দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-১০

0
1

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী

আমি রুমে এসে ওজু করে যোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম। তারপর বাইরে খাবার অর্ডার করলাম। একটু বেশী করেই করলাম। যেন রাতে রাঁধতে না হয়। আমার পক্ষে রান্না করা সম্ভব না। শরীরটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। আর মাহফুজ বেচারা জার্ণি করে এসে আবার বৌকে রান্না করে খাওয়াবে সেটাও মনে হয় শোভন হবে না। এর থেকে খাবার অর্ডার করে আনাই ভালো। কাউকে আর রান্না করতে হবে না। তাছাড়া জেলা শহরগুলোতে রাতের বেলা অর্ডার করলে অনেক সময় কিছু পাওয়া যায় না। তাই দিনের বেলাতেই বেশী করে অর্ডার করলাম। অর্ডার করার ঘন্টাখানিক পর খাবারগুলো চলে আসার কথা। তিনপদের ভর্তা অর্ডার করেছি। শিদল ভর্তা, বেগুন ভর্তা আর সিম ভর্তা। সাথে গুতুম মাছের( ছোটো বাইম মাছ) চচ্চড়ি আর নাপা শাক। গরুর মাংস রান্না করা আছে। আমি মাঝে মাঝে বিপদের বন্ধু হিসাবে গরুর মাংস রান্না করে ডিপে রেখে দেই। যেদিন রান্না করতে মন চায় না সেদিন গরুর মাংস দিয়ে চালিয়ে নেই। মাংসটা বের করে রাখলাম।
ঘন্টা খানিকের মধ্যে খাবার চলে আসলো। আমি ফ্রিজে রাখা ভাত বের করে ওভেনে গরম করে নিয়ে খেতে বসলাম। প্রথমে শিদল ভর্তা দিয়ে শুরু করলাম। জ্বর মুখে ভালোই লাগছে। কলিং বেলটা বেজে উঠলো। এসময় আবার কে আসলো। খাওয়া থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-কে?
—-ম্যাম আমি অরুপ,
—-এই অসময়ে তুমি
দরজা খোলার সাথে সাথে দেখি অরুপ একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
—-কি ব্যাপার?
এমনসময় পাশ থেকে মাহফুজ বের হয়ে অরুপের হাত থেকে ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে বললো,
—-তুমি এখন যেতে পারো। বাকিটা আমি দেখছি।
অরুপ আমার আর মাহফুজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেল। ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে মাহফুজ বললো,
—-তোমাদের এই কেয়ারটেকার ছেলেটা বেশ করিৎকর্মা।
—-হুম,অরুপ অলরাউন্ডার। বাজার বলো, মিস্ত্রি আনা বলো,সব কাজে বেশ পারদর্শী। অরুপের কথা থাক। তোমার কথা বলো। তোমার তো রাতে আসার কথা।
—-হুম,তোমাকে একটু চমকে দিলাম।
—– আমার মাথা কাজ করছে না। তুমি এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলে।
—-পুরোটা পথ প্লেনে এসেছি।
—-একদম ডাইরেক্ট আসছো?
—-না, ফেনী থেকে চিটাগাং গিয়ে বাংলাদেশ বিমানে করে ঢাকা এয়ারপোর্ট। আর ঢাকা থেকে নভোএয়ারে করে সোজা সৈয়দপুর। তারপর ওখান থেকে একদম তোমার আঁচলের তলায়।
—থাক এখন আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসো। আমারও খাওয়া হয়নি।
মাহফুজকে থামিয়ে দিলাম। তা,নাহলে নানা রকম নোংরা কথা বলা শুরু করবে। এমনিতে সবার সামনে এমন ভাব দেখাবে ওর মতো ভদ্র দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু আমি জানি ও কি জিনিস। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মাহফুজ খাবার টেবিলে বসে শিদলের ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করলো। আমি ওর খাওয়া দেখে ভাবছি শাশুড়ী মা এই দৃশ্য দেখলে আঁতকে উঠবেন। শাশুড়ী মায়ের কাছে গল্প শুনেছিলাম মাহফুজ বিয়ের আগে শুঁটকি ভর্তা খেতো না। অথচ শুঁটকি আমার অতি প্রিয়। সাহেব কতোদিন না খেয়ে থাকবেন? কোনো অভিযোগ দায়ের না করে সাহেব এখন শুঁটকি খাওয়া শিখে নিয়েছেন। উনি যদি কোনো অভিযোগ দায়ের করতেন তাহলে তো আমি শুঁটকি ছাড়া কিছু খেতাম না। যার ফলে ক,দিন শুঁটকি না খেয়ে থাকবেন। বেচারা মনে হয় প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিলো। তাই কোনোদিকে না তাকিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছে। ওর খাওয়া দেখে অবশ্য আমারও খারাপ লাগছে। তাই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-সকালে ব্রেকফাস্ট কখন করেছো?
মুচকি হেসে বললো,
—-আমার খাওয়া দেখে ভাবছো না খেয়ে বেড়িয়েছি। বাস্তবতা তা নয়। শিদলের ভর্তাটা খুবই চমৎকার হয়েছে।
—-তুমি কি বানিয়েছো?
—-না,আজ আমি রান্না করিনি। বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করেছি।
—-তবে খাবার যেখানে অর্ডার করা হয়েছে সেখানকার রাঁধুনীর হাতের রান্না বেশ ভালো। এটা মানতেই হবে।
—-তা অবশ্য ঠিক বলেছো।
—-শোনো, দ্রুত খেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নাও। সন্ধা সাতটায় ফ্লাইট।
—-কোথায় যাবো?
—-এটা সারপ্রাইজ থাক।
আমি আসলে ওর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। তাই আবারও ওকে বললাম,
—-দেখো, কোথায় যাচ্ছি কিংবা কতোদিন থাকবো সেটা না বললে আমি ছুটি নিবো কেমন করে? না বলে স্টেশন লিভ করা ঠিক না।
—-ঐ দিকটা আমার উপর ছেড়ে দাও।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
—-ফারাহ্, চারটা বাজে। আমাদের কিন্তু পাঁচটার মধ্যে বের হতে হবে।
আমিও আর কিছু না বলে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। এরপর এঁটো থালাবাসনগুলো কিচেনে নিয়ে ধুয়ে ফেললাম। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে পাঁচটার মধ্যে ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। নভোএয়ারে করে শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। ঢাকায় পৌঁছে সে রাতটা বাবার বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন খুব ভোরে গুলশান দুই নম্বরে থাই ভিসার জন্য দাঁড়ালাম। খুব সকালে যাওয়াতে ভিসার কাজ দ্রুতই হয়ে গেল। আমরা এগারোটার মধ্যে বের হয়ে অনলাইন থেকে বাংলাদেশ বিমানে থাইল্যান্ড যাওয়ার জন্য দুটো টিকিট কেটে নিলাম। এরপর বাসায় এসে ব্যাগ নিয়ে সোজা বিমানবন্দর পৌঁছে গেলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা বাজে। আমাদের ফ্লাইট পাঁচটার সময়। ইমিগ্রেশন ক্রস করে ওয়েটিং রুমে বসে আছি। পাঁচটার সময় আমরা বাংলাদেশ বিমানে উঠে পড়লাম। আমার অবশ্য মাহফুজের এই সারপ্রাইজটা ভীষণ ভালো লেগেছে। প্লেনে বসে সিট বেল্টটা বেঁধে নিলাম। মাহফুজ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—-সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম?
আমিও মুখভর্তি হাসি দিয়ে বললাম,
—-দারুন।
প্লেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর আমাদের খাবার দিয়ে দিলো। সারাদিনের দৌড়ঝাপে বেশ ক্ষুধার্ত ছিলাম। খুব দ্রুত খেয়ে নিলাম। আমি আবার তাড়াতাড়ি খেতে পছন্দ করি। খাওয়া শেষ করে আস্তে আস্তে জুসের গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলাম। আর মনে মনে ভাবলাম মাহফুজ আমার কথাটা মনে রেখেছে। বিয়ের পর যখন সাজেক ঘুরতে যাই তখন শ্বশুর শাশুড়ী মিলে দল বেঁধে যেতে হয়েছে। মাহফুজের উপর খুব রাগ হয়েছিলো। ও অবশ্য আমার বিষয়টা বুঝেছিলো। তখন আমাকে বলেছিলো সময় সুযোগ করে আমাকে দেশের বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবে। মনে মনে তখন বলপছিলাম,”হুম ততদিনে আমি বুড়ি হয়ে নাতিপুতি হয়ে যাবে।” এটা ভেবে ভালো লাগছে ও আমাকে দেওয়া কথাটা ভুলে যায়নি। আসলে প্রত্যেকটা জিনিসের একটা সময় থাকে। জীবনের সমস্ত কাজ সময়নুযায়ী করা উচিত। এতে বেলাশেষে জীবনটাকে অনেক সুন্দর মনে হয়। ঘন্টাতিনেকের মধ্যে আমরা সুবর্নভুমি এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। ওখান থেকে পাতায়াতে যাওয়ার জন্য বাসের দুটো টিকিট কেটে নিলাম। আমরা এখান থেকেই পাতায়াতে যাওয়ার জন্য বাসে উঠবো। রাত বারোটার বাসে পাতায়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবো। এই ফাঁকে আমরা কিছু খেয়ে নিলাম। এখানকার ডিউটি শপগুলো ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। নিদিষ্ট সময়ে বাসে উঠে পড়লাম। খুব দ্রুতগতিতে বাস চলতে শুরু করলো। আমার আবার বাসের দুলুনিতে ঘুম এসে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। মাহফুজের ডাকে আমি ধড়মর করে উঠলাম। মাহফুজ আমাকে ধাতস্থ হতে বললো,
—আস্তে ধীরে উঠো। আমরা পাতায়াতে পৌঁছে গিয়েছি। হোটেল থেকে আমাদের নিতে গাড়ি আসবে।
আমি আর মাহফুজ বাস থেকে নামতেই প্লাকার্ডে আমাদের নাম লিখে একজন থাই দাঁড়িয়েছিলো। মাহফুজ এগিয়ে গিয়ে উনাকে নিজের পরিচয় দেওয়াতে উনি আমাদের নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। পাতায়াতে আমাদের হোটেলে যাওয়ার পথে একটা কথা আমার মনে হলো এরা এদের বীচটাকে বিশ্বের কাছে খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে। আধুনিক উন্নত জীবনের সমস্ত সুযোগ সুবিধা আছে। নানারকম বিনোদনের আয়োজন রয়েছে। আমার যদিও পাতায়া বীচটার চেয়ে আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতটাকে ভীষণ ভালো লাগে। বিশাল সিবীচ। একদিকে পাহাড় অন্যদিকে সমুদ্র। এর সৌন্দর্য আলাদা। কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা আমাদের হোটেলে পৌঁছে গেলাম। হোটেলটা বেশ সুন্দর। দক্ষিনমুখী। জানালা দিয়ে দূরে সাগর দেখা যায়।
হোটেলে পৌঁছে মাহফুজ ঘোষণা দিলো ও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিবে তারপর আমার সাথে বীচে ঘুরতে বের হবে। আমারও মনে হলো ওকে একটু সময় দেওয়া উচিত। বেচারা দু,দিন একটানা জার্ণির উপর আছে। আমরা রুম সার্ভিসে খাবার অর্ডার করলাম। মাহফুজ ব্রেকফাস্ট করেই ঘুমিয়ে পড়লো। আমি ব্রেকফাস্ট শেষ করে এক মগ কফি নিয়ে রুমের লাগেয়া লনে রকিং চেয়ারটায় বসে দূরে সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করছি।

মাহফুজ একটা লম্বা ঘুম দিয়ে দুপুর দু,টায় ঘুম থেকে উঠলো। ওকে এখন বেশ ফ্রেস লাগছে। এরপর ও ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিলো। আমি আগেই গোসল করে রেডী হয়ে আছি। জিন্স প্যান্টের সাথে একটা লাল ফতুয়া আর মাথায় লাল হেজাব পড়ে নিয়েছি। মাহফুজ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তোমাকে খুব হট লাগছে।
—-ফালতু কথা বাদ দিয়ে এখন চলো, আমি লাঞ্চ করবো। খুব খিদে পেয়েছে।
—-আচ্ছা তুমি এতো কাঠখোট্টা কেন? একদম রসকষ নাই।
—শুনো ক্ষুদার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।
আমার কথাশুনে ও ফিক করে হেসে ফেললো। আমাদের হোটেলের লাগোয়া একটা রেস্টুরেন্টে আমরা লাঞ্চ করতে আসলাম। ফিস ফ্রাই, সালাদ, আর ভেজিটেবল অর্ডার করলাম। দুজনে পেটপুরে খেয়ে চারটার দিকে বীচের পানে হাঁটতে লাগলাম। এখানকার পানিটা একদম নীল। নীচের সাদা বালিগুলে দেখা যাচ্ছে। আমার পানিতে নামতে ইচ্ছে হলো।
সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঢেউগুলো আমার পায়ের উপর আঁছড়ে পড়ছে। সমুদ্রের নোনা বাতাসে আমার হেজাব ওড়না সব এলোমেলো উড়ছে। মাহফুজ বালির উপর বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার পানিতে খুব ভয়। তাই পানি থেকে উঠে মাহফুজের হাত ধরে টেনে পানিতে নামিয়ে আনলাম। তারপর ওর হাত ধরে আমি সমুদ্রের পানিতে এসে দাঁড়ালাম। একটা বড় ঢেউ এসে আমাকে আর মাহফুজকে ভিজিয়ে দিলো। আমি হোঁচটা খেয়ে মাহফুজের বুকের সাথে ধাক্কা খেলাম। মাহফুজ এই সুযোগটা কাজে লাগালো। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো,
—-আমার চোখে নেশা ধরাতে লাল ফতুয়া পড়েছো। তা আমি বেশ বুঝতে পারছি।
আমার ভীষণ লজ্জা বোধ হলো। এভাবে প্রকাশ্যে ভালোবাসা প্রকাশ করার সাথে আমি অভ্যস্ত নই। মাহফুজ সেটা বুঝতে পেরে আমাকে বললো,
—এখানে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। চর্তুদিকে তাকিয়ে দেখো সব কেমন জোড়ায় জোড়ায় একজন আর একজনের গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।
চর্তুদিকে তাকিয়ে দেখলাম,আসলেই তাই। আমিও মাহফুজের হাত ধরে সমুদ্রের নোনা জলে হাঁটতে লাগলাম। মাহফুজ অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অস্তরাগের শেষ আলোটা আমার পুরো অবয়বে পড়েছে। মাহফুজের ঘোর লাগা দৃষ্টিটা আমি ভালোই উপভোগ করছি। প্রতিটি নারীর তো এটাই চাওয়া নিজের প্রানপ্রিয় স্বামী ব্যক্তিটি যেন তার প্রেমে হাবুডুবু খায়। এ এক অন্যরকম সুখানুভূতী।

চলবে