#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী
যত প্রতিকুল অবস্থায় থাকি না কেন আমি লেখাপড়া মনোযোগ দিয়ে করতাম। তবে বাসায় পড়ার পরিবেশ ছিলো না। পড়তে বসলেই মামী কোনো না কোনো কাজ হাতে ধরিয়ে দিতো। সে কারনে যখন স্কুলে পড়তাম তখন সেখানেই ক্লাসের পড়াগুলো কমপ্লিট করতাম। কলেজেও তাই করেছি। মামী তো সমস্যা করতোই মীমও কোনো অংশে কম যায় না। আমাকে পড়তে দেখলেই ওর জামা স্ত্রী করা কিংবা জুতো পরিস্কার করার প্রয়োজনটা বেশী হতো। আমি সবই বুঝতাম। ওরা চাইতো না আমি পড়াশোনা করি। এতো কিছুর পর ও মীমের থেকে আমার রেজাল্ট ভালো হতো। এসএসসি আর এইচএসসি তে জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাশ করি। যেদিন এইচএসসির রেজাল্ট বের হয় আমি ভীষণ খুশী ছিলাম। মনে মনে ভাবলাম আর একটু কষ্ট করলে আল্লাহর রহমতে আমার কষ্টের দিনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। যে কোনো একটা পাবলিক ভার্সিটি চান্স হলে এই কারাগার ছেড়ে আমি বের হয়ে যাবো। এরপর টিউশনি করে নিজের জীবনটা চালিয়ে নিবো। কিন্তু কলেজ থেকে বাসায় ফিরে জানতে পারলাম, আমাকে নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি মামার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওড়নার আঁচলের সুতো টানছিলাম। মামা তখন টেবিলে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,
—-কিছু বলবি,
—-জিপিএ ফাইভ পেয়েছি,
—-শুনেছি তো,এটা নিয়ে বেশী আদিখ্যাতা করার দরকার নেই। মীম কষ্ট পাবে।
মামার কথা শুনে ভীষণ আহত হলাম। নিজের মেয়ে টই টই করে ঘুরে বন্ধুদের নিয়ে মোজ মাস্তি করে রেজাল্ট খারাপ করেছে। সেটা নিয়ে মামার কোনো কথা নেই। আমার রেজাল্ট ভালো হওয়াতে তার মেয়ে কষ্ট পাবে সে প্রসঙ্গে কতো মাথা ব্যথা। তারপরও আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মামা বললো,
—-আর কিছু বলবি?
সাহস করে মামাকে বলেই ফেললাম,
—-মামা,আমি এখন বিয়ে করতে চাইছি না।
মামা কিছু বলার আগেই মামী কোত্থেকে উদয় হয়ে বললেন,
—-কিচেনে গরমে সিদ্ধ হয়ে ছেলেপক্ষের জন্য রান্না করছি আর উনি আহ্লাদ করে বলতে এসেছেন বিয়ে করবেন না,মগের মুল্লুক নাকি? এখানে ঐ সব নটাঙ্গিনীপনা চলবে না। তোমার মায়ের মতো নষ্টামী করার সুযোগ আমি দিবো না। যাও, ঘর দোরগুলো গুছিয়ে ফেলো।
মামা আমার কথার জবাব দিলেন না। যা বুঝলাম মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। আমি ওখান থেকে বের হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার খুব কান্না পেয়েছিলো সেদিন। হুহু করে কেঁদেই ফেললাম। মনের ভিতর জমানো বেদনার মেঘগুলো কষ্টের বৃষ্টি হয়ে ঝরতে লাগলো। সুর্যটা তখন পশ্চিমে ঢলে পড়ছিলো। গুমোট গরম ছিলো। হঠাৎ শোঁ শোঁ বাতাস বইতে শুরু করলো। মনে হলো মুষলধারে বৃষ্টি হবে।আজ তুমুল বৃষ্টি হোক। সব কিছু ভেসে যাক। আমারও সেদিন ভেসে যেতে মন চেয়েছিলো। কিন্তু মন চাইলে কি বাস্তবতা এড়ানো যায়? যায় না।
মামী হঠাৎ বারান্দায় এসে আমাকে ধমক দিয়ে বললেন,
—-এখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে না থেকে গোছগাছ শেষ করে রেডি হয়ে থাক। যে কোনো মুহুর্তে উনারা এসে পড়বেন।
হাজারো অরুচি থাকা সত্বেও ঘরের কাজকর্ম করতে লাগলাম। আর নিজের মনকে বললাম,অস্থির হওয়া যাবে না। ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে।
কাজগুছিয়ে গোসল সেরে আমার মায়ের শাড়িগুলো থেকে একটা গাঢ় নীল জমিনে হালকা গোলাপী পাড়ের সুতি শাড়ি পরে নিলাম। প্রসাধনের মধ্যে চোখে কাজলের প্রলেপ দিলাম। আমি পাশের রুম থেকে শুনতে পারছি মামী বিগলিত হয়ে ছেলের মাকে বলছে,
—এতিম মেয়েটাকে আমি অনেক কষ্ট করে এই বুকে রেখে বড় করেছি। নিজের মেয়ের থেকে বেশী ছাড়া কম করিনি। মাটিতে রাখলে পিপড়ায় খাবে মাথায় রাখলে উকুনে খাবে তাই বুকে রেখে মানুষ করেছি। পড়াশোনার জন্য ঘরে বাইরে টিচার দিয়েছি। এই জন্যই ডাবল জিপিএ ফাইভ পেলো। ওর মামার তো তেমন ইনকাম নেই। বোনের মেয়ের জন্য করতে গিয়ে বেচারা নিজের মেয়ের জন্য একটু কম করে ফেলেছে। সে কারনে মেয়েটা জিপিএ ফাইভ পায় নাই। তাতে কি? নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে কেউ কিছু বলতে আসবে না অথচ বোনের মেয়ের রেজাল্ট খারাপ হলে সবাই বলতো, “পরের মেয়ে বলে মেয়েটাকে দিয়ে শুধু সংসারের কাজ করিয়ে নিয়েছে। যার কারনে মেয়েটার রেজাল্ট খারাপ হলো।” এসব কথা শুনতে আমাদের কেমন লাগতো বলেন?
মামীর কথা শুনে ছেলের মা গদগদ হয়ে বললেন,
—-জুলেখার অনেক বড় ভাগ্য আপনাদের মতো মামা মামী পেয়েছে।
জানেন,আমি মাঝে মাঝে খুব অবাক হই মানুষের কি মরণের ভয় নেই? এভাবে জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা কিভাবে বলে? রাসুল (সাঃ) বলেছেন,”হাশরের ময়দানে কিছু মানুষ অনেক ইবাদত বন্দেগী করা সত্বেও নিঃস্ব এবং রিক্ত হবে। কারণ তারা মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে,মানুষকে ঠকাবে,কথার মাধ্যমে আঘাত করবে। হাশরের ময়দানে ঐ মানুষগুলো তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিকার চাইবে। সেখানে তো টাকা পয়সা কিংবা মাফ চাওয়ার সিস্টেম থাকবে না। তখন অভিযুক্তদের নেক আমলগুলো ঐ অত্যাচারিত ব্যক্তিদের দিয়ে দিতে হবে। সমস্ত নেক আমল দেওয়ার পরও যদি অভিযোগের দায় এড়াতে না পারে তখন ঐ অভিযুক্ত ব্যক্তি অত্যাচারিত ব্যক্তির পাপগুলো নিয়ে জাহান্নামের পথে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে হাঁটা দিবে।”
কি ভয়ঙ্কর অবস্থা! আল্লাহপাক আমাদের হেদায়াত দান করুন।
এরপর আমি নাস্তা নিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকতেই উপস্থিত সবার দৃষ্টি আমাতে আটকে গেল। আমি ওদের চোখে মুগ্ধতা দেখলাম। গল্প গুজব আড্ডা চললো। তবে পাত্রকে বেশ বয়স্ক মনে হলো। আমার তখন বয়স বিশ বছর আর পাত্রের বয়স কম করে হলেও পঁয়ত্রিশের উপরে হবে। যাইহোক আমি মনে মনে দোয়া করছিলাম বিয়েটা যেন না হয়। হঠাৎ পাত্রের বাবা বললো,
—-আমাদের পছন্দ হয়েছে কিন্তু এরা আজকালকার যুগের ছেলেমেয়ে। নিজেদের মধ্যে একটু কথা বলে নিলে ভালো হয়। নিজেদের মধ্যে একটু কথা বলুক।
এতেই সবাই রাজী হলেও মামীর মুখটা কালো হয়ে যায়। ছেলের মা সাথে সাথে বললো,
—-যাও মা,তোমরা দুজন ছাদ থেকে ঘুরে আসো।
আমি আমানকে নিয়ে ছাদে আসলাম। আর আমার মন আমাকে বলতে লাগলো,”জুলেখা এটা একটা বড় সুযোগ।কাজে লাগানোর চেষ্টা কর।”
ছাদে এসে আমি মনে মনে ভাবছিলাম কি করা যায়? আমার নিরবতায় আমান প্রথমে বলতে শুরু করলো,
—-জুলেখা আমাদের বয়সের পার্থক্য থাকলেও আমি তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো। তোমার সাথে আমার আজই প্রথম দেখা হলেও তোমার ছবির প্রেমে আমি দুমাস আগেই পড়েছি। তোমাকে লেখাপড়া করাবো।
আমি যখন এই বিপদের জাল থেকে কিভাবে বের হবো সেই ফন্দি আঁটছি তখনই ছেলে আমার হাত ওর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে বললো,
—-আমি তোমাকে ভালোবাসি জুলেখা।
বেত্রাঘাতে মানুষের চেতনা যেমন ফিরে তেমনি আমিও সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম,
—+আমি তো বাসি না। আর আপনি আমার হাত ধরলেন কেন?
—-এখন বাসো না,কিন্তু বিয়ের পর ঠিক ভালোবাসতে শুরু করবে। আজ না হোক কাল তুমি তো আমার বউ হবে, সুতরাং হাত ধরলে কি সমস্যা? তাছাড়া আমার চালের দুটো আড়ত আছে, একটা ইটের ভাটা আছে। তুমি সারাজীবন রাজরানী হয়ে সংসার করবে।
—-সমস্যা আছে,আমি একজনের বাগদত্তা।
সাথে সাথে আমান সাহেবের মুখটা এমন হলো, যেন মাথায় বাজ পড়েছে। ভীষণ মন খারাপ করেছিলো। আজ মনে হয় ঐ মানুষটাকে আঘাত দেওয়ার ফল আমি রাজনকে বিয়ে করে শোধ করেছি। মানুষটা মনে হয় আমাকে সত্যি খুব ভালোবেসেছিলো।
অনেকক্ষণ কথা বলার পর খুব ক্লান্ত লাগছিলো। ইউসুফ সাহেব আমার নিরবতার ফাঁদে পড়ে বললেন,
—-আমান সাহেবের সাথে আপনার রিজিক বাঁধা ছিলো না। থাকলে ঐ বিয়ের ফাঁদ থেকে আপনি বের হতে পারতেন না।
চলবে