#তোর_মায়ায়_আবদ্ধ
#পর্ব_৩
#আঁধারিনী(ছদ্মনাম)
ফজরের আজান কানে আসতেই হুসে ফিরলাম। একদিনেই নিজের জীবনের সব কিছু কেমন ওলোট পালোট হয়ে গেলো।অভ্রের বলা প্রতিটা কথা কেমন জানি ঘৃণায় কাঁটার মতো বিঁধছে। আর শুভ্রের করা অপমান গুলোতে ভিশন কষ্ট হচ্ছে।আমার সাথে এমনটা না হলেও পারতো।ভিশন কষ্ট হচ্ছে। সারাটা রাত কাঁদতে কাঁদতেই যে কিভাবে পার করে ফেললাম হুসই ছিলো নাহ।
নাহ আর কাদবো নাহ এবার নিজের জীবন টা নিজেকেই গুছিয়ে নিতে হবে।চোখের পানিটুকু মুছে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে নিলাম।তারপর নামাজ পরে পুরো ঘরটার দিকে একটু খেয়াল দিতেই দেখলাম ঘরটা পুরো এলোমেলো। জিনিস পত্র চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।তাই ঘর পরিষ্কার কাজে লেগে গেলাম।ঘর পরিষ্কার করতে করতে হাঁপিয়ে গেছে।কারণ পুরো ঘর টাকে গোটা একটা জঙ্গল বানিয়ে রেখেছে ঘরের মালিক।বাড়ির অন্যান ঘরগুলো দেখেছি খুব পরিষ্কার পরিছন্ন।শুধু এই ঘরটাই এমন জঙ্গল।আল্লাহ জানে কতো বছর যাবত এই ঘর পরিষ্কার করতে দেয় নাহ।নাম তো শুভ্র কিন্তু কাজ গুলো এমন নোংরা কি করে।
আরো আধা ঘন্টা সময় লাগলো কাজ পুরো কমপ্লিট করতে।অনেকটা বেশিই ক্লান্ত হয়ে গেছি।এখন ছয়টাও বাজে নাহ বাড়ির সবাই উঠেছে কি-না তাও জানি নাহ।এক কাপ চা বা কফি খেতে পারলে শরীর টা একটু ভালো লাগতো।তাই৷ আর কিছু না ভেবে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।দেখে তো মনে হচ্ছে সবাই এখনো ঘুমিয়ে আছে তাই তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে ছুট লাগালাম।কিন্তু রান্না ঘরে গিয়ে কালকের সেই রোকেয়া মেয়েটাকে দেখতে পেলাম।মেয়েটা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমে জুড়ছে।আমি পাশে গিয়ে হালকা একটা কাশি দিতেই মেয়েটা লাফিয়ে উঠলো।
“বিশ্বাস করেন খালাম্মা আমি ঘুমাইতাছিলাম নাহ।আমি তো এটু ঘুমের অভিনয় পেকটিস করতাছিলাম।”
এতোক্ষণ আমাকে না দেখেই এসব বলতছিলো রোকেয়া।পিছন ঘুরে আমাকে দেখে অনেক জোরে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো মেয়েটা।
“ওহ আফামনি তুমি! আমি তো ভাবছিলাম খালাম্মা মনে হয় আইছে।তুমি এহানে?কিছু লাগবো তোমার?শোনো খালুজান তোমার দায়িত্ব আমারে দিছে।কিছু লাগলে তুমি শুধু আমারে কইবা আমি পদীপের জ্বীনের মতো সব তোমার সামনে হাজির কইরা দিমু।তুমি তো জানো না এই রোকেয়া কি ক্ষমতা!”
রোকেয়ার কথা শুনে না হেসে থাকতে পারলাম নাহ।হাসতে হাসতেই বললাম,
” আসলে আমি এক কাপ চা বানাতে এসেছিলাম।কোথায় কি আছে আমি তো কিছু জানি নাহ তুমি একটু দেখিয়ে দেও তাহলেই হবে।”
“আরে আফামনি আমি থাকতে তুমি কেন চা বানাইতে যাইবা!” বিস্ময় নিয়ে বললো রোকেয়া।
” কেনো কি হবে তাতে?”ওর এমন বিস্ময় নিয়ে বলাতে একটু অবাক হলাম।
” খালুজান আমার গর্দান নিবো।আর আমি তো চা বানাইতে দিয়াই এহানে দাঁড়াইলাম এতোক্ষণে মনে হয় চায়ের পানি উতলাইয়াও গেছে খাঁড়াও চা পাতা দিয়া লই।”বলতে বলতেই ফুটন্ত পানিতে চা পাতা দিলো রোকেয়া।
রোকেয়ার থেকে এক কাপ চা নিয়ে আমি ঘরে চলে আসলাম।শুভ্রের ঘরের সাথে সুন্দর একটা বারান্দাও আছে।এখান দাঁড়ালেই জুই ফুলের দারুণ মিষ্টি একটা গন্ধ এসে নাকে ধরা দেয়।আশেপাশে বোধদয় জুই ফুলের কোনো গাছ আছে।আর এখান থেকে খুব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও উপভোগ করা যায়।শহরের এই কোলাহল যুক্ত জায়গায় এসেও যে এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবো ভাবতেই পারিনি।বোঝাই যাচ্ছে এই বাড়ির মানুষ গুলো খুব প্রকৃতি প্রেমি।কাল মিহির ঘরের বারান্দায়ও দেখলাম বেশ কয়েকটা ফুলের টব।ফুলের টবের কথা মনে পরতেই মনে হলো আমিও তো এই বারান্দাটায় কয়েকটা ফুলের টব লাগাতে পারি।কিন্তু কাকে বললো এ কথা তখনই রোকেয়ার কথা মনে পরলো।ও তো বলেছিলো কিছু লাগলে ওকেই বলতে প্রদীপের জ্বিনের মতো সব হাজির করে দিতে পারবে।ওর ক্ষমতাটা তাহলে এবার পরক করেই নেওয়া যাক। কথা গুলো ভাবতেই আরো একগাল হাসলাম।মেয়েটা সত্যিই খুব মজার।
দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম শুভ্র ঘরে ডুকছে।ওকে দেখেই কাল রাতে কথা মনে পরলো।একি ও এদিকেই কেনো আসছে।ও যতো এগোচ্ছে আমার অবস্থা ততো বেশি খারাপ হচ্ছে। নড়ার মতো শক্তিও মনে হয় এই মুহুর্তে আমার নেই।পাথরের মূর্তির ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছি।আল্লাহ জানে কাল রাতের মতো আবার গলা টিপে ধরে কি-না।এই লোককে বিশ্বাসও নেই এই বারান্দা থেকে ফেলেও দিতে পারে।এই তিন তলা থেকে ফেলে দিলে তো আমায় আর আস্ত খুঁজে পাওয়া যাবে নাহ।আল্লাহ বাঁচাও।
যতো দোয়া পারতাম সব একসাথে পরতে লাগলাম।তাই মনে হয় আল্লাহর আমার উপর একটু দয়া হয়েছে।শুভ্র বারান্দার দিকে একদম এগিয়ে এসে পাশ কাটিয়ে অন্য দিকে চলে গেলো।ওহ আমি তো ভুলেই গেছি এ ঘরের জামা কাপড়ের আলমারি টা এই কর্নারেই।তাই তো ও একি আসছিলো।আর আমি কিনা কিসব আজগুবি চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছি।ডাক্তার দেখাতে হবে একটু বেশিই আজগুবি মাথার ভিতর জেঁকে বসে আজকাল।পাগল টাগল হয়ে গেলাম নাকি!ধুর আবারও উল্টো পাল্টা ভাবতে শুরু করে দিছি।মাথা থেকে সব ঝেড়ে ঘরে ঢুকলাম।
ঘরে এসে শুভ্রকে কোথাও পেলাম না।এরমধ্যেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে।আল্লাহ এই লোক এতো খাটাস কেমনে।আলমারি থেকে জামা বের করতে গিয়ে সকাল থেকে আমার এতো কষ্ট করে গুছানো সব জামা কাপড়ই আবারো এলোমেলো করে দিছে এই লোক।যাচ্ছে তাই একটা লোক।মনে মনে আরো কয়েক গালমন্দ করে আবারো গুছাতে লাগলাম।এমনিতে অলস প্রকৃতির আমি কিন্তু মাঝে মাঝেই ঝোক উঠে গুছানোর।আর আমার গুছানো জিনিস যদি কেউ একবার অগোছালো করে তাঁর অবস্থা আমি খুব একটা ভালো থাকতে দেই নাহ।কিন্তু এখানে নতুন মানুষ তাও আবার কথায় কথায় গলা টিপে ধরার মতো লোককে এই মুহূর্তে কিছু করা ঠিক হবে নাহ। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতেই জামা গুলো ভাজ করে আলমারিতে তুলে রাখছিলাম।
” এই মেয়ে আমার আলমারি ধরার সাহস পেলে কি করে?”কারো রাগান্বিত গলার স্বর পেয়ে পিছনে ঘুরলাম।
শুভ্র অগ্নি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ওই অবস্থায় আমার দিকে একটু তেড়ে আসতেই আমি লাফিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে নিজের গলা দুই হাত দিয়ে আড়াল করে নিলাম।
” প্লীজ গলা চেপে ধরবেন নাহ।কাল কোনোরকমে বেঁচে গেলেও আজ নাও বাঁচতে পারি আপনার ওই মোটা মোটা হাতে অনেক শক্তি ভালোই বুঝে গেছি।”শুকনো ঢোক গিলতে গিলতেই বলে উঠলাম।
শুভ্র আমার কথা শুনে আরো বেশি রেগে গেছে।দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে আবারো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।শুভ্র যেতেই মিহি আসলো ঘরে।ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাকতে।
ডাইনিং টেবিলের নিঃশব্দে যে যার মতো করে খাচ্ছে। মনেই হচ্ছে না এখানে এতোগুলা মানুষ উপস্থিত আছে।আমার তো মনে হচ্ছে আমি কোনো এক প্রানহীন রোবটের দেশে এসে পরছি।প্লেট চামচের টুংটাং শব্দ টুকু ছাড়া আর একটা টু শব্দও এখানে নেই।
“শুভ্র আজ বাসায় থাকবে।বাড়িতে অনেক মেহমান আসবে।”নীরবতা ভেঙ্গে শশুর মশাই বলে উঠলেন।
” আজ সময় হবে নাহ কাজ আছে।”কোনোরকম বনিতা না করে সোজাসাপ্টা জবাব দিলো শুভ্র।
“আমি যখন বলেছি আজ তুমি বাড়ি থাকবে মানে থাকবেই।আর তোমার কাজ মানে তো জানাই আছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া।আজ একদিনের জন্য আড্ডা বন্ধ রাখলে কিছুই হবে নাহ।তোমার শশুর বাড়ি থেকে লোকজন আসবে।মিথিলারাও আসবে।আমার কথার যেনো নড়চড় না হয় আজ কেউ বাড়ি থেকে বের হবে নাহ।” শশুর মশাই নিজের কথা শেষ করেই খবার টেবিল থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
বাবার কথা শুনে শুভ্রও চট করে খাবার টেবিল থেকে চলে গেলো।শুভ্রকে চলে যেতে দেখে শাশুড়ী মাকেও দেখলাম খাবার ছেড়ে উঠে গেলেন।কি আজব পরিবার!একজন আরেকজনের উপর রাগ করে রাগ দেখায় খাবারের উপর।তাতে আমার আমি কি আমি তো আরামছে পাউরুটিতে বাটার লাগিয়ে আমার মতোই খেয়ে চলেছি।আমার আবার ওতো খাবারের উপর রাগ আসে নাহ।যতোই রাগ দেখাই নাহ কেনো খিদে পেলে লুকিয়ে লুকিয়ে হলেও নিজের খিদে নিবারন করে নেই।ইহাই আমি যদি বলেন পেটুক তবে পেটুকই আরে ভাই অন্যের উপর রাগ দেখাতে গিয়ে তো আর নিজের পেটকে কষ্ট রাখতে পারি নাহ।
চলবে,,,,,