তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-৬৫ এবং শেষ পর্ব

0
11

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৬৫ ( #শেষ_পর্ব )

জানালার শুভ্র রাঙা পর্দা উল্টেপাল্টে নৃত্য করছে, চকচক করছে ঘরের মেঝে। ক্ষণে ক্ষণে ঠান্ডা হাওয়ায় কেশ গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তবু তাড়াহুড়ো নেই। নিবিড় নিস্তব্ধ দুপুর। এর চাইতেও নিস্তব্ধ ঘরটা। এ দিকের ঘরটা দক্ষিণ মুখী। আলো বাতাস না চাইতেও ঘর জুড়ে আলো বাতাস।এখন আর আলো ভালো লাগে না তার। ইচ্ছে করে গুমোট, অন্ধকার, নিশ্চুপ ঘরে একা থাকতে। যে ঘরে থাকবে না কোনো আলোর হাতচ্ছানি, দমকা বাতাসের ছোঁয়া, থাকবে না কোনো সাড়াশব্দ, মানুষের নিঃশ্বাস। একা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। খুব একা!

আহ পর্দাটা জ্বালাচ্ছে অনেক। পর্দার নৃত্যে এই ফুলদানিটা গড়িয়ে পড়ল বলে। ওই দেখো দেখো, বলতে বলতে গড়িয়ে পড়ে পেল। সে চেয়েও পারল না আটকাতে। তার চোখের সামনে ছোট্ট শৌখিন ফুলদানির কয়েক শ টুকরো মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। এর চেয়েও শত টুকরো হয়েছে তার হৃদয়টা। আহা! শব্দ শুনে ঝড়ে*র বেগে ঘরে ঢুকল শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী। হম্বিতম্বি করে ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক ফিরে তাকাল। তনয়াকে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে। তনয়া মুখ ফিরে আছে তার দিকে। হাতটা বাড়িয়ে দেখাল মেঝেতে পড়ে থাকা ফুলদানিটা। উষ্ণ তনয়ার মুখের পানে চেয়েও চোখ ফিরিয়ে নিল। ইদানিং তার চোখাচোখি হতে ভ*য় করে তার। নিজেকে অপরা*ধী মনে হয় ভীষণ। তার জন্যই তো মেয়েটার আজ এই হাল। আহ*ত হৃদয় নিয়ে ফুলদানির দিকে পা বাড়াল।

একটু একটু করে ভা*ঙা টুকরো গুলো হাতে নিচ্ছে। আচ্ছা টুকরো জোড়া যায় না কেন? কেন এতো শক্ত কাজ এটা?

আরে সাবধানে! বলার আগেই হাতটা কে*টে গেল। তনয়া উঠতে গিয়ে বসে পড়ল শক্ত ভাবে। দু হাতে মুঠ করে নিল হুইলচেয়ার। ইচ্ছে করলেও আর আগাতে পারছে না সে। ল*জ্জায় ঘৃণা*য় রক্তিম হয়ে উঠল মুখশ্রী। চোখ বুজে ঠোঁট কামড়ে মুখ সরিয়ে নিল। উষ্ণ কিঞ্চিত হেসে বলল,

“ঠিক আছি!”

তনয়া আর ওদিকে তাকাল না। ইদানিং নিজেকে বোঝা মনে হয় তার। বহু কষ্টে হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিল। পিছন ফিরল। পিছনে রাখল উষ্ণ কে। সে তো অতীত, অতীতই থাকবে। এখন তার ভবিষ্যৎ কি? সামনের আয়নায় নিজেকে দেখে অসহা*য় বোধ হচ্ছিল তার। দৃষ্টি ভরে উঠল নোনতা ধারায়। ঘৃণা*য় চোখ সরিয়ে নিল। ক দিন গেল? আজ ক’দিন হলো সে হুইলচেয়ারে। বহুদিন বোধহয়। এখনো রপ্ত করা শিখল না। এখনো পারে না ঠিক করে হুইলচেয়ারটা ঘুরাতে। এদিক থেকে ওদিক যেতে। এসব করতে তো মন লাগে। এখন মনটাই তো…

যাক গে! বহুদিন কেটে গেছে। বিয়ের দিন ও সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে প্রহর গুনছিলো। তার পাশে ছিলো কেবল উষ্ণ! হ্যাঁ তিনিই ছিল। হাত ধরে কথা দিয়েছিল সব ঠিক হয়ে যাবে,‌ সে সুস্থ হয়ে যাবে! মিথ্যে মিথ্যে সব মি*থ্যে! সে তো আর হাঁটতে পারবে না, কখনোই পারবে না। কেন তাকে মিথ্যে বলল উষ্ণ, কেন বলে সবাই! কেন কেন? ভালো লাগে না তার মি*থ্যে!

দামী জুতো জোড়ার কর্ণপাত হতেই বুঝল উষ্ণ ঘর ছেড়ে চলে গেছে। টপটপ করে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। স্বচ্ছ আয়নায় আর মুখোমুখি হলো না সে। হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিল। ফোনটা বাজছে। কার? তন্ময়ের? সে-ই যে হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িতে এলো এরপর থেকেই তন্ময়ের ফোন। তুলে নি সে। কেন তুলবে? কি বলবে? কথা তো সেই কবেই ফুরিয়েছে! আর কিছু বাকি আছে কি? উষ্ণের ভ*য়েতে নাহলে বোধহয় কবেই চলে আসত। মানুষ প*ঙ্গু হয়ে গেলে বুঝি ভালোবাসা বেড়ে যায়!

তনয়া এলো বিছানার কাছে। একা একা এখনো বিছানার উপর বসতে পারে না সে। উষ্ণ সবসময় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। হাতের উল্টো পিঠে অশ্রু মুছিয়ে নিল। বিছানার পাশে ছোট টেবিলের উপর তার আর উষ্ণের ছবির ফ্রেম বাঁধানো আছে। ইচ্ছে ছিল তাদের বিয়ের ছবিটা ফ্রেম বানিয়ে রাখবে। ইচ্ছে তো কতো কিছুরই ছিলো। এখন ইচ্ছের কথা শুনলেও হাসি পায়। যাক!

বিছানার উপর খবরের কাগজ। ইদানিং খবরের কাগজের লোকগুলো বড্ড স্লো। এরা খবর ছাপায় অনেক দেরি করে। ফ্রন্ট পেজে শেহনেওয়াজ ঊষাণ চৌধুরীর সাথে উষ্ণ চৌধুরীর ছবি ভাসছে। আজকের টাটকা খবর, সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় ছোট ভাই গা*ড়ি চা*পা দিয়েছেন বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে! ঊষাণ এখন পুলি*শের হেফাজতে। ক’দিন চলে এসব মা*মলা কে জানে? তিলোত্তমা বেগম তো জান প্রাণ সবকিছু নিয়ে পড়েছেন। জাওয়াদ চৌধুরী পড়েছেন বিপাকে। এতোদিনের সঙ্গীনিকে একা ছাড়তে পারছে না আবার উষ্ণের প্রতিও অন্যা*য় করতে পারছেন না তিনি। বুঝে গেছেন এখন যদি ঊষাণের পক্ষ নেয় তাহলে উষ্ণ চৌধুরী তাকে ত্যাজ্য পিতার মর্যাদা দিবে। সোজা ক্র*স ফায়ার। কোনো সম্পর্ক আর থাকবে না তাদের মাঝে!

তনয়া ফোঁস করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এখনো মনে পড়ে সেদিন হাসপাতালের বেডে দম্ভে পরিপূর্ণ নাক উঁচিয়ে রাখা তিলোত্তমা বেগম ও তার অকেজো পা ধরে মাফ চাইছিলো। বার বার বলছিলো মাম*লা তুলে নিতে। কিন্তু মাম*লা তুলে নেবার সে কে?

পা দুটো যেন থেকেও নেই। তনয়ার আজকাল বড্ড ঘৃ*ণা পায় এই শরীর কে নিয়ে। অকেজো দুটো পা। চলছেই না। না থাকলেও বোঝা যেত!থেকেও চলছে না, একদমই চলছে না। হয় কখনো! সে অবাক হয়, আশ্চর্য হয়! হাত ছুঁয়ে দেখে এই তো আমার পা। কিন্তু বোধ করতে পারে না। এতো বছর শরীরের সাথে জুড়ে একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ কিভাবে থেকেও যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। খারাপ লাগে,‌ কষ্ট হয় লোকটার জন্য। কতো করছে! আর কতো করবে? কতোদিন? হাঁপিয়ে যাবে না?

———-

ডাক্তার যেদিন মুখ ফুটে বললেন, Spinal Cord মা*রাত্মক ইনজু*রি হয়েছে, কোমরের নিচের অংশ প্যারালাইজ।

“প্যারা*লাইজ মানে? ও কখনো হাঁটতে পারবে না?”

আঁত*কে উঠে উষ্ণ। ডাক্তারের কপালে চিন্তার ভাঁজ। উষ্ণের নিষ্প্রাণ চাহনি দেখে কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। উষ্ণের ক্লান্ত লাগছে, চোখ বুজে আসছে। আই সি ইউ তে এখনো এডমিট তনয়া। একটু পরেই বোধহয় বেডে শিফট করা হবে। ভারী দেহখান নিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়াল। জীবনীশক্তি শুষে নিচ্ছে কেউ। তনয়া আর হাঁটতে পারবে না? কখনো না! এ কথা তাকে কোন মুখে বলবে সে? কোন মুখে? তনয়ার তো ভা*রী কষ্ট হবে? খুব কষ্ট!

ডাক্তার তার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, মেরুদ*ন্ডের ইনজুরিটা মারা*ত্মক। আমি যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি কিন্তু এখন আর আমার হাতে তো কিছু নেই। একটু শক্ত করুন নিজেকে। নাহলে আপনার স্ত্রীকে সামলাবে কে?”

উষ্ণ কেঁদে উঠল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কেমন যেন করে উঠল ডাক্তারের বুকটা। জড়িয়ে ধরে নিল তাকে। মনে হলো তারই মায়ের পেটের কোন ভাই। উষ্ণ থামছে না, থামতে পারেনি। কোনো সহানুভূতি তাকে থামাতে পারেনি।নিঃশব্দে একাকী মনে কেঁদেছিলো বহুক্ষণ।এখন আর কান্না পায় না। মন খারাপ হয়! দূর থেকে তনয়াকে দেখলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। সারাক্ষণ মেয়েটা মনম*রা হয়ে থাকে। মুখের হাসিটাই যেন হারিয়ে গেছে কোথাও। উষ্ণ ফেরত আনতে পারেনি। ছিঃ! এই কি তবে ভালোবাসা তার! ভালোবাসার মানুষটির মুখে সামান্য হাসি ফুটাতে পারল না সে!

তনয়াকে বিছানার সামনে বসে থাকতে দেখে হুট করে এসে তাকে কোলে তুলে বিছানার শুয়ে দিল। আধশোয়া তনয়া। হায় হায় করো কি? সবে না হাতটা কাটলো?

অভিমানে মুখ ভা*র হয়ে উঠল তনয়ার। উষ্ণ মৃদু হেসে তার গাল হাতড়ে কপালে চুমু খেলো। হাতের তালুতে সাদা ব্যান্ডেজে হাত রেখে তনয়া বলল, “খুব লেগেছে তাই না?”

“না, লাগে নি। দেখি তোমার ওষুধের সময় হয়ে গেল।”

“একা একা কতো কিছু করতে হয় তোমার? অফিস সামলাও, ঘর সামলাও আর আমাকেও!”

ঔষধের পাতা থেকে ট্যাবলেট বের করে হাতে ধরিয়ে বলল, “তুমি তো আমারই, আমার দায়িত্ব! সামলাবো না বুঝি। এতো টুকু অধিকার কি নেই আমার?”

কালচে মুখে বলে উঠলো, “এটা তো অধিকার বোধ না। কেলবই বোঝা! বোঝা বইছো!”

“চুপ! একদম চুপ!”

রু*ক্ষ স্বর উষ্ণর। তনয়ার চোখে এসে জলরাশি ভিড় করলো আবারো।

“তুমি আমার বোঝা? বলেছি কখনো? এই দেখলে আমার ভালোবাসা! যদি আর কখনো বলো না।”

“যদি বলি তো?”

রাগে তি*রতির করে উঠল উষ্ণ। পানির গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়ে হনহন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তনয়া দরজার প্রান্তে চেয়ে থেকে বলল, “এভাবে কেন চলে যাও না! গিয়ে তো আমার ব্যথা ক*মাতে পারো!”

মূহূর্তেই দরজা খুলে উষ্ণের মাথা বেরিয়ে এলো। কাঠ কাঠ গলায় বলল, ছেড়ে যাচ্ছি না। খাবার আনতে যাচ্ছি। ঔষধ খাবার আধ ঘণ্টা পর হালকা খাবার খেতে হয়। মনে আছে তো? ঘুমিয়ে পড়ো না, আমি আসছি!”

দরজা বন্ধের নিরব শব্দ আবারো। তনয়া চোখে মুখে জড়তা। ফিসফিসিয়ে বলল,‌, “পা*লিয়ে যাও না কোথাও? হা”রিয়ে যাও। নাহয় আমায় হারি*য়ে ফেলো। এই প*ঙ্গু মেয়ের সাথে থেকে নিজের জীবনটা কেন ন*ষ্ট করবে বলো তো!”

জবাব এলো না। জবাব তো নেই কি জবাব আসবে? তনয়া তো ভালো করেই জানে জবাবটা!

তখন প্রায় মধ্যরাত। উষ্ণ আচ্ছন্ন গভীর ঘুমে। তনয়া জেগে উঠল। জরুরী কাজ সাড়া দরকার যে। আহা! তার মুখটা দেখে থমকে দাঁড়াল। এখন ঘুম থেকে উঠাতে হবে? কেন? নাই বা উঠালো। সে কি একা পারে না? ওই তো, ওতো দূরে আর কি? ঘরের মধ্যেই ওয়াশরুম। দু পা দিলেই…

সাহস দেখাল এবার। দুঃসা*হসিক কাজ করে বসল। বিছানা ছেড়ে একা একা হুইলচেয়ারে বসে গেল। দুই হাতে চেপে ধরে বিজয়ের হাসি হাসল। পেরেছে! হ্যাঁ সে পেরেছে। একা একাই তো বসল এখানে। আনন্দ হচ্ছে, মনের ভিতরে আনন্দের ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে। এখন এই তো, একটু একটা করে এগিয়ে যাচ্ছে। যেতে পারবে। পারবে তো…

হকচকিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল উষ্ণ। এদিক ওদিক ফিরে ওয়াশরুমের কাছে তনয়াকে পড়ে থাকতে দেখে আ*ত্মাই যেন বেরিয়ে যাচ্ছিল তার। হুইলচেয়ার উল্টে গেছে। কি সর্বনাশ! এই সর্বনাশ ঘটল কি করে? ছুটে গেল। তনয়াকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। তনয়া তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

“যাবো না!”

উষ্ণ পাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল না। তাকে নিয়ে এলো বিছানার কাছে। নিজের কোলে বসিয়ে বলল, “কোথায় ব্যথা পেয়েছো?”

লজ্জা*য় তির*তির করে উঠল শরীরটা। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল সে। তার বুকে লেপ্টে থেকে, বুক খাম*চে একাকার করে ফেলল। ছিঃ ছিঃ। লজ্জায় ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে তার। এতো টুকু তো পথ তবুও পারল না। কেন পারল না? কেন?

উষ্ণ নিজেকে শান্ত করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “চুপ চুপ কাঁদে না!”

হেঁচকি উঠে গেল তার। পিঠে আলতো করে মালিশ করে বলল, আমি কি তোমার পর হই? এমন কেন করো? আমার কে আছে তুমি ছাড়া? তোমার কিছু হলে আমার কি হবে একবারও ভেবেছো? আমি তো নিঃস্ব তনয়া। তোমায় হারিয়ে ফেললে নিজেকেও তো হারি*য়ে ফেলব। তখন? তখন আমার কি হবে? একবারও ভেবেছো, তুমিহীনা আমি বাঁচব কি করে?”

বোকা বোকা চোখ করে চেয়ে রইল তনয়া। উষ্ণের কথার জবাব দিল না। টি শার্ট খাম*চে ধরে তার কোলেই পড়ে রইল। এখানে ছাড়া কোথাও ভালো লাগে না তার!

——–

নিজের প*ঙ্গুত্ব, অকে*জো শরীর, দুর্বলতা কোনোটাই মেনে নিতে পারছে না। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেও হতে পারছে না। মেনেই নিতে পারছে না তার এই হাল। সেদিন আলমারি থেকে জামা বের করতে গিয়ে বিয়ের শাড়িটা চোখে পড়ল তার। এতো সুন্দর মিষ্টি শাড়িটা দেখেই গা জ্ব*লে উঠলো তার। অপেক্ষা করল না। ঘরের মধ্যেই আগু*ন ধরিয়ে দিল। শাড়ি পুড়*তে সময় নিলো না। ছাই হতে দেরি কিন্তু উষ্ণ আসতে দেরি করেনি। ঘর ভর্তি ধোঁয়া দেখে একপ্রকার উন্মা*দ হয়ে উঠেছিল সে। দরজা জানালা সব খুলে দিল। ছাই বর্ণ শাড়িটা দেখে ফিরে চাইল তনয়ার দিকে। তনয়া নিষ্প্রাণ, নিশ্চুপ! কিছু যায় আসেনা তার। উষ্ণ কথা বাড়াল না। কেবল ছাইগুলো পরিষ্কার করে রেখে দিল। তনয়াও কথা বাড়াল না। ওই ব্যাপার নিয়ে কথাই তুলল না কেউ।

এরপর কেটে গেছে বহু মাস।তনয়া এখন একা একাই পুরো ঘর আর ড্রয়িং রুম বিচরণ করে হুইলচেয়ারর সাহায্যে। আর কোনো কাজ নেই তার। সারাদিন ঘরেই পরে থাকে। ঘরের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। মাঝে মাঝে উষ্ণ অফিসের দু একটা কাজ দেয় তাও বেছে বেছে। তনয়ার যেন অসুবিধে না হয় সেই ভেবেই দেওয়া। আশ্বিন মাস! শরতের শুরু, চারদিকে শীতল আবহাওয়া। নীলাম্বর মেঘে ঢাকা থাকে সর্বক্ষণ। একটু পর পর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয় আবার থেমে যায়।

উষ্ণ বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যে হতেই। বৃষ্টির তোপে পড়েছিলো। ভিজল খানিকটা। ঘরে ফিরেই তনয়ার সুশ্রী মুখখানা দেখে ক্লান্তি চলে গেল মূহূর্তেই। নীলাম্বরীকে যেন আজ একটু সুখীই লাগছে!

গায়ের ব্লেজার খুলে এগিয়ে গেল তার দিকে। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল তনয়া।‌ তার এই সুখী সুখী মুখটা আজ কতোদিন বাদে দেখল সে। আহ প্রাণ জুড়িয়ে গেলো তার। তনয়া তার হাতটা চেপে ধরল। উষ্ণের উৎসুক চাহনি,

“কি হয়েছে?”

“একটা খুশির খবর দিই আপনাকে!”

তনয়ার চোখ দুটো চকচক করছে। উষ্ণের ও ভালো লাগল। আবার মনে মধ্যে ভয়ে*র বীজ। ভ*য় করছে তার। কিছু একটা তো হয়েছেই। তনয়া শুকনো ঢোক গিলল। তার হাতটা বাড়িয়ে পেটের কাছে নিতেই উষ্ণ হাত সরিয়ে ফেলল। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল সে। তনয়াও যেন কম অবাক হলো না। স্ত*ব্ধিত রইল। পানির গ্লাস রেখে দুই হাতে হুইলচেয়ার জোরে চেপে ধরে বলল,

“না তনয়া, এই ব্যাপারে তো আমাদের কথা হয়েছে। আমি তো তোমাকে বলেছি আমাদের বাচ্চা চাই না!”

নিষক কালো এক ছায়া এসে আঁকড়ে ধরল তনয়াকে। বি*ষণ্ণ মুখে চেয়ে রইল উষ্ণের মুখপানে। লোকটা ছট*ফট করছে। উষ্ণ তনয়ার হাত দুটো আগলে ধরে বলল,

“আমার কথা বোঝার চেষ্টা করো তনয়া। এরকম টা হয় না।”

“কেন হয় না। সবার তো বাচ্চা হয়।”

“সবাই আর তুমি এক না। আমি তো তোমাকে বলেছি। সম্ভব না। রি*স্ক আছে এতে। তোমার প্রাণের আ*শঙ্কা আছে। এতো বাচ্চার দরকার হলো আমায় বলো আমি তোমাকে এডপ্ট এনে দিচ্ছি।”

তনয়া মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিল, “ছিঃ!”

“তনয়া তুমি.. কথা শেষ করার আগেই চোখ পড়ল টেবিলের উপর রাখা প্রেগন্যান্সি কিটের উপর। শুকনো ঢোক গিলল সে। গলা শুকিয়ে আসছে তার। দু হাতে তনয়ার গালে আগলে ধরে বলল, “সত্যি সত্যি তুমি তাহলে..

তনয়া ঠোঁট চেপে রইল। উষ্ণের মাথায় যেন সাত আসমান ভে*ঙে পড়ল। মাথায় হাত রেখে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল সে। কম্পিত স্বরে বলল,

“মেডিসিন! তুমি মেডিসিন গুলো তবে নাও নি তনয়া! কেন?”

তনয়া হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিল। উষ্ণ নিশ্চুপ নির্বাক! সপ্তাহ দুয়েক আগেই এই নিয়ে তর্ক হয়েছে তাদের মধ্যে। তনয়া মা হতে চায়। কোল জুড়ে চায় একটি সন্তান কে। উষ্ণের নিঃসঙ্গতা দূর করতে একটি সন্তান চায়। দোষের কিছু তো নেই। সকল মেয়েরাই তো চায়। কিন্তু তনয়া! তনয়া তো বাকিদের মতো নয়। তনয়া শারীরিক অবস্থা মোটেও ভালো না। এসময় প্রেগন্যান্ট হলে মায়েদের একটা রিস্কের ব্যাপার থাকে।‌ ৩০% থেকে ৫০% রিস্কের মাত্রা। তনয়া ওসব পাত্তাই দেয়নি। একটা বাচ্চা জন্ম দেওয়াই তো রিস্ক। জীবন মৃ*ত্যুর মাঝামাঝি গিয়ে একটি মেয়েকে বাচ্চা জন্ম দিতে হয়। নারী হয়ে মাতৃত্বের স্বাদ থেকে কেন বঞ্চিত হবে সে। এ জীবন, এ ভাগ্য, তার কিশোর, যৌবন সবকিছুই তো কেড়ে নিয়েছে। মাতৃত্ব সে কেড়ে নিতে দিবে না। কখনোই না!

এদিকে উষ্ণ সবকিছু মানতে নারাজ। তনয়া কে ছাড়া তো আর কিছু চায় না সে। তনয়া তবে কেন বুঝতে পারে না। তার জীবনে তো তনয়ার উপর আর কিছু নেই। সন্ধ্যে গগণ ছুঁয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। তীব্র অন্ধকারে একাকী বসে আছে উষ্ণ। তনয়া সেখানে এগিয়ে গেল। শুষ্ক মুখে বলল, “অফিসের জামা কাপড় ছাড়ুন। বদলে নিন। ফ্রেশ হন!”

উষ্ণ নির্বাক। মন উদাস করে বসে রইল। পৃথিবীতে কি সেই একমাত্র বাবা যে তার আগত সন্তানকে নিয়ে একটুও খুশি হতে পারছে না। কেবল ভয় আঁকড়ে ধরেছে তার। কি এক অজানা ভয়।
তাদের সেই বেলকনির ওপাশ দিয়ে তিমিরে ঢাকা আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেখানে এক টুকরো চাঁদ উঠেছে। তনয়ার হুইলচেয়ারের সাথে লাগোয়া উষ্ণ মেঝেতে বসে আছে এলোমেলো ভাবে। কিছুটা সময় নিশ্চুপে কাটার পর তনয়া বলে উঠলো, “শুনুন!”

চোখের জল মুছে উষ্ণ ভাঙা গলায় বলল, “বলো!”

কতো কিছুই তো বলার ছিল কিন্তু তনয়া বলতে পারল না। থেমে গেলো। হঠাৎ বুকটা কেঁপে উঠছে তার। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠল সে। উষ্ণ পিছন ফিরল। তনয়ার চোখে জল থেকে আর স্থির থাকতে পারল না সে। উঠে তাকে আগলে ধরল। উষ্ণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিচ্ছে। বলছে, থামো থামো কেঁদো না! আচ্ছা তুমি কি বুঝতে পারো না আমি কতোটা অসহায় তনয়া। ঠিক কতোটা অসহায়। আমি তোমাকে ছাড়া কি করে থাকব বলো তো। তুমি এমন করলে কিভাবে সম্ভব?”
তনয়া কান্না থামিয়ে নাক টেনে বলল,‌“আমরা‌ তো একসাথেই থাকব সারাজীবন!”
“হ্যাঁ, থাকব। সবসময় তুমি চাইলেই।
অতঃপর তার হাতটা শক্ত করে ধরে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। অপরা*ধীর স্বরে বলতে লাগল,

“তনয়া, সময় আছে। চলো ডাক্তারের কাছে যাই!”

কথাটা শেষ হলো। নিস্তব্ধ ঘিরে ধরল আবারো চারদিক। তনয়া বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল উষ্ণের মুখপানে। এই মুহূর্তে উষ্ণ কে আর ভালো লাগছে না তার। কেমন মতলবি লোক বলে মনে হচ্ছে। যে মতলবি লোক কি না স্ত্রী কে‌ বাঁচানোর আশায় নিজের বাচ্চাকে মে*রে ফেলার ষড়*যন্ত্র করছে। তনয়ার মুখাবয়ব কঠিন হয়ে উঠল। উষ্ণের হাতটা ছেড়ে দিয়ে মুখ সরিয়ে নিল। উষ্ণ অসহায়ের মতো চেয়ে থেকে বলল, “তোমার মায়া হয় না আমার জন্য!”

“আপনার কি সন্তানের প্রতি মায়া হয় না। বাবা হয়ে এতো ভ*য়ংকর কথা বলেন কিভাবে?”

“আমি যে তোমাকে হারা*তে ভয় পাই তনয়া।”
বলেই তার কোলে মাথা রাখল। তনয়ার রাগ আর কঠোরতা স্থির হচ্ছে না কোনোভাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার রাগ গলে গেল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “বললাম তো, বিশ্বাস করুন কিছু হবে না। আমি অনেক রিসার্চ করেছি। একটু রিস্ক আছে কিন্তু অসম্ভব তো নয় বলুন। ভালো হবে না আমাদের ঘরেও একজন নতুন অতিথি আসবে। সারাদিন ঘরে একা একা থাকি এখন থেকে দুজন থাকব। আপনিও দুজন ভালোবাসার মানুষ পেয়ে যাবেন। মন্দ কি? এতো কেন ভ*য় পাচ্ছেন?”
ফ্যাকাশে কালচে মুখখানা তুলে চাইল তনয়ার পানে। তনয়া আলতো করে তার কপালে চুমু খেলো। উষ্ণ বুঝে গেল,‌তনয়া তার কথা মানতে নারাজ। সে আর কিছু করতে পারবে না!”

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এক পা এখন আগায় না উষ্ণ। আর না তনয়াকে আগাতে দেয়। অফিস শব্দটাই যেন জীবন থেকে মুছে ফেলেছে। সারাক্ষণ তনয়ার সাথে সাথে কাটায়। ডাক্তারের কথামতোই চলে সর্বক্ষণ। দেখা গেল কিছু মাসের মধ্যেই ঘরের মধ্যে বাবুদের খেলনা জুড়ে গেল। তনয়ার চোখে মুখে আনন্দ ঝরে পড়ছে। যেই লোকটা কিছুমাস আগেও এই অনাগত বাচ্চাকে চাইছিলো না আজ সেই যেন তার থেকেও বেশি উৎসাহিত। কতোটা প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা কাজ করছে মনের ভেতর। কিন্তু শরীর আর ভালো যায় না। এই সুস্থ থাকে আবার এই অসুস্থ হয়ে পড়ে।‌ শরীরটা কেন যেন মনের কথা শুনতে চায় না!

দেখতে দেখতে সেই কাঙ্ক্ষিত মূহূর্তে। তনয়ার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে,অসহায়ের মতো চিৎকা*র করছে। কিন্তু উষ্ণের কেবল তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। বাড়ির লোক বলতে মৌ ছাড়া আর কেউ নেই। ঊষাণকে না পেয়ে তিলোত্তমা বেগম রীতিমতো অ*সুস্থ হয়ে গেছেন। তাকে নিয়ে দেশের বাইরে এখন জাওয়াদ চৌধুরী। তাই উষ্ণের পাশে থাকার মতো জেএস ছাড়া আর কেউই নেই। আর কাউকে আশাও করে না সে।

কিন্তু এই ক*ষ্ট তো মেনে নেওয়া যায় না। তনয়া ক*ষ্ট পাচ্ছে, সে কিছু করতে পারছে না। এই কষ্টের উপশম কি? কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তারের দেখা পাওয়া গেলো। নার্স দুজন ছুটে আসছে। এখনি ওটিতে নেওয়া হবে। তনয়া কে বেডে শুইয়ে ধরাধরি করে নিচ্ছে দুজন বয়। তার পাশেই দৌড়াচ্ছে উষ্ণ। সবাই যেখানে তাড়াহুড়ো করছে সেখানে তনয়া আচমকা শান্ত হয়ে গেল। ঠান্ডা হাতে উষ্ণের হাতটা ছুঁয়ে ধরল। উষ্ণ ফিরে তাকাল। সামনেই ওটি!

“কিছু বলবে?”

তনয়া লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। উষ্ণ মাথা এগিয়ে দিল। তনয়া ফিসফিসিয়ে তার কানের কাছে বলল,‌ “আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি, বুঝলেন তো!”
বুকটা ধক করে উঠল তার। তনয়ার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কি জানি,‌ভালোবাসার কথা আর বলতে পারবে কি না সে। বিয়ের দুবছরে এই প্রথম ভালোবাসির কথা বলল সে। অশ্রুসিক্ত নয়নে উষ্ণ মাথা নাড়িয়ে বলল, আমিও ভালোবাসি। তুমিই তো আমার সব। দেখো! সব ঠিক হবে!”

চুমু খেলো তার কপালে। এরপর, এরপর আর কেউ অপেক্ষা করল না।তারা ছুটে তাকে নিয়ে গেল বন্ধ ঘরটাতে। উষ্ণ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এখন এসে মনে হচ্ছে, তনয়াকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হয়নি। তার কথা মানা উচিত হয়নি। তার জেদে*র কাছে হারা উচিত হয়নি। হায় হায়,‌ এখন তনয়ার কি হবে? তার কি হবে? সে কিভাবে বাঁচ*বে? কিভাবে?

দূরে দাঁড়ানো মৌ উড়নার আঁচলে মুখ ঢেকে বসে আছে অস্থিরতায়। উষ্ণ ভাইকে এরকম ভে*ঙ্গে থাকতে দেখে তার মনও যেন কু ডাকছে। জেএস এসে দাঁড়াল উষ্ণের পাশে। ঘাড়ে হাত রেখে পাশে দাঁড়াল সে।
সময় পেরুলো। টেনশনে উষ্ণের হাত পা প্রায় জমে গেছে। ওটির দরজা খুলে একজন নার্স কে দেখা গেল। উষ্ণ ছুটে গেল তার নিকটে। অস্থির হয়ে শুধাল, “আমার স্ত্রী!”

নার্স ছোট করে জবাব দিল, “ভেতরে আসুন!”
নার্সের থমথমে মুখ দেখেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলো উষ্ণ। তার পা যেন জ*মে গেল। ঘোরের মধ্যে চলে গেল প্রায়। কি করে ভেতরে এসে যে তনয়ার পাশে দাঁড়ালো মনে পড়ে না। তনয়ার মৃদু ডাকে ঘোর কাটে তার।

ওটির ভেতরটা নিস্তব্ধ, চারপাশে মনিটরের টু টু শব্দ। মাঝখানে তনয়া। তার ওপাশে কয়েকজন নার্স দাঁড়িয়ে ছিল। উষ্ণ কে দেখতে পেয়ে তারা সরে দাঁড়াল। উষ্ণ ডাক্তারের পানে তাকাল। তিনি মাস্ক খুলে এদিকে তাকালেন। মুখাবয়ব যেন স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, আমাদের আর কিছু করার নেই!

ডাক্তার বেরিয়ে এলো। জেএস তার পথ আটকালো। সাথে মৌ! হয়েছে কি? ডাক্তার জানালেন,
তনয়ার মেরুদণ্ডে গভীর আঘাত লেগেছিল, যার ফলে সে হাঁটতে পারেনি, শরীরের নিচের অংশ সম্পূর্ণ অবশ ছিল। এ ধরনের ইনজুরির কারণে তার শরীরের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণও নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। ডাক্তাররা একে বলে Autonomic Dysreflexia (AD) — একটি মারাত্মক শারীরিক প্রতিক্রিয়া, যা বিশেষ করে এমন রোগীদের মধ্যে দেখা দেয় যাদের মেরুদণ্ডে উচ্চতর ইন*জুরি হয়েছে।

এই অবস্থায় শরীরের নিচের অংশে কোনো চাপ, ব্যথা বা উত্তেজনা মস্তিষ্কে সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারে না, আর সেই ভুল সংকেতের প্রতিক্রিয়ায় রক্তচাপ হঠাৎ আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। কখনো কখনো এতটাই দ্রুত এবং প্রবল হয়ে ওঠে এই প্রতিক্রিয়া, যে হৃদযন্ত্র থেমে যায়, শ্বাস ব*ন্ধ হয়ে যায়, এবং জীবন ন*ষ্ট হয়ে যায়।

তনয়া এই রিস্কের কথা জানত। তার হাতে এখন আর সময় নেই। তারা যতটুকু পেরেছিলো করেছে। ওটিতে ঢোকার পর তার শেষ কথা এটিই ছিল, “আমার বাচ্চাকে বাঁচাবেন প্লিজ!”

উষ্ণর চোখে অস্থিরতা, ঠোঁট শুকনো, বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত শূন্যতা। মিনিট গড়িয়ে ঘন্টা, অথচ সময় যেন থেমে আছে। বাচ্চার কান্না কর্ণপাত হতেই মস্তিষ্ক যেন সজাগ হয়ে উঠল। উষ্ণের বোধ হলো। বেডে শুয়ে থাকা তনয়ার দিকে তাকাল। সে কিছু বলার চেষ্টা করছে। উষ্ণ তার কাছে এগিয়ে গেলো। তনয়াকে ফিসফিসিয়ে বলছে, “বাচ্চা!”

উষ্ণ বাচ্চার দিকে তাকালো। সাদা তোয়ালে পেঁচানো বাচ্চাটা। নার্স তাকে কোলে তুলে দিল।উষ্ণ দু হাতে তাকে আগলে ধরে তনয়াকে দেখাল। মুখখানা দেখতে পেয়েই তনয়া হাসল। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কি অদ্ভুত হাসি। তনয়া লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। সময় বুঝি বেশি নেই। উষ্ণের মনে হলো তার হৃৎপিণ্ড কেউ টেনে বের করে নিচ্ছে দেহ থেকে। চোখ ভিজে উঠছে বার বার। শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিল। তনয়া লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

“মেয়ে হয়েছে তাই না!”

উষ্ণ জানত না, ছেলে না মেয়ে। তবু মাথা নাড়ল। মেয়েই হবে বোধহয়। তনয়া সবসময় মেয়ে চাইত। বলত, আপনাকে একটা মা জোগাড় করে দিব। মেয়ে মায়ের মতো আগলে রাখবে, ভালো হবে না!

তনয়া মুচকি হাসল। অমায়িক হাসি। উষ্ণের মনে হলো তনয়াকে সে কখনো ভুলতে পারবে না। এই হাসি তার হৃদয়ে ছবির মতো গেঁথে থাকবে। সে বলল, “ওর নাম তৃষ্ণা রেখেছি! সুন্দর না!”

উষ্ণ ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ল। তার ঠোঁট কাঁপছে। শরীর কেঁপে উঠছে বার বার। চোখেতে অশ্রু টলমল। একহাতে বাচ্চাকে আগলে অন্যহাতে তনয়ার হাতটা মুঠোয় নিয়ে নিল। ভরসা দিল যেন, “কিছু হবে না তোমার, আমি আছি তো!” এই তো তনয়া শ্বাস নিচ্ছিলো। আবারো নিল। খুব লম্বা করে একটা শ্বাস নিল। চোখ বুজল। কিন্তু! কিন্তু আর মেলে তাকাল না! উষ্ণ তার কপালে হাত রাখল, তাকে ডাকল,‌ সাড়া দিলো না। নার্সরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। উষ্ণ তার আজীবনের অর্ধাঙ্গিনীর কপালে চুমু খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কোলে তার বাচ্চা, হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। উষ্ণের হাতের‌ মুঠোয় হাতটা আগলা হয়ে গেছে। তবু উষ্ণ শক্ত করে চেপে ধরে আছে। ছাড়ছে না! কখনো ছাড়বে না! সে তো কথা দিয়েছিল! কথা রাখবে বলেছিলো কিন্তু মানুষটা যে আর নেই। কথা রেখে কি হবে? নিঃশব্দে কেঁদে উঠল সে। তৃষ্ণার কান্নার আওয়াজে তার কান্না নিমিয়ে গেল। ও কেন কাঁদছে? ও কি তবে বুঝল ওর মা আর নেই। নেই তবে সে! আহা, বাপ আর মেয়ের ভাগ্যটা কি একইরকম হলো! কি নিদারুণ!

নার্সরা বেরিয়ে যেতে আর কান্নার আওয়াজ শুনেই জেএস ওটিতে ছুটল। তার পিছন পিছন মৌ! উষ্ণের কোল থেকে বাচ্চাকে সে নিয়ে নিল।‌ কিন্তু জেএস উষ্ণ কে ছাড়াতে পারছে না। উষ্ণ ছাড়ছে না। কি করে ছাড়বে? হাত ছাড়ার কথা তো সে দেয়নি। দেয়নি তো…

~ সমাপ্ত

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#শেষের_পরে

গ্রীষ্মের ভোরবেলা। সবে সকাল ৭ টা বাজে। অথচ এই বেলাতেই রাস্তায় কাঠফাঁটা রোদ। সূর্য্যিমামার যেন তর সইছিলো না। তাই সকাল হতেই তার আগু*নে ভস্ম ক*রতে উঠে পড়ে লেগেছে। ফ্যানের নিচে থেকেও মেয়েটা ঘেমে একাকার। উষ্ণ বেশ কয়েকবার তৃষ্ণা কে ডাকল। কিন্তু সে আঠার মতো বিছানাতেই লেগে আছে। শেষমেষ উঠে গিয়ে মাথার উপরের ফ্যানটা বন্ধ করে দিল। অতঃপর দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। ১, ২ গিয়ে ৫ মিনিটে তৃষ্ণা ছটফট করে চোখ মেলে তাকাল। দূরে বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই মাথার উপরে তাকাল। ফোনটা বন্ধ দেখে আদুরে ভঙ্গিতে বলল, “বাবা!”

উষ্ণ একটুও গলল না। বরঞ্চ গলায় একটু কঠো*রতা এনে বলল, “নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, দু মিনিটের মধ্যে আসো!”

উষ্ণ বেরিয়ে গেল। তৃষ্ণা বেপরোয়াভাবে ভঙিতে আরো উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানার উপর। আবার কি ভেবে উঠে দাঁড়াল। ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

তৃষ্ণার বয়স আজ ৫ বছর। হ্যাঁ, ৫ টি বছর পেরিয়ে গেছে। তৃষ্ণা কে‌ এ বছরই কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে উষ্ণ। সে গিয়ে দিয়ে আসে আবার নিয়েও আসে। সযত্নে আগলে রাখে যেন মোলায়েম কোনো বস্তু। ওই তো, ওই তো আছে,‌‌ও ছাড়া আর কে আছে এখন।‌

ভিজে মুখে হামি ছাড়তে ছাড়তে খাবার টেবিলে এসে পৌঁছাল তৃষ্ণা। মেয়েটা মুখ ও মুছে নেয়নি। সে‌ এসে তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিল। পাশেই ইস্ত্রি করা স্কুল ইউনিফর্ম। উষ্ণ তাকে ইউনিফর্ম পড়িয়ে সোজা খাবার টেবিলে বসিয়ে দিল। সামনে সকালের নাস্তা হিসেবে জ্যাম পাউরুটি, একটা কলা আর একগ্লাস দুধ দিল। কোনো অভিযোগ ছাড়াই তৃষ্ণা পুরোটা খাবার খেলো। মেয়েটা লক্ষ্মী আছে। খাবার নিয়ে কখনো ঝামেলা করে না।‌ ততোক্ষণে উষ্ণ তার বক কাটানো ছোট চুলগুলো পিছনে নিয়ে একটা ঝুটি করিয়ে দিল। ঘড়ির কাঁটা ৮ টা ছুঁই ছুঁই। না আর তো বসে থাকা যায় না। নিজের নাস্তার কথা ভুলে গিয়ে কেবল মুখে একটা আপেল আটকে তৃষ্ণা কে কোলে তুলে নিল। অন্যহাতে তার স্কুল ব্যাগ, ব্লেজার, অফিসের ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়ে গেলো সে।

তৃষ্ণা আপেলটা নিজের হাতে নিয়ে বাবার মুখের কাছে ধরে বলল, “খাও বাবা!”

উষ্ণ হাসল। কামড় বসালো তাতে। বাপ মেয়ে দুজনের মাথায় পিছনেই ঝুলছে ছোট ছোট দুটো ঝুটি। হ্যাঁ উষ্ণের চুলগুলো এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। তাই তৃষ্ণা তার জন্য মাথার ক্লিপ কিনলে বাবার জন্য ও কিনে। বাবার মাথায় রঙ বেরঙের চুলের ক্লিপ বসাতে ভালোই লাগে তার।

গাড়িতে গিয়ে বসল দুজন। তৃষ্ণা সামনের সিটে বসে পা ঝুলাচ্ছে। উষ্ণ আরো একবার তার সিটবেল্ট চেক করে গাড়ি স্টার্ট দিল। তৃষ্ণা ফের ইয়া বড় একটা হামি ছাড়ল। গোলগাল মুখ পুঁচকে সোনার, বড় বড় দুটো চোখ, ফোলা ফোলা দুটো গাল আর চিকন চিকন দুটো ঠোঁট। দেখতে একদম মায়ের মতো। জন্মের পর বুঝতে পারেনি, ধীরে ধীরে যখন দেখল তৃষ্ণা যত বড় হচ্ছে ততোই তার মায়ের মতোই হচ্ছে। নিশ্চিত তার মতোই হবে!

স্কুল গেট থেকে বিদায় দিল তাকে। রোজকার মতো একটা হামি মানে চুমু খেতে ভুল করল না তৃষ্ণা। সে রোজ দাঁড়িয়ে দেখত, বাইরে ছেলেগুলোর কপালে মায়েরা চুমু খায়। তার তো আর মা নেই, তাই সেই বাবার গালে চুমু খেয়ে ফেলে। বাবা আবারো আসবে ছুটির সময়।

ক্লাসে গিয়ে তৃষ্ণা বসে পড়ে অন্তুর‌ পাশে। তার একমাত্র বন্ধু অন্তু। তাকে টিফনের ভাগ ও দেয় সে। বাবা রোজ টিফিন একটু বেশি দিয়ে দেন যাতে ভাগাভাগি করে খেতে পারে মিষ্টি তৃষ্ণা। কিন্তু সেই ছোট্ট তৃষ্ণা টিফিন বক্স ভুলে সারাক্ষণ ছোটাছুটিতে ব্যস্ত থাকে। শক্ত রাবার ব্যান্ড দিয়ে করা পোনি টাই আর চুলে থাকে না। ধীরে ধীরে সেটা নিচে নামতে থাকে। তৃষ্ণার চুলগুলো এই বয়সেই বেশ লম্বা। লম্বায় চুলগুলো যেন মায়ের মতো আর সিল্ক হয়েছে বাপের মতো। মিলেমিশে তো তৈরি সে!

স্কুল ছুটির ২০ মিনিট আগেই হাজির উষ্ণ। অফিসের কাজ মিটিয়ে যত দ্রুত পেরেছে স্কুলে ছুটে এসেছে। কিন্তু স্কুল গেটে পরিচিত মুখখানা দেখে ইত*স্তত বোধ করল সে। জাওয়াদ চৌধুরী ছেলের পানে চেয়ে রইলেন দৃঢ় ভাবে। আজ কতো বছর পর দেখছে তাকে। শেষবার দেখেছিলেন যখন তৃষ্ণার ২ বছর বয়স ছিলো। নাতনিকে দেখে ভীষণ মায়া হয় তার। কি মিষ্টি! ইচ্ছে করে সারাক্ষণ নিজের কাছে রেখে দেয়। উষ্ণ কে বহুবার সেধেছে লাভ হয়নি কোনো। মাঝে মাঝে লোভ সামলাতে না পেরে উষ্ণের আড়ালে এসে দেখা করেন নাতনির সাথে। মেয়েটা দেখলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। অপটু গলায় কেবল কথাই বলতে থাকে!

উষ্ণর মুখটা ক*ঠোর হয়ে উঠল। বাবাকে দেখলেই কঠোর হয়ে যায় আজকাল। ঊষাণ এখনো জে*ল হাজতে। এতো সহজে তাকে বেরুতে দিবে না সে। তিলোত্তমা বেগম নিমিয়ে গেছেন। জাওয়াদ চৌধুরী এই বলে বুঝিয়েছেন, যতদিন ঊষাণ হাজতে আছে নিরাপদে আছে। কেননা বাইরে এলেই উষ্ণ তাকে মে*রে ফেলবে।

কথাটা এক প্রকার সত্যই। ইরিশা জামানের মৃ*ত্যু এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। তাই মুখ বুজে হলেও এখন পড়ে থাকে। ছেলেটা বেঁচে তো আছে! নয়তবা উষ্ণর হাত থেকে রে*হাই দিতে পারবেন না।

জাওয়াদ চৌধুরী আর উষ্ণ দাঁড়িয়ে স্কুল মাঠের আঙ্গিনায়। একটু বাদেই স্কুল ছুটি হবে বলে চারদিকে কেবল গোলমেলের শব্দ অথচ মাঠ খালি। একটুপরই যে এক ঝাঁক পাখি উড়ে আসবে তারই আগাম বার্তা দিচ্ছে। উষ্ণ এদিক ওদিক চেয়ে রইল। বাবার সাথে চোখ মেলাতে ইচ্ছে হয় না তার। রুক্ষ স্বরে শুধাল,

“আপনি এখানে কেন?”

“তৃষ্ণার সাথে দেখা করতে এসেছি।

সচেতন হয়ে উঠল উষ্ণ তীক্ষ্ণ আঁখি জোড়া। ভেঙে ভেঙে বলল, “মাঝে মাঝেই আসেন?”

“না আজই প্রথম!”

সহজ ভাবেই মি*থ্যে বলল জাওয়াদ চৌধুরী। কারণ তার এখানে আসাটা উষ্ণ সহজভাবে নিতে পারছে না।

“ওহ!” ছোট করে জবাব দিল উষ্ণ। অর্থাৎ কথা এখানেই সমাপ্ত। জাওয়াদ চৌধুরী কথা বাড়ালেন,

“তৃষ্ণা কে নিয়ে আমাদের ওখানে চলে এসো না।

“কেন?”

“কারণ চাই তোমার? দাদার কাছে কি নাতনি থাকতে পারেন না? আমার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকার তো সে-ই এখন!”

উষ্ণ তার বাবার মুখপানে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে সহজ গলায় জবাব দিল, “আমি তৃষ্ণা কে আমার থেকে দূরে করতে পারব না।”

“কেন? তৃষ্ণা কি একা থাকবে নাকি? তুমি থাকবে না?”

“না, ও বাড়িতে আমি মায়ের লা*শের গন্ধ পাই। থাকতে পারব না!”

জাওয়াদ চৌধুরী থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ সময় এভাবেই কাটল। ছেলের সাথে তিনি যতই সহজ হতে চাইছেন ততই বি*পত্তি ঘটছে।

বাচ্চাগুলো বেরুতে শুরু করেছে। জাওয়াদ চৌধুরী বললেন, “তুমি আরেকটা বিয়ে কেন করছো না উষ্ণ? তৃষ্ণার জন্য হলেও তো..

“না, আমি আপনার মতো হতে চাই না!”

বলেই সামনে আগালো। তৃষ্ণা ছুটে এদিকেই আসছে। এতো দিন পর দাদাকে দেখতে পেয়ে সেখানেই ছুটে গেলো প্রথমে। উষ্ণ ক*ঠোর হলো না। যথাসম্ভব মলিন থাকার চেষ্টা করল। জাওয়াদ চৌধুরী নাতনিকে কোলে তুলে ভীষণ আদর করলেন। নাতনিও গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইল। উষ্ণ অনেক কষ্ট করে তাকে নিজের কাছে নিয়ে নিল। তৃষ্ণা আবদারের সুরে কেবল বলতেই লাগল, বাবা চলো না, আমরা দাদুর সাথে চলে যায়। ভালো হবে না, তুমি আমি দাদা দাদী সব একসাথে থাকব, হুম!”

উষ্ণ কেবল মন রাখার জন্য বলে, হ্যাঁ মা যাবো এখন চলো বাসায় যাই!”

ছোট তৃষ্ণা কথার এতো মারপ্যাঁচ বুঝে না। দাদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাবার কোলে চড়ে যায়। এতোক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থেকে বাবা ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। তাই ছোট হাতে ছোট রুমাল নিয়ে বাবার ঘাম মুছে দেয় সে। মিটিমিটি হেসে আবার গলা জড়িয়ে ধরে। উষ্ণ হাসে! তনয়া যা চেয়েছিল ঠিক তাই। বলেছিল, আপনার জন্য একজন মায়ের ব্যবস্থা করব। মা পেয়ে গেছে সে!

এরপরে কেবল ধকল। প্রথমেই তৃষ্ণা কে বাড়িতে ফেরত নিয়ে ফ্রেশ করিয়ে নাস্তা করিয়ে দেয়। এরপর লাঞ্চ বানিয়ে তাকে গোসল করিয়ে দুই বাপ বেটি মিলে অফিস চলে আসে। অফিসে তৃষ্ণার বন্ধুর অভাব নেই। জ্যোতি, শরীফ ম্যানেজার সাহেব সবাই ভীষণ আদর করে তাকে। একটু আড়ালেই আবার আফসোস করে। ইশ, তনয়া হত*ভাগীর কপালে এতোটুকু সুখ সইল না। তার অতীতের ব্যাপারে সকলের জানা কি না!

আরো একজন গুরুতর ব্যক্তির সাথে তৃষ্ণার ভাব রয়েছে, সে হচ্ছে তন্ময়! তন্ময়ের চাকরি এখনো এখানেই বহাল রয়েছে। মাসে দু’বার সে ঢাকায় এসে সেখানকার অফিসের রিপোর্ট জমা দেয়। এরপর অপেক্ষা করে। বিকেলে তৃষ্ণার সাথে দেখা না করে যায় না সে। মাসে দুবারই কেবল তাদের দেখা অথচ তৃষ্ণা কি ভালো মনে রেখেছে তাকে। ছোটো মেয়েটার স্মৃতিশক্তির প্রখরতা দেখে অবাক হয় বড্ড। আজও তার জন্য চকলেট আর খেলনা নিয়ে হাজির সে। তাকে নিয়ে অফিসে ঢোকার পথেই তন্ময়ের সাথে মুখোমুখি হয় উষ্ণর। তার হাত ধরে থাকা তৃষ্ণা তন্ময় কে দেখেই ছুটে চলে যায় তার কাছে। উষ্ণ বারণ করে না। কেবল পিছন ফিরে জেএস কে ইশারা করে ভেতরে চলে যায়। গোটা একটা বিকেল পার করে তারা দু’জন।

তন্ময় কে তৃষ্ণার কেন ভালো লাগে সে জানে না। তবে আংকেল ভালো। তাকে আইসক্রিম আর চকলেট দেয়। মজার মজার খেলনাও দেয়। লোকে মাঝে মাঝে তাকে দেখলে বলে বে*চারী। তৃষ্ণা ভারী অবাক হয়। দুনিয়াতে এতো মানুষ তাকে ভালোবাসতে সে বেচারী হবে কোন দুঃখে। মুখ ভেংচি কাটে তাদের কথার উপর। তন্ময়ের গলা জড়িয়ে কথা নেয়, তুমি আবার আসবে তো আংকেল!

তন্ময় মাথা নেড়ে বলে, আসব!

সে কেন আসে? অপ*রাধ বোধ থেকে। যে অপরা*ধের জন্য তনয়ার থেকে কখনোই ক্ষমা চায়নি সে। সেটা করলেও বোধহয় কম হয়ে যেত। এখন একা জীবনই তার চলছে বেশ!

অফিস টাইম শেষ হতেই তৃষ্ণা কে নিয়ে বাড়ি ফিরে উষ্ণ। তৃষ্ণার এর্নাজি তখন শূন্যতে। ঘুমে ঢলে পড়ে বাবার বুকের সাথে লেপ্টে শুয়ে থাকে। অবিশ্রান্ত ভাবে তাকে বুকের মধ্যেই জড়িয়ে ধরে বসে থাকে উষ্ণ। জেএস গাড়ি চালানোর মাঝে মাঝে ফিরে চায়। মিররে তাদের দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠে। বছর পেরিয়েছে, সময় পেরেয়েছে‌। সেই শোক থেকে এখন তারা সবাই মুক্ত। মুক্তই তো!

মুক্ত কি? যারা ভালোবাসে তারা কি মুক্তি চায়? তারা তো ভালোবাসার শিকলে নিজেদের বেঁধে রাখতে চায়। গাড়িতে বসে ঘুমে ঢুলতে থাকা তৃষ্ণা বাসায় পা রাখতেই ঘুম যেন কোথায় উড়ে চলে যায়। একশ ভাগ এর্নাজি নিয়ে বাবার সাথে ছোটাছুটি করে। তাকে পড়তে বসাতেই জান চলে যায় উষ্ণর। ছলচা*তুরি, বাহানা সবকিছু করানোর পরই স্কুলের হোমওয়ার্ক গুলো করিয়ে নেয় সে। এরপর যত রাত্রি গভীর হয় ততোই একাকিত্ব ঘিরে ধরে তাকে। ধীরে ধীরে আঁধার যতই ঘনিয়ে আসে ততোই যেন পুরনো ক্ষ*ত গুলো মাথা জাগা দিয়ে উঠে। মনে করিয়ে দেয়, সে নেই! তার প্রিয়তম, তার অর্ধাঙ্গিনী, সেই নীলাম্বরী তো আর নেই। তবে সে আছে কেন? কেন? এই তো, এই পুচকের জন্য! তৃষ্ণার জন্য। নাহলে তারই বা কে ছিল?

তৃষ্ণা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বাবার পাশে বসে। বেলকনিতে বাবা ইজি চেয়ারে বসে আকাশ দেখছে। তৃষ্ণা বিজ্ঞর মতো তার পাশে চেয়ারে বসে রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে তার বাবাকে। তার ধারণা বাবা এসব গল্প কোনকালেই শুনেনি। উষ্ণ ভাবটাও সেরকম। তৃষ্ণা এবার ছবি দেখে দেখে বলল,

“এরপর বড় রাজা তার রাজত্ব ফিরে পায়,‌ রাজ্যের সকল মানুষ সুখী হয়ে যায়!”

উষ্ণ হাততালি দিয়ে বলল, খুব সুন্দর!”

পোকরা দাঁত বের করে হেসে উঠে তৃষ্ণা। এই গল্পটা আজই স্কুলে শুনেছে সে। বাবাকে তো শুনানো চাই। এরপর শুরু হলো গল্প বলা। বিরাট গল্প। আজ কি কি করল,‌কার সাথে কি কথা হলো সবটা বলা চাই। একবার বলে ক্লান্ত না হলে দুবার বলবে। উষ্ণ তখন আরো দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে শুনবে। তার চুল গুলো আঁচড়ে দিবে। হাত পায়ে লসুন মাখিয়ে বলবে, এরপর?”

“এরপর.. ইয়া বড় হামি ছাড়ে সে। বলে,

“তুমি জানো না, স্কুলে গুট্টো কি মোটা হয়েছে বাবা। মিস আজ বলেছে গুট্টু একটু কম খাও। নাহলে তো বেলুন হয়ে যাবে বাবা!”

উষ্ণ হেসে বলে, তাই!”

তৃষ্ণা মাথা ঝুলায়। একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে নেচে নেচে বলে। দেখে বাবার আনন্দ। বাবা তার চুল আঁচড়ে দেওয়ায় এবার সেও বাবার চুল আঁচড়ে দেয়। বলে, বাবা জানো, দিতি কি বলে?

“কি বলে মা?”

“বলে তোর আর তোর বাবার চুলগুলো সমান কেন করে? ছেলেরা কি বড় চুল রাখে?”

“রাখে না বুঝি?”

“রাখে তো! মিস তো বলল রাখে। আমি কি বলেছি জানো?

“কি?

“বলেছি বাবা আমাকে খুব ভালোবাসে তাই আমাদের চুলগুলোও একরকম। তাই না বাবা!

আদুরে ভঙ্গিতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। হাসির ঝলমল শব্দ। উষ্ণ পিছন ফিরতেই মনে হলো,‌ তৃষ্ণা না যেন তনয়া তার গলা জড়িয়ে হেসে বেড়াচ্ছে। গল্প করতে করতে তার বুকের মধ্যেই শুয়ে পড়ে ছোট তৃষ্ণা। উষ্ণ ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে তার মাথায় হাত বোলায়। অন্য হাত তার পায়ের কাছে। ছায়ামূর্তি তার পায়ের কাছে মাথা ঠেসিয়ে বলে,

“কি করলে আজ?”

“অনেককিছু, জানো না বুঝি? সবসময় তো আমার সাথেই থাকো।”

চিকন হাসির শব্দে ঘরে নিস্তব্ধ নেমে এলো। ছায়ামূর্তির চুলগুলো যেন হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। কা*তর স্বরে বলল, আমায় একটু আদর করবে না,‌মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছ না যে?”

উষ্ণ হাত বাড়ায়। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সে বলে, দিন দিন তোমার ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। আমায় আর আগের মতো ভালোবাসো না বুঝি।

উষ্ণ মৃদু হেসে জবাব দেয়, “তুমি কি আমায় স্থির থাকতে দাও? তোমায় ভালো না বেসে উপায় আছে আমার!”

দুটো মায়াবী চোখ ভেসে উঠে। অশ্রুসিক্ত টলটলে নয়ন। কা*তর স্বরে বলে, যাহ! আমায় এতো ভালোবাসো নাকি?”

“খুব ভালোবাসি! তুমি তো বাসলে না।‌ এতো ভালোবাসলে ছেড়ে চলে যেতে কি? একা ফেলে রেখে যেতে না আমায়!

নিস্তব্ধ ঘরে নিঃস*ঙ্গতা আঁকড়ে ধরল। গুমোট অন্ধকার ঘরে বেলকনিতে আধো আধো নিয়ন আলোয় মায়াবী ভরা মুখখানা, আর্তনাদ করে ছায়ামূর্তি বলল,‌ “আসছি‌ তবে?”

দমকা হাওয়া বয়ে যায়। ছায়ামূর্তির চুল গুলো হাওয়ায় দুলতে থাকে। সে ভেসে যায় বাতাসের সাথে। উষ্ণ চোখ বুজে শুয়ে পড়ে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখের কার্নিশ বেয়ে। অস্পষ্ট গম্ভীর কাতর স্বরে বলে উঠে, “চলে যাচ্ছ? তুমি ছিলেই বা কবে?”

~ সমাপ্ত