দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-০৪

0
4

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

শাশুড়ী ঐদিন ঘুরে আসার পর বেশ ফুরফুরে। পরদিনই উনার বাপের বাড়ি চাঁদপুরে চলে যাওয়ার কথা। একদিন পরেই শুক্রবার। সেই কারনে আমি আর মাহফুজ যেতে বারণ করলাম। শুক্রবার ছুটির দিন থাকাতে মাহফুজ জেলা প্রশাসন থেকে গাড়ি রিকুইজিশন দিতে পারবে। শাশুড়ী মা ও স্বাচ্ছন্দে মাহফুজের সাথে চলে যেতে পারবেন। উনিও রাজী হলেন। তবে আমাকেও একটা বুদ্ধি দিলেন। আমি যেন বেশীদিন মাহফুজের এখানে না থাকি। পরীক্ষার সাতদিন আগে আমি যেন ঢাকায় আমার বাবার বাড়ি চলে যাই। তাহলে নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে পারবো। কারণ হিসাবে উনি যা বললেন তাতে আমি তব্দা খেয়ে গেলাম।
—-শোনো মেয়ে বিয়ের পর নতুন নতুন স্বামীদের প্রেম এতোই টইটম্বুর থাকে তখন যথেচ্ছা বৌকে বিলাতে থাকে। যদি ভেবে নাও এটাই ওদের আসল ভালোবাসা তাহলে মরেছো। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
আমারও জানবার খুব লোভ হলো। একটু আহ্লাদী ভঙ্গিতে শাশুড়ী মাকে বললাম,
—অভিজ্ঞতাটুকু কি আমাকে বলা যায়?
—-বলবো বলেই তো নিজ থেকে কথাটা উঠালাম। আমাকে তো দেখছো খুব সাদামাটা চেহারার মানুষ আমি। তোমার শ্বশুর বিয়ের সময় ছ,ফিটের মতো লম্বা বেশ ফর্সা মেদহীন ঝরঝরে ফিগারের মানুষ। আমাদের পারিবারিকভাবে দেখাশোনা করে বিয়ে হয়েছে। তবে বিয়ের পর স্বামীর রুপে মুগ্ধ আমি তার প্রেমে আপাদমস্তক পুরোটাই দেওয়ানা হয়ে গেলাম। তখন কেল্লাফতে। মানে আমার বাবা আমাদের তিনবোনের নামে ঢাকার উত্তরার দক্ষিনখানে তিন কাঠা করে ন,কাঠা জমি দিয়েছিলো। আমার বাকি দু,বোনের জমি এখনও আছে। আর তোমার শ্বশুর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে বললো,
“সালেহা ঢাকায় এই টুকুন জমি রেখে কি লাভ? তুমি বরং এই জমিটা বিক্রি করে কুমিল্লায় অনেক জমি কিনতে পারবা। ওখানে আমরা আমবাগান লিচুবাগান তৈরী করবো। আমাদের নাতি নাতনীরা এসে ঐ বাগান বাড়িতে ঘুরে বেড়াবে। একটা বাংলোবাড়িও তৈরী করবো। সবই তোমার শ্বশুর আমাকে করে দিয়েছে।
—তাহলে সমস্যা কোথায়?
—-করেছে তো সব উনার নামে। আমার নামে তো কিছুই নেই।
—-বাবার নামে থাকা আর আপনার নামে থাকা তো একই কথা।
—-শোনো মেয়ে, গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধনের কোনো মুল্য নাই। এই কথাটা মনে রেখো।
—কথাগুলো এ কারনেই বললাম,তোকে তো আমি বৌমা বা মেয়ে ভেবে নয়। একজন নারী হয়ে আর একজন নারীর কিভাবে ভালো হবে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা।
আমি আমার শাশুড়ী মায়ের কথা যতই শুনছি ততই অবাক হচ্ছি।
সেদিন রাতে ডিনার করে যখন মাহফুজের সাথে শুয়ে রোমান্টিক গল্প করছিলাম। তখন কথার ছলে ওকে বললাম,
—-আমি না একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
—বেবি নেওয়ার সিদ্ধান্ত?
—-জ্বীনা,এখন এসবকিছু ভাবছি না। আমার চাকরি হয়ে গেলে আমি একটা আলাদা একাউন্ট খুলবো।
—–কিন্তু কথা তো ছিলো আমাদের যৌথ একাউন্ট হবে।
—-হুম,কিন্তু মা বলেছে পরহস্তে ধন আর গ্রন্থগত বিদ্যার কোনো মুল্য নাই।
মাহফুজ একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—-তুমি আর কথা খুঁজে পেলেনা। রোমান্টিক মুহুর্তে কি ধরনের কথা বলতে হয় তাও শেখোনি? তা বলো শুনি, মা কি বলেছে?
—-বলেছে, আমি যেন মায়ের মতো তোমার প্রেমে গদগদ হয়ে না যাই। মা যেমন বাবার প্রেমে পাগল হয়ে নিজের জমিজমা সব বাবাকে দিয়ে দিয়েছে। আমি যেন সে কাজটা না করি।
—-যতটুকু জানি, তোমার বুদ্ধির তো কোনো ঘাটতি নেই। মা আবার তোমার কাছে ঘরের কথা ফাঁস করে উল্টোপাল্টা বুদ্ধি কেন দিচ্ছে বুঝতে পারছি না। মাকে তো উনার কথামতো ঠিকঠাকভাবেই ঘুরিয়ে আনলাম। কি জানি আমি মায়ের কোন বাড়াভাতে ছাই দিয়েছিলাম? ম্যালা বকবক করেছো। এবার ঘুমাও।

আমি মাহফুজের আচরনে বেশ বুঝতে পারলাম, ও আমার এসব কথায় মায়ের উপর বিরক্ত হয়েছে। তবে আমি খুব হ্যাপি। কারণ এই উপমহাদেশে সবচেয়ে স্পর্শ কাতর সম্পর্ক হচ্ছে শাশুড়ী বৌমা আর ননদ ভাবী। আমার ননসের যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে তাই আমি শাশুড়ী মায়ের সাথে সম্পর্কটা ইতিবাচক করার চেষ্টা করছি। যদিও আমার এ সম্পর্ক খুব বেশীদিনের নয় তারপরও মনে হচ্ছে আমরা দুজনেই পাশ করে গিয়েছি। বরং আমার শাশুড়ী মা আমার থেকে একটু বেশী নাম্বার পেয়ে এগিয়ে আছেন। আমি যদিও জেনেছিলাম, বিয়ে হলো কম্পিটিশন অব স্যাক্রিফাইস। কিন্তু এই প্রচলিত ধারাকে আমি ডিঙ্গাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার শাশুড়ী মা আগেই এ ধারাকে ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে থাকাতে আমার কাজটা অনেকটাই এগিয়ে রইলো। উনার চলে যাওয়া সময় হয়ে যাওয়াতে আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি বুঝতে পারছি, আমি উনাকে প্রচন্ডভাবে মিস করবো। আমি যখন পড়তে বসতাম মা ঠিক মনে করে চা বা কফি পাঠিয়ে দিতো। উনি এভাবে পাঠিয়ে দেওয়াতে একটু সংকোচ বোধ হতো তবে পাশাপাশি এক ধরনের ভালো লাগা আমার অন্তরে ছড়িয়ে পড়তো।

আমার শাশুড়ী মা চলে যাবার এক সপ্তাহ পরে আমিও ঢাকায় চলে আসি। কারণ পরীক্ষার আর সাতদিন বাকি আছে। আমি বাপের বাড়িতেই উঠলাম। ঐ সাতদিন কোনো দিকে না তাকিয়ে একরুমে বন্দী হয়ে পড়তে লাগলাম। আমি বরাবর সিরিয়াস স্টুডেন্ট ছিলাম। রেজাল্ট খুব ভালো ছিলো। প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় পজিশনে থাকতাম। যাইহোক আমার ভাইবা পরীক্ষা বেশ ভালোই হলো। শুনলাম দু,মাস পর রেজাল্ট দিবে। এই ফাঁকে আমি আবার ফেনী চলে যাই। শাশুড়ী মা থাকাতে তখন উনি রান্না করে খাইয়েছে। এখন তো আমাকেই করতে হবে। এরমাঝে কাজের খালা আবার অসুস্থ। শাশুড়ী মা ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন। আমি ঠিকমতো রান্না করতে পারছি কিনা? আমার রান্না হয়তো মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারবো কিন্তু পেয়াজ কুটতে খুব কষ্ট হয়। কুটার আগেই দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। শাশুড়ীমাকে জানানোর পর উনি একটা পরামর্শ দিলেন। সেটা হলো, মাহফুজ নাকি খুব ভালো পেয়াজ কাটতে পারে। উনি মাহফুজকে ঘরকন্নার কিছু কাজ শিখিয়েছেন। কারন উনার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর কিচেনে হেল্পিং হ্যান্ড হিসাবে উনি উনার দুই ছেলেকে কাজে লাগাতেন। উনার বড় ছেলে ভালো রাঁধতে পারে আর ছোটো ছেলে তরকারী আনাজ কুটা আর প্লেটবাসন সুন্দর করে ধুয়ে ফেলা। আমার শুনে বেশ ভালোই লাগলো। কারণ আমাদের বাসায় দাদী যতদিন বেঁচে ছিলেন আব্বা আম্মাকে সহজে কোনো কাজে সাহায্য করতেন না। কারণ দাদী দেখা মাত্রই বলতেন,” কিরে তুই আবার কবে থেকে স্ত্রৈণ হইলি?”কিন্তু সেক্ষেত্রে আমার শাশুড়ী অনেক উদার মানসিকতার মানুষ। তবে এক্ষেত্রে মাহফুজ একটু বিরক্ত হচ্ছে। কারণ ওকে এখন নিয়মিত পেয়াজ কাটতে হয়। পাশাপাশি প্লেট বাসনও ওকে ধুয়ে দিতে হচ্ছে। আসলে আমার ধএতে কোনো সমস্যা নাই। শুধু নখগুলো ক্ষয়ে যায়। এগুলো অবশ্য ওর অস্থায়ী কাজ। কাজের খালা সুস্থ হলে ওকে আর একাজ করতে হবে না। মাহফুজ অফিসে চলে গেলে আমি শাশুড়ী মায়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলি। সেদিনও উনি ফোন দিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-ফারাহ্ আজ কি রাঁধলে?
—–কাচকি মাছের চচ্চড়ি করোল্লা ভাজি ।
আমার শাশুড়ী অবাক হয়ে বললো,
—-কি সর্বনাশ! মাহফুজ তো এগুলো খেতে পারে না।
—-না,মা ও খুব পছন্দ করে এগুলো খায়।
—-হুম বুঝেছি, বৌয়ের হাতে সবই মজা লাগে।
আমাদের শাশুড়ী বৌমার কথা বলতে সেদিন দুটো বেজে যায়। ডোরবেল বাজাতে আমি দরজা খুলে দিলাম। মাহফুজ ভিডিও কলে শাশুড়ী মাকে দেখে বললো,
—-মা তুমি কেমন আছো?
—-ভালো, তবে ফারাহ্ র কাছে শুনলাম তুই এখন কাচকি চচ্চড়ি আর করোল্লার ভাজি নাকি খুব পছন্দ করে খাস? বিয়ের আগে তো তোকে কখনও খাওয়ানো যাইনি।
—-,মা,ফারাহ্ এতো মজা করে রান্না করে যে না খেয়ে পারা যায় না।
—-,হুম,নতুন বৌ বলে কথা! সবই মজা লাগে। ফোন রাখছি। তুই ফ্রেস হয়ে ভাত খেয়ে নে।

চলবে