#দ্বিধা_চক্র
পর্ব ১১.
ঘরে ফিরে নদী মায়ের কাছে জানতে পারলো বিকাল থেকেই নিলয় রুম বন্ধ করে আছে। যা বোঝার বুঝে নিল। বোকা ভাইটা কষ্ট পেয়েছে ভেবে নিজেরও মন খারাপ হলো। রাতের খাবারে নিলয়ের বিধ্বস্ত মুখ দেখে নদীর কান্না চলে এলো। ভালোই তো ছিল, বিয়ে করে সুন্দর একটা সংসার করতো। মাঝখানে কেন প্রেমে পড়তে গেল? নদীর খুব ইচ্ছে করলো ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলতে, তুই যেমন আছিস তেমনি থাকবি, খবরদার কারো জন্য নিজেকে বদলাতে যাবি না। তুই আমার শ্রেষ্ঠ ভাই, সবচেয়ে ভালো মানুষ।
সকালে অফিস যাওয়া, অফিস শেষে বাসায় ফেরার মতো নিত্য রুটিনে আবার নিজেকে জড়িয়ে নেয় নিলয়। রাস্তায় বিশেষ কারো সাথে দেখা হওয়ার তাড়া নেই, ভালোবাসা নামক মরিচীকার হাতছানি নেই , বিষাদের নীল সমুদ্রে ডুবে যাওয়াও নেই। সকল অনুভূতিগুলো বড্ড ভোঁতা হয়ে আছে।
অফিসের কাজে অন্য একটি অফিসে গিয়েছিল। ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল হৃদয়হীনার সাথে। কেন দেখা হলো, হলোই যখন এমন করে কেন হলো? বুকের ক্ষতটা নিরবে কষ্ট দিচ্ছিল এখন তো হাত পা ছড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করবে। নিজের পরাজয় মেনে নেয়া যায় কিন্তু ভালোবাসার পরাজয় সহ্য করা যে কঠিন কাজ!
অবনির হাতের আইসক্রিমে সানন্দে কামড় বসালো সাথে থাকা মানুষটি। চুলের ছাট, বেশভূষা দেখেই বুঝা যাচ্ছে অবনির সেই নম্র ভদ্র ক্যাপ্টেন সাহেব । অবনি হেসে তার মাথায় আদুরে চাপড় দিলো। এরই মাঝে নিলয়ের চোখে চোখ পড়লো অবনির। দুজনার চোখ একে অন্যের মাঝে থমকে গেল। সাথের মানুষটি অবনির কাঁধে হাত রেখে কিছু জিজ্ঞেস করতেই চমকে উঠল নিলয়। কপোত-কপোতীর ভালোবাসাময় খুনসুটি দাঁড়িয়ে দেখার মতো অভদ্র সে নয়। দ্রুত পা চালালো।
অবনি সজোরে ডাক দিল, এই যে নিলয় সাহেব।
নিলয় দাঁড়ালো না। দাঁড়ানোর কোনো কারণ নেই। অনুশোচনা হচ্ছে কেন একটা ভুল মানুষকে ভালোবাসতে গেল। মেয়েটার কাছে সবকিছু এতো সহজ? নাকি এটাই তার স্বভাব?
সাথে আসা কলিগের বাইকের পেছনে বসল। অবনি পেছন থেকে এগিয়ে আসার আগেই বাইক সামনের দিকে ছুটে চলল। অবনি আরো জোরে ডাক দিলো যা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল।
পেছনে ফেলে আসা মানুষটি থেকে নিলয় দূরে যেত চায়, সমস্ত পৃথিবী ফেলে ভিনগ্রহে হারিয়ে যেতে চায়।
মোবাইল হাতে নিয়ে অবনির নাম্বার ব্লক করল। তারপর অবনির নামটিও ডিলিট করল মোবাইল থেকে, নিজের জীবন থেকে।
কদিন ধরে নিলয়ের বিমর্ষ চেহারা সবার নজরে পড়লেও আজকের ঘটনায় একেবারে দুমড়ে মুচড়ে গেল নিলয়।
খাওয়া শেষে নদী তার মাকে বলল, তুমি ভাইয়ার কাছে যাও মা, ভাইয়া কষ্ট পাচ্ছে।
নিলয় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। শিউলি রুমে ঢুকে নিলয়ের পাশে বসলে আড়ালে চোখের জল মুছে নেয় নীরবে।
– বাবা, কি হয়েছে বল?
নিলয় কিছু না বলে মায়ের কোল জড়িয়ে শুয়ে থাকে।
শিউলি চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। ছোটবেলা থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ছেলেটা। মায়ের সাহায্য নেয়া ছেড়ে উল্টো মাকে সাহায্য করেছে। নদীকে কোলেপিঠে বড় করেছে। কোনো কাজে বলতে হয়নি এটা করছিস না কেন বরং বলার আগেই সব কাজ গুছিয়ে সবার প্রশংসা পেয়েছে । অথচ আজ কেমন বিভ্রান্ত মনে মায়ের কোলে আশ্রয় খুঁজছে।
-মা, আমি কি খুব বেশি দম্ভ নিয়ে চলি?
– কেমন দম্ভ?
-নিজেকে সেরা ভাবার দম্ভ?
– কোনো কাজে পারদর্শী হলে সে কাজে নিজেকে সেরা ভাবা যায় কিন্তু মনে দম্ভ চলে আসাটা খারাপ।
-আমি বোকা ছিলাম মা। আমার কোনো যোগ্যতাই নেই।
– তুই তো দেখি আসলেই বোকা রে….যোগ্যতা নেই বলছিস কেন? যোগ্যতা জিনিসটা একেকজনের কাছে একেকরকম। তুই যেটাতে বেস্ট সেটা হয়তো অন্যের কাছে মূল্যহীন, আবার অন্যের কোনো বিশেষ গুণ তুই হয়তো পছন্দই করিস না। তুই তোর যোগ্য মানুষের কাছে যাসনি বলে তোর যোগ্যতার মূল্য হয়নি।
– যুক্তিতর্কের বাইরেও অনেককিছু আছে মা। আমি এতোদিন তা বুঝি নি।
– এখন বুঝেছিস?
– হুম! খুব কষ্ট হচ্ছে। যার কিছুই আমার ভালোলাগার কথা নয় তাকে কেন আমার জীবনের সেরা মানুষ বলে মনে হয়? কেন মনে হচ্ছে একমাত্র সে-ই ছিল আমার এতোদিনের আরাধ্য ?
– একদিকে কিছুই ভালো লাগে না অন্যদিকে জীবনের আরাধ্য, এ কেমন দ্বিধাযুক্ত কথা?
– কোনো দ্বিধা নেই। আমি ভালোবেসেছি কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসেনি।
– তাহলে কষ্ট হলেও সরে আয়। যে আমার ছেলের মূল্য বোঝে না তার কথা ভেবে কষ্ট পাওয়ার কারণ নেই।
– দোষ আমারই ছিল মা, আমিই পিছু নিয়েছিলাম। সে পরিপূর্ণ, আত্মবিশ্বাসী। বরং আমি ভাঙ্গাচূড়া নড়বড়ে মানুষ।
কেউই পরিপূর্ণ নয় নিলয়। আমি ঘরবাড়ি পরিপাটি করে রাখতে পছন্দ করি, তোর বাবা এলোমেলো, যেখানে সেখানে জিনিস রেখে বেমালুম ভুলে যায়। অথচ মনের দিক থেকে আমি খুব অগোছালো, অস্থির কিন্তু তোর বাবা ধৈয্যর্শীল, যেকোন পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় সামলাতে জানে। দুজন দুই মেরুর মানুষ কিন্তু তারপরও আমরা একে অপরের জন্য যথার্থ।
দুজন অপূর্ণ মানুষ মিলেই একটি পরিপূর্ণ সংসার গড়ে উঠে।
____________
অবনির ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। বারোদিন পর পরীক্ষা শুরু হবে। কলেজ থেকে ফিরলেও পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মাঝে মাঝে মোবাইল চেক করে কারো কল বা মেসেজ এলো কি না। কথায় কথায় যে মানুষ রাগ দেখায় তাকে নিজে থেকে কল করে পাত্তা দেয়ার মানে হয় না। এমন মানুষ নিয়ে জীবন কাটানো মুশকিল। শুধু ভালোবাসি বললেই তো হয় না, রোমান্টিকতা জানতে হয়, খুনসুটি জানতে হয়। প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কোথাও কোনো রোমান্টিক আলাপ করেনি বেরসিক লোকটা। সুযোগ বুঝে ভালোবাসি বলেছে কিন্তু ওটা খোলা মাঠ না হয়ে মাছ বাজার হলেও বলতো। অবনির মনে কত স্বপ্ন ঘুরে কিন্তু মনে হয় না নিলয় তা কখনো বুঝবে।
যে মানুষটা সেদিন মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল তাকে নিয়ে রোজ কেন ভাবতে বসে অবনি? কেন বার বার ভাবে ফোনটা বেজে উঠবে নিলয়ের ডাকে?
শিরিন রুমে এসে একটা খাম এগিয়ে দিল।
অবনি বিরক্ত মুখে বলল, মা, বলেছি না পরীক্ষার পর পাত্র দেখো।
– এটা খুব ভালো পাত্র। ডাক্তার। আমরা রাজি, তোর বাবা কথা চালাচ্ছে। পরীক্ষার পর বিয়ে হবে।
– ওমা, আমি জানিই না আর তোমরা আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো?
– দিলাম তো ছবি, দেখ। তবে মানা করতে পারবি না, এবার আমারই সিদ্ধান্ত নেবো। শিরিন রুম ছেড়ে চলে গেল।
অবনি খাম হাতে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। পরীক্ষার পর বিয়ে? অসম্ভব!
খাম খুলে দেখলো, বেশ সুদর্শন ছেলে।
তাতে কী? আজকাল সবার ছবিই এডিট করে সুন্দর হয়ে যায়। সে অনুযায়ী নিলয় এডিট ছাড়া সুন্দর। মানুষটা হাসে কম কিন্তু যখন হাসে দেখতে কত ব্যক্তিত্বশীল মনে হয়। শ্যামলা গড়নে খাড়া নাক রাগে ফোঁস ফোঁস করে। আনমনে হেসে উঠে অবনি। ছবির দিকে আবার তাকায়।ছেলেটা কেমন জানি নায়ক নায়ক ভাব। এসব মডেল টাইপ ছেলে একদম পছন্দ নয় অবনির। অন্যদিকে নিলয় মনের ভেতরে যা তাই প্রকাশ করে। কোনো ভনিতা নেই।
আশ্চর্য! নিলয়কে এই ছেলের সাথে কেন বার বার তুলনা করছে? এ মুহূর্তে কাউকে নিয়েই ভাবতে চায় না অবনি।
রাতে খেতে বসে অবনির বাবা বললেন, পাত্রের ছবি দেখেছো?
-হ্যাঁ দেখেছি, পছন্দ হয়নি। তাছাড়া আমি এখন….
– জানতাম তোমার পছন্দ হবে না। এ পর্যন্ত কোনো ছেলেকেই তোমার পছন্দ হয়নি। তাই তোমার অনুমতি নেয়ার আর প্রয়োজন নেই। আগামী মাসেই বিয়ে ঠিক করবো।
– বাবা, আমার অনুমতি ছাড়া কিভাবে বিয়ে দেয়ার চিন্তা করছো তুমি?
– একমাসের মধ্যে তোমার মত পাল্টে যাবে আশা করছি। ছেলে ভালো পরিবারের, মিশুক। এমন ছেলে তোমার খামখেয়ালীতে হাত ছাড়া করা যাবে না। তোমার একটা ছোট বোন আছে। ওটারও বিয়ে দিতে হবে।
– ছোটর বিয়ে দিতে হলে ওকে আগে দাও। আমাকে ক্ষান্ত দাও বলেই অবনি খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল।
ফরিদ সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, আমি আদর করে যেমন মাথায় তুলেছি দরকার হলে আছাড় মারতে দেরী করবো না বলে দিলাম। অবাধ স্বাধীনতা দেয়ায় এখন কোনো পাত্রই তার পছন্দ হয় না। তার জন্য সালমান খান আসবে …..
শিরিন বললেন, আহা কি বলছ এসব!
-ঠিকই বলছি, তোমার স্বভাব পেয়েছে, কী ভাবে নিজেকে….
-সেটা অবনিকে আমি বুঝিয়েছি। উত্তম কুমার চাইলেই পাওয়া যায় না, আমার কপালে জুটে নি, ওর কপালেও জুটবে না।
ফরিদ সাহেব আরো ক্ষেপে গেলেন, কিসের মধ্যে কী বলো তুমি? আমি কিসে খারাপ…..
অবনির প্রসঙ্গ বদলে দুজনার প্রাত্যহিক সাংসারিক সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল।
অবনি নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। খামটা খুলে ছেলেটার ছবি আবার দেখলো।
নাহ! কোনোভাবেই একে বিয়ে করা সম্ভব নয়। বাবা জোর করতে পারে না। ছেলেটার ছবির দিকে তাকালে চোখের সামনে নিলয় ভেসে ওঠে। সেই বৃষ্টিভেজা বিকাল কি করে ভুলবে অবনি?
নিলয়ের হাসি… শেষ দিন অবনির দিকে নিলয়ের করুন দৃষ্টি… নাহ্, ওই চোখদুটি ভোলা যাবে না। মানুষটা অবনিকে ভালোবাসে তাকে কী করে কষ্ট দেবে?
মোবাইল হাতে তুলে কল দেয় নিলয়কে। এনগেইজড টোন বাজছে। একবার, দুইবার, বার বার। অস্থির হয়ে উঠে অবনি। অবনির অন্য কোথাও বিয়ে হলে নিলয় কষ্ট পাবে, অনেক কষ্ট পাবে। নিলয় কষ্ট পাক তা অবনি চায় না।
বুক ভার হয়ে আসছে। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন?
নিজেকে বুদ্ধিমতী ভাবা বোকা মেয়েটা একবারো বুঝলো না নাকউঁচু নিলয়ের ভালোবাসার সমুদ্রে নিজেও তলিয়ে গেছে।
চলবে।
ঝিনুক চৌধুরী।।