#দ্যা_লাস্ট_ব্লাড_মুন
#পর্ব_৪
#সারিকা_হোসাইন
**********
প্রভাত ঘনিয়ে আসার সাথে সাথেই শীতের মাত্রা আরো খানিক বাড়লো যেনো।ভারী কুয়াশা শিশিরে রূপ নিয়ে বড় বড় গাছের পাতা গড়িয়ে গড়িয়ে টুপটাপ শব্দের মূর্ছনা সৃষ্টি করেছে।স্তব্ধ নীরব পরিবেশে এমন স্বাভাবিক শব্দ টাও ম্যাপলের কাছে চূড়ান্ত ভৌতিক লাগছে।উষ্ণ ভারী কম্বল টা কিছুতেই যেনো তার শরীরের হিম শীতল ভাব দূর করতে পারছে না।সমগ্র শরীর ক্রমাগত ঠকঠক করে কেঁপে যাচ্ছে শুধু।অক্ষিপটে বারবার সেই জন্তুর ভয়ানক ছায়া ভেসে উঠছে।হৃদযন্ত্রে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে।আর সেই কুণ্ডলী পাকানো ভয়ানক শব্দের বাতাস ?
সব মিলিয়ে ভয়ে বিছানায় কম্বল পেঁচিয়ে গুটিশুটি মেরে উপুড় হয়ে বসে রইল ম্যাপল।
কতক্ষন এভাবে পেরিয়ে গেলো সে জানেনা।হঠাৎ ই একটা মিষ্টি সুগন্ধ ভারী কম্বল ভেদ করে তার নাসারন্ধ্রে ভুরভুর করে প্রবেশ করলো।
গন্ধের উৎস খুঁজতে অবাক চিত্তে হালকা কম্বল সরিয়ে অল্প করে চোখ বের করলো ম্যাপল।
পুরো কক্ষ ঝকঝকে আলোকিত দেখতে পেয়ে ভয় কাটিয়ে ঠেলেঠুলে কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
“আরে ভোরের আলো কখন ফুটলো?কিছুক্ষন আগেও যেই ভয়াবহ ঘন অন্ধকারের বিস্তার ছিলো ধরনীতে মুহূর্তেই তা কিভাবে আলোকিত হলো?আর এই মিষ্টি গন্ধটা কিসের?
নিজের লম্বা প্ৰম গাউন দুই হাতে উঁচু করে ধরে ধরে আশেপাশে নজর বুলিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে ম্যাপল।
দূর থেকে নিজের শ্রেয়সীর এমন বোকা বোকা আচরণে প্রশস্ত হাসলো লিও।
“এখনো আলো ফুটেনি প্রিয় তমা।তোমার ভয় দূর করার সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র”!
পুরো ঘর পায়চারি করে হঠাৎ ই টেবিলের উপর আরেকটি রঙিন চিরকুট দেখে বেশ অবাক হলো ম্যাপল।চিরকুট টি হুবুহু আগের টার আদলে তৈরি।আশেপাশে সন্তর্পণে নজর বুলিয়ে কক্ষের খিল এঁটে দিয়ে কাঁপা হাতে চিঠির ভাজ খুললো ম্যাপল।
“সমগ্র পৃথিবীর অধিশ্বর এর প্রিয়তমা হয়ে যদি তুমি সামান্য জন্তুর ভয়ে কাবু হও তাহলে যে আমার অপমান!
চিঠিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কত বার পড়লো তা জানা নেই অবোধ কিশোরীর।কিন্তু প্রত্যেকটা চিঠিতেই আলাদা আলাদা সম্মোহন রয়েছে ।কিসের এতো ভালোলাগা এই চিঠি গুলোতে?
হঠাৎই চিঠি দাতাকে দেখার জন্য মন অকুলিবিকুলি করে উঠলো সপ্ত দশীর।কক্ষ ডিঙিয়ে বৃহৎ বেলকনি তে এসে ঘাড় বাড়িয়ে ইতি উতি খোজাখুঁজি করলো।অতঃপর কাউকে দেখতে না পেয়ে নিরাশ হয়ে মলিন কন্ঠে বলে উঠলো―
“আপনাকে আমি স্বচক্ষে দেখতে চাই মিস্টার চিরকুট ওয়ালা”
ম্যাপলের মনের নিষিদ্ধ ইচ্ছায় শ্লেষত্বক হাসলো লিও।সেই সাথে বেদনার কালো কষ্টে র*ক্তা*ক্ত হৃদয় ছি*ন্ন*ভিন্ন হলো।
“তুমি আমাকে ছুঁয়ে দিলেই যে আমি আর কোনো দিন তোমাকে দেখতে পারবো না প্রিন্সেস।আমার এই অভিশপ্ত জীবনে কেনো এসেছিলে তুমি?আটশত বছর ধরে একই যন্ত্রনা খনে খনে হৃদয় দহন করে যাচ্ছে।আমি যে আর পারছি না এই দহনে ছাই হতে”
“রাজকুমার ভোর হতে চলেছে,দুর্গে চলুন”
হঠাৎ আলফ্রেড এর ধীর কন্ঠে সম্বিৎ ফিরে পেলো লিও ।বেদনা যুক্ত ফ্যাকাশে মুখশ্রী নিয়ে আলফ্রেড এর উদ্দেশ্যে আহত কন্ঠে শুধালো
“আর কতদিন এভাবে আমাকে জ্বলতে হবে আলফ্রেড?
আলফ্রেড জানে এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর রাজকুমার লিও এর কাছেই আছে।মিথ্যে শান্তনার আশায় তাকে প্রশ্নখানি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে মাত্র।কিন্তু যেখানে অর্ধেক ঘটনাই তার অজানা সেখানে প্রশ্নের উত্তর কিরূপে দেবে সে?
“দুর্গে ফিরে চলুন রাজকুমার।আর বেশি সময় অবশিষ্ট নেই।আর এই প্রাসাদের আশ পাশের বাতাস ও যে আপনার জন্য ক্ষতিকারক”.
ইতিমধ্যেই ঘুমন্ত পাখিরা জেগে উঠেছে।কার্পাথিয়ান জঙ্গল থেকে তাদের কিচিমিচির ভেসে আসছে।গভীর অরণ্যের কারনে ভোরের আলো খুব সহজে এখানে প্রবেশ করতে পারেনা।তার মধ্যে ঘন কুয়াশার আস্তরণ।থেকে থেকে দুই একটা শেয়ালের হুক্কাহুয়া বিরক্তিকর ডাক কানে এসে লাগছে।আর অবস্থান নিতে পারলো না লিও।
হাওয়ায় মিলানোর আগে শক্ত কন্ঠে আদেশ করলো
“এই রাজ্যের একটা মানুষের ও যেনো কোনো ক্ষতি না হয় আলফ্রেড।আর ওই নেকড়ে রাজ স্যাম এর সকল গতিবিধি লক্ষ রাখবে।সে আমার হাজার বছরের শত্রু।বার বার সে আমার কলিজায় আক্রমনের চেষ্টা করে।এবার ওর কলিজা খা*বো আমি।”
আলফ্রেড মাথা নিচু করে সম্মতি জানাতেই হাওয়ার বেগে ঘন অরণ্য,ঝিরি,পাহাড় পর্বত পেরিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চললো লিও।গন্তব্য ফ্লাকি মাউন্টেইন।
*********
ক্রাকোয়া, পোল্যান্ড
বৃহৎ ঘন জঙ্গল বেষ্টিত উঁচু পর্বত ফ্লাকি।ভু পৃষ্ঠ থেকে আড়াই হাজার ফুট উচ্চতার সেই ভয়ানক পর্বতের কোল ঘেঁষে স্বগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যাম্পায়ার কিং জর্জ হেনরির রাজকীয় প্রাসাদ।প্রাসাদের একদম কাছ ঘেষে কল কল ধারায় বয়ে চলেছে স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা ধারা।প্রাসাদটির চারপাশ জুড়ে বিশাল বিশাল উচ্চতার বার্চ ,পাইন আর ওক কাঠের ঘন বেষ্টনী।সেই বেষ্টনী ভেদ করে সূর্যের তাপ তো দূরে থাক সামান্য আলো পর্যন্ত আসে না।প্রাসাদটি এতটাই ভয়ঙ্কর যে,সেই প্রাসাদের উপর দিয়ে তো দূর আশেপাশে পর্যন্ত কোনো জীব জন্তুর চলাফেরা চোখে পড়ে না।দূর থেকে এই বিশাল প্রাসাদটি যে কারো নজর কাড়তে সক্ষম হবে।দিনের বেলায় প্রাসাদটি থতমমে মৃত্যপুরী তুল্য।কিন্তু রাত যত গভীর হতে থাকে মৃত স্তব্ধ প্রাসাদটি ততো প্রাণ ফিরে পেতে থাকে।এই প্রাসাদের গভীর কঠিন রহস্য যেই বের করতে প্রাসাদে পা রেখেছে দ্বিতীয় বার পোল্যান্ড শহর তাদের চেহারা দেখে নি কেউ।তাই প্রাসাদটির রহস্য হাজার হাজার বছর ধরে অজানা।কারো কারো মতে এই প্রাসাদে রাক্ষস বাস করে কারো মতে আবার গ্রীম রিপার।কিন্তু কেউ কেউ মেনে নেয় এই প্রাসাদে রক্ত পিপাসু পিচাশ বাস করে।কিন্তু ভক্তভোগী ব্যাতিত কেউ এই প্রাসাদের একটা ধূলিকনার খবর ও জানেনা।
হাজার বছরের তৈরিকৃত এই প্রাসাদে কংক্রিটের চেয়ে র*ক্তে*র প্রলেপ বেশি।কতশত মানুষ এখানে এসে তাদের প্রাণ খুইয়েছে তা কারো জানা নেই।
ইচ্ছে করেই ফ্লাকি ঘন জঙ্গলে বাড়তে দেয়া হয়েছে মায়া হরিণের বংশ।সেই মায়া হরিণের মায়ায় পড়ে কতো শিকারি নিজেই শিকার হয়েছেন সে সকল ঘটনাও অজানা।
**********
“ইথার দেখো কতো সুন্দর একটি প্রাসাদ”!
শিকারে আসা কয়েকজন শিকারি ঘোড়ায় চেপে চলতে চলতে একজন আরেকজনকে হেনরির প্রাসাদ খানা আঙুলে ইশারা করে দেখালো।
সহযোগী “জো” এর নির্দেশ অনুযায়ী প্রাসাদের পানে চোখ মেলে তাকালো আটাশ বছর বয়সী যুবক ইথার।ছেলেটি সুদূর ইংল্যান্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করে কয়েকদিন আগেই পোল্যান্ড ফিরেছে।তাই অবসর সময় কাটানোর কোনো মাধ্যম খুঁজে না পেয়ে পশু শিকারকেই বেছে নিয়েছে সে।সেই উচ্চাস কে কেন্দ্র করে সকলের নিষেধ অমান্য করে নিজের বাল্যকালের বন্ধু নিয়ে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে এই জঙ্গলে।
“চলো প্রাসাদ টি ঘুরে দেখা যাক”
উত্তেজিত কন্ঠে সকলকে আমন্ত্রণ জানালো ইথার।তাদের সকলের মধ্যেই প্রাসাদটি দেখার বেশ আগ্রহ জন্মালো।শুধু পঁচিশ বছর বয়সী যুবক চার্লস বাদে।
“কি ব্যাপার চার্লস তুমি এতো ভয় পাচ্ছ কেনো?
জো এর করা প্রশ্নে চার্লস ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“জায়গাটা কেমন ভুতুড়ে লাগছে জো। আর আমরা এখানকার কিছু চিনিও না জানিও না।প্রাসাদটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিত্যক্ত।আমার গ্র্যানি বলেছে এসব প্রাসাদে আত্মা ঘুরে বেড়ায়।তোমরা যাও আমি যাবোনা।”
চার্লস এর কথায় সকলেই সমস্বরে হো হো শব্দে হেসে উঠলো।সেই হাসি ফ্লাকি পর্বতের গায়ে বাড়ি খেয়ে ভয়ংকর আওয়াজ তুলে ফিরে এলো।
এমনই ভয়ানক পরিবেশে তাদেরই আরেক সহযোগী হ্যাভেন বলে উঠলো
“এমন রোমাঞ্চকর পরিবেশে পোল্যন্ড এর লাস্যময়ী রমণী এলিস কে আনা দরকার ছিলো।সারা রাত আদর বিনিময় করা যেতো।উফ ভাবতেই শিহরণ জাগছে।”
“চলো আগে আমরা ইনজয় করি পরবর্তীতে না হয় লাস্যময়ী নিয়ে উষ্ণতা ছড়ানো যাবে”
“আর যাই বলো ভাই রাজা বাদশাহ রাই প্রকৃত সুখী।রাজ্য আছে রানীও আছে আবার সারা রাত ভর নরম গদিতে লাস্যময়ীর উষ্ণ তা।”
“চলো রাজা হীন প্রাসাদে আজকে আমরাই রাজা হই”
হাসতে হাসতে সকলে কথা গুলো বলতে বলতে প্রাসাদ অভিমুখে চললো।বহু অনুরোধ করেও চার্লস কে সেই প্রাসাদে নেওয়া গেলো না।চার্লস সকল সহযোগীকে বিদায় জানিয়ে তার ঘোড়া নিয়ে পোল্যান্ড শহর অভিমুখে ফিরে চললো।
ইথার এর দল প্রাসাদের অনেকটা কাছে চলে গিয়েছে।চার্লস ও তাদের থেকে কিছুটা দূরে।হঠাৎই দ্রুত পায়ে দৌড়ানো ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলো চার্লস।দুই পা উঁচু করে থেমে গেলো চার্লসের কালো রঙের ঘোড়াটি।
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে একপলক তাকিয়ে প্রাসাদটি দেখলো চার্লস।
এরপর শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“বেঁচে থাকলে ফের দেখা হবে জেমস ইথার ”
#চলবে
#দ্যা_লাস্ট_ব্লাড_মুন
#পর্ব_৫
#সারিকা_হোসাইন
********
দিগন্তের দগদগে সূর্যখানা তার তেজ হারিয়ে ফ্লাকি পর্বতের চূড়ায় মুখ লুকাতে চাইছে।তাপমাত্রাও কমতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।জায়গাটা ঘন গাছগাছালি তে পরিপূর্ণ থাকায় শীতের প্রকোপ একটু বেশিই অনুভূত হচ্ছে।
বহু পুরোনো মোটা মোটা ওক গাছের ঘন সারি ভেদ করে ছুটে চলেছে ইথার দের ঘোড়া গুলি।প্রাসাদের কিছুটা কাছে আসতেই ঘোড়া গুলো আর এগুতে চাইলো না।চাবুকাঘাত করেও এক পা নড়ানো গেলো না ঘোড়া গুলোকে।ঘোড়া নিয়ে তামাশা করতে করতেই ডুবে গেলো সূর্য খানা।কিছুক্ষন আগের ক্ষীন আলো এখন কালচে অন্ধকারে রূপ নিচ্ছে।বৃহতাকার সুউচ্চ গাছের ঘন পাতা ভেদ করে প্রাসাদের আশেপাশে আলো আসতে পারেনা বিধায় জায়গা টা অন্য সকল স্থানের চেয়ে একটু বেশি অন্ধকার।
হঠাৎই বড় সুউচ্চ বার্চ গাছের ডালে বসে থাকা অদ্ভুত এক পাখি কর্কশ স্বরে ভয়ংকর ডেকে উঠলো।সেই ডাক শুনে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো হ্যাভেন।
নিজের ধূসর রঙা ঘোড়ার পিঠে থেকে লাফিয়ে নেমে ইথার কে উদ্দেশ্য করে হ্যাভেন বলে উঠলো
“মনে হচ্ছে চার্লস এর কথাই সত্যি,যেখানে ভুত প্রেতের আত্মা রয়েছে সেখানে নাকি ঘোড়া এগুতে চায়না”
হ্যাভেন এর এমন বোকা কথায় স্বশব্দে খানিক হাসলো ইথার।এরপর রসিকতা মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো
“একটা শিক্ষিত ছেলে হয়েও এমন ভুত প্রেতে বিশ্বাস করছো?এগুলো রূপকথার গল্পে শোনা যেতো।বাস্তব আর রূপকথা দুটোই ভিন্ন হ্যাভেন।তোমার মত তাগড়া জোয়ানের কাছে কথাটি আরো বেশি হাস্যকর শোনাচ্ছে”
ইথারের এমন হাস্যরসাত্মক কথা শুনেও মন হালকা হলো না হ্যাভেন এর।সে তার নিজের ভাবনাতেই মশগুল থাকলো।
তাদের সহযোগী জো বলে উঠলো
“যেহেতু সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে আর চারপাশে ঘন জঙ্গল আমি মনে করি এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করাই উত্তম।চলো ঘোড়া গুলোকে টেনে প্রাসাদের ভেতরে যাওয়া যাক’
জো কে প্রাধান্য দিয়ে সকলেরই এক যোগে বলে উঠলো
“হ্যা খুব সুন্দর কথা বলেছো।চলো আগে ভেতরে যাই তারপর বাকি ব্যাবস্থা করা যাবে।
ঘোড়া গুলোকে নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি খাটিয়ে টেনে হিচড়ে প্রাসাদের সামনে এসে দাড়ালো সকলে।
সেই প্রাসাদের সামনে এসে ঘোড়া গুলো দুই পা উঁচু করে বিকট শব্দে চিৎকার করতে লাগলো।
ঘোড়া গুলোর এহেন অদ্ভুত আচরণে সকলেই ঘাবড়ে গেলো।সকলকে শান্ত থাকার অনুরোধ করে ইথার ইথার বলে উঠলো
“সারাটা দিন দৌড়ে ছে তাই এমন করছে।এদের খাবারের ব্যাবস্থা করা উচিত।
আশেপাশে নজর বুলাতেই লম্বা লম্বা ঘাস যুক্ত ফাঁকা জায়গা দেখা
গেলো।সকলেই ঘোড়া নিয়ে সেই জায়গায় বেঁধে রাখলো।কিন্তু ক্লান্ত ঘোড়া গুলো একটা ঘাসের ডগায় ও মুখ ছোয়ালো না।
প্রাসাদের প্রধান ফটক এর নিকট উপস্থিত হতেই কেমন এক উষ্ণ হাওয়া সকলের শরীর স্পর্শ করে চলে গেলো।
“আমার প্রচন্ড ভয় লাগছে ইথার”
পুনরায় হ্যাভেন কথাটি বলে উঠলো।
হ্যাভেন কে আশ্বস্ত করে ইথার বলে উঠলো
“দাঁড়াও এক্ষুনি তোমার ভয় দূর করছি।
কথাটি বলেই নিজের ব্যাগ থেকে একটা যন্ত্র বের করে তা চেপে আগুন বের করলো।সেই আগুন দেখে সকলেই বেশ অবাক হলো।
ইথারের হাতের অভিনব যন্ত্র টি ই যেনো এখন সকলের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু।
“এটা কি ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র?
ইথার হ্যাভেন এর এহেন প্রশ্নে কিঞ্চিত হাসলো।
“বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে বন্ধু।এটা আঠারোশত চল্লিশ সাল।ইংল্যান্ডে গেলে আরো অনেক কিছু দেখতে পাবে ।এখানে দাঁড়িয়ে সময় অপচয় না করে চলো ভেতরে যাওয়া যাক”
নিজেদের ব্যগ থেকে মশাল বের করে তাতে আগুন লাগিয়ে প্রাসাদের ভেতর অগ্রসর হলো চারজনের এই দল।
যত প্রাসাদের ভেতর এগুচ্ছে ততোই যেনো গা ছমছমে ভয় এসে হৃদযন্ত্রে ভর করছে।চারিদিকে পরতে পরতে ধুলা বালির আস্তরণ আর সর্বত্র বড় বড় মাকড়শার জালের বিস্তার।কিছুদূর এগুতেই বিশ্রী উটকো গন্ধে সকলের বমির উদ্রেক হলো।সহ্য করতে না পেরে জো মেঝেতেই বমি করে ফেললো।
“এটা কি ধরনের গন্ধ ইথার?মনে হচ্ছে মানুষের মাং*স পঁচা দুর্গন্ধ।
“সব কিছু এতো সিরিয়াসলি কেনো নাও হ্যাভেন?কোনো পশুপাখি ও তো ম*রে পরে থাকতে পারে”
ইথার এর কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলো না হ্যাভেন।ক্ষণে ক্ষণে তার মনে হচ্ছে প্রেমিকার কথা অমান্য করে ইথার এর সাথে এই গভীর জঙ্গলে আসাই যেনো মস্ত বড় ভুল হয়েছে।
“ভালোয় ভালোয় ফিরে গিয়ে ইভা কে সবার আগে বিয়ে করে ঘরে তুলব,আর কখনো তার কথা অমান্য করবো না”
পুরো হল রুম জুড়ে অদ্ভুত সব প্রাণীর আর লুসিফার এর তৈলচিত্রে ভরা।চিত্র গুলো ধূলায় নোংরা হয়ে দেয়ালে অবহেলায় সেটে আছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে শত বছরের পরিত্যক্ত প্রাসাদ।
“সত্যি ই কি শত বছরের পরিত্যক্ত নাকি আরো হাজার বছর?
জো কে কোন মতে সামলিয়ে বিশাল বড় হল রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সকলে।চারপাশে বাদুড়ের নোংরা বিষ্ঠায় ভরপুর।সেই বিষ্ঠা থেকেই এমন উটকো গন্ধের উৎপত্তি হচ্ছে।
কৌতূহলী ইথার হলরুম পেরিয়ে বিশাল সিঁড়ি বেয়ে উপরের কক্ষের দিকে অগ্রসর হতে নিলেই পেছন থেকে হ্যাভেন বলে উঠলো
“অধিক কৌতূহল ক্ষতি বয়ে আনে ইথার।আমার মনে হচ্ছে আমাদের এই প্রাসাদ ত্যাগ করা উচিত”
“তোমরা বিদায় নিতে পারো,আমি তো এই প্রাসাদের সৌন্দর্য উপভোগ করে তার পরেই যাবো।”
হ্যাভেন এর মন চাচ্ছে সব ছেড়ে পোল্যান্ড শহরে ফিরে যেতে।চার্লস এর সাথে ওই মুহূর্তে কেনো সে ফিরে গেলো না এটা ভেবেই তার চূড়ান্ত আফসোস হচ্ছে।
ইতিমধ্যে ইথার সবাইকে ফেলে গটগট পায়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠে গিয়েছে।ধুলার পুরু স্তরে ইথারের পায়ের ছাপ স্পষ্ট।সেই ছাপ ধরে ধরে এগিয়ে চললো বাকি তিনজন।
মনে মনে হ্যাভেন গড কে সমানে ডেকে যাচ্ছে।এরপর গায়ে জড়ানো পোশাকের আস্তিন থেকে ফাদারের দেয়া ক্রুশ লকেটটি গলায় পড়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগলো হ্যাভেন।
**********
বেলায় বেলায় গড়িয়েছে ঘন নিশুতি রাত।জঙ্গলের ভেতর থেকে অদ্ভুত সব প্রাণীর আওয়াজ ভেসে আসছে।শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক আর হুতুম পেঁচার ভয়ানক শব্দ।দুই ই মনে ভীষন ভয়ের উদ্রেক করে।বড় বড় অজগরের ফসফস নিঃশাস প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে যেনো।
দুর্গের সকল ভ্যাম্পায়ার শিকার খুঁজতে চলে গিয়েছে আরো আগেই।
শুধু জীবন্মৃত হয়ে কফিনে শুয়ে আছে যুবরাজ লিও।
তার জাগার অপেক্ষায় অধীর হয়ে প্রহর গুনছে আলফ্রেড।
দেয়ালে থাকা বৃহতাকার পুরোনো ঘড়িটা বেজে উঠলো বিকট শব্দে
“ঢং”
কোনো প্রকার যান্ত্রিক শক্তি ছাড়াই যুগের পর যুগ পেরিয়ে বেজে যাচ্ছে ঘড়ি খানা।যান্ত্রিক শক্তি দিয়েই যদি সব কিছু করতে হয় তাহলে মায়ার শক্তির কি কাজ?
ঘড়ির কাটা সাতের ঘরে পৌঁছাতেই খট করে কফিনের দরজা খুলে গেলো।খুশিতে মাটিতে মাথা নোয়ালো আলফ্রেড।
পূর্বের ন্যায় একই ভাবে কফিন থেকে বেরিয়ে এলো লিও।শুধু খুশি হবার পরিবর্তে রেগে গর্জে উঠলো
“প্রাসাদে অপরিচিত দুর্বল মানুষ পা রেখেছে আলফ্রেড”এক্ষুনি তাদের বন্দির ব্যাবস্থা করো”
যুবরাজের গর্জনে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো আলফ্রেড।নিজের হাতের শক্তিতে আগুনের বলয় শিখা তৈরি করে তাতে সেই আগন্তুক দের চেহারা দেখার চেষ্টা করলো।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কারো চেহারা সেখানে দেখা যাচ্ছে না।
“মনে হচ্ছে আপনার ভুল ধারনা রাজকুমার।আমার এই বলয় থেকে আজ পর্যন্ত কারো চেহারা পালাতে পারেনি ”
পাশে থাকা পিলারে শক্ত এক ঘুষি বসিয়ে দিতেই পুরো প্রাসাদ নড়বড়ে কেঁপে উঠলো সেই সাথে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলো পিলার খানা।
বড় বড় কালো নখ রক্তিম চোখ আর বেরিয়ে আসা হিংস্র দাঁত নিয়ে চিৎকার করে উঠলো লিও।
“এই মানুষ গুলোর গন্ধে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি আলফ্রেড।নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ খাটছে না।এখানে শুধু মানুষ নয় নেকড়ে ও আছে”
এবার কেঁপে উঠলো আলফ্রেড।সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো
“শেহজাদী ক্যারোলিন এর কফিন কক্ষে যায়নি তো?
ক্রোধে চুল ছিড়তে ইচ্ছে হলো লিও এর।যেই কক্ষে তার নিজেরই যাওয়া আজীবন নিষেধ সেই কক্ষে একটা নেকড়ে ঢুকে বসে আছে?যদি কফিন খুলে ফেলে তবে?
আর ভাবতে পারে না লিও।দৌড়ে গিয়ে সার্কোফ্যাগস কফিন খুলে উন্মুক্ত করে কুচকুচে কালো রঙের সবুজ মনির অধিকারী বিশাল এনাকোন্ডা লুকাস কে।
কফিন থেকে বেরিয়ে অগ্নি চক্ষু নিয়ে ফনা তুলে লুকাস।প্রভুর বশ্যতা মেনে মাথা নিচু করে অপেক্ষা করে পরবর্তী আদেশের।
“যে ঐ কক্ষে প্রবেশ করেছে তাকে কঠিন থেকে কঠিন তম মৃ*ত্যু যন্ত্রনা দাও লুকাস”
প্রভুর আদেশ পেতেই লকলকে পুরু জিহবা বের করে নিজের ক্রুরতা জানান দেয় এনাকোন্ডা লুকাস,এরপর হিসিসিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।
“বহুদিন মানুষের মাং*সে*র স্বাদ পায়নি এই জিহ্বা”
***********
হ্যাভেন,ইথার ,জো আর ম্যাডি মিলে একটি কক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে।কক্ষ জুড়ে অদ্ভুত সুন্দর এক গোলাপের গন্ধ।শুধু তাই নয় কক্ষটি তরতাজা গোলাপ ফুলে পরিপূর্ণ।ধুলোয় ভরা প্রাসাদে এমন পরিপাটি ঝকঝকে কক্ষ বেশ অবাক করলো সকলকে।শুধু ইথারের চোখে কোনো বিস্ময়ের ছিটেফোঁটা নেই।
“এইতো চেয়েছিলাম।”!
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ইথার।সেই হাসিতে সকলেই ভয় পেয়ে শুধালো
“এভাবে হাসছো কেনো ইথার?আমরা কেউ এমন রঙ তামাশা দেখার মোডে নেই।চলো এই প্রাসাদ ত্যাগ করি এখনো সময় আছে”
কিন্তু এসব কথা কানে তুললো না ইথার।তার দৃষ্টি সামনে থাকা মেরুন রঙা চকচকে কফিনটার উপর।ইথারের দৃষ্টি অনুসরণ করে সকলেই সেই দিকে দৃষ্টি পাতলো।
রাজকীয় এক কফিন যার চারপাশ বড়বড় লাল গোলাপ দিয়ে সজ্জিত।কিন্তু অদ্ভুত বিষয় তুষার পাত ছাড়াই সব গুলো ফুল বরফে আচ্ছাদিত হয়ে আছে।সেই বরফাচ্ছাদিত ফুল থেকেই এমন মিষ্টি সুঘ্রাণ আসছে।
“এই কফিনে কি আছে ইথার?
অবাকের স্বরে জানতে চাইলো সকলে।ঠোঁটে হাসির রেখা অব্যাহত রেখে তৃপ্তি যুক্ত নজরে ইথার উত্তর করলো
“যদি ভুল না হই তবে অমরত্ব লাভের হাতিয়ার আছে এখানে”
অমরত্বের কথা শুনে সকলেই অবাক হলো।
“মানুষ কখনো অমর হয়?
“এই গুপ্তধন পেলে ঠিক অমর হবে”
কফিনে কি এমন গুপ্তধন আছে তা দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো প্রত্যেকে।ইতোমধ্যে ম্যাডি নামের ছেলেটির লোভে চোখ দুটো চকচক করে উঠলো।ইথার এর আগেই দৌড়ে কফিনটির কাছে গিয়ে লোভাতুর দৃষ্টি বুলালো কফিন জুড়ে।
সেখানে খুব সুন্দর করে কফিন জুড়ে খোদাই করে লিখা
“ক্যারোলিন ডিসৌজা”
ম্যাডি কফিনে হাত বাড়াতে যাবে তার আগেই ইথার তাকে দূরে ছুড়ে ফেললো।
“তোদের সাধারণ মানুষের লোভের জন্যই তোরা আজ সকলের শত্রু”
ইথারের এমন অদ্ভুত আচরণ কারোর ই সুবিধার ঠেকলো না।হঠাৎই হ্যাভেন এর মনে হলো
“এই কক্ষে নিশ্চিত মৃত্যু আছে”
তাই সে জো কে নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে এসে অন্য একটি কক্ষে ঘাপটি মেরে বসে রইলো সেই সাথে প্রাসাদ ছেড়ে পালানোর পথ খুঁজতে লাগলো।
ইথারের আঘাতে বেশ কাবু হলো ম্যাডি।তবুও তার লোভ গেলো না।মুখে বিশ্রী হাসি ঝুলিয়ে ম্যাডি বলে উঠলো
“চলো ইথার অর্ধেক অর্ধেক খাওয়া যাক সেই অমৃত সুধা!
ম্যাডির কথায় বাঁকা হেসে ইথার শুধালো
“জানিস এতে কি আছে?
ম্যাডি মাথা নেড়ে বলে উঠলো
“না”
“এখানে রাজকুমারী ক্যারোলিন এর বরফ জমা হৃদপিন্ড আছে,শুধু কি তাই?সেই হৃদপিন্ডে গেঁথে আছে মন্তপুত হাতিয়ার।সেই হাতিয়ার যার হবে সে হবে অমর….পুরো পৃথিবী হবে তার দাস”
কথাটি বলেই বিশ্রী ভাবে হো হো করে হেসে উঠলো ইথার।ইথার এর হাসিতে ক্রোধ জন্মালো লোভী ম্যাডির।
“এক হাতিয়ার এর মালিক দুজন কোনো ভাবেই হতে পারেনা।এর জন্য যে কোনো একজন কে অবশ্যই প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে”
#চলবে