দখিনা দুয়ারে প্রেমের ছোয়া পর্ব-১৭

0
2

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ১৭ (❌কপি করা নিষেধ❌)

মাঝখানে কেটে গিয়েছে আরো দুদিন। সকালের শীতল বাতাসে ঘুম ভাঙে নবনীর। মুগ্ধ পাশে শুয়ে তালমাতাল হয়ে ঘুমাচ্ছে। রাতে দেরী করে ফেরত আসার ফল এটা। ইদানিং বাহিরে কাজের চাপ বেশি। নবনী ওকে না ডেকে নিচে চলে যায়। মুগ্ধর মা আর শ্যামলী টুকিটাকি রান্নার কাজ করছে।

নবনী তাদের কাজের হেল্প করতে থাকে। আর ভাবে কাল এই প্রথম শরীফ নেশা ছাড়া বাসায় ফিরেছে। এই কয়টা দিনেই মানুষটাকে ভালো টাইট দিয়েছে নবনী। এসব ভাবতে ভাবতেই শাওনের মা সেখানে উপস্থিত হয়।

“উঠতে একটু দেরী হয়ে গেল। দেও তো। আমি করি।”

“সমস্যা নেই। আমরা করে নিয়েছি। প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে।”

নবনীর হঠাৎ খেয়াল হলো শরীফ এখনো খাওয়ার জন্য জালাতন করছে না কেন? তাই সে তার স্ত্রীকেই প্রশ্ন করল,

“চাচা কোথায়?”

“জমিতে কাজে গিয়েছে।”

সবাই বেশ অবাক হয়। শরীফের মতো অকর্মণ্য লোক গিয়েছে কাজে? ভাবা যায়। নবনী আবার প্রশ্ন করে,

“আজ হঠাৎ সূর্য কোন দিকে উঠল?”

“যাবে না তো করবে কি? বারবার তুমি বেকার, বৌয়ের বদলে খায়। যোগ্যতা নেই এসব বলে যে খোটা দিয়েছো! যতই যা হোক পুরুষ মানুষতো।”

“যাক ভালোই হলো। এই সুযোগে একটু ভালো হবে মানুষটা।”

সবাই হাতে হাতে কাজ করতে লাগল। এমন সময় রুম থেকে মুগ্ধ ডেকে বলে, নবনীর ফোন ভাজছে। নবনীও রুমে গিয়ে কল রিসিভ করে। মুগ্ধ ততক্ষণে নিচে নেমে পুকুরে গিয়েছে হাতমুখ ধুতে।

“হ্যালো। আসসালামুয়ালাইকুম। কে?”

“নবনী আমি। বিহান।”

নবনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

“কি বলবে বিহান ভাই?”

” এখন এই মূহুর্তেই উঠানের পাশে যে বাগানটা আছে সেখানে আসো।”

“সম্ভব না। নিচে সবাই আছে তো। কী ভাববে?”

“ভাবলে ভাবুক। তুমি আসো। নয়ত আমিই বাসার ভিতর এসে পড়ব।”

শেষে এক প্রকার বাধ্য হয়েই নবনী নিচে যায়। অতি সাবধানে যেন কেউ না দেখে পাশ কাটিয়ে উঠানে চলে যায়। এদিকে বিহান হাতে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। নবনী আসার সাথে সাথেই বিহান তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে বলল,

“মুগ্ধর বাবা কতজনকে ঠকিয়েছে। কি কি পাচারের ব্যাবসা করেছে সবকিছুর প্রমাণ তোমার কাছে দিয়ে গেলাম।”

নবনী স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। কি করবে সে? এইসব যে তার সংসার ভেঙে দিবে। বিহান নবনীকে বেখেয়ালি দেখে কিছুটা বুঝতে পারে।

“নবনী। নিজের জন্য না হক। বাচ্চা মেয়েগুলোর সাথে যে অমানুষের মতো কাজ করছে মানুষটা। এটার জন্য একটু প্রতিবাদ কর। এসব এখন রাখ তোর কাছে। আমি পরে খবর দিলে পুলিশের কাছে সব প্রমাণ দিতে হবে।”

“কিন্তু….”

“এখানে তবে, কিন্তু এসব আনলে চলবে না। এখন সব দায়িত্ব তোর উপরে।”

নবনী কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সবকিছু নিয়ে চুপচাপ রুমে চলে যায়। রুমের একপাশে টি টেবিলের নিচে সবকিছু রাখে। চুপচাপ খাটে বসে ভাবতে থাকে কী করবে? কীভাবে করবে? কোনোকিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। এমন সময় রুমে মুগ্ধ আসে।

“কি হলো?”

“হুমম।”

“কি ভাবছ?”

“হুমম।”

নবনী এতটাই ধ্যানে ছিল পাশে কে আছে কি বলছে কোনো খেয়ালই নেই। মুগ্ধ নবনীর কাধে হাত রাখল।

“ওহ আপনি।”

“এত গভীর কল্পনায় ডুব দিয়ে কী ভাবছিলে?”

“না কিছু না। আমি নিচে কাজে গেলাম।”

নবনী চলে যেতে নিতেই মুগ্ধ এত হাত ধরে একটা হেচকা টান দিয়ে ওকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। এতটা কাছে এসেও নবনীর কোনো ভাবান্তর নেই। মুগ্ধ নবনীর সামনের ছোট ছোট চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে। তখনই নবনী বলে উঠে,

“আমাকে নিচে যেতে হবে।”

আর এক মূহুর্ত না দাড়িয়ে সে চলে যায়।
মুগ্ধ নবনীর ব্যবহার দেখে বুঝল কিছুতো একটা হয়েছে। যেটা এই মেয়েটা লুকাচ্ছে। তবে কী সেটা?
…..

সারাদিন কাজ শেষে বিকালে নবনী রুমে এসেছে। এখনও কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি সে। তবে হঠাৎ সে অনেকটা ঘাবড়ে যায়। কেননা যেই ব্যাগটা সে টেবিলের নিচে রেখেছিল সেটা ওখানে নেই। কোথায় গেল ব্যাগটা?

পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুজেও কিচ্ছু পায়নি সে। আচমকা নিচ থেকে মুগ্ধর মায়ের চিৎকার শুনতে পেল সে। দৌড়ে নিচে যেতে দেখেই, মুগ্ধর মা ফ্লোরে বসে কান্না করছে। পাশে শাওন, তার মা, শরীফ সবাই চোখে মুখে প্রচণ্ড আশ্চর্যতা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। শাওন নবনীকে দেখেই বলে উঠল,

“ভাবী। মুগ্ধ ভাইকে পুলিশে ধরছে। সে এখন জেলে।”
……

মতিসুর মেম্বার বাইজি শালায় মেয়েদের দরদাম করছে। এসব তার কাছে নতুনের কিছু না। নানান জায়গা থেকে কখনো ছোট বাচ্চা চুরি করে, কখনো বা কাজের লোভ দেখিয়ে মেয়েদের এখানে আনা হয়। তারপর শুরু হয় ব্যবসা।

হাতে পায়ে ধরলেও আর কোনো মেয়েকে এখান থেকে যেতে দেয়া হয় না। এই নিয়ে কত মেয়ের জীবন সে নষ্ট করেছে হিসাব নেই। কখনো কখনো মেয়েরা এখান থেকে পালিয়েও চলে যায়।

তবে ঐ যে আমরা সভ্য সমাজ। এই সভ্য সমাজের পুরুষরা রাতের আড়ালে এখানে এসে নিজের তৃপ্তি মিটাতে রাজি আছে। তবে এসব মেয়েদের জীবনটাকে নতুন করে শুরু করতে দিতে রাজি না। এসব মেয়েরা ফিরে গেলেও, ছি ছি করে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়।

ফলসরূপ এই অন্ধকার জগতে একবার যার পায়ের পদধুলি পড়ে। সে আর কখনো বাহিরের দুনিয়ায় পা দিতে পারে না। এখানকার কিছু বাচ্চারাতো জানেই না, ধর্ম আর খোদা বলতে কিছু আছে। পড়াশোনা করে কিছু হওয়া যায়।

এদের জীবন শুরুই হয় পর পুরুষের ছোয়া দিয়ে। শেষও হয় কোনো এক হিংস্র মানুষরূপি জানোয়ারের ছোয়া দিয়ে। মাঝে মাঝে মতিসুর ভাবে। কারা বেশি ভয়ানক, বনের হিংস্র পশুরা, নাকি মানুষরূপি জানোয়াররা। তারপর হেসে ফেলে। তার এসবে কিছুই যায় আসে না। তার সব হিসাব টাকার সাথে।

মতিসুর গ্লাসে ম/দ ঢেলে চুমুক দিতে দিতে এক বাইজিকে ইশারা করে অন্য একজনকে ডেকে আনার। এখন একটু নাচগান না হলে হয় নাকি। তবে হঠাৎ ফোন ভেজে উঠলে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। বিরক্ত নিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই বলে উঠে,

“ওস্তাত। তাড়াতাড়ি আহেন। ঘটনা ঘইটা গেছে।”

“কি হইছে ওইটা ক।”

“মুগ্ধরে থানায় আটকাইয়া রাখছে। পুলিশে ধরছে।”

কান দিয়ে যেন ধোয়া উড়ে মতিসুরের। সে নিজে যতই খারাপ হোক। তার ছেলেদের সাথে যতই স্বার্থপরতা করুক। এই ছেলেগুলোই তার সব। সে একটা গালি দিয়ে বলে,

“ঐ দুই টাকার পুলিশ গুলিরে মাস শেষে কত কইরা ঘুষ দেই ভুইলা গেছে। আমার পোলারে ধরার সাহস পাইছে কই।”

“জানি না ওস্তাত। তাড়াতাড়ি আহেন।”

মতিসুর আর এক মূহুর্ত দাড়ালো না। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
…….

হাজতের মাঝে পা ভাজ করে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে মুগ্ধ। তার পুরো দুনিয়াটাকে জাহান্নাম মনে হচ্ছে। যেন বুকের উপর সে শক্ত একটা পাথর বেধে রেখেছে। নিজেকে শান্ত করে সে বলে উঠে,

“এত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে চলবে না মুগ্ধ। এক এক করে এখন তুই সব হাড়াবি। এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাস না। শক্ত হ।”

এমন সময় বাহির থেকে চেচামেচি শোনা গেল। বাসার সবাই হয়ত এসে পড়েছে।

#চলবে …..