তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-০৪

0
14

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৪

নতুন বসের জন্য তার কেবিনের সবকিছু বদলে ফেলা হয়েছে। নতুন ফার্নিচার, নতুন টেবিল চেয়ার এমনকি নতুন এসি অবধি কেনা হয়েছে। মানুষের টাকা থাকলে কতো কিছু কিনতে ইচ্ছে করে। এই তো, আগের এসিটা কিনেছে মাসখানেক হয়নি। এর মধ্যেই চেঞ্জ করে ফেলল। এছাড়া আরো বদল ঘটেছে। কাঁচের দেওয়াল বসানো হয়েছে। ভেতর থেকে বাইরের সবকিছু ভালোই স্পষ্ট দেখা যায়। অথচ বাইরে থেকে কিছু্ই দেখা যায় না। সকালে পিয়ন চাচা বলছিলো, “স্যারের বড় পোলা স্যারের খুব আদরের। বিদেশ থেকে পড়ালেখা কইরা আইছে তো। তাই এতো শখ!” এই মানুষটার চোখে মুখে হাসি উচ্ছ্বাস। একজন বাবাই তো বুঝতে পারে আরেক বাবার আনন্দ। বাইর থেকে পড়াশোনা করে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে তার ব্যবসায় হাল ধরবে। কম কিছু কি!
তনয়া হেসে বলেছিলো, “তা চাচা, আপনার মেয়ে এবার কিসে পড়ে?”
“এই তো এসএসসি দিবো।”
“পড়াবেন তো অনেক। অনেক পড়লে অনেক বড় মানুষ হতে পারবে।”
চাচা দাঁত পাটি বের করে হাসলেন। তার অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো পুরো কেবিনের চারদিক ঘুরে দেখল। তার চোখ বলে দিচ্ছিল তার মনের কথা। একদিন তার মেয়েও এমন বড় কোন জায়গায় নিশ্চিত চাকরি করবে। তখন তিনি আর এসব পিয়নের কাজ করবেন না। বড় বড় স্যারদের জন্য চা কফি বানিয়া আনা, ফাইল এদিক থেকে সেদিক নিয়ে ছোটাছুটি করা, তাদের ফায়ফরমাশ খাটা এসব কিছু করতে হবে না। সেদিন তিনিও একজন গর্বিত বাবার মতো বলতে পারবে। আমার মেয়ে পড়াশোনা করে এখন বিরাট অফিসার!
.
ধোঁয়া উঠা গরম চা। সারাদিনে আজ অনেক খাটাখাটুনি হয়েছে। নতুন বসের কাল জয়েন অফিসে। কি অদ্ভুত তার নাম। উষ্ণ! উষ্ণ স্যার! এটাও কারো নাম হয়। এমন নাম কখনো শুনেনি তনয়া। ম্যানেজার সাহেব কে এদিক আসতে দেখেই তড়িঘড়ি করে চায়ের কাপ রেখে দিল। হাতে ফাইল গুলো নিয়ে শুধালো, “স্যার! এগুলো কি স্যারের রুমে রেখে আসবো।”

ম্যানেজার সাহেব চলেই যাচ্ছেন। স্বর শুনে থেমে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“এগুলো! হ্যাঁ, রেখে আসো। বলছি তনয়া ফুলের ব্যবস্থা করো তো। স্যার আসছে, ফুলের বুকে দিয়ে তো স্বাগতম জানাতে হয়।”
“জি স্যার। আমি তন্ময় কে বলে দিচ্ছি।”
“ও তো সেই কখন চলে গেছে। জানো না।“
“চলে গেছে?”
“হ্যাঁ, আরো আগেই তো আমাকে বলে চলে গেলো। তোমার কাজ ও আর বেশি নেই। শেষ করে চলে যেও।”
“জ্বি স্যার।”

ম্যানেজার স্যার চলে যেতেই তনয়া ভাবনায় পড়ে গেল। তন্ময় চলে গেছে! কখন? তাকে তো বলে গেলো না। রোজ তো বলে যায়। আজ কি হলো?ফোন বের করে কল করতে করতে স্যারের কেবিনের দিকে আগালো। চা খাওয়া আর হলো না। গরম চা পড়ে রইল তার জায়গায়। ধোঁয়া উড়তে উড়তে এক সময় চা ঠান্ডা জল হয়ে গেল। সময় পেরিয়ে গেছে বহুক্ষণ। তন্ময় এখনো ফোন করেনি। তার ফোনটাও ধরেনি। শেষবারের মতো সবটা দেখে নিল সে। রাত্রি ৯ টা বাজে। তন্ময়ের জন্য বেশ চিন্তে হচ্ছে। শরিফ ও বের হয়ে গেল। এবার তাকেও যেতে হয়। অফিস থেকে বেরিয়ে আসতেই ফোনটা বেজে উঠল। তন্ময়ের ফোন! যাক শেষ অবধি ফোনটা করার সময় হয়েছে তার।

“হ্যালো! হ্যাঁ, কোথায় তুই? কতোক্ষণ ধরে কল করছি..
“ম্যাম বলছেন!”
“জি! আপনি কে? আর তন্ময় কোথায়?”
“ম্যাম স্যার আমাদের বারে এসে একটু বেশিই ড্রিংক করে ফেলেছে। এখন উঠে দাঁড়াতেও পারছে না। আপনি যদি একটু এসে..
তনয়া আঁতকে উঠল। এ কি ধরণের কথাবার্তা! তন্ময় বারে বসে ড্রিংক করছে! উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় আপনাদের ঠিকানা?”
“বলছি ম্যাম। আপনি নোট করে নিন।”
.
কোনমতে একটা উবার ভাড়া করে নিল তনয়া। বার মোটেও কাছে কোথায় নেই। বেশ দূরে! তাদের অফিস থেকে উবার ভাড়া করলে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। তবে তার যেতে যেতে ঘণ্টা খানেকের মতো লাগবে মনে হচ্ছে। জায়গার নামও চিনে না ঠিক করে।

অতঃপর তার যাত্রা শুরু করল। বাইরে আকাশে কালো ঘন মেঘ। তনয়া গাড়ির পিছনের সিটে খোলা জানালার কাছে বসা। দমকা হাওয়া তার গায়েও এসে ঠেকছে। তার আর তন্ময়ের সম্পর্ক তার কাছে যেন একটা গোলক ধাঁধা। তাদের শুরুটা ছিল অন্যরকম। লোকে বলে একটা ছেলে আর মেয়ে কখনোই বন্ধু হতে পারে না। কিন্তু তন্ময় তাদের দেখিয়ে দিল। সে আর তনয়া শুধুই বন্ধু আর কিছু না। নাহলে তাদের এতো দিনের দীর্ঘ বন্ধুত্বে তন্ময় একটি বারের জন্যও তার মনের খবর টের পেলো না। একবারও ঠিক করে তাকে চেয়ে দেখল না। তনয়া নেহাত কম সুন্দরী নয়। ভালোই দেখতে সে! অথচ দুদিনের জন্য আসা ওই তরী কে এক নিমিষেই ভালোবেসে ফেলল। কাছে থাকা এই তনয়াকে বিন্দুমাত্র দাম দিলো না সে। কতো শতো আক্ষেপ হয় তার!
তন্ময় ঢুলছে। সত্যিই আজ একটু বেশি করে ফেলেছে। চোখ মেলে তাকাতে অবধি পারছে না। সেখানকার স্টাফের কাছে বার বার তাকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখছে। কিন্তু তন্ময়ের কোন হুঁশ করছে। বিরবির করে কি বলছে কানেও ঠেকছে না ঠিক করে। অতঃপর বিল পরিশোধ করে বের হলো তারা। একাই তাকে ধরে নিয়ে আসল গাড়ির কাছে। এরপর গাড়ির ড্রাইভারসহ সে ধরে গাড়িতে বসাল। পাশেই বসে পড়ল তনয়া। সযত্নে তন্ময়ের মাথাটা নিজের ঘাড়ের কাছে রাখল। এবার গন্তব্য তন্ময়ের বাসা!

রাত ভালোই হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা ১১ টা ছুঁই ছুঁই। তনয়া বহু কষ্টে তন্ময় কে নিয়ে ফ্লাটের সামনে এলো। দরজার সামনেই তন্ময় ধপ করে বসে পড়ল। তনয়া দরজার তালা খুলছে। তন্ময় মনমরা হয়ে বসে আছে। এতো নে*শা করার পরেও তন্ময় একটা উলোট পালোট কাজ করেনি। একদম থম মেরে বসে আছে। কারণটা কি? ও কি কোন কারণে খুব কষ্ট পেয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্ট অনেক সময়ই মানুষদের নিশ্চুপ করিয়ে দেয়। তন্ময়ের বেলায় ও তাই ঘটল! দরজা খুলে তন্ময় কে ধরে আবারো দাঁড় করিয়ে ঘরে ঢুকানো হলো। তাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘরের কাছে চলে গেল। টক কিছু খেলে নাকি নে*শা কমে! তনয়া তাই খুঁজছে। কিন্তু কোথাও কিছু নেই। ফ্রিজে একটা লেবু অবধি পেলো না সে। গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে এসে হাজির হলো। তন্ময় এক জায়গায় ঝিম মেরে বসে আছে। ওর কি হয়েছে?

কাঁধে হাত রাখল তনয়া। শুধালো, “তন্ময়! কি হয়েছে তোর?”
তন্ময় জবাব দিলো না। কেমন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার মুখের দিকে। তনয়া গ্লাসটা মুখের সামনে ধরল। তন্ময় নিশ্চুপে পানি খেয়ে নিল। এর মধ্যে ফোনটা বেজে উঠলো টুং টুং করে। কোন মেসেজ নাকি? তন্ময়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে দেখল রিমাইন্ডার! ওহ আজ তরীর জন্মদিন ছিলো তবে। আফসোস হচ্ছিল তনয়ার। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তন্ময়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ভুলে যা সবকিছু! কেন নিজেকে এতো কষ্ট দিচ্ছিস তন্ময়? আমার ভালো লাগে না তোকে এতোটা কষ্ট পেতে দেখলে!”

গলা ভার হয়ে উঠল। আচমকা তার গাল বেয়ে টপ টপ করে অশ্রু ঝরে পড়ল। ঠোঁট কামড়ে ধরে তনয়া কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। ফোনের স্ক্রিনে এখনো তরীর হাস্য উজ্জ্বল ছবি। হৃদয়ের পুরনো ক্ষ ত জেগে উঠল। ভালোবাসার মানুষ অন্য কাউকে ভালোবাসে! এই চরম সত্য মানতে মানতে এবার ক্লান্ত সে। তন্ময় এখনো গম্ভীর হয়ে বসে আছে। সে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগটা হাতে নিল চলে যাবার উদ্দেশ্যে। স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, “আমি চলে যাচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়!”

অতঃপর পা বাড়াল। মনে হলো তন্ময় তার পিছনে দাঁড়িয়ে। সেও পিছন ফিরতেই আচমকা তন্ময় তাকে জড়িয়ে ধরল। সারা শরীর ঝনঝন করে উঠল তনয়ার। হাত থেকে ব্যাগ টা পড়ে গেল মেঝেতে। কিৎকর্তব্যবিমূঢ় সে! ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে লাগল। তন্ময়ের গায়ের গন্ধ তাকে হতভম্ব করে তুলল। তন্ময় তার কানের কাছে ফিসফিস করছে। এখন না, সেই কখন থেকেই ফিসফিস করছিলো। তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছে। তন্ময় তরী কে ডাকছে। কানের কাছে এখনো তরীর নামের ধ্বনি। আচমকা চমকে উঠল তনয়া। তন্ময় থেমে থেমে বলছে, “আমি তোমাকে ভালোবাসি তরী! আমায় ছেড়ে যেও না প্লিজ! কখনো যেও না!” কতো আক্ষেপ, কতো বেদনা কথাগুলোয়। বলতে বলতে তন্ময় যেন কেঁদে উঠল। ছিঃ! তরীর এই কান্নায় ও মন গলল না। ও কিভাবে পারল তন্ময় কে ছেড়ে আসতে।

শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। তনয়া খুশি হতে চেয়েও পারছে না। কারণ সে তরী নয়। এ যেন সারাজীবনের আক্ষেপ! সে কেন তরী হলো না! তন্ময় কেন তাকে এতো ভালোবাসলো না! তাকে ভালোবাসলে তো আর এতো কষ্ট পেতে হতো না। তন্ময় বিনীত করছে। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। দুহাতে মুষ্টি বদ্ধ তনয়ার এক হাত। তনয়া মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদছে। তন্ময়ের এই কষ্ট যেন সে দেখতে পারে না। হাত ছাড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো। সে তরী নয়! তন্ময় তরী কে চায়! সে তো তরী হতে পারবে না। তরী নেই তন্ময়ের জীবনে। কোথাও নেই! ফ্ল্যাটের বাইরে এসে দরজার সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে রইল। আবার আড়ি পাতল। না তন্ময় আসছে না। নে’শার ঘোরে কিছু করতে পারবে না সে। এখন কাঁদছে! কাঁদতে কাঁদতে নিশ্চিত ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। সকালে সমস্ত কিছু ভুলে যাবে!
.
রাস্তায় কোন গাড়ি ঘোড়া কিছু নেই। অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় তনয়া একা হাঁটছে। আকাশে মেঘের গর্জন। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তনয়া থেমে গেল। মাথা উপুড় করে আকাশের দিকে চাইল। বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে তার শিয়রে। মূহূর্তের মধ্যে ভিজে গেলো সে। বৃষ্টির থেকে বাঁচার চেষ্টা করেনি। উল্টো দাঁড়িয়ে রইল। এই বৃষ্টি যেন তার জন্যই এসেছে। এক জায়গায় নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছে সে। খুব কষ্ট লাগছে তার। শুধু আফসোস আর দোষারোপ! কেন এতো যন্ত্রণা! কি আছে এই ভালোবাসায়। শেষ অবধি সে যেন কষ্টকে আলিঙ্গন করে নিল। জীবন জড়িয়ে গেল বেদনার চাদরে। তার আর্তনাদ এই‌ বৃষ্টির সাথে মিলিয়ে গেল, কান্না মূর্ছা গেল বৃষ্টির জলে। কেউ জানলো না তনয়া একা আছে! কষ্টে আছে! কে জানবে? তার খোঁজ নেবার আদৌও কি কেউ আছে? যখন বাবা সাদা চাদরে শুয়ে ছিলো, হাতটা আর শক্ত করে ধরেনি তখনি সে বুঝে গেছে সে একা। মা যখন আর আগলে নেয়নি তখনি বুঝে গেছিল এই পৃথিবীতে আর কেউ তাকে আগলে রাখবে না। কেউ না!

বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝমিয়ে। অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজার কারণে এখন শীত শীত লাগছে খানিকটা। শরীর তখনো বোধ করেনি এসব। হঠাৎ এক চলন্ত গাড়ি এসে ঠেকল পাশ বেয়ে। হর্ন বাজছে। তনয়া মুখ তুলে চাইল। গাড়ির জানালা থেকে কাঁচ কিছুটা নামল। সেখান থেকে একটা হাত বেরিয়ে এলো। হাতে একটা ছাতা। তনয়া বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল। তবুও হাত বাড়িয়ে ছাতাটা ধরতেই ছেড়ে দিল অপরপক্ষ। অতঃপর গাড়িটা চলে গেল। তনয়া এখনো বিমূর্ত। হঠাৎ করেই তার কান্না থেমে গেল। গাড়ির পিছনে চেয়ে থেকে হাতের ছাতার দিকে তাকাল। তার জন্য এতো মায়া হঠাৎ কার হলো?

#চলবে….