দুই দুয়ারী পর্ব-০১

0
376

#দুই দুয়ারী

পর্ব ১

ঈদের ছুটিতে আব্বা আম্মার দাদু বাড়িতে আসাটা চিরকালের রুটিন, যতদুর পর্যন্ত আমি মনে করতে পারি, হয় রোজার নাহয় কোরবানির, যেকোন একটা ঈদ আমরা এখানে করি। ওই যে লোকে বলেনা, ঈদে ঢাকা শহর খালি হয়ে যায়? কারণ ঢাকা শহরে জীবিকার টানে আসা মাননুষেরা সব গ্রামে বা মফস্বলে চলে যায়? আমরা সেই চলে যাওয়া মানুষদের একাংশ।

ছোটবেলায় গা করতাম না, ব্যাগ গুছিয়ে ঈদের আগে আগে বাড়ি রওয়ানা হতে ভালোই লাগতো, বরং এক ধরণের উত্তেজনাই বোধ করতাম। এখন আমার এসব আর ভালো লাগেনা, কেউ ” বাড়ি” কোথায় জিজ্ঞাসা করলে রেগে যাই। বাড়ি কোথায় আবার কি? এই যে ঢাকা শহরে থাকছি, খাচ্ছি, পড়ছি এটাই তো বাড়ি! আলাদা করে গ্রামের বাড়ি, দেশের বাড়ি এসব কেমন কথা?

এবার আসার আগেও বাবার সাথে রীতিমতো ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছিলাম। নতুন পাঞ্জাবী পরে বন্ধুদের সাথে ঈদগাহ যাব নামাজ পড়তে, সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরবো, ধানমন্ডি লেকে গিয়ে মেয়ে দেখে বেড়াবো, তা নয়, দাদার বাড়ি এসে বসে থাকতে হবে। বাবা রাগ করে বলেছিলেন, আরো বড় হও, বিয়ে শাদী করো, তখন আর আমাদের সাথে কোথাও যেতে হবেনা। এখনো ছোট তুমি, তোমাকে একা ঘরে এতদিন রেখে কোথাও যাবোনা।

আসতেই হলো শেষ পর্যন্ত। আমার বয়স বাইশ, আমি মোটামুটি অপদার্থ একজন মানুষ। ম্যাট্রিক ইন্টারমিডিয়েতে গড়পরতা ফলাফল, বাপের টাকার শ্রাদ্ধ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, জীবনে একটিও টিউশনি জোগাড় না করতে পেরে যখন তখন মার কাছে টাকা চাওয়া, এই সবগুলি বিশেষ গুন আমার মধ্যে রয়েছে। আর গোপনে আরেকটা দুঃখ, এসব কিছুই না পেরেও যদি একটা প্রেম করতে পারতাম, নিজেকে একটুও অপদার্থ মনে হতোনা আর। তাও পারিনি এখন পর্যন্ত।

আগামীকাল ঈদ, বাড়ি জুড়ে ব্যস্ততা। আম্মা, আমার দুই চাচী আর দাদি রান্না নিয়ে আছেন সকাল থেকে। হ্যাঁ সত্যি আমার দাদা এই মফস্বল শহরের গুটিকয়েক গুরুত্বপূর্ণ লোকদের একজন, রাজনৈতিকভাবে উনি বেশ প্রভাবশালী । ঈদের দিন মোটামুটি লোকজন আসে, খাওয়া দাওয়া করে, পরে লম্বা সময় ধরে বাড়ির সামনে বসে গল্প ও করে। আমাকে এগুলি এখন আর টানেনা, আমি শুয়ে শুয়ে শুধু মোবাইলে এটা সেটা দেখি আর বন্ধুদের মেসেজ দেই।

” জালাল মিয়ার হোটেলের নাম শুনেছিস?” চাচাতো ভাই রায়হান পাশে বসে বলল, ” এই ছোট, গ্রামের মত শহরের মধ্যে হোটেলের ব্যবসা এতো ভালো চলে ভাবতে পারিস? ”

আমার আরেক চাচার ছেলে রনি, সে মন খারাপ করে বললো, ” আমার খুব খাইতে ইচ্ছা করে। বাসায় এতো রান্না রাইখা এখন গেলে পিটানি খাইতে হবে “।

জালাল সাহেব আঞ্চলিক লোক নন , বছর তিনেক আগে অন্য কোথাও থেকে এসে বিশাল একটা মুদি দোকান চালাতে শুরু করেন । সেই দোকান বেশ নাম করেছিল, তারপর কিছুদিন আগে আবার কি ভেবে
” জালাল মিয়ার ভাতের হোটেল” দিয়ে বসেন।

উনি ভুল করেননি, মানুষ জন শুনি ইদানিং টাকা হাতে পেলেই তার হোটেলে খেতে যায়। উনি সবসময় প্রকাশ্যেই বলেন, হোটেলের বেশিরভাগ রান্না এই বয়সেও তার মা ই করেন, নিজ হাতে না করলেও অন্তত পরিচালনা করেন। উনার মায়ের রান্নার রেসিপি এখন বহুল প্রশংসিত, লোকে কোনোরকম উৎসব হলেই উনাকে রেঁধে দিতে বলে শুনেছি।। সেই বিদ্যা তিনি শিখাচ্ছেন পুত্র বধূকেও, তিনজন মিলে ভালোই চলছে হোটেল।

বাড়িতে সেমাই আর পায়েস রান্নার গন্ধে আমারো মাথা ধরেছিলো, আমি বললাম, ” চল যাই। কে দেখবে? ”

দুজনের চোখ চকচক করে উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে, ওরাও আমার মতোই বাধ্য হয়ে এসেছে গ্রামে, সুতরাং তিন ভাই মিলে ভর দুপুরে রওয়ানা হলাম জালাল মিয়ার ভাতের হোটেলে।

***

দুপুরের কড়া রোদ মাথার উপরে, এক রিক্সায় তিনজন গাদাগাড়ি করে বসে যখন হোটেলে পৌছালাম তখন বেলা তিনটা, খুধায় পেট চো চো করছে। খুবই ছোট একটা একতলা হোটেল, দুপুরের খাওয়ার পর্ব মনে হয় শেষ, আমরা ছাড়া তেমন কেউ নেই তখন। জালাল সাহেব আমাদের দেখে চিনতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত, হৈ হৈ করতে লাগলেন অকারণে।

” আমরা ত্রিশ জনের বেশি তো রান্না করিনা, এখন তো পাতিলের তলার গুলা পইরা আসে, খাটাস সব এখানের লোকজন, সব খাইয়া শেষ করছে, কেন তোগো বাসায় কি রান্না হয়না? ”

আমরা মজা পেয়ে হাসছি তিনজন। পাতিলের তলায় পরে থাকা বললেও পাঙ্গাস মাছের ঝোলের মধ্যে ভাসতে থাকা কাঁচা মরিচ খেয়ে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, মহিলার হাতে সত্যিই জাদু আছে। ডালের মধ্যে আস্ত ঢেঁড়স দিয়ে কি একটা রান্না করেছে, যেই আমি বাড়িতে ঢেঁড়স দেখলে টেবিল ছেড়ে উঠে যাই, সেই আমিও চেটে পুটে খেলাম।

খাওয়া শেষে দেখা গেল মিষ্টি কিছু নেই, জালাল সাহেবের মা নিজের হাতে মাটির পাতিলে দই পাতেন , তার আর একটুও নাকি বাকি নেই। আমরা বললাম, অসুবিধা নেই, পেট এমনিই ভরা কিন্তু জালাল সাহেব চুক চুক করে আফসোস করতেই থাকলেন।

সেই সময় উনার স্ত্রীর দেখা মিলল, সুতির শাড়িতে আধা হাত লম্বা ঘোমটা মাথায় দিয়ে উনি বের হয়ে আসলেন। আমি দেখলাম, উনার হাতে ছোট একটা মাটির বাটি, রীতিমতো আঁচলে লুকিয়ে নিয়ে এসেছেন। আমাদের সবাইকে অবাক করে তিনি দাঁড়ালেন আমার সামনে, ফিসফিস করে বললেন, এই একটুই আছে, তুমি খাও। আম্মা খুব খুশি হইতেন ।

আমি খুবই অবাক হলাম, জালাল সাহেবের মায়ের সাথে আমার কোনোদিন দেখা হয়নি, বছরে একবার এখানে আসি, বড়জোড় এক সপ্তাহ থাকি। আমার এতো সময় কোথায়?

” আমি খেলে খুশি হবে? ” আমি না বলে পারলাম না।

” ওই তো। ওইরকম ই করে। দুইটা বাচ্চারে ফালাইয়া একজনরে খাওয়ানোর শখ হইসে তার” জালাল সাহেব রাগ করে বললেন, ” আর তুমিও। উনি বললেন আর মাথা উচা কইরা হাজির হইলা ”

উনার স্ত্রী অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ” খুব কানতেসে। আমি কি করতাম? ”

ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মাথাটা হঠাৎ ই একটু ঘুরে উঠল, এক পলকের জন্য মনে হলো শূন্যে ভাসছি। চারদিকে কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু শূন্যতা। কয়েকটা সেকেন্ড বোধহয়, হুট্ করেই সব ঠিক হয়ে গেল আবার।

আমিই আবার বললাম, ” কানতেসে কেন? ”

” বলতে পারবোনা। উঁকি দিয়া একবার দেখলো তোমরা খাইতেস, তারপর থেকে কাঁন্দন শুরু। আমারে বললো, একটু মিষ্টি না দিয়া ওরে যাইতে দিসনা ”

আমার শরীর আবার ঝিমঝিম করে উঠল, আমি রনির ঘাড়ের উপর হাত রেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম, কেন যেন মনে হচ্ছিলো, আমি হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারবোনা। গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, ” একবার ওনার সাথে দেখা করে যাই? ” বললাম।

জালাল হঠাৎ হড়বড় করে বললেন, ” হইছে এখন যাও তোমরা। বাসায় চিন্তা করবো “।

যদিও বলেছিলাম দেখা করতে চাই, তার এই কথায় কেন জানিনা আমার বেশ স্বস্তি হলো। চেপে রাখা নিঃশ্বাস শব্দ করে ছেড়ে বললাম, চল বিল দিয়ে বাড়ি যাই।

উনি আবারো হৈ হৈ করে বললেন, ” না না। নজরুল সাহেবের নাতিদের থেকে টাকা নিতে পারবোনা। গ্রামে থাকতে হবে তো। হেহে ”

***

হেঁটে হেঁটে যখন ফিরছি, আমি খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। তখন ওরকম মাথা ঘুরে উঠল কেন ভাবছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিলো, কিছু একটা মনে পরি পরি করেও মনে পরছেনা, খুব জরুরী, খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি যেন। কিন্তু সেটা কি? ওরা দুই একবার কথা বলার চেষ্টা করে হাল ছেড়েছে ইতিমধ্যে।

হঠাৎ আমার মনে পরল। তীব্রভাবেই মনে পরল। মুখের ভেতর এখনো লেগে থাকা দইয়ের স্বাদটা আমার খুব পরিচিত, মনে হচ্ছে গতকাল ই যেন খেয়েছি! কিন্তু কিভাবে সম্ভব? মধু দিয়ে যে দই হয় এটাই তো জানতাম না এই কিছুক্ষন আগেও? তাহলে এই ডেজা ভু হচ্ছে কেন?

আমার থমকে যাওয়ায় ওরাও থেমে গেছে, আমি বললাম, আচ্ছা, এখানে আর এসেছি আমরা আগে?

ওরা জানালো, ওরা আসেনি, আমার ব্যাপারে নিশ্চিত না। একটু হাসাহাসিও করলো দুজন, দইয়ের স্বাদ কি এমন জরুরি ওরা বুঝতে পারছেনা। বুঝতে পারছেনা, কারণ আমি বুঝাতে পারছিনা। এতো তীব্রভাবে আমি অনুভব করছি যা কাউকেই বলে বুঝানো যাবেনা। তার চেয়েও বড় কথা আমার কোন কারণ ছাড়াই ইচ্ছে করছে উল্টোদিকে ঘুরে আবার সেখানে যাই। কেন ইচ্ছে করছে তাও জানিনা।

বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে আমার ঘোর আরো বাড়তে থাকল। একসময় খেয়াল করলাম, আমি কারো কথা শুনছিনা, প্রশ্ন করলে জবাব দিচ্ছিনা। আবছাভাবে একবার মনে হল, মা কাঁদছে, আমাকে কি না কি খাইয়ে এনেছে, তাই দুষছে আমার ভাইদের। আমি ভাবনার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম, ক্রমশঃ ডুবেই যাচ্ছিলাম একপ্রকার। এতো পরিচিত? এতো পরিচিত কেন?

রাতে বিছানায় কিছুক্ষন শুয়ে থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম একবার। আমরা যখন চলে আসছি, আমার পিঠের উপর পরিষ্কারভাবে কারো দৃষ্টি অনুভব করেছিলাম, মহিলা যে উঁকি দিয়ে আমাদের দেখছিলেন তখনও , আমি তার শাড়ির একাংশ দেখেছি। নীল রঙের জংলা ছাপার একটা শাড়ি। কি আশ্চর্য! আমি কখন শাড়ির রং খেয়াল করলাম? আসলেই কি খেয়াল করেছি? নাকি কল্পনা করছি? কেন যেন মনে হচ্ছে এই যে আমি শুয়ে আছি, উনি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর এটা কোন কল্পনা না, সত্যিই ঘটছে এমন মনে হচ্ছিলো। আমি আছন্ন হয়ে পরলাম।

শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম হয়ত, ঘুমের ঘোরে টের পেলাম, কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আমার, সেই হাত ভর্তি মেহেদির সুবাস। কে? কে? চিৎকার করতে গিয়েও করলাম না। আমার ভীষণ ভালো লাগছিলো।

***

নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম দাদা, বাবা চাচা আর চাচাতো ভাইদের সাথে, রীতিমতো তিন প্রজন্ম একসাথে। মসজিদ বেশ দূরে হলেও দাদা সবসময় হেঁটে যান, সম্ভবত পথে মানুষের সালাম পেতে তার ভালো লাগে বলে। উনার বয়স পচাত্তরের কাছাকাছি কিন্তু যথেষ্ট শক্ত সমর্থ আছেন এখনো। আমরা হাঁটতে ক্লান্ত হই, উনি হন না।

আমার স্পষ্ট মনে আছে ঈদের নামাজের বিভিন্নতা নিয়ে আমরা তিন ভাই একটু হাসাহাসি করছিলাম, বছরের পর বছর পড়ার পরেও কেন যেন প্রতিবারই কেউ না কেউ ভুল করেই বসে। কিন্তু এরপরের ঘটনা আমার কাছে ঝাঁপসা।

আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম অচেনা একটা বাড়ির সামনে, সাথে কেউ নেই, একা দাঁড়িয়ে আছি বোকার মত। দুই এক মিনিট গেলো মনে করার চেষ্টা করতে, তারপর প্রচন্ড ভয় আমার মাথা থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নেমে গেল। কারণ এই বাড়ি কার আমি জানিনা। কিভাবে কেন এখানে এলাম তাও জানিনা। আমার প্রচন্ড পানির তৃষ্ণা হতে লাগল।

বাড়িটির দরজা খুলে গেল হঠাৎ, জালাল সাহেবকে বের হয়ে আসতে দেখে একটু স্বস্তি বোধ করলাম, অন্ততঃ একটা পরিচিত মুখ! হয়ত তিনি আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবেন, নিদেনপক্ষে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি যদি…

” আপনি আবার এখানে ” উনি বললেন, আপনি শব্দটা বাজল কানে, যতদূর মনে পরে গতকাল তুমি করেই সম্বোধন করেছিলেন, ” যান, বাসায় যান ”

” আবার মানে? ” আমি প্রশ্ন না করে পারলাম না, ” আগেও এসেছি নাকি? ”

” কালকে রাতে… আপনাকে রীতিমতো কোলে কইরা দিয়া আসছি।” ওনার গলায় বিরক্তি।

আমি অবাক হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি, নিজের অজান্তেই বললাম, ” চাঁদ রাতে বাসার মেয়েরা সব মেহেদী দিয়েছিলো, তাই না? ”

চলবে