দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-০১

0
4

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

মাসখানিক আগে বিয়ে হয়েছে আমার। আমার হাসব্যান্ড মাহফুজ একজন সরকারী কর্মকর্তা। সদ্য বিসিএস কোয়ালিফাই করে প্রশাসন ক্যাডারে জয়েন করেছে। ওর পোস্টিং ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। ওর সাথে আমি আর আমার শাশুড়ী এসেছি। আমাদের অবশ্য নিজেদের পছন্দের বিয়ে। ও ভার্সিটিতে আমার দুবছরের সিনিয়র। ওর এখানে এসে ভালোই লাগছে। সরকারী কোয়ার্টার পেয়েছে মাহফুজ। আমারও একটা গিন্নী গিন্নী ভাব লাগছে। শাশুড়ী মা রান্না করছেন। আমি রান্না করতে চেয়েছিলাম। তবে মনে হলো উনি আমার উপর ভরসা পাচ্ছেন না। যাইহোক আমি সাথে করে বিয়ের গিফ্ট থেকে বেডসিটের সাথে ম্যাচিং পর্দা কিছু শোপিচ, কিছু কৃত্রিম ফুল নিয়ে এসেছি। সেগুলো দিয়ে ঘরটা সুন্দর করে সাজানো শুরু করলাম। সঙ্গে করে একটা কার্পেট এনেছিলাম। সবই বিয়ের গিফ্ট ছিলো। কোয়ার্টারে একজন খালা থাকেন। উনি অন্যান্য অফিসারের বাসায় কাজ করেন। তো এ বাসাতেও ঘর মোছা মাজাঘষা করা, তরকারীও কুটে দেন। আমি ঘর গুছিয়ে দিলে উনিও বেশ ঝকঝকে করে ঘর মুছে দিলেন। আমি যে খুব কাজকর্মে পটু তেমনটা নয়। তবে কাজ করতে আমার ভালোই লাগে। আসলে আমার মা একটা কথা সবসময় বলতেন। “জীবনে যখন যে কাজটা করবে সেটা সবসময় মনোযোগ দিয়ে করার চেষ্টা করবে। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। সেটা লেখাপড়া কিংবা ঘর ঝাড়ু দেওয়া যেটাই হোক না কেন।” মায়ের এই কথাটা আমরা তিনভাইবোন সবসময় মেনে চলি। তো শাশুড়ী মা আমার কাজকর্ম দেখে অখুশী হলেন না। তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা কথা বললেন,
—- ফারাহ তোমাকে এতো মনোযোগ দিয়ে সংসারের কাজকর্ম করলে তো চলবে না। এতো লেখাপড়া শিখেছো, বিএ এমএ পাশ দিয়েছো, ঘরে বসে শুধু কাজ করলে এই লেখাপড়াটা তো বিফলে যাবে। তোমার সামনে ভাইবা আছে। বিয়ের ঝামলায় একমাস ধরে বইয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ। এখন বই নিয়ে পড়তে বসবে। তোমাকে এই পরীক্ষাটায় পাশ দিতে হবে। তোমাকে আমার সঙ্গে করে এখানে আনার একটাই কারন নিরিবিলি তে তোমার পড়াশোনা ভালো হবে। যেহেতু তোমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে তাই ঢাকায় থাকলে দু,বাড়িতেই তোমাকে আত্মীয়স্বজনের চাপ সামলাতে হবে। আমি তোমাকে এখানে রেখে আমার বাপের বাড়ি চাঁদপুরে একটু ঘুরে আসবো। আর তুুমি সময় নষ্ট না করে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে।

শাশুড়ী মায়ের কথাগুলো শুনে আমার ভীষণ ভালো লাগলো। আমি অবাক হয়ে গেলাম উনি আমার জন্য কতোটা ভেবেছেন। অথচ মফস্বলে বেড়ে উঠা আমার শাশুড়ী খুব বেশী শিক্ষিত না। উনার বাবা ছিলেন তহশীলদার। আমার শ্বশুর ছিলেন ডিসি অফিসের নাজির। কিন্তু চিন্তায় চেতনায় আমার শাশুড়ী মা বেশ শিক্ষিত। আমি আমার শাশুড়ী মাকে হাগ করলাম। কারণ আমার বাবা মা বলেছিলেন আমি মাহফুজকে বিয়ে করে সুখী হতে পারবো না। আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেদিক থেকে মাহফুজদের বাড়ির পরিবেশ ভিন্নরকম। মানে আমার বাবা ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্ত কমকর্তা। উনি ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার। আমার মা এমএ পাশ করেছেন। কিছুদিন প্রাইভেট কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। তবে আমার জন্মের পর মায়ের আর চাকরি করা হয় নাই।
আমিও বিসিএস দিয়েছি। তবে শিক্ষা বিভাগে পরীক্ষা দিয়ে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। সামনের মাসে আমার ভাইবা পরীক্ষা। আমি ছোটোবেলা থেকে চারপাশে এতো স্বার্থপর সংকীর্ণ মনা শাশুড়ীদের দেখেছি তাতে করে আমার মনে হতো শাশুড়ী মানে হচ্ছে যেন এক জলজ্যান্ত আতংক। উনাদের দেখে আমার মাঝে মাঝে মনে হতো নয়তো আমি কোনো এতিম ছেলে বিয়ে করবো নয়ত বিয়ের কিছদিনের মধ্যে বাথরুমে পিছলে পড়ার ব্যবস্থা করে দিবো। অবশ্য বিছানায় পড়ে থাকলে আমার হয়তো কষ্ট হবে। তাতেও সমস্যা নাই। তখন আমার মনে হতো আর যাই হোক অন্তত কূটকচাল থেকে তো রক্ষা পাবো। অবশ্য আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন না। আসলে আমি তখন জী বাংলার সিরিয়াল দেখতাম। ওখানে শাশুড়ীদের ঘরের বউয়ের পিছনে যেভাবে লেগে থাকতে দেখতাম সেকারনে ঐ কূটবুদ্ধিগুলো ধারণ করেছিলাম। আম্মু মনে হয় বুঝতে পেরেছিলো। তারপর থেকে আমার সিরিয়াল দেখা বন্ধ হয়ে গেল। তখন অবশ্য আমার বয়স কম ছিলো। সিক্সে সেভেনে পড়ার সময় কতোই বা বয়স হবে। পরে অবশ্য মাথা থেকে এসব দুষ্টবুদ্ধি বার করে দিয়েছি। কেননা ঐ ব্যাটা মানে যে আমার স্বামী হবে সে যদি আমার মায়ের সাথে এমন করে তখন তো আমার মা কষ্ট পাবে। আমিও পাবো।
অবশ্য বয়সের সাথে সাথে আমার বুদ্ধিও বেড়েছে। নিজেকে ভালো মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আসলে আমার দাদীমা আমাদের সাথেই থাকতেন। উনি আমাদের পারিবারিক নানা বিষয়ে নাক গলাতেন। যেটা আমার পছন্দ না। বাবা মা কোথাও বেড়াতে গেলে দাদীর অনুমতি নিতে হতো। যেটা আমার কাছে খুব বিরক্তিকর মনে হতো। একদিন আম্মুকে বললাম,
—+আম্মু দাদী যে তোমার পারসোনাল বিষয়ে নাক গলায় তোমার বিরক্ত লাগে না?
আম্মু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তোমার কি মনে হয়? আমি বিরক্ত হই।
—-না,তা মনে হয় না। তবে আমি হলে বিরক্ত হতাম।
—মা যখন তোমার সব ব্যাপারে মাথা ঘামায় তখন কি তুমি বিরক্ত হও? এই যেমন বাইরে যাওয়ার সময় প্যান্ট আর ফতুয়ার সাথে ওড়না পরতে বলি। আবার মুখে বেশী মেকাপ করলে বকা দেই। যখন তখন বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিতে দেই না। কোনো বান্ধবীর বাসায় রাতে থাকতে দেই না। তখন কি তোমার মেজাজ খারাপ হয়।
—-একটু খারাপ লাগে। তবে পরক্ষণেই মনে হয় তুমি আমার ভালোর জন্য এসব কথা বলছো।
—+তোমার দাদীর কথায় আমার অনুভূতী অনেকটা সেরকমই হয়।

যাইহোক শাশুড়ী সম্পর্কে নানা ভীতি নিয়ে বড় হলেও ভাগ্যক্রমে আল্লাহপাকের রহমতে আমার নিজের শাশুড়ী মা অনেক ভালো মনের মানুষ। আমার বিয়ের কেনা কাটা করার সময় শাশুড়ী মা আমার আর মাহফুজের সাথে গিয়েছিলো। আমার বিয়ের শাড়িটা উনার পছন্দে কেনা হয়েছিলো। আর লেহেঙ্গা আমার পছন্দে কিনেছিলাম। একটা নাগরা কিনে ছিলাম। দাম তিনহাজার টাকা। সেটা দেখে শাশুড়ী মা বলেছিলো,
—+বাহ্ নাগরাটা তো খুব সুন্দর।
আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার শাশুড়ীমা খুব মনোযোগ দিয়ে জুতোটা দেখছিলো। কাছে গিয়ে বললাম,
—-মা৷ নিবো নাকও আপনার জন্য একজোড়া।
উনিও আহ্লদিতো হয়ে বললেন,
—-মন্দ হয় না।
আমি উনার জন্য আমার মতো নাগরা কিনে নিলাম। সেটা দেখে মাহফুজ অবশ্য একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিলো,
—++মায়ের কি এখন এসব পড়ার বয়স আছে?
আমার তখন মাহফুজের উপর খুব রাগ হলো। আমিও রেগে গিয়ে বললাম,
—-মেয়েদের চিরকাল সাজুগুজু করার বয়স থাকে।
ও অবশ্য আর কথা বাড়ায়নি। তবে শাশুড়ী মা আমার উপর খুশী হয়েছিলেন।

বিয়ের পর যখন শ্বশুর বাড়িতে যাই সেদিন রাতে শাশুড়ী মা আমার হাতে একটা চাবি দিয়ে বলেছিলেন,
—–এই আলমারীতে তোমার গয়নাগুলো রেখো।
আর এই অনুষ্ঠানের পর তোমার গয়না তোমার মায়ের কাছে রেখো। আমাকে এসবের দায়িত্ব দিও না।
আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে দশভরি আর আমাদের বাসা থেকে দশভরি গোল্ড দেওয়া হয়েছিলো। তবে শ্বশুর বাড়ীর গয়নাগুলোতে মাহফুজ ফিফটি পারসেন্ট শেয়ার করেছিলো। আমার আবার সোনা পড়তে ভালো লাগে। এরা মাহফুজ জানতো। তাই সম্পর্কের শুরু থেকে মাহফুজ টিউশনি করে টাকা জমাতো। বিয়েতে আমাদের বাসা থেকে মাহফুজকে প্লাটিনামের উপরে ডায়মন্ডের রিং দেওয়া হয়েছিলো। মাহফুজও আমার জন্য ডায়মন্ডের আংটি কিনেছিলো। সেটা দেখে শাশুড়ী মা বলেছিলেন,”একছেলে ইঞ্জিনিয়ার আর আর এক ছেলে ম্যাজিস্টেট। কিন্তু আমার ভাগ্য হলো না ডায়মন্ড পড়ার। অন্তত একটা হীরার নাকফুল তো পড়তে পারতাম।” কথাটা আমার কানে আসা মাত্রই আমি কাউকে না জানিয়ে বিয়ের শপিং এর সময় শাশুড়ী মায়ের জন্য একটা ডায়মন্ডের নাকফুল কিনে রেখেছিলাম। অবশ্য শাশুড়ী মায়ের এ কথাটা মাহফুজের কাছেই শোনা। ওর কথা হচ্ছে মায়ের যদি হীরের নাকফুল পড়ার বয়স থাকতো তাহলে ও ঠিক কিনে দিতো। আসলে ওতো বুঝবে না। মধ্যবিত্ত ঘরের একজন বাবা মা তাদের সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে তাদের শখ আহ্লাদগুলোকে অন্তরের গোপন কুঠুরীতে তালা বন্ধ করে রাখে। সেটা তো চিরজীবনের জন্য নয়। জীবনের তাগিদে হয়তো কিছু সময়ের জন্য চাপা পড়ে থাকে।

চলবে