দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-০৫

0
4

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব- পাঁচ
মাহবুবা বিথী

আমার রেজাল্ট হলো। অবশেষে আমি কোয়ালিফাই করলাম। মাহফুজ ভীষণ খুশী। পাশাপাশি আমার শ্বশুর শাশুড়ীও খুশী। আমার চাকরিটাকে সেলিব্রেট করার জন্য শ্বশুর শাশুড়ী কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে ছোটো খাটো একটা উৎসবের আয়োজন করলো। সেই উৎসবে যোগ দিতে আমি আর মাহফুজ ফেনী থেকে কুমিল্লায় রওয়ানা হলাম। জেলা প্রশাসন থেকে একটা গাড়ি মাহফুজ রিকুইজেশন দিয়েছিলো। আমাদের কুমিল্লা নামিয়ে আবার সেদিনই গাড়িটা ফেনীতে ব্যাক করলো। উইকেন্ডের দু,দিনই আমরা কুমিল্লায় থাকার প্লান করে এসেছি। যদিও শ্বশুর শাশুড়ীর এটা মনঃপুত হলো না। তবুও সামনে একসপ্তাহ ছুটি নিয়ে আবার আসবো এই কথা বলে উনাদের আশস্ত করলাম। আগামীকাল শুক্রবার বিধায় ঐ দিন উৎসবের দিন ধার্য করা হয়েছে। ঢাকা থেকে আমার ভাসুর আর জা তাদের দুটো বাচ্চা নিয়ে আজই চলে আসবেন। ননাসও পথেই আছেন। হয়ত আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। আপুরও দুটো বেবি। বড়টা ছেলে আর ছোটোটা মেয়ে।

আমার শ্বশুর বাড়িটাকে গ্রাম বলা ঠিক হবে না। কারণ কুমিল্লা সদরেই বাড়ি। বাংলোটাইপের বাড়ি। একদিকে লিচুবাগান,একদিকে আমবাগান একপাশে একটা। পুকুরও আছে। তাতে শানবাঁধানো ঘাটও আছে। পুকুরের চর্তুদিকে নারিকেল গাছ লাগানো রয়েছে। আমার কাছে ভীষণ ভালো লেগেছে। আমি আর মাহফুজ ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখানে পৌঁছাতে গোধুলি নেমে এসেছে। আসলে অফিসের কাছ সেরে বাসায় আসতে মাহফুজের বিকাল চারটা বেজেছে। আমি রেডীই ছিলাম। মাহফুজ এসে ঘরটা শুধু লক করলো। তারপরই গাড়িতে উঠলাম। আমি লক করে নেমে আসতে পারতাম। কিন্তু সারা রাস্তায় মনে হতো আমি মনে হয় ঘর লক করিনি। আর এতে আমার পুরো আনন্দটা মাটি হয়ে যেতো। অথচ আমি লক করেই বের হয়েছি। তারপরও আমার মনে হতে থাকবে, আমি লক করিনি। যাইহোক মাহফুজ লক করাতে আমি ফুরফুরে মেজাজে চলে এসেছি। শাশুড়ী মা বাগানে হাঁটতে বললেন। উনি চা করে আনছেন। আশেপাশের মানুষগুলো উঁকি ঝুঁকি মারছে। আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছে। তাই মাহফুজকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-ওরা এভাবে আমায় দেখছে কেন?
—-নতুন বউ দেখছে।
—-আমার বিয়ের তো পাঁচ মাস হয়ে গেল।
—-হুম,কিন্তু ওরাতো তোমাকে আজকে প্রথম দেখছে। ওদের কাছে তুমি আনকোরা, একদম নতুন।
—-আর তোমার কাছে,
—-আমি তো প্রতিমুহুর্তে তোমার রুপে মুগ্ধ হই। মনে হয় তোমার এই অবয়ব তো আগে দেখা হয়নি।
—+ও,বাবা সাহিত্য যেন ঝরে ঝরে পড়ছে।
এমন সময় বাড়ির অ্যাসিসটেন্ট চা নাস্তা এখন দিবে কিনা জানতে এলো। এদিকে মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। তাকে বলা হলো আমরা মাগরিব আদায় করে খাবো। আমি আর মাহফুজ ঘরে এসে মাগরিব আদায় করে নিলাম। এর মাঝে সদর দরজায় হুন্ডার শব্দ পেলাম। মনে হয় আপু চলে এসেছে। মাহফুজ গেট খুলে দেখলো, আপুই চলে এসেছে। আমিও কাছে গিয়ে আপুকে জড়িয়ে ধরে দুলাভাইয়ের সাথে কুশল বিনিময় করলাম। আপুর ছেলে জিসান আমাকে এসে সালাম দিয়ে বললো,
—-মামীমা কেমন আছো? চলো, আমরা ঘরে গিয়ে বসে গল্প করি।
—+হুম,ভালো আছি। তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?
আমি ওকে নিয়ে ঘরে এসে বসলাম। আমার পাশে বসে বললো,
—-এখন একটু ভালো চলছে। আসলে ভালো করে পড়াশোনা করা ছাড়া আমার তো উপায় নেই।
—-সবে তো ক্লাস ফোর এ পড়ো। এতো প্যারা নেওয়ার দরকার নেই।
—আগে মনোযোগ দিয়ে পড়তাম না। তবে মামার বিয়ের পর থেকে ভালো করে পড়াশোনা করছি।
—-তাই,
—–আম্মু বলেছে ভালো করে পড়াশোনা করে মামার মতো ম্যাজিস্টেট হতে পারলে তোমার মতো একটা বউ পাওয়া যাবে।
ওর কথা শুনে আমার খুব হাসি পেলো। কিন্তু হেসে ফেললে বেচারা লজ্জা পাবে। তাই হাসিটাকে চেপে রেখে ওকে বললাম,
—+তোমার বউ আমার থেকেও সুন্দর হবে।
—-কিন্তু আমার যে তোমাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
মনে মনে ভাবলাম কি দিনকাল পড়েছে। ক্লাস ফোর এ পড়া ছেলে এখনই বউয়ের কথা ভাবা শুরু করেছে। আর আপার মেয়ে জারা তো আর এক কাঠি সরেস। ও আমার পাশে বসলো। এরপর আমার চেহারাটা খুব নিঁখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। এরপর আমাকে বললো,
—-মামী,তুমি আমাকে একটু লিপিস্টিক দিয়ে দিবে?
—-ওকে,
আমি ব্যাগ থেকে লিপিস্টিক বের করে জারার ঠোঁটে লাগিয়ে দিলাম। অমনি সে আমাকে বলে বসলো,
—-তুমি কি সবসময় ব্যাগে লিপিস্টিক নিয়ে ঘুরে বেড়াও?
এতোটুকু মেয়ের কি কথারে বাবা? আমি ওকে সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললাম,
—-কেন?
—–আমার মনে হয় তুমি সবসময় সাজুগুজু করো মামার জন্য।
—-তোমার এ কথা মনে হবার কারণ।
—-সাজুগুজু করলে তোমাকে সুন্দর লাগে। আর মামাও তখন তোমার পিছু পিছু ঘোরে।
—-তোমার তাই মনে হয়?
—-হুম,কেননা আমি আব্বুকে দেখেছি যখন আম্মু খুব সাজুগুজু করে তখন আব্বুকে আম্মুর পিছু পিছু ঘুরতে দেখেছি। এমনকি ওরা দু,জন আমাকে তখন কেয়ার করে না। আমাকে নানা নানীর কাছে রেখে ঘুরতে বের হয়। আমার তখন খুব বিরক্ত লাগে।
মানে ওর কথা শুনে আমার চক্ষুচড়কগাছ। সবে তো মেয়ের বয়স পাঁচ বছর। এতেই এতো ইঁচড়ে পাকা। বাহিরে গাড়ির হর্ণের শব্দ পেলাম। মনে হয় ভাইয়া ভাবি চলে এসেছে। জারা আর জিসান দুজনেই ছুটে গেটের কাছে চলে গেল। ভাইয়ার আছে দুটো পিচ্চি। ওগুলো যে আবার কি ধাঁচের কে জানে? ভাবি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-কেমন আছো?
—-ভালো, আপনি কেমন আছেন?
—-ভালো আছি বলেই তো এতোটা পথ আসতে পেরেছি।
এরমাঝে শাশুড়ী মা আমাদের চা নাস্তা খেতে ডাকলেন। আমরা সবাই লিভিংরুমে গিয়ে বসলাম। চায়ের পর্ব শেষ হওয়ার পর আমার শাশুড়ী মা তার দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে কিচেনে ঢুকলেন। আগামীকাল এ বাড়িতে দাওয়াতের আয়োজন করা হয়েছে। উনি ডেজার্ট আর গরুর মাংস রাতেই রান্না করে রাখবেন। আমিও কিচেনে গিয়ে শাশুড়ী মাকে বলললাম,
—-মা, আমিও কিচেনে থাকি।
—-কেন,
—-আপনাকে হেল্প করার জন্য,
—-শোনো, অতি সন্ন্যাসিতে গাঁজন নষ্ট হয়। তুমি বরং ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। সবে তো নতুন বিয়ে হলো। পুরোটা জীবন কাজ করার জন্য পড়ে আছে।
বাচ্চাদের দেখে রাখার দায়িত্ব আমার জায়ের উপর দিলেন। আমি রুমে এসে খাটে বসে মোবাইল ক্রল করতে লাগলাম। এমন সময় আমার জা এসে বললো
—-হজ্জ করে আসার পর আমাদের শাশুড়ী মা অনেকটা ভালো হয়ে গেছেন।
আমি উনার কথা শুনে চোখ গোল করে উনার দিকে তাকালাম। আমার তাকানো দেখে উনি আবারও বলে উঠলেন,
—-বিশ্বাস হচ্ছে নাতো! শোনো, তোমার বিয়ে হয়েছে পাঁচমাস তারপরও বলছেন নতুন বিয়ে হয়েছে। আর আমার বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে কিচেনে ঢুকিয়ে বলেছিলেন,”এখন থেকে এই হেঁসেল তোমাকে সামলাতে হবে।” আমার তখন বয়স কতো কম। আমি যা রান্না করতাম সব কিছুর কঠোর সমালোচনা করতো। তোমাকে তো উনি চাকরি করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। আর আমাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন। তোমাকে তো দশভরি গোল্ড দিয়েছেন। আর আমাকে পাঁচ ভরি দিয়েছিলেন। তার অর্ধেকটা আবার খাদে ভরা ছিলো।

উনাদের সবার কথাশুনে আমার মাথাটা যেন হ্যাঙ হয়ে গেল। তবে শাশুড়ী মায়ের একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগলো। উনি উনার ছেলেদের নিয়ে কিচেনে ঢুকলেন। অথচ আমাদের বাসায় দাদীকে সারাজীবন দেখেছি ছেলেদেরকে উনি কোনো সাংসারিক কাজ করতে দিবেন না। সব কাজ বৌদের দিয়ে করাবেন। আর আমার শাশুড়ী মা উনার প্রতিটি কাজে ছেলেদের সাথে নেন। সেটা ঘর কন্নার কাজ হোক কিংবা বাজার সদাই।

পরদিন সকালে মাহফুজের ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। ও আমাকে ডেকে বললো,
—-ফারাহ্ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো। তোমাকে অনেকে দেখতে আসছেন।
মাহফুজের ডাকে আসলে আমি প্রথমে কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম। আমি আসলে কোথায় সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। ফেনীতে না ঢাকায় সেটা নিয়ে ভাবছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার হুঁশ ফিরলো। মাহফুজ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—যাও না লক্ষিটি মুখ ধুয়ে রেডী হয়ে বাইরে আসো। দাদী এসেছেন তোমায় দেখতে।
—-মানে কি? দাদী কি আমায় দেখতে কবর থেকে উঠে এসেছেন?
—-কি সব বলছো? কেউ শুনলে কি ভাববে বলতো?
—-তুমি ওভাবে ডাক দেওয়াতে আমার এখন মাথা ব্যথা করছে।
—-সরি,আসলে এ ছাড়া উপায় ছিলো না। আব্বার চাচী মানে আমাদের দাদী তোমাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে মাকে গিয়ে বলছিলেন?
—-কি বলছিলেন?
—-বলছিলেন, যেখানে সবাই কাজ করছে আর তুমি রাজরানির মতো বিছানায় শুয়ে আছো। এভাবে লাই দিলে তুমি নাকি আম্মুর মাথার চুল ছিঁড়বে।
—-তুমি কিছু বললেন না?
—-আমি কি বলবো? উল্টা আমাকে বললো,দেখে শুনে এমন মেয়ে আমি এনেছি, সারাজীবন আমাকে তোমার গোলামী করে যেতে হবে।

চলবে