#দ্যা_লাস্ট_ব্লাড_মুন
#পর্ব_২০
#সারিকা_হোসাইন
ক্রমশ রাতের কুয়াশা বেষ্টিত ঘন অন্ধকার চারপাশের সবকিছু কে গ্রাস করে ফেলেছে।রাতের নিস্তব্ধতা নামার সাথে সাথে শীতের তীব্রতাও যেনো হুহু করে বেড়ে চললো।পাশের গহীন অরণ্য থেকে নেকড়ের পালের করুন হাউলিং শোনা যাচ্ছে।হয়তো এই ভারী হিমবাহ তারা সহ্য করতে পারছে না।বৃষ্টির ফোটার ন্যয় ঝরঝর করে সমানে ঝরে যাচ্ছে অধিক শীতল কুয়াশা।শীত নিবারনের ভারী কাপড় ছাড়া উষ্ণ শরীর খানা নিমিষেই জমে বরফ হয়ে যাবার উপক্রম।
কিন্তু এমন শীতল পরিবেশেও দরদর করে ঘামছে স্যান্ডি।প্রচন্ড পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ।বরফ গলা অধিক শীতল পানি ও বোধ হয় আজ তার এই পিপাসা মেটাতে পারবে না।চোখে তার ভয়ানক ভীতির ছাপ স্পষ্ট।পুরোটা শরীর তার থরথরিয়ে কাঁপছে।নিজের কান দুটোকে আজ তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।রাজকুমারী ম্যপল এর করুন পরিণতি চিন্তা করে তার মাঝারি আকৃতির নেত্র দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো।এই ভয়ানক স্তব্ধ অরণ্যে নিজের শ্বাসের শব্দ ও যেনো বিকট শব্দ মনে হচ্ছে।এই বুঝি কেউ দেখে ফেললো সব সময় এমন এক উপলব্ধি কাজ করছে তার মধ্যে।
ঘসঘসে কন্ঠে জেনারেল এইডেন শুধালো
“মহারাজ কি পদক্ষেপ নিবো এই মুহূর্তে?
স্যম কেলভিন ভয়ানক নেকড়ের মতো গর্জে বলে উঠলো
“হাতে আর দুটো দিন সময় আছে আর এর মধ্যে সিগমুন্ড এর মেয়ের প্রতি দরদ উথলেছে?ঠিক আছে আমিও দেখতে চাই কতো দরদ তার বুকে।সিগমুন্ড এর উষ্ণ কলিজা খুবলে দেখতে চাই আমার কথা অমান্য করার কত বড় ধৃষ্টতা সে অর্জন করেছে।আর কতদিন ই বা ওই ভীরু কাপুরুষ রাজকুমার এর রূপ ধরে থাকবো বলোতো এইডেন?
এইডেন গলার স্বর নিচু করে শুধালো
“সিগমুন্ড কে আপনার রাজ্যে ধরে নিয়ে আসবো?
“না এইডেন।আমি রাজকন্যা সহ ওই প্রাসাদ দখল করবো।শুধু একটা দিন অপেক্ষা করো।
এরপর দুজন পশু রূপী মানবের ফুঁস ফুঁস শ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না।
চতুর স্যান্ডি ঘটনার প্রকটতা উপলব্ধি করে নিঃশব্দে সেই স্থান ত্যাগ করলো।
হঠাৎই এইডেন উন্মাদের মতো গর্জে বলে উঠলো
“মানুষের গন্ধ আসছে কোথা থেকে?তবে কি কেউ শুনে নিয়েছে আমাদের কথা?
স্যম কেলভিন ছুটাছুটি করে চারপাশে নজর বুলালো।কিন্তু কোনো মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পেলো না।কিন্তু গন্ধের রেশ এখনো রয়ে গিয়েছে প্রবল ভাবে।
শেষমেশ নিজের ক্রোধ বহাল রেখে বজ্র কন্ঠে বলে উঠলো
“আজ রাতেই শেহজাদী কে আমার চাই।আজকের রাত লিও এর জন্য কাল রাত।কোনো ভাবেই শেহজাদীর করুন আত্মচিৎকার তার কানে প্রবেশ করবে না।সিগমুন্ড কে বধ করে ওই প্রাসাদের রাজা হবো আমি।ঐ প্রাসাদের প্রত্যেকটা মানুষকে শক্ত পাথরের মেঝেতে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করো এইডেন।
কথাগুলো বলে বিশ্ৰী হাসিতে ফেটে পড়লো স্যাম।এইডেন বুঝে গেলো তার মালিক কি চাচ্ছে।তাই মুখে ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে এইডেন বলে উঠলো
“রাতের দ্বিতীয় প্রহরে তবে নেকড়ের পাল প্রাসাদ ঘেরাও করুক।
স্যম হিসহিস করে বলে উঠলো
“অবশ্যই জেনারেল এইডেন।
********
আকাশের চাঁদ টা প্রায় ভরে গিয়েছে।এক দম ঝকঝকে আলো বিলাচ্ছে।গভীর কুয়াশা কোনো ভাবেই এই চাঁদের আলোকে ম্লান করতে পারছে না।বিশাল রাজকীয় বারান্দার রেলিং ধরে সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে ম্যাপল।চোখে তার বেদনা আর হতাশা মিশ্রিত জল।লিও কে ঘিরে জমেছে হাজারো অভিযোগ।
‘তবে কি তুমি আমাকে ধোকা দিলে লিও?তোমার প্রিয়তমার হৃদয়ের চিৎকার কি তোমার কাছে পৌছাচ্ছে না?নাকি পিচাশ দের কাজই সম্মোহনে সব আদায় করে নিয়ে ফেলে রেখে চলে যাওয়া?তোমাকে কোনোভাবেই অবিশ্বাস করতে চাই না আমি।কিন্তু মনের ভয়ে কিসব ভাবছি নিজেও জানিনা।
হঠাৎই গোলাপ বাগানের দিকে নজর গেলো মেপলের।স্যান্ডি দৌড়ে আসছে।স্যান্ডি কে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে।স্যান্ডির ভয় মিশ্রিত চলন বেশ বুঝতে পারলো ম্যাপল।ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষন নিজের মনে ভাবল
“প্রাসাদে কাউকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।স্যান্ডিকে এমন লাগছে কেনো?কি হয়েছে?নিজ চোখে দেখা চাই।
নিজের প্রতিরক্ষার বড় তলোয়ার নিয়ে শেহজাদীর দম্ভ নিয়ে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলো ম্যাপল।আজ সে কারো নিষেধ শুনবে না।পায়ের গতি বাড়িয়ে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে।প্রাসাদ প্রায় পুরোটাই খালি।সকলেই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে বোধ হয়।কয়েকজন প্রহরী ছাড়া আর কাউকেই সেভাবে চোখে পড়লো না।
ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই হুড়মুড়িয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করে মেপলের পায়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে ককিয়ে উঠলো স্যান্ডি।
এরপর দ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে কাঁপা অস্ফুট ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“জেনারেল এইডেন এবং রাজকুমার ফেলিক্স কেউই মানূষ নয় শেহজাদী।দুজনেই ভয়ানক নেকড়ে।তারা যুবরাজ লিও আর সম্রাট কে বধ করবার ফন্দি এটেছে।র/ক্তা/ক্ত পূর্ণিমার আগেই সেই নেকড়ে রাজ আপনাকে হরণ করবে শেহজাদী।আপনি এই প্রাসাদ ছেড়ে পালান।হাতে যে আর বেশি সময় অবশিষ্ট নেই।
এক দমে ভাঙা ভাঙা স্বরে কথা গুলো বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো স্যান্ডি।স্যানডির কথায় ম্যাপল যেনো শ্বাস নিতে ভুলে গেলো।শক্ত হাতে ধরে থাকা তলোয়ার খানা হাত ফসকে কখন পরে গেলো ম্যাপল তা টেরই পেল না।মুহূর্তেই ঝনঝন শব্দে আলোড়িত হলো নিস্তব্ধ প্রাসাদ।সম্বিৎ ফিরে পেতেই স্যান্ডিকে খামচে ধরে দাঁড় করালো ম্যপল।এরপর বিস্ফারিত নেত্রে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে শুধালো
“তুমি যা বলছো তা কি সঠিক স্যান্ডি?
ভীত স্যান্ডি কথাই বলতে পারছে না।তবুও মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠলো
“আমি স্বচক্ষে দেখেছি রাজকুমারী।আর রাজকুমার ফেলিক্স নয় ওটা।সে রাজকুমার ফেলিক্স এর রূপ ধারণ করেছে।
স্যান্ডির মুখের নির্মম ভয়ানক সত্য শুনে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেললো ম্যাপল।সে স্যান্ডিকে বগল দাবা করে ছুটে চললো সিগমুন্ড এর কক্ষের দিকে।আজ যে করেই হোক ওই মানুষ রূপী নেকড়ে জেনারেল এইডেন কে একটা কঠিন শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে সে।
*******
নিজের কাজ কর্ম শেষে কেবলই বিছানার দিকে অগ্রসর হতে যাচ্ছেন সম্রাট সিগমুন্ড।এমন সময় দরজায় ভারী আঘাত হলো।
ভ্রু কুঁচকে ধমকে উঠলেন সিগমুন্ড
“এ ওখানে?
“পিতা মশাই আমি।দরজা খুলুন।
এই অসময়ে হঠাৎ মেয়ের আগমনের হেতু বোধগম্য হলো না মাঝ বয়সী সিগমুন্ড এর।দ্রুত পদে দরজার দিকে এগিয়ে খুলে দিলেন কক্ষের ভারী দরজা।
ক্রোধিত কন্যা আর ভীত দাসী কে দেখে সিগমুন্ড বেশ অবাক হলেন।সেই সাথে মেয়ের পানে তাকিয়ে শুধালেন।
“কি হয়েছে ম্যাপল?
“পিতাজী জেনারেল এইডেন কোনো মানুষ নয়।সে একজন নেকড়ে।
কোন প্রকার ভনিতা না করে ঝনঝন গলায় কথাটা বলে সিগমুন্ড এর চোখে চোখ রাখলো ম্যপল।
কিন্তু নিজ কন্যার মুখে এমন নির্বোধ কথা শুনে বেশ বিরক্তি প্রকাশ সিগমুন্ড।গম্ভীর কন্ঠে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন
“এই গভীর রাতে এসব রূপকথার গল্প বলতে এসেছো তুমি শেহজাদী?
পিতার গলার উপর আরো খানিক গলা চড়িয়ে ম্যাপল বলে উঠলো
“আমি নিজ চোখে দেখেছি এবং স্যান্ডি তার প্রমান।
এবারো পাত্তা না দিয়ে সিগমুন্ড বলে উঠলেন
“রাতে ঠিক মতো না ঘুমানোর কারনে হ্যালসিনেশন হয়েছে তোমার।তোমার চিকিৎসা প্রয়োজন।যাও নিজের কক্ষে যাও আর রাজকুমার ফেলিক্স কে বিবাহের জন্য নিজেকে তৈরি করে নাও।
সিগমুন্ড এর এহেন হেঁয়ালি কথায় ক্রোধে ফেটে পড়লো ম্যাপল সেই সাথে জ্বলে উঠলো তার হাতে থাকা চিহ্নটি।
সিগমুন্ড এর চোখে চোখ রেখে ম্যপল বলে উঠলো
“অশুভ শক্তি এবং বহুরূপী প্রাণী চাইলেই তো বধ করতে পারবো তাই না পিতাজী?
মেয়ের এমন অসঙ্গত কথাবার্তা কিচ্ছুটি বুঝে উঠতে পারছেন না সিগমুন্ড।কিন্তু ম্যাপল কে মোটেও সাধারণ ভাবে নেয়া যাচ্ছে না।তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আসলেই কিছু একটা হয়েছে।
“জেনারেল এইডেন কে আমার সামনে আনার ব্যবস্থা করুন পিতাজী।তাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই।
সিগমুন্ড ভ্রু কুঁচকে শুধালেন
“একজন পরপুরুষ কে স্পর্শ করবে তুমি?
“সে তো পুরুষ ই নয় বাবা।
সিগমুন্ড বুঝলেন মেয়ে পুরোটাই পাগলের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে।কারঙ এইডেন তার বিশ্বস্ত একজন সেনাপতি।নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে বহুবার এইডেন তাকে রক্ষা করেছে।এইডেন আছে বলেই রাজ্যের মানুষকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা হয় না।প্রতিটি রাতে শান্তি নিদ্রা যাপন করতে পারেন তিনি।তবুও কাওকে কিছু না বুঝতে দিয়ে মেয়ের ভুল ধারনা প্রমাণের লক্ষে দাস মারফত খবর পাঠানো হলো
“জেনারেল এইডেন কে এক্ষুনি আমার সভাষদে আসার হুকুম করো।
*******
চারপাশে সতর্ক নজর বুলিয়ে কেবলই প্রাসাদে প্রবেশ করেছে এইডেন।আজ রাতেই এই প্রাসাদ তাদের দখলে চলে যাবে।পুরো প্রাসাদ রঞ্জিত হবে দুর্বল মানুষ গুলোর লাল তরলে।শেহজাদী ম্যাপল হবে নেকড়ে সাম্রাজ্যের রানী।আদৌ কি তাকে রানীর মর্যাদা দেবার জন্য এই যুদ্ধ?নাকি এর পিছনে আরেক উদ্দেশ্য?কিন্তু যেখানে নিজের জোড়া হিসেবে ড্যাজেন রয়েছে তারপরও স্যাম কেলভিন কেনো এই সাধারণ মানবী তে মজেছে?নাকি হাতিয়ার হাতে এলেই ভক্ষণ করা হবে শেহজাদীর উষ্ণ নরম মাংস?
রাতের ভয়াবহতা মনে মনে ভাবে হো হো শব্দে হেসে উঠলো এইডেন।সেই হাসি ঝংকার তুললো বদ্ধ কামরায়।হঠাৎই দরজার করাঘাতে হাসি থামিয়ে উঁচু গম্ভীর আওয়াজে শুধালো এইডেন
“কে ওখানে?
অপেক্ষারত ভৃত্য নিচু স্বরে বলে উঠলো
“সম্রাট আপনাকে তার সভাষদে ডেকেছেন জেনারেল এইডেন।
এতোরাতে সম্রাট তাকে ডেকেছে ভাবতেই ভ্রু কুঁচকে নাক ফুলে উঠলো এইডেন এর।তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে নিজের তলোয়ার সমেত বেরিয়ে এলো এইডেন।
সভাষদে পৌছেই রাজকুমারী আর সিগমুন্ড কে এক সাথে দেখে সামান্য ভড়কে গেলো এইডেন।ধরা পড়ে যাবার অজানা ভয়ে হৃদয় ধক করে উঠলো
তবুও ভালো মানুষির মুখশে নিজেকে আবৃত করে আজ্ঞাবাহী দাসের ন্যায় বলে উঠলো
“হুকুম করুন সম্রাট”
এইডেন এর পানে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন সিগমুন্ড।এরপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলেন
“আগামী কাল ই শেহজাদীর বিবাহের আয়োজন করতে চাচ্ছি জেনারেল।শেহজাদী কে রাজকুমার ফেলিক্স এর প্রাসাদে নিয়ে যাবার বহর তৈরি করো।
নিজের পিতার এহেন মুখর্তামি দেখে সহ্য করতে পারলো না ম্যাপল।ক্রোধে হিংস্র হয়ে দ্রুত পদে এসে চেপে ধরলো এইডেন এর ঘাড়।জীবন্ত হলো হাতে থাকা রাজকীয় চিহ্ন।মুহূর্তেই গগন বিদারী হুংকারে পুরো প্রাসাদ কেঁপে উঠলো।স্থির হয়ে গেলেন সম্রাট সিগমুন্ড আর স্যান্ডি।নির্বিকার ম্যাপল।এমনটা যেনো হবারই ছিলো।
দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো এইডেন এর পুরো শরীর।আহত হয়ে দূরে ছিটকে পড়লো এইডেন।মুহূর্তেই মানব রূপ হারিয়ে নেকড়ে তে পরিণত হয় গড়গড় করে এলোমেলো দুর্বল পায়ে হিংস্র নজরে চক্কর কাটতে লাগলো।কিন্তু শরীর বোধ হয় সায় দিলো না।বিশাল দেহি পোক্ত যুবক নিমিষেই লোমশ পশু রূপে পরিবর্তিত হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।মেয়ের এহেন সাহসে মুখের ভাষা হারালেন সিগমুন্ড।শুধু চিৎকার করে ডেকে উঠলেন
“কে কোথায় আছো বন্দি করো এই পশু টাকে।
#চলবে
“অপনাকে সারা জীবনের জন্য মুক্ত করে দিয়ে আমি গ্রামে ফিরে যাবো হিমাদ্র চৌধুরী।আমাদের আর কখনো দেখা হবে না।আপনার প্রতি আমার এক পাক্ষিক ভালোবাসার অবসান হতে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত।মায়া বড় অদ্ভুত জিনিস।জানিনা কখনো আপনার জন্য যেই মায়া আমার মনে আছে তা কাটিয়ে উঠতে পারবো কিনা।ভালো তো সবাইকেই বাসা যায়।তাই বলে কি সবার উপরেই মায়া জন্মায়?
কাঁপা কাঁপা আহত স্বরে কথা গুলো বলে মুখ নিচু করে ফেললো চড়ুই।তার রক্তিম আভা ছড়ানো কপোল বেয়ে নোনা জলের ধারা ছুটছে অবিরত।চড়ুইয়ের এহেন নিষ্ঠুর কথা হিমাদ্রের কলিজায় বিষাক্ত তীরের ফলার ন্যায় বিধলো।মুখে জমানো কথা নিমিষেই হারিয়ে গেলো।কন্ঠনালী রোধ হয়ে শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো।অসহনীয় যন্ত্রনায় মাথার প্রতিটি নিউরন চিরবিড়িয়ে উঠলো।
তবুও নিজেকে শান্ত রেখে নিজের উষ্ণ দুই হাতের আজলায় চড়ুই এর ছোট মুখ খানি ভরে নিজের মুখের সামনে মেলে ধরলো।এরপর চড়ুই এর কান্নারত চোখের পাতায় ঠোঁট ছোয়ালো হিমাদ্র।হিমাদ্রের ভালোবাসার পরশে হু হু করে কেঁদে উঠলো চড়ুই।
“আপনাকে ভালোবেসে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি হিমাদ্র।আমার বুকের এই খানটা প্রতিনিয়ত যন্ত্রনায় দগ্ধ হয়েছে।বেদনার নীল কষ্টে জর্জরিত হয়েছে পুরোটা শরীর।আপনি কখনো সেই খবর রাখেন নি।আমার প্রতি আপনার এতোই ঘৃণা আপনি আমার মুখটা পর্যন্ত দেখলেন না”
কাঁদতে কাঁদতে নিজের দুই হাতের তালু দিয়ে পুরো মুখমন্ডল ঢেকে ফেললো চড়ুই।আজ যেনো কোনো ভাবেই মনের দুয়ারে খিল দেয়া যাচ্ছে না।সব দুঃখ ভেঙে চূড়ে আন্দোলন করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।কান্নার লাগাম ও টানা যাচ্ছে না।
চড়ুইয়ের কান্নায় হিমাদ্রের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলো।বলার মতো কোনো ভাষা অবশিষ্ট রইলো না।হিমাদ্রের মনে হলো চড়ুইয়ের এই আহাজারি থেকে একমাত্র মৃত্যুই পারে হিমাদ্র কে মুক্তি দিতে।কিন্তু হিমাদ্র মরতে চায়না।চড়ুইকে বুকে জড়িয়ে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ভালোবাসতে চায়।কিন্তু কি বলে চড়ুইকে মানিয়ে নেবে সে?মেয়েটা তো আজ বাধন হারা!
কিছুক্ষন কেঁদে কেটে নিজেকে শান্ত করলো চড়ুই।এরপর সিক্ত কন্ঠে করুন আবদারে বলে উঠলো
“আপনাকে কি একটাবার জড়িয়ে ধরতে পারি হিমাদ্র?
“এই ইট পাথরের কঠিন শহরে সব কিছুই হয় শুধু একই ছাদের নিচে থেকেও আপনার আর আমার দেখা হয় না।আমাকে একটু ভালোবাসলে কি হয় হিমাদ্র?
“না চাইতেও যেই মেয়েটা জীবনের সাথে হুট করে জুড়ে গিয়েছে তার কোনো দোষ নেই।কিন্তু যাকে রুচিতেই টানছে না তার সাথে জোর করে সংসার হবে কিভাবে?”
“পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবার সাথে সাথেই আপনাকে আমি একপাক্ষিক ভালোবেসে ফেলেছি অথচ আপনি আমাকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখলেন না।
“যে করেই হোক তোমাকে আমি বিদেয় করবো মেয়ে”
“আপনাকে মুক্তি দিয়ে আমি আবার গ্রামে ফিরে যাবো হিমাদ্র।আপনি ই ঠিক ছিলেন।জোর করে কখনো সংসার হয় না।
চলবে।
#দ্যা_লাস্ট_ব্লাড_মুন
#পর্ব_২১
#সারিকা_হোসাইন
বিশাল এক চিড়িয়া ধরার শক্ত লোহার খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়েছে নেকড়ে রূপী এইডেন কে।বৃহৎ শরীরের প্রায় বেশি জায়গা জুড়েই ভয়ানক ক্ষত সেই সাথে পুড়ে গিয়েছে পশমী চামড়া সমেত মাংস।চূড়ান্ত কাবু হয়ে গর্জে চলেছে সমানে।এইডেন এর খাচাকে কেন্দ্র করে প্রাসাদের সকল মানব মানবীর বিস্ময়ের শেষ নেই।একটা খতরনাক মাংসাশী পশু এতদিন তাদের মধ্যে বাস করেছে অথচ এই চূড়ান্ত সত্যি টা ঘূর্ণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি এটা যেনো তাদের কাছে কল্পনাতীত।থেকে থেকেই এইডেন গড়গড় করে গর্জে উঠছে।সেই গর্জনে কেঁপে উঠছে প্রাসাদের সকল মানুষ।কিন্তু ভাবলেশ ভীতি হীন ম্যাপল।তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে এসব দৃশ্য যেনো সে আগেও উপভোগ করেছে।
“ওরা প্রাসাদের সকলকে হ/ত্যা করার পরিকল্পনা করেছে সম্রাট।
ভীত কাঁপা কন্ঠে কথাটি বলে চোখ মুখ খিচে নিজের শরীরের কাঁপুনি রোধ করার চেষ্টা করলো স্যান্ডি।কিন্তু এইডেন এর গর্জনে স্যান্ডির পুরো শরীর অসাড় হয়ে এলো সেই সাথে নিজের প্রানের ভয়ে হাটু ভেঙে ধুলো যুক্ত মেঝেতে বসে গেলো স্যান্ডি।
সম্রাট সিগমুন্ড ভেবেই পাচ্ছেন না এতো এতো যুগ পরে হঠাৎ তার প্রাসাদেই কেনো এমন ভয়ানক প্রাণী হামলা করবে?..যেই প্রাণীর গল্প কেবল রূপকথার কাহিনীতে শোনা গিয়েছে সেই প্রাণী এই উনিশ শতাব্দীতে কি করে এলো?আর তার প্রাসাদের মানুষের সাথেই এই প্রাণী গুলোর কিসের বৈরিতা?
স্যান্ডি পুনরায় ভীত নিভু নিভু স্বরে বলে উঠলো
“শেহজাদী কে হাসিল করাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য সম্রাট সিগমুন্ড।শেহজাদী যার কাছে থাকবে সে হবে অমর ,এমনটাই নিজ কানে তাদের কথোপকথন এর অংশ বিশেষ শুনেছি আমি।
দাসী স্যান্ডির মুখে এমন ভয়ানক কথা শুনে সকলেই অবাক মিশ্রিত আতঙ্কিত চোখে মেপলের দিকে নজর বুলালো। সেই সাথে সকলের মনে গভীর ভাবনার উদ্রেক হলো একই সাথে
“কি আছে এই শেহজাদীর ভেতরে?একটা সাধারণ মানবী আবার কোনো পশুকে কিভাবে অমরত্ব দান করবে?
সম্রাট সিগমুন্ড মেয়ের পানে নজর বুলিয়ে অপরাধীর স্বরে বলে উঠলেন
“আমি সত্যি অন্ধ ম্যপল।পিতা এবং শাসক দুই হিসেবেই আমি ব্যর্থ।আমাকে তুমি ক্ষমা করো।আমি শুধু নিজের দিকটায় ভেবে গিয়েছি।আমি কখনো তোমাকে বুঝতে চাইনি।তোমার মাকে দেয়া কথাও আমি রাখতে পারিনি।তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তোমাকে বুকের মধ্যে খানে খুব করে আগলে রাখবো।কিন্তু দেখো !তোমার চারপাশে এতো এতো বিপদের হাতছানি অথচ আমি কিচ্ছুটির খবর রাখিনি।
কথাগুলো বলতে বলতে সিগমুন্ড এর গলা ধরে এলো।সে আরো কিছু অনুতাপ মিশ্রিত বাণী আওড়াতে চাইলো কিন্তু পিতার এহেন অপরাধকে প্রশ্রয় না দিয়ে শক্ত কন্ঠে ম্যাপল বলে উঠলো
“এসব বলার সময় এখন নয় বাবা।সামনে ভয়াবহ বিপদ আসতে চলেছে।জানিনা প্রতিপক্ষ কোন দিক থেকে প্রথম আঘাত হানবে।আমার মনে হচ্ছে এইডেন ছাড়াও প্রাসাদে তাদের আরো গুপ্ত চর রয়েছে।এইডেন এর এমন পরিণতি অবশ্যই এতোক্ষনে তাদের কানে পৌঁছে গিয়েছে ।আপনি সকল সেনাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলুন।আমার কাছে কিচ্ছুটি স্বাভাবিক ঠেকছে না।
ছোট মেপলের মুখে এমন বিচক্ষণ কথা দেখে বেশ অবাক হলেন সিগমুন্ড শুধুবটাই নয় অবুঝ বাচ্ছার ন্যয় চুপ করে অপলক তাকিয়ে রইলেন কন্যার শুভ্র তেজী মুখের পানে।
আচানক যুদ্ধের প্রস্তুতি কেনো নিতে হবে এটাই বুঝতে পারছেন না তিনি।পশুর ও তো জীবনের মায়া রয়েছে তাই নয় কি?চাইলেই কি দলবদ্ধ হয়ে কতগুলো পশু প্রাসাদে প্রবেশ করতে পারবে?তবুও মেয়ের কথাকে প্রাধান্য দিয়ে জরুরি তলবে প্রাসাদের সকল সেনাকে একত্রিত করলেন সম্রাট সিগমুন্ড।এরপর সকলের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন
“ভয়ানক নেকড়ের পাল প্রাসাদে হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।ইতোমধ্যে আমরা তাদের গুপ্ত চর রূপী এক নেকড়ে কে বন্দি করতে সক্ষম হয়েছি।তাদের মূল উদ্দেশ্য রাজকুমারী কে হরণ করে নিয়ে যাওয়া।আমি জানিনা আমার কন্যার সাথে তাদের কি শত্রুতা।তাই তোমাদের আদেশ করছি তোমরা সবাই নিজেদের অবস্থান থেকে সতর্ক থাকো।মনে রেখো এই রাজ্য এবং রাজকুমারী দুই ই রক্ষা করা তোমাদের দায়িত্ব কর্তব্য এবং তা রক্ষার্থে তোমরা নিজেদের উৎস্বর্গ করতে বাধ্য।
সম্রাট কে কথা শেষ করতে না দিয়েই এক সেনা আজ্ঞা ভরা তেজী গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো
“আপনি কোন চিন্তা করবেন না সম্রাট।আমরা নিজেদের প্রাণ দিয়ে দেবো তবুও রাজকুমারীর গায়ে একটা ফুলের আঁচড় লাগতে দেবো না।
সেনাদের কথায় সিগমুন্ড এর বুক ভরে উঠলো সেই সাথে চোখ উপচে জল এলো।এরকম একটা দিন তাকে দেখতে হবে এটা তিনি কখনো ভাবেন নি।স্ত্রীকে হারিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে রাজ্যের মানুষ জন নিয়ে বেশ সুখেই আছেন তিনি।হঠাৎ এমন অহেতুক মুসিবত কোনো ভাবেই মানতে পারছেন না তিনি।এইডেন কে দেখেই তাদের হিংস্রতা সম্পর্কে অনুমান হয়ে গিয়েছে।এই অদ্ভুত পশু সম্পর্কে না আছে কোনো জ্ঞান না আছে তাদের প্রতিহত করার ব্যবস্থা।কিভাবে কন্যাকে রক্ষা করবেন এটাও তার অজানা।মেয়ের জীবন রক্ষার্থে এতদিন মিছে পিচাশ সত্তার আগমন নিয়ে পরে ছিলেন তিনি।কই চার্চের সেই ফাদার এই ভয়ানক পশু সম্পর্কিত কিছু তো তাকে কখনো বলে নি!
সবকিছু গভীর ভাবে চিন্তা করে সিগমুন্ড অস্থির হয়ে উঠলেন।এই কন্যা তার কাছে আমানত স্বরূপ।বিধাতা খুশি হয়ে এমন পবিত্র কন্যা তাকে উপহার দিয়েছেন।এমনকি আগের জন্মে বিশাল এক রাজ্যের রাজকুমারী ছিলো এই মেয়ে সেই বিষয়েও সিগমুন্ড অবগত।
“তবে কি এই শত্রুতা পূর্ব জন্মের?
******
ধীরে ধীরে ধরনীতে রাতের গভীরতা নেমে আসছে সেই সাথে পুরো আকাশ ভয়ানক ভাবে কালো মেঘে ঢেকে গেলো।পুরো প্রাসাদ জুড়ে আতঙ্ক জনিত অস্থিরতা।কারো চোখে বিন্দু মাত্র ঘুমের উপস্থিতি নেই।তীব্র শীতের মধ্যেও সকলের কপাল আর চিবুক বেয়ে যেনো ঘামের ফোয়ারা ঝরছে।সবাই জটলা পাকিয়ে ঈশ্বর এর নাম জপে যাচ্ছে শুধু।।
প্রাসাদের বাইরে কি ঘটনা ঘটছে তা দেখার জন্য ম্যাপল নিজ কক্ষে চলে এলো।সতর্কতার সহিত ভারী পর্দার আড়ালে লুকিয়ে কালো গোলাপের বাগানের দিকে নজর দিলো সে।কালো গোলাপের বাগানের পাশ ঘেঁষেই ভাঙা যেই প্রাচীর ওই প্রাচীর ভেদ করে অদুরের গহীন জঙ্গল নজর কাড়ে।এইডেন কে সেদিন এই পথ ধরেই আসতে দেখেছে সে।দীর্ঘ সময় ধরে শকুনি নজর তাক করে রেখেও সন্দেহ জনক কিচ্ছুটি চোখে পড়লো না তার।সহসাই লিও এর কথা মনে পড়তেই হৃদয় খানা ধক করে উঠলো।নিজ মনে ম্যাপল বলে উঠলো
“দুটো দিন তোমাকে দেখি নি,অথচ মনে হচ্ছে দুটো যুগ চলে গিয়েছে।আমি ভালো নেই লিও।জানি না কি হতে চলেছে।কিন্তু খুব ভয় লাগছে।হাজার বছরের অপেক্ষার বুঝি অবসান কখনোই হবে না!স্যাম কেলভিন পুনরায় কুৎসিত খেলায় মেতে উঠতে চাইছে।পূর্বের ন্যায় সে আবার প্রাসাদে হামলা চালাতে চাইছে।মানুষ রূপী এই নেকড়ের সাথে আমাদের শত্রুতা আর মোহের শেষ কোথায়?এবারও কি তবে অতৃপ্ত হৃদয় নিয়ে তোমাকে ছাড়াই অকাল কালো নিদ্রায় পাড়ি জমাতে হবে?আমি আমার নিজের জন্য ভাবছি না।তোমার জন্য যে আমার অন্তর পুড়ে ছাই হচ্ছে লিও।আমার পূর্ব জন্মে দেয়া প্রতিশ্রুতি আমি বোধ হয় এবারও রাখতে পারবো না।আর এটাই আমার শেষ পুনর্জন্ম।
নিজের এতোগুলো জীবনের কঠিন সমাপ্তির কথা ভেবেই ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো ম্যাপল।হাতে থাকা এই চিন্হ টা জাগ্রত হবার সাথে সাথেই পূর্বের সকল ঘটনা গুলো একদম ঝকঝকে চিত্রের ন্যয় মনে পরে গিয়েছে তার।প্রত্যেক বার খুব করুন ভাবে মৃ/ত্যু হয়েছে তার।লিও কে কখনোই পাওয়া হয়নি।তবে কি এবারও?
লিও কে পাওয়া হবে না ভেবেই ছোট হৃদয় খানা খা খা করে উঠলো।সেই রাতের মিষ্টি মধুর চুম্বন আর উষ্ণতা বিনিময়ের কথা মনে পড়তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ম্যপল।লিওকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু স্বপ্ন দেখে ফেলেছে সে।তবে কি সব অপূর্ণই রয়ে যাবে বছরের পর বছর ধরে?
অশ্রু মিশ্রিত তপ্ত শ্বাস ছাড়তেই ভাঙা প্রাচীরের দিকে কিছু একটা নড়তে দেখলো ম্যপল।ঘন কুয়াশা বেষ্টিত অন্ধকারে ঠাহর করা গেলো না জিনিসটি কি।কিন্তু ম্যাপল ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়।একটা নেকড়ের কাছে সে কখনো নিজেকে সপে দেবে না।ওই নেকড়ে রাজের একটা ব্যবস্থা করে তবেই ক্ষান্ত হবে সে।যদি ঐ নেকড়ের সাথে শক্তিতে পেরে না উঠে তবে দরকার পড়লে নিজেকে নিজেই শেষ করে দেবে সে।যেই হৃদয়ে লিও নামক পেরেক ঠুকা হয়েছে হাজার বছর আগে সেই হৃদয়ের নাগাল আর কাউকে পেতে দেবে না সে।আর একটা পশু কখনো কাউকে ভালোবাসতে জানে না।সেতো কেবল নিজের ক্ষুধা নিবারনের তাগিদে মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়।তার মনে প্রেম প্রীতি থাকলে সে কি আর হিংস্র পশু হতো?
রাত কতো গড়ালো ম্যপল জানেনা।প্রাসাদের ভেতরেও সকলে ওঁত পেতে বসে আছে।একটা প্রাণীর সাথে কিভাবে যুদ্ধ করতে হয় এটা তাদের অজানা।এইডেন এর আকৃতি দেখে এতটুকু উপলব্ধি হয়েছে যে প্রাণী গুলো বিশাল দেহের অধিকারি সেই সাথে অপরিমেয় শক্তিশালী।শক্তির চাইতে বুদ্ধির খেলায় জিততে হবে এদের সাথে।
স্যান্ডি অন্যান্য দাসীকে জড়িয়ে সেই যে মেঝেতে পা গুটিয়ে বসেছে এখনো সেই অবস্থাতেই বহাল আছে।
রাতের দ্বিতীয় প্রহর গড়াতেই গড়গড় শব্দে চারপাশ উদ্বেলিত হলো।যারা কিছু সময়ের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলো এমন ভয়ানক গর্জনে ধরফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলো।
কারোর বোধগম্য হচ্ছে না এতো গভীর রাতে নেকড়ে গুলো এই প্রাসাদে কি খেলা খেলতে চাইছে।বাইরে থাকা কুকুর গুলো ভয়ানক ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ম্যপল দেখতে পেলো ধীরে ধীরে লোমশ বৃহৎ পশুর পাল প্রাসাদ অভিমুখে এগিয়ে আসছে।মুহূর্তেই তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো।এক মুহূর্তের জন্য ভয়ে ম্যাপল স্থির হয়ে উঠলো।একজন শেহজাদী হিসেবে যেসব যুদ্ধ কৌশল তার শেখা উচিত এগুলো সম্রাট সিগমুন্ড কিচ্ছুটি শিখায় নি তাকে।জন্ম থেকেই এক প্রকার ঘর বন্দি সে।লেখাপড়ার শিক্ষাটা বাদে আর কিছুই নেই তার।এতো এতো পশুর সাথে যুদ্ধ হবে কি রূপে,?
ভাবনা ফেলে বেলকনির দরজা নিঃশব্দে আটকে দিয়ে দ্রুত পদে নীচে নেমে এলো ম্যাপল।ইতিমধ্যে প্রাসাদের ভেতরে সকলে এলোমেলো ছুটাছুটি শুরু করে দিয়েছে।নিরুপায় হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন সিগমুন্ড।পিতার এহেন দুরবস্থা দেখে সকলকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলে উঠলো ম্যপল
‘ড্র ব্রিজ থেকে শুরু করে প্রাসাদে প্রবেশের সকল পথ বন্ধ করা হোক।কোনো ভাবেই যেনো ওই পশুর দল ভেতরে আক্রমনের জন্য এগুতে না পারে।
এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা এতো সময় কারোর মাথাতেই আসেনি।শেহজাদীর আদেশ পাওয়া মাত্র সকল দ্বার রক্ষী ছুটলো সমস্ত দরজা বন্ধ করতে।কিন্তু খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি কি?
নেকড়ের গর্জন খুব নিকটে।সেনারা নিজেদের ঢাল তলোয়ার হাতে নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।
ম্যাপল পুনরায় বলে উঠলো
“হাতি শালের হাতি গুলো ছেড়ে দেয়া হোক,আর সকল তীরন্দাজ কে অগ্নি বারুদ মিশ্রিত তীর নিক্ষেপের আদেশ জারি করা হলো।
নিজের কন্যাকে যেনো চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছেন না সিগমুন্ড।যাকে এসব বিষয়ে কোনো শিক্ষাই দেয়া হয়নি কোনো দিন সে আবার এসব পটুতা কিভাবে দেখাচ্ছে?
রাজকুমারীর আদেশ মতো প্রাসাদের ছাদে দৌড়ে চলে গেলো পাকা হাতের তীরন্দাজ।কেউ কেউ বেশ ভীত হলো।কিন্তু এখন নিজের ভীরুতা প্রদর্শনের সময় নয়।
প্রাসাদের চারপাশ ঘিরে রেখেছে হাজার হাজার নেকড়ে।প্রাসাদের ভেতর ঢুকার জন্য সমানে ভয়াবহ গর্জন করে চলেছে তারা।সেই নেকড়ের গর্জনের সাথে মিলিয়ে ভেতর থেকে হাউলিং করে উঠলো এইডেন।দুর্বল আধ মরা এইডেন যেনো মুহূর্তেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো।খাঁচার ভেতর থেকেই সমানে বড় বড় দাঁত খেচিয়ে উঠলো সকলের উদ্দেশ্য।
এদিকে প্রাসাদের ভেতর প্রবেশের প্রধান যেই পানির উপরের কাঠের ব্রিজ সেটা কোনো ভাবেই সেনারা উপরে তুলতে পারছে না।বরাবর এই কাজ এইডেন এক হাতে সামলাতো।আজ তারা এতোগুলো মানুষ এই কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।শক্তি প্রয়োগ ঘাড়ের রগ ছিড়ে যাবার উপক্রম অথচ ব্রিজ উপরে উঠছে না।এদিকে নেকড়ে রা হিংস্র হয়ে দিকবিদিক প্রাসাদে ঢোকার রাস্তা খুঁজে চলেছে।অবশেষে এক পাল নেকড়ে চোখের পলকে হামলে পড়লো ড্র ব্রিজের শিকল ধরে রাখা সেনা দের উপর।নিমিষেই তাদের ধারালো নখের সাহায্যে ফেঁড়ে ফেললো বুকের পাটা।অসহনীয় গগন বিদারী চিৎকারে পুরো প্রাসাদ ছেয়ে গেল সেই সাথে বাড়তে লাগলো আতংক।
শতশত নেকড়ের পাল ঢুকে গেলো প্রাসাদের ভেতর।তাদের খুরের মতো ধারালো নখের কাছে মানুষ যেনো ছোট মুরগি।
তীরন্দাজ এর তীর ও যেনো আজ তাদের প্রতিহত করতে পারছে না।
সম্রাট সিগমুন্ড নিজ হাতে তলোয়ার তুলে নিলেন।এগিয়ে এলেন আরো কয়েকশত সেনা।শেহজাদী নিজেও এগিয়ে এলো তলোয়ার হাতে।চোখে তার যেনো আগুনের স্ফুলিঙ্গ ঝরছে।দিকবিদিক সিগমুন্ড এর সামনে থেকে আক্রমণাত্মক এক নেকড়ের শরীর থেকে ধর আলাদা করে ম্যাপল গর্জে উঠে বলে উঠলো
“সম্রাট সিগমুন্ড আপনি নিজের কক্ষে ফিরে যান।এখানে থাকলে বেঘোরে প্রাণ হারাবেন।
মুহূর্তের জন্য সিগমুন্ড এর মনে হলো এটা তার মেয়ের কন্ঠ স্বর নয়।আর যাকে সে অগ্নি মূর্তি রূপে চোখের সামনে তলোয়ার হাতে নেকড়ের সাথে লড়তে দেখছে এটা তার মেয়েও নয়।
মুহূর্তেই পুরো প্রাসাদ রণক্ষেত্রে পরিণত হলো।এইডেন এর গর্জন খুব করে কানে লাগলো ম্যাপল এর।মশালে করে আগুন নিয়ে ছুড়ে মারলো এইডেন এর খাঁচায়।মুহূর্তেই এইডেন এর সারা শরীর আগুনে ছেয়ে গেলো।দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো এইডেন।কিছুক্ষন আগের ভয়ানক গর্জন করুন আর্তনাদে পরিণত হলো।সময়ের ব্যবধানে পুড়ে ছাই হলো এইডেন।কিন্তু কেউ তার খবরই রাখলো না।
আগুনের ভয়ে ধীরে ধীরে নেকড়ে গুলো মানুষের রূপে ফিরে এলো।তাদের পেশির শক্তিবলে ধরাশায়ী হলো সাধারণ সেনা।একে একে লাশের স্তুপ পরে গেলো প্রাসাদের চারপাশে।দুর্বল দাসী গুলোকেও ছাড় দিলো না ভয়াবহ নেকড়ে।হঠাৎই লক্ষ্য করা গেলো তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে সেই নেকড়ের দাসে পরিনত হচ্ছে সাধারণ সেনার দল এবং তারা নিজেরাই নিজেদের আঘাত করে আত্মহুতি দিচ্ছে।
কারোর আর বুঝতে বাকি রইলো না এরা সকলেই মায়া নেকড়ে।চোখের মায়ায় সাধারণ মানুষকে দাস বানানোর অসীম ক্ষমতা রয়েছে তাদের।এবার বেশ ঘাবড়ে গেলো ম্যাপল।নিজের গাউনের মোটা ফিতা ছিড়ে এনে চোখে বেঁধে চালাতে লাগলো তলোয়ার।
হঠাৎই পাশ থেকে পরিচিত সম্মোহিত স্বরে কেউ বলে উঠলো
“হাজার বছর পরে তোমার দেখা পেলাম ক্যারোলিন ডিসৌজা”
কণ্ঠটি কার বুঝতে সময় নিলো না ম্যাপল।সাই সাই শব্দে হাতের কৌশলে তলোয়ার ঘুরিয়ে মানুষটির পানে তাকিয়ে ম্যপল তাচ্ছিল্য হেসে গর্জে উঠা কন্ঠে বলে উঠলো
“এবার তবে মৃ/ত্যু/র প্রতীক্ষা গুনতে থাকো নেকড়ে রাজ স্যাম কেলভিন।
#চলবে
#দ্যা_লাস্ট_ব্লাড_মুন
#পর্ব_২২
#সারিকা_হোসাইন
*******
কুয়াশার সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমশ ভারী বাতাসের শো শো আওয়াজ বেড়ে চলছে।পুরোটা আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়ে ধরণী কে করেছে কুৎসিত।চিরচেনা আবহাওয়া মুহূর্তেই বৈরী রূপ ধারণ করলো।দেখে মনে হচ্ছে খুব করে তুষার ঝড় উঠবে।প্রাসাদের সুউচ্চ টাওয়ার এর উপর দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এহেন বিধস্ত অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো লিও এর।মুহূর্তেই দুই চোখ ফেটে উপচে লালচে রক্তের ধারা ছুটলো।ভয়ানক গর্জে উঠে মনের জমানো কষ্ট গুলো কে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে চাইলো লিও।এর পর আক্ষেপ মেশানো আহত কন্ঠে চিৎকার করে বলে উঠলো
“আজকের এই রাতে আমাকে ছেড়ে তুমি চলে গিয়ে ছিলে ক্যারোলিন।যেদিন তুমি বিদায় নিলে সেদিন রাতেও ঠিক এমন বৈরী রূপ ছিলো ধরণীর।হাজার বছর পরে আজ কেনো আবারো সেই একই বৈরিতা?কি ঘটতে চলেছে আজ?
মুহূর্তেই অজানা আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠলো লিও এর কঠিন হৃদয়।কুণ্ডুলি পাকিয়ে ঝড়ের বেগে প্রাসাদে প্রবেশ করে ডেকে উঠলো
“মা”
এমিলি প্রাসাদেই ছিলো।রক্ত পূর্ণিমার আগের রাতটি সকল ভ্যাম্পায়ার দের জন্য নিষিদ্ধ রাত।এই রাতে তাদের শক্তি হঠাৎই নিঃশেষ হয়ে যায়।একটা সাধারণ মানুষের চাইতেও তারা দুর্বল হয়ে পরে।কোনো রকমে এই একটি ভয়াবহ রাত পাড়ি দিতে পারলেই তারা পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে উঠে।এজন্য প্রাসাদের সকল রক্ত চোষা প্রাণী আজ নিজেদের স্থান থেকে কোথাও এক বিন্দু নড়েনি।
লিও এর কাতর ভীতি যুক্ত কন্ঠে দৌড়ে এলেন এমিলি।ছেলের গালে মমতার হাত রেখে মায়া মাখা কন্ঠে শুধালেন
“আমার প্রিন্স কি হয়েছে?তোমাকে এতো উদ্বিগ্ন লাগছে কেনো?
“আজকের আবহাওয়া দেখেছো মা?
ভয় আর উদ্বিগ্ন মিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো লিও।
এমিলি দৌড়ে বিশাল জানালার কাছে দাঁড়িয়ে একটু বাইরের প্রকৃতি দেখে নিলো এরপর বিশ্ময়ভরা কন্ঠে বলে উঠলো
“তুষার ঝড় হবে মনে হচ্ছে।কিন্তু এই সময় তো কখনো তুষার ঝড় হয় না।আর আকাশের বড় চাঁদটা কোথায় হারালো?রাত টুকু তো শুভ বলে মনে হচ্ছে না লিও।
এমিলির কথায় আরো ঘাবড়ে গেলো লিও।সে প্রাসাদ ছেড়ে বাইরে বের হবার জন্য উতলা হয়ে উঠলো।লিও এর তর্জন গর্জনে লুকাস,হ্যাভেন ,আলফ্রেড এবং সব শেষে হেনরি দৌড়ে এলেন।
এমিলি ছেলের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে চিৎকার করে বলে উঠলেন
“ছেলে মানুষি করো না লিও।প্রাসাদের বাইরে ভয়ানক নেকড়ে ওঁৎ পেতে থাকে।আজ তুমি একদম শক্তি হীন।বেঘোরে নিজের প্রাণ হারাতে চাও নাকি?
হেনরি ছেলের বাহু চেপে ধরে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“কোন ভয়ে এমন কঠিন ভাবে ভীরু হয়েছো তুমি?
অবলীলায় লিও পিতার চোখে চোখ রেখে আহত কন্ঠে বলে উঠলো
‘শেহজাদী ম্যাপল এর জন্য ভয় হচ্ছে বাবা।আর দুদিন পর ওর আঠারো বছর পূর্ণ হবে।স্যাম কেলভিন যেকোনো মূল্যে ওকে নিজের রানী করতে চাইবে।আমার উপর প্রতিশোধ নিতে ও ম্যাপল কে হরণ করবে বাবা”
লিও এর কাতরতা বুঝতে পারলেন হেনরি।ছেলেকে পিঠ চাপড়ে আশ্বাস দিয়ে বলে উঠলেন
“নেকড়ে সম্রাজে গুপ্ত চর লাগিয়ে রেখেছি আমি।সেরকম কিছু হলে অবশ্যই আমি সংবাদ পেতাম।এতোটা অস্থির হইও না।সব মনের ভয়।
হেনরির কথায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলো না লিও।লিও এর মনের ছটফটানি হয়তো বুঝতে পারলো হ্যাভেন।লিওকে শান্ত হবার নির্দেশ দিয়ে হ্যাভেন বলে উঠলো
“ঠিক আছে যুবরাজ।আমি নিজেই গ্র্যাভো শহরের দিকে রওনা দিচ্ছি।যে করেই হোক শেহজাদী কে তোমার কাছে নিয়ে আসবো।তুমি শান্ত হও।
ক্ষমতা হীন আলফ্রেড হাতের কারসাজির সাহায্যে শেহজাদীর খবর নিতে চাইলো।কিন্তু বার কয়েক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।শেষমেশ নিরুপায় হয়ে বলে উঠলো
‘কোনো জাদু মন্ত্র কাজ করছে না যুবরাজ লিও।
হ্যাভেন আর অপেক্ষা করতে চাইলো না।নিজের যাত্রার জন্য বলে উঠলো
“আমাকে ভালো একটা ঘোড়া দিন।এখানে দাঁড়িয়ে আমি আর সময় অপচয় করতে চাচ্ছি না।
কিন্তু একি!মুহূর্তেই ধরণী লন্ডভন্ড করে শুরু হলো বিশাল ঝড়।সেই ঝরে যেনো ফ্লাকি প্রাসাদ ই উড়ে যাবার উপক্রম।হঠাৎ এমন ভয়ানক ঝরে প্রাসাদে অবস্থিত সকলেই ভীত হয়ে পড়লো।
“তবে কি আবার নতুন কোনো বিপদের হাতছানি?
*********
সম্রাট সিগমুন্ড এর রাজপ্রাসাদ মুহূর্তেই রক্তের বন্যায় ভেসে গেলো।অবশিষ্ট যে সকল সেনা আর দাস দাসী ছিলো তারাও ক্লান্ত হয়ে নিরুপায় ভাবে হাল ছেড়ে দিলো।সম্রাট সিগমুন্ড আরো অনেক আগেই স্যাম কেলভিনের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে অকাতরে হত্যা করে চলেছে নির্দোষ মানুষ গুলোকে।চতুর স্যান্ডি কোনো মতে নিজেকে বাঁচিয়ে একটি মশাল নিয়ে ম্যাপল এর কাছে দৌড়ে এলো
“শেহজাদী পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।আপনি পালিয়ে যান প্রাসাদ ছেড়ে।একটা পশুর কাছে নিজেকে সপে দিলে এই সাম্রাজ্যের সম্মান নষ্ট হবে।শত বছরের জমানো গৌরব মুহূর্তেই খর্ব হবে।
কিন্তু ম্যাপল স্যান্ডির কথা কানেই তুললো না যেনো।জলন্ত ক্রোধে আর হিংস্রত্বক হয়ে নেকড়ের পালের সাথে সমানে লড়ে যেতে লাগলো।কিন্তু এই টুকু বয়সের একটা মেয়ে হয়ে আর কতো শক্তিতে কুলাতে পারবে?যেখানে শক্তিশালী পুরুষরাই ধরাশায়ী হয়েছে!
হঠাৎই সম্রাট সিগমুন্ড এর গগনবিদারী চিৎকারে স্তব্ধ হলো সবকিছু।স্যাম কেলভিন তার ভয়ানক থাবা বসিয়ে উষ্ণ কলিজা বের করে নিয়ে এসেছে সম্রাট সিগমুন্ড এর।নিজের পিতার এহেন ভয়ানক অবস্থা চোখের সামনে অবলোকন করে চিৎকার করে উঠলো ম্যপল।দৌড়ে পিতার কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে সিগমুন্ড এর সর্ব শরীরে হাত বুলিয়ে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলো
“বাবা এ আপনার কি হয়ে গেলো?আমি আপনাকে রক্ষা করতে পারলাম না।আমি সন্তান হিসেবে ব্যর্থ।আমায় ক্ষমা করুন।
মেয়ের করুন আর্তনাদে সিগমুন্ড এর চোখ থেকে খসে পড়লো জল।চোখ দুটো আর সায় দিচ্ছে না।প্ৰর্চন্ড ক্লান্তিতে বুজে আসছে।তবুও ইচ্ছে হলো শেষ বারের মতো মেয়েকে বুকে জড়াতে।রানীর মৃত্যুর পর এক প্রকার দূরে রেখেই বড় করা হয়েছে মেয়েকে।পিতা হিসেবে কন্যার প্রতি সেরকম কোনো দায়িত্ব ও পালন করতে পারেন নি তিনি।কাঁপা রক্তাক্ত হাতে মেয়ের শীর্ন বাহু চেপে ধরে নিভু নিভু সিক্ত অপরাধী কন্ঠে সিগমুন্ড বলে উঠলেন
“আমাকে ক্ষমা করো ম্যাপল।বাবা হয়ে অনেক অবিচার করেছি তোমার উপর।তুমি পালিয়ে যাও, ওই পশু তোমাকে হরণ করবে।তুমি যে অন্য কারো আমানত।
আর কথা বলতে পারলেন না সিগমুন্ড।অস্পষ্ট আরো কিছু কথা বলেই প্রাণ বিয়োগ করলেন।পিতার রক্ত ভেজা শরীরের পানে তাকিয়ে করুন আর্তনাদ করে চিৎকার করে উঠলো ম্যাপল।সেই চিৎকারের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে লাগলো বাতাস আর তুষার ঝড়ের তান্ডব।
মুহূর্তেই চার পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে ম্যপল এর কাছে এসে উপস্থিত হলো স্যাম।মানব রূপে ফিরে মুখে প্রশস্ত হাসি ঝুলিয়ে ম্যাপল কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
“শেহজাদী ক্যারোলিন আমার চোখে চোখ রাখো।আমার দাসে পরিনত হও।আমার নেকড়ে সাম্রাজ্যে তোমাকে স্বাগতম।
স্যামের কথার মোহনীয় স্বরে কান্না ভুলে গেলো ম্যপল।ধীরে ধীরে কান্না রোধ করে মাথা তুলে উপরের দিকে তাকাতে থাকলো।সেই সাথে স্যামের লালচে ঠোঁটে ফুটে উঠলো ক্রুর হাসি।
মুহূর্তেই স্যান্ডি এসে ম্যাপল কে টেনে দূরে সরিয়ে স্যাম এর সামনে মশাল আর তলোয়ার হাতে দাঁড়ালো।
স্যান্ডিকে দেখতে পেয়ে নাক মুখ ফুলিয়ে দাঁত খেচিয়ে ক্রোধিত চোখে গর্জে উঠলো স্যাম।
“শেহজাদী আপনি পালান।যুবরাজ লিও আপনার প্রতীক্ষায় হাজার টি বছর কাটিয়ে দিয়েছে।আপনি প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যান।
স্যানডির চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলো ম্যাপল।নিজেকে ধাতস্থ করে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো
“তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না স্যান্ডি।ইতোমধ্যে প্রাসাদের সকলেই এই পশুদের হাতে প্রাণ দিয়েছে।শুধু তুমি বেচেঁ আছো স্যান্ডি।এই নর খাদকের সামনে তোমাকে ফেলে আমি কিছুতেই যাবো না।
আকস্মিক এক হিংস্র নেকড়ে এগিয়ে এলো ম্যাপল এর কাছে।নিজের হাতের সাহায্যে জোরে আঘাত করতেই গর্জে উঠে ছিটকে পড়ে গেলো নেকড়ে টি।সেই সাথে করুন আওয়াজ তুলে মুহূর্তেই প্রাণ ত্যাগ করলো।
স্যাম স্যান্ডি র পানে ধীরে ধীরে এগুতে লাগলো।স্যান্ডি হাতে থাকা মশাল দিয়ে বার বার ভীত করলো স্যাম কে।
ভয়ানক তুষার ঝড়ের বরফের স্তুপ ভারী বাতাসে খোলা দরজা জানালা দিয়ে প্রবেশ করে পুরো প্রাসাদ ভরিয়ে ফেললো।বাতাসের তোড়ে দপ করে নিভে গেলো স্যান্ডির হাতের মশাল।এই দৃশ্য দেখে স্যাম যেনো খুব খুশি হলো।আকস্মিক বাতাসের দাপট আর তীব্র শীতে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালো ম্যাপল।হিংস্র স্যাম পুনরায় হাত বাড়ালো ম্যপল এর দিকে।চৌকস স্যান্ডি নিজের গলায় ঝুলানো ক্রুশ সমেত রুপার চেইন টি স্যাম এর হাতে পেঁচিয়ে এক প্রকার টেনে হিচড়েই ম্যাপল কে নিয়ে প্রস্থান করলো ।
গায়ে ক্রুশ আর চেইন লাগার সাথে সাথেই ভয়ানক গর্জন করে প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে চাইলো স্যাম।তার পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে।নিজ রাজ্যে ফিরে নিজেকে হিল না করলে তার মৃত্যুও হতে পারে।একদিকে মানুষের লাশের স্তুপ অপরদিকে নেকড়ের স্তুপ।সবকিছু ঠেলে নিজেদের চেনা পরিচিত ঘোড়া শালে ম্যাপল কে টেনে নিয়ে এলো স্যান্ডি।এরপর ভয় মিশ্রিত ক্লান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো
“প্রাসাদের চিন্তা বাদ দিন শেহজাদী।ওই প্রাসাদে নিজেদের আর কেউ নেই।আপনাকে এখনই এই প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে।
নিজের কান্না রোধ করে ম্যাপল শুধালো
“এই ভয়ানক ঝড় বৈরী আবহাওয়া ঠেলে কোথায় যাবো স্যান্ডি?
“যুবরাজ লিও এর প্রাসাদে চলুন শেহজাদী।
এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ম্যাপল বলে উঠলো
“আমি লিও এর প্রাসাদ চিনি না স্যান্ডি।লিও কখনো সেই প্রাসাদে আমাকে নিয়ে যায়নি।আর সব কিছু এতো দ্রুত হয়ে গিয়েছে যা আমাদের ভাবনাতীত।
মেপলের সমস্ত কথা বুঝে গেলো স্যান্ডি।সে আর এক মুহূর্ত সময় অপচয় করতে চাইলো না।স্যানডির বাবা এই প্রাসাদেই ঘোড়া দেখ ভালের কাজ করতো।ঘোড়া সম্পর্কিত বেশ ভালো জ্ঞান অর্জন করেছিলো স্যানডি তার বাবার কাছ থেকে।তাই ভালো ঘোড়া চিনতে তার বেশি সময় লাগলো না।কালো সাদা মিশেলের একটা ঘোড়া লাগাম সমেত মেপলের হাতে দিয়ে স্যান্ডি বলে উঠলো
“মনে রাখবেন আপনি রাজ পরিবারের সন্তান।আপনি একজন শেহজাদী।আপনার জন্ম হয়েছে কোনো রাজকুমারের রানী হবার জন্য।কোনো পশুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে রাজ্যের নাম ডুবানোর জন্য নয়।
অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ম্যাপল বলে উঠলো
“আমার পিতার মৃত্যুতে আমি ভীত এবং দুর্বল হয়ে পড়েছি স্যান্ডি।আর এভাবে পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া তো নিজের জন্যই লজ্জা।আমি তো এই রাজ্যের শেহজাদী।
ঘোড়াকে বাইরে বের করতে করতে স্যান্ডি বলে উঠলো
“এখানে কোনো মানুষে মানুষে যুদ্ধ হচ্ছে না শেহজাদী।একটা হিংস্র পশুর কাছে কিসের আবার পরাজয় বরণ?
হঠাৎই স্যাম সমেত অন্যান্য নেকড়ের গর্জন শোনা গেলো।স্যান্ডি ঘোড়ার পিঠে জোর করে ম্যাপল কে তুলে দিয়ে বলে উঠলো
“ভাগ্য যেখানে নিয়ে যায় সেখানে চলুন শেহজাদী।ভাগ্য খণ্ডাবার ক্ষমতা ঈশ্বর ব্যতীত কারোর নেই।যদি আপনার জন্য মৃত্যু অবধারিত হয় তবে অবশ্যই বেঁচে ফিরবেন না।
শেষ অনুরোধ হিসেবে ম্যপল কাতর স্বরে বলে উঠলো
“তুমিও আমার সাথে চলো স্যান্ডি।
স্যান্ডি মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে চাবুক চালালো।মুহুর্তেই লম্বা পায়ে দৌড়ে চললো ঘোড়া দুটো।মেপলের কাছে মনে হচ্ছে এগুলো কোনো সাধারণ ঘোড়া নয়।এগুলো যেনো পংখীরাজের ঘোড়া।না বাতাসের দাপট গায়ে মাখছে না বরফের গভীর স্তুপ।
এদিকে নেকড়ের পাল শেহজাদীকে পুরো প্রাসাদ জুড়ে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো।পুরো রাত ধরে প্রাসাদ এবং আশেপাশের অরণ্য কোত্থাও খুঁজে পাওয়া গেলো না শেহজাদী ম্যাপল আর তার দাসী কে।
ইতোমধ্যে ফুটে গিয়েছে ভোরের আলো।তুষার ঝড় কমে গিয়ে কড়া রোদ্রোজল এক নতুন দিনের সূচনা হয়েছে।চারপাশের মনোরম পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে গত রাতে যেনো কিচ্ছুটি হয়নি।অথচ একটি সাম্রাজ্য পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে পশুদের ঘাতক আগ্রাসীর উন্মাদনায়।।
আহত স্যম প্রাসাদে ফিরে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে শয্যা নিয়েছে।শরীরে তার বিন্দু মাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই।তার সেনারা ফিরতেই অন্যের সহায়তায় বিছানা ছেড়ে উঠে দুর্বল কন্ঠে শুধালো
“কোথায় সেই রাজকুমারী?
নেকড়ে সেনা ড্যাভিন মাথা নিচু করে অপরাধীর স্বরে বলে উঠলো
“ঝড়ের সাথে কোথায় পালিয়েছে আমরা খুঁজে পাইনি মহারাজ।
ড্যাভিন এর কথা খানা মনঃপুত হলো না স্যাম কেলভিন এর।আহত গর্জনে বলে উঠলো
“পাতাল থেকে হলেও খুঁজে বের করো তাকে।আজ রাতের মধ্যেই তাকে আমার চাই।না হলে আমার মৃ/ত্যু অনিবার্য।
#চলবে