দর্পণ পর্ব-৩+৪

0
226

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৩

উসমান সময় দেখলো। প্রায় ঘন্টা হয়ে এলো সে বসে আছে। তাঁর এখন আবার বিরক্ত লাগছে। শুধু বিরক্ত না। সাথে রাগও লাগছে। এই মেয়েকে আবার অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে উঠে গিয়ে দু- গালে দুটো ঠাস ঠাস করে লাগিয়ে দিয়ে বলতে, -” এই আপনার রেডি হতে সময় লাগবে না। এক ঘন্টা হয়ে এলো এখনও আপনি এই ঘর থেকে ঔ ঘরে টুকটুক করে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। একবার লাল, একবার নীল জামা পরে এমন ভাব নিচ্ছেন বোনের বাড়ি না যেন ফ্যাশন শো করতে যাচ্ছেন। ফাজিল মেয়ে ! দের ইঞ্চি শরীর নিয়ে রেডি হতে এতো সময় লাগে?”

সে মনে মনে হাবিজাবি বললেও উপরে শুধু হাঁফ ছাড়লো! রাগ তাঁর নাকের ডগায় থাকে। কি কষ্টে যে দমাচ্ছে সে’ই একমাএ জানে। মেয়েটার যাওয়ার কথা শুনে সে খুশিই হয়েছিলো। তবে এখন মনে হচ্ছে আস্ত এক ঝামেলা। তাঁর কাজ আছে। তাঁরতো থাকার কথা ছিলো না। কালকেই চলে যাওয়ার কথা ছিলো। এখন ফোনের উপর ফোন আসছে। সে ভাইকে মেসেজ পাঠালো, — তোমার শ্যালিকা আসছে। একজনকে তো সামলাতে পারো না। এখন ঘরের বাইরের দুইজনের ঠেলা সামলানোর জন্য তৈরি হও।

তখনই দিলশাদ তাঁর রুম থেকে বের হলো। উসমান অবশ্য তাঁকালো না। এই মেয়ে যতোবারই রুম থেকে বের হয়েছে ততোবারই ভ্রু কুঁচকে একবার তাঁর দিকে তাকিয়েছে। এমন ভাব যেন সে পারমাণবিক বোমা তৈরির ফর্মুলা পাছায় চেপে বসে আছে। তাই তাকাক! যতো ইচ্ছে তাকাক! উসমানের কি আসে যায়। দু-দিনের পিচ্ছি এক মেয়ে। নাক টিপলে এখনো দুধ বের হবে। অথচো ভাব তাঁর আকাশ ছোঁয়া।

দিলশাদ বাবার রুমে আসলো! রাজ্জাক সাহেব খাঁটে আধাশোয়া হয়ে বসে আছে। তাঁর মুখ বিষন্ন। সে বাবার পাশে গিয়ে বসলো। বসে কোমল সুরে বললো, — আমি যাচ্ছি বলে কি তুমি রাগ করেছো আব্বু?

— না! রাগ করবো কেন? তবে কিছুদিন পরে তোমার এইচ.এস.সির রেজাল্ট আসবে। ভর্তির জন্যও তো প্রস্তুতি নিতে হবে। তুমি জানো আমি লেখা পড়া নিয়ে হেলাফেরা পছন্দ করি না।

দিলশাদ হাসলো!
— আমি কি সেখানে সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি নাকি?

— তবুও প্রভাবতো পড়বে। তবে যার জন্য যাচ্ছো, সে কিন্ত আমাদের কথা একবারও ভাবেনি।

— সে ভাবেনি বলে আমরাও কি ভাববো না। তাঁর মতই হয়ে যাবো। তাঁর মতো হলে তুমি খুশি হবে?

রাজ্জাক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে বললেন,— আমি তোমাদের সব সময় সব রকমের স্বাধীনতা দিয়েছি। কোথায়, কখন, কোন ডিসিশন নিতে হবে শিখিয়েছি। কখনও কোন কিছুর জন্য বাঁধা দেয়নি। তবুও দীপা এমন কেন করলো? তাহলে ধরে নিতে হবে আমরা পিতা, মাতা হিসেবে ব্যর্থ। সে তাঁর ভালো মন্দের কথা আমাদের বলতে পারেনি।

— সেটা তাঁর ব্যর্থতা, তোমাদের না। তোমরা ওয়ার্ল্ডের বেষ্ট বাবা, মা ?

রাজ্জাক সাহেব হাসলেন! বিষন্ন মাখা মুখে একটুকরো স্বস্থির হাসি।

দিলশাদও হাসলো! হেসে বাবার হাতের উপরে হাত রাখলো। রেখে মনে মনে সেও দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাঁর মনে এখন অনেক খটকা। লোকটার কথা সে মন দিয়ে শুনেছে। তবে কথার মধ্যে ফাক ছিলো। আপু ভালোবেসে বিয়ে করেছে। করতেই পারে। আজকাল কমন ব্যাপার। তবে এক বছর গায়েব থাকবে কেন? আমার বাবা, মা এমন কোন কঠোর পিতা মাতা না যে ভয়ে পালিয়ে থাকতে হবে। এসে ক্ষমা চাইলেই মিটমাট হতে যেত। এটা আর কেও না জানুক আপু জানে। তবে কেন এতো লুকোচুরি। আর রইলো মানসিক সমস্যা। স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকলে, বাবা মার কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য কষ্ট থাকবে। তবে মানসিক সমস্যা হবে না। হবে তখননি যখন যে বিবাহিত জীবনে সুখী থাকবে না। আফসোস হতে থাকবে এই কাজের জন্য। তাহলে ধরে নিতে হবে সে সুখী না। সে এমন অবস্থায় আছে। আসতেও পারছে না, থাকতেও পারছে না।

আসলে সমস্যা টা কোথায়? সাথে তার আফসোস হলো! কেন সে আগে একটু খেয়াল করেনি? কেন সে আপুর সাথে একটু ভালোভাবে কথা বলে নি।

_____

হামিদা বানুর কর্কশ বাক্যে দীপার ঘুম ভাঙলো। এটা অবশ্য নতুন না। রোজকার রুটিন! একটা মানুষ প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই কিভাবে এতো চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারে দীপা বুঝে উঠতে পারে না। হামিদা বানু তাঁর দাদী শাশুড়ি।এই বাসার একমাএ মাথা। এই মাথা যেই দিকে নড়ে এই বাড়ির বাতাসও সেই দিকেই চলে। আর তাঁর একমাএ সাথী তাঁর মেয়ে। রুবিনা ফুপু! সে বিধবা! তাঁর ছেলে মেয়ে আছে। সবার অবস্থাই ভালো। তবুও তিনি বাবার বাড়ি ছাড়তে পারেন না। তাঁর ধারনা তিনি চলে গেলেই এই বাড়ি ভেসে যাবে।

দীপা নড়েচড়ে হালকা একটু কাত হলো। তাঁর আট মাস চলছে। টুইন বেবি! ইদানিং তাঁর রাতে ঘুম হয় না। রাত যতো বাড়তে থাকে তাঁর ততো অস্থিরতা বাড়তে থাকে। এক সময় এমন হয় সে আর নিশ্বাস নিতে পারে না। মনে হয় দেয়াল গুলো সব তার দিকে চেপে আসছে।

প্রায় আধা রাত প্রর্যন্ত সে ড্রইং রুমেই বসে থাকে। এই বাসাটা একতলা! আজকাল যেখানে সবাই ডুপ্লেক্স ট্রিপ্লেক্স বাড়ি করতে মরিয়া। সেখানে তাঁর শুশুর মশাই বিশাল একটা একতলা বাড়ি করেছেন। সেই একতলার বাড়ির মধ্যেখানে বিশাল একটা ড্রইং রুম। সেই ড্রইং রুমের সামনে কারুকাজ করা বিশাল একটা কাঠের দরজা। সে দরজা খুললে সামনে সুন্দর একটা উঠান, উঠান পেরুলেই সোজা রাস্তা। যা এই ড্রইং রুম থেকে পুরোটাই দেখা যায়।

এই দরজা দীপার জন্য এখন সবসময় হাট করে খোলা থাকে। কারণ এই ড্রইং রুমে বসেই দীপা আধা বেলা, আধা রাত পার করে। চুপচাপ একলা। এ বাড়ির কাওকে তাঁর সহ্য হয় না। এখনতো আরো না। আর সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগে উমরকে।তবে সে জানে! সে যতোক্ষণ এই ড্রইং রুমে বসে থাকে সে আশেপাশেই থাকে। রাতে যতোক্ষণ জেগে থাকবে সেও জেগে থাকে।

দীপার এসব সহ্য হয় না। ঢং, ঢং সব ঢং । সে যেমন এই বাড়ির কাওকে দেখতে পারে না। তেমনি তাঁকেও অনেকে দেখতে পারে না। বিশেষ করে দাদী শুশুড়ি আর ফুপু। তাঁদের চক্ষের বিষ দীপা। শুধু উমরের জন্য সহ্য করা। তবে উসমান আর ইউসুফ ভালো। তাঁরা তাকে মন থেকে ভাবি বলে সম্মান করে।

দীপা কান পাতলো! তাঁর দাদী শাশুড়ি এখন তাঁকে বকছে। এটাও রোজকার রুটিন। দীপাকে একচোট বকাবকি না করলে তাঁর পেটের ভাত হজম হয় না। দীপা অবশ্য কখনও কিছু বলে না। ঝগড়া, চিৎকার, চেঁচামেচি এসব করতে তাঁর আর এখন ইচ্ছা করে না। প্রথম প্রথম বসে কাঁদতো এখন বসে বসে হাসে।
এখনো হাসলো!

কেও রুমের দিকে আসছে। কে দীপা জানে। এই মানুষটার হাঁটা, চলা, ঘ্রাণ সব দীপার পরিচিত । দীপা আস্তে করে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

উমর রুমে এসে দেখলো দীপা শুয়ে আছে। তবে সে জানে দীপা জেগে আছে। চোখ বন্ধ করে এভাবে সে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারে। আজব এক মেয়ে। অথচো এই আজব মেয়েটার জন্যই তাঁর ভিতর কেঁপে উঠে। এক পলক না দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে। সে দীপার পাশে গিয়ে বসলো! অনেকে বলে মা হওয়ার সময় মেয়েদের রুপ খোলে। দীপার ক্ষেত্রে তা হয় নি। ফর্সা মুখ এখন ফ্যাকাশে, চোখের নিচে কালি, শুকিয়ে চাপা ভেঙে গেছে, গলার হার উঠে গেছে। তবুও উমরের এতো ভালো লাগে। ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁকিয়ে থেকেও মন ভরে না। উমর আস্তে করে দীপার পাশে শুয়ে পড়লো। এই মেয়েকে দেখলেই তার জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। অবশ্য এখন সামান্য ছোঁয়াতেও তাঁর ভয় হয়। যদি ব্যথা পায়।

উমর শুতেই দীপা চোখ খুললো! খুলে উঠে বসার চেষ্টা করলো।
উমর দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে আগে নিজে উঠে দীপাকে আস্তে করে ধরে উঠালো।
— কিছু লাগবে?
— না!
— তাহলে উঠলে কেন?
— এমনিই।
উমর কিছু বললো না। দীপার পায়ের দিকে তাঁকালো। পা ফুলে আছে। সে আঙুল টেনে দিতে দিতে বললো, — বাইরে বসবে?
— না!
— আমি একটু বাইরে যাব। দেরি করবো না। তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো।

দীপা কিছু বললো না। তাঁর পেট মোড়াচ্ছে। এটা বমির পূর্বলক্ষণ। সে ঢোক গিললো।

উমর কিছুক্ষণ দীপার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। দীপা ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। উমন তাড়াতাড়ি খাটের সাইড থেকে বালতি আনার জন্য ঘুরতেই দীপা গরগর করে বমি করে খাট ভাসিয়ে দিলো। উমর আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললো! এই মেয়ে মরে গেলেও তাঁকে কিছু বলবে না।

উমর সব পরিষ্কার করে বাইরে আসলো। দীপার খাবার আনতে হবে। এই মেয়ে সারাদিন না খেয়ে থাকলেও কাওকে বলবে না খাবার দিতে। সে মুক্তাকে ডাকলো। মুক্তাকে দীপার যাবতীয় কাজ টাজ করার জন্য রাখা হয়েছে। তবে যতোক্ষণ উমর বাসায় থাকে তাঁর খুব একটা কাজ থাকে না। উমর নিজেই করে।

উমরকে দেখেই হামিদা বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন! নবাবের বউ উঠছে নাকি?

উমর তাঁকালো! তবে কিছু বললো না! সে কিচেন রুমে গিয়ে মুক্তাকে খাবার নিয়ে যেতে বললো। তারপর হামিদা বানুর সামনে গিয়ে বসলো। বসে বললো, — এখন বলো কি যেন বলছিলে?

— কি বলুম! বাচ্চা আর আমরা পয়দা করি নাই। নাকি তর বউ একলাই করতাছে। দিন রাত শোয়া বসা। আমরা পেটে বাচ্চা নিয়া মুণে মুণে ধান সেদ্ধ করছি।

— তো?

— তো কি রে হারামজাদা?

— দাদা যদি পেটে বাচ্চা নিয়ে তোমাকে মুণে মুণে ধান সেদ্ধ করায় ওটা দাদার সমস্যা, আমার না। আর দাদার সমস্যার জন্য আমার বউকে উঠতে বসতে কথা শুনাও কেন? শুধু আমি বলে চুপ আছি। পারলে উসমান আর ইউসুফের বউকে বইলো। যে আধা হাত উপরে আছো না। সেটুকুও নিচে পাঠিয়ে দিবে।

হামিদা বানু ফুঁসে উঠলেন!
— ওরা তোর মতো কোন অলক্ষী ধরে আনবো না। আমি নিজে ওগো বিয়া দিমু।

উসমান হাসলো! হেসে বললো,—
— সেটা সময় বলবে! আর এখন আমার কথা মন দিয়ে শোনো। দীপার বোন আসছে। তাই দয়া করে দীপার ব্যাপারে মুখ বন্ধ । দীপা এই বাড়ির বউ! তাঁকে বলো, বলো! কিন্তু এই বাড়িতে দীপার বোনের যেন কোন অসম্মান না হয়। এই কথা তোমার মাথায় ভালো করে ঢোকাও আর তোমার মেয়ের মাথায়ও, বুঝেছো! বলেই উসমান বেড়িয়ে গেলো।

হামিদা বানু উমরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলেন। কি জাদু করেছে ঐ কাল নাগিনী কে জানে। তাঁর ছেলেরা এখনও তাঁর উপরে কথা বলে না। অথচো তাঁর নাতি বলে। একজন কম ছিলো, যে আরেকজনকে হাজির করছে। তিনি চেঁচাতে লাগলেন, ” রুবিনা! ঐ রুবিনা! কই মরছোস?

চলবে…..

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৪

দিলশাদ উসমানের দিকে তাকালো। ড্রাইভারের সাথে বসার কারণে তাঁর শুধু পেছন সাইড দেখা যাচ্ছে। খাড়াখাড়া চুলে আর্মি কাটিং দেওয়া। লোকে বলে খাড়া চুলের ছেলেরা হয় বাঁকা, ঘাড়ের রগ থাকে ত্যাড়া । আর এই ত্যাড়া বাঁকা ছেলেরা কোন কাজ কখনও সোজা করে না। এরা সব করবে নিজের মতো করে। উসমানকেও দিলশাদের বাঁকাই মনে হচ্ছে। এই ছেলের নাকের ডগায় যে রাগ নিয়ে ঘুরে দিলশাদ ঠিক বুঝেছে। দেরি হচ্ছে বলে রাগে কেমন ছটফট করছিলো। দিলশাদ অবশ্য দেখেও দেখেনি। কেন দেখবে? ব্যাটা তুই এসেছিস নিজের ইচ্ছায় যাবি আমাদের ইচ্ছায়। এতো কিসের তারা তোর? থাকিসতো গ্রামে! গ্রামের মোড়ল তুই?

এই যে রাত ভরে সেবা করেছি, একটু বিরক্ত হয়েছি? জীবনে যা করিনি তাই করেছি। তোর মতো পাহাড়- পর্বতের শার্ট খুলেছি, রাত ভরে মাথায় পট্টি দিয়েছি। তুই যে জ্বরের ঘোরে এক পলকে লাল লাল ড্রকুলা মার্কা চোখে আমার দিকে রাত ভরে তাকিয়ে থেকেছিস। আমি তোর চোখ গেলেছি? না গালিনি তো! বরং ধৈর্য্য ধরে সেবা করেছি। আর তোর একটু দেরি সহ্য হয় না । মেয়েরা দেরি করবে না তো কে দেরি করবে, ব্যাটারা? এটা মেয়েদের জাতিগত অধিকার। সেই অধিকারের জন্য রাগ দেখাস। ব্যাটা খাটাশ! তুই যে খাটাশের খাটাশ এতে আমার আর বিন্দু মাএও সন্দেহ নেই। শুধু খাটাশ না! বুইড়া খাটাশ।

উসমান তখনি পেছনে ফিরলো! মেয়েটার অনেকক্ষণ সারা শব্দ নেই। তাঁদের রওনা দিতে দিতে প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। ঝামেলাতো কম না। অবশ্য রাজ্জাক আঙ্কেলই গাড়ি ঠিক করে দিয়েছেন। সাথে একগাদা ফলমূল। তাঁর মেয়ে খালি হাতে আরেক মেয়ের শুশুর বাড়ি যাবে এটা হয়তো তিনি মানতে পারবেন না। তবে আন্টি ছিলেন নিশ্চুপ,নির্বিকার । তাঁর মধ্যে আজ কোন ভাবাবেগ দেখা গেলো না। খুবই কঠিন টাইপ মহিলা। এর মতোই হয়তো তাঁর দুই মেয়ে এমন ডেনজারাস হয়েছে। একজন খাচ্ছে ভাইয়ের মাথা, এখন আরেকজন খাচ্ছে তাঁর।

সে দিলশাদের দিকে তাকালো! দিলশাদ মূর্তির মতো বসে আছে। এই মেয়ের আবার কি হলো? হঠাৎ হঠাৎ এমন মূর্তির মানবী হয়ে যায় কেন?

— আপনি ঠিক আছেন?

দিলশাদ কিছু বললো না! উপর নিচে হালকা মাথা ঝাকালো।

উসমানের হাসি পেলো! সে হাসি দমিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মাথায় পনিটেল করা, কানে ছোট্ট সোনার দূল। গায়ে হাল্কা গোলাপী থ্রিপিস। এভাবে বসে থাকার কারণে মেয়েটাকে পুতুলের মতো লাগছে। সে ঘুরে সামনে তাকালো। মেয়েটাকে কখনও ম্যাচিউর , আবার কখনও একদম বাচ্চা মনে হয়। কখনও তাঁকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আবার একসময় সহ্যই হয় না। আশ্চর্য! এর কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। অবশ্যই থাকতে হবে।

উসমান সিটে গা এলিয়ে দিলো! জ্বরের ক্লান্তি এখনো পিছু ছাড়ে নি। তখনি দিলশাদ কোমল সুরে বললো, — কে কে আছে আপনাদের বাসায়?

উসমান হাসলো! এই মেয়ে কথা বলে মাখনের মতো কিন্তু চোখ দিয়ে বের করে আগুনের ফুলকি । এখনি যদি সে তাঁকায়। দেখা যাবে এই মেয়ে ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট চেপে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে আছে । যেন সে বিরাট এক অপরাধ করে ফেলেছে। অথচো গত রাতে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়েই ছিলো এক পলকে। কেন ছিলো সে নিজেও জানে না। মেয়েটা মুখ গোমড়া করে যখন তাঁর এক একটা করে শার্টের বোতাম খুলছিলো, সে কি জানে তখন কি ঝড় হয়েছিলো। না প্রকৃতির ঝড় না। এ এক অন্য ঝড়! যুগ যুগ ধরে প্রত্যেক পুরুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্য একটা প্রকৃতি। সেই প্রকৃতিতে ঝড় উঠে শুধু বিশেষ বিশেষ মানুষের জন্য। তবে তার এই উথাল পাথাল ঝড় হলো কেন? নাকি জ্বরের জন্য! অবশ্যই জ্বরের জন্য। তা না হলে কে এই মেয়ে?

সে আবারো হাসলো! হেসে বলল,—- দাদি, বাবা, ফুপু, ভাই, ভাবি আর আমদের ছোট একটা ভাই ইউসুফ।

— ভাইয়ার নাম কি?
— কার ভাইয়া?
— কার আবার! আপনার?
— আমার ভাইয়া আপনার কি হয়?
দিলশাদ উত্তর দিলো না। সে জানালার দিকে তাকালো। শহর থেকে তাঁরা অনেক আগেই বেড়িয়ে এসেছে। এখন দু- পাশে যতোদূর চোখ যায় বিল আর বিল। কি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, নির্মূল বাতাস, তবুও কেমন জানি একটা শূণ্যতা।

— উমর! আমার বড় ভাইয়ের নাম উমর! বলেই উসমানও বাইরে তাকালো। তারা দু-জন বসেছে গাড়ির সামনে আর পিছনে। তবে একই সাইডে। জানালার বাইরে দৃশ্যও একই। তবে একজন দেখলো মনোমুগ্ধকর শূণ্যতা আরেক জন দেখলো শান্ত, শীতল, কোমল একটা মুখ, যা এই সুন্দর প্রকৃতিকে অদৃশ্য করে তাঁর চোখের সামনে ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো।

____

দীপা ড্রইং রুমে সোফায় এসে বসলো। তাঁর হাতে লেবু পাতা। ইদানিং এই ঘ্রাণ ছাড়া কোন কিছুরই ঘ্রাণ তাঁর ভালো লাগে না। নাকে গেলেই বমি পায়। তাঁর জন্য উমর আজকাল কোন পারফিউম গায়ে মাখে না। অথচো পারফিউম দিয়ে গোসল করা তাঁর স্বাভাব। সে তো এতো কিছু চায়নি। সে এই উমরকে চায়নি, এই টাকা -পয়সা,আরাম-আয়েশ কিছুই চায় নি। শুধু চেয়েছে শুভ্রতম পুরুষের একটু খানি ভালোবাসা। সেটা কি উমর তাঁকে দিতে পেরেছে। সবাই শুভ্রতম নারী চায়। একটা নারী কি শুভ্রতম পুরুষ চাইতে পারে না?

সে পাশে তাকালো! হামিদা বানু বসা। আজ কি রান্না হবে না হবে তিনি বলে দিচ্ছেন। বাসায় কেও আসবে কিনা কে জানে। এক গাদা রান্না – বান্নার কথা বলছেন। সে অবশ্য ওতো খেয়াল করলো না। কি হবে করে? এই সংসার কখনও কেন জানি তাঁর আপন মনে হয় না। প্রথম যখন এসেছিলো! হামিদা বানু এটা করো, ঐটা করো, এভাবে করো, ও ভাবে করো বলে বলে দিন ভরে চেঁচাতে থাকতেন। বাসায় দু-টো কাজের লোক। তবুও তিনি প্রায় সব কাজই তাকে দিয়ে করাতেন। সে চুপচাপ থাকতো! কেন জানি কিছুই বলতে ইচ্ছা করতো না। কাওকেই না, বলতোও না। এখনও বলে না। তবে তিন ভাইয়ের এক ভাইয়ের চোখে পড়লেই হলো। উমর ভালো ভাবে বললেও বাকি দুটো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলতো। আহা! দেখতে সব কতো সুন্দর। আসলেই কি সুন্দর? যেখানে মনের শান্তি নেই। সেখানে সবই অসুন্দর।

রুবিনা হাত মুছতে মুছতে হামিদা বানুর পাশে বসলেন। দীপার দিকে একবার তাকিয়ে হামিদা বানুর উদ্দেশ্য বললেন,— ভাবছিলাম উমর বিয়া করলে এই ডোবা সংসার আবার ভইসা উঠবো। আমার ছুটি মিলবো। আর কতো ভাইয়ের সংসারে বান্দি খাটুম। তাইতো মোজো ভাইয়ের মেয়েটারে আনতে চাইলাম। আর দেখো কপাল। কোথাকার কোন ভাঙা কূলা নিয়া আইছে। যার সংসারই ভালো লাগে না। আরে ভাই! মেয়ের অভাব আছে! যে থাকতে চায় না তাকে এতো ধইরা বাইনধা রাখার দরকার কি? জুতো একটা টিকবে না আরেক জোড়া নতুন কিনে আনবো। টাকা পয়সার অভাব আছে।

হামিদা বানু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের সাথে সহমত হলেন! তাঁর এই মাইয়াডা না থাকলে, এই নাতি তিনডা ভাইসা যাইতো। তবুও এরা এর কদর বুঝে না। দু-দিনের বউ নিয়া লাফালাফি করে।
না, একটা যা করছে করুক। আরেকটারে তিনি সুযোগ দিবে না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁর বড় ছেলে আর মেজো ছেলেরে নিয়া বইতে হইবো। আলি হোসেন কথা দিছে জসিমের মেয়েই তাঁর বাড়িরই বউ হউবো। তো কি হয়ছে বড় পোলার সাথে হয় নাই। মোজো ডা তো আছে। অতি তাড়াতাড়ি তিনি এই কাজ পুরা করবো। অবশ্যই করবো। তাঁর তিন ছেলের একটা মাএ মাইয়া। এই মাইয়া তিনি বংশের বাইরে যাইতে দিবেন না। কোন দিনও না।

এতো এতো কথায় দীপার কোন ভাবান্তর হলো না। সে তাকিয়ে আছে ঐ দূর রাস্তায়। মুক্তা কুসুম গরম তেল নিয়ে আসলো। ইশ! পা গুলা কেমন ফুলে আছে। ইউসুফ বাইরে থেকে আসলো! নেয়ে ঘেমে একাকার! হাতে তাঁর ফুটবল। পড়ালেখায় মন নেই বললেই চলে। দিনভরে টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। সামনে তাঁর এস এস সি পরীক্ষা। সেই ব্যাপারে তাঁর কোন মাথা ব্যাথাও নেই । অন্য কারোও নেই। আদরের ছোট ভাই বলে কথা। যা মন চায় করে।

ইউসুফের জন্ম উমর,উসমানের অনেক পরে। উমর উসমান তিন বছরের ছোট বড়। ছোট বড় হলেও এদের দেখতে প্রায় সমবয়সী’ই লাগে। পর পর দু-ছেলের জন্ম দিয়ে রোকসানা বেগম আর বাচ্চা নিতে চাইনি। কিন্তু ভুল করে তিনি কনসিভ করে ফেলেন। তখন উমর, উসমান ভালোই বড়। প্রায় সব কিছুই বুঝে। লজ্জায় তিনি শেষ। তাই বাচ্চা রাখতে চাইছিলেন না। কিন্তু হামিদা বানু নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই এই পাপ করতে দিবেন না। তিনি যেমনি থাক নাতি নাতনিদের তিনি বরই ভালোবাসেন। তাঁর জেদের কাছে আলি হোসেনও হার মানলেন। হামিদা বানু পুরুনো আমলের মানুষ। নাতি নাতিদের ভালোবাসলেও বউদের তিনি কখনও দেখতে পারেন না। সেই বউ বাচ্চা পেটে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া, আরাম, আয়েশ করা তাঁর কাছে বরই আদিখ্যেতা। রোকসানাও লজ্জায় কাওকে কিছু বললেন না। সঠিক সময়ে বাচ্চা আর মধ্য বয়সে এসে বাচ্চার জন্মের তফাত এরা বুঝতে পারলো না। বাচ্চা হওয়ার সময় তো একটু আকটু সমস্যা হবেই তাই কেও ওতো খেয়ালও করলো না। যেহেতু প্রথম দু-বাচ্চা বাসায় নরমালেই হয়েছে। এটাও বাসায় হওয়ার চেষ্টা করলেন। যার ফলাফল রোকসানা জীবন দিয়ে ভোগ করলেন।

ইউসুফ দীপার পাশের সোফায় ধপ করে বসলো! বসে হেসে বললো,— এখন কেমন লাগছে ভাবি?

দীপা ইউসুফের দিকে তাকালো! এদের তিন ভাইয়ের আদল একই। একই উচ্চতা, একই গায়ের রং, একই শরীরের গঠন ।

আস্তে করে কোনরকম দীপা বললো—- ভালো!

— আমরা ভাইয়েরাতো খুবই ভালো! তবে আমাদের কলিজারা তোমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে কেন বললো তো?

দীপা কিছু বললো না! মলিন ভাবে হাসলো।
— ভাই কই?
— আমি জানি না।
— মেজো ভাই কই! কালকে থেকে দেখেনি।
— আমি সেটাও জানি না।

ইউসুফ মুখ ভোঁতা করে বললো, —- জানো কি তুমি?

দীপা ইউসুফকে হাত দিয়ে ইশারা করলো। কাছে আসার জন্য।

ইউসুফ বড় একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে আসলো। একটু নিচু হয়ে বললো,– কি?

দীপা ইউসুফের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,— আমি জানি না।

ইউসুফ হেসে ফেললো! হেসে আবার সোফায় বসতে বসতে বললো! তুমিও না ভাবি।

দীপাও হালকা হাসলো! কিছুক্ষণ ইউসুফের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাসার গেইটের ভিতরে গাড়ি ঢুকেছে সে খেয়াল করে নি। গাড়ির দরজা লাগানোর শব্দে সে বাইরে তাকালো। তাকিয়েই সে স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখ থেকে একা একাই টুপটাপ করে পানি পড়তে লাগলো। ইশ! কতোদিন, কতোদিন পরে এই শুকনো মরুভূমিতে বৃষ্টি নামলো। এক বছর, দুবছর নাকি তারো বেশি।

চলবে…..