#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী
আমি বাসর ঘরে বসে আছি। ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। তাজা রজনীগন্ধা আর বেলীর সুবাস এসে আমার নাকে লাগছে। রুমের ভিতরে লাইটিং করা হয়েছে। মৃদু আলোতে রুমটাকে রাজমহলের মতো লাগছে। জানালায় দামী ভারী পর্দা লাগানো হয়েছে। বাসর খাটটা অনেকটা পালঙ্কের মতো। তাতে ভেলভেটের চাদর বিছানো রয়েছে। রুমের ভিতর ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা বেশ বড়। অর্থাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলীলায় সাজানো যায়। সিংহাসনের মতো একটা ডিভান রাখা আছে। তবে এই বাসর নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। বরং আমি উৎকন্ঠায় আছি। কারণ এটা আমার প্রথম বাসর নয়। এটা দ্বিতীয় বাসর। আপনারা শুনলে অবাক হবেন আমার এই দ্বিতীয় বাসরের ব্যবস্থা আমার স্বামীই করেছে। বলতে পারেন নিজেই নিজের ফাঁদে পড়েছে। কথায় আছে না, নিজের বুদ্ধিতে ফকির হওয়া ভালো তবুও অন্যের বুদ্ধিতে ধনী হওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়। আমার স্বামীর অবস্থা অনেকটা সেরকম। আমার খুবই অস্বস্তি হচ্ছে। কিভাবে আমার এই রাত পার হবে। আমার স্বামী রাজন অবশ্য আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছে আমি যেন আমার এই দ্বিতীয় বরের সাথে শারীরিক সম্পর্কে না জড়াই। এই রাতটা পার হলেই কাল আমি যেন আবার রাজনের কাছে ফিরে যাই। তারপর ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলে এই ল্যাটা চুকে যাবে।
আচ্ছা এটা কি কখনও সম্ভব? আমার যদি এই লোকের সাথে কোনোরকম সম্পর্ক নাও হয় তাই বলে এই সমাজ কি আমাকে বিশ্বাস করবে? এমনকি রাজনের মা ভাইবোন কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না। এমনকি রাজনও বিশ্বাস করবে না। ও মুখে কিছু না বললেও মনে মনে আমার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। অথচ এই ঘটনার জন্য আমি মোটেই দায়ী নই। তবে আমি মনে মনে সিদ্বান্ত নিয়েছি ইউসুফ চৌধুরীকে সব জানিয়ে দিবো। আমি জানি না কাল আমার জন্য কি দিন অপেক্ষা করছে? রাজনরা দুই বোন দুইভাই। রাজনের বড় একবোন। উনার নাম শিখা। মাঝখানে রাজন আর সুজন সবার ছোটো দীপা। রাজন যখন দশম শ্রেনীতে পড়ে তখন ওর বাবা মারা যায়। সেই থেকে সংসারের ভার আস্তে আস্তে ওর উপরে পড়ে। বিশেষত এটা দেখে আমি ভাবতাম রাজন আমার ব্যাপারেও দায়িত্বশীল হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। যাই হোক সেই প্রসঙ্গে পড়ে আসছি।
দীপা আর আমি আমি লম্বায় একই সমান। ওর চেহারা খারাপ নয়। তবে গায়ের রংটা বেশ চাপা। সেক্ষেত্রে ওর জন্য তেমন ভালো প্রস্তাব আসে না। এদিকে ইউসুফ চৌধুরী রাজনের অফিসের বসের ছেলে। বেচারা বিপত্মীক। বয়স একটু বেশী। রাজনের বস ইসহাক চৌধুরী ছেলের জন্য রাজনকে পাত্রী দেখতে বলে। পাত্রীর ক্যাটাগরী হচ্ছে মেয়েকে লম্বা আর ফর্সা হতে হবে। দীপা লম্বা আছে তবে ফর্সা তো নয়। রাজন ওর মায়ের সাথে এই কথা শেয়ার করলে ওর মা দীপার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু রাজন বলে,”দীপা তো ফর্সা নয়।”
কিন্তু ওর মা বলে,
—-এটা কোনো সমস্যা নয়।
রাজন চিন্তিত হয়ে ওর মাকে বলে,
—-কালো মেয়েকে তুমি রাতারাতি ফর্সা কি করে বানাবে?
আমার শাশুড়ী মাও ছাড়বার পাত্র নয়। কারণ উনার সাথে দুবছর থেকে আমি এটুকু বুঝেছি কূটবুদ্ধিতে উনি বেশ পারদর্শী। উনিই রাজনকে ডেকে বলে,
—-শোন রাজন,তোকে একটা কথা বলে তুই অমত করিস না। ওরা যেদিন পাত্রী দেখতে আসবে সেদিন জুলেখাকে আমরা পাত্রী হিসাবে দেখাবো। তারপর দেখাদেখি হয়ে গেলে বিয়ের ডেট পাকা হলে সেই নির্ধারিত দিনে দীপার সাথে বিয়ে হবে।
পাশের রুম থেকে আমি সবই শুনতে পেয়েছিলাম। রাজন ওর মায়ের এই কথার কোনো প্রতিবাদ করলো না। বরং আমার কাছে এসে ইনিয়ে বিনিয়ে মায়ের কথা উপস্থাপন করলো। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-আমাকে এই প্রস্তাব দিতে তোমার জিহ্বায় আটকালো না?
ও কাপুরুষের মতো বলে উঠলো,
—-এখানে খারাপটা কি দেখলে? তোমাকে তো আর বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তুমি শুধু পাত্রী বেশে ছেলে পক্ষের সামনে গিয়ে বসবে। এ আর এমনকি?
আমিও রেগে গিয়ে বললাম,
—-তুমি এমনি এক পুরুষ মায়ের কথা রাখতে বউকে বাজারে নিয়ে বেঁচতে দ্বিধা করবে না।
তবে আমার কোনো উচ্চবাচ্যই ধোপে টিকলো না। রাজন ইতিমধ্যে আমার ছবি নিয়ে দেখিয়েছে। উনারা পছন্দ করেছেন। সে কারনে উনারা আমাকে যেদিন দেখতে আসে বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে আসে। আজকেই সকালে উনারা আমাকে দেখতে এসে পছন্দ করে। তারপর বিয়ের পাট চুকিয়ে বউ করে নিয়ে আসে। চাকরি বাঁচাতে আর মায়ের কথা রাখতে রাজনও কোনো বাঁধা দিলো না। আমার ভাগ্যের কি বিড়ম্বনা!
আমার দুঃখ আমি ভালেবেসে রাজন নামে একজন কাপুরুষকে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পর বুঝলাম রাজন একটা মাম্মাস বয়। বিয়ের আগে ঘুর্ণাক্ষরেও যদি বুঝতে পারতাম ও আসলেই একটা কাপুরুষ। নিজের বৌয়ের দায়িত্ব পালন সে সঠিকভাবে করতে পারবে না। সবক্ষেত্রেই সে মায়ের আদেশের অপেক্ষা করে সেক্ষেত্রে আমি কিছুতেই ওর সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতাম না।
আমার বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। মামার বাড়িতে মামীর মুখ ঝামটা খেয়ে প্রতিনিয়ত বড় হয়েছি। আমার বয়স যখন সাত বছর তখন থেকেই মামার বাড়িতে আশ্রিত হই। আসলে আমার বাবা আমার মাকে ভালেবেসে বিয়ে করেছিলো। আমার মায়ের স্ট্যাটাস আমার বাবার বাড়ির তুলনায় খুবই নগন্য। সেক্ষেত্রে আমার দাদা দাদী বাবার মুখ রক্ষার্থে বিয়েটা মেনে নেয়। কিন্তু আমার মাকে মেনে নিতে পারেননি। তাই বাবা মায়ের মৃত্যুর পর আমার ঠাঁই হয় মামার বাড়িতে। মামী আমার উপর অনেক অত্যাচার করতো। কিন্তু মামাকে কখনও প্রতিবাদ করতে দেখেনি। আমার সমবয়সী মামাতো বোন ছিলো। ওর নাম মীম। আমরা দু’জন একই রুমে ঘুমাতাম। ও খাটে শুইতো আর আমি মেঝেতে তোষক বিছিয়ে ঘুমাতাম। আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। বই একসেট কেনা হতো। মীমের মর্জি অনুযায়ী আমাকে পড়াশোনা করতে হতো। মীমের বিছানা আমাকে গুছিয়ে দিতে হতো। ঈদের সময় নতুন জামা মীমের পছন্দে কেনা হতো। মাঝে মাঝে মামা মামী মীম আর নওশাদ একসাথে বাইরে বেরাতে যেতো। নওশাদ আমার মামাতো ভাই। মীম আর আমার থেকে তিন বছরের ছোটো। কিন্তু ওরা আমাকে কখনও সঙ্গে নিতো না। ঘর পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে আমাকে রাখা হতো। ঘরে শুধু ঘর মোছার জন্য ছুটা বুয়া রাখা হতো। বাকি সব কাজ আমাকেই করতে হতো। এতো কিছুর পরেও আমি এসএসসি এইচএসসি জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাশ করি। কিন্তু মীম জিপিএ ফাইভ পায়নি। আমি সোসিওলজিতে ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি। মীম ব্রাকে ইংলিশে পড়ছে। ভার্সিটিতে ঢোকার পর আমার একটাই টার্গেট একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করে বিয়ে করে চিরদিনের মতো মামার বাড়ী থেকে মুক্তি পাওয়া। সে কারনে রাজনের সাথে সম্পর্কের পর ওকে যাচাই করার সুযোগ হয়নি। বিয়ের আগে বুঝিনি কেন রাজন আমার মতো এতিম মেয়েকে বিয়ে করেছে। কারণ ও কখনও মায়ের মুখের উপর কথা বলতে পারে না। সেটা যদি কোনো অন্যায় আচরণ হয় তাও না।
দরজাটা খোলার সাথে সাথে আমি সচকিত হলাম। খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উনি আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
—-আপনি ব্যস্ত হবেন না। বিছানাতেই আরাম করে বসুন।
লোকটা বেশ লম্বা। সুঠামদেহী শরীরে কোথাও মেদ নেই। উনি পাগড়ীটা খুলে খাটের পাশের সাইট টেবিলে রাখলেন। এরপর আমার কাছে এসে কিছুটা দুরত্ব রেখে বসে বললেন,
—হুট করেই বিয়েটা হয়ে গেল। আপনি হয়তো এভাবে বিয়েতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু আপনার ছবি দেখে আমার ভীষণ পছন্দ হয়ে যায়। আব্বু আমাকে অনেক মেয়ে দেখিয়েছিলো। কিন্তু আমার বিয়ে করতে ইচ্ছে হতো না। কিন্তু আপনার ছবি দেখে মনে হলো,এরকম একজন সঙ্গী জীবনে আসলে মন্দ হয় না।
আমি শুধু উনার কথা শুনছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম কিভাবে ওকে বলবো আমি রাজনের বোন নই। ওর স্ত্রী হই। ওর অভিব্যাক্তি কেমন হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
চলবে