#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৮
আরাব হওয়াতে খুশি হলো বাচ্চামহল। আবার একটা বাবু আসলো তাদের মাঝে। আট বছরের তানিশা থেকে শুরু করে তিন বছের ছোট্ট অহিও বাচ্চাটাক আদর করতে লাগলো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্যখানে। দুষ্ট আরাব এতোগুলো মানুষকে একসাথে দেখলেই ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে। তাই ঠিক হলো একসাথে দুইজন বা তিনজন যাবে আরাবের কাছে। সবায় একসাথে যওয়া যাবে না৷ এই নিয়ম ঠিক করে দিলো তানিশা। মন খারাপ হলো ছোট্ট অহি আর তোষার। তানিশা তাই তার ভাগের সময়টুকুও দিয়ে দিলো ছোট বোনদের।
ছোট্ট আরাব তখন বসতে শিখেছে। অহি তোষার সাথে তার মিল। তিনজন একসাথে খেলে। দারুণ সময় কাটে তাদের আরাবকে নিয়ে। সেদিন ছিলো ঝুম বৃষ্টি। বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বারান্দার একপাশে মাদুর বিছিয়ে খেলছে অহি, তোষা আর আরাব। আরাব মুখ নাড়িয়ে অদ্ভুত সব শব্দ উচ্চারণ করছে, অহি তোষা তাই শুনে খিলখিল করে হাসছে। তানিশা বসে ছিলে পাশেয়৷ তার দায়িত্ব ওদের দেখে রাখা। এমন সময় শোনা গেলো ছোট চাচির চিৎকার। তানিশা তাড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। তোষার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইকে দেখে রাখবে ঠিক আছে? আমি আসছি।”
তোষা মাথা নড়লো। তানিশা ছুটে গেলো নিচে। দেখলো ছোট চাচি পেট ধরে কাঁদছে। ছোট চাচা চাচিকে ধরে রেখে ফোনে কথা বলছে৷ আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে বাকিরাও। ছোট চাচিকে শান্তনা দিচ্ছে। প্রায় পনেরো মিনিট পর বাড়ির বাইরে শোনা গেলো এম্বুল্যান্সের শব্দ। দ্রুত চাচিকে কোলে নিয়ে বের হলো চাচা। সাথে তানিশার মা আর তাদের দাদুনি। সেঝ চাচাও যাবে। তানিশা এগিয়ে এসে বলল,
“মা, আমিও যাই?”
তহুরা মেয়ের দিকে তাকিয়ে সবে না বলবে তখনই নবনী আনজুম বললেন,
“যাবে? বেশ চলো।”
আর কথা বাড়ালো না কেউ। বের হলো বাড়ি থেকে। হসপিটালে পৌঁছাতে সময় লাগলো প্রায় বিশ মিনিট। তুবাকে এডমিট করা হলো। ডাক্তার এসে চেক করে জানালো নরমাল ডেলিভারি হবে। সমস্যা নেই। বাইরে অপেক্ষা করছে সবায়। ফয়জাল হাসান ফর্মালিটি সম্পূর্ণ করে চিন্তিত ভঙ্গিতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তানিশা চুপচাপ বসে রইলো। এরমাঝেই একজন নার্স তোয়লে দিয়ে প্যাচানো ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ে এলো। কোলে নিলো ফয়জাল হাসান। তার চোখে পানি। মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলেন তিনি। তানিশা চোখ বড়ো বড়ো করে দেখতে লাগলো সদ্য জন্মানো বাচ্চাটিকে। একদম পুতুলের মতো দেখতে। কি সুন্দর পাতলা ফিনফিনে লাল ঠোঁট। তানিশা এগিয়ে গেলো চাচার কাছে। আবদার করলো,
“চাচা, আমি একটু বাবুকে কোলে নেই?”
ফয়জাল হাসান ভাইঝির দিকে ফিরলেন। মৃদু হেসে বললেন,
“কোলে নিবি মা বোনকে?”
তানিশা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। ফয়জাল হাসান তাকে একটা চেয়ারে বসতে বললো। তারপর নিজের প্রথম সন্তানটিকে তানিশার কোলে দিলো। তানিশা তার ছোট দু’টি হাত দিয়ে আঁকড়ে নিলো ছোট বোনটিকে। তখন বোধহয় তানিশা জানতো না, সদ্য জন্মানো বাচ্চাটির ভরসার জায়গাটা হবে সে নিজে!
মেয়ে হওয়ার খুশিতে সপ্তাহ দুই অফিসে গেলেন না ফয়জাল হাসান। নিজেদের ব্যবসা, ভাইরাও কিছু বললো না। ছোট ভাইটা তাদের বাবা হয়েছে। খেয়াল রাখুক বউ-বাচ্চার। এই দুই সপ্তাহ ভীষণ আদরে থাকলো অধরা। ও হো, বাড়ির নতুন সদস্যের নাম দেওয়া হয়েছে অধরা আসফিন। নাম রেখেছে নবনী আনজুম এবং নাহিদ হাসান। সে যাই হোক, দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ কেটে গেলো। ফয়জাল হাসান কাজে যাওয়া শুরু করলো। তুবা যেন এরই অপেক্ষায় ছিলো। এ কয়দিন স্বামীর কারণে মেয়েটাকে দেখে রাখতে হয়েছে। এখন আর কে তাকে কি বলবে? সামনে তার পরীক্ষা, মাস্টার্সের। সে দরজা আটকে পড়তে বসলো। ছোট্ট অধরার খেয়াল রাখার মানুষের আভব ছিলো না ঠিকই কিন্তু মায়ের মতো কি কেউ হয়? অধরা মা’কেই পেলো না।
খিদে পেলে কান্না শুরু করে অধরা। তহুরা গিয়ে দরজা ধাক্কায়,
“ছোট, মেয়েটাকে খাওয়া।”
তুবা দরজা খোলে না। শুনেও শোনে না। নবনী আনজুম প্রথম কয়দিন খুব বকলেন। তুবা গায়েও লাগায় না সেসব কথা। তিনি বাধ্য হলেন ছেলেকে সব কথা বলতে। এই নিয়ে ঝগড়া হলো ফয়জাল হাসান আর তুবার। এই কথা কাটাকাটি যেন কাল হলো। অধরা তুবার কাছে হয়ে গেলো বিষ। দেখতেই পারে না ও কে। এমন ভাবে তাকায় যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে মেয়েটাকে। সারাদিন দাদি, চাচি, ভাই-বোন, কাজের মেয়েদের কোলে কোলে থাকে অধরা। রাতে বাবা আগলে রাখে। এভাবেই চলছিলো সব।
অধরার তখন দুইমাস। আরাবের ভীষণ জ্বর। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো সেঝ চাচি আর দাদি। মেঝ চাচি দুপুরবেলা ঘুমিয়েছে। কাজের মেয়েটাও সেদিন আসেনি। হঠাৎ কান্না শুরু করলো অধরা। তার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। তানিশা মা’কে ডাকতে গিয়ে দেখলো তহুরা গোসল করছে। তানিশা কিংকত্যর্ববিমূঢ় হয়ে পড়লো। কি করবে সে? এই আদুরে পুতুলটার কান্নাও বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। ডাইনিং টেবিলে ফ্লাস্কে গরম পানি ভরে রাখা। তানিশা ফ্লাস্ক থেকে ফিডারে পানি ঠাললো, দুধ গুলিয়ে নিলো। তারপর ফিডার ঠান্ডা পানিতে চুপিয়ে রাখলো কিছু সময়। বোনের মুখে ধরতেই সে শান্ত হয়ে গেলো। খেয়ে নিলো চুপচাপ। এই তো শুরু! আট বছরের তানিশার আর একটি শিশুকে বড় করে তোলার গল্প!
অন্যের সন্তানের ঘানি টানতে কার ভালো লাগে? বিরক্ত হয়ে গেলো তহুরা, মায়মুনা। আয়েশা আরাবকে সামলিয়ে সময় পায় না অধরার সব খেয়াল রাখার। নবনী আনজুম ইদানীং বাড়িতে থাকেন খুব কম। নাহিদ হাসানের হার্টের সমস্যা। হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করতেই দিন যায় তার। তবে যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, নাতনির খেয়াল রাখেন। অধরার কান্না যেন সয়ে গেলো সবার। ঘন্টার পর ঘন্টা কাঁদলেও গায়ে লাগে না কারো। কিন্তু সহ্য হলো না তানিশার। সে লেগে পরলো বোনের সব খেয়াল রাখতে। অপটু হাতে বোনকে খাওয়ায়, গোসল করায়, পটি পরিষ্কার করে দেয়। কথায় বলে না বিষাদের ছোঁয়া পেলে মানুষ জন্মলগ্ন থেকে কাঁদতে শিখে যায়৷ অপটু তানিশাও সব কাজে পটু হয়ে গেলো অনায়াসে। বাস্তবতা তাকে মা হওয়া শিখিয়ে দিলো অনায়াসে। আট বছরের ছোট তানিশার কাছে মা মা গন্ধ পেয়ে গেলো অধরাও। তানিশার কোলে থাকলে তার কান্নারা হারিয়ে যায় অতল গহ্বরে।
এর পরের দিন গুলো কারো কাছে সুন্দর তো কারো কাছে জঘন্য। তহুরা সইতে পারেন না নিজের মেয়ের অন্যের প্রতি এমন দরদ। কতো কথা শুনান! তানিশা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। তহুরার বিরক্ত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। যে জন্ম দিয়েছে সে দেখেও দেখে না৷ আর এদিকে তার মেয়ে খেটে মরছে। তানিশার ঘরে ঢুকলে সাক্ষাৎ পাওয়া যায় দুর্লভ কিছু দৃশ্যের। আট বছরের একটা মেয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। পায়ের উপর বালিশ। বালিশে শুয়ে আছে চার মাসের একটা শিশুকন্যা। আট বছরের বালিকা খানিক পরপর পা নাড়ছে। আর শিশুকন্যা আনমনে নিজের হাত মুখে দিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় শিশুকন্যা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তানিশা আলতো হাতে তাকে নিয়ে শুয়ে দেয় বিছানায়। পুরো দৃশ্যটা এতো সুন্দর আর স্নিগ্ধ! চোখের তৃষ্ণা নিবারণ হয়ে যায়।
অধরা বেড়ে উঠলো দিনদিন। সেই সাথে বড় হলো তানিশাও। অধরা বোন ন্যওটা। হবেই না কেন? বোন যে ভীষণ ভালোবাসে। এভাবেই দিন গড়ালো। তানিশার বাপের বাড়ি ছাড়ার সময় চলে এলো। এ বাড়ি ছাড়তে হবে ভেবে যতটা না মন খারাপ হলো তানিশার তারচেয়ে বেশি মন খারাপ হলো অধরাকে রেখে যেতে। সে চলে গেলে মেয়েটার খেয়াল রাখবে কে? ছোট চাচা তো দিনে বাড়ি থাকে না। অধরার চুল বেঁধে দিবে কে? এমন হাজার চিন্তা মাথায় নিয়ে এ বাড়ি ছাড়লো তানিশা। কিন্তু যার জন্য সে আট বছর বয়সে মা হওয়া শিখে গেছে তাকে ভোলা যায়? তানিশার কাছে অধরা এখনো বাচ্চা। তার বাচ্চাটা! তার সোনটার কি হয়েছে? চাচা বললো না কেন? খুব খারাপ কিছু? তানিশার কান্না পায়। গাড়ির জানালা ভেদ করে সে বাইরে তাকায়। আশ্চর্য পথ শেষ হয় না কেন? নবকুঞ্জের দেখা মিলে না কেন? তানিশা হাসফাস করে।
—————-
গাড়ি নবকুঞ্জের সামনে থামতেই তানিশা ছুট লাগালো ভিতরে। ডাইনিং এ দেখা মিললো মায়ের। তহুরা মেয়েকে দেখে অবাক হলেন। কোন সংবাদ না দিয়ে মেয়ে হঠাৎ এলো। কোন সমস্যা হলো নাকি? তহুরা ছুটে মেয়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে, কি হয়েছে? না বলে এলি!”
“এমনি এলাম মা। আসতে ইচ্ছে হলো তাই।”
তানিশার চোখ চক্রাকারে ঘুরছে। খুঁজছে ছোট চাচা বা অধরাকে। কিন্তু কারো দেখা মিললো না। সে দ্রুত মাসফিয়াকে মায়ের কোলে দিলো। তারপর সিড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। তহুরা হতবিহ্বল হয়ে মেয়েকে দেখলেন। কিছু সময় পর বুঝতে পারলেন মেয়ে কোথায় যাচ্ছে। ফুঁসলে উঠলেন তিনি। বিরবির করে বললেন,
“এই ময়ে খবর পেলো কি করে?”
#চলবে…?