দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-০৯

0
2

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব–নয়
মাহবুবা বিথী

জ্বর থাকায় আজ আর কলেজে যাইনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা বারোটা বাজে। পর্দা সরিয়ে বাইরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ ধোয়াশা হয়ে আছে। কুয়াশার কারনে এমনটা হয়েছে। বিছানা থেকে উঠতে মন চাইছে না। জানি,তারপরও আমাকেই উঠতে হবে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। একটু চা খেলে মনে হয় ভাল লাগবে। জ্বরের কারনে ফজরের নামাজও ক্বাজা হয়েছে। নিজেকে একরকম জোর করেই বিছানা থেকে উঠালাম। একা থাকা আসলেই অনেক কষ্টের। ইলেকট্রিক কেটলিটা অন করে দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে লাগলাম। পানিটা গরম হওয়া মাত্রই মগে ঢেলে মুখটা ধুয়ে ফেললাম। এরপর কেটলিতে চায়ের পাতা ছেড়ে দিলাম। দুধ আর চিনি মিশিয়ে ছাকনি দিয়ে ছেকে চাটা মগে ঢেলে নিলাম। ইলেকট্রিক চুলা অন করে ফ্রাইপেন বসিয়ে দিলাম। ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন পরোটা বের করে ফ্রাইপেনে তেল দিয়ে ভেজে নিলাম। আমার গরম গরম চা আর পরোটা ভীষণ প্রিয়। চা আর পরোটা খাওয়া মাত্রই রুমের লাগোয়া বারান্দাতে যেন একটু সুর্যের আলো উঁকি দিলো। মনে হলো সুর্যটা যেন আমার উঠার অপেক্ষায় ছিলো। বারান্দায় গিয়ে রকিং চেয়ারটায় বসে একটু রোদ পোহানোর চেষ্টা করলাম। বারান্দার সামনে একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে। সেখানে আমার মতো চড়ুই পাখিটা রোদ পোহাচ্ছে। তবে ও আমার মতো একা নয়। সঙ্গিনীটি সাথে আছে।মাঝে মাঝে চঞ্চু দিয়ে সাথীর পালকগুলো নাড়িয়ে দিচ্ছে।

জানুয়ারী মাস পর্যন্ত রংপুরে ভালোই শীত থাকে।এসময় প্রকৃতিও অনেকটা জবুথবু হয়ে থাকে। প্রচন্ড শীতে যেন গাছের পাতাগুলো কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যায়। ভাবছি, আমার জীবন তরীটা সংসার সমুদ্রে কিছুটা অপূর্ণতা নিয়ে বয়ে চলছে। যদিও আমার আর মাহফুজের দু,জনের সেটেলড চাকরি হয়েছে। ও মাসে দু,বার রংপুরে আসে। আমার রংপুর থেকে ফেনীতে যাওয়া হয় না। তবে ও বর্তমানে চেষ্টা করছে আমাকে ফেনীতে নিয়ে যাওয়ার। কিংবা ও রংপুরে পোস্টিং নিয়ে চলে আসবে। আসলে এক জীবনে সব কিছু পাওয়া যায় না। এটাই জীবনের বাস্তবতা। বিয়ে করলাম, সেটেলড চাকরি হলো কিন্তু দু,জনে মিলে একসাথে সংসার করতে পারছি না। দু,জনকে দু,জায়গায় থাকতে হচ্ছে। বাস্তবতার তাগিদে মেনে নিয়েছি। যদিও ওর সাথে আমার রিলেশনের বিয়ে তবুও বিয়ে করে এক ছাদের নীচে থাকা আর রেস্টুরেন্ট কিংবা পার্কে বসে প্রেম করা এক কথা নয়।আমার অবশ্য প্রেম করার সে রকম সুযোগ হয়ে উঠেনি। সবসময় আম্মুর গোয়েন্দা নজরে থেকেছি। তাই আমার প্রেম করার সাধ এখনও মেটেনি। ভেবেছিলাম বিয়ের পর চুটিয়ে ওর সাথে প্রেম করবো। সে সুযোগটাও এখন পাচ্ছি না।
বেশ ঠান্ডা লেগেছে আমার। রংপুরে এই এক সমস্যা। অসম্ভব ঠান্ডা পরে। যদিও শাশুড়ী মায়ের ধারনা আমি খুব পানি ঘাটাঘাটি করি। আমিও উনার মুখে এ কথা শুনে খুব অবাক হয়েছি। উনি তো আমার সাথে থাকেন না। কিভাবে জানলেন? কৌতূহল বশত উনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি আমাকে বললেন,”যখনি তোমাকে ভিডিও কলে ফোন দেই তখনি তোমাকে কিচেনে কাজ করতে দেখি। একটা প্লেট ভিম লিকুইড দিয়ে মেজে তুমি কলের নীচে ধুতেই থাকো। সেই টিভির বিজ্ঞাপনের লাইফবয় হ্যান্ডওয়াশের ছেলেটার মতো। এই শীতের সময় এভাবে পানি ঘাটলে ঠান্ডা না লেগে উপায় আছে? আমার একবউ তো কোনো কিছু না ধুতে পারলেই বাঁচে। আর আর এক বউ ধুতে ধুতে ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলে।”
মায়ের কথায় আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। এই অল্প ক,দিনে মা আমাকে ভালোই চিনেছে। আসলেই আমার পানি ঘাটার বাতিক আছে। আজ রাতে মাহফুজের আসার কথা। আমার ঠান্ডা লেগেছে বলে হাফ অফিস করে ডিসি স্যারের কাছে ছুটি নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে। আমিও আজ ছুটি নিয়েছি। বৃহস্পতিবার থাকায় ছুটি নেওয়াতে ভালোই হলো। পরপর তিনদিন ছুটিতে শরীরটা সামলে উঠবে। ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি আপু ফোন দিয়েছে। আমার একমাত্র ননস রোদেলা আপু। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আপু বলে উঠলো,
—আসসালামু আলাইকুম। ফারাহ্ কেমন আছো?
—আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছি আপু। তুমি কেমন আছো? জারা আর জিসান কেমন আছে?
—-আর বলো না। ওরা দু,জন মিলে আমায় জ্বালিয়ে মারলো। জারা তো সারাদিন হিন্দী নাচ নেচে বেড়ায়। নিষেধ করলে বলে, ও নাকি ইউটিউবার হবে। আর জিসান আমার সাথে সারাদিন চোর পুলিশ খেলে। কিসের মধ্যে যে আছি তোমাকে কি করে বুঝাই?
—আপু, সব ঠিক হয়ে যাবে। জারার বয়স মাত্র চার বছর। ও এখন কিছু বুঝে না।
—-বুঝে না আবার কি? দেখোনা বলছে ইউটিউবার হবে। যে এখন পড়ালেখার প’টাই বুঝতে পারলো না সে নাকি হবে ইউটিউবার। আর জিসান,ওর জন্য আমার মোবাইলটা তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। যার জন্য তোমরা ফোন দিলে আমাকে পাও না আর আমিও ফোন দিতে পারি না। হাতে পেলেই হলো দিন দুনিয়ার কোনো খবর নাই। সারাদিন গেইম খেলে। শাসন করতে গেলে আব্বু আম্মুর কাছে ফোন দিয়ে বলে, আমি নাকি ওকে মারতে মারতে মেরেই ফেলবো। আব্বু আম্মু ওর কথা শুনে দৌড়ে আমার বাসায় ছুটে আসে। ওর সামনেই আমাকে বকাবকি করে। আমারও মাথা গরম হয়ে যায়। আব্বু আম্মুর সাথে তর্ক করি। উনারাও রাগ করে বাসা থেকে চলে যান। আর এদিকে জিসান আমাকে মানতে চায় না। জানো, নিজের জীবন দিয়ে একটা শিক্ষা হয়েছে। বিয়ের পর বাবা মায়ের কাছ থেকে মেয়েদের দূরে থাকাই ভালো। এতে দু,জনের জন্যই মঙ্গল। আর জিসানের কারনে মোবাইল তালাবন্ধ করে রাখি। এতেও আব্বু আম্মু অভিমান করে। আমি নাকি ইচ্ছে করেই আব্বু আম্মুর ফোন রিসিভ করি না। আসলে কি জানো,আমি ছোটোবেলায় আম্মুকে অনেক জ্বালাতাম। তখন আম্মু বলতো, আমাকে যতটা জ্বালাচ্ছিস তোর পেটেরগুলো তোকে এর থেকে বেশী জ্বালাবে। এখন দেখছি আমার কপালে তাই হয়েছে।
আপু কথা বলতে বলতে থেমে গেল। উনার গলাটা কেমন যেন মনে হলো। আপু মনে হয় কাঁদছে। কি বলবো বুঝে পাচ্ছি না। আমার শ্বশুর বাড়িতে সবাইকে দেখি অল্পতেই চোখ দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় পানি পড়ে। মনে হয় চোখের কোনায় পানির ট্যাংকি ফিট করে রেখেছে। আমার শাশুড়ি মাও অল্পতেই কেঁদে ফেলেন। সেক্ষেত্রে আমার মা খুব শক্ত ধাঁচের মহিলা। উনার চোখ দিয়ে আমি কোনোদিন পানি পড়তে দেখিনী। তবে এ ক্ষেত্রে আম্মুর লজিক হচ্ছে, ” চোখের পানি অত্যন্ত মুল্যবান জিনিস। তাই ওকে যত্র তত্র ফেলতে নেই। শুধু নিজের একান্ত গোপনে পাপের অনুশোচনায় আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চেয়ে ফেলতে হয়। বান্দার চোখের পানি আল্লাহপাকের অতি প্রিয় বস্তু। তারপরও আপুকে সান্তনা দিয়ে বললাম,
—-আপু এতো চাপ নিয়েন না। ওরা তো এখন ছোটো আছে। দেখবেন একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।
—-কি জানি! আমার বাচ্চাদের জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করো। এখন রাখি।
আসলে প্যারেন্টিং অনেক বড় ব্যাপার। আমি আমার বাবা মায়ের বড় সন্তান। যার কারনে শাসন এবং আদর দুটোই অনেক বেশী পেয়েছি। আমিও অনেক দুষ্ট ছিলাম। জারার মতো সারাদিন হিন্দী নাচ নেচে বেড়াতাম। সাজুগুজু করতাম। অবশ্য এসবের জন্য কখনও মার খাইনি। আমি মার খেয়েছি পড়াশোনা আর খাওয়া দাওয়ার জন্য। খেতে চাইতাম না। প্রচুর খাবার নষ্ট করতাম। সে কারনে আম্মু পিটুনী দিতো। আর ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে আম্মুর একটাই কথা ছিলো ” তোমাকে আগে একজন ভালো মানুষ হতে হবে আর পড়াশোনাটাও এমনভাবে করতে হবে যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারো। আর সেটা যদি না পারো তাহলে নরমাল গ্রাজুয়েশন করে বিয়ে করে সংসারের পাঠ শুরু করতে হবে।”
আম্মুর এই কথার জন্য আমি ছোটোবেলা থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করতাম। আম্মুকে সারাদিন সংসারের কাজ করতে দেখে আমার তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছে নাই। কাজ করার থেকে আমার কাছে পড়াশোনাটাকে শ্রেয় মনে হয়েছে। এজন্য ক্লাসে আমি এক দুই কিংবা তিনের মধ্যে থাকতাম। অবশ্য আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে আমরা তিনভাইবোন স্টুডেন্ট হিসাবে বেশ মেধাবী ছিলাম।
তবে আম্মু যেদিন শাসন করতো সেদিন অবশ্য আমার মজাই হতো। আম্মু স্কুল ছুটির পর বুমার্সে নিয়ে যেত। আমি ভিকারুন্নেছার মেইন শাখাতে পড়তাম। বেলী রোডে বুমার্সের একটা শাখা ছিলো। ওখানে লাঞ্চ পিরিয়ডে বুফে ছিলো। আমি ইচ্ছে মতো খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। বিয়ের আগে আমার একটাই কাজ ছিলো ভালো করে পড়াশোনা করা। এটা দেখে দাদী মাঝে মাঝে আম্মুকে বলতো,
“মেয়ে সন্তানদের সংসারের কাজকর্ম শেখাতে হয়। তোমার মেয়ে যতবড়ই বিদ্যার জাহাজ হোক না কেন দিনশেষে তাকে হাড়িই ঠেলতে হবে আর পরের বাড়িতে সংসার করতে যেতে হবে।” দাদীর এ কথার উত্তরে আম্মু বলতো,
“পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে জ্ঞান অর্জন করা। কারণ জ্ঞান টাকে পড়ার সাথে সাথে নিজের আত্মার মাঝে আত্মস্থ করতে হয়। সেটা অনেক সাধনার বিষয়। তবে জ্ঞান যদি আপনার নাতনী ধারণ এবং লালন করতে পারে তাহলে জগতের সব কাজই তার জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই পড়াশোনাটাই ঠিক মতো করুক।”
আজ মনে হয় আম্মুর কথাটা ভুল নয়। আমি তো এখন সব কাজই করে নিতে পারি। অনভ্যস্তর কারনে একটু দেরী হয়। কিন্তু করে নিতে পারি।
আর আমাদের বাসায় মোবাইল সবসময় আম্মুর কাছেই থাকতো। আম্মু আলমারীতে তালাবদ্ধ করে রাখতো। বাসায় ল্যান্ড ফোন ছিলো। আমরা সবাই ল্যান্ড ফোনেই কথা বলতাম। আমাদের বাসায় পিসি তে বসার সুযোগ ছিলো না। কারন ল্যাপটপ ছিলো। কিন্তু ডেক্সটপ ছিলো না। সেই ল্যাপটপও আম্মুর হেফাজতে থাকতো। সেই কারনে ফেসবুকও চালাতে পারতাম না। তবে বার্ষিক পরীক্ষার পর পনেরোদিনের জন্য পাওয়া যেতো। তখন চুটিয়ে মুভি দেখতাম। আর প্রচুর গল্পের বই পড়তাম। যোহরের আযান শোনা যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে নামাজ আদায় করে নিলাম। আজ অবশ্য দুপুরে কিছু রান্না করবো না। বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করবো। আজ কেন যেন আমার অতীত ভাবনায় পেয়ে বসেছে। মাঝে মাঝে মানুষের ফেলে আসা উঠোনটায় হাঁটতে ইচ্ছে হয়।

চলবে