দখিনা দুয়ারে প্রেমের ছোয়া পর্ব-০৬

0
2

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ৬ (❌কপি করা নিষেধ❌)

বিকালের দিক দিয়ে বাড়ির পরিবেশটা খুব শান্ত। শুধু কিছু পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। স্নিগ্ধ রুমে আছে নাকি তা শ্যামলীর অজানা। সে ভয়ে ভয়ে রুমে উকি দিয়ে দেখে কেউ নেই। যাক বাচা গেলো!

রুমে ঢুকে খাটে গিয়ে বসে শ্যামলী। পাশের ছোট্ট টি টেবিলটার উপর একটা ছবি রাখা স্নিগ্ধর। ছবিটা হাতে নিয়ে শ্যামলী একা একা বলতে থাকে,

“বিশ্বাস করুন, আমি ইচ্ছে করে খারাপ চেহারা নিয়ে জন্মাইনি। আমি যদি জানতাম খোদা আমাকে এই রঙে পাঠাবে, আমি আল্লাহর সামনে আকুতি মিনতি করে বলতাম আমাকে যেন মানুষ না বানায়। জানেন আপনার সামনে আমার নিজেকে কত তুচ্ছ আর অসহায় লাগে?

সমুদ্রের বিশাল জলস্রোতের মাঝে পানির একটা ফোটা যতটুকু তুচ্ছ ঠিক তেমন ছোট লাগে আমার। ঝড়ে ঘর ভেঙে যাওয়া পাখিটা যখন থাকার জন্য ছোট্ট একটা কুটিরের খোজ করে, ঠিক তার মতো আমি অসহায়। ছোট থেকে কম কথা শুনে বড় হইনি আমি। আত্মীয় সজন থেকে পাড়া প্রতিবেশী, কিংবা আপনার ছোট মা। কেউ কম কথা শুনায়নি আমায়।”

শ্যামলী ছবিটাকে রেখে আরো বলতে থাকে,

“ভেবেছিলাম নিজে রঙ হীন হয়েও আপনার জীবণটা রাঙিয়ে দিবো। কিন্তু দেখুন, কী কপাল আমার। আমার শ্যামল বর্ণ সবটা শেষ করে দিলো।”

আর কিছু বলেনা শ্যামলী। ইদানিং স্নিগ্ধর কথা ভাবলেই চোখে পানি এসে যায়। কোনোভাবে সামলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। স্নিগ্ধ অতি সাবধানে দরজার ওপর পাশে নিজেকে আড়াল করে রাখে। মেয়েটার মনে এত কিছু? সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,

“সব ঠিক করে দিবো আমি।”

মুগ্ধ একটা নীল রঙের শার্ট আর সাদা প্যান্ট পড়ে নেয়। শার্টের উপর সাদা ব্লেজার পড়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে, এমনি এমনিতো আর ভার্সিটির মেয়েরা তাকে বিরক্ত করে না। কারণতো আছে। হেসে পকেট থেকে সানগ্লাসটা বের করে চোখে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

তবে উঠান পার হয়ে পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে নিতেই কেউ একজন পিছন থেকে তার বুক জড়িয়ে ধরে। আর পিঠে মাথা এলিয়ে দিয়ে পরম যত্নে তার বুকে হাত বোলাতে থাকে। মুগ্ধর সবকিছু বুঝে উঠতে জাস্ট কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। সাথে সাথে বুক থেকে হাত সড়িয়ে এক ঝটকা দিয়ে মেয়েটাকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর হুংকার দিয়ে বলে উঠে,

“don’t cross your limit, মাহি। থাপ্পর মেরে তোর বেহায়াগিরি একদম ছুটিয়ে দিবো। এটা গ্রাম, তোর হোস্টেলের পার্সোনাল পার্ক না যে খোলামেলা ছেলেদের সাথে ডলাডলি করবি।”

মাহি ব্যথিত হরিণের ন্যায় তাকিয়ে বলে,

“এভাবে কেন বলছো মুগ্ধ। তোমাকে দেখে নিজেকে একদম আটকাতে পারিনি। আগের থেকেও বেশ সুন্দর হয়ে গিয়েছো।”

“জাস্ট সাট আপ। নয়ত তোর বাপকে ডেকে এখুনি সিনক্রিয়েট করব।”

মাহি কিছুটা ভয় পেয়ে দূরে সরে যায়। এই ছেলেটার রাগ সম্পর্কে তার জানা আছে। দেখা গেল রাগের বশে, পকেট থেকে নিজের লাইসেন্স করা পিস. তলটা বের করে কপালে ধরে বসবে। মাহি নিজেকে সামলে নেকা সুরে বলে,

“আই লাভ ইউ মুগ্ধ। শুধু তোমার জন্য গ্রামে আমি ছুটে আসি। নয়ত আমার মতো হট মেয়ের পিছে ঘুরার জন্য শহরে ছেলেদের অভাব নেই।”

মুগ্ধ মাহির পা থেকে মাথা অব্দি তাকায়। একটা টাইট টাউজার আর গায়ে শর্ট টপস দেয়া। মুগ্ধর নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে এসব দেখে। মাথা ঘুরিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে সে বলে উঠে,

“বাজারের মেয়েদের পিছে ছেলেরা এমনিতেও বেশি ঘুরে। দেখিস না? পচা খাবারে কত মাছি পড়ে।”

“মুগ্ধ!”

“এই তুই গলা উচিয়ে কার সাথে কথা বলছিস ভুলে যাস না। আল্লাহর দোহাই লাগে, তোর লজ্জাহীনতা শহরে গিয়ে প্রদর্শন করিস। তোর এসব পোশাকের জন্য গ্রামের লোকদের কাছে আমাদের ছোট হতে হয়। এখানকার মেয়েরা খুব সাদামাটা। শাড়িতে অভ্যস্ত।”

আর একটাও কথা বলেনা মুগ্ধ। আগে করে রেডি করে রাখা নিজের বাইকে উঠে স্টার্ট দিয়ে দেয়। মেজাজটা পুরো গরম হয়ে গিয়েছে। মাহির দিকে আর একবার তাকিয়ে বলে,

“লজ্জা আর ভার্জিনিটি মেয়েদের সম্পদ। স্বামীর আমানত। প্লিজ বিয়ের আগে পরপুরুষের কাছে তা বিলিয়ে দিস না। ভাই হিসেবে এইটুকুই বললাম। বাকিটা জাহান্নামে গিয়ে বুঝবি। ওখানে গিয়ে দেখবি তোর সব পছন্দের সেলিব্রেটি আর হট বয়গুলোও আছে।”

মাহি শুধু হা করে ওর চলে যাওয়া দেখে। আর কিসব জ্ঞান দিয়ে গেল ছেলেটা। মুগ্ধ যেতে যেতে ভাবে, শহরের সব মেয়েরাই কী এমন? এদের জন্যই সমাজের আজ এই অবস্থা।

হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজতে দেখা মেয়েটার কথা মনে পড়ে। মেয়েটাকে সে তখন যতই নির্লজ্জ বলুক, তার পোশাকে একটা শালীন ভাব ছিল। আর এমন সময় ভিজছিল যখন আশেপাশে তেমন কেউ নেই।

মুগ্ধকে দূর থেকে দেখেও কোনো ইনটারেস্ট দেখায়নি নেকামি করার। তার মানে সব মেয়েরা হয়ত এক না। সব ছেলেরা যেমন ধর্ষ.ক হয়না। তেমনি সব মেয়েরা চরিত্রহীনা হয় না। শুধু সঠিক মানুষকে খুজে বের করতে হয়।
……….

……….

নবনী শাড়ি পড়তে চায়নি একদমই। তবুও ছোট মামি জোর করে পড়িয়ে দিয়েছে। সাদা ব্লাউজের উপর একটা নীল শাড়ি। যেনো আকাশ আর সমুদ্রর মিশে যাওয়ার একটা অনুভূতি আসছে।

শাড়ি পড়ানো শেষ করে খোলা চুলগুলো একটু আচরিয়ে দেয় মামি। নবনীর মা এসে একবার দেখে যায়। মেয়েদের শাড়ি পড়লে বয়স যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

নবনীর মুখে অথচ কোন হাসি নেই। সেই নাফিজার কথাই সত্য হয়ে গেলো। তার নানা তাকে পাঠিয়েই ছাড়ল। একটু পর রেস্টুরেন্টে যাবে ঐ অচেনা ছেলের সাথে দেখা করতে। নানা সেখান অব্দি পৌছে দিয়ে চলে আসবে। যেহেতু ওদের বিয়ে, একটু একা কথা বলে নেয়ার দরকার আছে।

“দেখি দেখি, দাড়াতো। দেখি সব ঠিক আছে নাকি।”

নবনীর মামি দূরে গিয়ে দাড়িয়ে নবনীকে দেখতে থাকে। মুখে একদম হালকা পাউডার ছাড়া কিছুই দেয়া নেই। আর ঠোটে হালকা লিপস্টিক। নবনীর ঠোট এমনিতেও একটু অন্যরকম। উপরের ঠোটটা হার্ট সেইপ। চুলগুলো একদম খোলা। শাড়ির আচলটা এক পাশে ফালানো। নবনীর মামি হেসে বলে,

“ঐ ছেলেতো তোকে দেখেই প্রেমে পড়ে যাবেরে নবনী। দেখিস আবার, সাথে সাথে বিয়ে করে ফেলেনা যেনো।”

নবনী মুখে ভেঙচি কেটে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এখন তার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
……….

“কীরে ছেমরি কি করছ?”

আয়েস করে বসে বসে কফি খাচ্ছিল মাহি। আর ভাবছিল মুগ্ধকে কীভাবে সিডিউস করা যায়। এই ছেলের কী কোনো সমস্যা আছে নাকি? মাহি নিজে থেকে ধরা দিচ্ছে, আর এর কি হেডাম।

মাহি মনে মনে ভাবে, ওকে একবার পটিয়ে নিতে পারলেই কেল্লাফতে। এই বাড়ির অর্ধেক সম্পত্তি তার হয়ে যাবে। শাওনের কথা শুনে সব মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বিরক্তমাখা চেহারায় সে বলে উঠে,

“কী সমস্যা তোর?’

“আমার আবার কি সমস্যা? তুই একটু আগে মুগ্ধ ভাইয়ের সাথে যে ছেছড়ামি করছিলি ওইটাই দেখলাম।”

“বেশি কথা বললে হাতের কফিটা একদম গায়ে ঢেলে দিবো। আর তুই তো দুবছর যাবৎ স্কুলের মাস্টারের মেয়ের সাথে প্রেম করছ। আমি কিছু বলছি?”

শাওন মুখ ভেংচিয়ে বলে উঠে,

“হাউ য়ার প্রেম করি। দুইবছরে একখান চুম্মাও দিতে পারি নাই। আর মাইনষে ভাবে বাশঁ ঝাড় পরিষ্কার কইরা ধান চাষ কইরা লাইছি।”

মাহি ওর কথা শুনে হাসে। এমন মদন মদন কথা শুধু এই ছেলের কাছ থেকেই আশা করা যায়।
…..

গ্রামে সাধারণত তেমন ভালো রেস্টুরেন্ট দেখা যায় না। তবে এই রেস্টুরেন্টটা কিছুটা ভিন্ন। খুব সুন্দর করে দেয়ালে নানান আর্ট করা। প্রতিটা টেবিলে একটা করি ফুলদানি। কয়েক রকমের ফুল সেগুলোতে সাজানো। সাথে কিছুটা জোড়ে গান বাজছে। মুগ্ধ বসে বসে সেই ফুলগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া দিয়ে দেখছে। মেয়েটা লেইট কেন?

বিরক্তি ভাব কমাতে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে ডেকে বলে গান চেন্জ করতে। কিসব মরা মরা গান ছেড়ে দিয়েছে। তার কথা মতো গান পালটে দেয়া হয়। একটা শ্রেয়া গোশালের একটা হিন্দি গান ছাড়ে।

Maine tera naam, Dil rakh diya.
Maine tera naam, Dil rakh diya. Dhadkega tu mujhmein sada.
Maine tera naam. Dil rakh diya.

মুগ্ধ টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ফুলগুলোতে হাত ফুলাচ্ছে আর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। গানটাও বদলালো আর দরজা দিয়ে তাকালো। তবে হঠাৎ মুগ্ধর দৃষ্টি আটকে যায়। একজন যুবতী প্রবেশ করল। নীল শাড়ি পড়া খোলা চুলে মেয়েটাকে একদম হিমুর রূপার মতো লাগছে।

মুগ্ধ টেবিল থেকে মাথা উঠিয়ে এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হচ্ছিল মিউজিকের সাথে সেও একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে। সবকিছু যেন স্লো মোশনে চলছে। মেয়েটা ধীরে ধীরে তার টেবিলের কাছে হেটে আসছে। নবনী এসেই মুগ্ধকে প্রশ্ন করে,

“আপনি কি মিস্টার মুগ্ধ?”

মুগ্ধ যেন কথা বলতে ভুলে গেছে। এটা ওর দ্বিতীয় দেখা। প্রথম সেদিন বৃষ্টিতে দেখেছিল। হ্যা, এটাই সেই মেয়ে। মুগ্ধর মনে আছে। নবনী মুগ্ধকে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করতে যাবে, তখনই মুগ্ধ উত্তর দেয়,

“জ্বী। বসুন।”

নবনী বসে। মনে মনে কিছুটা অবাকও হয়। ও ভেবেছিল গ্রামের কোনো হাবাগোবা ছেলে হবে হয়ত। কিন্তু এতো খুব স্মার্ট আর শিক্ষিত মনে হচ্ছে। তবে বসতেই মুগ্ধ এমন কথা বলে নবনী অবাক হয় ও বেশ রেগেও যায়।

কিছুক্ষণ পর…. (ফাস্ট পার্টে ঘটনা দেয়া আছে।)

প্রায় অনেকক্ষণ বসে বসে নবনী সব ভাবছে। হঠাৎ খেয়াল হলো সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। এখন তার উঠতে হবে। মুগ্ধতো আগেই চলে গেলো।

নবনী উঠে সেখান থেকে বের হয়। বের হয়ে একটা অটো নিয়ে সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

#চলবে…..