার ধারে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে কাঁদছিল। উষ্ণ সেদিন হা করে মেয়েটিকে দেখছিলো। সেদিন আর আজকের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাৎ নেই? হ্যাঁ আছে তো, সেদিন প্রথমবার উষ্ণের ক্ষুদ্র হৃদয়ে তনয়া যে জায়গা করে নিয়েছিলো, আজ যৌবনে তা পরিপূর্ণ হয়ে ফিরে এসেছে। সেদিনের মতো ছোট ছোট পায়ে আজও হাজির হলো তনয়ার সামনে। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই মেয়ে, এখানে এভাবে বসে কাঁদছো কেন?”

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৩৯

কয়েক ঘণ্টা আগের ঘটনা,

বেশ অনেকক্ষণ যাবত এক জায়গায় বসে আছে তরী। তার চোখ মুখ শ*ক্ত হয়ে আসছে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলেই ফেলল,

“আমি আর এ কাজ করতে পারব না।”

বলেই সামনের ব্যক্তিটির দিকে ফিরল। তার নাম ছাড়া আর কোনোভাবেই তাকে চিনে না সে। নামটুকুই পরিচয়। জেএস মাথা তুলে চাইল। তরী এবার শুকনো ঢোক গিলল। বলে উঠলো,

“আমি আর এসব করতে পারব না। তন্ময় আমাকে ভালোবাসে। সত্যিই ভালোবাসে। এভাবে দিনের পর দিন ওর সাথে ভালোবাসার মি*থ্যে নাটক করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি বিদেশ চলে যাচ্ছি। তন্ময় কে সবকিছু বলে আমি এখান থেকে চলে যাব!”

কথাগুলো বলতে গিয়ে তার গলা ভা*রী হয়ে আসছিলো। ভীষণ ক*ষ্ট হচ্ছিল তার। সামনের লোকটার দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিরে তাকাল। রা*গে ঠোঁ*ট কামড়ে ধরল। নেহাত টাকার ভীষণ দরকার।‌ মায়ের হঠাৎ অসুস্থতা। তাই তো উপায়ান্তর না পেয়ে লোকটার থেকে টাকা নিতে বাধ্য হয়েছিল সে। কিন্তু এর পরিণাম এতো ভয়ংকর হবে তা বুঝতে পারেনি।

তন্ময় তাকে ভালোবাসে, অ*ন্ধের মতো বিশ্বাস করে। তার বিশ্বাস নিয়ে তরী খেলতে পারবে না। হৃদয়ের অন্তঃপুরে এখনো সফট কর্নার আছে তার জন্য। এভাবে ঠকিয়ে গেলে তন্ময় আর কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। অশ্রু কণা গুলোকে শাসালো। অতঃপর ব্যাগ ভর্তি টাকা গুলো জেএসের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

“বাকি টাকা গুলোও খুব জলদি পরিশোধ করে ফেলব। আমি আসছি!”

“দাঁড়ান!”

“আমি বললাম তো…

“আপনাকে বসতে বলেছি।”

তরী ফের চেয়ারে বসে পড়ল। জেএস টাকা ভর্তি ব্যাগটা তরীর দিকে ফিরিয়ে বলল,

“এই নাটকের আজ শেষ পর্ব চলবে আর আপনি বলছেন চলে যাবেন। এটা কি করে হয় ম্যাডাম!”

“আমি বলছি যে …..

“আপনি কি বলছেন না বলছেন সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। আপনাকে আমি যেটা বলব আপনি সেটাই করবেন। চুক্তি এটাই হয়েছিল। কেবল আজকের রাতটা। কাল সকাল হলেই আপনার যেখানে মন চায় সেখানে চলে যান। তন্ময় কে সবকিছু বলে দিতে চাইলে বলে ফেলুন কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আজকের রাত আপনি কোনো বাড়াবাড়ি করবেন না।”

“যদি করি?”

“আপনার মায়ের হাসপাতালের বাইরে আমাদের লোক রয়েছে। এর মানে আপনি বুঝতে পারছেন মিসেস তরী!”

তরী হাসার চেষ্টা করল। তাচ্ছি*ল্যের হাসি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও টাকা ভর্তি ব্যাগ সমেত দাঁড়াল। জেএস একটা কার্ড তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“হোটেলের রেস্টুরেন্টে তন্ময় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। হোটেলে আপনার নামে একটা রুম ও বুক করা আছে। রাতে আপনি সেখানেই থাকবেন।”

“তন্ময়ের সাথে।”

“সেটা আপনার‌ ইচ্ছা।”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চোখে কালো সানগ্লাস জড়িয়ে কার্ড নিয়ে বিদায় হলো ক্যাফে থেকে। জেএস পিছন ঘুরে তাকাল। তার পিছনের টেবিলেই কফি মগে চুমুক দিল উষ্ণ চৌধুরী!

তরীকে এখানে আনার প্ল্যান উষ্ণ চৌধুরীর। তনয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায়, যাকে এতো বছর ধরে ভালোবেসে যাচ্ছে সে কোনো কালেই তাকে ভালোবাসবে না। মাঝে কিছুদিনের যা ছিল সব ভালোবাসার নাটক। তন্ময় কেবল তরীকেই ভালোবাসাতে পারে আর কাউকে না।
উষ্ণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। টেবিলের উপর পড়ে থাকা মানিব্যাগ হাতে নিল। মানিব্যাগটা তার। সেটা উল্টাতেই তনয়ার ছবি নজরে এলো। উষ্ণ মৃদু হেসে বলল,

“আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না নীলাম্বরী! তোমার চোখের জল আমার সহ্য* হয় না। মেনে নিতে পারি না। কিন্তু এখন যা হচ্ছে এসবে তুমি ক*ষ্ট পাচ্ছ। কিন্তু তোমার চাইতেও বেশি কষ্ট পাচ্ছি আমি। কারণ আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। বিশ্বাস করো নীলাম্বরী, তোমার ক*ষ্টে আমার কখনো সুখ হয় না। কিন্তু আমি অসহায়। এসবের দ্বারপ্রান্তে এসে আমায় দাঁড় করিয়েছো তুমি। কেবল তোমার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝানোর জন্যই এসব। তন্ময়ের জীবনে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি না থাকলেও ওর জীবন থেমে থাকবে না। কিন্তু আমার থেমে যাবে। আমার একলা জীবনে তুমি ছাড়া কেউ নেই। অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে, আমি হয়ে যাবো নীর হারা পাখি, সঙ্গীনি ছাড়া আজহারি আমার জীবন। আমার একমাত্র সঙ্গীনি‌ তুমি। জীবনসঙ্গী হিসেবে তোমায় গ্রহণ করেছি আরো আগে। তন্ময় সরে গেলেই তুমি আমার হবে। তোমার জীবন থেকে তন্ময়কে সরি*য়ে দিব,তোমাকে নিজের করে পাবো। হয়তো তুমি নিজেই স*রিয়ে দিবে। আজকের পর তো সরিয়ে*ই দিবে! ভুলেই যাবে তার কথা!”

ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির ঝলক। জেএস এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“স্যার কাজ হয়ে গেছে!”

উষ্ণ তার দিকে ফিরে মৃদু হাসল। তার কাজটা সহজ করে দিচ্ছে উষাণ। এসব সে কেন করছে উষ্ণ জানে না। তবে এখন জানার সময় নেই। রেস্টুরেন্টে তনয়াকে আনতে পারে উষাণ চৌধুরী। সে এটাই করবে। উষ্ণ নিজেও জানতে উষাণ কেন ডাকছে তনয়া কে। কোন কারণে?

কিন্তু উষাণের বিয়ের প্রস্তাবে উষ্ণের মাথায় আ*গুন ধরে উঠলো। আগ্নেয়*গিরির মতো উৎপাত শুরু করল সেখানে। যেকোনো মূহুর্তে মাথা ফেটে লা*ভা বের হবে। চোখ দুটোই উষাণ কে গিলে ফেলার জন্য যথেষ্ট। দাঁতে দাঁত চেপে উত্ত*প্ত দৃষ্টিতে কেবল উষাণকে দেখছিলো সে। এই ছেলের একটা ব্যবস্থা তো এবার করতেই হবে!

————–

এই মূহুর্তে তনয়া দাঁড়িয়ে সেই ফাইভ স্টার হোটেলের এক রুমে। রুম নাম্বার তার মনে নেই। আপাতত আছে রুমের বাথরুমে। ঝর্ণার কল ছেড়ে এর নিচে এসে দাঁড়াল। ঝরঝরিয়ে পড়া বারিধারার ছোঁয়া গায়ের সমস্ত নোংরা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল। জীবন থেকে কয়েকটা তিক্ত স্মৃতি এভাবে ঝেরে ফেলতে পারলে শান্তি পেত।

হাঁপিয়ে গেছে, ক্লান্ত লাগছে। শরীরে আর শক্তি নেই। কান্না করার সাহস করছে না। কার জন্য কাঁদবে? জীবনের আজ ২৫ টা বছরে তার প্রাপ্তি কোথায়? কিসের অভাব এতোটুকু জীবনে। কি চেয়েছিলো। অন্য সবার মতো একটা সংসার, স্বামী, বাচ্চা নিয়ে নিজের জগত। বেশি কিছু কি? অবাস্তব তো আর না। মা বাবাকে তো আর চায়নি। তাদের পাওয়া সম্ভব না। তবে একজন জীবনসঙ্গী কি সে ডিজার্ভ করে না।

ঝর্ণা বন্ধ করে দিল। জীবনের ২৫ টা বছরের পিছনে গিয়ে কিছু মনে করতে পারছে না। ভালো কোনো স্মৃতি নেই। আজ এখানে দাঁড়িয়ে কিছু মনে পড়ছে না তার। তোয়ালে শরীরে জড়িয়ে নিতেই দরজায় করাঘাত। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সেখানে। একটু দরজা ফাঁক করে উঁকি মার*ল। সাদা শার্টে আবৃত এলোমেলো চুলে দাঁড়ানো এক হ্যান্ডসাম যুবক দেখা যাচ্ছিল। তার শক্ত পেশিবহুল হাতে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল। দরজার ওতোটুকু ফাঁকেই তনয়া হাত বাড়িয়ে প্যাকেট টা নিতেই উষ্ণ তার গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

“বাইরে অনেক বৃষ্টি! এখানে এতোটুকুই জোগাড় করতে পেরেছি।”

তনয়া চোখ তুলে তাকাল। দরজার ওতোটুকুনি জায়গার মধ্য থেকে তনয়ার আঁখি জোড়া দেখতে পেয়ে নিমগ্ন হয়ে পড়ল উষ্ণ। তার ভিজে চুলগুলো আঠার মতো লেগে আছে কাঁধে। শুকনো ঢোক গিলে চোখ ঘুরিয়ে নিল। এভাবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিজের উপরই আর আয়ত্ত থাকবে না তার।

তনয়া প্যাকেট খুলে দেখতে পেলো একটা সাদা শার্ট, কালো জিন্স আর একটা ইনার। এটা দেখতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল সে। এই লোকটা এটা আনলো কিভাবে? হাতড়ে দেখেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সঠিক সাইজ দেখতে পেয়েই কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। দু হাতে প্যাকেট চেপে ধরে বলল,

“অসভ্য লোক একটা!”

চোখ মুখ খিচে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। আবার নিজেকেই শান্ত করল। লোকটা ছিল বলেই তো রেহাই পেল। নাহলে এখনো এই বৃষ্টির মধ্যে কাঁদায় পড়ে থাকতে হতো। যদি না তখন গিয়ে তিনি উঠিয়ে আনতেন তাহলে! তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। প্যাকেট দেখতেই শরীর তির*তির করে উঠল। লোকটা আসলেই সুবিধার না!

সাদা দেওয়ালের কারুকাজ পুরো ঘর জুড়ে। সোনালী আলোর মাখামাখিতে রোমাঞ্চকর অনুভূতির সৃষ্টি করছে। ড্রয়িংরুমের ডিভানে বসে আছে উষ্ণ। তার সামনেই বিশাল জায়গা জুড়ে বেলকনির স্বচ্ছ কাঁচের দরজা। বৃষ্টির তেজে ছিটেফোঁটা এসে ভিড়ছে দরজার উপর। পানি হয়ে সেটা গড়িয়ে পড়ছে দরজা বেয়ে। ভারী বর্ষণে ঢাকা শহরের অর্ধেক রাস্তা আজ ডু*বে যাবে। একটু বাদে বাদে বিদ্যুৎ ঝলকা*নির আলোতে আক্কেল গুড়ুম হবার অবস্থা।

জেএসের ঘর থেকে একটু আগেই গোসল সেরে এখানে এসেছে। পরনে তারও সাদা শার্ট আর কালো ট্রাউজার। তাড়াহুড়ো করে চলে আশায় চুলগুলোয় মুছতে পারেনি ঠিক করে। এখানে এসে হেয়ার ড্রায়ার ও খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ একটা তোয়ালে দিয়ে ঘসাঘসি করলে। কিন্তু সময় যেতেই শুষ্ক চুলগুলো আবারো নরম ভিজে হয়ে উঠল। টুপ টুপ করে পানি পড়ে তার পিঠ ভিজিয়ে ফেলছে।

এতে সে ভ্রুক্ষেপ না করে ডিভানে পা তুলে বসল। অ্যালকোহলের বোতল থেকে খানিকটা গ্লাসে ঢেলে নিল। কিছুক্ষণ আগে ক্লাইন্ট এই রুমে এসেই আলোচনা করেছে। তাদের জন্য আনা বিশেষ ওয়াইন এখনো পড়ে আছে এখানে। দুটো বোতল ভর্তি। উষ্ণ সেখান থেকে একটা গ্লাসে ঢেলে চুমুক দিল। দরজা খোলার শব্দে দ্রুত ওয়াইনের গ্লাস নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল।

গুটি গুটি পায়ে রুমে এসে দাঁড়াল তনয়া। বিব্রত আর লাজুকতায় তার চিবুক ঠেকেছে গলায়। ঠোঁট কামড়াচ্ছে বারংবার। উষ্ণ তার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল।‌ মন কেন জানি আজ স্থির থাকছে না। তার উপর তনয়ার বেশভুষা।
বাইরে কোনো দোকান থেকে না, বরং হোটেলের এই ফিমেইল কর্মচারী থেকে এসব এনে দিয়েছে সে। বাইরে যাবার অবস্থাই নেই।

সাদা শার্টটা একটু বোধহয় বড় হয়ে গেছে। হাতাটা ঝুলছে। তনয়া উপরে উঠানোর সাহস করছে না। উষ্ণ ঘোর লাগানো কামু*ক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আর তাকাবে না। সাথে সাথেই বেহায়ার মতো ফিরে তাকাল। শুকনো ঢোক গিলতে দেখল মুখটাই শুকিয়ে গেছে। দ্রুত ওয়াইনে চুমুক দিল। এখন একটু পর পর গলা ভিজানো দরকার!

গ্লাস রেখে এগিয়ে এসে বলল, “ঠিক আছো?”
তনয়া মাথা নাড়ল। মুখ তোলার সাহস করল না। কি এসব হচ্ছে তার সাথে। উষ্ণ স্যারের চোখাচোখি হতে আজ এতো কেন লজ্জা লাগছে। বেশ অনেকক্ষণ নিজের পা দুটোই দেখতে লাগল। ঘরের মেঝেটা সুন্দর।

উষ্ণ চৌধুরী বলে উঠলো, “খাবার অর্ডার করি, কি খাবে?”

তনয়া মুখ তুলে বলল, “না খাবো না!” তখনি হোটেল রুমের সৌন্দর্যতায় হতভম্ব হয়ে গেল। হা হয়ে চারদিক দেখার ছলে চোখ পড়ল উষ্ণ স্যারের দিকে। স্তব্ধ হয়ে পড়ল সে। উষ্ণ স্যারকে আজ যেন একটু আলাদাই লাগছে। উষ্ণ মৃদু হেসে বলল, “আসো!”

তনয়া ঘোরে আটকে ছিল। “আসো” বলতেই পা ফেলতে গিয়ে নিজের পায়ের সাথে পেঁচিয়ে পড়ে যেতে নিল। উষ্ণ না আসলে বোধহয় নিজেই পড়ে যেত। বাঁচতে গিয়ে উষ্ণের বুকের কাছে খা*মচে ধরল। টান লেগে শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেছে। খাম*চির দাগ গিয়ে বুকের মাঝে! অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তনয়া আহ*ম্মক বনে গেল। এদিকে বুকটা জ্বা*লা করছে দেখে উষ্ণ ঠোঁট চেপে ধরল। আজ তাকে বেহাল হওয়ার হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। দ্রুতই মনে হচ্ছে নিজের উপর কন্ট্রোল হারাবে সে।

“সরি সরি স্যার, আমি বুঝতে পারি নি।”

দ্বিধা*বোধ, ল*জ্জা আর কাতরতায় তনয়া উন্মাদ হয়ে গেল। চোখ মুখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এসব উল্টাপাল্টা কি করছে সে। এতোটা ও তো চাইল্ডিশ না ও। আজ কেন এমন হচ্ছে। উষ্ণ নরম স্বরে বলল, “ইটস ওকে!”

তনয়ার হাতটা ছেড়ে আবারো ডিভানে গিয়ে বসল। পিছু পিছু তনয়াও সেদিক এসে বসল। সামনে বেলকনির দৃশ্য দেখে দ্বিতীয়বারের মতো মুগ্ধ ফলোঊ। উষ্ণ তখন ডিভানে আরাম করে বসে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে তনয়াকে দেখতে বিভোর। তনয়া উচ্ছ্বাসে সমেত বলে উঠলো,

“এটা তো খুব সুন্দর স্যার, ইশ কি দারুণ!”

উষ্ণ জবাবে বলল, “হ্যাঁ, দারুণ!”

তনয়া আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগল। মেঘের গুঁড়গুড় গর্জন, বজ্রপা*তের ঝলকা*নি, আসমান যেন ভেঙ্গে জমিতে নেমে আসে। আচমকা এক চিলতে হাসি দেখা গেল ঠোঁটের কাছে। তনয়া এদিক ফিরতেই উষ্ণ মুখ ঘুরিয়ে নিল। তনয়া এখন একটু কমফোর্টেবল ফিল করায় পা তুলে বসল। বলল,

“বাব্বাহ, বড়লোক হলে কি লাভ। আপনারা বড়লোক বলে কতো ভালো ভালো জায়গায় থাকেন আর সৌন্দর্য উপভোগ করেন।”

“কেন? এতোক্ষণ তো তুমিও সৌন্দর্য নিচ্ছিলে!”

“মানে?”

“কাদামাটির সৌন্দর্য!”

তনয়া সামনে ওয়াইনের দিকে ফিরে বলল, “মজা নিচ্ছেন। হ্যাঁ নিন, আপনি তো নিবেনই।”

উষ্ণ হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরল। দু হাতে ওয়াইনের গ্লাস চেপে ঝুঁকে গিয়ে বলল, “বয়ফ্রেন্ড চিট করায় কি কাদামাটির সাথে প্রেম করছিলে? ভালো বুদ্ধি তো তোমার?”

তনয়ার মুখটা মলিন হয়ে গেল। ওয়াইনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি এক গ্লাস নিব!”

“হ্যাঁ শিউর!” উষ্ণ নিজে তাকে গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে বলল, “একটু খেলে নেশা ধরে না। টেস্ট করার জন্য তুমি খেতেই পারো!”

গ্লাস এগিয়ে দিতেই তনয়া একদমে পুরোটা শেষ করে ফেলল। উষ্ণ হা হয়ে চেয়ে রইল। তনয়া চোখ মুখ খিচে নিল। কি বিস্বাদ! উষ্ণ হেসে উঠে বলল,

“তাড়াহুড়ো কেন করছো? ওটা তোমার বয়ফ্রেন্ড না যে পালি*য়ে যাবে!”

তনয়া এবার নিজেই যেচে গ্লাসে ওয়াইন ঢাললো। খেতে ওতোটাও খারাপ লাগছিলো না। তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বলুন বলুন, আজ আপনার দিন। আপনি বলবেন আমি শুনব।”

তনয়ার কথায় উষ্ণ খানিকটা চুপসে। নিরব প্রহর গেল কিছুক্ষণ। তনয়া ওয়াইনের গ্লাসে কেবল চুমুক দিচ্ছে আর বাইরের বৃষ্টি উপভোগ করছে। তার পাশে বসা উষ্ণ কেবল দেখছে তার প্রেয়সীকে। তার নীলাম্বরী! দেখার ছলে খেয়াল করল ভিজে চুলে তনয়ার পিঠ ভিজে উঠেছে। সাদা শার্ট আটকে আছে তার পিঠে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সোজা হয়ে বসল সে। আরেকটু কাছাকাছি এসে, তনয়ার পাশে!

তনয়া তখন নিজের ভাবনায় নিমগ্ন। বার বার মনে পড়ছে একটা কথা। একটি ঘটনা। তন্ময় আর তরীর সাথে। এই হোটেলে, কোন এক রুমে দুজনে এক বিছানায়! চোখ বন্ধ করে নিল। শক্ত হাতে গ্লাস চেপে চুমুক দিল। এসব ভাবতেই শরী*রে অস*হ্য যন্ত্র*ণা শুরু হয়ে যায়। হৃদয় কেঁ*পে উঠে।

পাশে উষ্ণ কেবল তার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে আর তনয়াকে দেখছে। দেখতে দেখতে একটা বোতলের অর্ধেক ওয়াইন তনয়া সাবার করে ফেলেছে। প্রথম দিনেই এই। আবারো গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে গেলে উষ্ণ তার হাতটা চেপে ধরে বলল,

“থামো! সামলাও নিজেকে!”

তনয়া হেসে উঠল। করুণ সুরে বলল, “তন্ময় আজ এখানে, তরীর সাথে, কোন একটা রুমে!”

বলতে গিয়েই চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। উষ্ণ বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মুছিয়ে বলল,

“ওর ভাবনা ছেড়ে দিলেই তো পারো!”

কপালের চুল গুলো কানে গুঁজে তনয়া বলে উঠলো, “এতোই কি সহজ? ভালোবাসা ভুলে ফেলা কি এতোই সহজ আপনার মনে হয়?”

ফিরে তাকাল উষ্ণের। চোখে চোখ রেখে বলল, “আপনি বলুন সহজ কি?”

“না সহজ না!”

“তাহলে?”

উষ্ণের কথা উপেক্ষা করে আবারো এক গ্লাস সাবার করল। হৃদয় জ্ব*লে যাচ্ছে। বিষে বিষে বিষক্ষ*য়! তনয়া নেশা হয়ে যাচ্ছে। সে এখনই টুলছে। উষ্ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার পানে ফিরে চাইল। তনয়া সামনে তাকিয়ে হেসে বলে উঠলো,

“আপনি জানেন, আমি ওকে কতো বছর ধরে ওকে ভালোবাসি! ৮ বছর! খুব কম সময় কি? একা একা আটটি বছর এমন এক পুরুষ কে ভালোবাসা যে কখনোই আপনার হবে না। ভাবতে পারেন কথাটা?”

উষ্ণের চিত্ত চিরে বেরিয়ে এলো তপ্ত এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস। বিরবির করে বলল, “আর আমি যে গত পনের বছর তোমাতে মত্ত হয়ে আছি তার বেলায়!”

কথাটা তনয়ার কানে যায়নি। মনের সকল দুঃখ আজ উজার করে বলে দিতে ইচ্ছে করছে তার। তার মনের দুঃখ বলার একটি মানুষ ও নেই। কি আশ্চর্য! কেউই নেই তার!

নিঃশব্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নাক টেনে তনয়া ঢোক গিলে বলল,

“ভালোবেসে আমরা কেন ভুল করি?”

“কারণ আমরা ভুল মানুষকে ভালোবাসি!”

তনয়া এদিক ফিরে উষ্ণের চোখে চোখ রেখে বলল, “যদি জানতাম তারা ভুল তাহলে কি কখনো ভালোবাসতাম!”

“ভালোবাসা কি এতো পরিমাপ করে হয় তনয়া?”

তনয়া চেয়ে রইল তার পানে। শার্টের ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসা খোলা বক্ষের দৃশ্য, উষ্ণের গভীর দুটি দৃষ্টি, এই শীতল আবহাওয়া আর অদ্ভুত পরিস্থিতি! মনের চাহিদা না থাকলেও দেহের চাহিদা বলে একটা কথা আছে। যুবতীর মন এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যেখানে সে কাউকে চায়, তাকে কাছে পেতে চায়, সান্নিধ্য চায়!
তনয়া ঘোর লাগা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তার পানে। মনের নি*ষিদ্ধ অনুভূতি গুলো কে প্রশ্রয় দিতে চাইছে না। মুখ ঘুরিয়ে মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠল। কথাবার্তায় কখন যে কাছাকাছি চলে এসেছে বুঝতে পারেনি। উষ্ণের গা থেকে আসা তীব্র পারফিউমের ঘ্রাণ তাকে মাতাল করে তুলছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে যাচ্ছে শিহরণ। এই অনুভূতির সাথে সে পরিচিত, এই সুঘ্রাণ তার সে চিনে। সেইদিন অন্ধকার রাতে স্যারের কাছে আসা কিংবা ওইদিন স্যারের ঘরেতে তার ঘাড়ে কাছে গভীর চুম্বনে তনয়ার মনে কোনো অনুভূতি মাথা জাগা উঠেনি তা হতে পারে না। কিন্তু বরাবরই এসব সে অস্বীকার করে এসেছে। প্রশ্রয় দেয়নি কখনো। ভেবেছে এসব প্রশ্রয় দেওয়া অ*ন্যায়। সে তো তন্ময়ের! কিন্তু আজ এখন এসব ভাবনা তার ধুলি*সাৎ হয়ে গেছে। কৃত্রিম এসব অনুভূতি থেকে ঘাড় ধা*ক্কা দিয়ে বের করে এনে বোঝানো হয়েছে, এতোদিন কেবল স্বপ্নের মধ্যে দিয়েই বেঁচে ছিল সে। সবই স্বপ্ন!

চোখের সামনে সব ঝাপসা লাগছে। না সে কাঁদছে না। মাথা যন্ত্র*ণা করছে। বুক জ্বা*লা করছে। কি আশ্চর্য! হঠাৎ এমন অস্থিরতা উন্মাদ হয়ে উঠল সে। উষ্ণের নরম সুরে সবকিছু কেমন শীতল হয়ে উঠল। উষ্ণ তার মাথায় হাত রেখে বলল,

“খারাপ লাগছে? বলেছিলাম এতো খেয়ো না। প্রথমবারই কেউ এমন করে? পাগল কেন হয়ে যাচ্ছ?”

“উষ্ণ স্যার!”

“হুম!”

“আমি কি দেখতে খুব খারাপ।”

“এসব কি বলছো?”

“আপনি জানেন সেদিন তন্ময় আমার এতোটা কাছে এসে ফেরত চলে গেছে। সে আমায় চুমু খেতে পারেনি। অথচ আজ, আজ ও সবার সামনে তরীকে চুমু খাচ্ছিল। এতোটাই কি কুৎ*সিত আমি? এতোটাই নোং*রা! আমার কি মন নেই, ভালোবাসা যায় না আমায়!”

বলতে বলতে কেঁদে ফেলল সে‌। জল এসে ভিড়ল উষ্ণের লোচনে। দ্রুত সেটা মুছে নিল। বুঝতে পারল সেদিন কিছু ঘটেনি। তনয়ার নে*শা ধরে গেছে। তার কথা জড়িয়ে আসছে। উষ্ণ তার বাহুটা চেপে ধরে কাছে এসে কঠোর শব্দে বলে উঠলো, “তোমায় বললাম না চুপ করতে। বার বার সেই তন্ময়ের নাম নিয়ে আমার মাথা গ*রম করিও না তো। ভালো লাগছে না! আরেকবার তন্ময়ের নাম নিলে এই রুম থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিব তোমায়!”

তনয়া হেসে উঠল।নরম ঠান্ডা হাতটা উষ্ণের গালে রেখে বলল, “আমায় কেউ ভালোবাসে না। আপনিও ভালোবাসেন না আমায়! করু”ণা সব! ঢং, প্রতার*ণা, ছলনা! ভালোবাসা বলতে কিছু নেই!”

সকল বাঁধা নিষেধ ভুলে উষ্ণ আগলে ধরল তনয়াকে। নিজের বাহুডোরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি ভালোবাসি তোমায়, কোনো ছ”লচাতুরি নেই এখানে। তুমি কি এটা বুঝতে পারো না!”

তনয়া এখনো ঘোরের মধ্যে। কথা আদৌও তার কানে গেছে কি না সন্দেহ। সে বরঞ্চ উষ্ণের বুকে মাথা রেখে বলল, “ঠান্ডা লাগছে!”

আচমকা উষ্ণ তাকে দু হাতে কোলে তুলে নিল। তার কোলের মধ্যে তনয়াকে বসিয়ে শক্ত বাহুতে জড়িয়ে ধরল। তনয়ার ভিজে পিঠে হাত রাখতেই মনে অস্থিরতা জেগে উঠেছে। তনয়াও চোখ বুজে পড়ে রইল তার বুকের মধ্যে। থিতুনি তনয়ার মাথার উপর রেখে বলে উঠল, “গরম লাগছে এখন!”

অস্ফুট স্বরে সে বলল,
“হুম!”

উষ্ণ হেসে উঠল। আজ তার উষ্ণতায় তনয়া ঘিরে গেছে। এই স্বপ্ন তার বহুদিনের। তার শুষ্ক ঠোঁটজোড়ার দিকে নজর পড়তেই শুকনো ঢোক গিলে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তনয়া বুক থেকে মাথা তুলে তার পানে চাইল। কালচে মসৃণ অধরজোড়ার আকর্ষণীয়তায় সে বিস্মিত! চুম্বকের মত যেন তাকে টানছৈ। ঠোঁট জোড়া নড়েচড়ে উঠছে। উষ্ণ বলছে, “সকাল হলেই তুমি এসব ভুলে যাবে, তখন কি হবে তনয়া?”

নেশা*ধরা দৃষ্টিতে তনয়া সেই মুখের পানে চেয়ে রইল। তার অধরজোড়ার নড়বড় আচরণ, উষ্ণ স্যারের উষ্ণতা, এতো কাছে আসা, এই গরম নিঃশ্বাস! তনয়া জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “আপনি মনে করিয়ে দিবেন!”

বলেই অকস্মাৎ সেই ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিল। উষ্ণ হতবাক! যেই নদীর স্রোত বাঁধ দিয়ে এতোক্ষণ প্রতিরোধ করে রাখছিলো সেই বাঁধ আজ ভেঙ্গে দিয়েছে তনয়া নিজেই। যেন ভ্রমরের মাঝে এক ফোঁটা গোলাপ। এই যে উন্মাদনা সে দমিয়ে রাখছিলো সব কিছু উচ্ছন্নে চলে গেল। তনয়ার ভেজা চুলগুলোয় হাত ডুবিয়ে গভীর স্বরে বলে উঠলো, “ফাইন দেন, ডোন্ট রিগ্রেট ইট, তনয়া। রিমেম্বার, ইউ ওয়্যার দ্য ওয়ান হু টুক দ্য ফার্স্ট স্টেপ।”

তনয়া বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ। উষ্ণ আচমকা তাকে ধরে ডিভানের উপর শুয়ে দিয়ে তার উপর এগিয়ে গেল। হামলে পড়ল ওই ঠোঁট জোড়ার উপর, তার মুগ্ধতা তাকে ডাকছিলো, যার নে*শায় এতোক্ষণ নিমজ্জিত ছিল। উষ্ণ তো এতোক্ষণ কোনো নে*শাই করেনি। নে*শা তার এখন শুরু হয়েছে। দীর্ঘ দিনের অপেক্ষার পর আজ প্রাপ্তির রেশ। এতো সহজে কি ছেড়ে দিবে। একটু থেমে আবারো তার ঠোঁট দুটো আঁকড়ে ধরে চুমু খেতে লাগল। তনয়া ও যেন কোনো ছাড় দিতে চাইছে না। তার হাতের নখের আঁচ*ড়ে উষ্ণের ঘাড়ে দা*গ কেটে গেল। ঠোঁটের স্বাদ ছেড়ে দিয়ে উষ্ণ মুখ লুকালো তার গলার কাছে। তার ভিজে কেশের ঘ্রাণে আরো নেশা*ক্ত করল নিজেকে। তার বুকের মধ্যে কুন্ডলী পাকিয়ে গেল তনয়া। কাঁধের কাছে উষ্ণের নরম চুমু পুরো শরীরে ত*রঙ্গ ছুটে দিচ্ছিলো। কি অদ্ভুত সেই সৌরভ! উষ্ণ ফের দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে অধরজোড়ায় ঠোঁট ডুবাল!

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৪০

নরম তুলতুলে বিছানার উপর ঢেউ খেলানো শরীরটা নড়চড়ে উঠল। নাকে ভেসে আসে তীব্র সুঘ্রাণে। সুঘ্রাণে মাতাল হবার জো! মেয়েটা বুক ভরে নিল তীব্র সুঘ্রাণ। অযাচিত মন বলছে, গন্ধ তার গায়ে থেকে আসছে। আশ্চর্য! এটা তো তার গায়ের গন্ধ নয় তাহলে? সে কি এরকম সুঘ্রাণের সাথে মাখামাখি করছিলো নাকি। মিনিমিনি চোখ খুলে এদিক তাকাল। দু’চোখ ভর্তি ঘুমের রেশ। তারা অবাধ্য হয়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়ল। বিছানায় মাথা গুঁজে নিয়ে সাপের মতো আঁকা*বাঁকা শরীরটা মুচরাতে লাগল। আবারো চোখ খোলার প্রয়াস।

ঝাপসা ঝাপসা লোচনে এদিক ফিরতেই এক সুদর্শন পুরুষের মুখখানি ভেসে উঠল। সে ভ্রু কুঁচকে মুখটা দেখার চেষ্টা করল। এই জীবনে কখনো ঘুম ভেঙ্গে পুরুষের মুখ দেখবে বলে আশা করেনি। লোকটা কে? তন্ময় নাকি?

তন্ময়ের কথা মাথায় আসতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। দুই হাতে মাথা চেপে ধরল। পর্দায় আড়ালে জানালা ভেদ করে তীর্যক আলোর রশ্মি এসে পড়ছে মেঝেতে। কি আশ্চর্য! সকাল হয়ে গেছে। সে কোথায়?

এদিক ওদিক চোখ ফিরতেই তনয়ার মনে পড়ল রাতের কথা। গত রাত, সেই রাত যেই রাতে জীবনে প্রথমবার কোনো পুরুষের সংস্পর্শে এসেছিলো সে, ছুঁয়েছিল তাকে। আদরে মাখামাখি হয়ে বিছানা অবধি… ভাবতে গিয়েই শরীর শি*উরে উঠল। তনয়া থতমত খেয়ে পাশে তাকাতেই উষ্ণ চৌধুরীর মুখটা দেখে থড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে নামল। আরেকটুর জন্য চেঁচাতে যাচ্ছিল। মুখে হাত চেপে ত*টস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের অকর্মের কথা পুরোপুরি মনে না পড়লেও অর্ধেক, অস্পষ্ট যা দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠছে সেসবই শি*উরে উঠছে সে। নিজেকে দেখল এবার। না! নিজের পরনে শার্ট টা তার নিজেরই। এমনকি জিন্স ও। কেবল শার্টের সামনে দুটো বোতাম খোলা দেখে শক্ত হাতে সেটা চেপে উঠল। ঠোঁট দুখান চেপে সামনে তাকাল। উদাম শরীরে উষ্ণকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেই মাথায় শতশত প্রশ্নের ঝোঁক এসে ভিড়ল। কি করেছিল তারা? কতোটুকুই বা করেছিল তারা? না আর ভাবতে পারছে না। নিজের করা পা*পের কথা মনে করতে না পারলেও অপরা*ধবোধে সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। কোনো কিছু না ভেবে টেবিলের উপর থাকা নিজের ব্যাগটা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। বের হতে হতে শার্টের বোতাম আটকে নিয়ে হাতাটা ঢেকে নিল ভালোভাবে। এভাবে পালি*য়ে আসতে গিয়ে নিজেকে চো*র মনে হচ্ছিল তার।

দরজা বন্ধের শব্দে ঘুমের মধ্যেই মৃদু হেসে উঠল উষ্ণ চৌধুরী। যেই বালিশে এতোক্ষণ তনয়া ঘুমিয়ে ছিল সেটাই একহাতে আগলে নিল মুখের কাছে। তনয়ার মাতাল করা সুগন্ধে উন্মাদ হয়ে উঠল মুহূর্তের মধ্যেই। বিরবির করে বলে উঠলো,

“পালাও নীলাম্বরী, পালাও! আমিও দেখি তুমি এই উষ্ণের হাত থেকে কতোদূর পালাতে পারো। কোথায় গিয়ে থামবে? সেখানে থামবে সেখানেই আমায় পাবে। তুমি নিজে এসে ধরা দিয়েছ পাখি, উষ্ণের মনের খাঁচা থেকে পা*লানো এতোও সহজ না!”

ফের ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বালিশে মুখ গুজল সে!

হনহন করে হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তনয়া! হঠাৎ পা দুটো থেমে গেল, চোখ পড়ল একটা রুমের সুন্দর নকশা আঁকা কালো খয়েরী দরজা। সাদা পাথরে ৪০৩ নাম্বার লেখাটা উজ্জ্বল করছে সেখানে। তন্ময়ের কথা মাথায় আসতেই মনের অজান্তেই ফুঁসে উঠল। পায়ের গতি বাড়িয়ে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেলো!

———

দরজা ধাক্কানোর শব্দেও ঘুম ভাঙছে না মৌয়ের। তনয়া লাগাতার ফোনের কল্যাণে ম্যাডামের ঘুম ভাঙাতে সক্ষম হলো। দরজা খুলে মৌ কে কোনো সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে নিল। মৌ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সেকেন্ড দুয়েক পিটপিট আঁখি মেলে চেয়ে রইল। কি হলো ব্যাপারটা?

ঘরের দরজা জানালা সমস্ত কিছু বন্ধ করে এসে দাঁড়াল আয়নার সামনে। একে একে শরীরের সমস্ত বস্ত্র খুলে ফেলে নিজেকে দেখতে লাগল নিখুঁতভাবে। গলায় আচরের দাগ কিংবা কামড় বা কিছু যাতে মনে করতে পারে গতরাতে কি হয়েছিল? কি হয়েছিল? না কিছু নেই? শরীরের কোনো দাগের চিহ্ন না পেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল সে। হতভম্ব হয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করলে কেবল একটি কথাই মনে করে, উষ্ণ স্যার বুকের মধ্যে লুটিয়ে পড়েছিল সে। তার গায়ের গন্ধ নিচ্ছিল প্রাণভরে। বুকের মধ্যে তাকে শক্তপোক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে সে। আর কিছু বলছিলো, কিছু তো বলছিলো। মনে পড়ে না সেসব! কি হয়েছিল তার? গতরাতে কেনই বা এতো কাছাকাছি গিয়েছিল সে। কেনই বা এতো ঘনিষ্টতা? কেন?

কোনো জবাব নেই, নেই কোনো উত্তর। কান্না থামানোর চেষ্টায় দাঁত খিচে রইল সে। রেগে চুলগুলো এলোমেলো করে নগ্ন শরীরটাকে টেনে বাথরুম অবধি নিয়ে গেল শাওয়ার নেবার জন্য। আজ এটাকে শরীর মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে যেন কোনো নর্দমা! ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা! মাথা ঠান্ডা করল। শরীর শীতল হয়ে উঠল। তোয়ালে পেঁচানো শরীরটা নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই মেঝে থাকা শার্টটা টেনে তুলল। নাকের কাছে নিচেই তীব্র ঘ্রাণে মাথা চাড়া দি্যষ্টয়ে উঠল। মস্তিষ্ক আবারো জ্বালাতেন করছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে যাচ্ছে শিহরণ। তনয়া মুঠো হাতে শক্ত করে শার্টটা ধরে বসে পড়ল বিছানায়!

———-

অন্যদিনের তুলনায় আজ দেরি করে অফিস আসায় ম্যানেজার সাহেব একবার উঁকি দিয়ে গেলেন টেবিলের কাছে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে শুধালেন, “ঠিক আছেন মিস তনয়া?”

তনয়া হকচকিয়ে উঠে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,‌“মানে স্যার, ঠিকই তো থাকব!”

চোখে মুখে ভয়ের ছাপ প্রখর। কেবল মনে এই সবাই জেনে গেল। সবাই বুঝে যাবে সে উষ্ণ স্যারের সাথে একটা গোটা রাত কাটিয়েছে। পুরো রাতভোর চুপসে ছিল স্যারের বক্ষদেশে! গতরাতের কথা মনে পড়তেই আনমনে ওদিক ফিরে তাকাল। তন্ময় আজ অফিসে আসেনি।

ম্যানেজার স্যার হেসে হেসে বলেন, “না দেরি করে আসলেন তাই। শরীর খারাপ করেনি তো আবার। কাজের যেই প্রেসার নিচ্ছেন, উষ্ণ স্যার তো পারে না সব কাছ আপনাকে দিয়েই করায়।”

জবাবে তনয়া কেবল হাসে। উষ্ণ স্যারের কথা উঠতেই কেবিন ছেড়ে তিনি বেরিয়ে আসেন। তনয়া ওদিক ভুলেও ফিরে তাকায় না। সে চোখাচোখিই হতে চায় না উষ্ণ স্যারের।পরনের স্যুটটা খুলে রেখে কেবল সাদা শার্ট আর ফরমাল প্যান্টে বাইরে বেরিয়ে আসে উষ্ণ স্যার। হাতে গোটা কয়েক ফাইল। কখনোই টাই পরে না সে। তাই শার্টের উপরের বোতাম দুয়েক খোলা থাকে সর্বক্ষণ। আজও তাই! সেখানেই গতরাতের নখের আঁচড় ছেড়েছে দারুণ নকশা। চোখে যেন লাগে, নাকি লাগার জন্যই এমন বেশভুষা।

তনয়ার টেবিলের কাছে না গিয়ে পা ঘুরিয়ে আসে জ্যোতির থাকে। ফাইল গুলো টেবিলে রেখে রোবটের মতো কতো গুলো কথা বলে। জ্যোতি কেবল মাথা নাড়ে। সে বিস্মিত, বিমোহিত! স্যার যে তার টেবিলের সামনে এটাই তো বিশ্বাস হচ্ছে!
মেয়েগুলোও বড্ড নাছোড়বান্দা। স্যার কেবিনে থেকে কি বের হয়েছে এরা বাজপাখির চোখ দিয়ে স্যারকে দেখে। কি নিখুঁত পর্যবেক্ষণ! যেন জীবনের একমাত্র কাজই কেবল এটা। এমন রমণীদের চোখ থেকে বাঁচা এতো সহজ না। গতরাতে তনয়ার নখের আঁচড় যে কেবল তার বক্ষদেশ নয়, তার পৃষ্ঠদেশ এবং ঘাড়ের কাছে নিপুণ নকশা এঁকেছে তা সকলের চোখে পড়ল। এরা একেকজন স্যারের ঘাড়ের দিকটা দেখেই থেমে যায়নি। গলার কাছে দাগটা নিয়েও পরামর্শ শুরু করল। এদের গুচুর গুচুর উষ্ণের কানে যায়নি এমন হতেই পারে না। তবুও সে ভাবলেশহীন!

স্যার কেবিনে চলে যেতেই মিটিং বসলো। গতরাতে স্যার কোনো মেয়ের সাথে ছিল এটা বের করতে তাদের বেশিক্ষণ সময় লাগল না। তরী তো ছুটে এসে তনয়াকে ধাক্কা মেরে বলল,

“কিরে? স্যার গতকাল কোন মেয়ের সাথে ছিল?”

“কি?” চেঁচিয়ে উঠল যে একটু। সকলে আলোচনা ছেঁড়ে তনয়াকে দেখতে লাগল। সে ইতস্তত বোধ করে বলল, “কি বলছিস?”

“বলছি স্যার কালরাতে কোনো মেয়ের সাথে ছিল। দেখিসনি? মেয়ে কি আদর করেছে। গলায়, ঘাড়ে আর কোথায় কোথায়…

তনয়া সহ্য করতে না পেরে উঠে দাঁড়াল। জ্যোতি এসে ন্যাকাকান্না করছে, “কই ভাবলাম, স্যার কে পটিয়ে প্রেম করব, এদিকে স্যার কোন মেয়ের সাথে কি না করে আমাদের দেখাচ্ছে। সহ্য হয় এসব!”

তনয়া শুকনো ঢোক গিলে এদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে গেল। এখানে থাকলে তার রক্তচাপ বাড়বে, শেষে মাথা ফেটে মারা যাবে। অস্থিরতা আর অস্বস্তি নিয়ে গেল ক্যান্টিনে। এককাপ গরম চা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করে আবারো গবেষণায় নেমে পড়ল। গতরাতে কি হয়েছে ব্যাপারটা স্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখবে! না না, মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে সে। কস্মিনকালেও সম্ভব নয় তার দ্বারা।

গভীর ভাবনা চিন্তা করতে করতে এসে দাঁড়ায় লিফটের কাছে। দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকে গিয়ে আবারো ভাবনা চিন্তায় পড়ে যায়। কারো গভীর ধ্বনি কানে শোনা মাত্র ভাবনা চিন্তার মাঝে ভূমিকম্পন শুরু হয়। তনয়া হকচকিয়ে পিছন ফিরতেই দেখতে পায় উষ্ণ স্যার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দু হাত পকেটে ঢুকিয়ে এদিক ফিরে আছে। মুখে তার দুষ্টু মিষ্টি হাসি। ঠোঁট কামড়ে বলে উঠে,

“এতো কি ভাবছো যে আমায় খেয়াল করলে না?”

তনয়া আমতা আমতা করে জবাব দিল, “কককিকিছু না!”

“আমার কথা?”

তনয়া হকচকিয়ে উঠে। উষ্ণ স্যার কথা বলতে বলতে এবার কাছে চলে এসেছে। আর তিনি আরো কাছেই এগিয়ে আসছেন। পিছন ভিড়তে ভিড়তে তনয়া পিঠ ঠেকে দেওয়ালে। উষ্ণ স্যার ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলেন, “সকালে পালিয়ে গেলে কেন?”

উষ্ণ স্যারের গলার দাগ এখন নজরে পড়ল তনয়ার। ছিঃ ছিঃ এসব কি? এটা কি সে করেছিলো? ভাবতে পারছে না। লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। তার লজ্জিতবিষর্ম মুখখানি দেখে ভীষণ মজা পায় উষ্ণ। দু আঙুলে থিতুনি ছুঁয়ে বলে, “আমার দিকে তাকাও, কথা বলো! জিজ্ঞেস করছি কিছু? এখন বলো না গতরাতের সব কথা ভুলে গেছো?”

মুখটা উঁচু করিয়ে চোখে চোখ রেখে কথাটা বলে উষ্ণ। তনয়া হাঁসফাঁস করে উঠে। মনে জোর এনে মিনমিনিয়ে বলে, “কি হয়েছিল গতরাতে?”

উষ্ণ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে ফের। এগিয়ে এসে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে, মনে করিয়ে দিব?”

তনয়া মুখ ফেরানোর আগেই উষ্ণ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার অধরজোড়া। তনয়া ছটফট করতে থাকে। দু হাতে উষ্ণ স্যারকে পিছন ঢেলতে থাকে। উষ্ণ এতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না। বরঞ্চ এক হাতে তার হাত দুটো শক্ত করে ধরে অন্য হাতে চুল গুলো মুঠোয় নিয়ে আরো জোড়ালো ভাবে চুম্বন করতে উদ্যত হয়! মিষ্টি ভালবাসার সাথে যেন রাগের হিসাবনিকাশ করছে। একে একে কষছে রাগের পাল্লা!

তারা বোধহয় ভুলেই গেছে তারা লিফটে ছিল। তনয়ার সেই কথা মনে থাকলেও উষ্ণের মনে ছিল না। নয়তো পরোয়া করল না। এসবে তার কিছু যায় আসে না। লিফটের দরজা খুলে যেতেই সামনের দৃশ্য দেখে জেএস হকচকিয়ে উঠে। পিছন ফিরে দেখে কেউ দেখছে কি না। দ্রুত লিফটের বোতাম চাপছে যেন দরজা বন্ধ হয়ে যায়। স্যারের সবুর বলে কিছু নেই। এইখানেই এসব করছে! অফিসের কেউ জেনে গেলে কি কেলেঙ্কারি ঘটবে কোনো ধারণা নাই। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই জেএস হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বিরবির করে দোয়া করছে, “স্যার হুশ জ্ঞান যেন ফিরে আসে!”

#চলমান