দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
2

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

মাহফুজের বেতন না হওয়াতে আমরা দুজনেই একটু বিপাকে পড়ে গেলাম। কারণ আমার শ্বশুর শাশুড়ীর ওষুধের খরচ ওকেই দিতে হতো। সেটা এখন দিতে পারছে না। আমি কিছুটা সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু পেরে উঠছি না। আসলে সংসারের জায়গাটা এমন এখানে টাকা পয়সার চাহিদাটাকে দমিয়ে রাখা যায় না। এটা নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমার ভাসুরের উপর চাপ পড়ে যাচ্ছে। সে কারনে আমার জা সেদিন ফোন দিয়ে আমাকে বললো,সংসারের চাপে নাকি ভাইয়ার প্রেসার বেড়েছে। বাবা মায়ের ওষুধের খরচ থেকে শুরু করে সব কিছুই ভাইয়াকে সামলাতে হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কাউকে তো বুঝানো যাবে না আমাদের অবস্থা। সরকারী চাকরি করতে গেলে এ ধরনের সমস্যায় কাউকে না কাউকে পড়তে হয়। যাইহোক এখন কিল খেয়ে কিল হজম করতে হচ্ছে। জীবনের তাগিদে বেশীরভাগ মানুষই প্রয়োজনের প্রিয়জন হয়। এদিকে আমার প্রিন্সিপাল ম্যাম আমাদের ঢেকে বলে দিয়েছেন,যে সব ছাত্রীরা মিছিলে অংশ নিবে তাদের উপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবং আমাদের টিচারদের বলেছেন,আমরা যেন ছাত্রীদের প্রতি অনেক কঠোর হই। কোনোভাবে তারা যেন মিছিলে যেতে না পারে। কিন্তু এভাবে ছাত্রীদের মিছিলে যাওয়া কি আটকানো যাবে? আমার তা মনে হয় না।

আস্তে আস্তে সব পাবলিক ইউনিভার্সিটি গুলোতে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করলো। এই সরকার বসার পর বহুবার নানা রকম আন্দোলন হয়েছে। প্রতিবার সরকার সেটা শক্ত হাতে দমন করতে পেরেছে। কিন্তু এবারের আন্দোলনটা আমার কাছে একটু ভিন্ন মাত্রার মনে হতে লাগলো। পাশাপাশি আমার একটু টেনশনও হচ্ছে। আন্দোলন জোরালো হলে যদি ভিসার পেতে দেরী হয়। কিন্তু এই আন্দোলন আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। কারণ ৫৬%কোটা থাকার কারনে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী সরকারী চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়। আমি যেহেতু সম্প্রত্তি সরকারী চাকরিতে জয়েন করেছি তাই এই সম্পর্কে আমার ভালো অভিজ্ঞতা আছে। আমার অনেক মেধাবী বন্ধু বান্ধব ছিলো। শুধু কোটার কারনে তাদের স্বপ্নটা অধরাই থেকে যায়। সেই কারনে ছাত্ররা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় আন্দোলনটাকে বেগবান করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো।

জুনমাসের মাঝামাঝি সময়ে কুরবানি ঈদ থাকায় আন্দোলনে ধীরগতি নেমে আসে। এদিকে আমার সংসারেও নানারকম সমস্যা উঁকি মারতে শুরু করে। মাহফুজের বেতনটা এখন পর্যন্ত আটকে আছে। আমার ও একটু টেনশন হচ্ছে শেষ পর্যন্ত চাকরিটা থাকবে তো? আমাদের এতো সুন্দর দাম্পত্যে আনন্দটা যেন অনেকটাই ভাটা পড়লো। এতে একটা উপকার হয়েছে। আমরা দুজনেই ইবাদত বন্দেগীতে নিজেদের ব্যস্ত রাখছি। আসলে বিপদে না পড়লে আমরা তো আল্লাহপাককে মন উজাড় করে ডাকি না। যদিও আমাদের সবসময় আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করা উচিত। সেটা আমরা ক’জন করি। বেশীরভাগ মানুষই বিপদে পড়লে আল্লাহপাককে স্মরণ করে।

ঈদের পর জুনমাসের শেষের দিকে আন্দোলন আবারও দানা বাঁধতে শুরু করে। ছাত্ররা মিছিল মিটিং সমাবেশ এমনকি বাংলাব্লকেট পালন করতে থাকে। স্বৈরাচারী সরকারের সীমাহীন কতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষের সহ্যের সীমা বহু আগেই পার হয়েছে। প্রতারণা মূলক নির্বাচন, মন্ত্রী, পুলিশ, আমলা আর শেখ পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের ক্ষমতার অপব্যবহার আর দূর্নীতি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ মাস্তানদের অত্যাচার,মানি লন্ডারিং,এসব কারনে বাংলাদেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ে। যদিও স্বৈরাচারী সরকার আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য বেনজির,আর মতিউরের দূর্নীতি সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু এবার এসব অপকৌশলে কোনো কাজ হয়নি।

এই সময় আমাদের টিচারদের ক্লাস না থাকলেও কলেজে প্রতিদিন যেতে হয়েছে। আমার প্রিন্সিপাল তো আমাকে রীতিমতো হুমকি দেয়। উনার কথা না শুনলে আমাকেও আমার স্বামীর মতো ওএসডি করে রাখা হবে। এতে অবশ্য আমি ঘাবড়াইনি। কারণ বাইরে যেহেতু মাস্টার্স করতে চলে যাবো তাই এখানকার চাকরি নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। দরকার হলে পিএইচডিরও এপ্লাই করবো।এরমধ্যে প্রতিটি পাবলিক ভার্সিটিতে ছাত্রলীগের গুন্ডারা সাধারণ ছাত্রদের উপর হামলা করে। আর ছাত্রীদের কে অসম্মানিত করে। এতে এই আন্দোলন দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও এসে আন্দোলনে যোগ দেয়। তারমাঝে ১৬ই জুলাই পুলিশের গুলিতে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুসাইদের হ*ত্যাকান্ডে পুরো দেশ অগ্নিগর্ভে পরিনত হয়। ১৭-১৮ জুলাই সর্বস্তরের জনগন এসে আন্দোলনে যোগ দেয়। আমিও কলেজের ছাত্রীদের সাথে মিছিলে অংশ নেই। তবে মাহফুজ মিছিলে অংশ নেয় না। আমিও ওকে জোর করি না। আবুসাঈদের মৃত্যুতে রংপুরের পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে যায়। যারফলে স্বৈরাচারী নীতিনির্ধারকদের পরামর্শে পুলিশের গুলিতে সারাদেশে ব্যাপক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। তবুও এই আন্দোলন দমানো যায়নি। আমি ৫২দেখিনি ৭১ দেখিনি ৯০ দেখিনি। কিন্তু ২০২৪ দেখেছি। স্বৈরাচারী সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে পুলিশ আর আওয়ামী গুন্ডা বাহিনীর হত্যাযঞ্জে এই সবুজ শ্যামল বাংলায় রক্তের বন্যা বয়ে যায়। তবে সেনাবাহিনী এই হত্যাযজ্ঞে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। উনারা সাধারণ ছাত্র জনতার পাশে এসে দাঁড়ায়। এতো কিছুর পরেও স্বৈরাচার যখন আন্দোলন দমাতে পারলো না তখন ছাত্রজনতার কাছে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রক্তের উপর দাঁড়িয়ে এই সমঝোতার প্রস্তাব ছাত্র জনতা নাকচ করে দেয়। এবং এই স্বৈরাচারী সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস শেষ হবে না বলে ঘোষণা দেয়। যার ফলে ১ আগস্ট হয়ে যায় ৩২ জুলাই। ৩-৫ আগস্ট অর্থাৎ ৩৪-৩৬ জুলাই ব্যাপক হত্যাকান্ড ঘটে। সবচেয়ে বেশী হত্যাকান্ড ঘটে ৩৫শে জুলাই। তার মানে ৪টা আগস্ট রক্তের প্লাবন বয়ে যায়। মিরপুর,উত্তরা,যাত্রাবাড়ি থেকে শুরু করে ঢাকার প্রায় সব জায়গাতে পুলিশের গুলিতে প্রচুর মানুষ মারা যায়। পাশাপাশি কিছু পুলিশ ও আক্রোশের স্বীকার হয়ে মারা যায়। যার ফলে গনঅভ্যুত্থান ঘটে যায়। স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে। খু*নী হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়।

এরফলে মানুষ স্বৈরাচারের থেকে রেহাই ঠিকই পায় কিন্তু পুলিশ,প্রশাসনে স্থবিরতা নেমে আসে। দূর্নীতিগ্রস্ত অফিসাররা সব পালাতে থাকে। তবে এর মাঝে মাহফুজের কপাল খুলে। ওকে রংপুরেই আবার পদায়ন করা হয়। যদিও সময়টা খারাপ তারপরও মাহফুজ মানসিকদিক থেকে ভালো থাকে। আমার কলেজের প্রিন্সিপালও ওএসডি হয়ে যায়। তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ে ন্যস্ত করা হয়। আমার সংসারটা আবারও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করলো। কিন্তু চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এতো মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনি। কারণ আমি তো মিছিলে ছিলাম। দেখেছি কিভাবে ছোটো বাচ্চারা বন্দুকের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন আমার একটা কথাই মনে হলো দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলে মানুষের ভিতর থেকে মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়। চারিদিকে এতো চাটুকার,ক্ষমতার অপব্যবহারে মানুষ আর মানুষ থাকে না। অনাকাঙ্খিত এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের কারনে আমার ভিতরে ট্রমার সঞ্চার হয়। এমনকি আমি রাত্রে ঘুমাতে পর্যন্ত পারতাম না। আমার মানসিক অসুস্থতায় আব্বু আম্মু ঘাবড়ে যায়। শ্বশুর শাশুড়ীও চিন্তায় পড়ে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আমি তখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। ডাক্তার আমাকে নিয়ে মাহফুজকে দেশের বাইরে ঘুরতে যেতে বলে। এদিকে ক্যামব্রিজ থেকে আমার কাছে মেইল আসে। ক্লাস অক্টোবরের এক তারিখে শুরু হবে। এরমাঝে ভার্সিটির ডরমেটরীতে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। আমিও আর দেশে থাকতে চাইলাম না। নিজেকে কেমন যেন খুব ছোটো মনে হলো। হাসপাতালে প্রচুর মানুষ মৃত্যূর সাথে পাঞ্জা লড়ছে আর আমি স্বার্থপরের মতো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি। এরমাঝে আমি আমার বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন এমনকি কলিগদের সহযোগিতায় বেশ কিছু টাকা উঠিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের ডোনেট করি। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
আসলেই মানুষ বড় স্বার্থপর। নিজেকে বাঁচাতে কিংবা ভালো রাখতে আমি সেপ্টেম্বরের এক তারিখে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাই। মাহফুজও ছুটি নিয়ে আমার সাথে আসে। য
আমি আরো পরে আসতে পারতাম কিন্তু আমার অক্ষমতার কারনে আমি দেশে থাকতে পারলাম না। চোখের সামনে যখন ছোটো ছোটো বাচ্চা ছেলেগুলোকে হাসপাতালে মরে যেতে দেখি তখন ওদের জন্য কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা আমাকে অনেক পোড়ায়। আমার বোন সারাহ্ আর ভাই শাদাফও আন্দোলনের সাথে ছিলো। কিন্তু ওদের অবস্থা আমার মতো হয়নি। ওরা নিজেদের সামলে নিতে পেরেছে। আমি পারিনি। সারাহ্ বিয়েটা ডিসেম্বরে হওয়ার কথা ছিলো। আমার দেশের বাইরে চলে আসার কারনে আমাদের বাসায় ছোটো করে আকদএর অনুষ্ঠান করা হয়। আসলে এটা ছাড়া উপায় ছিলো না। সারাহ্ আর ওর বর কবির ভার্জিনিয়া ভার্সিটিতে পিএইচডির অফার পায়। ওরাও অক্টোবরের মাঝামাঝি আমেরিকায় পাড়ি জমাবে।
ক্যামব্রিজের ডরমেটরীতে আমার নতুন দাম্পত্য শুরু হলো। মাহফুজ একমাসের ছুটি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ম্যানেজ করে। সবার আগে ক্যামব্রিজের ভিতরটা ঘুরে দেখি। নিউটনের সেই বিখ্যাত আপেল গাছটাও দেখি। এরপর আমরা লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বের হই। ওখানকার রাস্তাঘাট বেশ পরিস্কার। মানুষগুলো খুব নিয়ম মেনে চলে। পার্কগুলো ছবির মতো সাজানো। কখনও বা টেমস নদীর তীরে আমি আর মাহফুজ হেঁটে বেড়াই। অবশ্য এখানে আসার সময় আব্বু আমার হাতে প্রায় তিনহাজার ডলার তুলে দেয়। আর আমি আমার কিছু গয়না বিক্রি করে আরো তিনহাজার ডলার যোগাড় করি। যার কারনে ঘুরাঘুরি করা আমার জন্য একটু সহজলভ্য হয়।
মাহফুজ একমাস পর দেশে চলে আসে। শুরু হয় আমার একলা জীবন। ভার্সিটির ক্লাস,অ্যাসাইনমেন্ট, পরীক্ষা এসব নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকি। আর ছুটির দিনগুলো মা বাবা শ্বশুর শাশুড়ী আত্মীয় স্বজনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলি। জানি, ন,মাস সময় দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। তারপর দেশে গিয়ে আবারও আমার আর মাহফুজের টক মিষ্টি ঝাল দাম্পত্য শুরু হবে। ততদিনে এই অভ্যূত্থানের ক্ষতটা হয়তো কিছুটা শুকোবে।

সমাপ্ত

বিঃদ্রঃ(গল্পটা কেমন লাগলো কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।)