তোর রঙে হবো রঙিন পর্ব-০২ এবং বোনাস পর্ব

0
46

#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০২

নিশানের বিয়ে হয়ে গেছে এই খবরটা জানাজানি হতেই আলিশার বন্ধুমহলে কৌতূহলের সীমা রইলো না। চার বছর যে মেয়েটা নির্দ্বিধায় বলতো সে নিশান ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেনা সেই নিশানই কিনা হঠাৎ এমনভাবে অন্যকাউকে বিয়ে করে নিলো? সেদিন বন্ধুদের একটি ছোটো রিইউনিয়নে গেছিলো। সেখানে কতজনের কতো কথা, কতো প্রশ্ন! সবাই বলছে, শুধু আলিশা চুপ ছিলো। মেয়েটা এখন কথা কম বলে, হাসে আরও কম। যে মেয়েটা একসময় আসর মাতিয়ে রাখত সে হঠাৎ কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে, একটা অদ্ভুত স্থিরতা এসেছে ওর চোখে। হয়তো সেই স্থিরতা হার মানানোর। আলিশা নিজেও যে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ বিষয়ে ও কারও সঙ্গে আলাপ করেনি। না এমনকি ওর মা ও এখনও এ বিষয়ে জানেনা!এক সপ্তাহ পর…এক বিকেলে, আলিশার বাসায় লোক এলো। এনায়েত সাহেবের ছোট ছেলে জায়ানের সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে অথচ সে দেখতে আসেনি, এসেছে ওর বড় ভাই সায়ন, ওদের মা কাবেরী বেগম এবং সঙ্গে বাবার সেক্রেটারি হেলাল সাহেব। সায়ন কথা কম বলেন, তবে তীক্ষ্ণ চোখে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে! আলিশার বাবা বা ভাই জায়ান সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন করার আগেই সায়ন জানালো…

‘ আজ আমার ছোট ভাই আসতে পারেনি, ও একটু ব্যস্ত আছে আর কি!’

দু পরিবারের মধ্যে আলাপ শুরু হলো। সায়ন আলিশার বাবা ভাইয়ের সঙ্গে নিজেদের ব্যবসা ও পরিবার সম্পর্কিত আলোচনা করলেন। হেলাল সাহেবও কিছু মন্তব্য করলেন। অ্যাপায়ন ও কথাবার্তা চলতে থাকলো। আলাপের এক পর্যায়ে কাবেরী বেগম মৃদু হেসে আলিশাকে বললেন…

‘আমার ছেলেটা একটু অবাধ্য, ছোটো ছেলে তো। ছোটো থেকেই নিজের মত করে চলে এসেছে। তবে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সংসারও সামলাতে পারবে। জায়ান কিছুটা…আড়ষ্ট। সহজভাবে মিশতে পারে না, তবে খারাপ না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, আপনার মেয়ে সম্মানের সাথেই থাকবে আমাদের বাড়িতে।’

আলিশা জায়ানের সম্পর্কে বিশেষ কোনো প্রশ্ন করেনি, যে মানুষটাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তার সম্পর্কে অন্য কারো মুখ থেকে জেনে নয় বরং সঙ্গে থেকেই তাকে চিনতে চায়। দীর্ঘ আলাপচারিতা শেষে বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেলো। সেদিনই রাতে…জায়ান বারান্দায় বসে ছিলো। মুখে হালকা রাগ আর বিরক্তি, কারণ একটু আগেই সে জানতে পেরেছে তার বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে অথচ সে কিছুই জানেনা! একটু পরে কাবেরী বেগম এসে ছেলের পাশে বসে বললেন, মাকে দেখেও জায়ান নিরব! ছেলের কাঁধে হাত বুলিয়ে উনি বললেন…

‘ মেয়েটার নাম আলিশা। মাশাআল্লাহ, সুন্দরী। পড়াশুনা শেষ হয়েছে, কিছুদিন একটা কোম্পানিতে চাকরিও করেছে তবে এখন কিছু করছে না। সবদিক থেকে তোর সঙ্গে মেয়েটাকে দারুন মানাবে ‘

ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয় জায়ান…

‘ আমি কি বিয়ে করতে চেয়েছি?’

‘ তোর বাবা বলেছে। এবার যদি বিয়ে না করিস, তাহলে সম্পত্তি থেকে তোর নাম কেটে দেবে। কেনো বাবাকে রাগাচ্ছিস? বিয়ের বয়স তো হয়েছেই, করে নে বিয়েটা’

‘ তোমার স্বামীকে খুশি করার জন্যে আমাকে ওনার মর্জিমত চলতে বলছো? কিন্তু উনি নিজের ছেলের খুশির জন্যে কখনো কিছু করেছে? কোনোদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে আমি কি চাই বা আমার কি পছন্দ?’

কাবেরী বেগম কিছুক্ষণ নিরব রইলেন, তার স্বামী যে দুই ছেলেকে দুই চোখে দেখেন এ তো আর তার অজানা নয়!

‘ রাগ করিস না বাবা, দেখ তোর তো আমার ওপর ভরসা আছে তাইনা? আমার পছন্দ তো তোর পছন্দ হয়। দেখিস মেয়েটাকে তোরও পছন্দ হবে ‘

জায়ান এবার মুখ ঘুরিয়ে মায়ের তাকালো…

‘মেয়েটাকে আগে আমায় দেখানো হলো না কেনো? আমার জন্যে মেয়ে ঠিক করা হচ্ছে, অথচ আমাকেই কিছু জানানো হয়নি?’

‘কারণ, তুই গেলে ওখানেই না করে চলে আসতি আর বাসায় এলে অনেক ঝামেলা হতো। তোর বাবার এক পরিচিত ক্লায়েন্টের মেয়ে আলিশা। দেখ তোকে তোকে জোর করে কিছু করতে বলা হচ্ছে না। তোর বাবা শুধু চায় তুই এবার একটু স্থির হ!’

‘ আমি স্থিরই আছি মা! কিন্তু বিয়ে? আমি বিয়ে করবো না ‘

‘ তোর মায়ের ওপর একটু ভরসা রাখ, তুই মেয়েটার সঙ্গে আগে একবার দেখা কর। দেখবি ওর সঙ্গে কথা বললে তোরও ভালো লাগবে। এভাবে আর কতদিন ছন্নছাড়া হয়ে জীবন কাটাবি? জীবনে কেউ যখন আসবে তখন দেখবি জীবনটা কতো সুন্দর, কতো রঙিন’

কাবেরী বেগম ছেলেকে কিছুক্ষণ ঠান্ডামাথায় বোঝালেন, জীবনে একজন জীবনসঙ্গী কেনো প্রয়োজন সেটাও ব্যাখ্যা দিলেন। জায়ান সবটাই নিরবে শুনলো। বাবার অবাধ্য হলেও মায়ের অবাধ্য সে নয়, যদিও বিয়ে করার ইচ্ছে নেই ওর। কিন্তু মায়ের জোরাজুরিতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আলিশার সঙ্গে একবার দেখা করতে রাজি হলো!
_____________________________________

চোখবুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলো সায়ন, রোজ সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে এই বিকেলেই একটু স্বস্তি পায় সে। কিছু সময় পরেই ওর সেক্রেটারি মেঘনা এলো, হাতে থাকা ফাইলটা ডেস্কের ওপর রেখে আগে এক কাপ কফি বানিয়ে সায়নের সামনে দিলো। সায়ন কপাল টিপছে দেখে মেঘনা প্রশ্ন করলো…

‘ আপনার কি মাথা ব্যথা করছে? মাইগ্রেন প্রবলেম হলে ওষুধ দিচ্ছি ‘

‘ নো, আই অ্যাম ফাইন! ক্লায়েন্টদের স্যাম্পল পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে?’

‘ জ্বি, স্যার! মিটিংয়ের পরেই আমি সবাইকে মেইল করে দিয়েছিলাম’

‘ এ মাসের প্রফিট – লসের টোটাল হিসেবের কপিটা আনতে বলেছিলাম, এনেছেন?’

‘ আপনার সামনেই রাখা আছে ‘

সায়ন আগে কফিটা খেলো, এরপর ফাইলটা ঘাটতে ঘাটতে হুট করেই প্রশ্ন করলো…

‘ আজকে লাঞ্চের সময় আপনি কোথায় গেছিলেন?’

‘ নতুন একজন ইন্টার্ন এসেছে, তাকে নিয়েই বাইরে গেছিলাম, লাঞ্চে!’

সায়ন ফাইলে চোখ রেখেই মৃদু হাসলো…

‘ কদিন হলো ছেলেটা এসেছে এর মধ্যেই আপনাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে দেখছি, একসঙ্গে লাঞ্চও করতে যাচ্ছেন!’

‘ আসলে ও এখানে নতুন এসেছে, আশেপাশে কিছু চেনেনা তাই আমাকে বলেছিল। তাছাড়া কাজের ব্যাপারেও কিছু বিষয় জানতে চেয়েছিল’

‘ অফিসে আরো অনেকেই আছে, তাদের কারো কাছে হেল্প না চেয়ে আপনার কাছে কেনো চাইছে?’

মেঘনা মৃদু হেসে খানিকটা গর্ব করেই বললো…

‘ কারণ আমি আপনার সেক্রেটারি! অন্যদের থেকে আমার অভিজ্ঞতা বেশি, তাই!’

‘ আপনি আমার সেক্রেটারি, আপনি গুরুতর বিষয় হ্যান্ডেল করবেন। কোনো ইন্টার্নকে শেখানো আপনার দায়িত্ব নয়, তার জন্যে অফিসে আরো লোক আছে। ইন্টার্নকে বলবেন তাদের থেকে সাহায্য চাইতে। আপনি তাকে সাহায্য করতে গিয়ে আমার কাজে গাফিলতি করলে তো হবেনা, লাঞ্চ টাইমে বাইরে গিয়ে অনেকক্ষণ পরে এসেছেন। তখন আপনাকে আমার জরুরী প্রয়োজন হলে কি করতেন?’

মেঘনা চোখ নিচু করে নরম স্বরে বললো…

‘ সরি স্যার, এরপর থেকে আর এমন হবেনা ‘

‘ হুমম! কালকে কি আপনি ফ্রী আছেন?’

‘ কাল তো ছুটির দিন, কোনো কাজ আছে?’

‘ কাল বিকেলে একটু কাজ আছে ‘

‘ ঠিক আছে, কখন যেতে হবে আমাকে একটু টেক্সট করে দেবেন। আসলে ছুটির দিন তো, বাসায়ও টুকটাক কাজ থাকে’

অনেকসময় ছুটির দিনেও জরুরি কাজ থাকে, অনেক ক্লায়েন্ট ছুটির দিনে দেখা করতে চায় আর সেক্রেটারি হিসেবে সায়নের সঙ্গে মেঘনাকেও ছুটতে হয়। গত চার বছর ধরে সায়নের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করছে মেয়েটা, ওর আগে সায়নের যতো সেক্রেটারি ছিলো তাদের কেউই এক বা দেড় বছরের বেশি টিকতে পারেনি কারণ কেউই সায়নের কথামতো চলতে সক্ষম হতো না। মেঘনা কিভাবে যেনো এতো বছর টিকে গেলো! অন্যদের তুলনায় বেশি পরিশ্রম করতে হয় ওকে। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয় কিন্তু মোটা অঙ্কের স্যালারির জন্যে চাকরিটা ছাড়ার কথা ভুলেও মাথায় আনেনা মেঘনা। পরিশ্রম হোক, ভালো অর্থ তো আসছে!
______________________________________

বিকেলটা ছিল ভারি ধোঁয়াটে, আকাশে কালচে মেঘ ঘোরাফেরা করছিল সারাদিন ধরেই, যেন এক বিষণ্ণ প্রতীক্ষা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে সব কিছুকে। “কফি ইন দ্য রেইন” — শহরের ব্যস্ততার বাইরে এক কোণে সাজানো কাঠের ছাউনি দেওয়া ক্যাফে। নামটার মধ্যেই যেন একটা বৃষ্টি-কাব্য আছে। ঠিক এইখানেই বসে ছিল আলিশা, নীল মশারির মতো ঝুলে থাকা জানালার পাশে, কফির কাপে ঠোঁট ছুঁয়েও পান না করে ফিরে এসেছে বারবার। সে অপেক্ষা করছে। আসলে সে জানে না কিসের জন্য অপেক্ষা। জায়ান নামের সেই ছেলেটার জন্য, নাকি নিজের জীবনের অনিশ্চয়তা থেকে নিশ্চিত কিছু একটা পাওয়ার জন্য? চোখেমুখে অনিশ্চয়তার ছায়া। আনমনে বসে যখন আলিশা বৃষ্টির দেখছিলো ঠিক তখনই ক্যাফের দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল! বৃষ্টির গন্ধ ঢুকে পড়ল ভেতরে, আর তার সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল সেই কাঙ্খিত পুরুষটি! জায়ানের প্রবেশ যেন এক মুহূর্তে বদলে দিলো ক্যাফের আবহ। ভেজা চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে গালের নিচে, চোখদুটো কিছুটা লালচে — হয়তো ঠান্ডায়, নয়তো ঘুম না-হবার ক্লান্তিতে। গা জুড়ে কালো বাইকার জ্যাকেট, যা ভিজে গিয়ে শরীরের সঙ্গে মিশে আছে। গলায় হেলমেট ঝুলছে একটা হাতের সঙ্গে, অন্য হাতে ফোন। জায়ান চারপাশে চোখ বুলিয়ে এক লহমায় খুঁজে নিল তাকে। চোখাচোখি হলো দুজনের। এক মুহূর্ত, দুই জগত! আলিশা ও জায়ান উভয়েই একে ওপরের ছবি দেখেছে তাই চিনতে অসুবিধা হয়নি। ক্যাফের ওয়েটার একটা তোয়ালে এগিয়ে দেয় জায়ানকে, মুখটা একটু মুছে নিয়েই চেয়ারে বসে পড়লো সে। হেলমেটটা টেবিলের এক কোণে রেখে সে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় আলিশার দিকে। প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছে তারা, অথচ কথার চেয়ে নীরবতাই যেন বেশি বলছে আজ। আলিশা নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো…

‘ এই বৃষ্টিতেও আপনি বাইকে করে এসেছেন?’

জায়ান হালকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, যেন প্রশ্নটা একটু অবান্তর মনে হলো!

‘ কেনো? বৃষ্টিতে কি বাইকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে?’

‘ না মানে…আপনি তো পুরোটাই ভিজে গেছেন। ঠান্ডা লাগবে না?’

জায়ান চোখ নামিয়ে চা’র কাপটা হাতে তুলে বললো..

‘ আমার অভ্যাস আছে ‘

এরপর দুজনের মাঝেই আরেকদফা নিরবতা, জায়ানের কথা বাড়ানোর আগ্রহ নেই দেখে আলিশা নিজেই বললো…

‘আপনি চুপ করে আছেন যে? আপনার কি আমার সম্পর্কে কিছু জানার ইচ্ছা নেই?’

জায়ান তার দিকে তাকালো, কিন্তু তার চোখে ছিল না কোনো প্রশ্নের তাড়াহুড়ো…

‘ ইচ্ছা আছে, তবে আমি মনে করি প্রশ্ন করে মানুষকে চেনা যায়না। আমি শুধু তাদের আচরণ দেখে বুঝতে অভ্যস্ত। মানুষের মুখের কথা মিথ্যে হলেও আচরণ মিথ্যে হয় না’

আলিশা বিস্মিত হলো, কারণ নিশানের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার পর এই বিষয়টা ও নিজেও উপলব্ধি করেছে যে মুখের কথায় মানুষ চেনা যায়না!

‘ দারুন ভাবনা আপনার ‘

‘ তবে আমি মানুষটা দারুন নই! আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেই তুমি নিজেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে? আমি বছরে দুবার হলেও জে’লে গেছি, ক্লাসে লাস্ট হয়েছি সবসময়, বাবার চোখে একেবারে ‘উইনলেস কেস’— এসব নিশ্চয় আমার মা বা ভাই বলেনি?’

‘ তারা বলেনি কারণ আমি জানতে চাইনি, তবে আপনার মুখ থেকে তো জানলাম! এখনও আমার কোনো আপত্তি নেই ‘

‘ তোমার ব্যকগ্রাউন্ড তো বেশ ভালো, তাহলে এসব জানার পরও আমার মত একটা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি আছো?’

আলিশা তাকায় জায়ানের চোখে, ফেলে আসা সম্পর্কের কথাটা স্বাভাবিকভাবেই জায়ানকে বললো। সব শুনে জায়ান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো…

‘ ওহ! তারমানে তুমি তোমার প্রাক্তনকে ভুলতে চাইছো তাই বিয়ের জন্যে এত ডেসপারেট? আমাকে তুমি টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছো?’

‘ না জায়ান। আমি শুধু অতীত ভুলে নতুন একটা জীবন শুরু করতে চাইছি। কিছু তিক্ত অতীত তো সবার জীবনেই থাকে তাইনা? আমিও আমার অতীত নিয়ে এসেছি, আপনি আপনার অতীত নিয়ে আসুন। আমরা যদি একে অপরের অতীতের পাতাগুলোকে পুড়িয়ে ফেলে নতুন একটা খাতা খোলার চেষ্টা করি তাহলে হয়তো মন্দ হয় না। সেখানে শুধু আমাদের সুন্দর বর্তমান ও কাল্পনিক ভবিষ্যতের গল্প থাকবে!’

আলিশার বিয়ের জন্যে এই তাড়াহুড়োর কারণ জায়ানের আর বুঝতে বাকি নেই! আলিশার কথায় মোটেই মন গললো না ওর!

‘ প্রাক্তন প্রেমিককে এতো সহজে ভোলা সম্ভব না আলিশা, আপনি আমার মন ভোলানোর চেষ্টা করছেন নাকি নিজেকে বুঝ দিচ্ছেন?’

‘ আমি অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর আমি আমার প্রাক্তনকে জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছি। আপনি আমার জীবনে কারো প্রক্সি হিসেবে নয় আপনার মত করে আসবেন ‘

বিয়ের বিষয়টা বরাবরই জায়ানের কাছে বাড়তি ঝামেলা মনে হয়, নিজের মতো চলবে সেখানে আরেকজন এসে ওর জীবনে দখল নেওয়ার চেষ্টা করবে এটা মানতে নারাজ সে কিন্তু আলিশার সঙ্গে কথা বলার পর মেয়েটাকে ওর বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো। সে সত্যিই অতীত ভুলে নতুন সম্পর্ক মেনে নিতে পারে কিনা তা দেখতে আগ্রহী জায়ান…

‘ ঠিক আছে, সুযোগ তোমাকে দিচ্ছি। আমার একটা শর্ত আছে। বিয়ের পর তুমি আমাকে বদলানোর চেষ্টা করবে না। কারণ আমি বদলাতে চাইনা। তুমি তোমার মত থাকবে আমি আমার মত’

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]

#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#বোনাস_পর্ব

এক দীর্ঘ আলাপ শেষে আলিশা ও জায়ান উভয়েই ফেরার পথ ধরলো। আলিশা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে জায়ান যেমনি হোক ওকেই বিয়ে করবে, এদিকে জায়ান এক প্রকার ধরেই নিয়েছে যে আলিশা শুধু নিজের প্রাক্তনকে ভোলার জন্যে ওকে চাইছে। আসলে বিয়েটা কিছুই নয়, আলিশা শুধু নিজের মন ভোলাতে চাইছে। তবুও জায়ান আলিশাকে বিয়ে করার জন্য ইতিমধ্যেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। জীবনটা ভীষণ পানসেভাবে কাটছিল, সেখানে যদি একটু নতুনত্ব যোগ হয় মন্দ কি? জায়ানের সঙ্গে দেখা করার পর আলিশা ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলো। ওর মা বাবা আলাদা থাকলেও মেয়ের প্রয়োজনে উভয়েই মেয়েকে সঙ্গ দিতে প্রস্তুত! আলিশার মা পেশায় একজন নিউট্রিশনিস্ট! ছুটির দিনে ব্যতীত তাকে বাসায় পাওয়া মুশকিল! এক ছুটির দিন, জিনিয়া বেগম বাড়িতেই আছেন। মেয়ে আসবে আগেই বলেছিলো, তাই মেয়ের পছন্দের খাবারও রান্না করে রেখেছেন। ফ্রেশ হয়ে এসেই খেতে বসলো আলিশা, বহুদিন হলো মায়ের হাতের রান্না খাওয়া হয় না। ডাইনিং টেবিলের ওপর সাদা টেবিলক্লথে সাজানো প্রিয় ভুনা খিচুড়ি সঙ্গে মুরগির মাংস দেখেই আলিশার মুখে হাসি চলে এলো। জিনিয়া বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন…

‘তুই ঠিক আমার মতোই! ভুনা খিচুড়ির গন্ধেই মুখে হাসি চলে আসে ‘

আলিশা হাসলো, প্লেটে খাবার বেড়ে বসলো…

‘তুমি তো সব মনে রাখো, তাই না? আমি নিজেই অনেক কিছু ভুলে যাই এখন’

‘ সব ভুলে যা সমস্যা নেই, কিন্তু নিজেকে কখনো ভুলিস না ‘

আলিশা খেতে খেতে থেকে গেলো। ওর মা কোন উদ্দেশ্যে কথাটা বলেছে বুঝতে অসুবিধা হয়নি!

‘ ছেলেটার সঙ্গে তো আজ দেখা করার কথা ছিলো, দেখা করেছিস?’

‘ হুমম, ওর সঙ্গে দেখা করার আগে যে সিদ্ধান্ত ছিলো পরেও একই সিদ্ধান্তই আছে। আমি ওকেই বিয়ে করেছি’

‘তুই কি মেন্টাল প্রেসার থেকে বাঁচার জন্য বিয়ে করতে চাইছিস?’

‘ কেনো হঠাৎ করেই বিয়ের জন্যে ডেসপারেট হলাম জানিনা। এখন শুধু জানি, আমি আর পেছনে ফিরে যেতে চাই না। অতীতের দিকে তাকানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আপাতত মানসিক শান্তি চাই। জায়ানের মাঝে সেটা খুঁজে পাবো কিনা জানি না, তবে চেষ্টা করে দেখতে চাই ‘

এতো বছরের সম্পর্ক হুট করে শেষ হওয়ায় মেয়ে যে তার ভীষণ মানসিক চাপে ভুগছে তা জিনিয়া বেগম বেশ বুঝতে পারছেন। আলিশা প্লেটে আঙ্গুল নাড়তে লাগলো, চোখ ভিজে এলো মেয়েটার। জিনিয়া বেগম মেয়ের হাত ধরে বললেন…

‘ তোর যদি বিশ্বাস থাকে যে জায়ান তোকে সম্মান দেবে, তোকে ভালো রাখবে তাহলে তোর সিদ্ধান্তে আমি সম্মান করি কিন্তু যদি মনে হয় তুই শুধু কষ্ট লুকানোর জন্য এই বিয়েটা করছিস, তাহলে নিজেকে আবার হারিয়ে ফেলবি। তাই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভেবেচিন্তে নিবি। বিয়ের সম্পর্ক কিন্তু শুধু তোকে ঘিরে না বরং তোদের দুজনকে ঘিরে গড়ে উঠবে ‘

মায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে অনেকক্ষণ কথা বলার পর আলিশার মনটা হালকা হলো, ওদিকে…বিকেলে সায়নের সঙ্গে একটা ক্যাফেতে এসেছে মেঘনা, সায়ন কফি ও পেস্ট্রি অর্ডার করলো। মেঘনা ভেবেছিলো ক্লায়েন্ট হয়তো দেরি করে আসবে তাই সায়ন আগেই খাবার খাচ্ছে। ও আর প্রশ্ন করেনি, কিন্তু খাওয়া শেষে বিল মেটানোর পরেও কোনো ক্লায়েন্ট না দেখতে পেয়ে মেঘনা প্রশ্ন করলো…

‘ স্যার, আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফেললাম অথচ আমাদের ক্লায়েন্ট এখনও এলো না?’

‘ খাবার কেমন লাগলো?’

‘ হ্যাঁ, ভালোই লেগেছে কিন্তু ক্লায়েন্ট…’

‘ কোনো ক্লায়েন্ট আসার কথা ছিলো না!’

‘ মানে? তাহলে আমরা…’

‘ এই ক্যাফে সম্পর্কে কিছুদিন আগেই জেনেছি, ভালো রিভিউ পাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম আসা দরকার। একা একা আসতে ইচ্ছে করছিলো না তাই আপনাকে সঙ্গে আসতে বলেছি ‘

‘ আমরা এখানে কাজের প্রয়োজনে আসিনি?’

‘ কাজ ব্যতীত কি আপনার আমার সঙ্গে কোথাও যাওয়া মানা আছে?’

সায়নের কথা শুনে হতাশ হলো মেঘনা, কোথায় ভেবেছিলো সারা সপ্তাহের ধকল শেষে ছুটির দিনে সারাদিন পড়ে ঘুমাবে কিন্তু বসের জন্যে সেটাও হলো না। মনে মনে সায়নকে কয়েক দফা গা’লা’গা’লিও করে ফেলেছে মেঘনা। মেঘনার অসন্তুষ্ট মুখখানি দেখে সায়ন প্রশ্ন করলো…

‘ কি হলো? কাজের প্রয়োজন না জানলে আসতেন না মনে হচ্ছে?’

মেঘনা জোরপূর্বক হাসলো, বসকে তো আর অসম্মান করা যাবেনা!

‘ তেমন কিছুনা, আপনি আমাকে ইনভাইট করেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ স্যার ‘

খাওয়া শেষেই বাড়ি ফেরার জন্যে উসখুস করতে লাগলো মেঘনা…

‘ আর যদি কোনো প্রয়োজন না থাকে তবে আমি আজ আসি। কাজের কোনো দরকার হলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন ‘

মেইন রোডেই ওরা দাড়িয়ে ছিলো তাই আর দেরি না করে একটা ট্যাক্সি ধরেই উঠে গেলো মেঘনা, সায়নের অনেককিছু বলার ছিলো কিন্তু সুযোগ পেলো না। মেয়েটা চলে গেলো। মেঘনার যাওয়ার পর সায়নের মনে এক মুহূর্তের জন্য হুট করে প্রশ্ন জাগলো, মেয়েটা কি আনকমফোর্ট ফিল করছিলো?
_________________________________

সন্ধ্যায়…পুরনো এক কফিশপ—”রোডসাইড ব্রু”।
চেনা টেবিল, পাশের দেয়ালে হ্যান্ডপেইন্টেড মোটরবাইক, আর মাথার ওপর ঝুলে থাকা হ্যাঙিং লাইট। রোজকার মতো আজও জায়ান আর ওর বন্ধুরা বসে আড্ডা দিচ্ছে। রোহান, আদিত্য, ও তাফসির! সবার সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। আড্ডা জমে উঠেছে, এরই মাঝে জায়ান ঘোষণা করলো যে ও বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কথা শুনে উপস্থিত সকলে হেসে উঠলো, আদিত্য বেচারার তো কফি গলায় আটকেই গেছিলো। রোহান ওই বেচারার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো…

‘ওই শুনছিস তোরা? এই ছেলে না কি বিয়ে করতে চলেছে!’

তাফসির কফিতে চুমুক দিয়ে হাসতে হাসতে বললো…

‘এক মিনিট, কে বিয়ে করছে? আমাদের জায়ান?’

আদিত্য ভেঙিয়ে বললো…

‘নাহ, ওই জায়ান তো ছুটিতে গেছে রে ভাই। এটা ‘নতুন সংস্করণ’! বিবাহযোগ্য জায়ান ২.০!’

সকলে মিলে মজা করতে শুরু করলো, জায়ান ওদের থামিয়ে বললো…

‘ তামাশা থামা এখন। আমি সিরিয়াস ‘

রোহান অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে বলে উঠলো…

‘তুই? বিয়ে করবি? তোর তো একটা ক্যাকটাসও ম’রে যায় এক মাসেই, একটা মানুষ সামলাবি কিভাবে রে ভাই?’

‘ আমার মা সেদিন বলেছে সব সময় মানুষ এক রকম থাকে না। জীবন নাকি মাঝে মাঝে একটা থামার সিগন্যাল দেয়। আমারও মনে হয় থামার সিগনাল এসে গেছে’

তাফসির চোখ ছোট করে বললো…

‘না ভাই, আমাদের গায়ে তো এখনও সেই সিগন্যাল লাগেনি। বরং স্পিড ব্রেকারেও তুই গ্যাস দিয়ে উড়ে যাস। এখন হঠাৎ এমন কী হল?’

আদিত্য অন্যদের থামিয়ে কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলো…

‘ ছবিতে তো দেখেছিলাম আমরা। মেয়েটাকে অ্যাভারেজ লাগলো, তোর সামনে থেকে কেমন লাগলো দেখে?

জায়ান একটু চুপ রইলো, আলিশার সঙ্গে সাক্ষাতের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো…

‘ উহু! সে সুন্দরী ‘

‘ তারমানে সুন্দরী দেখেই?’

‘ তেমন কিছুনা!’

‘এই! তুই তো মেয়েদের বায়ো দেখে এড়িয়ে চলতি। ভার্সিটিতেও ছিলি “লো মেইনটেনেন্স ওনলি” টাইপের। এবার কি হলো?’

জায়ান এবার হেসে কফি কাপে চুমুক দিলো…

‘এই মেয়েটা লো না, বরং হাই রিস্ক জোন। তবুও মনে হয়, ঝুঁকিটা নেয়া উচিত ‘

সকলে বুঝলো জায়ান এবার সিরিয়াস! রোহান বললো…

‘ ভাই, আমরা মজা করছি ঠিক আছে, কিন্তু যেহেতু তুই সিরিয়াস একটাই কথা বলি। বিয়ে খেলনা না, প্রেমে না পড়ে বিয়ে করতে গেলে তোর মতো মানুষ দম বন্ধ হয়ে ম’রতে পারে। চিন্তা করে করিস যা করার ‘

জায়ান বন্ধুদের আলিশার প্রাক্তন প্রেমিক সম্পর্কিত বিষয়ে কিছু বললো না, তাহলে হয়তো বন্ধুরা ওকে বিয়েটা করতে না করবে। কিছু বিষয় গোপন থাকাই উত্তম! জায়ান নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো…

‘জানি। কিন্তু জীবন তো এতদিন ধরে আমার সঙ্গে মজা করেছে। এবার আমিও একটু সিরিয়াস খেলতে চাই, দেখি কি হয়!’

বন্ধু বিয়ে করবে, এ বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া মাত্রই আদিত্য ঘোষণা করলো…

‘ তাহলে বন্ধুগন, আমাদের প্রিয় বন্ধু যখন বিয়ে করতেই যাচ্ছে তাহলে আগে ব্যাচেলর পার্টি ঠিক করতে হবে। তারপর বিয়ে! আমাদের গ্রুপের প্রথম কেউ বিয়ে করছে। আমরা আছি, জায়ানের শেষ স্বাধীনতা আমরা ধুমধাম করে উদযাপন করবো ‘

সবাই হেসে ওঠে, জায়ানও হালকা হাসে। কিন্তু মনে কোথাও যেন একধরনের দ্বিধা কাজ করছে, আলিশার জীবনে আবার ও শুধুই তার প্রাক্তন প্রক্সি হয়ে রয়ে যাবে না তো?

চলবে…