তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-০৯

0
24

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৯

“ভালোবাসি! আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি! শুনছো তুমি?” শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গভীর স্বরে বলল উষ্ণ। তনয়া বিহ্বল! উষ্ণ স্যারের গরম নিঃশ্বাস তার ঘাড়ের উপর পড়ছে। স্যার ফিসফিসিয়ে কানের কাছে “ভালোবাসি” বলছে। তার গাঢ় চুমুতে তনয়ার সারা শরীরে বিদ্যুতের ন্যায় তরঙ্গ ছুটে চলল। সাগরের উথালপাতাল টেউয়ের মতো তার মন আনচান করছে। ওষ্ঠজোড়া কাঁপছে। কথা আঁটকে আছে গলায়। পুরো শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। এসব অনুভূতি আজ প্রথমবার। কখনো কোনো পুরুষ এতো ঘনিষ্ঠ ভাবে তার গায়ে ঘেঁসতে পারেনি। তনয়া সেসবের ক্ষীণ চেষ্টাও করেনি। দৃষ্টি জোড়া স্থির করে আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে। রাগে চোয়াল দুটো শক্ত করে নিল। রক্ত যেন টগবগ করছে। উষ্ণ দৃষ্টি ফিরে আয়নাতে ফিরতেই তাঁকে ছেড়ে ছিটকে দূরে চলে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “তততুমি এখানে? ইরিশা কোথায়? আমি তো ভাবলাম ইরিশা এসেছে!”
তনয়া কিৎকর্তব্যবিমূঢ়! তার বিমূর্ত চাহনি উষ্ণ স্যারের মুখের উপর। তিনি কি ভয় পেয়েছেন। স্যার বোঝানোর চেষ্টা করছে। কথাগুলো কেমন এলোমেলোভাবে ঠেকল তনয়ার কাছে।

“আমি ভাবলাম ইরিশা এসেছে। তুমি চলে আসবে এটা তো ভাবিনি। সত্যি আমি ইরিশাকে ভেবেছিলাম। এজন্য তোমায়….
থেমে গেল। তনয়া চোখ বন্ধ করে নিল। ছিঃ ছিঃ ওসব কথা সে শুনতেও চায় না। দরজার ওপাশে কেউ ছুটে আসছে। জোরে বলে উঠল, “উষ্ণ!”
তনয়া পিছন ফিরল। উষ্ণ এগিয়ে যেতেই সুন্দরী রমনী তাকে জড়িয়ে ধরল। হাস্যোজ্জ্বল দু’জনের মুখ। তনয়ার কাছে বোধহয় সবকিছু পরিষ্কার হচ্ছে। ইরিশা তাকে ছেঁড়ে দিয়ে গাল দুটো ধরে বলল, “ও মাই ডার্লিং! কতোদিন পর দেখলাম তোমায়! মাই সুইটিই!“
গাল দুটো টেনে ধরল। তার ব্যবহার অদ্ভুত ঠেকল তনয়ার কাছে। বেশি বেশি! লোকদেখানো মনে হচ্ছে। উষ্ণ স্যার হাসছে। একবার উষ্ণ স্যারের দিকে আরেকবার সুন্দরী রমনীর দিকে দৃষ্টিপাত করল। এই ঝুটিওয়ালা ভাদাইম্যা বেডার কপালে এতো সুন্দর মাইয়াখান কেডা?

উষ্ণ নরম হাতে তার কোমর ধরে তনয়ার দিকে ফিরে একগাল হেসে বলল, “সরি তনয়া। আমি ভেবেছি ইরিশা এসেছে। মিট ইরিশা জামান! আমার ফিয়োন্সে!”
ঠোঁটের রেখা টেনে ইরিশা জামান কে ভালো করে লক্ষ্য করল। তাকে কোনদিক থেকে ইরিশা জামানের মতো দেখতে। ধবধবে সাদা ভেড়ার পশমের মত গাঁয়ের রঙ, ঘন কালো চুল। এই চুলগুলো সামনে দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট করে কাটা। ছোটবেলায় যেমন বক কাটিন দিত ঠিক তেমন। পিছনের চুল গুলো লম্বা। তার চিকন লম্বা দেহ, আকর্ষণীয় ফিগার, টাইট ফিটিং জামা, তিন ইঞ্চি উঁচু হিল! এসব কখনো পরে তনয়া! কি আশ্চর্য! কোন দিক থেকে তাঁরা এক। এই মেয়ের কোমর তো নয় যেন সাক্ষাৎ সরু রাস্তা। এতো চিকন কোমর কারো হয় নাকি? বিভ্রান্ত তনয়া। উষ্ণ তার হাত দুটো ধরে আদুরে কণ্ঠ বলল , “আমার একটু কাজ আছে, সেরে আসছি। দেখো কাজের জন্য তাকে এখানে ডেকেছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো কিউটি!” বলে হাতের উপর আলতো করে চুমু খেয়ে চোখ টিপ মারল। তনয়ার ইচ্ছে করে দেয়াল ঘুরে দাঁড়াতে। এদের রঙ ঢঙ প্রেম তার সহ্য হচ্ছে না। কি অদ্ভুত! কারো সুইটি কারো কিউটি! এতো বড় ডেঙা লোক এমন কিশোরের মত আচরণ কেন করছে? একে কি ছোট বেলায় ভিটামিন ক্যাপসুল খাওয়াতে ভুলে গেছিলো। তনয়া চোখ ঘুরিয়ে দেওয়ালের দিকে ফিরল। মেয়েটা ঠকঠক করে হেঁটে চলে গেল। উষ্ণ শব্দ করে শ্বাস ফেলে বেলকনির দিকে এগিয়ে যেতে বলল, “আসো!”

বহু দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে তনয়া আগাল। বেলকনিতে টি টেবিলের সামনে চেয়ার বসানো। উষ্ণ স্যার পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসল। তনয়া ধপ করে ফাইলগুলো টেবিলের উপর রাখল। উষ্ণ স্যারের টনক নড়ে উঠল। এখনো কি রেগে আছে নাকি? উষ্ণ স্যার উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, “বিলিভ মি তনয়া, আমি সত্যিই চিনতে পারেনি। পিছন থেকে তোমায় দেখতে পুরো ইরিশার মতো!”

তনয়া চোখ মুখ কুঁচকে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,‌“আপনি কি অন্ধ না চোখে কম দেখেন? কোন দিক থেকে আমরা এক!”
“তুমি পিছনে ঘুরে দাঁড়াও, আমি বলছি!”
“একদম বাজে কথা বলবেন না!”
ধমকে উঠল তনয়া। উষ্ণ হাসার চেষ্টা করল। তবুও সাফাই গাইতে লাগল, “শোন, আমার কোনো খারাপ ইনটেনশন ছিলো না। আমি সত্যি বলছি। তুমি দেখলে তো, এই মাত্র ইরিশা আসলো। আমার ফিয়োন্সে। বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার সাথে!”
তনয়া ছোট ছোট চোখ করে তার আঙুলের দিকে তাকাল। হ্যাঁ, অনামিকা আঙ্গুলে আংটি খান তো দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু তবুও স্যারের কথার উপর তার বিন্দুমাত্র আস্তা নেই। বিয়ে ঠিক হয়ে থাকলেও আজকের পর থেকে এই স্যারের চরিত্র নিয়ে তার সন্দিহান আছে। উষ্ণ স্যার আবারো সাফাই গাইছে।
“উফ! তুমি দেখছি আমায় বিশ্বাস করছো না। আচ্ছা সরি বললাম তো। জানি যা করেছি ভুল করেছি। না না অন্যায় করেছি। এমন কাজ কেউ করলে তুমি নির্ঘাত তাকে চ ড় মারতে। আমায় মারতে পারো‌ কোনো সমস্যা নেই। তবুও প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো। যা হয়েছে এটা একটা এক্সিডেন্ট! আমি…

ঠাস করে একটা চ ড় পড়ল উষ্ণর গালে। তটস্থ হয়ে গেল উষ্ণ! চোখ গরম করে তনয়ার দিকে তাকাল। তনয়া একগাল হেসে বলল, “এবার ঠিক আছে!”
“তুমি সত্যি সত্যি আমায় চ ড় মারলে?”
“আপনিই তো বললেন!”
গালে হাতখানা ঘসে উষ্ণ হেসে উঠল। উপহাসের হাসি। বলল, “এবার বিশ্বাস হলো। যেসব কথা তোমায় বলেছিলাম সেগুলো তোমার জন্য ছিলো না।”
“হ্যাঁ, আপনার ফিয়োন্সর জন্য ছিলো। একশবার বলেছেন কথাটা। মনে আছে। কিন্তু স্যার এইবারের‌ মতো আমি আপনাকে ছেড়ে দিলাম। এরপর থেকে এই যে, এতো টুকু দূরত্ব রেখে আমার সাথে দাঁড়াবেন। ফাইলগুলো ছেঁড়ে যাচ্ছি। কোনো সমস্যা হলে অফিসে এসে বলবেন। আমি যাচ্ছি!”

হনহন করে বেরিয়ে গেলো তনয়া। রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে আরো দুটো চ ড় মেরে আসতে। মনটা তাহলে শান্তি পেতো। উষ্ণ চৌধুরী গালে হাত রেখে হাসছে। এই চ ড়ের আঘাত তার কাছে কিছু না। জিভ দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে কামড়ে ধরল। গালে হাত রেখে দেয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়াল। তাঁর চোখ সামনের দিকে। বাড়ি ছেড়ে তনয়া বেরিয়ে যাচ্ছে। উষ্ণের তীক্ষ্ম দৃষ্টি সেখান থেকে একবিন্দুও নড়ল না। তাঁর বাঁকা হাসিই বলেই দিলো কতো বড় বাটপার সে। কিন্তু প্রথমেই নরম হাতে চ ড় খাওয়ার ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই প্রথম ছোঁয়া আরো সুন্দর, রোমাঞ্চকর করা যেত। আজও কম হলো না! সার্ভেন্ট এসে ডেকে গেলো। তিলোত্তমা বেগম ডাক পাঠিয়েছেন!
.
ডাইনিং টেবিলে তিলোত্তমা বেগম, ইরিশা জামান আর শেহনেওয়াজ ঊষাণ চৌধুরী! উষ্ণ চৌধুরী নিচে নেমে এই তিন মুখ দেখে ভীষণ বিরক্ত হলো। তিনজনই তার খুব অপছন্দের ব্যক্তি। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে এই অপছন্দ ব্যক্তিদের দেখতে হয়। কবে যে ঘুম ভেঙ্গে তনয়ার মতো মিষ্টি একটা মুখ দেখবে তারই অপেক্ষা কেবল। তিলোত্তমা বেগম পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে ইরিশা প্লেটে দিল। মিষ্টি করে হেসে উষ্ণ চৌধুরী কে ডাকল। বলল, “দাঁড়িয়ে আছো যে। এসো বসো!”
উষ্ণ বেশ একটু দূরত্ব রেখে বসল। টেবিল বিশাল বড়। তার এক প্রান্তে তিলোত্তমা বেগম অন্যদিকে উষ্ণ চৌধুরী। ঊষাণ চৌধুরী ইরিশার কানে ফিসফিসিয়ে কিসব বলছে আর হাসাহাসি করছে। তিলোত্তমা বেগম এবার গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, “বিয়ে কবে করতে চাইছো? কোম্পানিতে জয়েন করেছো। জামান সাহেব বলেছিলো এবার বিয়েটা সেরে নিতে!”

উষ্ণ চৌধুরী জুসের গ্লাসে চুমুক দিল। অতঃপর বলল, “যখন ইচ্ছে হয় তারিখ ফিক্স করে ফেলো!”
“তোমার‌ কোনো অসুবিধা নেই বলছো?”
“না কিসের অসুবিধা? তোমার ভাইয়ের মেয়েকে আমায় কাছে গছিয়ে দিতে চাইছো এটাতে কিসের অসুবিধা আছে?”
তিলোত্তমা বেগম খাওয়া থামিয়ে উষ্ণের দিকে ফিরলেন। থমথমে কণ্ঠে বললেন, “কি বললে?”
উষ্ণ খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমার খাওয়া শেষ!”
“আমার কথা শেষ হয়নি। বসো!”
“আমার কথা বলা শেষ!”
তিলোত্তমা বেগম কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। ইরিশা তার হাতটা ধরে আশ্বাস দিল। উষ্ণ তাঁর সামনে দিয়ে বেপোরোয়া ভাবে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেলো। এসব দেখে ঊষাণ চৌধুরীর হাসি পাচ্ছে। খুব কষ্টে সে হাসি থামাল।

অফিসে যাবার জন্য উষ্ণ চৌধুরী তৈরি হচ্ছে। দরজায় কড়া নাড়ল ইরিশা জামান। গায়ের সুট টা পরে তার দিকে ফিরে তাকাল উষ্ণ চৌধুরী। ইরিশা জামান এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। দু হাতে সুট টা ঠিক করে দিয়ে বলল, “খাবার টেবিলে এসব কি বলছিলে?”
“মিথ্যে বলিনি!”
ইরিশা চোখ গরম করে তাকাল। মূহুর্তে মিলিয়ে গেল। কিঞ্চিত হেসে বলল, “তখন অফিসের মেয়েটা ছিল বলে একটু ভালো করে কথা বলেছি। এর মানে এটা ভেবে নিও না আমায় বিয়ে করার জন্য তুমি যোগ্য!”

উষ্ণ কলার কাছ থেকে তার হাতটা সরিয়ে দিল। হেসে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “যোগ্যতা নাই থাকুক। আমায় বিয়ে করার জন্য তুমি আর তোমার ফুফু কেন উঠে পড়ে লেগেছো তা না আমি ভালোই জানি। এসব করলে আমার ভাগের সম্পত্তি তোমার হাতে। আল্টিমেটলি তোমার ফুফুর হাতে। এই তো!”
“আমি ইরিশা জামান উষ্ণ! তোমার চেয়ে কিছু কম না। এই বিয়ের কথা তোমার বাবা নিজে আমার বাবাকে বলেছেন। আশা করছি তুমি কারো সম্মান নিয়ে খেলবে না।”
উষ্ণ চৌধুরী হেসে মাথা দুলাল। ইরিশা জামান দুই হাত বাহুতে গুঁজে উপহাস করে বলল, “দেখো বলছিও কাকে? যার মা তার স্বামীর সম্মানের কথা ভাবলো সেই ছেলে আর নতুন কি করবে? রক্ত বইছে তো শরীরে অস্বীকার কি করে করবে?”
উষ্ণ চৌধুরী চোয়াল শক্ত করল। এগিয়ে এসে ইরিশা জামানের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “তাহলে বিয়ে করতে যাচ্ছ কেন? হাতের পুতুল বানানোর জন্য!”
ইরিশা ছিটকে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। কসিয়ে একটা চ ড় মারল উষ্ণ গালে। উষ্ণ চোখ বন্ধ করে সহ্য করে নিল। ইরিশা ঈষৎ হেসে বলল, “আমার হাত ধরছো? সাহস তো দেখো! ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি। এই চ ড় ছিলো টেবিলে সবার সামনে আমাকে অপমান করার জন্য। এরপর আমার নামে কিছু বলার আগে দু’বার ভাববে উষ্ণ চৌধুরী!”
ঠকঠক উঁচু হিলের শব্দ ফেলে ইরিশা জামান বেরিয়ে গেলো। শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী পিছন ফিরে আয়নাতে তাকাল। গালে পাঁচ আঙুল বসে গেছে। দ্রুত লাল হতে শুরু করেছে। আবারো গালে হাতখানা রেখে হেসে উঠল। দিনে পরপর দুইবার তাঁর গালে চ ড় পড়ল। সুন্দরীরা বোধহয় হ্যান্ডসাম ছেলেদের সহ্য করতে পারে না। কি যে হবে তোর উষ্ণ! নিজের উপরই দয়া হচ্ছে তাঁর। চোখে সানগ্লাস পরে বেরিয়ে গেলো সে। সকাল হতে না হতেই দুটো গালে পড়ল। সারাদিনে আর কতো গুলো পড়বে কে জানে?

#চলবে