দ্বিতীয় বাসর পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
16

#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

আমি ছাদে রাখা স্টিলের চেয়ারটায় বসলাম। চাঁদের আলোয় চারিদিক আজ আলেকিত। ইউসুফ আমার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-,নুরীর সাথে আমার চার বছরের সম্পর্কের পর বিয়ে হয়েছিলো। তবে সেই সম্পর্ক ছিলো ভার্সিটিতে কুশলাদি বিনিময়,দৃষ্টি বিনিময় মাঝে মাঝে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করা এতোটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কারণ ও ছিলো খুব রক্ষণশীল পরিবারের একমাত্র মেয়ে। তারপর পড়াশোনা শেষ করে আমাদের বাসা থেকে প্রস্তাব গেলে ওর বাবা মা অমত করেননি। আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। চার বছর ধরে দুটি মানব মানবীর অপেক্ষার পর যখন মিলন ঘটে এই মিলন যে কতনা মধুর তা তোমাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। ও আমাকে মন প্রাণ উজার করে ভালোবেসেছিলো। আমি এখন ভাবি যে যুগে প্রেমিক প্রেমিকা তাদের প্রেম টিকিয়ে রাখার জন্য রুম ডেট থেকে শুরু করে হেন কিছু নাই করে না সেখানে আমাদের শুধু চোখাচোখি হালকা পাতলা কথা বার্তাতেই প্রেম চার বছর টিকে থাকলো। ওকে একবার দুবার আমি আমার সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু ও রাজী হয় নাই। ও আমাকে কি বলেছিলো জানো,
“ইউসুফ তুমি আমার জন্য এখন হালাল হও নাই। তাই তুমি আমার মাহরাম নও। আর আমি আমাদের এই সম্পর্কটাকে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাই। এবং তোমার সাথে একান্তের মুহুর্তগুলো সেদিনের জন্য তোলা থাক। আমরা বিয়ের পর এই সময়গুলোকে মনের মতো করে উপভোগ করবো। আমি তো অপেক্ষায় আছি। আর তুমি ও একটু ধৈর্য ধরো।”
ওর কথাগুলো শুনে ওর প্রতি আমার ভালোবাসা ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে। সত্যিই ও বিয়ের পর যে কবছর বেঁচে ছিলো আমাকে অফুরন্ত সুখে ভরিয়ে দিয়েছিলো। লোকে বলে ঝগড়া, মান অভিমান না হলে নাকি ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয় না। কিন্তু যতদিন বেঁচেছিলো আমাদের মাঝে কখনও মান অভিমান ঝগড়া কিছুই হয় নাই। এবং আমার মায়ের সাথে এতো সুন্দর করে নুরী নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলো দেখে মনে হতো ওরা বান্ধবী। আব্বু ব্যবসার কারণে বাইরে বেশী ব্যস্ত থাকতো। আমি লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আম্মু এই কারনে খুব একাকীত্বে ভুগতো। নুরী এসে আম্মু একাকীত্বকে আনন্দে ভরিয়ে দিলো। সে কারণে ও মারা যাওয়ার সাথে আম্মুও হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। বিয়ের পর আমি আর আব্বু ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকাতে আম্মু আর নুরী সম্পর্কে শাশুড়ী আর ছেলের বউ হলেও বাস্তবে তারা বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। ওরা একসাথে শপিং করা,রেস্টুরেন্টে খাওয়া বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতো। বাসায় যখন থাকতো তখনও তারা একসাথে সময় কাটাতো। দুজনেই খুব ধার্মিক ছিলো। সে কারনে একসাথে সোম বৃহস্পতি রোজা রাখা,তাহাজ্জুদের নামাজের সময় দুজন দুজনকে ডেকে একসাথে স্টাডি রুমে নামাজও পড়তো।
আমি ইউসুফের কথা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম এই পৃথিবীতে শাশুড়ী বউমার সম্পর্কও এতো মধুরও হয়? তবে নুরীর প্রতি ইউসুফের ভালোবাসা দেখে আমার ঐ মৃত মানুষটার প্রতি মনে হলো একটু ইর্ষাবোধ হলো। হয়তো এই না পাওয়া আমি কিছুক্ষণের জন্য মানবিক গুন হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরক্ষণেই নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বললাম,
“উদার হতে শেখো জুলেখা। বরং তুমি ঐ মানুষটার জন্য দোয়া করো। ঐ মানুষটা চলে গিয়েছে বলেই আজ তুমি এই খালি জায়গা পূরণ করতে পারছো।”
তবুও তো আমি রক্ত মাংসের মানুষ। আমার চোখদুটো ভিজে উঠলো। মনে মনে ভাবলাম রাজনের সাথে দেখা না হয়ে আমার তো এই মানুষটার সাথে দেখা হতে পারতো।
নিজেকে সামলে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-রাত তো শেষ হয়ে এলো। ঘুমোবে না?
—-তোমার মুখে তুমি সম্বোধনটা আমার কানে মধুর হয়ে বাজলো। আর বেশী রাত জাগবো না। অল্প কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সেটুকু সেরেই আমরা ঘরে যাবো। তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?
—-নাহ্
—-আমি জানি তোমার হয়তো বিরক্ত লাগছে,
—-কেন তোমার এমন মনে হলো?
—-স্বাভাবিক নয় কি! বাসর রাতে স্বামী যদি তার মৃত স্ত্রীর ভালোবাসার কাহিনী বর্তমান স্ত্রীর সামনে বলা শুরু করে তাহলে কি ভালো লাগার কথা? তবুও বলছি। আমাদের সুন্দর দাম্পত্য শুরু করার আগে তোমার আমার সম্পর্কে পুরোটাই জানা উচিত। নুরী মারা যাবার পর পর আম্মু চলে যাওয়াতে আমি আর আব্বু যেন ঝড়ে সব কিছু হারানো পথ হারা পথিকের মতো হয়ে গেলাম। আমাদের খেতে শান্তি নেই ঘুমাতে শান্তি নেই। আব্বু তো তাও ব্যবসার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে আম্মুর শোকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো। কিন্তু আমি কি করে নুরীর শোক কাটাবো। তখন আমার এক বন্ধুর পরামর্শে কিছুদিন মাদক নিতে শুরু করি। গাঁজা খাওয়ার অভ্যস করলাম। এতে অবশ্য ভালোই লাগতো। আমার হ্যালুসিনেশন হতো। তখন নুরীকে আমি দেখতে পেতাম। ভালো লাগতো। কিন্তু এভাবে কতদিন। ওকে স্পর্শ করতে চাইতাম কিন্তু পারতাম না। যন্ত্রণায় ছটফট করতাম। তখন এক বন্ধু যন্ত্রনা কমানোর নাম করে আমাকে নিয়ে গেল এমন এক জায়গায় সেটা হলো কর্লগার্লদের বাসা। অর্থাৎ বিভিন্ন আবাসিক এরিয়ায় স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে ওরা দালালদের সাথে থাকে।
ইউসুফের এই কথা শুনে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। ভাবলাম এসব খারাপ জায়গায় গিয়ে লোকটা আবার কোনো রোগ বাঁধিয়ে বসেনিতো? উপর থেকে মানুষটাকে নিপাট ভালো মানুষ মনে হতো অথচ তলে তলে একি কথা শোনালো আমায়। আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম,
—-এরপর কি হলো?
—-কিছুই হলো না,
—-মানে বুঝলাম না
—-নিজেকে নষ্ট করতে মন চাইলো না। কিছুক্ষণ বসে থেকে ওর রেটের টাকাটা দিয়ে বের হয়ে এসেছিলাম। আসলে আমার শিক্ষা, আমার ধর্মীয়বোধ,নিজের সাথে নিজের সততা সব মিলিয়ে আমি পারিনি পাপের অতলে তলিয়ে যেতে। সেদিন থেকেই পণ করলাম নাহ্ এভাবে আর নয়। নিজেকে সামলে উঠতে হবে। আব্বুকে বলে অফিসে বসতে শুরু করলাম। দিনরাত কাজের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলাম। আর ঐ সব খারাপ বন্ধুদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে শুরু করলাম। বিয়ে করার মোটেই ইচ্ছা ছিলো না। তবে তোমার ছবিটা দেখার পর মনটা আমায় বুঝালো, একটা সঙ্গীর বড়ই প্রয়োজন। আমিও আর অমত করিনি। তোমাকে কেন আমার ঘটনাগুলো বললাম জানো?
—-কেন?
—-নিজের অপরাধবোধ থেকে। কারণ প্রতিটি মানুষের কিছু একটা গোপনীয় থাকে। উপরদিক থেকে যতই ধোপ দুরস্ত দেখাক না কেন ভিতরে ভিতরে সবার জীবনেই কিছু কালিমা থাকে। আমিও এর বাইরে নই। তোমাকে পুরো কথাগুলো বলে নিজেকে হালকা লাগছে।
মনে মনে বললাম,তোমার তো হালকা লাগছে আর আমার মনটা বিষাদে ভরে আছে। না পেলাম জীবনে বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা, না পেলাম ভালোবেসে যার সাথে ঘর বাঁধলাম তার ভালোবাসা আর তোমার কাছে আদৌ কি কোনো ভালোবাসা অবশিষ্ট আছে নাকি নুরী চলে যাওয়ার সাথে সাথে শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ শীতল বাতাস বইতে শুরু করলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মনে হলো এখনি বৃষ্টি নামবে। আমি মন দিয়ে ওর সমস্ত কথাগুলো শুনলাম। আমারও বুকের ভিতর অজানা কষ্ট হচ্ছিলো। মানুষটার জন্য মায়া যে লাগেনি তা বলবো না। নুরী চলে যাবার পর কি নিদারুণ কষ্টে ওর ভিতরটা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সে কারণে মাদক নিয়েছিলো। কিন্তু শেষ অবদি নিজেকে তো বাস্তব জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। এটাই বা কম কিসে। আমি হঠাৎ তাকে জিজ্ঞাসা করে বসলাম,
—-নুরীর মতো আমাকে ভালোবাসতে পারবে তো?
—-কিছুদিন আগে হলেও পারতাম না। কিন্তু এখন মনস্থির করেছি সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করবো। তবে তুমিও যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে আমাদের পুরোনো অতীত আর সামনে এসে দাঁড়াবে না।
বৃষ্টি নেমে গেছে আকাশ জুড়ে। মুষলধারে ঝরছে। তার সাথে ঝড়ো বাতাস। হঠাৎ ইউসুফ আমাকে ওর বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-পারবে না আমাকে ভালোবাসতে?
আমিও যেন এই অপেক্ষাতেই ছিলাম। ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম। মাথা নাড়িয়ে বললাম, “পারবো।”
এরকম একটা নির্ভরতার জন্য আমি যেন মুখিয়ে ছিলাম। প্রবল বৃষ্টিতে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে ইউসুফ আমাকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখলো। কত সময় গড়িয়ে গেল আমাদের যেন কোনো হুশ জ্ঞান নেই। একসময় বৃষ্টি থেমে গেল। ও আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আলতো করে চুমু খেলো।মমতা ভরা এই ছোঁয়াতে আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। চাঁদ ডুবে গিয়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ও আমাকে পাঁজাকোলা করে ছাদ থেকে নেমে আসলো। রুমে এসে আমি ওকে বললাম,
—-এতো দামী শাড়িটা বৃষ্টিতে ভিজে গেল।
—-যাক না,এ রাতটা না হয় শাড়িটার মাঝে স্মৃতি হয়ে থাকবে। তুমি দ্রুত কাপড় বদলে শুকনো তোয়ালে দিয়ে চুলটা মুছে ফেলো।
আমি ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়িটা বদলে একটা ম্যাক্সি পরে নিলাম। শুকনো তোয়ালেতে চুলটা জড়িয়ে নিয়ে বারান্দায় শাড়িটা মেলে দিলাম।
ততক্ষণে ইউসুফ ও তোয়ালে জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলো। চুলের গোড়া দিয়ে মুক্তোর দানার মতো পানির ফোঁটা ঝরছে। ইউসুফকে খুবই আকর্ষনীয় লাগছে। কিছুক্ষন তাকানোর পর আমার চোখদুটো লজ্জায় অবনত হলো। ইউসুফের দৃষ্টি এড়ালো না। কাছে এসে কানের কাছে গাঢ়স্বরে বললো,
—এতো লজ্জা পেলে মধুর দাম্পত্য কিভাবে শুরু করবে?

পাঁচ বছর পর——
ইউসুফ কথা রেখেছিলো। আমাকে এক আকাশ ভরা ভালেবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিলো। একটা ছেলে হলো আমাদের। আমার শ্বশুর এখন আর অফিস বসেন না।পুরো দায়িত্ব ইউসুফের কাঁধে অর্পিত হয়েছে। আমিও বিয়ের পরে চাকরিতে জয়েন করিনি। সংসার সামলিয়েছি। না রাজনের খোঁজ আর রাখিনি। কেননা আমি আর আমার বিষাক্ত অতীতকে মনে করতে চাই না। এতে আমার বর্তমান জীবনধারা বাঁধাগ্রস্ত হবে। তবে মামা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি আর ইউসুফ গিয়েছিলাম। আমার কাছে করা সমস্ত অন্যায়ের জন্য মাফ চেয়ে নিলেন। মামা তখন শয্যাশায়ী। এর কিছুদিন পরে মামা মারা যান। মামাতো ভাইটা নওশাদ জার্মানে প্রবাসী হয়েছে। মামীর শরীরও ভালো না। মীম এখন মামীর দেখাশোনা করে। আমিও খুব একটা যাই না। ফোনেই এক আধটু কথা হয়। আমি আসলেই এখন শুধু নিজের সংসার স্বামী সন্তান বৃদ্ধ শ্বশুর ওদেরকে নিয়ে থাকতে চাই। দুষ্ট লোকের বদনজরে আমার সংসারটাকে ফেলতে চাই না। আল্লাহপাকের কাছে এই শোকরানার শেষ নাই। অনেক অপ্রাপ্তি ছিলো জীবনে। কিন্তু দিনশেষে প্রাপ্তিটা এতো বেশী ছিলো যা সব অপ্রাপ্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছে।

সমাপ্ত