দর্পণ পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
166

#দর্পণ
#নূপূর_ ইসলাম
#পর্ব- ২৬

আলি হোসেন মনে এক রাশ প্রশান্তি নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসলেন। আজকাল তার সব কিছুতেই ফুরফুরে লাগে, শান্তি অনুভব হয়। এই যে তাঁর পুরাতন বাড়ি এখন আর পুরাতন না, নিস্তেজও না । নতুন মানুষ, নতুন নতুন আনন্দ নিয়ে পুরোই শোরগোল। রোকসানার নিস্তেজ, ভাঙা শেষ হওয়া সংসারটা এখন সতেজ। হাসি, আনন্দে ভরপুর।

সে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নিলো। মনের এক রাশ তৃপ্তি নিয়ে চমুক দিলো। তাঁর পাশেই রুবিনা আর সাবিহা। তাদের কোলে আহান, আহাদ। এই দু- জনের সময়ই কাটে এদের নিয়ে । দীপা এখন পুরো দমে সংসারী। ডানে বামে তাকানোর সময় তাঁর নেই। ইউসুফ আগের মতোই! তবে দীপার শাসনে পড়ালেখায় একটু মনোযোগ এসেছে। শুধু বাদলায়নি মা! সে আছে আগের মতোই। সকাল হলেই এটা সেটা নিয়ে চেঁচামেচি। একে মারছেন তো আরেক জনের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন। তাঁর এসব কর্মকান্ড অবশ্য কেও কানেও নেয় না, দেখেও দেখে না। যার যা করার করছেই।

সে হাসলো! হেসে দরজার দিকে তাকালো! উসমান আসছে! সবই ঠিক আছে তবে এই ছেলেকে নিয়ে সে একটু টেনশনে আছেন। উমরের তো একটা দিক হলো। তবে এ বিয়ে সাদির নামও নিচ্ছে না।
মা, রুবিনা পেছনে পড়ে আছে। তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা এই ছেলের মেজাজ! দিনকে দিন তুঙ্গেই উঠছে। যখন গরম হয় ডানে বামে কাওকেই দেখে না। তবুও ভালো উমরকে খুব মানে তা না হলে খবর ছিলো।

এইতো কিছুদিন আগে এক জমি নিয়ে ঝামেলা হলো। জমির ঝামেলায় টামেলায় উসমান কখনও যায় না। সে আর উমরই দেখে। এবার ঝামেলা হলো আমাদের থানারই তরুণ এক নেতার সাথে। এদের বয়স অল্প। মাথা থাকে গরম। অল্পতেই লাফালাফি করে। উমরকে জানের হুমকি দিলো।

উমর বরাবরি ঠান্ডা। ঠান্ডা মাথায় কিভাবে কাজ করতে হয় সে জানে। কিন্তু সমস্যা হলো উসমানকে নিয়ে। তার কানে যখন এই কথা গেলো। সে কি আর কাওকে দেখে। তার প্রাণ প্রিয় বড় ভাইকে হুমকি। সে সোজা গেলো সেই নেতার অফিসে। অফিসের ভিতরেই ইচ্ছেমতো মাইর।

সেই নেতা থানা, পুলিশ করলো। করে অবশ্য লাভ হয়নি! আলি হোসেন এখনও জীবিত। চুপ থাকে বলে যে ক্ষমতা নেই তা তো না।

তবুও, এই ছেলেকে নিয়ে সে টেনশনেই আছে। আর এজন্যই উসমানকে এসব থেকে দূরে রেখেছে। তাদের আরো অন্যান্য ব্যবসা আছে উসমান সেগুলোই দেখে।

তাঁর এই গরম ছেলের মাথা ঠান্ডা করতে পারবে এমন একটা মেয়ে দরকার। সাথে সাথেই সে মনে মনে আফসোস করলো! দীপার বোনটা তাঁর সত্যিই মনে ধরেছিলো। কি হাসি খুশি একটা মেয়ে। যেখানে তাঁর ভয়ে বা সংকোচে সবাই দূরে দূরে থাকে। সেখানে এই মেয়ে অনায়াসেই সহজ ভাবে কথা বলে। প্রায়ই ফোন দিবে, দিয়েই দুষ্টমি মাখা কন্ঠে বলবে , – ” কি খবর আঙ্কেল? আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু এখন দু- জন। আন্টিকে সামলে রাখবেন।

আলি হোসেন শুনে হাসেন! প্রাণ খোলা হাসি।
তারপরেই কি হলো না হলো, কি করছে না করছে সব কি সুন্দর ভাবে গুটুরগুটুর করে বলবে । তার শুনতে এতো ভালো লাগে।

তার খুব ইচ্ছে করে এই মেয়েটাকে একেবারে নিজেদের কাছে আনার। তাঁর মনও বলে উসমানের জন্য এই মেয়েটাই ঠিক, একেবারে ঠিক। তবে দীপার কথা ভেবে বলার আর সাহস পায় না। আর যাই হোক! সে উমরের জীবনে আর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চায় না।

উসমান আলি হোসেনের পাশের সোফায় হাত ছড়িয়ে বসলো। বসে শার্টের কলার পেছনে ঠেলে দিলো। বাইরে গরম! সে নেয়েঘেমে একাকার।
তাকে দেখেই আহান, আহাদ হাত পা ছোটাছুটি শুরু করলো। উদ্দেশ্য কোলো নাও।

উসমান হাসলো! আহান আর আহাদ এবার ছয় মাসে পড়লো। বসতে শিখেছে তবে এখনও পুরোপুরি হামাগুড়ি দিতে পারেনা।

উসমান হাত বাড়িয়ে দিলো। দিতেই দু- জনে দু- হাত ঝাপটে ধরলো। উসমান তাদের আঁকড়ে ধরতেই। রুবিনা বললো,—- ভাইয়ের ছেলেদের নিয়ে আর কতো খেলবি? বয়স তো কম হলো না। বিয়ে করবি কবে?

— এতো বিয়ে বিয়ে করো না তো ফুপু।

— তো কি করবো?

— আল্লাহ, আল্লাহ করো! বয়সও তো কম হলো না।

— তুই আমার বয়স দেখাচ্ছিস?

— না! কখনও না। আমার কি আর সেই ক্ষমতা আছে?

রুবিনা মুখ বাঁকালেন! এই হতোচ্ছাড়া বিয়ে করে চায় না কেন কে জানে। তবুও ভালো! ঐ কালনাগিনী পিছু ছেড়েছে। পেটের বাচ্চা কি করেছে কে জানে। আর তো কিছু শুনলোও না।

তখনি দীপা আসলো! তাঁর হাতে শরবতের গ্লাস। উসমানের সামনে রাখতে রাখতে বললো, —- এবার কিন্তু তোমার সত্যিই সিরিয়াস হওয়া উচিত। নিজের কথা না ভাবো, ভাবির কথাতো চিন্তা করতেই পারো। আর কতো একা একা খাঁটবো। আমারো তো একটা এসিস্ট্যান্ট দরকার তাইনা।

উসমান হাসলো! মনে মনে বললো, —- গিট্টু তো তোমরা বোনই পাঁকিয়ে রেখেছে। এর চেয়ে ভালো এসিস্ট্যান্ট তোমার জন্য আর কে হবে? আমার আর কি ! শান্তিতে ঘুমোতেও পারি না। যে মেয়েরে বাবা, ভার্সিটিতে যেয়ে কি কি করছে কে জানে। বদমাইশ মেয়ে! সারা দুনিয়ার সাথে ফোনে পটর পটর। শুধু সে ফোন দিলে ধরবে তো ভালো কথা তাকিয়েও দেখে না। গেলেও পালিয়ে বেড়ায়।

মুখে বললো,—- আমার কথা ভুলে যাও! বেশি এসিস্ট্যান্ট প্রয়োজন হলে ভাইকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দাও।

দীপা ঠোঁট টিপে উসমানের বাহুতে হালকা থাপ্পড় দিলো। দিয়ে চলে গেলো। চুলায় তাঁর রান্না। উমরেরও আসার সময় হয়ে গেছে।

দীপা যেতেই আলি হোসেন বললেন, —- ভুলে যাবো কেন? তুই বিয়ে করতে চাস না?

— চাইবো না কেন?

— তাহলে?

উসমান আবারো হাসলো! হেসে দু- টোকে দু- হাতে চেপে ধরে উঠে দাড়ালো! রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
— সময় হোক! হলে নিজেই বলবো।

উমর বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। হঠাৎ করে তাঁর মাথা ধরেছে। ধরবেই না কেন? কাজের খুব চাপ যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই কপালে নরম দু-টো হাতের স্পর্শ পেলো। তাঁর ঠোঁটে কোণে হাসি ফুটলো। সে কাত হয়ে দীপার কোলো মাথা রাখলো।

— কখন এসেছো?

— এইতো এখনি?

— ডাকলে না কেন?

— দেখলাম তুমি কিচেনে।

— তো?

উমর হাসলো! হেসে আরেকটু এগিয়ে পেটে মুখ গুজে কোমর দু-হাতে আঁকড়ে ধরে বললো ,—- কতোদিকে দৌড়াবে? সংসার, বাচ্চা, দিনতো ভালোই রাতেও তো ঠিকমতো ঘুমাতে পারো না।

দীপাো হাসলো! হেসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, —- কোথায় পারিনা! রাতে সবতো তুমিই করো। আমিই বরং পরে পরে ঘুমাই।

— সব তো করি! পেটতো ভরাতে পারি না। তখন তো তোমাকেই ডাকতে হয়।

— এটুকুই যদি না করি তবে কিসের মা হলাম।

— হুম! তাও ঠিক! তা আমার রাজপুএদের রাজমাতা। আমার রাজপুএরা কোথায়?

— তাদের মেজো বাবার রুমে।

— উসমান এসেছে?

— হুম!

— ইউসুফ?

— না! তাঁর খবর নেই।

— এইটা আর মানুষ হবে না।

— ইশ! তোমরা অনেক হয়েছো!

উমর হাসলো! তবে কিছু বললো না। বললো আবার দীপাই, — একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

উমর মাথা তুললো! তুলে দীপার দিকে তাকালো! গোলগাল মুখে এলোমেলো ভাবে উঁচু করে মাথায় খোঁপা করা।সাইড দিয়ে চুল বেড়িয়ে আছে। এতো ব্যস্তার মাঝেও গুছিয়ে কাপড় পরা। সে এক পলকে তাঁকিয়ে রইলো! এই মুখটা দেখে কখনও তাঁর মন ভরে না। যতো দেখে ততোই দেখতে ইচ্ছে করে। সে তাকিয়ে থেকেই বললো,—- আমার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য তোমার অনুমতিও লাগে?

দীপা হাসলো! হেসে উমরের চোখের উপড়ে হাত রাখলো! বাজে একটা অভ্যাস! এক পলকে তাকিয়ে থাকে। কি দেখে এতো কে জানে।

উমনের ঠোঁটে হাসি! ঠোঁটে হাসি নিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো,— বললে না কি জানতে চাও?

— উসমান ভাই কি কাওকে পছন্দ করে?

উমর কিছু বললো না। চোখ থেকে হাত সরালো! সরিয়ে আবার পেটে মুখ গুজলো।

দীপা বিরক্তির বড় একটা শ্বাস ফেললো! উমর তাঁর কাছে কখনও মিথ্যা বলবে না । তবে কিছু বলতে না চাইলে, বলবেও না, চুপ করে থাকবে। এই চুপ আর দুনিয়া উলটে গেলেও ভাঙবে না।

— এটার মানে আমি কি ধরবো?

— কোন মানে ধরার দরকার নেই! আমার অনেক কিছু আছে পারলে সেগুলো ধরো।

দীপা উমরের পিঠে কিল বসালো! বসিয়ে বললো,—- কে সে? আমি কি চিনি?

উমর এবারো কিছু বললো না।

দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে বললো, — ঠিক আছে। না বললে নেই। এবার ওঠো! ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে ঔষুধ খাও। খেয়ে ঘুম দিলেই মাথা ব্যথা ঠিক হয়ে যাবে।

— উঁহু!

— কিসের উঁহু! ওঠো…

— না! উঠতে হবে না। আমার ঔষুধ আমার কাছেই আছে। বলেই দীপা হাত মাথায় তুলে দিলো।

দীপা হাসলো! হেসে চুল মুঠো করে জোরে টান দিলো।
উমরের কোন হেলদোল হলে না। শুধু ঠোঁট দুটো আরো বিস্তৃত হলো।
_____

দিলশাদ ভিড় ঠেলে গলিয়ে গালিয়ে সামনে আসলো। এসে পেছনে তাকালো! তাদের বন্ধুদের একটাকেও চোখে পড়লো না। কোথায় আটকে মরে আছে কে জানে? সে আরেকটু সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলো। আজ তাদের এলাকায় কনসার্ট। সেখানে বিভিন্ন শিল্পীরা আসবে। তাঁর মধ্যে তাহসান ও। তাহসান আসবে আর সে আসবে না তা কি করে হয়। অবশ্য খুব কষ্ট হয়েছে। বাবা কিছু না বললেও মা রাজি হচ্ছিলো না। তবে রায়হান আছে কি জন্য? সেই সব রাস্তা ক্লিয়ার করেছে। অবশ্য কিছুক্ষণের জন্যই। আজ মা বাবাকে নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যাবে। বলেছে ফিরে এসে যেনো বাসাতেই পাই।
সে এক পায়েই রাজি হয়েছে। তাদের আসতে আসতে একটু দেরিতো হবেই। তাই নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। সে আরো এগুতে চাইলো! কাছে গেলো একটু ভালোভাবে দেখা যাবে। কিন্তু এতো ভিড়।

সে এগুতে গিয়ে ধাক্কা খেলো! শুধু খেলো না। উলটে পড়ে যেতেও নিলো। একটা হাত তাঁর হাত ধরে ফেললো! সে হাঁফ ছাড়লো! যাক বেঁচেছে! এতো ভিড়ের মধ্যে পড়লে সে চিরে চ্যাপ্টা হয়ে যেতো।
সে এক গাল হেসে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে। তাঁর আগেই মুখ চুপসে গেলো। ধুর!

চলবে……

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৭

দিলশাদ চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এখন ইউসুফ নেই। এই পাহাড়- পর্বতের তো কিছু জানার কথা না। সে একটু ভাবলো! তারপর হেসে ফেললো! হেসে ঢং করে বললো,— আরে উসমান ভাই..য়া! কি খবর? অনেক দিন পরে দেখা । আমাদের তো একদম ভুলেই গেছেন।

উসমান মৃদু হাসলো! শুরু হয়ে গেছে নাটকির নটাংকি। কি করবে সে এই মেয়ের। শক্তি দিয়ে কাবু করা যায়। কিন্তু শক্তি দিয়ে কি আর ভালোবাসা পাওয়া যায়। সে তো এই হ্নদয়হীনাকে হ্নদয় দিয়ে কাবু করতে চায়। এই মেয়ে বুঝেও যেন বুঝে না।

সে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! এই মেয়ে যে তাকে দেবদাস ঠিক বানাবে সে বুঝলো। অবশ্য বুঝেই বা লাভ কি? কোন গতি নেই। সে আটকে গেছে, সারা জীবনের জন্যই আটকে গেছে। এই মেয়ে জানে, বুঝে তবুও তাকে ইচ্ছে মতো নাচাচ্ছে। আর সে জেনে বুঝে নিজ ইচ্ছায় নাচচ্ছে।

ইউসুফ এখানে না থাকলেও খাদিজা আন্টির সাথে ইউসুফের ঠিকই যোগাযোগ আছে। এই মেয়ে কি করছে, না করছে কিছুটা হলেও খবর পাওয়া যায়। তবে এই কয় মাস সে তেমন কিছু করেনি। ইচ্ছে করেই করেনি। তাই দিলশাদ ধরতে পারেনি। তবে এখন ঠিকিই ধরে ফেলবে। হয়তো ফেলেছেও, এই মেয়ের মাথায় দুনিয়ায় বুদ্ধি।

তাই সে মুখে আর কিছু বললো না। যা বলবে ঢংয়ের উত্তরই পাবে। সে দিলশাদকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে দিলো! পেছন থেকে দু- হাত দিয়ে আড়াল করে বললো,— আস্তে আস্তে আগাও! কারো সাথে যেন টাচ না লাগে।

— লাগলে কি হবে?

— আগুন লাগবে।

— কোথায়?

— তোমার পাহাড় – পর্বতের বুকে।

— আমার কোন পাহাড়- পর্বত নেই।

— সেটা সময় হলেই দেখা যাবে।

দিলশাদ মুচকি হাসলো! হেসে আস্তে আস্তে এগুতে এগুতে বললো, — যাক এই পাহাড়- পর্বত আমার না হলেও, অন্তত কোন কাজে তো আসছে।

— সুযোগ দিয়ে দেখো, আরো অনেক কাজেই আসবে।

— সব সুযোগ অন্য কারো জন্য তুলে রাখুন। দিলশাদের প্রয়োজন নেই।

— কেন! নিতে ভয় পাচ্ছো?

— ভয় আর দিলশাদ! এই দুটো শব্দ পাশাপাশি কখনও হবে না।

— তা তো সেইদিন দেখলামই! গাড়ি সহ কাঁপছিলে! আমিতো ভয়ই পাচ্ছিলাম। রাস্তার আশে পাশের মানুষ না জানি কি ভাবে।

দিলশাদ ঠোঁট চেপে ঘুরে দাঁড়ালো!

উসমান হাসলো! হেসে বললো, — আরো যাবে
সামনে?

দিলশাদ সে কথার উত্তর দিলোনা! সে বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললো,—- আমার বন্ধুরা কই?

— সেটা আমি কিভাবে জানবো?

— অবশ্যই জানেন! তা না হলে এতোক্ষণে ওরা চলে আসতো।

উসমান উত্তর দিলো না। দু- হাত পকেটে পুরে বুক ফুলিয়ে সোজা দাঁড়ালো। তাঁর দৃষ্টি স্টেজের দিকে। কোন শিল্পী এখন গান গাইবে তাঁর এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে। চারিদিকের শব্দে তাঁর মাথা ধরে যাচ্ছে । অবশ্য তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই।

দিলশাদ এখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েই আছে! এই তালগাছের ভাব দেখে তাঁর শরীর জ্বলছে। সে আঙ্গুল নাড়িয়ে বললো,—- যদি আমি শুনি! আমার বন্ধুদের সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করেছেন। এবার আর আপনাকে আমি ছাড়বো না। অনেক হয়েছে এসব ফাজলামি।

উসমান কিছু বললো না। দিলশাদের মাথা ধরে সাউডে ঘুরালো! ঘুরিয়ে বললো,—- এখনও তো ধরতেই পারলে না, আবার ছাড়ার হুমকি দিচ্ছো।

দিলশাদ সে কথার উত্তর দিলো না। সাইডে মাথা ঘুরাতেই তাঁর নজর পড়লো তাঁর বন্ধুদের উপর। তাদের বরাবরই অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি সবার মুখ হাসি হাসি থাকলেও , রায়হানের মুখ ভার। সে একমনে সামনের দিকে তাঁকিয়ে আছে।

দিলশাদ হাসলো! কোন দুঃখে যে মানুষ নিজের মন অন্যকে দিতে যায় কে জানে? অন্যের কাছে কিছু যাওয়া মানেই তো অনশ্চিয়তা। সেটা সুখ হয়েও ফিরতে পারে, আবার কষ্ট। তাই কি দরকার দেওয়ার। নিজের কাছে রেখে নিজেই ভালো থাকো।

সে সাথে সাথে হাত দিয়ে ইশারা করলো। সবাইকে এদিকে আসার জন্য।

উসমান ঘড়ির দিকে তাকালো! প্রায় এগারোটা বাজে। এতো রাতে আর বাসায় ফেরা যাবে না। সে দিলশাদের দিকে তাকালো। এই মেয়ের দিন দুনিয়ার কোন হুশ নেই। বন্ধুদের নিয়ে প্রায় লাফাচ্ছে।

তাঁর হাসি পেলো। এই আধা পাগল মেয়েটার প্রেমে সে কিভাবে পড়লো? পড়লো তো পড়লো! দিন দুনিয়া ভেঙে পড়লো। এই যে এতো দূর থেকে এসে, এতো শব্দের মাঝেও দাঁড়িয়ে আছে। তবুও কোন ক্লান্তি নেই, নেই কোন বিরক্তি। শুধু একটু চোখের দেখা আর পাশে থাকার মাঝেও যে কতো শান্তি, কতো সুখ। এই আধা পাগল মেয়েকে ভালো না বসলে হয়তো জানাও হতো না।

সে মনে মনে হাসলো! হেসে রায়হানের দিকে তাকালো। তাঁর মতো সেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর আসায় সে সম্ভবতো খুশি হয়নি। অবশ্য হওয়ার কথাও না। ছোট বেলা থেকে তারা একসাথে। সেই এক সাথের মাঝে হঠাৎ করে সে ঢুকে গেছে।

উসমান রায়হানের কষ্ট বুঝে! রায়হান যে দিলশাদকে পছন্দ করে তাও জানে। তবে কি করবে? ঐ যে বলেনা এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার লাভ এন্ড ওয়ার। ব্যস তার ক্ষেএেও এটাই প্রযোজ্য।

সে আরেকটু এগুলো! স্পিকারের জন্য কথা বুঝা যাওয়ার কথা না। সে এগিয়ে প্রায় চেঁচিয়েই ডাকলো,— দিলশাদ!

দিলশাদ সাথে সাথেই পেছনে ফিরলো! ফিরে চোখ দিয়ে জানতে চাইলো, — কি হয়েছে?

উসমান হাত উঁচু করে ঘড়ি দেখালো।

সাথে সাথে দিলশাদের চোখ বড় হয়ে গেলো! আল্লাহ! কয়টা বাজে? সে তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করলো। আব্বুর নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসডকল উঠে আছে।

শেষ! সে আজকে শেষ। আব্বু আম্মু নিশ্চয়ই অনেক টেনশন করছে। ধুর! এখানেতো কথা বলাও যাবে না। সে তাড়াতাড়ি বেরুতে চাইলো। এতো ভিড়ে কি সম্ভব? উসমান এগিয়ে গেলো, হাত ধরে আস্তে আস্তে দিলশাদ কে নিয়ে বেরিয়ে এলো।

তারা অনেক কষ্টে একটু সাইডে আসলো! এখানেও শব্দ তবে ফোনে কথা বলা যাবে। সে তাড়াতাড়ি ফোন দিলো। রিং হলো তবে কেও ধরলো না ।

দিলশাদের ভ্রু কুঁচকে গেলো। ব্যাপার কি? সে ফোন করছে আর বাবা ধরবে না। এও সম্ভব!

সে আবার ফোন দিলো। এবার রিসিভ হলো! তবে তাঁর আব্বুর জায়গায় অন্য কেও রিসিভ করলো। খসখসে কন্ঠে বললো,— হ্যালো কে?

দিলশাদ অবাক হলো! অবাক হয়ে বললো, —- আপনি কে? আব্বু কোথায়?

দিলশাদ থমকে গেলো! নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেলো। সে নিষ্পলোক দৃষ্টিতে উসমানের দিকে তাকালো। অস্ফুটভাবে কিছু বললো।

উসমান তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তবে সে কিছু বুঝতে পারলো না। বুঝার জন্য একটু এগিয়ে যাওয়ার আগেই, দিলশাদের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেলো। হাত, পা অসাড় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

______

দীপা বাবুদের বিছানা গোছালো! উমর আহান, আহাদকে নিয়ে ড্রইং রুমে। তাঁরা রাতে সহজে ঘুমায় না। তাদের সাথে সাথে বাকি সবারও ঘুমোতে দেরি হয়।
তাইতো এখনো সবাই ড্রইং রুমে, তাদের সাথেই বসে বসে হইচই করছে। দীপা বিছানা গুছিয়ে দাঁড়াতেই উমর হন্তদন্ত হয়ে রুমে আসলো।

দীপা অবাক হয়ে তাকালো! তাকিয়ে বললো, — কি হয়েছে?

উমর কথা বলতে পারলো না! তাঁর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো।

দীপার ভিতর কেঁপে উঠলো! কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার তার সাহস হলো না । সে বুঝতে পারছে অনেক বড় কিছু হয়েছে। অনেক! সে দরজার দিকে তাকালো। বাড়ির সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই স্তব্ধ, করুণমুখে তাকিয়ে আছে। তাদের মধ্যে শুধু ইউসুফ হাউমাউ করে কাঁদছে। দীপা পড়ে যেতে নিলো।

উমর এসে আগলে ধরলো। ধরে বললো,— শক্ত হও দীপা। শক্ত হও! তুমি ভেঙে পড়লে দিলশাদকে সামলাবে কে?

দীপা শুষ্ক চোখে উমরের দিকে তাকালো! কি বলছে উমর? সে বুঝতে পারলো না।

উমরের বুক ছিঁড়ে যেতে চাইলো। সে কোন রকম ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, — আমাদের তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে দীপা। দিলশাদ ওখানে একা ।

দীপা কিছু বললো না! কাঁদলোও না। তাঁর মাথায় একটা কথাই ঘুরতে লাগলো। দিলশাদ সেখানে একা।

সে রবোটের মতো উঠে দাঁড়ালো। উদ্ভ্রান্তের মতো এগুতে লাগলো। তাঁর আশে পাশের কোন জ্ঞান নেই। তার পা খালি, যে এতো ব্যস্ততার মাঝেও শাড়ির আঁচল গুছিয়ে রাখে, সেই আঁচল আজ গাড়াগড়ি খাচ্ছে। সে বেরুতো যাবে উমর টেনে ধরলো, চোখে পানি নিয়েই বললো,– ” দু- মিনিট দাঁড়াও বাবা গাড়ি বের করছে।”

দীপা শূণ্য দৃষ্টিতে উমরের মুখের দিকে তাঁকিয়ে রইলো! উমরের মুখ নড়ছে কিন্তু কোন কথা তার কানে আসছে না কেন? সে পাগলের মতো আশে পাশে তাকালো! সব শূণ্য! কেও নেই, কোথাও নেই।

উমরা যখন হসপিটালে পৌঁছালো। তখন রাত আড়াইটা। দীপা গাড়ি থেকে নামলো! তবে এগুতে পারলো না। তাঁর শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। সে হসপিটালের সিঁড়িতেই বসে পড়লো।

উমর তাঁকে আগলে ধরলো। ধরতেই দীপা অস্ফুটভাবে বললো,—- দিলশাদ কই?

— হসপিটালেই আছে! তার জ্ঞান নেই।

— আমার আম্মু- আব্বু কই?

উমর উত্তর দিতে পারলো না। তাঁর বুক ফেঁটে যাচ্ছে। সে নিজে মা হারিয়েছে। এই কষ্টের স্বাদ সে জানে। কি করে বলবে সে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথেই তাদের এক্সিডেন্ট হয়েছে। ট্রাকের ধাক্কায় তাদের সিএনজি দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে। ড্রাইভার, দীপার বাবা সাথে সাথেই মারা গেছে। দীপা মা কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলো। কিন্তু হসপিটালে আনার পরেই……

দীপা চিৎকার দিয়ে উঠলো! উমরের বুকের শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো বললো, — আমার আব্বু কই উমর, আমার আম্মু কই। বলো? চুপ করে আছো কেনো। বলো! শুধু এইটুকু বলো? তারা এই হসপিটালে আছে। ভালো আছে, বেঁচে আছে।

উমর এবারো উত্তর দিতে পারলো না। তাঁর চোখ বেয়ে পানি পড়তো লাগলো।

দীপা চিৎকার করে উমরের বুকেই মাথা ঠুকে আর্তনাদ করতে লাগলো ! তাঁর আর্তনাদে গুমোট নিস্তব্ধ হসপিটালও যেনো থমকে গেলো।

চলবে……

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৮

সাবিহা বারান্দায় উঁকি দিলো। দিলশাদ চুপচাপ এক ধ্যানে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছুক্ষণ আগেও এসেছিলো। মেয়েটা ঠিক এভাবেই বসেছিলো। এর মধ্যে এতোটুকুও নড়েচড়ে বসেনি। কিছু দেখছে বলেও মনে হয় না। শুধু যেন বসে থাকার জন্যই বসে থাকা।

সে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! সে নিজেও ছোট বেলা বাবা, মা হারিয়েছে। এই কষ্ট সে বুঝে।

সে এগিয়ে গেলো। দিলশাদের মাথায় পরম মমতায় হাত রাখলো। অথচো তাঁর মাথায় হাত রাখার কেও ছিলো না। শোক করবে কি, মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে খুঁজতেই তখন সে দিশেহারা।

দিলশাদ হালকা কেঁপে উঠলো! তবে কিছু বললো না। যেভাবে বসে ছিলো, আবার সেভাবেই বসে রইলো।

সাবিহা ও তাঁর পাশে বসলো। প্রায় এক মাস হয়ে এলো খাদিজা আপা, রাজ্জাক ভাই নেই। বাস্তবতা বরই কঠিন। কারো জন্যই সে বসে থাকে না। অথচো এই মেয়ে দু- টো থমকে আছে। তাদের একেবারে আপন বলতে ছিলোই তো দু-জন। আজ তারা অন্য জগতের বাসিন্দা।

সে দিলশাদের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিলো। এই মেয়ে দু- টো তাঁর কেও না। সম্পর্ক থাকলেও দূরুত্বটা অনেক। তবুও এতো মায়া লাগে কেন কে জানে?

দিলশাদের চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো! সাবিহা টেনে দিলশাদকে বুকে নিলো। বুকে নিতেই দিলশাদ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

তাঁর কান্নার শব্দ দীপা রুম থেকে পেলো। তবে এগিয়ে গেলো না। সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো। আগের মতোই শুয়ে রইলো। শুধু তার চোখের কোণা থেকে টুপটাপ করে পানি পড়তে লাগলো।

আহান, আহাদ ও কাঁদছে! দীপার খালামণি, রুবিনা তাদের থামাতে হিমসিম খাচ্ছে। তবুও দীপা নড়লো না । তাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটের দুটো কোণায় তাঁর হ্নদয়ের দুটো অংশ ছটফট করছে। তবুও সে নড়লো না। সে পড়ে রইলো! সে পালাতে চায়! এই জগৎ সংসার থেকে সে পালাতে চায়। পালাতে চায় এই দুঃখ থেকে। পালাতে চায় এ সীমাহীন কষ্ট থেকে। পারে না কেন?

উমর এসে দীপাকে টেনে তুললো! হাত ধরে সামনে বসে কোমল সুরে বললো,—- যাদের উপরে দায়িত্ব পরে না, তাদের পালাতে হয় না দীপা। হাজার কষ্টের মধ্যেও না। তাদের শক্ত হতে হয়। দিলশাদ এখন তোমার দায়িত্ব। তাকে ভালো রাখতে হবে, তাকে আগলে রাখতে হবে । তুমিই যদি এভাবে না খেয়ে পড়ে থাকো। দিলশাদকে দেখবে কে? যারা চলে গেছে তাদের দুঃখে বিভোর না হয়ে। যে আছে তাকে আগলে ধরো। উঠো! দিলশাদের কাছে যাও। তাকে জড়িয়ে ধরো। দেখবে সব কষ্ট গায়েব হয়ে গেছে।

দীপা উঠলো! কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলো। তাঁর দিলশাদের কাছে যেতে হলো না। বারান্দায় পা রাখতেই দিলশাদ দৌড়ে এলো। তাঁর বুকে আছড়ে পড়লো।
দীপা চোখ বন্ধ করলো! দিলশাদকে বুকে জড়িয়ে মনে মনে বললো,—- হে আল্লাহ শক্তি দাও! এ কষ্ট সহ্য করার শক্তি দাও।

_____

দিলশাদ মাথা নিচু করে ড্রইং রুমে এসে দাঁড়ালো। আজ তাদের বাবা, মা গত হয়েছে চল্লিশ দিন। দুপুরে হুজুর, এতিমখানার মানুষ খাওয়ানো হয়েছে। সেই কারণে আত্মীয়- স্বজন সবাই আজ এ বাড়িতে। অবশ্য কারণ আরেকটাও আছে। সেটা হলো দিলশাদ।

দিলশাদ আসতেই সবাই তার দিকে তাকালো। সেই আগের হাসি, খুশি, উজ্জল দিলশাদের সাথে এই দিলশাদের কোন মিল নেই। নুইয়ে যাওয়া ফুলের মতো মাথা নিচু করে আছে। দেখলেই মনে হয় এখনি যেন ঝরে পড়ে যাবে।

উসমান অন্য দিকে তাকালো! আগে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করতো। মনে সুখের অনুভূতি হতো। এখন হয় ব্যথা। এই ব্যথার মুক্তি কোথায়? সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো!

সেই দিনের দূর্ঘটনার পরে দু- তিন সবাই ছিলো। পরে এই বাড়ির, ঐ বাড়ি সব আত্মীয় স্বজনই ধীরে ধীরে চলে গিয়েছে। সবারই সংসার আছে, কাজ আছে। কে কতদিন পরে থাকবে। তবে দীপার খালামণি আর শুশুর বাড়ির প্রায় সবাই ছিলো। এখনও আছে। তবে সব সময়তো আর থাকা সম্ভব না, না সম্ভব দিলশাদকে এখানে একা রাখা। তাই সবাই চাইছে দিলশাদের যার কাছে থাকতে ইচ্ছুক তাঁর কাছেই থাকুক। বোন, মামা, চাচা, খালা কেওই তাঁর পর না। তার যেখানে ভালো লাগে সেখানেই চলুক।

কিন্তু দিলশাদ শান্ত ভাবে বলেছে। সে হোস্টেলে উঠবে। বাকি পড়া লেখা সেখান থেকেই করবে।

এই কথা শুনে দীপা দিলশাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সে থাকতে তাঁর বোন কেন হোস্টেলে থাকবে। শুধু সে না, উমর সহ বাকি সবাইও বোঝাচ্ছে।

তবে দিলশাদ শক্ত হয়ে আছে। সে তার ডিসিশন থেকে নড়বে চড়বে না। তাই আজ সবাই একসাথে হয়েছে । যদি মেয়েটা কে একটু বোঝানো যায়।

দীপার খালামণি দিলশাদ কে দেখেই বললো,— ঠিক আছে, বোনের শুশুর বাড়ি! থাকতে চাছ না। আমার বাড়ি কি দোষ করলো? ছোট বেলা থেকে আসছিস, যাচ্ছিস। সবাই তোর পরিচিত। আর বলতে গেলে সেটাতো তোর নিজের বাড়িই। আজ না হোক কাল তো হবেই। কি রায়হানের আব্বু বলো।

রায়হানেন আব্বু সাথে সাথেই মাথা দোলালো! তবে রায়হান খুক খুক করে কেশে উঠলো। উঠে আড়চোখে উসমানের দিকে তাকালো।

উসমান শান্ত ভাবে বসে আছে। তাঁর দৃষ্টি নিচে! তবে রায়হানের মনে হলো, রাগে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। গত এক মাসে এই মানুষটাকে সে হাজার বার দেখেছে। পুরুষ মানুষ কাঁদে না। তবে ভেতরের ঝড় চেহেরা দেখলেই বোঝা যায়। এই এক মাসে রায়হানের মনে হয়েছে। এই মানুষটা ছাড়া দিলশাদের জন্য আর কেও ভালো হবেই না।

—- কি হলো কথা বলসিছ না কেন! হোস্টেলে থাকবি! কেন থাকবি? আমরা সবাই কি মরে গেছি?

দিলশাদ কোন কথারই উত্তর দিলো না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

উমর দীর্ঘশ্বাস ফেললো! কি করবে সে? দীপা এখানে আসেনি। ভেতরে বসে কাঁদছে! আর এদিকে দিলশাদ! সে জেদ ধরে আছে। কারো বাসায় সে যাবেনা।

অনেকক্ষণ এভাবেই গেলো। কেও দিলশাদ কে বোঝালো! কেও রাগ করলো। পরে বিরক্ত মুখে যে যার মতো চলে গেলো। কতোক্ষণ এভাবে বসে থাকবে। মেয়েটা ঠাট ধরে বসে আছে।

দিলশাদের খালামণিতো কিছুক্ষণ বসে বসে কাঁদলো। তবুও দিলশাদ নড়লো না। কারো কথা কানেই নিলো না। সে চুপচাপ, শান্ত ! এই নিশ্চুপতাই যেন তার সব প্রশ্নের উত্তর।

হামিদা বানু মুখ বাঁকালেন! বিরক্ত মুখে বললেন, —- এতো ঘাড়তেড়া মেয়ে তিনি জীবনে দেখেনি। এতোগুলো মানুষ বললো। কারো হাতই রাখলো না। বড়দের কথা শুনতে হয় বুঝেছো মেয়ে। এরা সবাই তোমার ভালো চায়। একা একটা মেয়ে। হোস্টেলে থাকবে। হোস্টেলে কি ভালো মেয়েরা থাকে।

এই কথায়ও দিলশাদের তেমন হেলদোল হলো না।

হামিদা বানু নিজের মতো বক বক করতে থাকলেন।
আর রুবিনা চুপচাপ এই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো । এই প্রথম মনে হলো মেয়েটা একটু অন্য রকম। এই মেয়েটাকে তিনি দেখতে পারেন না। এর অবশ্য কারণও আছে। এই মেয়েটার জন্যই সেইদিন প্রথম এতোগুলো কথা শুনেছে, প্রথম বার এতোবড় ঝগড়া হয়েছে। তাই তিনি মনে প্রাণে চেয়েছে, এই মেয়েটা তাদের পরিবার থেকে দূরে থাকুকু। বিশেষ করে উসমান থেকে। তার ধারণা ছিলো, মেয়েটা উসমানকে পটাতে চাইছে। উসমানকে পাওয়ার জন্য পেছনে পেছনে ঘুরছে।

তবে তাঁর ধারণা ভুল। এই মেয়েটা না বরং উসমানই মেয়েটার পেছনে ঘুরছে। সেইদিন মেয়েটার যখন জ্ঞান ছিলো না। তখন একবারের জন্যও উসমান মেয়েটার পাশে থেকে সরেনি। যখন জ্ঞান ফিরলো! মেয়েটার পাগলের মতো অবস্থা। কে কাকে সামলাবে! এক দিকে দীপা, আরেক দিকে আহান, আহাদ। দীপাদের খালা, মামাদেরও অবস্থা খারাপ। হাজার হলেও বোন। তখন উসমানই এই মেয়েটাকে আগলে রেখেছে। এক সেকেন্ডের জন্যও কাছ থেকে সরেনি।

এমন অবস্থায় আগলে রাখতেই পারে। এটা বড় কথা না। তবে দিলশাদ যখন আবারো জ্ঞান হারালো। আর কেও না দেখলেও সে দেখেছে। এই ছেলে অন্য দিকে ঘুরে বারবার চোখের পানি মুছছে। কার দুঃখে, কতোটা দুঃখে একটা ছেলের চোখে পানি আসে, এতোটুকু বোঝার বয়স তার হয়েছে। উসমান কেন বিয়ে করছে না। এখন সে বুঝতে পারছে।

তাই মেয়েটার এই ডিসিশনে সে খুশিই হলো। খুশি হলেও মেয়েটা প্রতি যে ঘৃণা ছিলো, তা আজ মুছে গেলো। মেয়েটার আত্মসম্মান অনেক প্রবল। সে চাইলেই যে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে যেতে পারতো। কিন্তু সেটা অন্যের! কেও না কেও, একটা না একটা সময় বোঝাবে। এখানে তুমি পর! সেই সুযোগ এই মেয়েটা কাওকেই দিবেনা। এক বারের জন্যও না।

রুবিনা উসমানের দিকে তাকালো! সে চুপচাপই বসে আছে। তবে সে জানে! এই ছেলে ভেতরে ভেতরে রাগে ফাঁটছে। ছোট বেলা থেকে সে এদেরকে চেনে। এতোটুকু যদি না বুঝে তো কি বুঝলো। বলার বা কিছু করার অধিকার নেইতো, তাই হয়তো চুপচাপ। তা না হলে এতোক্ষণে এখানে ভূমিকম্প হয়ে যেতো।

উমর উঠে দাঁড়ালো! দিলশাদের সামনে গিয়ে কোমল সুরে বললো,—- ভাই বলো তো আমাকে। সেই ভাইয়ের একটা রিকোয়েষ্ট রাখো। আমাদের সাথে চলো দিলশাদ।

দিলশাদ উমরের দিকে তাকালো! তার চোখে টলমলে পানি। সেই পানি নিয়েই বললো,—- আমি আপনাকে ভাই শুধু মুখে বলি না । মনে প্রাণে তা মানি! তবে এই রিকোয়েষ্ট আমি রাখতে পারবো না ভাইয়া।

— কেন? কি সমস্যা?

দিলশাদ এ কথার উত্তর দিলো না। চুপ করে রইলো।

— আচ্ছা! আমার কথা না রাখো। দীপার কথা ভাবো। সে কি ভালো থাকতে পারবে?

— আপনি তাকে ভালো রাখবেন।

— আমারটুকু তো আমি রাখবোই দিলশাদ! তোমারটার কি?

— সেইটুকুও আপনি রাখতে পারবেন। আমি জানি!

উমর অসহায় ভাবে তাঁকিয়ে রইলো। আর কি বলবে সে।

দিলশাদ আবার বললো,— আপনি প্রমিজ করেছিলেন। আমি কখনও কিছু চাইলে। আপনি জান প্রাণ দিয়ে হলেও দিবেন। তাহলে মনে করুণ আজ আমি এটাই চাইলাম।

উমর দীর্ঘশ্বাস ফেললো! আর উসমান হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো! বেড়িয়ে যাওয়ার আগে লাথি দিয়ে ফুলদানি উড়িয়ে গেলো।

সবাই চমকালো! চমকালো না দিলশাদ। সে যে ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।

হামিদা বানুর বকাবকি এবার দিলশাদ থেকে উসমানের দিকে গেলো। বিরক্তি নিয়ে বললো, — এই হারামজাদার আবার কি হইলো? জিনিস পএ ভাইঙ্গা এমন ফুটবল খেলতাছে ক্যা।

কেও কোন উত্তর দিলো না। আলি হোসেন উসমানের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ইউসুফের বলা সেই একটা কথা তার কানে বাজলো! মেজো ভাইও দিলশাদ আপুকে পছন্দ করে।

সে উঠে দাঁড়ালো! এই মেয়েটাকে তিনি সত্যিই স্নেহ করেন। মেয়েটাকে তিনি নিজের কাছে নিতে চেয়েছেন। তবে এতো কষ্টের মধ্যে দিয়ে এভাবে না।

সে এগিয়ে গেলো। দিলশাদের মাথায় হাত রেখে বললো,— আমি তোমাকে আমাদের সাথে যেতে বলবো না। শুধু বলবো, তুমিও প্রমিজ করো। কখনও যদি তোমার মন নিজের বাসায় জন্য কাঁদে তখন তুমি সর্বপ্রথম আমার বাসায় যাবে। বিনা দ্বিধায়, বিনা সংকোচে।

দিলশাদের চোখ ভর্তি পানি। সেই পানি নিয়েই সে মলিন ভাবে একটু হাসলো! হেসে বললো, — প্রমিজ!

চলবে…..